বিভাগগুলি

বিজ্ঞান ও নৈতিকতা




সুব্রত গৌড়ী

“The most important human endeavour is the striving for morality in our actions. Our inner balance and even our very existence depend on it. Only morality in our actions can give beauty and dignity to life.” - কথাটি বলেছিলেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। নৈতিকতাকে তিনি আমাদের জীবনের সৌন্দর্য ও মর্যাদার সাথে অবিচ্ছেদ্য ভাবে যুক্ত করেছিলেন। আর নৈতিকতার এই বিষয়টি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি গত প্রশ্নের সাথেও যুক্ত। মানুষ যে কারণে মানুষ, অর্থাৎ তার সামাজিক সত্ত্বার সাথে নৈতিকতার প্রশ্নটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সমাজের একজন দায়িত্বশীল সদস্য হিসাবে একজন মানুষের কী করণীয় তার দ্বারাই নৈতিকতার বিষয়টি নির্ধারিত হয়। তাই সমস্ত কাজের সাথেই নৈতিকতার বিষয়টি যুক্ত থাকে। বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এর প্রাসঙ্গিকতা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সমাজ বিকাশের প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত থাকে।

আমরা পরে আলোচনা করে দেখাব যে, মানুষের জীবনকে টিকিয়ে রাখতে এবং স্বাচ্ছন্দ্য আনতেই বিজ্ঞানের উদ্ভব; মানুষের প্রয়োজনেই বিজ্ঞান এবং সেই প্রয়োজন মেটানোর মধ্যেই তার চরম সার্থকতা। আয়োনীয় (Ionian) এবং তার কিছু পরে আণবিক মতবাদে বিশ্বাসী এপিকিউরিয় (Epicurian) দার্শনিকেরা এই সত্য প্রথম উপলব্ধি করেন। কিন্তু এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, মানুষের প্রয়োজন বলতে শুধু ব্যবহারিক প্রয়োজনকেই বোঝানো হয়নি। যে প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষের অবস্থান, সেই প্রাকৃতিক জানা, অর্থাৎ তার সুনির্দিষ্ট নিয়মকে জানা এবং সেই আহরিত জ্ঞানের ভিত্তিতে পরিবেশকে প্রভাবিত করা ও পরিবর্তিত করার প্রয়োজনকেও বোঝানো হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞানের অগ্রগতির পিছনে এই চিন্তাই চালিকা শক্তি হিসাবে কাজ করেছে।

কিন্তু বিজ্ঞান সম্পর্কে এটাই একমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি নয়। একদল বিজ্ঞানী মনে করেন বিজ্ঞান বিশুদ্ধ মননশীলতারই এক প্রকাশ মাত্র। কৌতূহল এর প্রধান অনুপ্রেরণা। যেমন আর্টের জন্যই আর্ট, তেমনি বিজ্ঞানের জন্যই বিজ্ঞান। তা কোনও উদ্দেশ্য বা সামাজিক স্বার্থ প্রণোদিত নয়। এর প্রয়োগের ফলে মানব সমাজ যদি উপকৃত হয়ে থাকে তবে তা নিতান্তই গৌণ। এরকম উপকার না হলেও বিজ্ঞানের সার্থকতা ক্ষুণ্ণ হয় না। এডিংটন, হোয়াইট হেড, ডীন ইন্‌জ, বিশপ অফ বার্মিংহাম প্রভৃতি বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা বিজ্ঞানকে বিশুদ্ধ মননশীলতার পর্যায়ে ফেলে সমাজের সাথে এর সম্পর্কের প্রশ্নকে একেবারে অস্বীকার না করলেও সম্পূর্ণ অবান্তর মনে করেন। তাঁদের মত ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি, জন্ম মৃত্যুর রহস্য প্রভৃতি গূঢ় প্রশ্নের ও জটিল রহস্যের কিনারা করাই বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য।

অধ্যাপক জে. ডি. বার্নাল এর সমালোচনা করে দেখিয়েছেন, ‘ব্রহ্মাণ্ড, জন্ম-মৃত্যু, সৃষ্টি রহস্য প্রভৃতি দুর্জেয় বিষয়ের গবেষণা যদি বিজ্ঞানের একমাত্র লক্ষ্য হত, তাহলে বিজ্ঞান বলে যে বস্তুকে আমরা জানি তার কোনওদিনই উদ্ভব হত না। বিজ্ঞানের ইতিহাসের প্রতি সামান্য মনোযোগ দিলেই দেখা যাবে যে, নিতান্ত পার্থিব প্রয়োজনের প্রেরণার দ্বারাই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সমূহ সম্ভবপর হয়েছে’।

এটা বাস্তব যে, মানুষের চিরন্তন কৌতুহল ও উদ্ভাবনী মননশীলতা বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন 'করেছে। কিন্তু সমাজের সঠিক প্রয়োজনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তা কখনও সম্ভব হয়নি। তাই বিজ্ঞানের সাথে সমাজের পারস্পরিক সম্পর্কের আলোচনা দিয়েই আমরা আলোচ্য নিবন্ধটি শুরু করব।

বিজ্ঞানের সাথে সমাজের পারস্পরিক সম্পর্ক

বিজ্ঞানের ইতিহাস আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাব যে, তা মানব ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনাক্রম নয়। একেবারে আদিপর্বে মানুষ যখন বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত তখন থেকেই তার মধ্যে তার চারপাশের চলমান জগৎ সম্পর্কে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে দু'টো কাজ তাকে করতে হয়েছে- খাদ্য সংগ্রহ এবং বিরুদ্ধ প্রাকৃতিক শক্তির মোকাবিলা। প্রথমটির জন্য তার চারপাশের বস্তু জগৎকে তাকে বুঝতে হয়েছে, তাদের গুণাগুণ (Properties) যাচাই করতে হয়েছে। যেমন, জঙ্গলের কোন ফলটি খাবার যোগ্য, কোনটি নয়, কোনটি এতই বিষাক্ত যে তা মৃত্যুর কারণ হতে পারে - তা বুঝতে হয়েছে, জানতে হয়েছে। তার জন্য বহু মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। শিকার করার প্রয়োজনেই তাকে পাথরের অস্ত্র বানাতে হয়েছে। তার জন্য তাকে বুঝতে হয়েছে, কোন পাথরকে ঘষলে ছুঁচালো বা ধারালো করা যাবে। এইভাবেই সে তার চারপাশের বস্তুজগতের গুণাগুণ সম্পর্কে একটা ধারণা গড়ে তুলতে পেরেছে এবং তার ভিত্তিতেই বস্তুজগতকে তাদের বাঁচার প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পেরেছে। আর দ্বিতীয়টির জন্য সে বিরুদ্ধ প্রাকৃতিক শক্তিকে বশ করবার কল্পনা করেছে এবং সেই উদ্দেশ্যে নানা কৌশল অবলম্বন করেছে, যার একটা অন্যতম মাধ্যম ছিল মন্ত্রতন্ত্র। এটা ছিল আদিম মানুষের বিজ্ঞান। এখন আমরা বিজ্ঞান বলতে যা বুঝি, অর্থাৎ পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে বস্তুর অন্তর্নিহিত নিয়ম আবিষ্কার ও বস্তুর পরিবর্তনকে নিয়ন্ত্রণ করতে তার প্রয়োগ- এর সাথে আদিম মানুষের বিজ্ঞানের কোনও মিলই ছিল না। প্রকৃত অর্থে তা বিজ্ঞান নয়। তবু তাকে আমরা বিজ্ঞান বলছি এই কারণে যে, বিজ্ঞানের সাহায্যে আজ আমরা যেমন বস্তুর শক্তি, বস্তুর রহস্য, বস্তুজগতের বিভিন্ন নিয়ম, চলার ভঙ্গি- এগুলো জানছি, তেমন করেই আদিম মানুষ সেদিন ঐ বস্তুকেই জানতে চেয়েছে, বশীভূত করতে চেয়েছে মন্ত্রতন্ত্রের দ্বারা।

এই পর্বে মানুষ প্রকৃতিতে সহজলভ্য নানা বস্তুকে তার জীবন ধারণের জন্য ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। যেমন, শিকারের জন্য পাথরের হাতিয়ার বানিয়েছে, নির্মাণযন্ত্র (tool) বানিয়েছে। নির্মাণযন্ত্র প্রথমে তৈরি হত পাথর কুঁদে, তারপর ঘষে, সবশেষে ধাতু পেটাই ও ঢালাই করে।

এইভাবে উৎপাদনের প্রয়োজনে এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত হয়ে প্রযুক্তিগত উন্নতি সামাজিক প্রয়োজনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত হয়েই এগোতে থাকে। আদিম সমাজের যে প্রত্নতাত্মিক নিদর্শন পাওয়া যায় তাতে এমন কিছু কিছু আধা সম্পূর্ণ পাথরের তৈরি হাতিয়ার পাওয়া গেছে যার গায়ে নির্মীয়মান হাতিয়ারটির ছক আগে থেকে পরিষ্কার করে খোদাই করা আছে। প্রথমদিকে মানুষের কল্পনাশক্তির এই অসম্পূর্ণ প্রকাশ ধীরে ধীরে পূর্ণতা লাভ করেছে এবং এই অভিজ্ঞতাই পরবর্তীকালে নকশা ও পরিকল্পনার রূপ নেয়। অর্থাৎ বিজ্ঞানের যা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সেই পরীক্ষা নির্ভর পদ্ধতির সূত্রপাত এখান থেকেই। আসল জিনিসটাকে একেবারে পূর্ণমাত্রায় তৈরি করতে যাওয়ার আগে তার মডেল বা রেখাচিত্র এঁকে নিয়ে সেই জিনিসটাকে তৈরি করার নানারকম সম্ভাব্য উপায় হাতে কলমে খতিয়ে দেখার প্রয়াস থেকেই এর উদ্ভব।

এই মূল পদ্ধতি, অর্থাৎ উৎপাদনের প্রয়োজনে নানা ধরণের প্রযুক্তিগত উপায় উদ্ভাবন, হাতে কলমে খতিয়ে দেখার মধ্য দিয়ে তার বিকাশ এবং বস্তুর অন্তর্নিহিত নিয়ম বোঝার প্রচেষ্টা - এই ধারাতেই সমাজের উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিকাশের সাথে যুক্ত হয়েই বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঘটেছে।

এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, উৎপাদন প্রক্রিয়া বা মানুষের বস্তুগত চাহিদা পূরণের জন্য বিজ্ঞানের এই বিকাশ শুধু প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রেই হয়েছে এমন নয়, অগ্রগতি ঘটেছে তার চিন্তার ক্ষেত্রেও। অনুমান নির্ভর চিন্তার পরিবর্তে পরীক্ষা নির্ভর বা যুক্তি নির্ভর চিন্তার স্ফুরণ ঘটেছে ধীরে ধীরে। বস্তুত চিন্তার বিকাশ ছাড়া, অর্থাৎ যুক্তিভিক্তিক চিন্তা পদ্ধতির বিকাশ ছাড়া প্রযুক্তির বিকাশও সম্ভব নয়। একটা আরেকটার পরিপূরক। তাই বিজ্ঞানের ইতিহাসে দেখা গেছে এমন বহু আবিষ্কার হয়েছে, যার সাথে উৎপাদন ব্যবস্থার প্রত্যক্ষ যোগ নেই, কিন্তু বস্তু জগতের আভ্যন্তরীণ নিয়ম আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে পরোক্ষভাবে তা উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে বিজ্ঞানচর্চার বহু নিদর্শন আমরা পাই। এর মধ্যে গ্রিক সভ্যতায় বিজ্ঞানচর্চার একটা সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যায়। গ্রিক সভ্যতায় জ্ঞানচর্চার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল তার বুদ্ধিগ্রাহ্যতা এবং বাস্তবানুগত্যের মধ্যে। অর্থাৎ যুক্তি সহযোগে বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করা ও সর্বজনীন অভিজ্ঞতার নিরিখে সত্য যাচাই করার ক্ষমতা ছিল এর বৈশিষ্ট্য। তবে এই যাচাই-এর বিষয়টা হাতে কলমে পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপর ভিত্তি করে করবার প্রশ্ন তখনও আসেনি, মূলত খালি চোখে দেখা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যাচাই করার বিষয়টি সীমাবদ্ধ ছিল। গ্রিক মননশীলতার আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, তাঁরা তাঁদের intuition দিয়ে পারিপার্শ্বিক জগৎ সম্পর্কে বহু সত্য ধারনায় উপনীত হতে পেরেছিলেন। আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সত্য যাচাই-এর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিটি তখনও আবিষ্কার না হওয়ায় বহু প্রশ্নে ভুল ধারণারও সৃষ্টি হয়েছিল, যা পরবর্তীকালে আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে সংশোধিত হয়েছে। পিথাগোরাস, এপিকিউরাস, ডেমোক্রিটাস, হেরাকলিটাস-এর মতো বহু ব্যক্তি বিজ্ঞানের সাধনায় বহু উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন - একথা সত্য, কিন্তু অ্যারিস্টটল এদের মধ্যে ছিলেন অনন্য। যুক্তিশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা, জীবনবিজ্ঞান, মানবীবিদ্যা - এসব ক্ষেত্রে তিনি বিরাট অবদান রেখে গেছেন। তিনিই ছিলেন প্রথম দিকপাল বিশ্ববিদ্যাবিশারদ। প্রকৃতি ও মানব জীবনের যে সব দিক নিয়ে তখন আগ্রহ ছিল, তার প্রত্যেকটি সম্বন্ধেই তিনি কিছু না কিছু বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং এই কাজটা তিনি সুশৃঙ্খলভাবে করতে পেরেছিলেন। এ’জন্যই পরবর্তীকালে বহুদিন পর্যন্ত যারাই জ্ঞান চর্চা করেছেন, তাদের উপর অ্যারিস্টটলের গভীর প্রভাব পড়েছিল। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে হাতে কলমে পরীক্ষা নিরীক্ষার ভিত্তিতে জ্ঞানচর্চার পদ্ধতি অনুসরণ না করার ফলে বহু বিষয়েই তাঁর চিন্তা সঠিক ছিল না। আবার পরবর্তী প্রায় 2 হাজার বছর ধরে তার চিন্তার দ্বারা বহু চিন্তাশীল মানুষ প্রভাবিত ছিলেন বলে এই ভুল চিন্তাগুলোও বহুদিন পর্যন্ত টিকে ছিল।

এরপর মধ্যযুগে বিজ্ঞানচর্চায় ভাটা পড়ে। তাই এই যুগকে। অন্ধকারময় যুগ বলা হয়। তবে এই সময়ও বিজ্ঞানচর্চা একেবারে থেমে থাকেনি। বিজ্ঞানচর্চা পুরোপুরি থেমে থাকার উপায়ও ছিল না। কারণ এই যুগে উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিকাশ ঢিমেতালে হলেও তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। এর সাথে সম্পর্কিত হয়ে বিজ্ঞানেরও কিছুটা বিকাশ হয়েছে। এই সময় বিশেষ করে অ্যালকেমি, ধাতু নিষ্কাশন, জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতের চর্চা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতিও ঘটেছে।

রেনেসাঁসের যুগে জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে, অতীতের কোনও পরিবর্তনের সাথে যার কোন তুলনাই চলে না। এই সময়েই, অর্থাৎ মূলতঃ সতেরো শতকে এসে বিজ্ঞান নিজস্ব মর্যাদা লাভ করেছে। ওই সময় থেকেই তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব লাভের প্রক্রিয়ার সূত্রপাত ঘটে।

বিজ্ঞান স্বতন্ত্র অস্তিত্ব লাভ করেছে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে সংযুক্ত হয়েই

বিজ্ঞান স্বতন্ত্র অস্তিত্ব লাভ করার অর্থ এ নয় যে, সমাজ থেকে, উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে তার বিকাশ সম্ভব হয়েছে। বরং ঘটনাটা ঠিক উল্টো। রেনেসাঁর যুগে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটেছে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সংযোগের ভিত্তিতেই।

এই যুগে দু’দিক থেকেই বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঘটেছে - চিন্তা প্রক্রিয়া এবং প্রযুক্তি। এই অগ্রগতি সমসাময়িক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘটেনি। আমরা জানি, এই যুগটা ছিল সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে ভেঙ্গে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা পত্তনের যুগ। এই যুগে পুঁজিবাদ ও বিজ্ঞান বিকাশ লাভ করেছে দু'টি পরস্পর সম্পর্কিত ধারায় - একটি হল অর্থনৈতিক এবং অন্যটি হল রাজনৈতিক। এ সম্পর্ক এতই ঘনিষ্ঠ যে কার্য-কারণের সরল ছকে ফেলে তাকে দেখানো যেতে পারে না। অবশ্য এটুকু নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে যে এই পর্বের গোড়ার দিকে অর্থনৈতিক ঘটনাবলীর গুরুত্বই ছিল মুখ্য। যে পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদ বিকাশ লাভ করে, সেই পরিস্থিতিই পরীক্ষা নির্ভর বিজ্ঞানের উদ্ভবকে সম্ভবপর এবং আবশ্যিক করে তোলে। পরবর্তী পর্যায়ে শিল্প বিপ্লবের সময়কালে বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতি ঘটে। কারণ সমাজের অন্যতম উৎপাদিকা শক্তি হিসাবে এই পর্বেই বিজ্ঞানের স্থানটি পাকা হয়ে যায়।

প্রথম দিকে পুঁজিবাদ ছিল প্রাণবন্ত এবং বর্ধিষ্ণু। ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্রের শিকলগুলোকে তা ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছিল। ম্যানুফ্যাকচার এবং ব্যবসা-বাণিজ্য তখন ক্রমশ বিকশিত হচ্ছিল, ছড়িয়ে পড়ছিল নিত্যনতুন এলাকায়। অর্থনৈতিক অগ্রগতির নানান প্রকৌশলের আরও উন্নতি ঘটতে থাকল - বিশেষ করে আকর খনন, সমরায়োজন এবং নৌচালনার ক্ষেত্রে। এর ফলে আবার নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব ঘটলো। বিজ্ঞান সে সব সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আরও উন্নত হতে থাকল।

সতেরো শতকের শুরুতে নবীন উদ্যমী বুর্জোয়াশ্রেণী বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে সাহায্য করতে লাগল। তারাই পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের ভিত্তি রচনা করল। এর আগে দুঃসাহসী বণিকদের যেমন সংগঠিত করা হয়েছিল, তেমনি করেই এই নবীন বিজ্ঞানীদের সংগঠিত করা হল। সতেরো শতক শেষ হওয়ার আগেই বলবিজ্ঞান এবং জ্যোর্তিবিজ্ঞান-এর মূল প্রশ্নগুলির সমাধানের বাস্তব সম্ভাবনা তৈরি হল। প্রকৌশল এবং প্রকৃতি বিষয়ক সমস্যার বিশ্লেষণ ও সমাধানে নবোদ্ভূত পরীক্ষামূলক ও গাণিতিক পদ্ধতিকে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করার মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানের সত্যিকারের বিজয়তোরণ রচিত হল।

এতক্ষণের আলোচনায় আমরা দেখলাম যে, আধুনিক বিজ্ঞানের উদ্ভব ও অগ্রগতির সাথে সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বা উৎপাদন ব্যবস্থার একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আবার সমাজের সামগ্রিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও বিজ্ঞান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, বিশেষতঃ এই পর্বে বিজ্ঞানের ভূমিকাটা ছিল যথার্থই বৈপ্লবিক। প্রাচীন গ্রিকদের কাছ থেকে আহরিত মননগত অনুমানের ভিত্তিতে জ্ঞানের যে বিশাল কাঠামোটি গড়ে উঠেছিল, তা ইসলামি ও খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিকদের হাতে পড়ে অকাট্য আপ্তবাক্যের এক সমষ্টিতে পরিণত হয়েছিল। সেই অচলায়তনটি এই বিপ্লবের ধাক্কায় চুরমার হয়ে গেল। তার জায়গা নিল সম্পূর্ণ নতুন এক চিন্তা প্রণালী; সহজ ভাষায় যাকে আমরা বলি যুক্তিবাদ। পুরানো সামন্তী সমাজের শত সহস্র বছর ধরে লালিত অন্ধতা, কূপমণ্ডুকতা, কুসংস্কার, যা মানুষের চিন্তাকে স্থবির করেছিল, তাকে সজোরে ধাক্কা দিয়েছে এই নতুন চিন্তা প্রক্রিয়া। পুরানো চিন্তা প্রক্রিয়া ছিল সামন্তী-সমাজকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। যুক্তিভিত্তিক যে নতুন চিন্তা প্রক্রিয়া বিজ্ঞান নিয়ে এল, তা মানুষের মনন থেকে অন্ধতা দূর করতে সচেষ্ট হল এবং পুরানো সমাজকে ভাঙ্গার চেতনায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করল। গড়ে উঠল নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা পুঁজিবাদী সমাজ।

বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে রেনেসাঁস নিয়ে এল একটা নতুন নৈতিকতা, তার আধার হল সত্য নিষ্ঠা। যেকোনও ধরণের পূর্ব-ধারণাকে বর্জন করে বাস্তব অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানকেই একমাত্র সত্য বলে গ্রহণ করা এবং তার প্রতিষ্ঠার জন্য আপসহীন ভাবে সংগ্রাম করার মানসিকতা। তাতে যদি হাজার বছরের বিশ্বাস পাল্টাতে হয় তাতেও কোনও ক্ষতি নেই। বিশ্বাসের ভিত্তিতে নয়, বিজ্ঞানকে দাঁড় করাতে হবে যুক্তির ভিত্তিতে। সঠিক যুক্তি করতে পারার মধ্য দিয়েই সত্যে উপনীত হওয়া সম্ভব।

এই সময় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে আর একটা নতুন বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়েছে। গবেষণার পরিধি ও ব্যাপ্তি বেড়ে যাওয়ায় এককভাবে নয়, একত্রে গবেষণার প্রয়োজন দেখা দিল। তাই বিজ্ঞানচর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হল। পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে বিজ্ঞানচর্চার পথ প্রশস্ত হল। একই সাথে বিজ্ঞান নিয়ে এল অবজেক্টিভিটি (objectivity)-র ধারণা। অর্থাৎ সত্য অবস্থান করে মানুষের চেতনা নিরপেক্ষভাবে। তাই কোনও মনগড়া ধারণার ভিত্তিতে সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। তার জন্য বাস্তব পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। এই নতুন নৈতিকতা সৃষ্টির পেছনে সে যুগের বহু বিজ্ঞান সাধকেরই অবদান আছে। কিন্তু তার মধ্যেও বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় গ্যালিলিও, ফ্রান্সিস বেকন ও রেনে দেকার্তের নাম। নিজে বিজ্ঞান গবেষণায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন না করলেও বিজ্ঞান যে সত্যের সন্ধান দিয়েছে সমাজে তাকে প্রতিষ্ঠা করবার প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন জিওর্দানো ব্রুনো, তা সত্য সাধনায় মানুষকে বহু যুগ ধরে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবে।

বিজ্ঞানের ইতিহাস আলোচনা করা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। শুধু এটুকু উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বিজ্ঞানের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাব কার্যক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সামগ্রিক অগ্রগতির মূলে যে ঘটনাটির গুরুত্ব সর্বাধিক তা হল - বাস্তব প্রয়োজনের দ্বারা নির্ধারিত সমস্যাবলীর সমাধানের প্রয়াস। পূর্ববর্তী বৈজ্ঞানিক ভাবধারা থেকে উদ্ভূত সমস্যাবলীর চর্চাও বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঘটিয়েছে ঠিকই, কিন্তু বাস্তব প্রয়োজনের ভূমিকা চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করেছে। একেকটি বিশেষ সময়কালে সাধারণতঃ এক গুচ্ছ সমস্যা মানুষকে ভাবিয়ে তোলে। সেই সমস্যাবলীর সমাধান করতে গিয়ে বিজ্ঞানের চর্চা হয় নিবিড়ভাবে এবং তারই ফলশ্রুতিতে আবির্ভাব হয় নতুন চিন্তা বা সূত্রাবলীর। যেমন বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানের জন্য বেদী নির্মাণের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা থেকেই বৈদিক যুগে জ্যামিতি ও বীজগণিতের উদ্ভব হয়। প্রাচীন গ্রিসের ডেল্ ফিতে ঘনাকৃতি বেদির আয়তন দ্বিগুন করার সমাধান করতে গিয়ে ঘনমূল (cube root) নির্ণয় করার প্রয়োজন হয়। দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় করার সমস্যা সমাধান করার প্রয়োজন থেকেই নিউটনের সূত্রাবলীর আবিষ্কার হয়। ফ্রান্সে রেশমগুটির অসুখ সারাতে গিয়ে পাস্তুর রোগের জীবাণুতত্ত্বের ধারণাটিতে উপনীত হন।

বিজ্ঞানের সাথে সমাজের এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের অভিব্যক্তি দেখা যায় আর এক দিক থেকে। দেখা গেছে, যে সব পর্বে অর্থনৈতিক ও প্রয়োগগত কর্মকাণ্ডর জোয়ার আসে, বিজ্ঞানও ঠিক সেই সব পর্বেই উচ্ছ্বসিত ভাবে বিকাশ লাভ করে। যে ভৌগোলিক পথ ধরে বিজ্ঞান বিকশিত হয়ে ওঠে, ঠিক সেই পথেই বাণিজ্য ও উৎপাদন শিল্পও বিকাশ লাভ করেছে। সেই ভৌগোলিক পথটি এইরকম - মিশর ও মেসোপটেমিয়া থেকে গ্রিস, ইসলামি স্পেন থেকে রেনেসাঁস যুগের ইতালি, সেখান থেকে ‘লো কান্ট্রিজ’ (বেলজিয়াম, লুক্সেমবুর্গ ও হল্যান্ড) হয়ে ফ্রান্স এবং শিল্প বিপ্লবের যুগের স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ড।

নতুন কোনও উদীয়মান শ্রেণি যখন ক্ষমতা দখল করতে এগিয়ে আসে তখন উৎপাদন সম্পর্ক অতি দ্রুত বদলাতে থাকে। সেই নতুন শ্রেণি তখন উৎপাদনের উন্নতিসাধনের ওপর বিশেষভাবে জোর দেয়, কেননা সেই উন্নতিই তার সম্পদ আর ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে। এরকম পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানচর্চার কদর খুব বেড়ে যায়। কিন্তু সেই শ্রেণি একবার ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে এবং অন্য কোনও প্রতিপক্ষশ্রেণির অভ্যুত্থানকে প্রতিহত করবার মতো ক্ষমতা অর্জন করে ফেললে, তখন গতানুগতিকতাকে প্রশ্রয় দিলেই তার লাভ।

পুঁজিবাদের ক্ষয়িষ্ণু যুগে বিজ্ঞানচর্চা ও তার নৈতিকতা

অতীতের সমস্ত সমাজব্যবস্থার মতোই পুঁজিবাদী সমাজও কালের নিয়মে এক সময় তার বৈপ্লবিক ভূমিকা রক্ষা করতে পারল না, উনবিংশ শতাব্দীর শেষ অধ্যায় থেকে শুরু হল তার অবক্ষয়। বিংশ শতাব্দীতে এসে এই অবক্ষয় চূড়ান্ত রূপ নিল - জন্ম নিল সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদী শোষণের আরও নির্মম রূপ হিসাবে। একদিন যে বুর্জোয়ারা ছিল বিজ্ঞানচর্চার সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক, সেই বুর্জোয়ারাই হয়ে পড়ল বিজ্ঞানের অগ্রগতির পথে প্রধান অন্তরায়।

পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে পুঁজিবাদী-উৎপাদন ব্যবস্থা ক্রমাগত উন্নত থেকে উন্নততর হতে থাকে। এই পর্বের শেষ পর্যায়ে শিল্প বিপ্লব বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি ঘটায় উৎপাদনের নতুন নতুন উপায় উদ্ভাবনের প্রয়োজনে একদিকে যেমন নিত্য নতুন প্রকৌশলের জন্ম হয়, তেমনি বস্তুজগতের অন্তর্নিহিত নিয়ম আবিষ্কারের তাগিদ থেকে প্রকৃতি বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে। উৎপাদিকা শক্তি এবং বিজ্ঞান একে অপরকে সাহায্য করে সমান্তরাল ভাবে এগিয়ে চলেছে।

কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি অধিক মুনাফা হওয়ার জন্য একসময় তা ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ল। কারণ শ্রমিককে তাঁর ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেই মালিকের লাভ। তাই যত দিন যেতে থাকে ততই কমতে থাকে সাধারণ মানুষের কেনবার ক্ষমতা, সংকুচিত হতে থাকে বাজার। ফলে আগের মতো পুঁজিপতিরা উৎপাদিকা শক্তিকে কাজে লাগাতে পারে না, কলকারখানাগুলো প্রায়ই তার installed capacity কে কাজে লাগাতে পারে না, তা অলস হয়ে থাকে। স্বাভাবিক কারণেই এই পরিস্থিতিতে নতুন নতুন প্রকৌশলের উদ্ভাবন, পুজিপতিদের কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে থাকে। প্রকৌশলের উদ্ভাবন যতটুকু ঘটে তা মূলত যুদ্ধবিগ্রহকে কেন্দ্র করে - সমস্ত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রই তার বাজার সম্প্রসারণের প্রয়োজনে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয় বা অর্থনীতির সামরিকীকরণের প্রয়োজনে যুদ্ধ-যুদ্ধ পরিবেশ তৈরি করতে ব্যস্ত থাকে। মানুষের জীবন রক্ষা বা জীবনকে স্বচ্ছল করে দেওয়ার প্রয়োজনে এখন আর বিজ্ঞানের ব্যবহার হয় না, মানুষের শ্রমের বোঝা বাড়ানো ও বেকারত্ব সৃষ্টির কাজে বা যুদ্ধের মাধ্যমে মানুষের জীবনকে ধ্বংস করার জন্যই তা ব্যবহৃত হচ্ছে। পাশাপাশি যে পুঁজিবাদ একদিন যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানভিত্তিক মননের চর্চাকে উৎসাহিত করেছিল, সেই পুঁজিবাদই এখন অন্ধতা, গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও মায়াবাদের চর্চাকে উৎসাহিত করছে।

পুঁজিবাদী অর্থনীতির বর্তমান পর্যায়ে এর বাইরে বিজ্ঞানচর্চার কোনও সুযোগ নেই। পুঁজিবাদের ক্ষয়িষ্ণু যুগে অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি করে বেকারি। নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ফলে যন্ত্রই বহু মানুষের কাজ করে দেয়। ফলে দৃশ্যত নতুন প্রযুক্তি বেকারের সংখ্যা আরও বাড়াতে থাকে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নিজেকে আড়াল করে যন্ত্রকেই তার শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করার কৌশল নেয়। যে বিজ্ঞানের কল্যাণে গড়ে উঠেছে সভ্যতা, সেই বিজ্ঞানকেই অভিশাপ হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করে।

