বিভাগগুলি

জল সংকট

Photo by Quang Nguyen Vinh

প্রদীপ কুমার দত্ত

ভূমিকা

জল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। মানুষ প্রাণী ও উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য জল অপরিহার্য। পান করা ধোয়াধুয়ী করা, রান্না করা, চাষ আবাদ করা প্রভৃতির জন্য আমাদের জল প্রয়োজন। সুস্থভাবে বাঁচার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষের প্রয়োজন বিশুদ্ধ জল। এছাড়া কৃষিকাজ ও শিল্প কারখানায়ও জল দরকার। কিন্তু বিশ্বে বিশুদ্ধ জলের পরিমাণে খুবই সীমিত। তাছাড়া বিশ্বে জলের উৎসগুলি সর্বত্র সমানভাবে বন্টিত নয়। তাই বিশ্বের বেশ কিছু অঞ্চলে জলের অভাব দেখতে পাওয়া যায়। এমনকী যেসব দেশে জলের উৎস পর্যাপ্ত সে সব দেশেও অপ্রতুল পরিকাঠামো, জল দূষণ, জল নিয়ে বিবাদ জল সম্পদের দুর্বল ব্যবস্থাপনা, প্রভৃতি করণে জলের সংকট দেখা দিতে পারে। এর সঙ্গে আবহাওয়ার পরিবর্তনও জল সংকট তৈরি করতে পারে। এর ফলে নিরাপদ পানীয় জলের অভাব হতে পারে, বাড়ি ও স্কুল কলেজে নিকাশি ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে পারে। ইউনিসেফের (UNICEF) মতে 2025 সালের মধ্যেই বিশ্বের জনসংখ্যার 50% তীব্র জল সংকট আছে এমন স্থানে বাস করবে; আর দুই বিলিয়নের বেশি মানুষ সেই সব দেশে বাস করবে যেখানে জল সরবরাহ অপ্রতুল; 2030 সালের মধ্যে প্রায় 700 মিলিয়ন মানুষ তীব্র জল সংকটের জন্য বাস্তুচ্যুত হতে পারে; চার বিলিয়ন মানুষ, যা বিশ্বের জন সংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, প্রতি বছর অন্তত এক মাস তীব্র জল সংকটের সম্মুখীন হয়; এবং 2040 সালের মধ্যে বিশ্বে প্রায় এক-চতুর্থাংশ শিশু অত্যন্ত তীব্র জল সঙ্কটে আছে এমন স্থানে বাস করবে। ইউনিসেফের মতে বিশ্বের জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ (1.42 বিলিয়নের বেশি, যার মধ্যে শিশুর সংখ্যা 450 মিলিয়ন) এমন এলাকায় বসবাস করে যেখানে প্রয়োজনীয় জলের অভাব আছে। বিশ্বের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ (2.3 বিলিয়নের বেশি) বিশুদ্ধ পানীয় জল পায় না।

নানা কারণে (যেমন, নগরায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জীবনধারণের মানের উন্নয়ন, দূষণ, আবহাওয়ার পরিবর্তন প্রভৃতি) সারা পৃথিবীতে জলের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। এর ফলে অনেক জায়গাতেই বিশুদ্ধ জলের অভাব দেখা দিচ্ছে। রাষ্ট্রসংঘের হিসাবে 2050 সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা 9 লক্ষ কোটিতে পৌঁছাবে, এর মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলিতেই জনসংখ্যা বৃদ্ধি বেশি হবে যেগুলিতে এখনই জল সংকট প্রকট। বর্তমান নিবন্ধে জলের উৎস, জল সংকট কী ও তার কারণ, জলের ব্যবহার, জল নিয়ে বিবাদ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে।

জলের উৎস

যেখান থেকে ব্যবহার্য জল পাওয়া যায় তাকেই বলা হয় জলের উৎস। পৃথিবীতে জল থাকে বিভিন্ন স্থানে ও বিভিন্ন ভাবে। যেমন বাতাসে জলীয় বাষ্প রূপে, ভূপৃষ্ঠে নদী, সমুদ্র, পুকুর প্রভৃতিতে, ভূগর্ভে, হিমবাহে বরফ রূপে প্রভৃতি। প্রকৃতিতে মোট জলের 97 শতাংশই থাকে সমুদ্রে যা লবণাক্ত। মাত্র তিন শতাংশ মিঠা জল (fresh water)। এই জলের অধিকাংশই (69%) থাকে মূলত গ্রিনল্যান্ড, অ্যান্টার্কটিকা প্রভৃতি অঞ্চলে হিমবাহ ও বরফের আস্তরণ (glaciers and icecaps) রূপে। স্পষ্টতই এই জল ব্যবহারযোগ্য নয়। ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণ 1.7% - যার মধ্যে লবণাক্ত জলের পরিমাণ 0.94% আর মিঠা জল মাত্র 0.76%। মিঠা জলের মাত্র 0.3% পাওয়া যায় নদী ও হ্রদগুলিতে। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে ব্যবহার্য জলের পরিমাণ কত সীমিত।

জল সঙ্কট কী ও কেন?

