বিভাগগুলি

যোশীমঠের সাম্প্রতিক বিপর্যয়: কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

photo: PTI


কানাইলাল দাস

ভূমিকা

সম্প্রতি উত্তরাখণ্ড রাজ্যের চামোলি জেলার অলকনন্দা নদীর তীরবর্তী প্রাচীন শহর যোশীমঠকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানকার 269টি পরিবারের প্রায় 900 মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হিমালয়ের এই অংশে বিখ্যাত আউলি স্নো স্কেটিং গ্রাউন্ড আছে শহরের 2909 মিটার উপরে 11 কিমি দূরে পাহাড়ের মাথায়, যেখানে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত যথেষ্ট পরিমাণে তুষার জমে এবং সেই স্নো ফিল্ডে স্কিইং চলে। যোশীমঠের উচ্চতা 1874 মিটার।

হিমালয়ের বিখ্যাত চারধামের অন্যতম বদ্রীনাথের পথে ভ্রমনার্থীদের যোশীমঠ অতিক্রম করেই যেতে হয়। তাই হিমালয়ের এই অংশে অর্থাৎ বদ্রীনাথ, ভীমপুল, বসুধারা জলপ্রপাত, শতপন্থ হিমবাহের দিকের প্রবেশদ্বার হল এই যোশীমঠ শহর। শীতকালে যখন প্রবল তুষারপাত শুরু হয় তখন বদ্রীনাথের শ্রী বিষ্ণুনারায়ণের বিগ্রহ যোশীমঠের নরসিংহ মন্দিরে এনে রাখা হয়। সেই মন্দির ভগ্ন অবস্থায় আছে,স্বাভাবিক ভাবে নতুন মন্দির তৈরি হয়েছেসাবেক মন্দিরের পাশেই। পাহাড়ের ঢাল ভেঙে সমতল করে মন্দির ক্যাম্পাস তৈরি করা হয়েছে। আরও মন্দির এবং বহুতল হোটেল ও বাড়ি তৈরির কাজ চলছে। ব্যবসা বাণিজ্য, দোকান পাট, এর সংখ্যা বাড়ছে। 2022 সালের অক্টোবর মাসেও এই দেখা গেছে।

প্রচলিত উপাখ্যান হল যোশীমঠের নৃসিংহ মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন আদি শঙ্করাচার্য স্বয়ং। বর্তমানে সেই মন্দির জরাজীর্ণ। তাই নতুন মন্দির নির্মাণের কাজ শেষের পথে। কেদারখণ্ড সংহিতা অনুসারে নৃসিংহ অবতারের বামহস্ত সেই মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই একটু একটু করে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে এবং একদিন তা নিশ্চিন্ন হয়ে যাবে। যেদিন এই বামহস্ত দৃশ্যমান থাকবে না সেদিন যোশীমঠ ও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। এই হল বসতির অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাসের কথা।

বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদ-দের সতর্কবার্তা

হিমালয়ের এই অংশে বিপর্যয়ের সম্ভাবনার কথা 1976 সালে জরুরী অবস্থার সময়ই মিশ্র কমিশন বলেন। মিশ্র কমিশনের উপর দায়িত্ব ছিল বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্ট তৈরি করে যোশীমঠ শহরের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা। মিশ্র কমিশনের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল যোশীমঠ শহরটি পাহাড়ের শক্ত পাথুরে ভূমির উপর তৈরি হয়নি, পাহাড়ের ধস থেকে তৈরি হওয়া শিথিল পলি, নুড়ির স্তুপের উপর বিপজ্জনক ভাবে তৈরি হয়েছে। শহরটি বিস্তৃত আছে কয়েকটি ধাপে বিভক্ত পাহাড়ের খাড়া দেওয়ালের বুকে, নিচে গভীর নদী খাত। বসতির দুদিক থেকে প্রবাহিত দুটি প্রবল শক্তিশালী নদী হল অলকনন্দা এবং ধৌলীগঙ্গা বা বিষ্ণুগঙ্গা। মিশ্র কমিশনের রিপোর্টে প্রকাশ, প্রতি বছরে জোশিমঠ 1 সেমি করে বসে যাচ্ছে। এদিকে ISRO’র রিপোর্ট বলছে জানুয়ারি মাসে মাত্র 12 দিনে 5 সেমি ভূমি অবনমিত হয়েছে। যোশীমঠসহ কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী উত্তরকাশি, চামলী, কাশ্মীর, সিকিম হিমালয় এক কথায় সমগ্র হিমালয় আজ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে।

এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করার আগে হিমালয়ের উদ্ভব এবং তার ভূগোল, ভূতত্ত্ব নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। তাছাড়া এখানকার ভূমি, নদীর চরিত্র, আবহাওয়া ও জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য এবং ভূ অভ্যন্তরের কিছু বিষয় ব্যাখ্যা খুব প্রয়োজন।

হিমালয়ের উৎপত্তি

হিমালয় পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশ্রেণী। এটি নবীন ফোল্ড মাউন্টেন বা ভঙ্গিল পর্বত। এই পর্বতের উৎপত্তির সঙ্গে একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব Plate Tectonic বা পাত চলন তত্ত্ব সম্পর্কযুক্ত। Tujo Wilson (1963), Mackenzie and Parker (1967), Morgan and Picho (1968) তত্ত্বটির ব্যাখ্যা দেন। আমাদের পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগের সঙ্গে একটি ডিমের অভ্যন্তর ভাগের সাদৃশ্য আছে বলা যায়। ডিমের আকারের সঙ্গে অবশ্য পৃথিবীর আকৃতির তেমন মিল নেই। ডিমের বাইরের আবরণ যাকে আমরা খোলা বলি তার নিচে থাকে থকথকে জেলির মতো অংশ। সেইভাবে পৃথিবীর বহিরাবরণ আছে, তাকে ভূত্বক বলা হয়। ডিমের বহিরাবরণ অবশ্য মসৃণ, কিন্তু পৃথিবীর বহিরাবরণ মসৃণ নয়। পৃথিবীর বহিরাবরণ অমসৃণ; সেখানে পাহাড়, পর্বত, মালভূমি, সমভূমি, সমুদ্র, আবার সমুদ্র তলদেশে ও পাহাড় পর্বত সমুদ্র খাত আছে। যাই হোক পৃথিবীর এই বহিরাবরণকে ভূত্বক বা crust বলা হয়।

ডিমের বহিরাবরণ এর নিচে থকথকে জেলির মতো পদার্থ আছে। পৃথিবীর গভীরেও এমন পদার্থ আছে তাকে ম্যাগমা বলা হয়। crust এর নিচেই আছে mantle। এই mantle এর ভূত্মক সংলগ্ন অংশ কিন্তু কঠিন। এই স্তরের নিম্নাংশ অর্থাৎ lower mantle প্রায় তরল এবং উত্তপ্ত ম্যাগমা দিয়ে তৈরি। ডিমের কেন্দ্রস্থলে কুসুম আছে, পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে আছে লোহা ও নিকেল দিয়ে তৈরি অত্যন্ত উত্তপ্ত তবে কঠিন কেন্দ্রমণ্ডল। পৃথিবীর কেন্দ্রের কেন্দ্রমণ্ডল এবং তার সঙ্গে যুক্ত lower mantle যা প্রায় তরল মাগমা দিয়ে গঠিত তাকে একত্রে Asthenosphere বলা হয়। অপরদিকে crust এবং Upper Mantle নিয়ে শক্ত আবরণকে বলা হয় Lithosphere। Lithosphere কিন্তু স্থির নয়, সচল। এই অংশ তার নিচের Asthenosphere এর উপর সচল অবস্থায় রয়েছে। Lithosphere আবার বিভিন্ন অংশে বিভক্ত। এক একটি অংশকে plate বলা হচ্ছে। এই plate আসলে ভূখণ্ড নিয়ে তৈরি হতে পারে যেমন উত্তর আমেরিকা প্লেট, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা প্লেট ইত্যাদি। কেবলমাত্র সামুদ্রিক অংশ নিয়েও হতে পারে প্লেট যেমন প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেট। আবার স্থলভাগ এবং জলভাগ নিয়েও প্লেট আছে যেমন Indian plate যেটি ভারতীয় উপদ্বীপ, ভারত মহাসাগর এবং অস্ট্রেলিয়া নিয়ে গঠিত।