এখানে একটা বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, শাসকশ্রেণি চাইলেই সে তার মতো করে বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে পুরোপুরি রুদ্ধ করে দিতে পারে না। আবার পুঁজিবাদের ক্ষয়িষ্ণু যুগের শুরুর দিকে বিজ্ঞানের বিকাশের পথে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কিছুটা অন্তরায় সৃষ্টি করলেও বিজ্ঞানচর্চার উপর রাষ্ট্রের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ফলে বিজ্ঞানীরা তাঁদের মতো করে স্বাধীনভাবে গবেষণা করতে পারতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই পরিবেশ কিছুটা হলেও অক্ষুন্ন ছিল। কিন্তু জার্মানিতে হিটলার ও ইতালিতে মুসোলিনী যখন ফ্যাসিবাদের জন্ম দিল, তখন থেকেই এসে গেল একটা নতুন বৈশিষ্ট্য - বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইতালির দু'জন প্রথম সারির বিজ্ঞানী সেদেশে জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিদের উপর যে নিষ্ঠুর নির্যাতন চলছিল, তা বন্ধ করার ব্যবস্থা করার জন্য ইতালির মন্ত্রী লিনর রোক্কোকে চিঠি লেখার অনুরোধ জানিয়ে আইনস্টাইনকে একটি চিঠি লেখেন। তার ভিত্তিতে তিনি। রোক্কোকে চিঠি লিখে বলেন, '...দৈনন্দিন জীবনের প্রত্যক্ষ লাভালাভের সম্পর্ক রহিত বৈজ্ঞানিক সাত্যের অনুসন্ধিৎসা প্রত্যেক সরকার কর্তৃক পবিত্র কর্তব্য বলে বিবেচিত হওয়া বিধেয় এবং সকলের মঙ্গলের জন্য সত্যের খাঁটি সেবকদের শান্তিতে থাকতে দেওয়া উচিত। নিঃসন্দেহে ইতালিয়ান রাষ্ট্রে হিত এবং বিশ্বের কাছে তার মর্যাদা এতে বৃদ্ধি পাবে।' কিন্তু দুঃখের হলেও সত্য যে, ইতালির ফ্যাসিস্ট প্রশাসন আইনস্টাইনের এই আবেদনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমস্ত পুঁজিবাদী দেশেও এ জিনিস ঘটতে থাকল। তখন থেকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে একদিকে বিজ্ঞানীকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে এবং অন্যদিকে রাষ্ট্রের বা তার পরিচালক পুঁজিপতি শ্রেণির নির্দেশমতো গবেষণা চালানোর জন্য বিজ্ঞানীদের বাধ্য করা হচ্ছে।

একদল বিজ্ঞানী বাধ্য সেবকের মতো রাষ্ট্রের নির্দেশমতো এমনকী মারণাস্ত্র তৈরির কাজেও নিজেদের নিয়োজিত করছেন। এবং এভাবেই ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও বৈভবের মধ্য দিয়ে জীবন-যাপনের সুযোগ করে নিচ্ছেন। তাতে নৈতিকতা থাকল কি গেল তা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। আবার উন্নত নৈতিকতার বলে বলীয়ান কেউ কেউ আছেন, যাঁরা বিজ্ঞানকে মানবকল্যাণের বাইরে ব্যবহৃত করার কাজে কোনভাবেই সাহায্য করেন না, বরং বিরোধিতাই করেন। তাতে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে হয়তো টান পড়ে, কিন্তু তার মধ্য দিয়ে নৈতিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসাবে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত হন।

এ’প্রসঙ্গে ড. সুশীলকুমার মুখার্জীর নাম বিশেষভাবে করতে হয়। আজীবন তিনি রেনেশাঁসের উজ্জ্বল নৈতিকতাকে বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অনুসরণ করে এসেছেন। ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের মুখপত্র 'এভরিম্যান সায়েন্স'-এর দীর্ঘ 30 বছরকাল প্রথমে একমাত্র সম্পাদক ও পরে প্রধান সম্পাদক ছিলেন ড. মুখার্জী। প্রধান সম্পাদক হিসাবে 2000 সালে Vol. XXXV No. 2 সংখ্যায় সম্পাদকীয়তে তিনি লেখেন যে, কেমন করে উচ্চ ফলনের নামে দেশের জৈব বৈচিত্র্যকে এবং জমির উর্বরা শক্তিকে ধ্বংস করে মুনাফা লুটছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এবং এক্ষেত্রে তিনি মনসান্টো কোম্পানির নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। এটি প্রকাশের পর কায়েমী স্বার্থান্বেষীদের প্রবল চাপের সৃষ্টি হয় এবং কর্তৃপক্ষ ড. মুখার্জীকে বার্ধক্যের অজুহাতে সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়। কিন্তু তিনি তাঁর বক্তব্য থেকে সরে আসেননি। শুধু তাই নয়, নিজের জীবনে বিজ্ঞানচর্চাকে তিনি আজীবন একই সমাজমুখী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছিলেন। বস্তুতঃ সমাজ ও মানবকল্যাণের বাইরে বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণার অন্য কোনও উদ্দেশ্য তাঁর কাছে ছিল না। তাই ভৌত রসায়নে M.Sc ডিগ্রী লাভের পর যখন ভবিষ্যৎ গবেষণার প্রশ্ন এসেছে, তখন তিনি মৃত্তিকা বিজ্ঞানকেই বেছে নিয়েছিলেন। কারণ তিনি বুঝেছিলেন, স্বাধীনোত্তর ভারতে কোটি কোটি মানুষের মুখে যদি দুবেলা দু'মুঠো অন্নের সংস্থান করতে হয়, তাহলে কৃষি উৎপাদন প্রচুর পরিমাণে বাড়ানো দরকার। আর তার জন্য কৃষি বিজ্ঞান, বিশেষ করে মৃত্তিকা বিজ্ঞানের গবেষণা অত্যন্ত জরুরী।

বলা বাহুল্য, এই জাতের বিজ্ঞানী আজকের দিনে অত্যন্ত বিরল। তাই বিজ্ঞানচর্চা মানেই তা মানুষের জন্য বা সমাজের জন্য- আজ আর এভাবে বলার কোন উপায় নেই। তাই নতুন করে ‘বিজ্ঞানচর্চা কেন করব’ বা 'বিজ্ঞান আশির্বাদ না অভিশাপ'- এইসব প্রশ্ন পাদ প্রদীপের আলোয় উঠে এসেছে।

ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থান ও বিজ্ঞানের ইতিহাস

স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞানের নৈতিকতার প্রশ্নটি প্রথম ব্যাপকভাবে আলোচিত হল বিগত শতাব্দীর তিরিশের দশকে- ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থানের সময়। জার্মানিতে হিটলার এবং ইতালিতে মুসোলিনী বিজ্ঞান গবেষণা এবং বিজ্ঞানীদের উপর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার চেষ্টা করলে বেশিরভাগ বিজ্ঞানী এর বিরোধিতা করেন। জার্মানি তখন বিজ্ঞান গবেষণা, বিশেষ করে পরমাণু গবেষণার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল এবং বহু প্রথম সারির বিজ্ঞানী জার্মানিতে থেকেই গবেষণা করতেন। বিজ্ঞান গবেষণায় সরাসরি হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে বহু বিজ্ঞানীই হয় বিতাড়িত হলেন, না হয় জার্মানি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। আর যারা রয়ে গেলেন তাদের উপর তৈরি হল রাষ্ট্রের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ। ইতালিতেও একই ঘটনা ঘটেছিল। তিরিশের দশকে নীলস্ বোর পরিচালিত কোপেনহেগেন ইনস্টিটিউট-এ বিজ্ঞানীরা মিলিত হতেন। শুরুর দিকে আলোচনা হত মূলতঃ বিজ্ঞান গবেষণার বিভিন্ন দিক নিয়ে, রাজনৈতিক বিষয় প্রায় থাকতই না বলা চলে। কিন্তু হিটলার প্রশাসন কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও আপেক্ষিকতাবাদের গবেষণা নিষিদ্ধ করার পর, বিশেষ করে বেশ কয়েকজন জার্মান পদার্থবিদকে গ্রেফতার করার পর বিজ্ঞানীরাও সরাসরি রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা শুরু করলেন।

তাঁদের মধ্যে এই বোধ তৈরি হল যে, বিজ্ঞান গবেষণার ভবিষ্যৎ শুধুমাত্র গবেষণাগারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের দ্বারাও বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। তাই সেসব বিষয়েও বিজ্ঞানীদের ওয়াকিবহাল থাকা দরকার।

বিজ্ঞানীদের এই ভাবনা শুধুমাত্র জার্মানি বা ইতালিতে সীমাবদ্ধ ছিল না, অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীরাও এই ভাবনার শরিক ছিলেন। ধীরে ধীরে International scientific community গড়ে ওঠে, যারা বিজ্ঞানের উপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। বিজ্ঞান গবেষণাকে কীভাবে মানব সমাজকে ধ্বংসের কাজে ব্যবহারের ভূমিকা থেকে সরিয়ে রাখা যায়, তা নিয়ে সকলে ভাবিত ছিলেন।

এদের মধ্যে একজন হলেন লিও জীলার্ড (Leo-Szillard), যিনি আমেরিকায় প্রবাসী হয়েছিলেন এবং ফ্যাসিস্টদের ভূমিকাকে বাধা দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী তাঁদের সহকর্মীদের আবেদন করেন যে, তাঁরা তাঁদের এমন কোনও গবেষণাপত্র প্রকাশ করবেন না, যা নাৎসীরা অপব্যবহার করতে পারে। সেই সময় অনেকেই এর গুরুত্ব বোঝেননি। কিন্তু হিটলার চেকশ্লোভাকিয়া দখল করার পর পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নেয়। কারণ চেকশ্লোভাকিয়া ছিল ইউরেনিয়াম খনিজের অন্যতম প্রধান উৎস এবং ওই দেশ দখল করার পর হিটলার সেখান থেকে ইউরেনিয়াম খনিজ রপ্তানী বন্ধ করে দিলেন। বিজ্ঞানীরা প্রমাদ গুণলেন। তখন জীলার্ডের (Szillard) কথা অনেকেই গ্রহণ করতে শুরু করলেন। এর কিছুদিন পরেই লিও জীলার্ড, ইউগেন পল উইগনার (Eugene Paul Wigner) এবং এডওয়ার্ড টেলর (Edward Teller) অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের কাছে যান। তাঁরা তাঁকে অনুরোধ করেন যে, তিনি যেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টের কাছে যান। তাঁকে যেন তিনি পরমাণু শক্তির সম্ভাবনার কথা বুঝিয়ে বলেন এবং এও বলেন যে, জার্মানিতে এ ধরনের গবেষণা চলছে। আইনস্টাইন 1939 সালের আগস্ট মাসে রুজভেল্টকে এই মর্মে চিঠি লেখেন। 1940 সালের শুরুর দিকেই পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য মিলিটারীর নিয়ন্ত্রণে মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমারের নেতৃত্বে লস আলামোসে ল্যাবরেটারী তৈরি হয়, যা মানহাটন প্রোজেক্ট নামে প্রসিদ্ধ। 1945 সালের 16 জুলাই পরমাণু বোমা পরীক্ষামূলকভাবে ফাটানো হয়। সামরিক ও রাজনৈতিক নেতারা এবং বিজ্ঞানীরা এই নতুন অস্ত্রের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা স্বচক্ষে পরখ করেন।

