বিভাগগুলি

আধুনিক বিজ্ঞানের সবকিছুই কি বেদে আছে?



সুব্রত গৌড়ী

কিছুদিন ধরে একটা প্রবণতা উত্তরোত্তর বাড়ছে। এতদিন সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীরা নানা আজগুবি কথা বলে আসছেন ভারতের যা কিছু সৃষ্টি, তার উৎস বৈদিক যুগে বলে দাবি করে আসছেন, তাতে আমরা খুব বিস্মিত হইনি। কারণ আমাদের দেশে এখন এইসব পদে বসবার জন্য কোনও কাণ্ডজ্ঞানের দরকার হয় না। কিন্তু যেভাবে আইআইটি (খড়গপুর) থেকে প্রকাশিত ক্যালেন্ডারে সিন্ধু সভ্যতাকে আর্য সভ্যতা বলে দাবি করা সহ বহু আজগুবি দাবি করা হয়েছে, আইআইটি (গৌহাটি) গো-বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার জন্য তৎপর হয়েছে, বা ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার চেয়ারম্যান যেভাবে সংস্কৃত ভাষাকে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার উপযুক্ত ভাষা হিসেবে দাবি করেছেন তা একটা বিপজ্জনক প্রবণতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। রেনেসাঁসের চিন্তানায়করা মানুষের চিন্তাপ্রক্রিয়ায় যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে সংগ্রাম করেছিলেন, তাকে ভুলুন্ঠিত করার প্রবণতা। ভুলে গেলে চলবে না যে, এই যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের যেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, আবার এই যুক্তিবাদকে ভিত্তি করেই আধুনিক বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। তাই আজ যে সমস্ত অদ্ভূত দাবিগুলো সামনে আনা হচ্ছে, বৈদিক যুগের মুনি- ঋষিরাই আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব ভাবনাই ভেবে রেখেছিলেন বলে দাবি করা হচ্ছে, সেগুলো খুঁটিয়ে বিচার করা দরকার।

বৈদিক যুগে বিজ্ঞানের প্রকৃত চর্চা কতটা হয়েছিল

তথ্যপ্রমাণের ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানের যে ইতিহাস নির্মিত হয়েছে, তা থেকে আমরা জেনেছি যে প্রাচীন ভারতে জ্ঞানচর্চার একটা উন্নত ধারা তৈরি হয়েছিল এবং সেইযুগে ভারতীয় বিজ্ঞান-সাধকরাবহু গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। কিন্তু তার বেশিরভাগটাই বেদোত্তর যুগের অবদান, বৈদিক যুগের নয়। যেমন ভাষা বিজ্ঞানে পানিনি-কৃত সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ, জ্যোতির্বিজ্ঞানে পৃথিবীর আহ্নিক গতি সংক্রান্ত ধারণা, গণিতশাস্ত্রে শূন্য ও দশমিক পদ্ধতি, চিকিৎসাবিজ্ঞানে আয়ুর্বেদ ও শল্য চিকিৎসা প্রভৃতি আবিষ্কার বিজ্ঞানের ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। এর সবকটিই হয়েছিল বেদ-পরবর্তী যুগে। ফলে প্রাচীন ভারতে যা কিছু আবিষ্কার, তা বেদের ঘাড়ে চাপালে তাতে বেদের অবমাননাই হয়। তাই বৈদিক যুগে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ঠিক কতটুকু অগ্রগতি ঘটেছিল, তা আমাদের জানা দরকার।

আমরা জানি যে, বৈদিক যুগের শুরুতে আর্যদের ভাষার কোনও লিখিত রূপ ছিল না। বেদ এবং অন্যান্য সাহিত্যগুলি এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রচারিত হত মুখে মুখে। তাই বেদের আর এক নাম শ্রুতি। কিন্তু বৈদিক যুগের শেষের দিকে (খ্রি:পূ: 1000 সালের পরবর্তী সময়ে) লিপির উদ্ভব হয় এবং পুঁথিপত্র লেখার রীতি চালু হয়।

এইসমস্ত নথি থেকে জানা যায় যে, বৈদিক যুগের শেষ পর্যায়ে সংখ্যা লেখার একটি পদ্ধতির প্রচলন হয়েছিল যাতে এক থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যাগুলির আলাদা আলাদা চিহ্ন ছিল। তখনও শূন্যের আবিষ্কার হয়নি। আধুনিক সংখ্যা লিখনের পদ্ধতিরও (place value system) আবিষ্কার হয়নি। ফলে দশ সংখ্যাটি লেখার জন্য আলাদা একটা চিহ্নের প্রয়োজন হতো। এরপর এগারো, বারো প্রভৃতি লেখা হত দশের জন্য চিহ্নটির পাশে এক, দুই ইত্যাদির চিহ্নগুলি বসিয়ে। কিন্তু কুড়ির জন্য আবার একটি চিহ্নের প্রয়োজন হতো। এইভাবে দশ, কুড়ি, ত্রিশ......একশত, একহাজার ইত্যাদি সংখ্যাগুলির আলাদা আলাদা চিহ্নের দরকার হত।

তৈত্তরীয় সংহিতায় সমান্তর প্রগতি ও গুণোত্তর প্রগতির উল্লেখ পাওয়া যায়। সহজ ভগ্নাংশের গুণ ভাগের পদ্ধতিও তারা জানতেন। আবার ধারাবাহিক ভগ্নাংশে দুই তিন ইত্যাদি সংখ্যার বর্গমূল বের করার প্রচেষ্টাও চোখে পড়ে। শতপথ ব্রাহ্মণ ও তৈত্তরীয় সংহিতায় জ্যামিতির প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়।

তবে জ্যামিতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির পরিচয় পাওয়া যায় শুল্বসূত্র নামের সাহিত্যে। সাতটি শুন্বসূত্র লেখা হয়েছিল বৈদিক যুগের শেষ থেকে বৌদ্ধ যুগের প্রথম দিকে পর্যন্ত। এর মধ্যে বৌধায়ন শুল্বসূত্র লেখা হয়েছিল বৈদিক যুগে। বিভিন্ন আকার ও আকৃতির যজ্ঞবেদী নির্মাণের প্রয়োজনে সেই সময় জ্যামিতির কিছু কিছু জটিল সমস্যা তাঁদের সমাধান করতে হয়েছিল। যেমন, তাঁদের প্রতিটি দেবতার জন্য সমান জায়গার মধ্যে বিভিন্ন জ্যামিতিক আকারের বেদি নির্মাণ করতে হতো। শুল্বসূত্রে আয়তন অপরিবর্তিত রেখে এক জ্যামিতিক আকৃতি থেকে আর একটি আকৃতিতে পরিবর্তনের পদ্ধতি বর্ণিত আছে। যেমন, একটি বর্গক্ষেত্রের সমান আয়তনের বৃত্ত কীভাবে আঁকবে, অথবা একটি বৃত্তের সমান আয়তনের বর্গক্ষেত্র কীভাবে আঁকবে, একটি বর্গক্ষেত্রের সমান আয়তনের একটি সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ, রম্বস ইত্যাদি কীভাবে আঁকবে তার পদ্ধতি তাঁদের জানা ছিল। বৌধায়ন শুল্কসূত্রে বৃত্তের সম-আয়তনের একটি বর্গক্ষেত্র আঁকার বিপরীত রূপান্তর পদ্ধতিও আমরা দেখতে পাই।

