বিভাগগুলি

পরিবেশ বিপর্যয় ও খাদ্য সঙ্কট

WFP/Michael Tewelde

সফিক উল আলম

পরিবেশের সঙ্গে খাদ্যশস্য উৎপাদনের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। পরিবেশে যেকোনও ধরণের বিপর্যয়ের প্রভাব তাই সরাসরি খাদ্যশস্য উৎপাদনের উপর প্রভাব ফেলে। সেই পরিবেশের উপর চলছে নানা ধরণের পীড়ন।

সমগ্র পৃথিবী জুড়েই সম্প্রতি পরিবেশগত এই সঙ্কট পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষভাবে দেখা যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ার পরিবর্তন, পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের বিনাশ ও জনসংখ্যার বৃদ্ধি, মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, কৃষিজ পণ্যের উৎপাদনে অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি ইত্যাদি ঘটে চলেছে। এই সমস্ত কারণে খাদ্যশস্যের চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বিগত এক দশকে খাদ্যশস্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে এবং সেই সঙ্গে খাদ্যশস্যের দামও ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। সারা পৃথিবী জুড়ে খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধি ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে ২০০৭-০৮ সাল নাগাদ। ঐ সময় সারা পৃথিবীতে বুভুক্ষু মানুষের সংখ্যা অতীতের সমস্ত পরিসংখ্যানকে ছাপিয়ে যায়।

খাদ্যশস্যের চাহিদা বাড়ছে তার একটি বড় কারণ হল—পৃথিবীতে সামগ্রিকভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। এছাড়া উৎপাদিত খাদ্যশস্য থেকে ইথাইল অ্যালকোহল তৈরি করে তা গাড়ির জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়ে উঠছে না। কেননা বর্তমানে রাসায়নিক উপকরণ ও শিল্পজাত উপকরণ (যেমন রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও বীজ ইত্যাদি) নির্ভর নিবিড় চাষাবাদ অনুসরণ করার ফলে মাটির উৎপাদিকা শক্তি কমে যাচ্ছে, চাষের জন্য প্রয়োজনীয় জল সরবরাহ কমে যাচ্ছে, মাটি ও জলের দূষণ ঘটছে, কৃষিজ পণ্যের একক পরিমাণ জমিতে উৎপাদন মাত্রা একটা বিশেষ সীমার পর আর বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না এবং বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। যদি আগামী দিনে এই প্রবণতা বিপরীতমুখী করা না যায় তাহলে খাদ্যশস্যের দাম বেড়েই চলবে এবং পৃথিবীতে বুভুক্ষু মানুষের সংখ্যাও আরও বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে দেশে ও সমাজে রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্থিতি ও শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে।

খাদ্য সঙ্কটের বর্তমান রূপ

পৃথিবীতে বর্তমানে প্রতিদিন ১০০ কোটিরও অধিক লোক প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করতে পারছে না। অসংখ্য পরিবারকে বহুদিনই উপোস করে থাকতে হয়। এইভাবে খাদ্যের ঘাটতি হওয়ার জন্য ব্যাপক সংখ্যক লোককে সাময়িক বা চিরস্থায়ী অপুষ্টির শিকার হতে হচ্ছে। অপুষ্টির ফলে কম বয়সিদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে। তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে যা পরবতীকালে কোনওভাবেই পূরণ হওয়ার নয়। বর্তমানে ভারতবর্ষে ২৪ শতাংশ, নাইজিরিয়াতে ২৮ শতাংশ ও পেরুতে ১৪ শতাংশ পরিবার খাদ্যহীন দিন অতিবাহিত করছে (একটি আন্তর্জাতিক চ্যারিটি সংস্থা সেভ দ্য চিল্ড্রেন-এর সমীক্ষা অনুযায়ী)। এখন পৃথিবীর জনসংখ্যা ৭২০ কোটি। প্রতি বছর প্রায় ৪ কোটি করে জনসংখ্যা বাড়ছে। ২১.৫ কোটি মহিলা, যারা পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিবার ছোট রাখতে চায়, তারা তা পারছে না। কারণ, এই ধরণের পরিষেবা তাদের কাছে পৌঁছচ্ছে না। পরিবার বড় হলে সাধারণত সেই পরিবারে দারিদ্র্যতা বাড়ে এবং অপুষ্টিও বাড়ে।

২০০৭-এর শুরু থেকে ২০০৮-এর মাঝামাঝি খাদ্যশস্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এরপর খাদ্যশস্যের দাম সাময়িকভাবে কিছুটা কমলেও পরবর্তীকালে খাদ্যশস্যের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। ২০১০-১১ সালে আর এক দফা খাদ্যশস্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এর প্রতিক্রিয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্ত সংক্রান্ত ঘটনাবলী ঘটে। তারপর থেকে খাদ্যশস্যের দাম আরও বেড়ে চলেছে এবং তা অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাপিয়ে যাচ্ছে। আমরা বর্তমানে এমন একটা সময়ে উপস্থিত হয়েছি যখন সারা পৃথিবীতে খাদ্যশস্যের দাম সবসময় ঊর্ধ্বমুখী এবং সেইসঙ্গে বুভুক্ষু মানুষের সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান।

বিশ্বখাদ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ খাদ্য সুরক্ষা বজায় রাখতে পৃথিবীতে বর্তমান সময়ের তুলনায় আরও ৭০ শতাংশ বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে হবে — দানাশস্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে ২১০ কোটি টন থেকে ৩০০ কোটি টনে ও মাংসের উৎপাদন বাড়াতে হবে ২৭ কোটি টন থেকে ৪৭ কোটি টনে।

কিন্তু বিভিন্ন পরিবেশগত ও আর্থসামাজিক সমস্যার কারণে ফসলের উৎপাদনের হার আর বাড়ানো যাচ্ছে না। যদিও ১৯৫০ সাল থেকে ২০১০ সাল নাগাদ একক জমিতে শস্য উৎপাদনের হার তিনগুণ বেড়েছে। ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাৎসরিক ফলন বৃদ্ধির হার ছিল ২.২ শতাংশ, ১৯৯০ সাল থেকে ২০১১ পর্যন্ত এই হার ছিল ১.৩ শতাংশ। উন্নত দেশগুলিতে শস্য উৎপাদনের হার সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে গেছে — যা বাড়ানোর আর সম্ভাবনা নেই। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ধানের ফলন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও জার্মানিতে গমের ফলন চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছে গেছে।