কিন্তু ততদিনে ইতিহাসের গতি অন্য ধারায় প্রবাহিত হতে শুরু করেছে। পরমাণু অস্ত্র তৈরির আগেই জার্মানি সোভিয়েত লালফৌজের কাছে পরাজিত হয়েছে। ইউরোপে শান্তি স্থাপিত হয়েছে। পূর্ব প্রান্তে জাপানও পরাজয়ের মুখে। তখন আমেরিকাই বিশ্বের একমাত্র দেশ যার হাতে পরমাণু বোমা রয়েছে। এই সময় জীলার্ড পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানীদের সংগঠিত করেন। নবীন পদার্থবিদরা প্রায় সকলেই এই প্রচেষ্টায় সামিল হয়েছিলেন। ফলে মার্কিন সরকার একটি অন্তবর্তী কমিটি গঠন করতে বাধ্য হন। এতে ছিলেন, পরমাণু বোমা তৈরির গবেষণায় নিযুক্ত তিনজন বিজ্ঞানী, চারজন মিলিটারী অফিসার এবং ফের্মি, এ.এইচ কম্পটন ও ই.ও লরেন্স- এই তিনজন বিজ্ঞানী। এই কমিটি পরমাণু বোমা তৈরির পক্ষে রায় দেয়। এই পরিস্থিতিতে 1945 সালের এপ্রিল মাসে জীলার্ডের অনুরোধে আইনস্টাইন মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেন, যাতে যুদ্ধে পারমাণবিক বোমা ব্যবহার না করা হয়। পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রোজেক্টে নিযুক্ত একদল বিজ্ঞানী প্রস্তাব দেন যে, পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা করা হোক জনসমক্ষে, যেখানে বিভিন্ন দেশের পর্যবেক্ষকরা থাকবেন। সেখানে বিজ্ঞানীরা তাঁদের আবিষ্কার এবং এর তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করুন। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে শত্রু শিবিরকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হোক। তাতে রাজি না হলে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করার স্থান ও সময় আগে থেকে ঘোষণা করা হোক। যাতে সাধারণ মানুষ ও পশু-পক্ষীকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে ফেলা যায়। কিন্তু তখন বিজ্ঞানীদের হাত থেকে বল বেরিয়ে গেছে। পরমাণু বোমা তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা, কিন্তু তার দখল চলে গেল মিলিটারী ও রাজনৈতিক নেতাদের, এক কথায় রাষ্ট্র শক্তি হাতে। বিজ্ঞানীদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে 1945 সালের 6 এবং 9 আগস্ট জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকি শহরে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করা হল - লক্ষাধিক মানুষ মারা গেল, পঙ্গু হল প্রায় সমসংখ্যক মানুষ, একটা প্রজন্ম নয়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। যে পাইলট এই বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন, তিনি এর বীভৎসতা দেখে সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যান। নাৎসী জার্মানির আগ্রাসন থেকে বিশ্ববাসীকে রক্ষা করার পবিত্র আকাঙ্ক্ষা থেকে বিজ্ঞানীরা যে গবেষণার সূচনা করলেন, সফলও হলেন, তার পরিসমাপ্তি ঘটল লক্ষাধিক নিরপরাধ, নিরস্ত্র ও অসহায় মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। মানুষের চিন্তার সর্বশ্রেষ্ঠ ফসল মানবতার বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হল এবং মানবসভ্যতার অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিল।

বিজ্ঞানীদের প্রতিক্রিয়া: বিজ্ঞানের নৈতিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

এডওয়ার্ড টেলরের মতো কোনও কোনও বিজ্ঞানী পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপকে সমর্থন করলেও বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই এর বিরোধিতা করেন। নিজের গবেষণার স্বরূপ প্রত্যক্ষ করার জন্য শুরুতে বোমা নিক্ষেপের পক্ষে থাকলেও রবার্ট ওপেনহাইমার এর বীভৎসতা দেখে অনুতাপে দগ্ধ হয়েছিলেন। বহু বিজ্ঞানীই এর প্রতিবাদ করেছিলেন। আইনস্টাইন বলেছিলেন যে, “আমি যদি নতুন করে জীবন শুরু করতে পারতাম, তবে বিজ্ঞানচর্চা করতাম না, হতাম মিস্ত্রি কিংবা ছুতোর”। জাপানি পদার্থবিদ হিদেকি ইউকাওয়ার কাছে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে ক্ষমা চেয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, “জার্মানরা অ্যাটোম বোমা তৈরির ব্যাপারে সফল হতে পারবে না জানলে আমি পরমাণু বোমার ব্যাপারে কিছুই করতাম না”। পাশ্চাত্যের বহু বিজ্ঞানী নিজেদের অপরাধী বলে মনে করতেন। হাইজেনবার্গ তাঁর The part and the whole গ্রন্থে বিজ্ঞানী অটো হান-এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে এক মর্মস্পর্শী বিবরণ দিয়েছেন। 1938 সালে অটো হান ও এফ. স্ট্রসম্যান যৌথভাবে ইউরেনিয়াম ফিশান (অর্থাৎ ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসের ভাঙন) আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কার পরমাণু বোমার প্রযুক্তিতে মূল ভূমিকা পালন করে। 1945 সালে হান, হাইজেনবার্গ এবং আরো কয়েকজন জার্মান বিজ্ঞানীকে ব্রিটিশ সৈন্যরা যুদ্ধবন্দী হিসাবে নিয়ে যায়। সহজেই বোঝা যায়, এই বিজ্ঞানীরা চাইলে পরমাণু বোমা তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারতেন। কিন্তু তা হিটলার প্রশাসনের হাতে গেলে মানব সমাজ ধ্বংসের হতে দেননি। নৈতিকতার এ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। স্বভাবতঃই তাঁরা কেউই পরমাণু বোমা তৈরিতে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না বা মার্কিন শাসকদের প্রভাবিত করবার কোনও সুযোগও তাদের ছিল না। তবু যখন হিরোসিমা- নাগাসাকির ঘটনার কথা শুনলেন, তখন হাইজেনবার্গ যন্ত্রণায় ছটফট করেছিলেন এবং আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘25 বছর ধরে আমি নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এর যে গবেষণা করেছি, তা শেষ পর্যন্ত লক্ষাধিক মানুষের হত্যার কারণ হল’। তিনি তাঁর উপরে উল্লিখিত গ্রন্থে অটো হানের প্রতিক্রিয়ার একটি ছবি দিয়েছেন এইভাবে- "অটো হানের আঘাত ছিল সবচেয়ে বেশি। ইউরেনিয়াম ফিশান তাঁর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আবিষ্কার এবং পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রযুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর পরিসমাপ্তি হল একটা পুরো শহর এবং তার পুরো জনগোষ্ঠির ধ্বংসের মর্মান্তিক পরিণতির মধ্য দিয়ে - যে জনসাধারণ ছিল সম্পূর্ণ নিরস্ত্র এবং যারা যুদ্ধের সাথে কোনভাবেই যুক্ত ছিল না। মানসিকভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ও মর্মাহত হান সম্পূর্ণ একাকী ঘরে চলে যান এবং আমরা সকলেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম যে, তিনি সাংঘাতিক কিছু না করে বসেন।" এই সময় থেকেই বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে নৈতিকতার প্রশ্নটি গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হতে থাকে। একজন বিজ্ঞানী কি শুধু বিজ্ঞানের জন্যই বিজ্ঞানচর্চা করবেন? নাকি সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই হবে তাঁর বিজ্ঞান চর্চা? এ প্রসঙ্গে হাইজেনবার্গ-এর মতামতকে বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে। তিনি মনে করতেন, একজন বিজ্ঞানী তাঁর পেশাগত কার্যাবলী সামগ্রিক সামাজিক- ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিচার করবেন শুধু তাই নয়, তাঁর আবিষ্কারকে মানবসমাজের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর যেকোনও প্রচেষ্টাকেই তিনি সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করারও চেষ্টা করবেন। হিরোসীমা ও নাগাসাকির পর বিজ্ঞানীদের মধ্যে যে অপরাধবোধ তৈরি হয়েছিল তা বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা বিজ্ঞান এবং সমাজের সাথে তার সম্পর্কের বিষয়টি নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছে।

এই অপরাধবোধ বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেছে। বিজ্ঞানীদের মধ্যে এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে যে, তাদের গবেষণা শুধু যে সমাজের শুভাশুভের সাথে যুক্ত তাই নয়, মানবসভ্যতার অস্তিত্বের সাথেও যুক্ত। প্রগতিশীল চিন্তাযুক্ত বিজ্ঞানীদের উপর এই আঘাত তাদেরকে মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতার প্রশ্নটি নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে। এখন তাঁরা সরাসরি জনমত সংগঠিত করতেও প্রণোদিত হলেন। যেমন নীলস বোর তাঁর 'A challenge to civilization' প্রবন্ধে বলেছেন- "The advance of physical science which has made it possible to release vast amounts of energy through atomic disintegration has initiated a veritable revolution of human resources. presenting civilisation with a most serious chal- lenge. The formidable means of destruction which have come within reach of man will obviously constitute a mortal menace to civilisation unless, in due time, universal agreement can be obtained about appropriate measures to prevent any un- warranted use of the new energy resources.”