প্লেটগুলি বিভিন্ন দিকে চলাচল করছে। Asthenosphere এর অন্তর্গত মাগমার উষ্ণ পরিচলন স্রোতের প্রভাবে প্লেটগুলি চলাচল করছে। প্লেটগুলি কোথাও বা দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পরস্পরের বিপরীত দিকে চলতে থাকে। এই ধরনের প্লেটগুলিকে diverging plates বলা হয়। দুটি প্লেটের মাঝখানের সৃষ্টি হওয়া fault বা ফাটলের মধ্য দিয়ে ভূগর্ভের ম্যাগমা বেরিয়ে আসে। ফলে সমুদ্রের মাঝে দীর্ঘ পর্বত শ্রেণীর উৎপত্তি হয়েছে। সমুদ্রতলের বিস্তৃতি ঘটছে। পাত সীমান্ত অঞ্চলে ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে। এমন সব ঘটনা ঘটছে আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে যেখানে উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকা পাত ইউরোপ এবং আফ্রিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পশ্চিম দিকে সরে যাচ্ছে।

আবার কিছু ক্ষেত্রে দুটি পাত পরস্পরের দিকে এগিয়ে এসে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এই ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে হিমালয় পর্বত জুড়ে। ভারতীয় পাত যা ভারতীয় উপদ্বীপ, ভারত মহাসাগর এবং অস্ট্রেলিয়া নিয়ে গঠিত, তা উত্তরে অগ্রসর হয়ে উত্তরের মহাদেশীয় পাত ইউরেশিও পাতের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে প্রায় পাঁচ কোটি বছর আগে। ভারতীয় পাতের অপর নাম ইন্দো অস্ট্রেলীয় পাত। দুটি পাতের সংযোগস্থলে ভারতীয় পাতের উত্তরপ্রান্তে টেথীস নামের একটি অগভীর অবতল ক্ষেত্র বা syncline ছিল। তার গভীরে বিপুল পরিমাণ পাললিক শিলার সঞ্চয় ছিল। দুটি পাতের সংঘর্ষের সময় ওই বিপুল পরিমাণ শিলা প্রথমে ভাঁজযুক্ত এবং পরে উপরে উঠে গিয়ে হিমালয় তৈরি হয়েছে, এখনও সেই উত্থান পর্ব চলছে।

সমগ্র কর্মকাণ্ডে যে বিপুল চাপ তৈরি হয়েছিল তার প্রভাবে পাললিক শিলা, sandstone, limestone, shale রূপান্তরিত হয়ে quartzite, marble, slate, phyllite এ পরিণত হয়। দুটি পাতের সীমান্ত অঞ্চলে ভারতীয় পাতের ভারী অংশ যা sima নামে পরিচিত, অবনমিত হয়ে (subduction) ভূগর্ভের তাপে গলিত হয়ে যায়। উত্তপ্ত এই গলিত অংশ দুটি পাতের সীমান্ত বরাবর বাইরে বেরিয়ে আসে বাসল্ট রূপে। Indus suture line জুড়ে কার্গিল সংলগ্ন এলাকায়, জনস্কার অঞ্চলে এর সন্ধান পাওয়া যায়। হিমালয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে গ্রানাইট দেখতে পাওয়া যায়, মূলত ভূমির অভ্যন্তরে ম্যাগমা জমে গিয়ে গ্রানাইট জাতীয় শিলার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতীয় পাতের বছরে দু এক সেন্টিমিটার চলন ঘটে। কিন্তু দুই পাতের মধ্যবর্তী চলন সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তারপর সহসা বেশ কয়েক মিটার সংঘর্ষ সীমা বরাবর চলাচল করলে বিপুল শক্তি নির্গত হয়। তার প্রভাবেই শক্তিশালী ভূমিকম্প তৈরি হয়। হিমালয় অঞ্চল ভূমিকম্প প্রবণ এবং প্রায়শই ভূমিকম্পে বিধস্ত হয়েছে বেশ কিছু এলাকা। এর পরিপ্রেক্ষিতে যোশীমঠসহ কেদারনাথ, বদ্রিনাথ, উত্তরকাশি, রুদ্র প্রয়াগের অবস্থা বা বিপর্যয় প্রবণতার কথা ভাবতে হবে। সমগ্র হিমালয় অঞ্চলের ভূমিকম্পের তীব্রতার নিরিখে IV এবং V নম্বর স্তরে আছে।