যে সমস্ত পরিবারে তাদের রোজগারের ৫০-৭০ শতাংশ খরচ হয় খাদ্য কেনার জন্য, খাদ্য শস্যের দাম বাড়তে থাকলে সেই সমস্ত পরিবারকে আংশিকভাবে না খেয়ে থাকতে হয়। অনেক দেশ যারা খাদ্য রপ্তানি করত, দেশের মধ্যে খাদ্যশস্যের চাহিদা বাড়ার ফলে তারা খাদ্য রপ্তানি হ্রাস করতে বাধ্য হচ্ছে। এর ফলে সেই সমস্ত অল্প আয়ের দেশগুলি যারা খাদ্য আমদানির উপর নির্ভরশীল তারা আর প্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানি করতে সক্ষম হবে না — এই ধরনের বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমরা খুব শীঘ্রই উপনীত হব। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের খাদ্যাভ্যাসও পাল্টাচ্ছে। সারা বিশ্বজুড়েই আমিষ বিশেষ করে প্রাণীজ প্রোটিনের (মাংস ও মাছ) চাহিদা বেড়েছে। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৩০০ কোটি লোক আরও বেশি পরিমাণে মাংস, দুধ, মাছ ও ডিম খেতে চাইছে। এই সমস্ত প্রাণীজ প্রোটিন খাদ্য তৈরি করার জন্য অতিরিক্ত দানাশস্য দরকার হয়ে পড়েছে। প্রসঙ্গত, উন্নত দেশগুলির বাণিজ্যিক পশুখামারে এক কেজি গরুর মাংস উৎপাদন করতে প্রায় ১০ কেজি দানাশস্য খাওয়ানো হয়; এক কেজি শূকরের মাংস উৎপাদন করতে ৩.৫ কেজি দানাশস্য ও এক কেজি মুরগির মাংস উৎপাদনে ২ কেজি দানাশস্য প্রয়োজন হয়। যদিও তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে (যেমন ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ইত্যাদি) গরুর মাংস ও দুধ উৎপাদনে খুব বেশি দানাশস্য খাওয়ানো হয় না; এই দেশগুলিতে মূলত বিভিন্ন ফসলের অবশিষ্টাংশ ও ভুসি খাইয়ে গো-পালন করা হয়। প্রসঙ্গত, ভারত দুধ উৎপাদনে পৃথিবীতে প্রথম স্থান অধিকার করে (২১.১ কোটি টন)। পৃথিবীতে বর্তমানে শূকরের সংখ্যা ১০০ কোটি, এর ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ৫০ কোটি রয়েছে চিনে, যাদের মূলত সয়াবিন ও অন্যান্য দানাশস্য মিশিয়ে তৈরি খাবার খাইয়ে পালন করা হয়। পৃথিবীতে সয়াবিনের যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয় তার ৫০ শতাংশ আমদানি করে চিন।

খাদ্য সুরক্ষা বজায় রাখার জন্য ও খাবারের দামে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য পৃথিবীতে অন্তত ১১০ দিনের (পরবর্তী ফসল না ওঠা পর্যন্ত) সঞ্চয় থাকা দরকার। কিন্তু বর্তমানে পৃথিবীতে ৭০ দিনের বেশি খাদ্য মজুত রাখা সম্ভব হচ্ছে না। খাদ্য উৎপাদন বাড়ার জন্য ১৯৯০ এর দশকে পৃথিবীতে বুভুক্ষু মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে, ১৯৯৭ সালে যাদের সংখ্যা ছিল ৭৯.২ কোটি। কিন্তু এরপর থেকেই নিরন্ন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। পৃথিবীতে যাদের আয় কম, খাদ্যশস্যের দাম দ্বিগুণ বা তার বেশি হয়ে যাওয়ায় তারা সমস্যায় পড়েছেন। (প্রসঙ্গত বর্তমানে পৃথিবীতে ৩০০ কোটি লোকের দৈনিক গড় আয় ১৫৫ টাকার কম এবং ১২০ কোটি লোকের দৈনিক গড় আয় ৭৭.৫ টাকার কম)। ২০০৬ সালে প্রকাশিত অর্জুন সেনগুপ্ত কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতবর্ষের ৭৭ শতাংশ জনগণ দৈনিক ২০ টাকার বেশি খরচ করতে পারে না। ভারতবর্ষে ৪৮ শতাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার, এবং সমীক্ষায় দেখা গেছে এই অপুষ্টির জন্য ঐ সমস্ত শিশুদের আই কিউ (বুদ্ধ্যংক) স্বাভাবিক পুষ্টি পায় এমন শিশুদের তুলনায় ১০-১৫ শতাংশ কম। দরিদ্র পরিবারে শিশুরা লেখাপড়ার সুযোগও কম পায়, তার জন্যও এই সমস্ত পরিবারের শিশুরা শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না।

বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকটের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে উন্নত বীজ, সার, সেচের জল এবং আরও কিছু কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে এক জোয়ার আসে। ফলস্বরূপ কোনও কোনও দেশে চাহিদা অনুযায়ী কিছুটা ঘাটতি থাকলেও সামগ্রিকভাবে বিশ্বে জনসংখ্যার প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদিত হতে থাকে। সারা বিশ্বে মজুত খাদ্যশস্যের পরিমাণও বেড়ে যায়। খাদ্যশস্যের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। এই সময় বিশ্বে সামগ্রিক খাদ্য সুরক্ষার জন্য দুটি রক্ষাকবচ ছিল। পৃথিবীতে ব্যাপক সঞ্চিত খাদ্য (১১০ দিন বা তারও বেশি) যা পরবর্তী ফসল ওঠা পর্যন্ত মানুষের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম ছিল। আর, পৃথিবীতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন যাতে প্রয়োজনের তুলনায় ব্যাপক বেড়ে না যায় সেজন্য আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছু কৃষি জমি শস্য চাষ না করে পতিত ফেলে রাখা হত। এইভাবে জমি ফেলে রাখার জন্য আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সরকার কৃষকদের ভর্তুকি দিত। যখন পৃথিবীতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় নীচে নেমে যেত, তখন ঐ জমিতে চাষ করা হত। উচ্চফলনশীল জাত চাষ করার ফলে এইসময় অতিরিক্ত উৎপাদন ও মজুত খাদ্যের বিশাল ভাণ্ডার সারা বিশ্বেই খাদ্য সুরক্ষা বজায় রাখত।