কোনও একটি অঞ্চলের মানুষদের যে পরিমাণ জলের প্রয়োজন সেখানে পরিশোধিত ও পানীয় জলের পরিমাণ তার থেকে কম হলে সেই অঞ্চলে জল সংকট আছে বলা হয়। জন সংকটের কয়েকটি কারণ হল-

  1. পরিষ্কার জলের পরিমাণ সীমিত। অর্থনৈতিক অগ্রগতি নগরায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে জলের চাহিদা বাড়ছে, অথচ জলের পরিমাণ বাড়ছে না। বরং পরিশ্রুত জলের উৎসে জলের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে।
  2. পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বছরে মাথাপিছু পরিশ্রুত জলের পরিমাণ কমছে। এই পরিমাণ 1989 এবং 2000 সালে যথাক্রমে ছিল 9000 ঘন মিটার এবং 7800 ঘন মিটার। অনুমান করা হচ্ছে যে 2025 সালে তা কমে 5100 ঘন মিটার হবে।
  3. বিশ্বে পরিশ্রুত জলের পরিমাণ সব ঋতুতে, সব বছরে এবং সব জায়গায় সমভাবে বন্টিত নয়। তছাড় অনেক জায়গায় ভূগর্ভস্থ জলের (groundwater) উৎসগুলি আর্সেনিক দূষিত এবং পানের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
  4. কলকারখানা, নর্দমা, এমনকি রাসায়নিক কারখানার নানা বিষাক্ত পদার্থ নদী এবং জলাশয়ে পড়ে সেগুলিকে দূষিত করে। ফলে পরিশ্রুত জলের পরিমাণ কমছে।
  5. অনেক সময় উচ্চ ফলনশীল শস্য উৎপাদনের জন্য মাটির নীচের জল প্রচুর পরিমাণে তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু যতটা জল তুলে নেওয়া হয় ততটা জল ভূগর্ভে সঞ্চিত হয় না। ফলে মাটির নীচে জলের পরিমাণ কমে।
  6. বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে আবহাওয়ার চরম পরিবর্তন, কোথাও খরা ও কখনও অতিবৃষ্টি। অন্যদিকে বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ভাল ব্যবস্থা নেই।
  7. জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হিমবাহ হ্রাস পাচ্ছে স্রোত ও নদীর প্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে এবং হ্রদ ও পুকুরগুলি সঙ্কুচিত হচ্ছে।
  8. কোন দেশে যথেষ্ট পরিমাণে জল থাকলেও নানা কারণে (যেমন, উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে, জলের সুসম বণ্টন না হওয়া, জল নিয়ে বিবাদ, জল দূষণ, প্রভৃতি) সেখানে জলের সংকট থাকতে পারে।
  9. বন্যা হলেও পরিশ্রুত জলের অভাব হয়, কারণ বন্যার ফলে শৌচাগার গুলি জলমগ্ন হয়ে জলকে কলুষিত করে এবং পানের অযোগ্য করে।
  10. বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে হিমবাহ ও বরফের আস্তরণ গলে যাচ্ছে। এর ফলে সমুদ্রের জলতল বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মিঠা জলের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে।

জলের আকাল (Water Stress)

Word Business Council for Sustainable Development -এর সংজ্ঞা অনুযায়ী কোনও স্থানে সব রকম কাজের জন্য প্রয়োজনীয় জলের যোগান না থাকলে সেই অঞ্চলে জলের আকাল রয়েছে বলা হয়। Falkenmark Water Stress Indicator অনুযায়ী কোনও স্থানে বছরে মাথাপিছু পুনঃনবীকরণযোগ্য বিশুদ্ধ জলের পরিমাণ 1700 ঘনমিটারের কম হলে সেই দেশ বা অঞ্চলে জলের আকাল রয়েছে বলা হয়। আর এই পরিমাণ 1000 ঘনমিটারের কম হলে জলের আকাল সেখানকার অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত করে এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। বিশ্বে প্রতি ছয় জন মানুষের মধ্যে একজনেরও বেশির জলের আকাল রয়েছে কারণ তারা পর্যাপ্ত পানীয় জল পায় না। চীন, ভারত ও অফ্রিকার কিছু অঞ্চলে ক্রমাগত জল সংকট বাড়ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জলের আকাল মধ্য প্রাচ্যে যেখানে মাথাপিছু জলের পরিমাণ গড়ে 1200 ঘনমিটারের কম।