আবার বর্গাকৃতির বেদির আয়তন এক, দুই বা তিনের মতো সংখ্যা হলে তার বাহুর দৈর্ঘ্য কত হবে? প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গিয়ে তাঁদের বর্গমূল নির্ণয় করার চেষ্টা করতে হয়েছে। বৌধায়ন শুল্বসূত্রে একটি শ্লোকের গাণিতিক প্রকাশ এইরকম —

√2=1+1/3+1/(3×4)-1/(3×4×34)

আধুনিক সংখ্যালিখন পদ্ধতিতে এটির মান দাঁড়ায় 577/408 = 1.4142156, যেখানে √2 এর সঠিক মান 1.414213, অর্থাৎ বৌধায়ন যে মান পেয়েছিলেন তা দশমিকের পর পাঁচ সংখ্যা পর্যন্ত সঠিক। লক্ষ করা দরকার, সেযুগে দশমিক দিয়ে ভগ্নাংশ প্রকাশ করার পদ্ধতি উদ্ভাবিত না হওয়ায় তাদের পূর্ণসংখ্যা দিয়েই সব অঙ্ক কষতে হয়েছে।

কিছু কিছু সূত্র থেকে বোঝা যায় পিথাগোরাসের উপপাদ্যটির মূল বক্তব্যটি শুল্বসূত্রের সূত্রকাররা জানতেন। বৌধায়নের শল্যসূত্রে এক জায়গায় বলা আছে, একটি আয়তক্ষেত্রের দুটি বাহু যে বর্গক্ষেত্র দুটি তৈরি করে তার আয়তন অতিভুজটি যে বর্গক্ষেত্র তৈরি করে তার আয়তনের সমান। এই নিয়ম মেনে চলে এমন কয়েকটি পূর্ণ সংখ্যার তালিকাও বৌধায়ন দিয়েছিলেন যেমন (3, 4, 5), (5, 12, 13), (8, 15, 17), (7, 24, 25), এবং (12, 35, 37) - এগুলি তিনটি সংখ্যার সেট, যা পিথাগোরীয় সূত্র মেনে চলে। এদের বলে পিথাগরীয় ত্রয়ী। কিন্তু শুল্বসূত্রে এর কোনও প্রমাণ দেওয়া নেই।

গণিত ছাড়াও বৈদিক যুগে জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রাথমিক ধারণাগুলোর উদ্ভব হয়েছিল। আমরা জানি, বৈদিক যুগের শেষ পর্যায়ে পশুপালনের পাশাপাশি কৃষিকার্যও শুরু হয়েছিল। আর সেইজন্যই শস্যবপন, ফসল তোলা এবং কৃষির সাথে জড়িত অন্যান্য কাজের সময় নির্ধারণের জন্য ক্যালেন্ডার বা পাঁজি প্রণয়নের প্রয়োজন হয়েছিল। একারণেই আকাশের গ্রহ নক্ষত্রগুলির অবস্থানের ঠিকঠাক পর্যবেক্ষণেরও প্রয়োজন হয়েছিল। এছাড়া যাগযজ্ঞের মতো অনুষ্ঠানের শুভ দিনক্ষণ নির্ধারণের প্রয়োজনেও মানুষ জ্যোতিষ্ক পর্যবেক্ষণে বাধ্য হয়েছিল।

বৈদিক সাহিত্য থেকে জানা যায় যে, মাস গণনা করা হত চাঁদের কলা পরিবর্তনের ভিত্তিতে এবং বছর গণনা করা হত সূর্যের গতির ভিত্তিতে। যেহেতু চন্দ্রমাসের দ্বারা একটি সূর্য বছর পূর্ণ হয় না, তাই অতিরিক্ত দিনগুলিকে 'মল মাস' হিসেবে ধরা হতো, যে সময়ে কোনও শুভ ঘটনা ঘটবে না। বছরকে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়েছে যখন সূর্য উত্তরমুখে যাত্রা করে (উত্তরায়ণ) এবং যখন সূর্য দক্ষিণমুখে যাত্রা করে (দক্ষিণায়ণ)। তাছাড়া তাঁরা গ্রীষ্ম ও শীত সংক্রান্তি চিহ্নিত করতে পারতেন।

যদুর্বেদে একটি বছরে বারোটি সূর্য মাস ও ছয়টি ঋতুর উল্লেখ আছে। বৈদিক পরিভাষায় এই ছয়টি ঋতু হল- বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত ও শিশির ঋতু। এছাড়াও তাঁরা সূর্য চন্দ্রের যাত্রাপথে 27টি নক্ষত্রের নামকরণ করেছিলেন এবং তার সাহায্যে সূর্য ও চন্দ্রের অবস্থান বর্ণনা করতে পারতেন। বৃহস্পতি এবং শুক্র গ্রহের উল্লেখও ছিল।

এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বৈদিক যুগে কোনও জ্যোতিষ চর্চা ছিল না যাতে বিশ্বাস করা হয় যে মানুষের জীবন তার জন্মমুহূর্ত দ্বারা নির্ধারিত হয় এবং তা গ্রহদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সেইসময় জ্যোতিষ শব্দটি জ্যোতির্বিদ্যা অর্থেই ব্যবহৃত হতো।

আর একটি ক্ষেত্রে বৈদিক যুগের শেষ পর্বে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল, সেটা হল, চিকিৎসাশাস্ত্র। অথর্ববেদে নানা শ্লোকে শারীর স্থান, শারীর বিদ্যা, ভেষজ বিদ্যা এবং চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে যে সমস্ত তথ্য আছে, তা আধুনিক বিজ্ঞানের নিরিখে পুরোপুরি সঠিক না হলেও সে যুগে পৃথিবীর অন্যত্র জ্ঞানের যে স্তর দেখা যায় তার থেকে অনেকটাই অগ্রণী ছিল। অথর্ববেদের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে, সেই সময় বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। কেউ রোগের কারণ হিসেবে দুষ্ট শক্তির উপস্থিতিকে দায়ী করেছেন। সেইজন্য তাঁরা দুষ্টশক্তিকে দূর করার জন্য জাদুবিদ্যা ব্যবহার করতে বলেছেন। আবার কেউ ব্যবহার করতেন গাছগাছড়ার পাতা, শিকড়, বীজ, ছাল প্রভৃতি। যাঁরা গাছগাছড়া ব্যবহার করতেন, তাঁরা ভীষক নামে পরিচিত ছিলেন। ধীরে ধীরে দ্বিতীয় পদ্ধতিটি প্রাধান্য লাভ করে এবং এঁদের লেখায় অনেক ভেষজ উদ্ভিদের উল্লেখ পাওয়া যায়।