১৯৬০ এর দশকের শেষদিকে যখন পৃথিবীতে খাদ্যশস্যের এই প্রাচুর্য দেখা দেয়, তখন পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ২৫০ কোটি। বর্তমানে এই জনসংখ্যা ৭২০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। পৃথিবীতে প্রতিদিন ২১৯০০০ করে জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। ১৯৫০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বিক্ষিপ্তভাবে কখনও কখনও খাদ্যশস্যের দাম বেড়েছে, তবে তার মুখ্য কারণ ছিল আবহাওয়া জনিত কারণে ফসলের উৎপাদন মার খাওয়া। সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্যাপক খরা বা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ তাপপ্রবাহ ঘটলে খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমে যেত। তবে এর প্রভাব হত ক্ষণস্থায়ী। বছর খানেক সময়ের মধ্যেই খাদ্যশস্যের উৎপাদন ও সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যেত। উল্লিখিত দুই রক্ষাকবজের কোনওটিই আর বর্তমানে নেই। ১৯৮৬ সালের পর থেকে অতিরিক্ত খরচের কারণে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র খাদ্যশস্যের জমি অকর্ষিত ফেলে রাখার পরিকল্পনা বন্ধ করে দিয়েছে। ষাটের দশক থেকে শুরু করে সত্তরের দশকে সবুজ বিপ্লব প্রযুক্তি প্রয়োগ করে অনেক খাদ্য আমদানিকারক দেশ খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভর হয়ে ওঠে ও আমেরিকা থেকে খাদ্যশস্য আমদানি কমিয়ে দেয়। সেই সময় সাময়িকভাবে খাদ্যশস্যের বৈদেশিক বাণিজ্যও কমে যায়।

পৃথিবীতে প্রায় ১০০০০ বছর পূর্বে মানুষ স্থায়ীভাবে চাষাবাদ শুরু করে। সেই সময় থেকে সুদীর্ঘকাল যাবৎ, এক মরশুমে উৎপাদিত খাদ্যশস্য থেকে মজুত করা শস্য পরবর্তী মরশুমে খাদ্যশস্য ওঠা পর্যন্ত মানুষের খাদ্য সুরক্ষা বজায় রাখত। সমস্ত দেশে কৃষকসমাজের লক্ষ্য ছিল – কেবলমাত্র পরের ফসল ওঠা পর্যন্ত যথেষ্ট খাদ্যশস্য ফলানো নয়, যাতে প্রয়োজনের তুলনায় আরও কিছু বেশি খাদ্যশস্য মজুত থাকে সেটাও তারা দেখতেন। ১৯৮৬ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জমি পতিত ফেলে রাখার পরিকল্পনা তুলে নেওয়ার পর থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সবসময় গড়ে পৃথিবীতে ১০৭ দিনের প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য মজুত ছিল। কিন্তু ২০০২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এই মজুত খাদ্যশস্যের পরিমাণ গড়ে ৭৪ দিনে এসে দাঁড়িয়েছে এবং এই সংখ্যা ক্রমে আরও কমছে। সেইসঙ্গে পৃথিবীতে মানুষের খাদ্য সুরক্ষার যুগ শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীতে খাদ্যশস্য সরবরাহের ক্ষেত্রে মানুষ বছর আনছে বছর খাচ্ছে ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন দেশে কৃষকেরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চাহিদা অনুযায়ী শস্য উৎপাদন করার ও তা বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু পরিবেশগত ও প্রযুক্তিগত কিছু সমস্যায় বাস্তবে তা সম্ভব হচ্ছে না বা তা করতে গিয়ে বেশ সমস্যা হচ্ছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রাচীনকালে অনেক সভ্যতা (মায়া সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা) গড়ে উঠেছিল, ক্রমে সেই সভ্যতাগুলি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে সেই সভ্যতাগুলি লুপ্ত হওয়ার একটি মূল কারণ হল — তাদের কৃষিজমি ধ্বংস হয়ে যাওয়া ও তার শস্য উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাওয়া। ঐ সমস্ত সভ্যতাগুলি লোপ পেয়েছে মাত্র অল্প কয়েকটি প্রতিকূল কৃষি পরিবেশগত সমস্যার জন্য। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ব উষ্ণায়নসহ আমরা অনেক বেশি পরিবেশগত সমস্যা তৈরি করেছি, ও তৎসহ ব্যাপকভাবে কৃষিজমির অবক্ষয়, ভূমিক্ষয় ও কৃষি বাস্তুতন্ত্রের উৎপাদিকা শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে চলেছি।

পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন কৃষিজমি, জল, জলাশয়, জৈব বৈচিত্র্য ও অরণ্য থেকেই এগুলি ব্যবহার করে মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ বা উৎপাদন করা হয়। কিন্তু বর্তমানে এই সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদগুলি এমনভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যার ফলে এই সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদগুলি হয় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নতুবা এদের উৎপাদিকা শক্তি কমে যাচ্ছে। নিবিড় চাষাবাদ ও পশুপালনের ফলে আফ্রিকা, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তীর্ণ পরিমাণ জমি পতিত হয়ে পড়েছে।

খাদ্যশস্যের বিশ্ববাণিজ্যে অস্থিরতা ও জমি দখলের লড়াই

২০০৮ সালে স্বদেশে দাম বেড়ে যায় বলে রাশিয়া ও আর্জেন্টিনা গম রপ্তানি কমিয়ে দেয়, ভিয়েতনাম চাল রপ্তানি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। ফলে যে সমস্ত দেশগুলি আমদানি করা খাদ্যশস্যের উপর নির্ভরশীল তারা সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। খাদ্য আমদানির জন্য তারা বাজারের উপর নির্ভর করতে ভরসা পায় না। রপ্তানিকারক দেশগুলির সঙ্গে খাদ্যশস্য আমদানির জন্য তারা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু রপ্তানিকারক দেশগুলি আমদানিকারক দেশগুলির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে।