বাস্তবে নীলস বোর এবং তাঁর ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীদের কাছে হিরোসিমা ও নাগাসাকি যে প্রবল আঘাত হিসাবে এসেছিল, তার ফলে তাঁরা অনুভব করেছিলেন যে, পরমাণু অস্ত্রের শক্তি ও ক্ষমতাকে কমানোর প্রশ্নে বিশ্বের বিজ্ঞানীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া উচিত। এই মনোভাবের ভিত্তিতেই 'মিলিটারিজম্-এর গঠনমূলক বিকল্প' গড়ে তোলার লক্ষ্যকে সামনে রেখে 1949 সালে Society for Social Responsibility in science নামে একটি সংস্থা গঠন করা হয়। 1969 সালে এই সোসাইটি ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সেনার সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের দাবী জানায় এবং সেখানে defoliant ব্যবহারের বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ টিম পাঠায়। এর মধ্যেই তৈরি হয়েছে আরও শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমা। এর প্রয়োগের বিরুদ্ধে জোরালো ভাষায় প্রতিবাদ করেন বিজ্ঞানী বেথে (Bethe) 1950 সালে। অন্যান্য বিজ্ঞানীরাও এতে সামিল হন। 1950-এর দশকে Scientists Institute of Public Information (SIPI) গঠিত হয় তেজস্ক্রিয় দুষণের ফলে উদ্ভূত সমস্যা মোকাবিলার উদ্দেশ্যে, যদিও পরবর্তীকালে অন্যান্য পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা নিয়েও তারা মাথা ঘামায়।

এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখনীয়। 1955 সালের 31 জানুয়ারি ফরাসী পদার্থবিদ ফ্রেডেরিক জুলিয়ট কুরী World Federation of Scientific Workers-এর তৎকালীন সভাপতি ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলকে এই মর্মে একটি চিঠি লেখেন যে, পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনাকে নির্মূল করার জন্য বিজ্ঞানীদের একটা যুক্ত ঘোষণাপত্র থাকা দরকার। জুলিয়ট কুরী কমিউনিস্ট ছিলেন। তিনি প্রস্তাব দেন যে, এ ধরণের একটি গবেষণাপত্রে প্রথিতযশা বিজ্ঞানীদের স্বাক্ষর করা উচিত, তাদের দার্শনিক মতাদর্শগত পার্থক্য যাই থাক না কেন। রাসেল সহমত হন। রাসেল একটি ঘোষণাপত্র রচনা করেন, যেখানে পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক দেশের বিজ্ঞানীরা স্বাক্ষর দেন। প্রথম স্বাক্ষরকারী ছিলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন (তাঁর মৃত্যুর দু'দিন আগে)। এছাড়া ফ্রেডেরিক জুলিয়ট কুরী, ম্যাক্স বন, লিনাস পাউলিং সহ আরও বহু বিজ্ঞানী স্বাক্ষর করেন। 1955 সালের ৭ জুলাই রাসেল এটিকে সর্বসমক্ষে নিয়ে আসেন এবং এটা রাসেল-আইনস্টাইন ম্যানিফেসটো হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। এটাই ছিল শান্তি ও নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্যে পাগওয়াশ আন্দোলনের সূচনা।

মার্কিন বিজ্ঞানীদের সংগঠন Scientists and Engineers for Social and Political Action (SESPA) গঠিত হয় 1969 সালে মূলতঃ পদার্থবিদদের উদ্যোগে। এই সংগঠন শুধু যে বিজ্ঞানীদের নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তাই নয়, এমনকী আমেরিকার পুঁজিবাদের খোলাখুলি এ সমালোচনা করেছে। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাকে সংহত করার প্রয়োজনে বিজ্ঞানকে ব্যবহারের বিরোধিতা করেছে এই সংগঠন। এই পথেই বিজ্ঞানীদের সামাজিক কাজকর্ম বাড়তে থাকে এবং ক্রমাগত বাস্তব সম্মত ও সংগঠিত রূপ নিতে থাকে। অচিরেই তার সুফল পাওয়া যায়। ক্রমাগত বেশি সংখ্যায় পরমাণু বিজ্ঞানী শান্তি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। পাশাপাশি মানবতা ও সমাজ প্রগতির স্বার্থে বিজ্ঞানকে ব্যবহারের জন্য সংগ্রাম চলতে থাকে।

পরিবেশ রক্ষা ও বিজ্ঞানের নৈতিকতা

মার্কস বলেছিলেন, 'Man lives on nature-means that nature is his body, with which he must remain in continuous interchange if he is not to die.' কথাটির তাৎপর্য গভীর ও সুদুরপ্রসারী। মানুষের উৎপত্তি প্রকৃতির বিবর্তনের পথেই এবং প্রকৃতির সাথে ঘনিষ্ঠ সংযোগের ভিত্তিতেই মানুষের বিকাশ। প্রকৃতির পরিবর্তন হয় নির্দিষ্ট নিয়মেই এবং বিজ্ঞানের সাহায্যে মানুষ সেই নিয়মকে ঠিক ঠিকভাবে বুঝে তাকে কাজে লাগিয়েছে এবং গড়ে তুলেছে সভ্যতা। কিন্তু পুঁজিবাদী সভ্যতা যেহেতু গড়েই উঠেছে অধিক মুনাফা লাভের উদগ্র আকাঙ্ক্ষাকে ভিত্তি করে, তাই পুঁজিবাদ যত উন্নত হয়েছে, ততই শুরু হয়েছে অবক্ষয়। মানুষের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি যতটুকু দায়বদ্ধতা তার প্রথম দিকে ছিল, অবক্ষয়ের যুগে তা নিঃশেষিত হতে শুরু হয়েছে, এবং ততই নির্মম হয়েছে তার শোষণ; সর্বোচ্চ মুনাফার উদগ্র বাসনায় সে প্রকৃতিকে লুণ্ঠন করেছে। প্রকৃতি মানুষের বাসযোগ্য থাকল কিনা তাতে তার কিছু যায় আসে না। কিন্তু প্রকৃতিকে যথেষ্টভাবে লুণ্ঠন করলে, তার ভারসাম্য নষ্ট হয়, সৃষ্টি হয় নানা অভাবিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়। যেমন করে সাম্প্রতিককালে উত্তরাখণ্ডে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটল। বিগত 100 বছরে পৃথিবীর energy potential বেড়েছে হাজার গুণ। কিন্তু একইসাথে প্রাকৃতিক সম্পদ হয়েছে নিঃশেষিত এবং দূষণের মাত্রা বেড়েছে সহনশীলতার অনেক বেশি। বিশ্ব উষ্ণায়নের সমস্যা, আজ সারা বিশ্বে একটা ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে - মেরু অঞ্চলের বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা বাড়িয়ে দিয়েছে। যার ফলে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকার মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে। তাছাড়া প্রতিবছরই সাইক্লোন-অতিবৃষ্টি মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। অথচ দূষণ রোধে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো উদাসীন। দূষণ রোধের কোন ব্যবস্থা না করেই চলছে কলকারখানা। বিভিন্ন দেশে পরিবেশ রক্ষার জন্য মোট যে খরচ বরাদ্দ হয়, তার তুলনায় মিলটারি বাজেটে বরাদ্দ হয় বহুগুণ বেশি। এভাবেই প্রকৃতির সম্পদ জীবনরক্ষার পরিবর্তে জীবন নিশ্চিহ্ন করবার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর চেয়ে অনৈতিক কাজ আর কী হতে পারে? যেসব বিজ্ঞানীরা এই ধরনের কাজে নিয়োজিত তারা কোন নৈতিকতার পরিচয় দিচ্ছেন?

সমাজতন্ত্রে বিজ্ঞানচর্চা ও নৈতিকতা

সমাজতান্ত্রিক সমাজে এমনভাবে বিজ্ঞানচর্চা হতে পারে না, যার ফলে মানব সমাজ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়। কারণ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সম্পূর্ণ বিপরীত এক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে। অধিক মুনাফা অর্জনের পুঁজিবাদী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পরিবর্তে মানুষের প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদন হয়। তাই পুঁজিবাদের বিপরীতে সমাজতন্ত্রে নতুন নতুন যন্ত্রের উদ্ভাবনে বেকার বাহিনী সৃষ্টি হয় না। বরং এক একটা নতুন যন্ত্রের আবিষ্কারের সাথে সাথে শ্রমশক্তির উৎপাদনশীলতা বাড়ে, নিছক বস্তুগত উৎপাদনে একজন শ্রমিককে সময় কম দিতে হয়। ফলে মানুষ তার মননশীলতার অন্যান্য ক্ষেত্রে বেশি সময় ব্যয় করতে পারে। তাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এক একটা নতুন আবিষ্কার মানুষকে যথার্থই পূর্ণাঙ্গ বিকশিত মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। তাই সমাজতন্ত্রে উৎপাদনে কখনো সংকট সৃষ্টি হয় না - কলকারখানা বন্ধ হয় না বা তার installed capacity কে অলস করে রাখতে হয় না। এই জন্যই সমাজতন্ত্রে উৎপাদনের নিত্য নতুন প্রকৌশল উদ্ভাবনের প্রয়োজনে বিজ্ঞানের ক্রমাগত অগ্রগতি ঘটাতে হয়। বিজ্ঞান থেমে থাকে না, থেমে থাকতে পারে না। তাই দেখা গেছে অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া একটা দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নে তিরিশ, চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি ঘটেছে। যতদিন সেখানে সমাজতন্ত্র টিকে ছিল, ততদিন এই ধারা অব্যাহত ছিল। ব্যক্তি সত্ত্বার সাথে সমাজসত্ত্বার পারস্পরিক সম্পর্কটা এমন ছিল, এমনভাবে মানুষের মননকে গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল যে, সমাজ কল্যাণের বাইরে বা এর সাথে সম্পর্করহিত হয়ে বিজ্ঞানচর্চার কথা বিজ্ঞানীদের মনেও কখনো উদয় হয়নি বা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রও কখনো তার পরিকল্পনায় এভাবে ভাবেনি। বাজারে কৃত্রিম তেজী ভাব তৈরির জন্য যুদ্ধাস্ত্র তৈরির কাজে সমাজতন্ত্রে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়নি। তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল সর্বদাই যুদ্ধের বিরুদ্ধে ও শান্তির পক্ষে।