এরই ধারাবাহিকতায় বৈদিক যুগের শেষে এবং বৌদ্ধযুগের শুরুতে আয়ুর্বেদ রচিত হয়। কেউ কেউ মনে করেন আয়ুর্বেদ অথর্ববেদের অংশ, আবার কেউ কেউ অন্যান্য বেদের বৈশিষ্ট্যের সাথে উল্লেখযোগ্য পার্থক্যের কারণে এটিকে একটি পৃথক বেদ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

সংক্ষেপে এই হল বিজ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে বৈদিক যুগের অবদান। সেই যুগের পরিপ্রেক্ষিতে এই অবদান কম নয়। এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে পরবর্তী যুগে (বেদোত্তর যুগে) বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছিল। সেই অর্থে এই যুগের জ্ঞানচর্চার বিশেষ গুরুত্ব আছে।

আবার একথাও মনে রাখতে হবে যে, শুধু বৈদিক যুগেই এই অগ্রগতি ঘটেছিল, তা নয়। পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে এই ধরনের বহু আবিষ্কার হয়েছে। শুধু তাই নয়, এও দেখা গেছে যে, একই চিন্তা একই সাথে একাধিক জায়গায় স্বকীয়ভাবে উদ্ভাবিত হয়েছে। একটা উদাহরণ দিচ্ছি।

আগেই দেখিয়েছি যে, বৈদিক যুগে পিথাগোরাসের উপপাদ্যের মূল চিন্তার উল্লেখ পাওয়া গিয়েছিল। আবার আমরা জানি, খ্রি:পূ: 2500 সাল নাগাদ মিশরে যে পিরামিড তৈরি হয়েছিল, তার জন্য এই উপপাদ্যের প্রাথমিক জ্ঞান প্রয়োজন ছিল। 1800 খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়াতেও এই রকম সংখ্যা-ত্রয়ীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ফলে পিথাগোরাসের উপপাদ্য বলে যা পরিচিত, তার জ্ঞান তাদেরও ছিল। এই দুটিরই সময়কাল বৈদিক যুগের আগে। শুল্বসূত্রে উপপাদ্যটি প্রথম সূত্রকারে উল্লেখ ছিল, কিন্তু প্রমাণ ছিল না। এই উপপাদ্যের প্রমাণ প্রথম পাওয়া যায় চীনে (খ্রি:পূ: 500 সাল)। পিথাগোরাস খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে এটিকে প্রমাণ সহ যথাযথ গাণিতিক বিবৃতির আকারে প্রকাশ করেছিলেন।

বৈদিক যুগের পরবর্তী সময়ে (বেদোত্তর যুগ) বিজ্ঞানের বিকাশ কতটা হয়েছিল?

বাস্তবে প্রাচীন ভারতে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে বেদোত্তর যুগের (ষষ্ঠ খ্রি:পূ: থেকে নবম খ্রিস্টাব্দ) অবদান উল্লেখযোগ্য।

প্রথমেই বলতে হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের কথা। এই যুগেই কয়েকজন বিশিষ্ট চিকিৎসকের জন্ম হয়েছিল। এদের মধ্যে আছেন আত্রেয় ও সুশ্রুত (খ্রি:পূ: ষষ্ঠ শতক), মগধরাজ বিম্বিসারের রাজবৈদ্য জীবক কুমারভক্ত (খ্রি:পূ: 566-486), এবং চরক। চরকের সময়কাল নির্দিষ্ট করে জানা যায় না। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হল, এই সময়ের শল্য চিকিৎসার বিকাশ। ইউরোপীয় রেনেসাঁর আগে পৃথিবীর অন্য কোথাও এরকম বিকাশ হয়েছে বলে জানা নেই। শল্য চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় 121 রকমের যন্ত্রপাতির উল্লেখ সুশ্রুত সংহিতায় পাওয়া যায়। কোন অঙ্গের অস্ত্র প্রচারে কীভাবে ছুরি চালাতে হবে, অস্ত্রোপচারের পর কীভাবে গাছের তত্ত্ব দিয়ে সেলাই করতে হবে, হাড় ভেঙ্গে গেলে কী ব্যবস্থা নিতে হবে - এসবের নির্দেশিকাও এঁদের লেখায় পাওয়া যায়।

প্রাচীনকালে বহু দেশেই রসায়ন সম্বন্ধে মানুষের কৌতূহল জেগেছিল তিনদিক থেকে। প্রথমত, রোগ নিরাময়ে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বস্তু ও মিশ্রণের দ্রব্যগুণ জানার প্রয়োজন ছিল। তাই যেখানেই চিকিৎসাশাস্ত্রের বিকাশ ঘটেছিল, সেই দেশেই রসায়নের চর্চা এগিয়েছে। দ্বিতীয়ত, আকরিক থেকে ধাতু নিষ্কাশন এবং বিভিন্ন ধাতু মিশ্রিত করে আরও কঠিন ও অভঙ্গুর ধাতু তৈরির প্রয়োজন মানুষকে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বাধ্য করেছে। তৃতীয়ত, রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে কোনও বস্তুকে সোনায় পরিণত করা সম্ভব এই বিশ্বাসও মানুষকে এটা সেটা করতে প্ররোচিত করেছে। এই তিন দিক থেকেই ভারতে রসায়নের প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল।

