বিভাগগুলি

ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম বা ভারতীয় জ্ঞানধারা - নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ এর মূল বিষয়




সৌমিত্র ব্যানার্জী

2020 সালের 29 জুলাই, একেবারে কোভিড অতিমারির মধ্যে যখন সারা দেশে লকডাউন পরিস্থিতি চলছে, সেই সময় পার্লামেন্টে কোনও আলোচনার সুযোগ না দিয়েই জাতীয় শিক্ষানীতি-2020 (NEP) চালু হয়েছে। এই শিক্ষানীতির একেবারে শুরুতেই বলা হয়েছে, “The rich heritage of ancient and eternal Indian knowledge and thought has been a guiding light for this policy” [page 4] অর্থাৎ, “প্রাচীন ও সনাতন ভারতবর্ষের যে সমৃদ্ধশালী জ্ঞান ও পরম্পরা তারই আলোকে আলোকিত এই নীতি”। এবং বলা হয়েছে এই জ্ঞান “আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে নতুন কাজে লাগানো হবে”।

কিন্তু 66 পৃষ্ঠার শিক্ষানীতির এই নথিতে, ‘ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমস’ শব্দটি দ্বারা নীতি-নির্ধারকরা কী বোঝাতে চেয়েছেন তার ব্যাখ্যা প্রায় নেই বললেই চলে। শুধু 4.27 নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “ভারতবর্ষের জ্ঞান-এর মধ্যে প্রাচীন ভারতবর্ষের জ্ঞান এবং আধুনিক ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে এর আদান ও সাফল্য ও চ্যালেঞ্জগুলো অন্তর্ভুক্ত হবে। ... এই উপাদানগুলিকে পুরো স্কুল পাঠ্যক্রম জুড়ে যেখানে প্রাসঙ্গিক হবে সেখানেই বিজ্ঞানসম্মতভাবে ও সঠিক উপায়ে শামিল করা হবে। বিশেষত আদিবাসী জ্ঞান এবং দেশীয় ঐতিহ্যগত শিক্ষার পদ্ধতি সহ ভারতীয় জ্ঞানের কাঠামোগুলি গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দৰ্শন, আর্কিটেকচার, ইঞ্জিনিয়ারিং, ভাষাতত্ত্ব, সাহিত্য, খেলাধুলা এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ভারতীয় জ্ঞানের কাঠামোগুলির উপর একটি আকর্ষক কোর্স বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা একটি ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে পাঠ করতে পারবে” [অনুচ্ছেদ 4.27, শিক্ষামন্ত্রকের ওয়েবসাইটের নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির বাংলা তর্জমা থেকে নেওয়া]।

স্বাভাবিকভাবেই, শিক্ষাবিদদের মধ্যে যারা নথিটি পড়েছেন, তাঁরা শিক্ষানীতিতে কী হতে চলেছে সে সম্পর্কে কোনও ধারণা পাননি। কিন্তু এই নীতি গৃহীত হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে শিক্ষানীতির প্রণেতাদের একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে যাকে তাঁরা “ভারতীয় জ্ঞানধারা” বলে চালাতে চাইছেন।

2020 সালের 6-8 নভেম্বর আইআইটি খড়গপুরে আয়োজিত ভারতীয় নলেজ সিস্টেমের উপর একটি আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারে প্রথম আভাস পাওয়া যায়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল নিশঙ্ক সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সঞ্জয় ধোত্রে, শিক্ষা সচিব অমিত খারে, শিক্ষা সংস্কৃতি উত্থান ন্যাস-এর অতুল কোঠারি এবং আইআইটি খড়গপুরের ডিরেক্টর, অধ্যাপক ভি কে তিওয়ারি। তাঁদের বক্তৃতা, যা এখন ইউটিউবে পাওয়া যায়, [1] এটা স্পষ্ট করেছে যে তথ্যপ্রমাণ দ্বারা সমর্থিত কিনা তার তোয়াক্কা না করেই বর্তমান সরকার ভারতের একটি কাল্পনিক গৌরবময় অতীত তুলে ধরতে আগ্রহী।

2021 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শিক্ষা মন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণাধীন সমস্ত প্রতিষ্ঠান মন্ত্রকের কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছিল, যেখানে তাদের বলা হয়েছিল যে ‘ভারতীয় শিক্ষণ মণ্ডল’ নামক একটি সংস্থার সাথে সহযোগিতার ভিত্তিতে NEP-2020 প্রচারের জন্য প্রোগ্রাম সংগঠিত করার জন্য। এই প্রোগ্রামগুলিতে ভারতীয় শিক্ষণ মণ্ডলের প্রতিনিধিদের আলোচনার মূল বিষয় ছিল শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ‘ভারতের গৌরবময় অতীত’-এর প্রচার : প্রাচীন ভারতে উৎপন্ন জ্ঞান, যা তাঁদের ভাষ্যে, অমূল্য সম্পদ হিসাবে লুকিয়ে আছে। তাঁদের মতে, আমাদের কাজ হল এই অমূল্য সম্পদকে নতুন করে আবিষ্কার করা এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করা। তাই এঁদের পরামর্শ ছিল যেন সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলি এই অমূল্য সম্পদকে উদ্ধারের কাজটি গ্রহণ করে।

এই উদ্দেশ্যে নয়া শিক্ষানীতি-2020তে শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কৃতকে মূলধারা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ -22.15 এ বলা হয়েছে, “সংস্কৃত ভাষার বহুধাবিভক্ত এবং অর্থপূর্ণ অবদান, শুধুমাত্র সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগ ও ঘরানায় নয়, এর অর্থপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং বিজ্ঞানমনস্ক মনোভাবের কারণে একে শুধুমাত্র পাঠশালা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না করে, স্কুলের পাঠ্যক্রমের মধ্যে তিনটি প্রধান ভাষার অন্যতম একটি হিসাবে এর অন্তর্ভুক্ত করার ভাবনাচিন্তা করা হচ্ছে, পাশাপাশি উচ্চতর শিক্ষাক্ষেত্রেও এর অন্তর্ভুক্তির উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। সংস্কৃতকে আলাদাভাবে পড়ানো হবে না, বরং আকর্ষণীয় ও নতুনত্ব পন্থা অবলম্বন করে এবং অন্যান্য সমকালীন ও প্রাসঙ্গিক বিষয়বস্তু, যেমন গণিত, অ্যাস্ট্রোনমি, দর্শনশাস্ত্র, লিংগুইস্টিক, নাট্যশাস্ত্র, যোগা প্রভৃতির সঙ্গেও যুক্ত করা হবে।”