এই পরিস্থিতিতে কিছু ধনী দেশের বেসরকারি কোম্পানি অন্য কিছু দেশে গিয়ে বিশেষ করে ইথিওপিয়া, সুদান ও দক্ষিণ সুদানে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে জমি কিনতে থাকে বা লিজ নিতে শুরু করে, মূলত ঐ সমস্ত জমিতে খাদ্য শস্য ফলিয়ে দেশে বিদেশে খাদ্যশস্যের ব্যবসা করার জন্য। অন্যদিকে এই সমস্ত দেশগুলিতে ব্যাপক সংখ্যায় বুভুক্ষু জনগণ রয়েছে, যারা জাতিসংঘের অনুদানে চলা বিশ্ব খাদ্য পরিকল্পনার মাধ্যমে বেঁচে আছে। যে সমস্ত দেশের বেসরকারি কোম্পানি এই জমি লিজ নিচ্ছে তার মধ্যে মুখ্যত রয়েছে চিন, ভারত, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া ও সংযুক্ত আরব ও আমিরশাহী। অন্যদিকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপের কিছু কোম্পানি বায়োফুয়েল তৈরির জন্য জমি লিজ নিয়ে চলেছে। কিছু কোম্পানি আবার এই সুযোগে এই জমি দখল করার মধ্য দিয়ে বিনিয়োগ করছে যাতে পরে দ্রুত মুনাফা করা যায়। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১১ সাল নাগাদ এই দেশগুলি ১৪ কোটি একর জমি অধিগ্রহণ করেছে। এই জমি দখল করার কাজ উল্লেখিত তিনটি দেশ ছাড়াও মুখ্যত চলছে কেনিয়া, মালি, তাঞ্জানিয়া ও আফ্রিকার আরও কিছু দেশে। এই সমস্ত দেশগুলিতে ২৫ থেকে ৯৯ বছরের মেয়াদে একর প্রতি বছরে এক ডলার মূল্যে ওই সমস্ত জমি অধিগ্রহণ হচ্ছে। আরও কিছু উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ যেমন রাশিয়া, কাজাখস্তান, ইউক্রেন, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন্সও দীর্ঘমেয়াদে জমি লিজ দিচ্ছে।

ইথিওপিয়া একটি অতিশয় দরিদ্র, বিভিন্ন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ দেশ। জনসাধারণের জীবন-যাপনের মান খুবই নিম্ন। বিদেশী বিভিন্ন কোম্পানি এসে এখানকার জমি দখল করার ফলে স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্কট আরও বাড়ছে। এদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়া হচ্ছে। ২০১২ সাল নাগাদ ১০ লক্ষ ইথিওপিয়াবাসীকে তাদের নিজ নিজ বাসস্থানের এলাকা থেকে সরকারিভাবে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। স্থানীয় অধিবাসীদের জমির উপর কোনও আইনগত অধিকার না থাকায় সরকার জোর করে তাদের সরিয়ে দিচ্ছে – তারা এই জমি হস্তান্তরের কোনও বিরোধিতা করতে পারছে না। অধিগ্রহণ করা এই সমস্ত জমিতে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলি বৃহদাকার কৃষিযন্ত্র নিয়ে চাষ শুরু করেছে সেখানে বিশেষ কোনও কর্মসংস্থান হচ্ছে না। উৎপাদিত শস্যও দেশের লোক খেতে পাচ্ছে না — সমস্ত উৎপাদনই কোম্পানিগুলি মূলত স্বদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে কিংবা অন্য দেশে বেশি দামে বিক্রি করছে। কেবলমাত্র জমিই নয়, যখন কোনও এলাকায় কোনও কোম্পানি বৃহদাকারে জমি সংগ্রহ করে, তখন সেই এলাকার জলসম্পদের দখলও সেই কোম্পানি নিয়ে নিচ্ছে। ফলে সেই সমস্ত দেশগুলিতে সামাজিক সুস্থিতি বিনষ্ট হচ্ছে, স্থানীয় জনগণ আন্দোলন করছে — রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। দেশে দেশে এই ধরনের জমি অধিগ্রহণ বিশ্বের ধনী ও শক্তিশালী দেশগুলির সঙ্গে অনুন্নত ও স্বল্প উন্নত দেশগুলির নিপীড়িত জনসাধারণের পৃথিবীর জল ও কৃষি ভূমির উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েমের এক ক্ষমতার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।

বিশেষ করে সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া ও চিন এই জমি দখলের কাজে বিশেষভাবে লিপ্ত হয়েছে। এই ধরণের জমির হস্তান্তর অনেক ক্ষেত্রেই গোপনীয়তা রেখে করা হচ্ছে। হস্তান্তরকারী দেশের জনগণ অনেক সময় এই সমস্ত চুক্তির বিষয়ে কিছুই জানতে পারছে না। পরবর্তীকালে তাদের দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসা এলাকা থেকে জোর করে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

জলসম্পদের বিনাশ, খাদ্য সঙ্কট ও আন্তর্জাতিক বিবাদ

চাষের প্রয়োজনে মাটির তলার জল অত্যধিক উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর ক্রমেই নেমে যাচ্ছে। তা স্বাভাবিকভাবে আর পুনরায় পূর্ণ হয়ে উঠছে না এবং পৃথিবীতে যে খাদ্যশস্য উৎপাদিত হচ্ছে তার ৪০ শতাংশ উৎপাদন করা হচ্ছে কৃত্রিম সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে। ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলনের মাধ্যমে যে খাদ্যশস্য উৎপাদন করা হচ্ছে, তা বেশিদিন সম্ভব নয়, কেননা সেই জল শেষ হয়ে গেলে বা জলের স্তর অনেক নীচে নেমে গেলে ঐ সমস্ত এলাকায় আর চাষ করা সম্ভব হবে না। এই সমস্ত এলাকায় খাদ্য বুদবুদ (food bubble) তৈরি হয়েছে, যা সেই এলাকার জল শেষ হয়ে গেলেই চুপসে যাবে। ভারতবর্ষ ও চিনে প্রায় ১৭.৫ কোটি লোকের খাদ্য উৎপাদন করা হচ্ছে, অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন করে। মধ্য প্রাচ্যে সৌদি আরবে এই রকম স্বাভাবিকভাবে পূরণ হয় না এমন ভূগর্ভস্থ জল তুলে গম চাষ করা হচ্ছে। ২০০৮ সালে সেই দেশের সরকার ঘোষণা করে সেই ভূগর্ভস্থ জল প্রায় শেষ হয়ে গেছে। ফলে আগামী ২০১৬ সাল নাগাদ ৩ কোটি জনসংখ্যার এই দেশকে সম্পূর্ণভাবে আমদানি করা খাদ্যের উপর নির্ভর করতে হবে।