এবার দেখা যাক জ্যোতির্বিদ্যায় এই সময় কতোটা অগ্রগতি ঘটেছিল। বৈদিক যুগে জ্যোতির্বিদ্যায় অগ্রগতি সম্পর্কে আমরা আগেই আলোচনা করেছি, যা ‘ব্রাহ্মণ’ ও ‘বেদাঙ্গ জ্যোতিষ’- এ উল্লেখিত হয়েছে। বৈদিক যুগের শেষ পর্যায়ে জ্যোতির্বিদ্যায় আর কোনও বিশেষ অগ্রগতি চোখে পড়ে না। এরপর জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার পুনরুত্থান ঘটে প্রায় পাঁচ-ছ’শো শতাব্দী পরে। প্রথম থেকে পঞ্চম খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লেখা বইপত্রে, যাকে একত্রে ‘সিদ্ধান্ত জ্যোতিষ’ বলা হয়, তার মধ্যে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার নিদর্শন পাওয়া যায়। ‘সিদ্ধান্ত জ্যোতিষ’ কোনও গ্রন্থ নয়। 100 থেকে 500 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লিখিত সূর্য-সিদ্ধান্ত, পিতামহ-সিদ্ধান্ত, বশিষ্ট সিদ্ধান্ত ইত্যাদি জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রন্থগুলিকে একত্রে সিদ্ধান্ত জ্যোতিষ বলা হত। এর মধ্যে রোমক-সিদ্ধান্ত, পৌলিশ-সিদ্ধান্ত, যবন-সিদ্ধান্ত ইত্যাদি গ্রন্থে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ পরবর্তী যুগের গ্রিক, রোমান জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের পরে ভারত এবং ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্য যোগাযোগ স্থাপিত হওয়া এবং তার ফলে সাংস্কৃতিক আদান প্রদান শুরু হওয়ার কারণে এই প্রভাব সম্ভব হয়েছে। লক্ষ্যণীয়, ভারতীয় সাহিত্যে প্রথম এই গ্রন্থগুলোতেই জ্যোতিষ চর্চার (অর্থাৎ একজন ব্যক্তির জন্মের সময় গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের ভিত্তিতেই তার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হওয়ার কল্পিত ধারণা এবং অশুভ শক্তির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য গ্রহ-শান্তির ধারণা সংক্রান্ত চর্চা) উল্লেখ দেখা যায়। তাই এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, জ্যোতিষ নামক কুসংস্কারটি পশ্চিম থেকেই আমদানি হয়েছিল।

‘সিদ্ধান্ত জ্যোতিষ’ বইগুলিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পাওয়া যায়। সেটি হল সূর্য, চন্দ্র ও গ্রহগুলির আবর্তনকাল সঠিকভাবে নির্ণয়ের প্রচেষ্টা। যদিও তার লেখার পদ্ধতি ছিল অন্য রকম। সেইসময় পৃথিবী যে সূর্যের চারিদিকে ঘোরে তা জানা ছিল না, বা পৃথিবীর নিজের চারিদিকে ঘূর্ণনও ছিল অজানা। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের নিজেদের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর যে আবর্তনকাল নির্ণয় করেছিলেন, তা (365.3216 দিন) আধুনিক হিসেবের (365.25৪ দিন) খুব কাছাকাছি ছিল। একইভাবে তাঁরা চন্দ্র ও গ্রহগুলির আবর্তনকাল গণনা করেছিলেন।

সিদ্ধান্ত জ্যোতিষ পর্যায়ের পরে ভারতে বেশ কয়েকজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও গণিতজ্ঞের আবির্ভাব হয়েছিল। এরা হলেন আর্যভট (পঞ্চম শতক), বরাহমিহির (ষষ্ঠ শতক), ব্রহ্মগুপ্ত (সপ্তম শতক), এবং ভাস্করাচার্য (দ্বাদশ শতক)। অন্যান্য দেশের জ্ঞানের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বৈদিক পরবর্তী যুগের প্রথমদিকে যে জ্ঞানভাণ্ডার তৈরি হয়েছিল তা ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে জোয়ার এনেছিল।

আর্যভটের সময় থেকেই সিদ্ধান্তিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের শুরু। সিদ্ধান্ত কথাটির অর্থ নিষ্পত্তি, অর্থাৎ যার ফলাফল প্রতিষ্ঠা করা গেছে। সিদ্ধান্তিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য হল বীজগণিত, জ্যামিতি ও ত্রিকোণমিতির গাণিতিক পদ্ধতির সাহায্যে গ্রহ ও নক্ষত্রগুলির অবস্থান নির্ণয়ের চেষ্টা। সেইজন্য এইসময়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং গণিতের বিকাশ একত্রে হয়েছিল।

এই যুগের জ্যোতির্বিদ আর্যভটই প্রথম পৃথিবীর আহ্নিকগতির কথা বলেছিলেন। অর্থাৎ সূর্য যে পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছে না, পৃথিবীর আহ্নিকগতির ফলেই তাকে আমরা চলমান দেখি - তা তিনিই প্রথম অনুমান করেছিলেন। যদিও তিনি টলেমির ভূ-কেন্দ্রিক ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি কিন্তু সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণের সঠিক ব্যাখ্যাই দিয়েছিলেন।

এযুগের অন্যান্য জ্যোতির্বিদদেরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। কিন্তু প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরের জন্য এখানে উল্লেখ করা হল না।

গণিতের ক্ষেত্রে বেদ-পরবর্তী যুগের শুরুতে জৈন দার্শনিকদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। খ্রি:পূ: 400 থেকে খ্রি:পূ: 200 সালের মধ্যবর্তী সময়ে এই দার্শনিকরা সংখ্যার ধারণার উন্নতি ঘটান। যদিও তখনও শূন্যের আবিষ্কার হয়নি, তবু তাঁরা অতি বৃহৎ সংখ্যা সম্পর্কে খুবই আগ্রহী ছিলেন এবং অসীম সম্পর্কে ধারণা করতে পেরেছিলেন। খ্রি:পূ: তৃতীয় শতকে গণিতজ্ঞ পিঙ্গলার লেখায় সংখ্যাতত্ত্বের অনেক সূত্র পাওয়া যায়। এমনকি পরবর্তীকালে যা পাসকালের ত্রিভুজ ও ফিবোনাচি সংখ্যা বলে পরিচিত হয়, অর ইঙ্গিত এর লেখায় পাওয়া যায়। জৈন গণিতজ্ঞদের অবদানের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, তাঁরা গণিতকে ধর্ম ও ধর্মীয় আচার আচরণের প্রভাব থেকে মুক্ত করে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন।

জ্ঞানজগতে ভারতের সবচেয়ে মহত্তম অবদানটি ঘটেছিল এই সময়েই। সেটি হল শূন্যের আবিষ্কার এবং সংখ্যা লেখার ক্ষেত্রে স্থানিক মসন পদ্ধতি (place value system)। এই পদ্ধতি আবিষ্কারের আগে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পদ্ধতি চালু ছিল। সেগুলি ছিল অনেক জটিল এবং কষ্টসাধ্য। কিন্তু শূন্য ও স্থানিক পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে অতি সহজেই মাত্র 10 টি সংখ্যা-চিহ্নের সাহায্যে যেকোনও বড় সংখ্যা লিখতে পারা সম্ভব হল।

আর্যভট তাঁর লেখা বইয়ে গণিতের নানাদিক, যেমন বর্গমূল, ঘনমূল, সমান্তরশ্রেণী, সমীকরণের সমাধান প্রভৃতি নানা বিষয় আলোচনা করেছেন।

ভারতীয় গণিতজ্ঞদের আর একটি বড় অবদান রয়েছে অনির্ণেয় সমীকরণের ক্ষেত্রে। কোনও একটি সমীকরণে দুটি অজানা রাশি থাকলে সাধারণভাবে সেগুলি নির্ণয় করা যায় না। কিন্তু ব্রহ্মগুপ্ত, শ্রীপতি এবং ভাস্কর দেখান যে, বিশেষ ক্ষেত্রে, যেমন রাশিদুটি পূর্ণসংখ্যা হলে এরকম সমীকরণের সমাধান সম্ভব।