শুধু তাই নয়। শিক্ষানীতি আরও বলছে, “এই নীতির অবশিষ্টাংশের সঙ্গে সংগতি রাখার জন্য সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকেও উচ্চতর শিক্ষার বৃহৎ বহু-বিষয়ক প্রতিষ্ঠান লক্ষ্যে অগ্রসর হতে হবে।... শিক্ষা এবং সংস্কৃত বিষয়ে চার বছরের বহু-বিষয়ক বি.এড ডিগ্রি কর্তৃক এবং ডুয়াল ডিগ্রি দ্বারা দেশব্যাপী অনেক বেশি সংখ্যক সংস্কৃত শিক্ষকদের পেশাগত শিক্ষা প্রদান করা হবে”(শিক্ষামন্ত্রকের বাংলা তর্জমা থেকে নেওয়া)। মোদ্দা কথা, বিজ্ঞান এবং প্রকৌশল বিষয় সহ নিয়মিত শিক্ষার অংশ হিসাবে “সংস্কৃত জ্ঞান ব্যবস্থা” গড়ে তোলা হবে।

অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন (AICTE), যারা দেশের সমগ্র কারিগরি শিক্ষার তত্ত্বাবধান করে, সেখানে ‘ভারতীয় জ্ঞান ব্যবস্থা (IKS)’-এর উপর একটি বিশেষ সেল তৈরি হয়েছে। এর সাহায্যে, AICTE IKS-এর উপর একটি ফ্যাকাল্টি ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম চালু করেছে এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলিকে এর উপর কোর্স চালু করার নির্দেশ দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানগুলিকে “প্রযুক্তিগত জ্ঞানের জন্য সংস্কৃত”, “নীতি শিক্ষা”, “যোগ দ্বারা স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট”, “লাইফ এনলাইটেনমেন্ট দক্ষতার মাধ্যমে ব্যক্তিত্ব বিকাশ” ইত্যাদি কোর্স চালু করার পরামর্শ দিয়েছে।

এসব থেকে মনে হচ্ছে, ক্ষমতায় আসীন ব্যক্তিদের কাছে শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ নয়। একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় মতাদর্শের দ্বারা শিক্ষার্থীদের মানসিকতাকে প্রভাবিত করাই নতুন শিক্ষানীতির প্রধান উদ্দেশ্য।


“ভারতীয় জ্ঞান ব্যবস্থা” কথাটার অর্থ কী?

ভারতীয় জ্ঞান ব্যবস্থা বলতে প্রবক্তারা কী বোঝাতে চান? স্কুল এবং কলেজের পাঠ্যক্রমে প্রাচীন ভারতে বিদ্যমান জ্ঞানের উপাদান অন্তর্ভুক্ত করার অর্থ কী? যদি NEP নথিতে এটি সম্বন্ধে কিছু উল্লেখ না থাকে, তবে আমাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সরকারের নেতাদের বক্তব্য থেকে তা বুঝে নিতে হবে।

2014 সালের 25 অক্টোবর মুম্বাইয়ের একটি বেসরকারী হাসপাতালে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দাবি করেছিলেন, “এক সময়ে আমাদের দেশ চিকিৎসা বিজ্ঞানে যা অর্জন করেছে তাতে আমরা গর্বিত বোধ করতে পারি। আমরা সবাই মহাভারতে কর্ণ সম্পর্কে পড়েছি। আরেকটু চিন্তা করলে আমরা বুঝতে পারি যে, মহাভারত বলছে কর্ণ তার মায়ের গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করেননি। এর মানে সেই সময়ে স্টেম সেল প্রযুক্তি বিদ্যমান ছিল”। তিনি আরও বলেছেন, “আমরা ভগবান গণেশের পূজা করি। সেই সময়ে নিশ্চয়ই কোনো প্লাস্টিক সার্জেন ছিলেন যিনি মানুষের শরীরে একটি হাতির মাথা প্রতিস্থাপন করতে পারতেন” [2]

2015 সালের 3-7 জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত 102 তম ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে ক্যাপ্টেন আনন্দ জে বোদাস নামে একজন একটি ‘পেপার’ বা গবেষণাপত্র পেশ করেছিলেন। যাতে দাবি করা হয়েছিল যে বৈদিক যুগে বিমান ছিল। তাঁর মতে, সেই অতীত যুগে বিমানগুলি ছিল বিশালাকার এবং সেগুলি বাম, ডান এবং পিছনে যেতে পারত, যেখানে আধুনিককালের বিমান কেবলমাত্র সামনের দিকেই উড়তে পারে। শুধু তাই নয়, বৈদিক বিমান এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহেও যেতে পারত বলে দাবি করেন তিনি! [3]

আপনারা হয়তো ভাবছেন যে মানুষ এই ধরণের ক্ষ্যাপাটে দাবি হেসে উড়িয়ে দেবে। কিন্তু না! 2020 সালের 6-8 নভেম্বর আইআইটি খড়গপুরে অনুষ্ঠিত উপরে উল্লেখিত ওয়েবিনারে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী পোখরিয়াল আইআইটি খড়গপুরে ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমের উপর একটি সেন্টার অফ এক্সেলেন্স তৈরির ঘোষণা করেন এবং ডিরেক্টর অধ্যাপক তিওয়ারি বলেন যে, “এই সেন্টার বৈদিক যুগে পুষ্পক বিমানের গল্পগুলি সত্যিই গল্প, নাকি এর পিছনে সত্য আছে তা খুঁজে বের করার জন্য গবেষণা পরিচালনা করবে”। এই সেন্টার অফ এক্সেলেন্স পরবর্তীতে 2022 সালের জন্য একটি ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেছে, যা ভারতীয় নলেজ সিস্টেম বলতে কী বোঝায় তা ব্যাখ্যা করেছে।

2018 সালের এপ্রিল মাসে, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব দাবি করেছেন যে, মহাভারতের যুগে ইন্টারনেট ছিল, টেলিভিশন ছিল। ইন্টারনেট যদি না থাকতো, তাহলে সঞ্জয় কী করে ধৃতরাষ্ট্রকে যুদ্ধের ধারাবিবরণী দিল? ফলে ইন্টারনেট ছিল! টেলিভিশন ছিল! [4]

আরেকজন হলেন সত্যপাল সিং। কিছুদিন আগে কেন্দ্রের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি বলেছিলেন, ডারউইনের তত্ত্ব ভুল, কেননা কেউ কোনও একটা লেজওয়ালা বাঁদরকে বা হনুমানকে মানুষ হয়ে যেতে দেখেননি। সুতরাং ডারউইনের থিয়োরি ভুল। এঁদের আধুনিক বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা এই স্তরের। যিনি শিক্ষামন্ত্রী, তিনি বলছেন যে স্কুল-কলেজে ডারউইন তত্ত্ব পড়ানো উচিৎ নয়, তাদের হাতে যদি আর বেশিদিন ক্ষমতা থাকে তবে তারা শিক্ষার কারিকুলাম পাল্টে ডারউইন তত্ত্ব বাদ দিয়ে দেবেন।

2016 সালে, IIT দিল্লিতে ‘পঞ্চগব্য’ [5] এর স্বাস্থ্য- উপকারিতা নিয়ে গবেষণা শুরু করার জন্য একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল। 2019 সালের জুলাই মাসে, উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী ত্রিবেন্দ্র সিং রাওয়াত দাবি করেন যে গরুই একমাত্র প্রাণী যে অক্সিজেন শ্বাস নেয় এবং অক্সিজেনই ত্যাগ করে [6]। 2020 সালে কোভিড তরঙ্গ ভারতে আঘাত করার সাথে সাথে কিছু মহল এমন ধারণা প্রচার করেছিল যে গোমূত্র পান করলে এবং শরীরে গোবর মাখলে ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। অনেক জায়গায় যৌথভাবে গোমূত্র পানের আয়োজনও করা হয়!