বিভিন্ন দেশের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর জলের যোগান ও ভাগাভাগি নিয়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সংঘাত বাড়ছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কলোরাডো নদীর জল অতিরিক্ত তুলে নেওয়ার ফলে মেক্সিকো কোনও জল পাচ্ছে না। তুরস্কে টাইগ্রিস নদীতে বাঁধ দেওয়ার ফলে সিরিয়া ও ইরাকে জলের যোগান কমে গেছে। ইথিওপিয়া ও সুদানে বিদেশীদের দ্বারা লিজ নেওয়া জমিতে ফসল চাষ শুরু হলে মিশর প্রয়োজন মত নীল নদের জল পাবে না। চিনে মেকং নদীতে বাঁধ দেওয়ার ফলে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও অন্যান্য নিম্ন অববাহিকা এলাকায় জলের যোগান কমে যাচ্ছে। চিনে ব্রহ্মপুত্র নদীর উচ্চ অববাহিকায় বাঁধ দেওয়ার ফলে ভারত ও বাংলাদেশে জলের যোগান কমবে। তিস্তা নদীর জলভাগ নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিরোধ চলছে। কাবেরী নদীর জল ভাগ নিয়ে তামিলনাড়ু ও কর্ণাটকের মধ্যে বিবাদ লেগেই আছে। জলের ভাগাভাগি নিয়ে এই আন্তর্জাতিক ও জাতীয় স্তরে বিভিন্ন এলাকায় এই বিবাদের ফলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে, একই দেশের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে এমনকী একই এলাকায় বিভিন্ন কৃষকদের মধ্যে, শহরবাসীর সঙ্গে গ্রামবাসী কৃষকদের সংঘাত বেড়ে যাচ্ছে।

প্রাণিজ প্রোটিনের চাহিদা বৃদ্ধি, পশুপালন, অরণ্য নিধন ও ভূমিক্ষয়

পৃথিবীর গোচারণ ভূমিতে গরু, ছাগল ও ভেড়ার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার (যাদের সংখ্যা পৃথিবীতে বর্তমানে ৩৪০ কোটি, ১৯৬০ সালে এদের সংখ্যা ছিল ২২০ কোটি) ও কৃষিজমিতে নিবিড় চাষাবাদ ও কর্ষণের ফলে এবং মাটি রক্ষা করার উপযুক্ত উপায় অবলম্বন না করার ফলে উপরিভাগের উর্বর মাটি অপসারিত হয়ে যাচ্ছে। চারণভূমিতে গরু চরলে সমস্ত ঘাস একেবারে মুড়ে খেয়ে ফেলে না। কিন্তু ভেড়া ও ছাগল চারণভূমির সমস্ত ঘাস মুড়িয়ে খেয়ে নেয়, ফলে সেখানে ভূমিক্ষয় ব্যাপকমাত্রায় হতে থাকে। ক্রমে এই এলাকাগুলি মরুভূমিতে পরিণত হয়। আফ্রিকা মহাদেশের নাইজিরিয়াতে ১৯৯০ সালে গরু, ভেড়া ও ছাগলের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১.৪, ১.২ ও ২.৩ কোটি, কিন্তু ২০১০ সালে এদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১.৭, ৩.৬ ও ৫.৬ কোটি। এর ফলস্বরূপ নাইজিরিয়ায় প্রতি বছর এখন ৮.৬ লক্ষ একর জমি মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। চিনে গরুর সংখ্যা ১৯৮০ সালে ছিল ৫.২ কোটি, ২০১০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১০.৫ কোটি। এই সময়ের মধ্যে সে দেশে ভেড়া ও ছাগলের সংখ্যা ১৮ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ২৪ কোটি। এর ফলে চিনে ভূমিক্ষয় ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় এবং ২৪০০০ গ্রাম মরু এলাকায় পরিণত হয়েছে। সেই সমস্ত গ্রাম থেকে অধিবাসীদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে। আফ্রিকা মহাদেশের ৭৫ শতাংশ জমি তাদের স্বাভাবিক উৎপাদিকা শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ত্রুটিপূর্ণ চাষ পদ্ধতির জন্য সমগ্র পৃথিবীতে এবং তৎসহ ভারতবর্ষেও এক তৃতীয়াংশ কৃষিজমি অবক্ষয় ও ভূমিক্ষয়ের ফলে উৎপাদিকা শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

এই সমস্ত কারণে পৃথিবীর কিছু এলাকায় ঐতিহাসিক কালের মধ্যে সবচেয়ে ব্যাপক ধূলিঝড় হচ্ছে। উত্তর-পশ্চিম চিনে ও পশ্চিম মঙ্গোলিয়া থেকে ধূলিঝড় মহাদেশ পেরিয়ে উত্তর আমেরিকায় পৌঁছে যাচ্ছে। আফ্রিকার সহেল এলাকা থেকে ধূলিঝড় প্রতি বছর ২-৩ শত কোটি টন মাটি উড়িয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। বিগত শতাব্দীতে দুটি বৃহৎ ধূলিঝড়ের ঘটনা ঘটেছিল। ১৯৩০-এর দশকে আমেরিকা ও কানাডার বৃহৎ সমভূমি অঞ্চলে (যা প্রেইরি নামে পরিচিত) পশুচারণের ফলে ১০ কোটি একর কৃষিজমি থেকে ধূলিঝড়ের মাধ্যমে মাটি উড়ে এসে ওয়াশিংটন, নিউ ইয়র্ক ও পূর্ব উপকূলের অন্যান্য শহরে ব্যাপক সমস্যা তৈরি করে। ১৯৫০ এর দশকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাশিয়া, পশ্চিম সাইবেরিয়া ও কাজাখস্তান অঞ্চলেও প্রায় ১০ কোটি একর তৃণভূমিকে চাষের আওতায় আনা হয়। ফলে ক্রমে সেখানকার অর্ধেক এলাকা পতিত জমিতে পরিণত হয়ে যায় এবং বৃহৎ ধূলিঝড়ের সৃষ্টি হয়। তবে বর্তমানে আফ্রিকা ও চিনে ঘটে চলা ধূলিঝড় আকারে অনেক বড়। আগামী দিনে এদের সম্পূর্ণ ক্রিয়া ও প্রভাব লক্ষ্য করা যাবে। এইভাবে ধূলিঝড়ের মাধ্যমে উর্বর মাটির অপসারণ ঘটলে তার সামগ্রিক প্রভাব পৃথিবীর খাদ্য সুরক্ষার উপর পড়বে।

সম্প্রতি, চিন দেশে মাংসের ব্যাপক চাহিদা বেড়েছে। সামগ্রিকভাবে চিনে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় মাংসের ব্যবহার দ্বিগুণ হয়েছে। যদিও মাথাপিছু মাংসের ব্যবহার চিনে আমেরিকার তুলনায় প্রায় অর্ধেক। মাংস ও মাছ উৎপাদনে সয়াবিনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এর উৎপাদনও বাড়ানোর প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার রপ্তানির জন্য সয়াবিন চাষ হয়ে থাকে। সয়াবিনের একর প্রতি ফলন আর বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ব্রাজিলে আমাজন অববাহিকায় জঙ্গল পরিষ্কার ও সাভানা ভূমি নষ্ট করে সয়াবিন চাষের এলাকা বাড়িয়ে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। পৃথিবীতে প্রতি বছর ৫৬ লক্ষ হেক্টর গহন অরণ্য ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে।