এই যুগের আর একটি বড় অবদান রয়েছে ভাষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে। সংস্কৃত কখনও কথ্য ভাষা ছিল না। পালি, প্রাকৃত ইত্যাদি কথ্য ভাষাকে শুদ্ধ করে এই ভাষার জন্ম। ভাষাতত্বে এই শুদ্ধকরণই একটি বড় কৃতিত্ব। এই কাজটি হয়েছে বেদ পরবর্তী যুগে। যখন বেদ লেখা হয় তখনও সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণের নিয়মগুলি নির্ধারিত ছিল না। সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণের নিয়মগুলি স্পষ্ট করে লিখে ফেলার কাজটি কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করেন পানিনি (চতুর্থ শতক)। তাই তাঁকে প্রাচীনকালের শ্রেষ্ঠ ভাষা ও ব্যাকরণবিদ বলা হয়।

বেদোত্তর যুগের মূল অবদানগুলি সংক্ষেপে দেওয়া হল। বিস্তারিত জানতে ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি প্রকাশিত অন্যান্য পুস্তক দ্রষ্টব্য।

সংস্কৃত ভাষায় কি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব?

এবার ইসরোর চেয়ারম্যানের দাবিটি খতিয়ে দেখা যাক। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, এই ধারণাটি যে ইসরো চেয়ারম্যানের নিতান্ত ব্যক্তিগত ধারণা নয়, তা বোঝা গেল জাতীয় শিক্ষানীতি 2020 কার্যকরী করার জন্য ইউ জি সির একের পর নির্দেশ থেকে।

এটা ঠিক যে, বেদোত্তর যুগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল ভাষাবিজ্ঞানের বিকাশ। পানিনির ব্যাকরণ সংস্কৃত ভাষাকে বৈদিক সংস্কৃতের তুলনায় সহজ করেছিল, বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দিয়েছিল। তাই সেই সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। কিন্তু তার অর্থ কি এই যে, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা সংস্কৃত ভাষায় সম্ভব? আমরা জানি, ভাষা হল চিন্তার বাহন। তাই উন্নত ভাষা উন্নত চিন্তার বাহন। সেজন্যই আমরা দেখেছি, এদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যাঁরা লড়াই করেছিলেন, তাঁরা কেউই ইংরেজি ভাষা শিক্ষার বিরোধিতা করেননি।

তাই এদেশে রেনেসাঁসের বার্তা-বাহক রামমোহন রায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষাদানের বিরোধিতা করেছিলেন। নিজে সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত হয়েও বলেছিলেন, “সংস্কৃত শিক্ষাব্যবস্থা দেশকে অন্ধকারে নিমগ্ন রাখার একটি সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ”। তিনি বলেন, “যে বৈদিক মতবাদ বিশ্বাস করতে শেখায় যে, কোনও দৃশ্যমান বস্তুরই বাস্তব অস্তিত্ব নেই, তা যুবকদেরকে সমাজের উন্নত সদস্য হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উপযোগী হবে না”। তিনি আরও বলেন, “এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সরকার হিন্দু পণ্ডিতদের তত্ত্বাবধানে ইতিমধ্যেই ভারতবর্ষে যে সব বিষয় চালু রয়েছে, সেগুলি পড়ানোর জন্য সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করছে।… ছাত্রছাত্রীরা সেখানে দুহাজার বছর আগে যা জানা ছিল সেই সব জ্ঞানই শুধু অর্জন করবে”।…এটা সর্বজনবিদিত যে, সংস্কৃত ভাষা - যা এত কঠিন যে, তা সঠিকভাবে আয়ত্ত করার জন্য একজন মানুষের প্রায় পুরো জীবৎকালই প্রয়োজন, জ্ঞানের বিকাশের পথে যুগ যুগ ধরে তা গভীর অন্তরায় সৃষ্টি করেছে এবং প্রায় অভেদ্য পর্দার অন্তরালে অর্জিত এই জ্ঞান এই ভাষা আয়ও করার জন্য ব্যয়িত শ্রমের মর্যাদা দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়”।

একইভাবে ভারতীয় রেনেসাঁর বলিষ্ঠতম ব্যক্তিত্ব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সংস্কৃত ভাষা ব্যবহারের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কতকগুলি কারণে সংস্কৃত কলেজে বেদান্ত ও সাধ্যে আমাদের পড়াতেই হয়। কিন্তু সাংখ্য ও বেদান্ত যে ভ্রান্ত দর্শন সে সম্বন্ধে এখন আর বিশেষ মতভেদ নেই। তবে ভ্রান্ত হলেও এই দুই দর্শনের প্রতি হিন্দুদের গভীর শ্রদ্ধা আছে। সংস্কৃতে যখন এইগুলি পড়াতেই হবে, তখন তার প্রতিষেধক হিসাবে ছাত্রদের ভালো ভালো ইংরেজি দর্শনশাস্ত্রের বই পড়ানো দরকার’। তিনি বলেছিলেন, “সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে গণিত শিক্ষা না দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। একথা থেকে যেন মনে করা না হয় যে, আমি শিক্ষার ব্যাপারে গণিতবিদ্যার যথাযথ গুরুত্ব দিই না। বিষয়টা ঠিক তার উল্টো। আমি চাই গণিতটা ইংরেজিতে পড়ানো হোক। কারণ সে ক্ষেত্রে সংস্কৃত ভাষায় যতটা সময় দিয়ে একজন ছাত্র যে পরিমাণ জ্ঞান অর্জন করে, তার অর্ধেক সময়ে সে তার দ্বিগুণ জ্ঞান সঞ্চয়ে সক্ষম হবে”।

এমনকী যে বিবেকানন্দকে ইসরো চেয়ারম্যানের মতো সঙ্ঘ সমর্থকরা অনুসরণ করেন বলে থাকেন, সেই বিবেকানন্দ কী বলছেন? বিবেকানন্দ বলছেন, “আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকে সংস্কৃতে সমস্ত বিদ্যা থাকার দরুন বিদ্বান ও সাধারণের মধ্যে একটা অপার সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে।...... পাণ্ডিত্য অবশ্য উৎকৃষ্ট; কিন্তু কটমট ভাষা যা অতিপ্রাকৃত, কল্পিতমাত্র, তাতে ছাড়া কি আর পাণ্ডিত্য হয় না? চলিত ভাষায় কি শিল্প-নৈপুণ্য হয় না?.....আমাদের ভাষা সংস্কৃত-র গদাই লস্করি চাল - এই চাল নকল করে অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে”।

তাহলে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? আমাদের দেশে যাঁরা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাঁরা সকলেই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সংস্কৃত ভাষাকে পরিত্যাগ করার কথা বলেছিলেন। তাঁরা সকলেই আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষাকে ব্যবহার করার কথা বলেছিলেন। যদিও আমরা জানি, রামমোহন-বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ- শরৎচন্দ্র সহ অনেকেই ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি বাংলা ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু সংস্কৃত ভাষার ক্ষেত্রে সেই ধরণের বিকাশ হয়েছে কি? তাহলে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা সংস্কৃত ভাষায় কীভাবে সম্ভব?