2014 সালে, একটি সংসদ-বিতর্কে অংশ নিয়ে, রমেশ পোখরিয়াল নিশঙ্ক দাবি করেছিলেন যে জ্যোতিষশাস্ত্র হল সবচেয়ে বড় বিজ্ঞান এবং আধুনিক বিজ্ঞান জ্যোতিষশাস্ত্রের সামনে নেহাতই শিশু। তিনি বলেছেন, “আমরা আজকে পরমাণু বিজ্ঞানের কথা বলি, কিন্তু ঋষি কণাদ এক লক্ষ বছর আগে পারমাণবিক পরীক্ষা করেছিলেন”[7]। এই নিশঙ্কজিই তারপর কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন এবং NEP চালু করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাই শিক্ষাব্যবস্থায় তার মত গুরুত্ব পাবে এটা আশা করাই যায়। সেই অনুযায়ী 2021 সালের জুন মাসে ইন্দিরা গান্ধী জাতীয় মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করেছে যে তারা জ্যোতিষশাস্ত্রে একটি নতুন এমএ প্রোগ্রাম শুরু করছে।

এই তালিকাটি আরও দীর্ঘায়িত করা যায়। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ভারতীয় জ্ঞানধারার প্রবক্তারা বিশ্বাস করেন যে প্রাচীন বৈদিক যুগে, বিমান, ইন্টারনেট, স্টেম-সেল প্রযুক্তি, প্লাস্টিক সার্জারি ছিল যা মানুষের ধড়ের উপর একটি হাতির মাথাও স্থাপন করতে পারতো। আরও অনেক কিছু ছিল। এসবই তারা শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে প্রচারের পরিকল্পনা করেছে। অর্থাৎ এরপর স্কুল-কলেজে ছাত্ররা এসবই পড়বে, পরীক্ষা দেবে।

এই দাবিগুলি কি সত্য হতে পারে?

এটা কি সম্ভব নয় যে উপরোক্ত বিজ্ঞান-প্রযুক্তিগুলি সত্যিই প্রাচীন ভারতে ছিল? আমি পাঠকদের অনুরোধ করব চারটি বিষয় বিবেচনা করার পর তারা যেন এই বিষয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেন।

প্রথমত, সবসময়ই আধুনিক বিজ্ঞান এই সব আবিষ্কার করার পর এই দাবিগুলো করা হয়েছে। রাইট ব্রাদার্স বিমান আবিষ্কার করার আগে এবং মানুষ যতদিন না বিমান ব্যবহার শুরু করেছিল, তার আগে কেউ দাবি করেননি যে প্রাচীনযুগে বিমান ছিল। 1980-এর দশকে ইন্টারনেট উদ্ভাবন ও প্রচলনের আগে কেউ দাবি করেনি যে সঞ্জয় ইন্টারনেট লাইভ স্ট্রিমিং ব্যবহার করে মহাভারত যুদ্ধের চলমান ভাষ্য দিয়েছিলেন। স্টেম সেল প্রযুক্তির ফলে কর্ণের জন্ম – একথা কেউ ভাবেননি বা বলেননি আধুনিক বিজ্ঞান স্টেম সেল নিয়ে গবেষণা শুরু করার আগে।

দ্বিতীয়ত, আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যদি সত্যিকার অর্থেই প্রাচীন গ্রন্থে থাকত, তাহলে এই গ্রন্থগুলি অনুসরণ করেই কিছু উদ্ভাবন করা যেত। একটিও আবিষ্কার সেভাবে ঘটেনি।

তৃতীয়ত, প্রযুক্তির যেকোনও বিকাশের জন্য মৌলিক বিজ্ঞানের পূর্ব বিকাশ প্রয়োজন। উড়োজাহাজের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের আগে প্রয়োজন বায়ুগতিবিদ্যা (এরোডাইনামিকস), তাপগতিবিদ্যা (থার্মোডাইনামিক্স), ইঞ্জিন, বস্তুর ধর্ম, কঠিন বস্তুর বলবিদ্যা, ন্যাভিগেশনাল টেকনোলজি ইত্যাদি জ্ঞানের সম্যক অগ্রগতি, এবং তারপর বিভিন্ন শাখা থেকে আসা এই জ্ঞানগুলিকে একত্রিত করা। প্রাচীন ভারতে বিমান ছিল বলে দাবি করতে হলে অন্তত দেখাতে হবে যে থার্মোডাইনামিক্সের সূত্র বা বার্নোলির নীতি সেই সময়ে জানা ছিল। ট্রানজিস্টর সুইচ, লজিক গেট এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি উদ্ভাবনের আগে ইন্টারনেট উদ্ভাবন করা সম্ভবই নয়। সেজন্য, প্রাচীন ভারতে ইন্টারনেট ছিল বলে দাবি করতে হলে দেখাতে হবে যে এইসব বিষয়ে জ্ঞান সেইসময়ে ছিল। এই সব অতিরঞ্জিত দাবিগুলি যারা করছে, তারা কেউই সেই সময়ে এইসব জ্ঞান ও প্রযুক্তিগুলি বাস্তবে ছিল কিনা তা নিয়ে কথা বলে না!