প্রায় ৮০ শতাংশ সামুদ্রিক মাছ চাষের এলাকায়, স্বাভাবিক উৎপাদনের পরিমাপে বা তার থেকে বেশি পরিমাণে মাছ সংগ্রহ করা হচ্ছে। ফলে ঐ সমস্ত এলাকায় মাছের আর উৎপাদন বাড়ানোর সম্ভাবনা নেই। পৃথিবীতে মাছের চাহিদা বাড়ার জন্য বাণিজ্যিক ছোট ও বড় মৎস্য খামার তৈরি হয়েছে এবং এর জন্যও বিভিন্ন দানাশস্য ও সয়াবিনের দরকার হয়ে পড়ছে। সমুদ্র থেকে ধরা মাছ দিয়েও এই সমস্ত মৎস্য খামারের মাছের খাবার তৈরি হচ্ছে। ফলে সমুদ্র থেকে আরও বেশি করে মাছ সংগ্রহ করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও খাদ্য সমস্যা

পৃথিবীর সব দেশেই মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে, শিশু-মৃত্যুর হার সামগ্রিকভাবে কমেছে। পাশাপাশি যদি জন্মহারও না কমে তবে জনসংখ্যা বেড়ে যেতেই থাকবে। অনুন্নত ও অল্প উন্নত তৃতীয় বিশ্বের (যেমন নাইজিরিয়া, ইথিওপিয়া, ভারতীয় উপমহাদেশ, নিম্ন সাহারার) দেশগুলিতে মৃত্যুহার থেকে জন্মহার অনেক বেশি হওয়ায় তারা এক সংকটের মধ্যে পড়েছে। ২০১১ সালের তুলনায় ২০৫০ সালে আরও ২০০ কোটি জনসংখ্যা বাড়বে বলে সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে। জাতি-সঙ্ঘের সমীক্ষা অনুযায়ী ২০৫০ সালে পৃথিবীতে ৯২০ কোটি লোক বসবাস করবে।

১৯৯০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে অতিরিক্ত খাদ্যের চাহিদা বেড়েছিল বছরে ২.১ কোটি টন করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, ও ইথানল তৈরির প্রয়োজনে পরবর্তী সময়ে ২০০৫ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বাৎসরিক অতিরিক্ত খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে ৪.৫ কোটি টন করে, যা পূর্ববর্তী দেড় দশকের তুলনায় দ্বিগুণ। কিন্তু খাদ্যশস্যের চাহিদা যখন এই ভাবে বাড়ছে তখন কৃষি জমি নষ্ট হওয়া, আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে শস্য উৎপাদনে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এখন প্রায় প্রতি বছরই বিভিন্ন দেশে আবহাওয়াজনিত কারণে শস্য উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটছে।

বায়োফুয়েল পরিকল্পনা ও খাদ্য সমস্যা

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীতে সবথেকে বেশি ভুট্টা উৎপাদন করে এবং সমগ্র পৃথিবীতে খাদ্যের যোগান দেওয়া ও খাদ্য সুরক্ষা বজায় রাখতে এই ভুট্টার আন্তর্জাতিক বাজারে যোগান দেওয়া খুবই দরকার। ২০০৫ সাল থেকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র উৎপাদিত এই ভুট্টা থেকে ইথানল তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। তারপর থেকেই বিশ্বে খাদ্যশস্যের দাম বাড়তে থাকে। আমেরিকায় উৎপাদিত ভুট্টার এক তৃতীয়াংশ এই ইথানল তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে। ২০১১ সালে আমেরিকায় ভুট্টার উৎপাদন ছিল ৪০ কোটি টন, এর প্রায় ২৩ শতাংশ (১২.৭ কোটি টন) ভুট্টা ইথানল তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। একটি বড় গাড়িতে ১০০ লিটারের তেলের ট্যাঙ্ক ইথানল দিয়ে একবার ভর্তি করতে যে পরিমাণ ভুট্টার (প্রায় ২০০ কেজি) দরকার, তা দিয়ে একজন মানুষের সারা বছরের দানাশস্যের যোগান হয়ে যায়। দানা-শস্য থেকে এই ইথানল তৈরি ছাড়াও বিভিন্ন তেল উৎপাদনকারী ফসল থেকে তেল সংগ্রহ করে তা বায়োডিজেল হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে (যেমন সয়াবিন – আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে, রেপসিড – ইউরোপে, পাম অয়েল ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডে)। এই ধরণের বায়োডিজেলের ব্যবহার বাড়ার জন্যে এই ফসলগুলির চাষও বাড়ছে এবং প্রয়োজনীয় জমি সংগ্রহের জন্য নিরক্ষীয় বনভূমি কেটে ফেলা হচ্ছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পরিকল্পনা নিয়েছে ২০২০ সাল নাগাদ ঐ দেশগুলিতে পরিবহন খাতে ব্যবহৃত জ্বালানির ১০ শতাংশ বায়োডিজেল থেকে সংগ্রহ করা যাবে। অন্যদিকে বায়োডিজেল ব্যবহারের ফলে খনিজ তেলের ব্যবহার কিছুটা কমলেও এর জন্য যে অরণ্য ধ্বংস করা হচ্ছে ও এই সমস্ত ফসলগুলি চাষ করার ফলে যে সমস্ত কৃষি রসায়ন ও সার ব্যবহার করা হচ্ছে তার জন্য সামগ্রিকভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ মোটেও কমছে না।