বেদোত্তর যুগের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের পরে নবম-অষ্টাদশ শতকে বিজ্ঞানচর্চা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল কেন?

বৈদিক যুগের প্রকৃত অবদান ঠিক কোথায়, সেটা জানার প্রয়োজন আছে। কারণ, সেটা না জানলে তার ধারাবাহিকতায় কিভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঘটেছে, তা জানা সম্ভব নয়। আবার একথাও সত্য যে, যে ভারতবর্ষে একসময় (বেদোত্তর যুগে) জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটেছিল, সেই ভারতবর্ষেই নবম-দশম শতাব্দীর পর বিজ্ঞান চর্চা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল কেন এবং তার দু’এক শতাব্দী পরে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কেন, সেই প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজতে হবে। নাহলে বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে আজ প্রকৃত বাধা কোথায় সেকথা বুঝতে পারা যাবে না। দুঃখের বিষয় ইসরোর চেয়ারম্যানের মতো পদাধিকারীরা সেই বিষয়ে কর্ণপাত করছেন না। করার কথাও নয়। কারণ একটা বিশেষ মতকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই বর্তমান ভারত সরকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা সংস্থার মাথায় একটি বিশেষ মতে বিশ্বাসী (পড়ুন হিন্দুত্ববাদী) লোকদেরই বসাচ্ছে। না হলে আইআইটি (খড়গপুর)-এর মত প্রতিষ্ঠান ইতিহাসকে বিকৃত করার জন্য ক্যালেন্ডার প্রকাশ করতে পারত কি? বা আইআইটি (গৌহাটি)'র মতো প্রতিষ্ঠান গো-বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার কথা ভাবতে পারত কি? কিংবা এনসিইআরটি দশম শ্রেণীর বিজ্ঞানের সিলেবাস থেকে ডারউইনের বিবর্তনবাদ ও পর্যায় সারণী বাদ দিত কি?

আমাদের দেশে যাঁরা মধ্যযুগীয় অন্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই করে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছিলেন, তাঁদেরকেও এই ধরনের চিন্তার বিরোধিতা করে এগোতে হয়েছিল। তাই স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা পর্যায়ে হিন্দুধর্ম পুনরুত্থানবাদী মতাদর্শের প্রভাবে একদল মানুষ যখন ‘সবই বেদে আছে’ জাতীয় ভাবনা পোষণ করতেন, তখন তার বিরুদ্ধে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা কলম ধরেছিলেন, লিখেছিলেন ‘সবই ব্যাদে আছে’ শীর্ষক বিখ্যাত প্রবন্ধ। আর এই ধরণের লোকজনদের দেখে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “সায়েন্সে ডিগ্রিধারী পণ্ডিত এদেশে বিস্তর আছে, যাদের মনের মধ্যে সায়েন্সের জমিটা তলতলে; তাড়াতাড়ি যা-তা বিশ্বাস করতে তাদের অসাধারণ আগ্রহ। মেকি সায়েন্সের মন্ত্র পড়িয়ে অন্ধ সংস্কারকে সায়েন্সের জাতে তুলতে তারা কুণ্ঠিত হয় না”।

এরপরের প্রশ্ন হল, নবম-দশম শতাব্দীর পরে ভারতবর্ষে বিজ্ঞানচর্চা স্তিমিত হয়ে গেল কেন? ইসরোর চেয়ারম্যান-এর মতো কর্তাব্যক্তিরা এর উত্তর দিতে উৎসাহী না হলেও বহুদিন আগেই এর উত্তর দিয়েছিলেন আচার্য্য প্রফুলচন্দ্র রায়। তিনি এর কারণ হিসেবে তিনটি বিষয়ের উল্লেখ করেছিলেন।

  • প্রথমত, জাতিভেদ প্রথার কঠিনরূপে আত্মপ্রকাশ।
  • দ্বিতীয়ত, মনু এবং শেষেরদিকের পুরাণগুলিতে কী করা চলবে, কী করা চলবে না - এসব কঠিনভাবে বেঁধে দেওয়া। যেমন, মনুর মতে দ্বিজদের ক্ষেত্রে মৃতদেহ স্পর্শ করা নিষিদ্ধ। আর সুশ্রুত বলছেন মানবদেহ ভালো করে জানতে হলে শব ব্যবচ্ছেদ জরুরি।
  • তৃতীয়ত, চিন্তাশীল মানুষদের উপর বেদান্ত দর্শনের প্রভাব, যা মানুষকে চারপাশের এই বস্তুজগতকে মায়া বা ভ্রমমাত্র বলে দেখতে শেখায়।

আর একটি বিষয়ও উল্লেখ করার দরকার। বৈদিক যুগে শিক্ষাদানের পদ্ধতি ছিল ব্যক্তিগত। একজন ঋষি বা জ্ঞানী ব্যক্তি নিজের গৃহে কিছু ছাত্রকে শিক্ষা দিতেন। ছাত্ররা কয়েক বছর গুরুগৃহেই থাকত, গৃহস্থালির কাজ থেকে শুরু করে গরুর দেখাশুনা বা চাষবাসের কাজ করে দিত এবং তার বিনিময়ে শিক্ষালাভ করতো। তাই সেই অর্থে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেই সময় ছিল না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদানের পদ্ধতি শুরু হয়েছিল বৌদ্ধযুগে। বৌদ্ধমঠ ও স্তূপগুলি জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল, যেখানে বহুসংখ্যক শ্রমণ ও ভিক্ষু একত্রে বাস করতেন এবং জ্ঞানের আদানপ্রদান করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে কয়েকটি শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে ওঠে, যেখানে বহুসংখ্যক শিক্ষক এবং ছাত্র একত্রে বসবাস করতেন এবং শিক্ষকরা শিক্ষাদান করতেন। এদের মধ্যে গান্ধার দেশের (বর্তমানে পূর্ব আফগানিস্তানের কান্দাহার) রাজধানী তক্ষশীলা এবং নালন্দা উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি সবচেয়ে প্রাচীন, যা খ্যাতিলাভ করে বুদ্ধের সময়কালে। দ্বিতীয়টি গড়ে উঠেছিল পরবর্তীকালে মগধ রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায়। এছাড়াও তুলনায় ছোট শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল ওড়িশায় পুস্পগিরি, বিহারের ওদন্তপুরী ও বিক্রমশিলা, বাংলায় জগদ্দল, গুজরাটে বলভী ইত্যাদি। সেই সময় এই সমস্ত শিক্ষাকেন্দ্রের সুনাম বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং দেশ-বিদেশ থেকে অনেকেই শিক্ষাগ্রহণের জন্য এসব জায়গায় আসতেন।