সম্প্রতিক কালের বিপর্যয়ের প্রকৃতি ও মানুষের ভূমিকা

কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, বসুধারা, রুদ্রপ্রয়াগ, তেহরি ড্যাম অঞ্চল প্রতিটি স্থানেই বিপর্যয়ের চিহ্ন বা বিপর্যয়ের সম্ভাবনা তীব্র হচ্ছে। আশির দশকে এই সব এলাকায় বসতি ঘন ছিল না। নানান কারণে পর্যটকের সংখ্যাও অধিক ছিল না।কেদারনাথ যাওয়ার পথ ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ এবং সংক্ষিপ্ত। আশির দশকের শেষের দিকেও একটি ধর্মশালা ছিল, কেদারনাথে। গৌরীকুণ্ড থেকে ধীরে ধীরে নদীর তীর ধরে এগিয়ে যাওয়া যেত। মন্দাকিনীর প্রবাহের শব্দ উপভোগ করতে করতে এবং মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিয়ে বিকালের শেষে পৌঁছে গিয়ে ধরমশালায় আশ্রয় মিলত। অন্ধকার-প্রায় কেদারনাথ ধরমশালায় খিচুড়ি জুটত। সে দিন আর নেই। দু হাজার তেরো সালে একরাত্রির প্রবল বৃষ্টি মন্দাকিনীর উৎস গান্ধী সাগরকে পরিপূর্ণ করে তোলে, বিপর্যয়ে হিমবাহের বেশ কিছুটা অংশ ভেঙে পড়ে হ্রদে। মুহূর্তে বরফগলা জল বিপুল স্রোতে ঝাঁপিয়ে পড়ে হ্রদের তীরের দেওয়ালে, মন্দিরের ঠিক পেছনে। বিপুল পরিমাণ জল, নুড়ি পাথর মন্দাকিনীর মধ্য দিয়ে বয়ে যেতে থাকে। মন্দাকিনীর গতিপথ জুড়ে ততক্ষণে গড়ে উঠেছে একের পর এক প্রাসাদোপম বাড়ি। মন্দাকিনীর উপত্যকা প্রায় অবরুদ্ধ। স্বাভাবিক ভাবে মন্দাকিনীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত জলস্রোতের উচ্চতা অনেকটা বেড়ে যায়। পাহাড়ের ঢালে গড়ে ওঠা বসতি পর্যন্ত পৌঁছে যায় জলস্রোত। প্রবল গতিতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, গবাদিপশু, মানুষ। শোনপ্রয়াগে আটকে যায় গাড়ি, মানুষের দেহ। প্রায় পঁচিশ হাজার মানুষের মৃত্যু হল।

এর পরের ঘটনা আরও বিপজ্জনক। পুরনো পথ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে নদী থেকে অনেক উপরে প্রায় পাহাড়ের মাথা দিয়ে তৈরি হয় নতুন পথ। আরও দীর্ঘ। পূর্বের 14 কিমির জায়গায় 22 কিমি অতি কষ্টকর পথ। কেদারনাথ এলাকায় প্রতিদিন প্রাসাদ, হোটেল নির্মাণের কাজ চলছে। 2018 সালেও দেখা গেল প্রচুর দোকান, রেস্টুরেন্ট, হেলিকপ্টার পরিষেবার অফিস, মন্দাকিনীর বুকে ভক্তদের স্নানের ঘাট। 5 মিনিট অন্তর অন্তর হেলিকপ্টার আসছে, তার থেকে বেরিয়ে আসছে প্রচুর পুণ্যার্থী। নির্জন কেদারনাথ এখন ছোট আকারের গঙ্গা সাগর মেলা। অবিরত ডিনামাইট ব্লাস্টিং চলছে। পাহাড়ের অমসৃণ শরীরকে অবিরত ভেঙে সমতল করার চেষ্টা।