ভূমিক্ষয় ও খাদ্য সমস্যা

বর্তমানে কৃষিজমির অতিরিক্ত কর্ষণ, বনভূমি নিধন করার ফলে বায়ু ও জলপ্রবাহ জনিত উপরিভাগের উর্বর মাটির ক্ষয় বা অপসারণ ঘটছে। সারা পৃথিবীতে এক-তৃতীয়াংশ কৃষি জমি থেকে স্বাভাবিকভাবে যে হারে মাটি প্রকৃতিতে তৈরি হয়, তার থেকে বেশি হারে ক্ষয়ে যাচ্ছে। কৃষিজমির উপরিভাগের এই উর্বর মাটি অপসারিত হলে ঐ জমিতে আর সুষ্ঠুভাবে ফসল ফলানো যায় না। ফলে ঐ এলাকার কৃষকদের সেই অঞ্চল থেকে অন্যত্র সরে যেতে। হয়। ভূমিক্ষয়ের ফলে জমির উর্বরতা কমে যাওয়ায় মোঙ্গলিয়া, লেসোথো, হাইতি, উত্তর কোরিয়া নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য আর উৎপাদন করতে পারছে না। প্রসঙ্গত, এক ইঞ্চি মাটি স্বাভাবিক ভাবে তৈরি হতে প্রকৃতিতে ৫০০-১০০০ বছর সময় লাগে। উপরিভাগের এক ইঞ্চি মাটি ক্ষয়ে গেলে ফসলের উৎপাদন ৬ শতাংশ কমে যায়। ভারতবর্ষের কৃষি জমি থেকে বছরে গড়ে এক মিলিমিটার মাটি ক্ষয়ে যাচ্ছে। এইভাবে মাটি ক্ষয়ে গেলে আগামী দিনে পৃথিবীতেই প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য উৎপাদন করা সঙ্গীন হয়ে উঠবে।

বিশ্ব উষ্ণায়ন ও খাদ্য সমস্যা

বর্তমানে বিভিন্ন খনিজ জ্বালানির ব্যাপক ব্যবহার ও দহনের ফলে পৃথিবীতে গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বিভিন্ন এলাকায় আবহাওয়ার চরিত্রগত বদল ঘটেছে এবং আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন হয়ে পড়েছে। এর ফলেও বিশ্বের শস্য উৎপাদন ব্যবস্থা টালমাটাল হয়ে পড়েছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, খরা এখন নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনও এলাকাতেই আর স্বাভাবিক আবহাওয়া নিশ্চিতভাবে আশা করা যাচ্ছে না। বিগত দিনে কোনও কোনও বছর প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ফসলের ক্ষতি হলে কৃষকরা পরবর্তী মরশুমে ভাল আবহাওয়া আশা করতে পারতেন। কিন্তু বর্তমানে এই আশাও কৃষকরা করতে পারছেন না। প্রতিবছরই এখন কম বেশি আবহাওয়ার প্রতিকূলতা দেখা যাচ্ছে। এছাড়া বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে ও তাপমাত্রা জনিত কারণেও ফলন কমার বাস্তবিক আশঙ্কা। ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ আশঙ্কা প্রকাশ করেছে — এই শতাব্দীতে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ৬.৪ ডিগ্রি সেঃ (১১.৪ ফাঃ) বাড়বে। প্রতি এক ডিগ্রি সেঃ তাপমাত্রা বাড়ার জন্য ধান, গম ও ভুট্টার ফলন ১০ শতাংশ কমে যায়।

আবহাওয়ার গড় তাপমাত্রা বাড়ার কারণে এখন থেকে পৃথিবীতে শস্যের উৎপাদন প্রতি বছর ২ শতাংশ করে কমবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই সময়ে যদিও খাদ্যশস্যের চাহিদা প্রতি দশকে ১৪ শতাংশ করে বাড়বে। আগামী দিনে আবহাওয়া-জনিত অনিশ্চয়তার জন্য শস্য উৎপাদন কমবে এবং পৃথিবীতে মজুত বাড়ানোর মতো অতিরিক্ত খাদ্যশস্য আর ফলানো সম্ভব হবে না। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে মেরুপ্রদেশে বরফ ও অন্যত্র হিমবাহ গলে গিয়ে সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা বেড়ে গিয়ে বিভিন্ন দেশের নিম্ন অববাহিকার কৃষিজমি ডুবিয়ে দেবে। কেবলমাত্র গ্রিনল্যান্ডের জমা বরফ গলে গেলেই সমুদ্রের গড় জলতল ২৩ ফুট বেড়ে যাবে। মাত্র ৩ ফুট জলতল বৃদ্ধি পেলেই বিভিন্ন দ্বীপ রাষ্ট্র এবং ভারত ও বাংলাদেশের বিশাল এলাকা জলের তলায় ডুবে যাবে। হিমবাহ গলে গেলে অনেক নদীতেই আর সারা বছর জল থাকবে না। ফলে সংলগ্ন এলাকায় সেচের জন্য এমনকী দৈনন্দিন কাজের জন্য জলের যোগান দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠবে না। যতদিন যাচ্ছে ততই দেখা যাচ্ছে আবহাওয়ার পরিবর্তিতত রূপের সঙ্গে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা আর ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য রাখতে পারছে না।

উপসংহার

বর্তমানে বিশ্বায়িত অর্থনীতির যুগে অন্যান্য পণ্য-সামগ্রীর সঙ্গে বিভিন্ন কৃষিজ পণ্যেরও বিশ্ব বাণিজ্য বেড়েছে। এই বাণিজ্য মূলত নিয়ন্ত্রণ করছে গুটিকয় বহুজাতিক কোম্পানি। কৃষিক্ষেত্রে কতিপয় বহুজাতিক কোম্পানি বীজ উৎপাদন, কৃষি রসায়ন ও সার উৎপাদন, উৎপাদিত পণ্য সংগ্রহ ও তার প্রক্রিয়াকরণ এবং বিপণন নিয়ন্ত্রণ করছে। এই সমস্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলির মুখ্য উদ্দেশ্য হল — মুনাফা করা। মুনাফাই মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়ায়, বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে, তা সংশোধন করার পরিকল্পনা বহুক্ষেত্রেই সুষ্ঠুভাবে নেওয়া হয় না বা এই ক্ষতির মূল্যায়ন করা হয় না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে পরিবেশ রক্ষার কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তার সুষ্ঠু রূপায়ণ সম্ভব হয়ে ওঠে না। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিকাঠামোয় অনেক ক্ষেত্রে আন্তরিক রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা কথায় থাকলেও বাস্তবে তার রূপায়ণ সম্ভব হয় না। ধনী দেশগুলি সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও গরিব দেশগুলির জল, জঙ্গল, মাটি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ গ্রাস করে নিচ্ছে এবং এই সমস্ত দেশগুলির সাধারণ জনগণ আরও গভীর সংকটে নিমজ্জিত হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে আগামী দিনে পৃথিবীতে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার সম্যক সম্ভাবনা রয়েছে। পৃথিবীর সকল জনসাধারণের জন্য একটি স্থিতিশীল খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা দরকার। খাদ্যশস্যের চাহিদার ক্ষেত্রেও একটি স্থিতিশীলতা দরকার। এজন্য আবার দরকার পৃথিবীতে সামগ্রিক জনসংখ্যার স্থিতিশীলতা, দারিদ্র দূরীকরণ, অত্যধিক প্রাণিজ প্রোটিন (বিশেষ করে মাংস) খাওয়ার অভ্যাস কমানো এবং খাদ্যশস্য থেকে ইথানল তৈরির পরিকল্পনা বন্ধ ও বাতিল করা।