চতুর্থত, কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে এধরণের কোনও প্রযুক্তির কোনও ভৌত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বৈদিক যুগে যদি সত্যিই বিমান আকাশের উড়ত, তবে তার কিছু ভাঙা অংশ কোনও একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে পাওয়া উচিত। মহাভারত যুদ্ধে আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়ে থাকলে কুরুক্ষেত্রে খনন করে সেগুলির কিছু খণ্ড পাওয়া উচিত ছিল। কোনওটাই পাওয়া যায়নি।


আইআইটি খড়গপুরের IKS ক্যালেন্ডার

আইআইটি খড়গপুরের ‘সেন্টার অফ এক্সেলেন্স ফর ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমস’ নির্দিষ্ট মতামত প্রচারের স্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে 2022 সালের জন্য একটি ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেছে। শুরুতেই বলা হয়েছে, এই ক্যালেন্ডারের উদ্দেশ্য হল “ভারতীয় জ্ঞান ব্যবস্থার ভিত্তি পুনরুদ্ধার, বেদের রহস্যের স্বীকৃতি, সিন্ধু সভ্যতার পুনঃব্যাখ্যা, এবং আর্য আক্রমণের মিথের খণ্ডন”। আরও গুরুত্বপূর্ণ, ‘ভারতীয় জ্ঞান ব্যবস্থা’ কথাটির দ্বারা প্রবক্তারা কী বোঝাতে চান এই ক্যালেন্ডারটি তার একটি আভাস দেয়।

Photo: Twitter/ChamuKShastry
2022 সালে প্রকাশিত ক্যালেন্ডারের প্রথম পাতা

ক্যালেন্ডারের মধ্য দিয়ে যে কাহিনীকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়েছে তা হল, বৈদিক ভারত বিশ্বব্যাপী সমস্ত সভ্যতার জন্মভূমি। এটি করতে তাদের বৈদিক যুগের সময়কাল 10000 বছর বা তারও বেশি সময় বাড়াতে হয়েছে। এই দাবির ক্ষেত্রে বড় বাধা হল হরপ্পা সভ্যতা, যার সময়কাল রেডিওমেট্রিক ডেটিং দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে : প্রায় 7000BCE থেকে 1800 BCE, যার মধ্যে 2600 BCE থেকে 2000BCE পর্যন্ত সময়কালকে ‘উন্নত’ পর্যায় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সুতরাং, বৈদিক সংস্কৃতিকে হরপ্পা সভ্যতার চেয়েও প্রাচীন বলে দাবি করতে হয়েছে। হরপ্পা সভ্যতা বৈদিক যুগেরই একটি অংশ ছিল এবং হরপ্পাবাসীরা বৈদিক আর্য ছাড়া আর কেউ ছিল না এটা তাদের দাবি করতে হয়েছে। এই কারণেই আমরা অদ্ভুত সব দাবি দেখতে পাই। যেমন, বেদের আধ্যাত্মিক গ্রন্থগুলি তৈরি করতে অবশ্যই ‘কয়েক হাজার বছর’ লেগেছিল। কিছু হরপ্পা সীলমোহরে পাওয়া এক শিংওয়ালা কাল্পনিক প্রাণীর ছবি ‘একশৃঙ্গ ঋষি’ ছাড়া আর কেউ নয়। সিন্ধু এবং ব্রহ্মপুত্র নদী নাকি কৈলাস পর্বত থেকে উৎপন্ন হয়েছে, এবং তাই সিন্ধু সভ্যতা এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা সভ্যতার উৎসও সেই দেবভূমি কৈলাস! হরপ্পার কিছু সিলে পাওয়া স্বস্তিক চিহ্নটি ছিল বৈদিক মূর্তি। এরকম আরও অনেক হাস্যকর দাবি।

চিন্তাশীল পাঠক অবশ্যই বুঝতে পারছেন, প্রথম দুটি খুবই ছেঁদো দাবি, স্রেফ বিশ্বাস ছাড়া কোনও ভিত্তি নেই। অন্য দুটি বাস্তবিকভাবে ভুল। সিন্ধু নদীর উৎপত্তি কৈলাশ পর্বতের কাছে অবস্থিত বোখারচু হিমবাহ থেকে, কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের উৎস একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন স্থান: মানস সরোবর অঞ্চল। আর, স্বস্তিকা প্রতীক মোটেই কোনও বৈদিক চিহ্ন নয়। আফ্রিকান, নেটিভ আমেরিকান, দক্ষিণ আমেরিকার আজটেক ইত্যাদি সহ কার্যত বিশ্বের সকল সভ্যতায় স্বস্তিকা প্রতীক পাওয়া যায়, যাদের সঙ্গে বৈদিক সংস্কৃতির কোনও যোগই ছিল না। (উইকিপিডিয়াতে ‘স্বস্তিকা’ সম্মন্ধে খোঁজ করলে ছবিসহ একটি তালিকা পাওয়া যাবে)।

আমরা এই দাবিগুলোকে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের উপাদান হিসেবে উপেক্ষা করতে পারতাম। সর্বোপরি, একটি ক্যালেন্ডারকে কখনওই এই ধরনের ধারণা প্রচার করার একটি মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। নতুন কোনও বক্তব্য উপস্থাপনা করার জন্য বৈজ্ঞানিক জার্নালগুলিই উপযুক্ত মাধ্যম। যাইহোক, আমরা এই বক্তব্যগুলিকে উপেক্ষা করতে পারি না, কারণ নয়া শিক্ষা নীতির মাধ্যমে এই বিশ্বাসগুলিকেই স্কুল এবং কলেজ পাঠ্যক্রমে চালু করার কথা বলা হচ্ছে।

সেজন্য আমাদের ঘটনাগুলো বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিবেচনা করতে হবে এবং আমাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোনটা সত্য।


সিন্ধু সভ্যতা কি সত্যিই বৈদিক যুগের একটি অংশ ছিল?

ঐতিহাসিকদের মতে, হরপ্পা সভ্যতা ছিল প্রাক আর্য সভ্যতা। আর্য ভাষাভাষী লোকেরা একসময় মধ্য-এশিয়ার স্টেপ উচ্চভূমি থেকে ভারতে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে একটি সমৃদ্ধ বৈদিক সংস্কৃতির জন্ম দেয়। ‘ভারতীয় জ্ঞান ব্যবস্থার’ প্রবক্তারা এই ধারণাকে পশ্চিমা ঐতিহাসিকদের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেন। তাই তাঁরা ইতিহাস পুনর্লিখন করতে চান, এবং এর প্রথম পদক্ষেপ হল নাম পরিবর্তন করা। ইউজিসি প্রকাশিত ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে তাই হরপ্পা সভ্যতাকে ‘সরস্বতী সভ্যতা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে।

ইতিহাসবিদরা যখন কিছু সিদ্ধান্তে আসেন, তখন তাদের তা প্রমাণের ভিত্তিতে করতে হয়। গবেষণাপত্র লিখে বিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদদের সামনে সেসব প্রমাণ উপস্থাপন করতে হয়। অন্যরা বিচার করে দেখেন, যা পাওয়া গেছে তা থেকে সেই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব কিনা। এই প্রক্রিয়ায় স্বীকৃত হলেই সেটি ‘ইতিহাস’ হিসেবে স্থান পায়।

1920-এর দশকের গোড়ার দিকে হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের পরে এবং পরবর্তীকালে এরকম একশোরও বেশি প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের সন্ধানের পর, ইতিহাসবিদরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে এই সভ্যতা প্ৰাক-বৈদিক ছিল। এই সিদ্ধান্তের ভিত্তি ছিল চারটি।