অষ্টম-নবম শতাব্দীতে শঙ্করাচার্যের হাত ধরে যখন বেদান্ত দর্শনকে ভিত্তি করে হিন্দু ধর্মের প্রবল জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, তখন সেই সময় প্রচলিত বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে কার্যত ক্রুসেড ঘোষণা করা হয়েছিল। বৌদ্ধমঠগুলিকে বলপূর্বক ধ্বংস করা হয়েছিল। ফলে বৌদ্ধধর্মকে ভিত্তি করে যে শিক্ষাকেন্দ্রগুলো গড়ে উঠেছিল, সেগুলোও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। জ্ঞানচর্চার বিকাশের ক্ষেত্রে এই ঘটনাও বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।

এইসব কারণেই নবম-দশম শতকের পরে প্রায় আট- ন’শো বছর বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে তেমন কোনও অগ্রগতি ঘটেনি। এই অবস্থার পরিবর্তনের সূচনা হয় উনবিংশ শতাব্দীতে নবজাগরণ আন্দোলনের প্রভাবে। রামমোহন- বিদ্যাসাগরের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এদেশের বুকে যুক্তিবাদী চিন্তার যে বাতাবরণ তৈরি হয়, তার উপর ভিত্তি করেই আধুনিক বিজ্ঞানচর্চা শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা জগদীশচন্দ্র, প্রফুলচন্দ্র, সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের পেয়েছি।

কিন্তু এখন যারা শাসনক্ষমতায়, তারা দেশকে বোধহয় আবার মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে, যাতে জ্ঞানচর্চার প্রকৃত পরিবেশকে ধ্বংস করা যায়। কেননা, জ্ঞানের আলো অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষের দৃষ্টিকে আলোকিত করলে শাসকদেরই সমস্যা। এইজন্যই তারা আজকে একদিকে যেমন বিজ্ঞান শিক্ষাকে বিপথগামী করছে, তেমনি বিজ্ঞান গবেষণাকে। রুদ্ধ করছে, যেটুকু গবেষণা হচ্ছে, তার বিষয়বস্তুও তারা তাদের হিন্দুত্ববাদী ধ্যান-ধারণাগুলো নিজেদের মর্জিমত ঠিক করে দিচ্ছে।

বিজ্ঞানচর্চার বিকাশের পথে মুসলিমদের আক্রমণের কি কোনও ভূমিকা ছিল?

হিন্দুত্ববাদীদের আর একটা দাবি হল, মুসলিম আক্রমণকারীরাই এদেশে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার উন্নত ধারাকে ধ্বংস করেছে। মুসলিম শাসকরা বিজ্ঞানের সমস্ত গ্রন্থ এবং প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে এই কাজটি সম্পন্ন করেছিল। এই দাবি কতটা সত্য, তা বিচার করে দেখা দরকার। আর এটা বিচার করার জন্য প্রয়োজন ঐতিহাসিক ঘটনাক্রম সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ ধারণা। দেখা যাক, সেই ঘটনক্রমটি কেমন ছিল।

আমরা আগেই দেখেছি, নবম-দশম শতাব্দীতে এদেশে জ্ঞানচর্চা স্তিমিত হতে থাকে এবং দ্বাদশ শতাব্দীর পরে তা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর এদেশে মুসলিম শাসনের সূচনা কবে হয়েছিল?

যে সময়কালে এদেশে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা বন্ধ হয়েছিল, সেই সময় এদেশে বাস্তবে কি কোনও মুসলিম শাসন বলবৎ ছিল? ইতিহাস বলছে যে, ঐ সময় মুসলিম শাসকরা কেবলমাত্র ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের রাজ্যগুলি আক্রমণ করেছে। তখনও উপমহাদেশের বৃহত্তর অংশে তারা তাদের শাসন কায়েম করতে পারেনি। একাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ঘজনীর মামুদ গান্ধারের হিন্দু রাজবংশের রাজা জয়পালকে পরাস্ত করে পেশোয়ার (বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থিত) পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল। এটাই ছিল প্রথম মুসলিম আক্রমণ। এরপর 1173 সালে মহম্মদ ঘোরি আফগানিস্তানের ঘোর অঞ্চল থেকে প্রবল আক্রমণ করে এবং 1187 সালে ঘজনী রাজাদের পরাস্ত করে ভারতের পশ্চিম অংশ পর্যন্ত তার সাম্রাজ্য বিস্তার করে। 1206 সাল নাগাদ দিল্লীতে সুলতানরাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ঘোরির এক প্রাক্তন ক্রীতদাস কুতুবউদ্দিন আইবক দিল্লীর প্রথম সুলতান হন। এরপর 1398 সালে তৈমুর লঙ দিল্লী আক্রমণ করে লুঠতরাজ চালায়, কিন্তু দিল্লীতে শাসন প্রতিষ্ঠা করেনি। এর অনেক পরে বাবর 1526 সালে ভারতে প্রবেশ করে এবং মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। মোগল সম্রাটরাই প্রথম ভারতের অধিকাংশ স্থান দখল করতে সমর্থ হয়।

ফলে নবম শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ভারতের ইতিহাস বলছে যে, এদেশে বিজ্ঞানচর্চার অধঃপতন শুরু হওয়ার অনেক পরে মুসলিম শাসকদের শাসন প্রতিষ্ঠার সূচনা হয়। তাই ভারতে বিজ্ঞানচর্চার অধঃপতনের সাথে মুসলিম শাসনের কোনও যোগ থাকতে পারে না।

বরং আমরা দেখেছি যে, মুসলিম পণ্ডিতরাই এদেশে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় যে অগ্রগতি ঘটেছিল, তাকে সংরক্ষিত করা ও বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এঁদের মধ্যে আল-খোয়ারিজমি শূন্যের ধারণা ও স্থানিক সংখ্যা পদ্ধতি মুসলিম জগতে নিয়ে যান এবং সেখান থেকে আরবীয় গ্রন্থের মাধ্যমে দ্বাদশ শতাব্দীতে ইউরোপ এই জ্ঞান লাভ করে। আর এক পণ্ডিত আল-বিরুনি নির্বাসনকালে সংস্কৃত শিক্ষালাভ করেন এবং 1035 সালে ব্রহ্মগুপ্তের ‘ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত’ গ্রন্থটির অনুবাদ করেন, যা ‘সিন্ধ-হিন্দ’ নামে পরিচিত হয়। এই গ্রন্থটি ভারতীয় বিজ্ঞান, দর্শন ও জ্যোতির্বিদ্যার একটি এনসাইক্লোপিডিয়া হিসেবে পরিচিত ছিল। বাস্তবে আরব সাম্রাজ্য ভারতীয় বিজ্ঞানকে শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করেছিল এবং এখান থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিল। তাই হিন্দুত্ববাদীদের এই দাবি কি বিশ্বাসযোগ্য?