আমরা এমন একটা সময়ে উপনীত হয়েছি, যখন আমাদের সুচিন্তিতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার — ধনী লোকেদের গাড়িতে চড়ার জন্য জ্বালানীর প্রয়োজনে নাকি বিশ্বের ক্ষুধার্থ মানুষকে অন্ন যোগানোর জন্য বিশ্বে খাদ্য শস্য উৎপাদন করা হবে। তবে এবিষয়ে ক্ষমতাবান দেশ ও সম্প্রদায় এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। আগামী দিনে বিশ্ব রাজনীতিতে খাদ্য নিয়ে কূটনৈতিক লড়াই, খনিজ তেল নিয়ে এতদিন যে লড়াই চলেছে তাকে ম্লান করে দেবে।

আগামী দিনে খাদ্যশস্যের ফলন কমে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা, সে ক্ষেত্রে পৃথিবীতে খাদ্য শস্যের চাহিদা পূরণ করা সঙ্কটজনক হয়ে উঠবে, ঘাটতি বাড়বে, খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনা বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে, বুভুক্ষু মানুষের সংখ্যা বাড়বে — সেই সঙ্গে বাড়বে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। আমরা ক্রমে চিরস্থায়ী খাদ্য সঙ্কটের দিকে এগিয়ে চলেছি।

অন্য দিকে খাদ্যশস্য উৎপাদন ব্যবস্থা স্থিতিশীল রাখা ও তা ক্রমশ বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার কৃষি জমির মাটি সংরক্ষণ করা, জল সংরক্ষণ ও শস্য উৎপাদনে জলের সুষ্ঠু ব্যবহার এবং যেখানে শস্যের গড় ফলন এখনও তুলনামূলক ভাবে কম, সেখানে ফলনের হাড় বাড়ানো। অন্যদিকে পৃথিবীর আবহাওয়াও যাতে স্থিতিশীল হয় ও বিশ্ব উষ্ণায়ন না ঘটে, তার জন্যও দরকার সবিশেষ উদ্যোগ। মাটি সংরক্ষণ করার জন্য দরকার — যেখানে ভূমিক্ষয় হচ্ছে সেখানে যাতে ভাল মত ঘাস জন্মাতে পারে সে দিকে লক্ষ্য রাখা, উঁচু নিচু ঢাল সম্বলিত এলাকায় ধাপে ধাপে সমতল ফালি (Terrace) তৈরি করে চাষ, যাতে ঐ সমস্ত এলাকায় ভূমিক্ষয় না হয়, মরু এলাকা বা মরু-প্রবণ এলাকায় বাতাসের গতি নিবারণার্থে বড় গাছ লাগিয়ে সুরক্ষা বলয় (Shelter belt) তৈরি করা এবং বিনা কর্ষণ বা অল্প কর্ষণে চাষ করা। জল সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার অঙ্গ হিসাবে দরকার সুষ্ঠু সেচ ব্যবস্থা (ড্রিপ সেচ বা ফোটা সেচ, স্প্রিংকলার সেচ, জমি ভাসিয়ে সেচ দেওয়ার পরিবর্তে কেবলমাত্র মাটি ভিজিয়ে অল্প করে ঘন ঘন সেচ দেওয়ার ব্যবস্থা), যেখানে সম্ভব জল কম লাগে এমন শস্যের চাষ, যেমন ধানের বদলে গম, ভুট্টা ও ডাল শস্যের চাষ, জলের পুনর্ব্যবহার (recycling) কৃষি বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে শস্যের উৎপাদন একটি মাত্রা পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব — তবে তার জন্য দরকার উর্বর কৃষি জমি ও সুস্থিত আবহাওয়া।

এতদিন কোনও দেশের সুরক্ষা ব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী তা পরিমাপ করা হত সেই দেশের সামরিক দক্ষতা কতটা উন্নত তার উপর। কিন্তু ক্রমেই পরিবেশজনিত টালমাটাল অবস্থায় ও পৃথিবীর স্বাভাবিক সম্পদের বিনাশ ও তাদের উৎপাদিকা শক্তির অবনমনের বর্তমান সময়ে কোনও দেশের নিরাপত্তা ও সুস্থিতি নির্ভর করছে – সংশ্লিষ্ট দেশের জনসাধারণের ক্ষুধা নিবৃত্তি ও দারিদ্র মোচনের কার্যকরী সামর্থ্যের উপর। বর্তমানে অর্থনৈতিক পরিকল্পনাও তাই এই আঙ্গিকে নিতে হবে। যেমন চলছে তেমনই চলুক উন্নয়নের এমন নীতি ও পরিকল্পনা আর একদম চলতে পারে না। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় আমাদের সুচিন্তিত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তার সফল রূপায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে সভ্যতাকে আশু বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে না। ভবিষ্যতে খাদ্য সুরক্ষা যাতে ভেঙ্গে না পড়ে তার জন্য প্রযুক্তি মানুষের হাতে রয়েছে — এখন দরকার আন্তরিক রাজনৈতিক বা সামাজিক সচেতনতা ও সুষ্ঠু উন্নয়ন পরিকল্পনা।

তথ্যসূত্র:

1) Lester R. Brown. (2012) Full Planet Empty Plates, W.W. Norton & Company, New York, London.

2) Mathew Aerthayil, Agrarian Crisis in India is a Creation of the Policy of Globalisation Main- stream, Vol XLVI, No 13 (March 15, 2008), New Delhi, India.

3) G. Tyler Miller and Scott Spoolman, (2008) Environmental Science Problems, Connections and Solutions, Thomson Higher Education, California, USA.

4) Stephen M. Tomecek, Global Warming and Climate Change (2012), Chelsea House — An Infobase Learning Company, New York, USA.

5) Lester R. Brown. (2011) World on the Edge: How to Prevent Environmental and Economic Collapse, W.W. Norton & Company, New York, London.

6) www.wikipedia.org

লেখক পরিচিতিঃ ডঃ আলম একজন বিশিষ্ট কৃষি বিজ্ঞানী এবং ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসইটি, প.ব. কমিটির অন্যতম সহ-সভাপতি।

“পরিবেশ বিপর্যয় ও খাদ্য সঙ্কট” শীর্ষক এই প্রবন্ধটি ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি প্রকাশিত ‘প্রকৃতি’ পত্রিকার একাদশ বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ থেকে নেওয়া।