প্রথমত, হরপ্পা সভ্যতার বাড়িগুলি পোড়া মাটির ইট দিয়ে তৈরি। কিন্তু তারপর হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতীয় ভূখণ্ডে কোনও ইটের ঘর পাওয়া যায়নি। পুরো বৈদিক যুগের একটিও বাড়ি পাওয়া যায়নি। ইট একটি সুস্থায়ী বস্তু, যা দু-তিন হাজার বছর অনায়াসে টিকে থাকে। এর থেকে বোঝা যায় বৈদিক আর্যরা পোড়ামাটির ইট তৈরি করেনি। যদি সিন্ধু সভ্যতা বৈদিক যুগের একটি অংশ হয়ে থাকে তবে তা হওয়ার কথা নয়।

দ্বিতীয়ত, বৈদিক সাহিত্যের প্রধান প্রাণী হল ঘোড়া। কিন্তু ভারতের কোনো বনে বন্য ঘোড়া নেই। এর মানে মানুষের সাথেই ঘোড়া ভারতে এসেছিল। হরপ্পা সভ্যতার শত শত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে খননকালে অনেক পোড়ামাটির সিল পাওয়া গেছে। এগুলিতে বিভিন্ন প্রাণীর ছবি রয়েছে ষাঁড়, বাঘ, গন্ডার, হাতি, হরিণ, শূকর, এবং এমনকি একটি ষাঁড়ের দেহ এবং হরিণের মাথাওয়ালা একটি এক শিংযুক্ত কাল্পনিক প্রাণী। কিন্তু ঘোড়ার কোনও ছবি নেই। অর্থাৎ হরপ্পা সভ্যতায় ঘোড়ার অস্তিত্ব ছিল না। এর ফলে ইতিহাসবিদরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে ঘোড়া জন্তুটি ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছিল পরিযায়ী মানুষের সাথে, এমন জায়গা থেকে যেখানে বন্য ঘোড়া রয়েছে।

  • [পাদটীকা : ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন যে হরপ্পা যুগে ভারতীয় উপমহাদেশে ঘোড়ার আগমন ঘটেনি। কিন্তু এখানে খেয়াল করা দরকার, হরপ্পা সভ্যতার শহরগুলির সঙ্গে মধ্য ও পশ্চিম এশীয় জনগণের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। ফলে সিন্ধুসভ্যতার এলাকায় ঘোড়া না থাকলেও জন্তুটির সঙ্গে পরিচয় থাকা অস্বাভাবিক নয়।]

তৃতীয়ত, সিন্ধু সভ্যতার সিলগুলি প্রমাণ করে যে তাদের লিখিত ভাষা ছিল। সে লিপি এখনও পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, কারণ এটির সাথে কোনো আধুনিক ভাষার সাদৃশ্য নেই। তবে এটা নিশ্চিত যে সেখানে একটি লিখি ভাষা ছিল। এবং আমরা এটাও জানি যে, বৈদিক সভ্যতার প্রথম যুগে লিখিত ভাষা ছিল না, বেদের শ্লোকগুলি শ্রুতি। স্মৃতির মাধ্যমে প্রচারিত ও সংরক্ষিত হতো। লিখিত ভাষা প্রচলন হয় পরে। যদি সিন্ধু সভ্যতা বৈদিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে থাকে, তাহলে ঋগ্বেদের ভাষা সিন্ধু সভ্যতার ভাষার ধারাবাহিকতায় আসার কথা, অর্থাৎ মিল থাকার কথা। তা হয়নি। বৈদিক যুগের প্রথম পর্যায়েও ঋষিদের লিখিত ভাষ থাকার কথা। তাও হয়নি।

চতুর্থত, বেদ, বেদাঙ্গ, বেদান্ত, উপনিষদ এবং পুরাণের মতো বৈদিক সাহিত্যে কোথাও সিন্ধু সভ্যতার মতো নগর জীবনের বর্ণনা পাওয়া যায় না: ইটের ঘর, পাকা রাস্তা, আচ্ছাদিত পয়ঃপ্রণালী ও জলনিকাশী ব্যবস্থা, গণ-স্নানাগার, উঁচু শস্যভাণ্ডার, ইতাদি। এটা পরিষ্কার যে বৈদিক ঋষিরা এরকম নগরজীবনের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না।

এই চারটি সূত্রের উপর ভিত্তি করে, ঐতিহাসিকরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোন যে, হরপ্পা সভ্যতা এবং বৈদিক সংস্কৃতির মধ্যে কোন সাংস্কৃতিক সংযোগ ছিল না। প্রত্নবস্তুর রেডিওমেট্রিক ডেটিং প্রমাণ করে যে হরপ্পা শহরগুলিতে প্রায় 1800 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে আর জনবসতি ছিল না। যেহেতু বৈদিক সভ্যতার একটি নিরবচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক ইতিহাস রয়েছে, তাই ঐতিহাসিকরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, বৈদিক যুগ শুরু হয়েছিল সিন্ধু সভ্যতার সমাপ্তির পরেই। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনতম ঘোড়ার জীবাশ্ম পাকিস্তানের সোয়াট উপত্যকায় পাওয়া যায়, যার সময়কাল আর্যভাষীদের ভারতে আগমনের সময়ের সঙ্গে মেলে। ইন্দো- ইরানীয় ভাষা গোষ্ঠীর বিবর্তনের ইতিহাস (বিশেষ করে আবেস্তা ও ঋগ্বেদের ভাষা এবং বিষয়বস্তুর মধ্যে লক্ষণীয় মিল) পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে আর্য-ভাষী স্টেপভূমির মানুষ ভারত ভূমিতে ঐসময়েই পদার্পন করেছিল [8]।

স্টেপ-জনজাতির স্থানান্তর গমনের সবচেয়ে শক্তিশালী। প্রমাণ গত পাঁচ বছরের জেনেটিক গবেষণার রিপোর্ট থেকে পাওয়া গেছে। এই বিষয়টি বিস্তারিতভাবে এই সংখ্যায় ‘ভারতের প্রাচীন সভ্যতা ও ইতিহাসের ধারণা’ প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে তাই এখানে পুনরাবৃত্তি করছি না।

ক্যালেন্ডারের প্রণেতারা ‘আর্য আক্রমণের মিথ’কে আক্রমণ করেছেন। এটি একটি কাল্পনিক শত্রুর সাথে লড়াই করার মতো, কারণ আজ কোনও ইতিহাসবিদ বলেন না যে হরপ্পা-সভ্যতার শহরগুলিতে আর্য আক্রমণ ঘটেছিল, কারণ সিন্ধুসভ্যতার শহরগুলিতে যুদ্ধ বা অগ্নিসংযোগের কোনও চিহ্ন নেই। এখন এটা পরিষ্কার যে এশিয়ান স্টেপস থেকে মানুষের স্থানান্তর ঘটেছিল এবং সেই অভিবাসনের সময়টি প্রাকৃতিক কারণে শহর-ভিত্তিক হরপ্পা-সভ্যতা ভেঙে যাওয়ার পরে হয়েছিল।

মানুষের ইতিহাস অভিবাসনের ইতিহাস। আজ পৃথিবীর সকল মানুষই প্রায় 75000 বছর আগে মধ্য আফ্রিকা থেকে স্থানান্তরিত মানুষের বংশধর। তারপর থেকে, মানুষ ক্রমাগত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে গেছে, বসতি স্থাপন করেছে এবং স্থানীয় জনগণের সাথে মিশেছে। তাই কোনও স্থানের মানুষকেই বিশুদ্ধ জাতি বলা যায় না।


ভারতে প্রকৃত জ্ঞান ব্যবস্থা কী ছিল?