জল সংকটের ফল

(1) নিরাপদ পানীয় জলের অভাবে জল-বাহিত নানা রোগে বহু মানুষ, বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা মৃত্যুমুখে পতিত হয়। বিশ্বব্যাংকের মতে জল-বাহিত রোগের 88 শতাংশের কারণ নিরাপদ পানীয় জলের অভাব, পরিচ্ছন্নতার অভাব এবং যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি পালন না করা। ইউনিসেফের হিসাবে প্রতিদিন নিরাপদ পানীয় জলের অভাবে পাঁচ বছরের কম বয়সী 800 -এরও বেশি শিশু ডায়ারিয়ায় মারা যায়।

(2) জল সংকটের বিরূপ প্রভাব পরিবেশের ওপরও পড়ে। গত 100 বছরে পৃথিবীর জলাভূমির অর্ধেকের বেশি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে বা অন্তর্হিত হয়েছে। জলাভূমিগুলি হল বিভিন্ন প্রাণীর, যেমন পাখি, মাছ, উভচর প্রাণী, অমেরুদণ্ডী প্রাণীর বাসস্থান। তাই জলাভূমি কমে গেলে এইসব প্রানীদের ক্ষতি হয়। জলাভূমিগুলি ধান ও কিছু শস্য উৎপাদনে সাহায্য করে। তাছাড়া ঝড় ও বন্যার হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করে। পরিষ্কার জলের হ্রদগুলিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, মাত্র তিন দশকে মধ্য এশিয়ায় অরাল সমুদ্রের (Aral Sca), যা এক সময় চতুর্থ বৃহত্তম পরিষ্কার জলের হ্রদ ছিল, 58,000 ঘন কিমি এলাকা নষ্ট হয়ে গেছে। অত্যধিক দূষণ এবং সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এর জল ব্যবহার করার ফলে এটি এখন সমুদ্রের মতই লবণাক্ত এবং পানের অযোগ্য। তাছাড়া হ্রদটি ছোট হয়ে যাওয়ার ফলে জমিও দূষিত হয়ে পড়েছে। এর ফলে খাদ্যের অভাব সৃষ্টি হয়েছে ও শিশুমৃত্যুর হার বেড়েছে এবং নিকটবর্তী অঞ্চলের মানুষের আয়ুষ্কাল কমেছে।

জল নিয়ে বিবাদ

জল সংকটের জন্য জল নিয়ে দুটি দেশ, রাজ্য বা অঞ্চলের মধ্যে বিভিন্ন সময় বিবাদ বাধে। এই বিবাদ হয় মিঠা ও লবণাক্ত দু'রকম জলের ক্ষেত্রেই। তবে মিঠা জলের পরিমাণ সীমিত এবং অসমভাবে বণ্টিত হবার ফলে বিবাদ হয় মূলত মিঠা জল নিয়েই। ইতিহাসে এমন বেশ কিছু ঘটনা আছে। সাম্প্রতিক কালে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর জল নিয়ে বিবাদ, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তার জল নিয়ে বিবাদ, প্রভৃতির কথা অনেকেরই জানা। আমাদের দেশের মধ্যেও কাবেরি নদীর জল নিয়ে কর্ণটিক ও তামিলনাড়ুর মধ্যে বিবাদ আজও মেটেনি। গোদাবরী ও কৃষ্ণা নদীর জল নিয়ে বিবাদ মেটানোর জন্য ভারত সরকারকে দুটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হয়েছিল। উল্লেখ্য প্যাসিফিক ইন্সটিটিউট জল নিয়ে বিবাদের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছে।