বৈদিক যুগে বা প্রাচীন ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানের সবকিছুই ছিল - এটা কি বাস্তব?

বৈদিক যুগে এবং তার পরবর্তীকালে বিজ্ঞানের অগ্রগতি কতটা ঘটেছিল, তা আমরা সংক্ষেপে রেখেছি। তা থেকে কি মনে হয় যে, আধুনিক বিজ্ঞানের সবকিছুই বেদেই রয়েছে?

আরও কয়েকটি বিষয় ভেবে দেখতে বলব। প্রথমত, এই যে উদ্ভট দাবিগুলো করা হচ্ছে, তার সময়কালটা খেয়াল করুন। এই দাবিগুলো করা হছে কখন? যখন আধুনিক বিজ্ঞান কিছু আবিষ্কার করেছে, তার পরে। রাইট ভ্রাতৃদ্বয় এরোপ্লেন আবিষ্কারের আগে কেউ দাবি করেনি যে, প্রাচীনকালে ভারতে মুনি-ঋষিরা দ্রুতগামী এরোপ্লেনে যাতায়াত করত। 1980 সালে ইন্টারনেট আবিষ্কারের আগে কেউ দাবি করেনি যে, সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ধারাবিবরণী শুনিয়েছিল। বা, স্টেম সেল নিয়ে গবেষণার আগে কেউ বলেনি যে, কর্ণের জন্ম হয়েছে স্টেম সেল টেকনোলজি ব্যবহার করে।

দ্বিতীয়ত, যদি আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চা প্রাচীনকালেই হত, তাহলে তাকে ভিত্তি করে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হত। কিন্তু এরকম কোনও আবিষ্কার বাস্তবে হয়নি।

তৃতীয়ত, আমরা জানি যে, যেকোনও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের আগে বিজ্ঞানের জগতে তার জন্য প্রয়োজনীয় বিকাশ হতে হয়। যেমন এরোপ্লেন তৈরির জন্য প্রয়োজন এরো-ডাইনামিক্স, থার্মো-ডাইনামিক্স, ইঞ্জিন, বস্তুর ধর্ম সংক্রান্ত ধারণা, সলিড মেকানিক্স, নেভিগেশন টেকনোলজি প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান এবং তারপর বিভিন্ন শাখা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের সমন্বয় সাধন। তাই কেউ যদি দাবি করেন যে, প্রাচীন ভারতে এরোপ্লেন ছিল, তাহলে তাঁকে দেখাতে হবে যে, প্রাচীন ভারতে থার্মোডিনামিক্সের নিয়ম বারনৌলির প্রিন্সিপল জানা ছিল। কিন্তু কেউই তা দেখাতে পারেননি। এরকম অন্যান্য ক্ষেত্রেও কোনও দাবি করার সময় কেউই তার জন্য প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক বিকাশের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন না। কারণ বাস্তবে এই ধরণের অগ্রগতি প্রাচীন ভারতে ঘটেনি।

চতুর্থত, কোনও বস্তুগত তথাও কেউ হাজির করতে পারেননি। যদি প্রাচীনকালে এধরণের কোনও এরোপ্লেন থাকতো, তাহলে তার কোনও না কোনও ধ্বংসাবশেষ কোথাও না কোথাও পাওয়া যেত। কিন্তু এরকম কিছু কোথাওই পাওয়া যায় নি। একইভাবে যদি মহাভারতের যুদ্ধে আধুনিক অস্ত্র ব্যবহৃত হত, তাহলে কুরুক্ষেত্রে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মধ্য দিয়ে তার কোনও অবশেষ অবশ্যই পাওয়া যেত। কিন্তু এরকম কোথাও কিছু পাওয়া যায়নি।

উপসংহার

এতক্ষণের আলোচনায় এটা পরিষ্কার যে, সংস্কৃত ভাষাকে উন্নত জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় যে, কেন্দ্রীয় সরকারের নেতা-মন্ত্রী আধিকারিকরা এই পরামর্শ দিচ্ছেন কেন এবং তাকে কার্যকরী করার উদ্যোগ নিচ্ছেন কেন? যদি বলি যে, দেশের নবীন প্রজন্মকে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার জন্যই এই উদ্যোগ, তাহলে সেটা খুব ভুল হবে কি? একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে যে, জ্ঞানচর্চার মাধ্যম হিসেবে একটা অনুন্নত ভাষা ব্যবহার করার অর্থই হল। জ্ঞানচর্চার সুযোগ থেকে শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করা।

একইভাবে একথা বলা যায় যে, প্রাচীনকালেই আমাদের মুনি ঋষিরা সবকিছুই চর্চা করে গেছেন - এই মিথকে ছড়িয়ে দিয়ে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পরিবর্তে বৈদিক যুগে কী হয়েছিল, সত্য মিথ্যায় জড়িয়ে তাকেই উর্দ্ধে তুলে ধরার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে পিছন ফিরে চলবার জন্য উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে না কি? তার ফলে লাভ হবে কার? যারা যুক্তিবাদকে ভয় পায়, তারাই লাভবান হবে না কি? তাই এই ধারণাগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়াতেই হবে, না হলে ইতিহাসের কাছে আমরা অপরাধী থেকে যাব।

তাই ভারতীয় বিজ্ঞানের বিকাশের প্রকৃত ইতিহাসকে জানা অত্যন্ত জরুরি। নাহলে বিজ্ঞানের অগ্রগতি আজ কোথায় আটকে আছে তা সম্যকভাবে বোঝা যাবে না; প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং প্রচলিত বিশ্বাসের বন্ধন থেকে বিজ্ঞানের বিকাশের পথকে মুক্ত করা যাবে না।

লেখক পরিচিতি: শ্রী গৌড়ী একজন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক এবং ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির সর্ব-ভারতীয় কমিটির সহ- সভাপতি।

তথ্যসূত্র:

[1] প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞান: কল্পনা ও বাস্তব ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি, 2016।

[2] Indian Knowledge System: The Central Plank of the New Education Policy Breakthrough, Vol-22, No-3, February 2023.

[3] বিজ্ঞানের ইতিহাস সমরেন্দ্রনাথ সেন, শৈবা প্রকাশন, 2008।

[4] A Brief History of Science Soumitro Banerjee, Breakthrough Science Society (2nd Edition), 2020.