বিশ্বের অন্যান্য সভ্যতার মতো আমাদেরও জ্ঞানচর্চার সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। হরপ্পা-সভ্যতাতে নগরায়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত উন্নত জ্ঞান ছিল : ইট-নির্মিত বাড়ি, বাড়ির মধ্যে বাথরুম, পয়ঃপ্রণালী, রাস্তার চৌকো নকশা, জলনিকাশী ব্যবস্থা, গণ-স্নানাগার, উচ্চ-স্থানে শস্যভাণ্ডার ইত্যাদি। এই সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর বৈদিক যুগের সূচনা ঘটে, যেখানে চিন্তাচেতনার উন্নত মানের প্রতিফলন হিসাবে বেদ, বেদাঙ্গ, বেদান্ত, পুরাণ, উপনিষদগুলি পাওয়া যায়। আমরা সুলভসূত্রগুলিতে এই যুগে জ্যামিতির কিছু উন্নতির চিহ্ন দেখতে পাই।

প্রাচীন ভারতে প্রধান অগ্রগতিগুলি ঘটেছে উত্তর-বৈদিক বা সিদ্ধান্তিক যুগে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে আমরা সুশ্রুত ও চরকের কাজ দেখতে পাই। পাণিনি সংস্কৃত ব্যাকরণকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন এবং যা থেকে এই ভাষাটি শেখার পথ সহজ হয়েছিল। কৌটিল্য সমাজের রাজনৈতিক সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। দ্বিতীয় তৃতীয় শতাব্দীতে সংখ্যা লেখার ক্ষেত্রে শূন্য আবিষ্কার এবং স্থানিক ব্যবস্থা চালু হয়েছিল, এর ফলে গণিতের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছিল। আর্যভট, বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত, শ্রীধর, ভাস্কর-2 এবং অন্যান্য অনেক গণিতবিদ পাটিগণিত, বীজগণিত এবং ত্রিকোণমিতিতে মৌলিক অবদান রেখেছিলেন। গণিতের অগ্রগতির সাথে সাথে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ধারণাগুলিও বিকশিত হয়েছে। নাগার্জুন এবং অন্যান্যদের হাতে রসায়নের (প্রধানত এ্যালকেমি) বিকাশ ঘটে। ধাতুবিদ্যায় গুরুত্বপূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল এবং ‘উটজ ইস্পাত’ তৈরির কৌশল এখানেই উদ্ভাবিত হয়েছিল। দীর্ঘকাল ধরে ভারতীয় রাজ্যগুলি মধ্যপ্রাচ্যে ইস্পাত রপ্তানি করত, যেখানে এর প্রচুর চাহিদা ছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে এই সময়ের অগ্রগতির বিস্তারিত জানার জন্য [9] দেখুন।

যাই হোক, নবম শতকের পরে, ভারতে বিজ্ঞানচর্চার গতি ক্রমাগত হ্রাস পায় এবং একাদশ শতকের পরে খুব সামান্যই অবশিষ্ট ছিল। “হিন্দু রসায়নের ইতিহাস” বইতে [10] আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ভারতে বিজ্ঞানচর্চার অবনতি ও পতনের জন্য তিনটি কারণকে দায়ী করেছেন:

  1. জাতিভেদ প্রথা সুদৃঢ়ভাবে এবং নতুন উদ্যমে সমাজজীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে, কারুকর্মকে ঠেলে দেওয়া হল নিচুজাতের কাছে, পেশাগুলিকে করে দেওয়া হল বংশগত। সমাজের মননশীল অংশকে কারুকর্মে সক্রিয়ভাবে যোগ দেওয়া থেকে সরিয়ে নেওয়া হল। ফলে প্রাকৃতিক ঘটনার ‘কী করে’ ও ‘কেন’ – এই কার্যকারণ সম্বন্ধটাই আর নজরে এল না।

  2. কী করণীয় এবং কী করণীয় নয়, এইসব বিষয়ে শাস্ত্রের (বিশেষত মনুসংহিতার) নানা বিধি-নিষেধ প্রচলিত হল। এর মারাত্মক প্রভাব পড়ল চিকিৎসাবিদ্যার ওপর, কারণ চিকিৎসকদের পক্ষে পরবর্তী প্রজন্মকে চিকিৎসাবিদ্যা, বিশেষত অস্ত্রোপচার শেখানো অসম্ভব হয়ে উঠল। এর কারণ, মানুষের দেহের গঠন ও শরীরতত্ত্ব জানার জন্য শরবাবচ্ছেদ ছাড়া কোনও উপায় নেই। অথচ, উচ্চবর্ণের মানুষের শবদেহ স্পর্শ করা নিষেধ ছিল, কারণ তা করলে দেহ অপবিত্র ও কলুষিত হয়ে যাবে। শুধুমাত্র শূদ্রদেরই মৃতদেহ স্পর্শ করার অনুমতি ছিল, যাদের আবার চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়ন করার অনুমতি ছিল না।

  3. সমাজের চিন্তাশীল ব্যক্তিদের একটি বড় অংশ শঙ্করের ‘মায়া’ দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, যা বস্তুজগতকে একটি মায়া হিসাবে দেখতে শিখিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই, তারা আর জড়জগতের চরিত্র অনুসন্ধানের প্রতি আগ্রহ দেখায়নি।

একাদশ শতকের পরে, বিজ্ঞানচর্চার আলো কার্যত নিভে যায় এবং ভারত অন্ধকার যুগে নিমজ্জিত হয়।

প্রাচীন ভারতে বাস্তব জ্ঞানচর্চার যে নিদর্শন আছে তা আমাদের গর্বিত করে। কিন্তু এগুলো নিয়ে গবেষণা না করে আমরা যদি দাবি করি যে, প্রাচীন ভারতে বিমান, ইন্টারনেট, স্টেম সেল প্রযুক্তি, প্লাস্টিক সার্জারি ছিল যা মানুষের ধড়ের ওপর অন্য কোনো প্রাণীর মাথা প্রতিস্থাপন করতে পারত, তাহলে তা ভারতের জ্ঞানধারার অবমূল্যায়নই করবে।