কারও কারও অভিমত, জল সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে যে জল নিয়ে বিবাদের ফলে যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। যেমন, রাষ্ট্রসংঘের পূর্বতন সেক্রেটারি জেনেরাল বুত্রস ঘালি বলেছেন, “মধ্য প্রাচ্যে পরবর্তী যুদ্ধ হবে জল নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে নয়”। রাষ্ট্রসংঘের একজন সেক্রেটারি জেনেরাল বলেছিলেন, "পরিশ্রুত জল নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা বিবাদের কারণ হতে পারে এবং ফলে যুদ্ধও লেগে যেতে পারে"। বিশ্ব ব্যাঙ্কের কাছের প্রাক্তন ভাইস-প্রেসিডেন্ট ইসমাইল সেরাগেলডিন (Ismail Serageldin) বলেছিলেন, "যদি উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে পরবর্তী শতাব্দীতে জল নিয়ে যুদ্ধ বেধে যাবে"।

কী পরিমাণ জল প্রয়োজন

বেঁচে থাকার জন্য আমাদের জলপান করতে হয় কারণ স্বাভাবিক কাজকর্মের ফলে আমাদের শরীর থেকে জল বেরিয়ে যায়। কতটা জল বেরুবে তা নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর এবং মানুষের শারীরবৃত্তীয় অবস্থার ওপর। যেমন গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে থাকলে কোনও মানুষের শরীর থেকে যতটা জল বেরুবে সেই মানুষই শীতপ্রধান অঞ্চলে থাকলে তার চেয়ে কম জল বেরুবে। আবার কোনও মানুষ বেশি ঘামে, আবার কেউ কম ঘামে। এদের ক্ষেত্রেও শরীর থেকে জল বেরোনোর পরিমাণে পার্থক্য থাকে। মানুষের শরীর থেকে মাত্র এক শতাংশ জল বেরিয়ে গেলে মানুষ তৃষ্ণার্ত হয় আর দশ শতাংশ জল বেরিয়ে গেলে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই মানুষের বেঁচে থাকার জন্য শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া জল নিয়মিত পূরণ করা দরকার। এর উপর ভিত্তি করেই মানুষের ন্যূনতম জলের প্রয়োজন নির্ধারিত হয়। স্বাভাবিক আবহাওয়ায় একজন মানুষের প্রতিদিন প্রায় 3 লিটার পানীয় জল প্রয়োজন। স্নানের জন্য প্রতিদিন প্রত্যেক ব্যক্তির প্রায় 15 লিটার জল প্রয়োজন। রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় জলের পরিমাণ অঞ্চল ভেদে ও খাদ্যাভ্যাস ভেদে বিভিন্ন হলেও মোটামুটি প্রতিদিন প্রত্যেক ব্যাক্তির ন্যূনতম প্রায় ১০ লিটার জল প্রয়োজন। এসব ছাড়াও খাদ্য উৎপাদন ও শিল্পের জন্যও জল প্রয়োজন। সেচের জন্য বিশ্বে প্রায় 70% জল ব্যবহৃত হয়। শিল্পের জন্য পৃথিবীতে 22% জল ব্যবহৃত হয়।

ভার্চুয়াল জল (Virtual Water)

খাদ্য বা কোনও বস্তু যেমন তুলা, পাট, কাগজ প্রভৃতি উৎপাদন করতে যে পরিমাণ জল প্রয়োজন হয় তাকে বলা হয় ভার্চুয়াল জল। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে এক মেট্রিক টন গম উৎপাদন করতে প্রায় 1600 ঘনমিটার জল লাগে, এক মেট্রিক টন চাল উৎপাদন করতে লাগে প্রায় 3000 ঘনমিটার জল, এক মেট্রিক টন সয়াবিন উৎপাদন করতে প্রায় 4000 ঘনমিটার জল লাগে। তাই এক মেট্রিক টন চাল বিদেশে রপ্তানি করলে 3000 ঘন মিটার জলও চালের সঙ্গে বিদেশে চলে যায়। তাই জল সংকটের হাত থেকে কিছুটা হলেও নিস্তার পেতে কোনও কোনও দেশ নিজের দেশে খাদ্য ও অন্য জিনিস উৎপাদন কমিয়ে নিয়ে বিদেশ থেকে সেগুলি আমদানি করে নিজের দেশের জল বাঁচায়।