সমাজতান্ত্রিক সমাজে বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষণার ভার তুলে নেয় জনসমর্থনপুষ্ট সরকারের বিভিন্ন বিভাগ। কারখানা বা খামারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ল্যাবরেটরী থেকে শুরু করে একেবারে অ্যাকাডেমি-পরিষদ পর্যন্ত সর্বত্রই এই প্রক্রিয়া চালু থাকে। এর ফলে পৃষ্ঠপোষণার চরিত্রে এক আমূল পরিবর্তন আসে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের মুনাফা ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিজ্ঞান সম্পর্কে এক মানব হিতৈষী ও সুদূর প্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। বস্তুত সে দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করাটা তার পক্ষে একেবারে আবশ্যিক, কারণ তা না হলে যথার্থই জনকল্যাণমুখী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। কাজেই বিজ্ঞানীদের কাজ সবসময়ই মূল্যবান বলে স্বীকৃতি লাভ করে। স্বভাবতই বিজ্ঞানীদের ভরণপোষণ ও তাঁদের কাজে সহায়তা দানের কাজটা জাতীয় ও স্থানীয় রাজস্বভাণ্ডারের প্রধান কাজ বলে স্বীকৃত হয়। এর বিনিময়ে দাবি করা হয় যে, বিজ্ঞানীরা তাঁদের সামাজিক দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন হবেন, অর্থাৎ উৎকৃষ্টতর সমাজ নির্মাণেরও পরিকল্পনায় তাঁরা সামিল হবেন, এমনভাবে তাঁদের কাজকে নির্দেশিত করবেন, যাতে দীর্ঘমেয়াদি এবং আশু, উভয় দিক থেকেই ফল দেয়। স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞানীদের অনৈতিক কাজ করবার সম্ভাবনা কম থাকে। একমাত্র যারা ক্ষমতাচ্যুত পুঁজিপতিশ্রেণির এজেন্ট হিসাবে কাজ করার কথা ভাববেন, তাদের পক্ষেই সমাজতান্ত্রিক সমাজে অনৈতিক কাজ করা সম্ভব।

বিজ্ঞানীর নৈতিকতা: সামাজিক দায়বদ্ধতা দৃষ্টিকোণ থেকে

‘বিজ্ঞানীর নৈতিকতা’- কথাটা শুনলে স্ববিরোধী মনে হতে পারে। একজন বিজ্ঞানী কি অনৈতিক কাজ করতে পারেন? কারণ বিজ্ঞান তো সমাজের জন্য, মানুষের জন্য। তাহলে তা তো সব সময়ই নৈতিকতার আধারেই গড়ে উঠবে। কথাটার মধ্যে সত্যতা আছে। বাস্তবে এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতেই বিজ্ঞান এগিয়েছে এবং সমাজও এগিয়েছে। কিন্তু আমরা আগেই দেখিয়েছি, সমাজ যখন চূড়ান্ত অবক্ষয়ের যুগে পৌঁছায়, বিজ্ঞান যখন এই অবক্ষয়ি সমাজকে ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার জন্য মানুষকে প্রণোদিত করে, তখন স্বার্থান্বেষী শ্রেণি তাকে আটকাতে চায়। তাই একদিকে যেমন বিজ্ঞানের স্বাভাবিক অগ্রগতি থমকে যায়, আবার অন্যদিকে ওই স্বার্থান্বেষী শ্রেণি বিজ্ঞানকে তাদের হীনস্বার্থে অপব্যবহার করে। সমাজের সামগ্রিক অবক্ষয়ের প্রভাবে একদল বিজ্ঞানীও তাদের হীন ব্যক্তিগত স্বার্থে এদের দ্বারা ব্যবহৃত হন। জেনে বা না জেনে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে যান। তাই বিজ্ঞানীর নৈতিকতার প্রশ্নটি আজ এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে আলোচিত হচ্ছে। এর সাথে সম্পর্কিত হয়েই আর একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন এসে যায়। তা হল- বিজ্ঞানচর্চা করব কেন?

আজকের দিনে যারা বিজ্ঞানচর্চায় নিযুক্ত তাদের মধ্যে অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বিজ্ঞানচর্চার প্রধান চালিকা শক্তি হল, ব্যক্তিগত কেরিয়ার, ডিগ্রী অর্জন করা, ভাল চাকরি পাওয়া, কাগজে নাম বের করা ইত্যাদি। মানব কল্যাণে বা প্রকৃতির রহস্য উদ্ঘাটনের অদম্য আকাঙ্ক্ষা থেকে বিজ্ঞান চর্চা - এ জিনিস খুব কমই চোখে পড়ে। তাই দেখা যায়, একদল বিজ্ঞানী অতি সহজেই মারণাস্ত্র নির্মাণের কাজে রাষ্ট্রের হাতে ক্রীড়নক হয়ে যান বা বিজ্ঞানের গবেষণায় যারা নিযুক্ত তাদের মধ্যে একদল কত কম আয়াসে, অন্যের তথ্য চুরি করে বা পুরানো গবেষণাপত্র থেকে কপি করে নিজের গবেষণাপত্র তৈরি করছেন এবং তারা ডিগ্রী পেয়ে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে এমনকী তারা কোনও বিবেকযন্ত্রণাও অনুভব করেন না। অথচ যুগে যুগে যাঁরা বিজ্ঞানচর্চা করেছেন সমাজের জন্য মানব কল্যাণের কথা ভেবে, তাঁদের জীবন ও সংগ্রাম অন্য কথা বলে।

এ প্রসঙ্গে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কথা দিয়েই শুরু করি। তিনি বলেছিলেন- “আমি সারা জীবন রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যয়ন, অধ্যাপনা ও গবেষণা লইয়াই কাটাইয়াছি; এ ব্রতের মূল সূত্রই হইল সত্যের অনুসন্ধান- খাঁটি নিছক ষোল আনা সত্যের অনুসন্ধান এবং তাহার প্রয়োগ; - এখানে পাই পয়সারও ভেজাল চলে না, এবং মিথ্যার সহিত এতটুকুও সন্ধি করা যায় না। চিরদিন সত্যের অনুসন্ধানে নিজেকে ব্যাপৃত রাখিয়াছিলাম বলিয়াই বোধহয় সত্য স্বরূপের উপাসনাকে জীবনের শ্রেষ্ঠ সার্থকতা বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিলাম এবং দীর্ঘকাল সেই সত্য স্বরূপের ধ্যান, ধারণা এবং উপাসনাকেই জীবনের ধ্রুবতারা রূপে লক্ষ্য রাখিয়া পথ চলিয়াছি”।

তিনি আরও বলেছিলেন, “লোকে অনুযোগ করিয়া বলেন যে সারা জীবন test tube নাড়াচাড়া করিয়াই ত জীবন কাটাইলেন - কিন্তু শেষ বয়সে আবার খদ্দর, সংকটত্রাণ, দেশি কলকারখানা স্থাপনের উদ্যোগ আয়োজন এবং বাঙালী ছেলেদের মাথায় ডাঙ্গল মারিয়া তাহাদিগকে জাগাইয়া তুলিবার বাতিক চাগাইল কেন?”

বস্তুত আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের জীবনটাই এর উত্তর। তিনি কখনোই ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কিছু করেননি। তাঁর বিজ্ঞান সাধনাও স্বদেশপ্রেমের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে। তাই যখনই ডাক এসেছে, ল্যাবরেটারী ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন - সে বন্যাত্রাণেই হোক, বা স্বাধীনতা আন্দোলনেই হোক। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র শুধু যে নিজে বিজ্ঞানচর্চাকে সামাজিক দায়বদ্ধতার দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছিলেন তা নয়, তিনি তাঁর ছাত্রদের মধ্যেও তা সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন। এঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি তাঁর শিক্ষকের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে নিজেকে কেবলমাত্র ল্যাবরেটারীর চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখেননি। তিনি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু গঠিত ন্যাশানাল প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর প্রথম সংসদ গঠিত হলে তিনি তার সদস্য নির্বাচিত হন। বিজ্ঞানকে মানুষের সার্বিক কল্যাণে ব্যবহার করার জন্য তিনি নানা পরিকল্পনা রচনা করেন। তার মধ্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণে তাঁর পরিকল্পনা আজও অবিস্মরণীয় হয়ে আছে - যদিও সরকার তাঁর পরিকল্পনাকে পুরোপুরি কার্যকরি করেনি।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই কেন্দ্রীয় সরকার তিন সদস্যের Atomic Energy Committee গঠন করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ছাড়া বাকি দুজন সদস্য ছিলেন মেঘনাদ সাহা ও হোমি ভাবা। এই কমিটি সুপারিশ করে যে, পরমাণু গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে চালু রাখতে হবে, এই গবেষণা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সমন্বয়ের ভিত্তিতে করতে হবে এবং শান্তিপূর্ণ কাজে পারমাণবিক শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পার্লামেন্টে Atomic Energy Act, 1948 আনা হয়, যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল পরমাণু গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে রাখা হবে না, তা সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের পরমাণু শক্তি দপ্তরের অধীনে আনা হবে এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে তা সরাসরি দায়বদ্ধ থাকবে। এই গবেষণা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য গোপন রাখা হবে। হোমি ভাবা এই বিলটিকে সমর্থন করলেও মেঘনাদ সাহা এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যদি ফ্রান্সে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে এই গবেষণা চলতে পারে এবং পরমাণু গবেষণাকে পর্দার আড়ালে রাখার প্রয়োজন না হয়, তাহলে আমাদের দেশে তা করা হচ্ছে কোন উদ্দেশ্যে। তিনি 1954 সালে পার্লামেন্টে এই মর্মে যে ভাষণ দেন তাতে এই বিলকে বিরোধিতা করার জন্য সমস্ত সদস্যদের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন। কারণ তিনি বুঝেছিলেন যে, পরমাণু গবেষণা পর্দার আড়ালে এবং রাষ্ট্রের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে হলে তা মানব সমজের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে। এই ঘটনায় মেঘনাদ সাহা একজন বিজ্ঞানীর নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে, সে ব্যাপারে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।

অন্য একটি আলোচনায় তিনি বলেছিলেন, “এই বিষয়টি সর্বদাই স্মরণে রাখতে হবে যে, বিজ্ঞান ততক্ষণই গুরুত্বপূর্ণ যতক্ষণ তা সংস্কৃতির পরিপূরক হয় এবং মানব প্রগতির স্বার্থে কাজ করে”।