আরেকটি দিক আছে। বিভিন্ন সভ্যতা এবং সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ার প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই জ্ঞানের বিকাশ ঘটে। জ্ঞানকে ভারতীয়, মিশরীয়, চীনা বা অন্য কোনো কিছু বলে দাগিয়ে দেওয়া যায় না। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানকে আহরণ করা, একত্রিত করা এবং উন্নত করার মাধ্যমেই মানুষের জ্ঞানজগতের বিস্তৃতি হয়েছে, মানবসমাজ বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছেছে। উদাহরণস্বরূপ, নিউটনের বলবিদ্যা, যা মানবজাতির ইতিহাসে একটি অনন্য কৃতিত্ব ছিল, তা বাস্তবিক অর্থে নিউটনের সময় পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের দ্বারা নির্মিত জ্ঞানের ফসল হিসাবে এসেছিল। নিউটনের বিখ্যাত উক্তি। “If I have seen further it is by standing on the shoulders of giants", এরই সাক্ষ্য।

প্রাচীন ভারতে সৃষ্ট জ্ঞান মানবজাতির জ্ঞানের ভাণ্ডারে মিশে গিয়েছে, তাকে সমৃদ্ধ করেছে। ভারতের জ্ঞানধারা এখন বিশ্ব-জ্ঞানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে সর্ব বিরাজমান। ছাত্ররা যখন সেই জ্ঞান আহরণ করে, তার মধ্যে ভারতে সৃষ্ট জ্ঞান স্বাভাবিকভাবেই মিশে থাকে। তাকে আলাদা করা যায় না।


আমাদের ছাত্রদের কি প্রাচীন জ্ঞান শেখানো উচিত?

আমরা আগেই দেখেছি, ‘ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’ বা ‘সংস্কৃত নলেজ সিস্টেম’ - এইসব শব্দবন্ধের দ্বারা তাঁরা যা বোঝাতে চান, অর্থাৎ সমস্ত আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রাচীন ভারতে বিদ্যমান ছিল - এই ধারণা কেবল অন্ধবিশ্বাস ও কল্পনার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এটি সত্যিই বিপজ্জনক, কারণ এইরকম শিক্ষাকে ভিত্তি করে ছাত্রদের মধ্যে গড়ে উঠবে এক ধরণের অন্ধবিশ্বাস।

বিজ্ঞানশিক্ষার ক্ষেত্রে অবৈজ্ঞানিক উপাদানের ভেজাল, পুরাকথাগুলিকে অতিরঞ্জিত করে ইতিহাস বলে চালানো, অতীত সম্পর্কে মিথ্যা দাবি এসব প্রাচীন ভারতের জ্ঞানচর্চার গৌরবময় ইতিহাসকে কালিমালিপ্তই শুধু করবে না, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এক মারাত্মক বাধার সৃষ্টি করবে।

কিন্তু আমরা দেখেছি যে প্রাচীন ভারতে, বিশেষ করে বৈদিক-পরবর্তী বা সিদ্ধান্তিক যুগে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় উন্নতি হয়েছিল। আমরা কি সেই জ্ঞান শেখাতে পারি না? আমরা কি ব্রহ্মগুপ্তের লেখা থেকে বীজগণিত ও ত্রিকোণমিতি, ভাস্করাচার্যের বই থেকে গোলাকার জ্যামিতি এবং অবস্থানগত জ্যোতির্বিদ্যা, চরক সংহিতা থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞান, পাণিনির ভাষাতত্ত্ব বা কৌটিল্যের অর্থনীতি শেখাতে পারি না?

এই কাজগুলির অবশ্যই ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে, এবং যেকোনও বিজ্ঞান-ঐতিহাসিকের কাছে এগুলির গুরুত্ব বিশাল। তাঁরা জ্ঞানের সন্ধানে মানবজাতির সংগ্রামের পথে এগুলিকে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসাবেই দেখেন। কিন্তু প্রকৃতি এবং সমাজ সম্পর্কে মানুষের উপলব্ধি তো একজায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। সেই প্রাচীনযুগ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে অগ্রসর হয়ে গেছে। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি হল ক্রমবর্ধমান প্রক্রিয়া যেখানে প্রতিটি প্রজন্ম পূর্ববর্তী প্রজন্মের দ্বারা সৃষ্ট জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে। যেকোনও সময়ে মানবজাতি অতীতের সমস্ত প্রজন্মের দ্বারা সৃষ্ট ও সঞ্চিত জ্ঞানের সুবিধা পায়। সেজন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে সবচেয়ে উন্নত জ্ঞানই আগামী প্রজন্মকে দিতে হবে।

লক্ষ্য করুন, যদিও নিউটন ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স-এর মূল সৃষ্টিকর্তা, তবুও আমরা ছাত্রদের মেকানিক্স শেখানোর জন্য তাঁর লেখা ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা’ বইটি ব্যবহার করি না। এর কারণ হল, ধ্রুপদী বলবিদ্যার জ্ঞান নিউটনের সময় থেকে অনেক উন্নত হয়ে গেছে, এবং আমরা সর্বশেষ জ্ঞানই প্রদান করি। একই কারণে আমরা ল্যাভয়েসিয়ারের লেখা ব্যবহার করে রসায়ন শেখাই না, যদিও তিনি আধুনিক রসায়নের জনক। এটা মানুষের জ্ঞানের সব ক্ষেত্রেই সত্য।

তাছাড়া, জ্ঞানের সন্ধান করা এবং শিক্ষার্থীদের সেই জ্ঞান প্রদান করা দুটি ভিন্ন জিনিস। বিশেষ জ্ঞানপ্রাপ্ত শিক্ষিত পাঠকদের জন্য লেখা একটি বই ক্লাসের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে সঠিক উপাদান নাও হতে পারে। শিক্ষাবিজ্ঞান দাবি করে কোনও একটি বিষয়ের ধারণা ধাপে ধাপে গড়ে তোলা, যাতে শেষপর্যন্ত বিষয়টির একটি সম্যক উপলব্ধি তৈরি হয়। এটিও আরেকটি কারণ যার জন্য আমরা নিউটন থেকে মেকানিক্স, ল্যাভয়েসিয়ার থেকে রসায়ন এবং ফার্মা বা অয়লার থেকে গণিত শেখাই না। এইসব বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের পরবর্তী সময়ের শিক্ষকরা এনাদের দ্বারা সৃষ্ট জ্ঞান ছাত্রদের মধ্যে সঞ্চারিত করার উপযুক্ত মাধ্যম ও পদ্ধতি তৈরি করেছেন। এইসব পাঠ্য বইগুলিই সারা দুনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দ্বারা ব্যবহৃত হয়।