ভারতের পরিস্থিতি

ভারতে প্রায় 600 মিলিয়ন মানুষ জল সংকট শুধু নয়, জলের আকালের সম্মুখীন হচ্ছে। ভারতের অনেকগুলি রাজ্যে জলের অভাব আছে। বিশুদ্ধ জলের অভাবে প্রতি বছর প্রায় 200,000 মানুষ মারা যায়। 14 জুন 2018 প্রকাশিত 'Composite Water Management Index' রিপোর্ট অনুযায়ী জলের সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেশি হবে বলে 2050 সাল নাগাদ অবস্থা আরও খারাপ হবে। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ব্যাঙ্গালোর, দিল্লি, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ সহ 21 টি শহরে 2030 সাল নাগাদ পানীয় জলের অভাব দেখা দেবে।

আমাদের রাজ্যে 1993 থেকে 2019 সালের মধ্যে ভূগর্ভের জলস্তর 1.3 মিটার নেমে গেছে। 1950 থেকে 2011 সালের মধ্যে মাথাপিছু লভ্য জলের পরিমাণ 69% হ্রাস পেয়েছে। 2025 সাল নাগাদ তা আরও 13% হ্রাস পাবে। নাসার (NASA) হিসাবে চাষের কাজে জল তুলে নেওয়ার ফলে ভারতের পূর্বাঞ্চলে ভূগর্ভের জলস্তর বছরে 5 ঘন মিটার হবে নেমে যাচ্ছে।

এছাড়াও ভারতবর্ষে জল সংকটের কারণ সরকারের পরিকল্পনার অভাব, কর্পোরেটদের স্বার্থরক্ষাকারী ভূমিকা (যেমন, বেসরকারি মালিকদের জল নিয়ে ব্যবসা করতে দেওয়া), জলের অপচয়, জলের উৎসগুলি সংক্রামিত হওয়া, নদীগুলি দূষিত হওয়া প্রভৃতি।

জলের অপচয়

আমাদের দেশে জল সংকট থাকলেও জনসাধারণের সচেতনতার অভাবে প্রচুর জল নষ্ট হয়। প্রায়ই দেখা যায় রাস্তার কলে অহেতুক জল পড়ে যাচ্ছে। বাড়িতেও কখনও কখনও জলের কল থেকে জল পড়ে নষ্ট হয়। তাই কেউ কেউ বলেন জলের জন্য দাম নেওয়া উচিৎ। এনিয়ে বিতর্ক আছে। বর্তমান লেখকের মতে প্রতিদিন মাথাপিছু প্রয়োজনীয় জল মানুষকে বিনামূল্যেই দেওয়া দরকার। তার বেশি জল ব্যবহার করলে তার জন্য মূল্য ধার্য করা যেতে পারে। আর শিল্প ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে (বিশেষ করে যারা জল নিয়ে ব্যবসা করে) জলের জন্য মূল্য ধার্য করা দরকার। এখানে একটা কথা বলা দরকার। কোকাকোলা, পেপসি প্রভৃতি সফট ড্রিংক প্রস্তুতকারকরা প্রচুর জল অপচয় করে। যেমন 500 মিলিলিটারের কোকাকোলা তৈরি করতে প্রায় 1.9 লিটার জল ব্যবহার করা হয়। তাই সফট ড্রিংক তৈরি বন্ধ করা দরকার।

উপসংহার

উপরের আলোচনায় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জল সংকট বা জলের আকাল রয়েছে। তাই বিভিন্ন দেশের সরকারের উচিৎ জল সংকট সমাধানের জন্য বিজ্ঞানসম্মত উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করা। বর্তমানে যে জল সম্পদ আছে তা যাতে সুষ্ঠুভাবে বণ্টিত হয়, জলের প্রাকৃতিক উৎসগুলিকে ভালভাবে ব্যবহার করা হয়, জলের অপচয় না হয়, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করা হয়, মাটির নিচের জল অযথা তুলে নেওয়া না হয় এবং জলকে পুনঃব্যবহার্য করা যায় প্রভৃতি হবে এই পরিকল্পনার অঙ্গ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনার পরিবর্তে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই জল সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণ করা হয়।

লেখক পরিচিতিঃ অধ্যাপক প্রদীপ কুমার দত্ত পূর্বতন প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান ছিলেন।

তথ্যসূত্র:

[1] https://water.usgs.gov/edu/earthwherewater.html

[2] United Nations Press Release POP/952, 13 March 2007

[3] https://en.wikipedia.org/wiki/Water.resources

[4] Peter H. Gleick, Water International 21, 83-92 (1996)

[5] Freshwater lifeblood of the planet.peopleandplanet.net (11 November 2002)

[6] All About: Water and Health. CNN. 18 December 2007

[7] https://www.worldwildlife.org/threats/waterscarcity

[8] https://worldwater.org/water-conflict