একজন বিজ্ঞানীর নৈতিক দায়বদ্ধতার আর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন আলফ্রেড নোবেল। প্রাক পারমাণবিক যুগে ডিনামাইট আবিস্কার করে তার বিস্ফোরণ ক্ষমতা দেখেই শিউরে উঠেছিলেন তিনি। মানবজাতির বিরুদ্ধে এর প্রয়োগের আশঙ্কায় ছটফট করেছিলেন। গভীর উদ্বেগ ও যন্ত্রণাবোধ থেকে তিনি এক অভিনব প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি তাঁর সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে 'নোবেল পুরস্কার তহবিল' গঠন করেছিলেন। ঘোষণা করেছিলেন যে, এই তহবিল থেকে প্রতিবছর সেই সব কৃতি বিজ্ঞানীদের পুরস্কৃত করা হবে যাঁদের কাজ মানবজাতির কল্যাণের পরিপূরক শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার বলে বিবেচিত হবে। উদ্দেশ্য ছিল, সবচেয়ে প্রতিভাবান বিজ্ঞানীদের সামরিক-অমানবিক গবেষণার পরিবর্তে মানবকল্যাণমুখী গবেষণায় নিয়োজিত থাকার প্রেরণাকে শুধু নৈতিক দিক থেকেই সমর্থন করা নয়, আর্থিক দিক থেকেও সহযোগিতা করা। নোবেলের এই কাজের পিছনে যে মূল্যবোধ কাজ করেছে, তা থাকলে একজন বিজ্ঞানী মহান হয়ে ওঠেন এবং এই মূল্যবোধই বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীকে পথ দেখায়।

সমস্ত বড় বিজ্ঞানীই বিজ্ঞানচর্চাকে এই মূল্যবোধের ভিত্তিতেই দেখেছেন। কিন্তু যাঁর নাম না করলে এ আলোচনা অসমাপ্ত থেকে যাবে, তিনি হলেন মাদাম মারি কুরি। তিনি ছিলেন নৈতিকতার মূর্ত প্রতীক। তাঁর জীবনী আলোচনা করার অবকাশ এখানে নেই। তবে দু'টি ঘটনা এখানে উল্লেখ করতে চাই। সকলেই জানেন, পিয়ের কুরির সাথে যৌথভাবে তিনি রেডিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন। অচিরেই জানা গেল ক্যানসার রোগ নিরাময়ে রেডিয়ামের কার্যকারিতা এবং তা থেকে ব্যবসায়িক সাফল্য লাভের সম্ভাবনা।

এক রবিবার সকালে ডাকপিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি চিঠি দিয়ে গেছে। চিঠিখানা পড়ে পিয়ের তাঁর স্ত্রী মারিকে বললেন, ‘আমাদের রেডিয়ামের বিষয়ে আরও একটু ফলাও করে ব্যাখ্যা করার সময় এসেছে। এখন এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে ব্যবসায়িক দিকে এর প্রচুর বিস্তৃতির সম্ভাবনা আছে। সম্প্রতি ম্যালিগনান্ট টিউমার চিকিৎসায় সাফল্য আমাদের এই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। কয়েক বছরের মধ্যে সারা দুনিয়া রেডিয়াম চাইবে। এইমাত্র বাফেলো থেকে যে চিঠিটা পেলাম, তাতে আমেরিকার কয়েকজন শিল্প-মালিক রেডিয়াম সম্বন্ধে আমাদের কাছে জানতে চেয়েছেন’। এর পর বললেন, ‘এখন আমাদের দুটো পথের মধ্যে একটা বেছে নিতে হবে। গবেষণার ফলাফল আর বিশ্লেষণের নিয়মাবলী সমস্তই আমাদের ব্যাখ্যা করে লিখতে হবে। কিংবা আমরা নিজেদেরকে রেডিয়ামের আবিষ্কারক হিসাবে স্বত্ব (পেটেন্ট) জারি করতে পারি। সেক্ষেত্রে পিচ-ব্লেন্ডের শোধন-পদ্ধতির বিস্তারিত বর্ণনা প্রকাশ করার আগে সর্বসত্ব বজায় রেখে, পৃথিবীর সামনে রেডিয়ামের ওপর আমাদের দাবি জাহির করতে হবে’।

মারি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, 'তা সম্ভব নয়! সে যে বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির বিরোধী কাজ হবে!'

পিয়ের-এর গম্ভীর মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি বললেন, ‘আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত হাল্কাভাবে নেওয়া উচিত নয়।... আমাদের একটি মেয়ে আছে, আরও ছেলে মেয়ে হবে। এই স্বত্ব সংরক্ষণের ফলে তাদের এবং আমাদের পক্ষেও প্রচুর অর্থসম্পদ, আরামের নিশ্চিন্ততা ও কর্মক্লাষ্ট জীবনের সুখ নিশ্চিত করতে পারবে’।

তারপর মৃদু হেসে আজীবন স্বপ্নের কথাটাও তুললেন, 'আমাদের একখানা খুব ভালো ল্যাবরেটারীও হতে পারে।'

ছোটবেলা থেকে দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করে বেড়ে ওঠা মারি এই লাভের কথা, পার্থিব স্বাচ্ছন্দ্যের কথা শান্ত মনে ভেবে দেখলেন। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মন থেকে তা ঝেড়ে ফেললেন, বললেন, ‘পদার্থবিদরা চিরকাল নিজেদের অভিজ্ঞতা বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যাই করে থাকেন। আমাদের আবিষ্কারের যদি কোনও ব্যবসায়িক সাফল্য থাকে তা আকস্মিক ঘটনামাত্র। তার দ্বারা লাভবান হওয়া আমাদের কখনই উচিত নয়। তাছাড়া চিকিৎসার কাজেই রেডিয়ামের সার্থকতা। এর সুযোগ নেওয়া অত্যন্ত নীচ মনোবৃত্তির পরিচয় হবে বলে আমার মনে হয়’।

সামান্য যে দ্বিধা ছিল পিয়েরের মনে, তা দূর হয়ে গেল। মারির কথার প্রতিধ্বনির মতো পিয়ের আস্তে আস্তে বললেন, 'হ্যাঁ, একাজ বাস্তবিক বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির বিরোধী হবে।' রেডিয়ামের স্বত্ব কোনও ব্যক্তির রইলো না। তা হয়ে গেল সর্বসাধারণের।

অন্য বহু বিজ্ঞানীর মতো মারি-কুরিও শুধুমাত্র ল্যাবরেটারীর মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রাখেন নি। তাঁর দেশ পোল্যান্ড ছিল জারের দখলে। মাতৃভূমির মুক্তিসংগ্রামে যারা নিয়োজিত ছিলেন, তাঁদের সাথে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। 1914 সালে যখন জার্মানি ফ্রান্স আক্রমণ করলো, তখন তিনি চলে গিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। আহত সৈনিকদের চিকিৎসার কাজে সহায়তা করার জন্য। যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে মেয়ে আইরিনকে। লিখেছিলেন, 'এরা প্যারি আক্রমণের আশঙ্কা করছে এবং তার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। এক্ষেত্রে তোমাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবার আশংকা আছে। তাই যদি হয়, সাহসে ভর করে সহ্য করো, কারণ যে মহা-যুদ্ধ লেগেছে তার কাছে আমাদের পারিবারিক ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনও মূল্যই নেই।'

আর একজন বিজ্ঞানীর কথা বলে এই পর্বের আলোচনা শেষ করব। তিনি হলেন, লুই পাস্তুর। বাস্তবিক, তিনি এমন কোনও গবেষণা করেননি, যার সাথে মানুষের জীবনের সরাসরি যোগ নেই - সে খাদ্যের পচন রোধের উপায় নির্ধারণ হোক, বা অ্যানথ্রাক্স রোগ প্রতিরোধের টীকা আবিষ্কারই হোক। জীবনে অনেক আবিষ্কারই করেছেন। কিন্তু তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত ছোটবেলার একটা স্মৃতি - এক জলাতঙ্ক রোগীর আর্তনাদ। কিন্তু তখন তিনি অসুস্থ- অসাড় হয়ে গেছে শরীরের একটা দিক। নিজের শারীরিক কষ্ট ও প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে এই অবস্থাতেই চলল তাঁর গবেষণা এবং শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করলেন জলাতঙ্ক রোগের টীকা।

উপসংহার

সমাজের জন্য বিজ্ঞান, মানুষের জন্য বিজ্ঞান - এই মন্ত্র নিয়েই বিজ্ঞানের সূচনা ও অগ্রগতি। এর উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে সভ্যতা। কিন্তু আজ সেই সভ্যতাকে ধ্বংস করতেই শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে ব্যবহৃত হচ্ছে বিজ্ঞান। ব্যবহার করছে একদল মানুষ। তারাও বিজ্ঞানী বলে পরিচিত। বিজ্ঞানচর্চা একদল মানুয়ের কাছে ব্যক্তিগত নাম যশ, অর্থ ও প্রতিপত্তি লাভের উপায় হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর জন্য তাঁরা বিবেক দংশনও অনুভব করেন না। তাই এখন ল্যাবরেটারীর সংখ্যা ও গুণমান আগের তুলনায় অনেক বাড়লেও সেইমতো গবেষণার মান বাড়ছে না, বাড়ছে না নৈতিক বলে বলীয়মান বিজ্ঞানীর সংখ্যা। বরং তা ক্রমাগত কমছে। তাই বিজ্ঞানের নৈতিকতার বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা জরুরি প্রয়োজন হিসাবে দেখা দিয়েছে। আরও প্রয়োজন নৈতিকতার প্রতিমূর্তি যে সব বিজ্ঞানী ছিলেন তাঁদের জীবনচর্চা। এর মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানচর্চাকে যদি আমরা উন্নত নৈতিকতার আধারে দাঁড় করাতে পারি, তাহলেই একমাত্র বিজ্ঞানের যে সম্ভাবনা উন্মুক্ত হয়েছে, তার পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব।

তথ্যসূত্র :

1. ইতিহাসে বিজ্ঞান - জে ডি বার্নাল

2. The Social Function of Science -J. D. Bernal

3. বিজ্ঞানের ইতিহাস - সমরেন্দ্রনাথ সেন

4. The Ethics of Science 1. Frolov, B. Yudin

5. মাদাম কুরি - ইভ কুরি

6. কিশোর রচনা সংকলন - আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়

7. Brighter than a thousand Sun - Jung.

লেখক পরিচিতি: শ্রী গৌড়ী বিজ্ঞান আন্দোলনের বিশিষ্ট সংগঠক এবং ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির সর্বভারতীয় কমিটির সহ-সভাপতি।