চরক, আর্যভট্ট, বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত এবং ভাস্করাচার্যের মতো প্রাচীন লেখকদের ক্ষেত্রেও একই ধারণা প্রযোজ্য। বিজ্ঞান যতো এগিয়েছে, এঁদের সৃষ্ট জ্ঞানের অনেকাংশই মানবজাতির জ্ঞানভাণ্ডারের মধ্যে মিশে গেছে। আবার তাঁদের কোনও কোনও ধারণা পরবর্তী গবেষণার আলোকে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তাছাড়া, তাঁরা শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার কথা মাথায় রেখে লেখেননি, এবং তাই এনাদের লেখা পাঠ্যপুস্তক হিসেবে উপযুক্ত নয়।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ( 1820-1891) সময়ে, ভাস্করাচার্যের ‘লীলাবতী’ ও ‘বীজগণিত’ বই দুটি ব্যবহার করে গণিত পড়ানো হতো। বিদ্যাসাগর মনে করেছিলেন, এই পাঠ্যপ্রণালী ছাত্রদের আধুনিক গণিতের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করছে এবং ছাত্রদের এই বিষয়ে দুর্বল করে তুলছে। তাই তিনি আধুনিক ইংরেজি পাঠ্যপুস্তক থেকে গণিত শিক্ষার প্রচলন করেন। তিনি যুক্তি হিসাবে লিখেছেন: “এই দুটি কাজ খুবই নগণ্য৷ … উদাহরণ খুব কম। সংস্কৃতে গণিত শিক্ষা বন্ধ হওয়া উচিত। আমার এই কথা থেকে যেন মনে না হয় যে আমি একটি সম্পূর্ণ শিক্ষার উপাদান হিসেবে গণিতকে গুরুত্বহীন বলে মনে করি। ঠিক উল্টোটা। আমি এটিকে প্রতিস্থাপন করতে চাই ইংরেজিতে গণিত শিক্ষার দ্বারা, যার দ্বারা সংস্কৃতে অঙ্ক শেখার থেকে অর্ধেকেরও কম সময়ের মধ্যে একজন বুদ্ধিমান শিক্ষার্থী দ্বিগুণেরও বেশি জ্ঞানার্জন করতে পারবে”।

এখন শিক্ষার পরিকল্পনাকারীরা চাকাটিই উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছেন!


সংস্কৃত জ্ঞানধারার নামে অপ-বিজ্ঞানের চর্চা

NEP নথিতে আরও বলা হয়েছে, “এই নীতির অবশিষ্টাংশের সঙ্গে সংগতি রাখার জন্য সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকেও উচ্চতর শিক্ষার বৃহৎ বহু-বিষয়ক প্রতিষ্ঠান লক্ষ্যে অগ্রসর হতে হবে” (অনুচ্ছেদ 22.15)। আসুন, দেখি সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন কী কী কোর্স পড়ানো হচ্ছে। নাগপুরে অবস্থিত কবিকুলগুরু কালিদাস সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয় বেদাঙ্গ জ্যোতিষের উপর একটি বিএ কোর্স চালু করেছে। দিল্লিতে অবস্থিত শ্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী জাতীয় সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয় ফলিত জ্যোতিষ, সিদ্ধান্ত জ্যোতিষ, বাস্তুশাস্ত্র ইত্যাদির মতো বিষয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভূক্ত করেছে। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি জ্যোতিষ বিভাগ রয়েছে, যেটি জ্যোতিষ এবং বাস্তুশাস্ত্রের উপর দুই বছরের ডিপ্লোমা কোর্স দেয়।

ব্রেকথ্রু পত্রিকার [11] সেপ্টেম্বর 2021 সংখ্যায় জ্যোতিষশাস্ত্রের উপর একটি বিশদ আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে অধ্যাপক জয়ন্ত নারলিকার, অধ্যাপক পার্থ মজুমদার, অধ্যাপক সুনীল মুখী, অধ্যাপক অনিকেত সুলে প্রভৃতি প্রথিতযশা বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে তাঁদের মত প্রকাশ করেছেন। তাই আমরা এই নিবন্ধে এটির পুনরাবৃত্তি করছি না। এটা বলাই যথেষ্ট যে জ্যোতিষশাস্ত্র এবং বাস্তুশাস্ত্র হল অপ-বিজ্ঞান, এবং জ্ঞানজগতে এদের কোনও স্থান থাকা উচিত নয়।


উপসংহার

নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি-2020 ভারতীয় নলেজ সিস্টেমের নামে স্কুল এবং কলেজ পাঠ্যক্রমে অবৈজ্ঞানিক ধারণা এবং অপবিজ্ঞান প্রবর্তন করতে চায়। এটা ভারতের ইতিহাসের ব্যাখ্যানটাকেই পাল্টে দিতে চায়, প্রতিষ্ঠা করতে চায় যে বৈদিক ভারতই সমস্ত সভ্যতার জন্মভূমি। জ্ঞানজগতে ভারতের অবদানের একটা কাল্পনিক চিত্র এঁকে মানুষের মনে অন্ধতা-গোঁড়ামির জমি প্রস্তুত করতে চায়। এই শিক্ষানীতি যদি কার্যকর হয় তবে আগামীদিনে ছাত্রদের মধ্যে যুক্তিহীন বিশ্বাসে ভর করা মনন তৈরি হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে এই আক্রমণ থেকে বাঁচাতে বিজ্ঞানী ও সাধারণভাবে বিজ্ঞানপ্রেমী মানুষকে পথে নামতে হবে।

লেখক পরিচিতি : অধ্যাপক ব্যানার্জী IISER-কলকাতার পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপনায় যুক্ত এবং ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির সর্ব-ভারতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক

তথ্যসূত্র :

[1] https://www.youtube.com/watch?Ev=QkRE2du8RTc&t=5081s

[2] The Guardian, 28 October 2014.

[3] India Today, 6 January 2015.

[4] Deccan Herald, 18 April 2018

[5] India Today, 18 February, 2017

[6] Indian Express, 28 July 2019

[7] The Hindu, 4 December, 2014.

[8] David W. Anthony and Don Ringe, The Indo -European Homeland from Linguistic and Ar- chaeological Perspectives, Annual Review of Linguistics, 1:199-219, 2015

[9] Science in Ancient India: Reality versus Myth, Breakthrough Science Society publica- tion, 2016.

[10] Acharya P C Ray, History of Hindu Chem- istry, Indian Chemical Society, 1956; and Cosmo Publications, 2010.

[11] Articles by J V Narlikar, Partha P Majum- der, Sunil Mukhi, and Aniket Sule, Break- through, Vol.22, No. 2, September 2021.