একই দৃশ্য বদ্রীনাথেও। বদ্রীনাথ থেকে মানা গ্রাম হয়ে অলকনন্দা ধরে বসুধারা যাওয়ার সহজ, সুন্দর পথ আর নেই। মানা গ্রামের ঠিক পরেই সরস্বতীর সুন্দর একটি প্রবাহ পর্বতের অন্দর থেকে অলকনন্দায় এসে মিশতো। অপূর্ব সুন্দর এই জলপ্রপাত এবং দুই নদীর মিলন দৃশ্য 2004 সালেও অমলিন ছিল। 2022 সালে দেখা গেল সেই এলাকার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। বদ্রীনাথে স্মার্ট সিটি তৈরির কাজ চলছে। নদীতীরের খাড়া পাহাড় ভেঙে সমতল অংশ তৈরি করে তার মধ্যে লেক, প্রাসাদোপম হোটেল তৈরি হচ্ছে। শব্দদূষণ পর্যটকদের অস্থির করে তুলেছে। ধূলায় ঢেকে গেছে বদ্রীনাথের মন্দির শহর। হাজার হাজার নির্মাণ কাজ চলছে। সরস্বতী ও অলকনন্দার মিলনস্থলে ব্রিজ তৈরি হয়েছে। পাহাড়ের অন্দরে মন্দির এবং প্রায় ত্রিশ ফুট উচ্চতার দেব, দেবীর মূর্তি স্থাপিত হয়েছে। মানা গ্রাম পেরিয়ে আবার দোকান, বাজার ছড়িয়ে পড়েছে। রাস্তাটাও আরও চওড়া করতে গিয়ে পাহাড়ের ঢাল ভেঙে ফেলতে হচ্ছে।

ওই অংশে উদ্ভিদহীন তুষার অবহবিকারে এমনিতেই পাহাড়ের ঢাল ক্ষত বিক্ষত। তার উপর যন্ত্রের সাহায্যে পাহাড় ভেঙে ফেলা হচ্ছে। সতপন্থ হিমবাহ থেকে অলকনন্দার উৎপত্তি। হিমবাহের স্খলন বা হিমানী সম্প্রপাত এখানকার স্বাভাবিক ঘটনা। এর ফলে মুহূর্তে বিপুল জলের সরবরাহ হয় এবং নদী তীরের বসতি ভাসিয়ে দেয়। নদী উপত্যকার দুদিকে প্রায়ই ধসের ঘটনা ঘটে। এই অলকনন্দর তীরেই যোশীমঠ বিষ্ণুপ্রয়াগ, কর্ণ প্রয়াগ। বিষ্ণুপ্রয়াগ এর আরও উত্তরে বিষ্ণুগঙ্গার উৎস অঞ্চলে মুহুর্মুহু ধস ঘটছে। বিপুল পরিমাণ নুড়ি, পাথর স্রোতের সঙ্গে এসে নদীর বিভিন্ন স্থানে, যেখানে স্রোত বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়েছে সেখানে জমা হচ্ছে। কর্ণপ্রয়াগে গত বছর অক্টোবর মাসে একটি নতুন দৃশ্য দেখা গেল, যা অতীতে দেখা যায়নি। বিপুল পরিমাণ মোরেন অর্থাৎ হিমবাহ সঞ্চিত নুড়ি, পাথর কর্ণ গঙ্গা বা পিন্ডার নদী দ্বারা বাহিত হয়ে কর্ণপ্রয়াগ শহর লাগোয়া এলাকায় জমা হয়েছে।

এর ফলে প্রবল শক্তির অলকনন্দার জলস্রোত ও অবরুদ্ধ হয়ে খানিকটা পশ্চিমে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে। এই বিপুল পাথুরে সামগ্রী নিশ্চয়ই ধসেরও ঘটনাকে নিশ্চিত করে, আবার বিপুল সঞ্চয় বয়ে আনার ক্ষমতাও নদীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত জলের পরিমাণ বৃদ্ধিকেও নিশ্চিত করে।

নদীর পূর্ণ যৌবন লাভ হিমালয় অঞ্চলের স্বাভাবিক ঘটনা। বর্তমান নদী খাত বা উপত্যকাগুলি অনেক ক্ষেত্রে পূর্বের নদীখাতের নিচে অবস্থান করছে। যে রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে তার অধিকাংশই আসলে পূর্বের নদীর সঞ্চয়ের ফলে গড়ে ওঠা উপত্যকা। এমনকি বহুক্ষেত্রে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে দুদিকের দেওয়ালও আসলে নদীর অনেক আগের তৈরি করা নদীর বুক। নিজের তৈরি করা বুক বা উপত্যকা নদী নিজেই ক্ষয় করে আরও গভীর অথচ সংকীর্ণ উপত্যকা তৈরি করে চলেছে হিমালয়ের নদীগুলি। একই আমরা নদীর পুনর্জীবন লাভ বলি।

হিমালয়ে নবীন ভঙ্গিল পর্বত। তার গঠন প্রক্রিয়া এখনও চলছে। ভূমির উত্থান চলছে, কখনও ধীর গতিতে, কখনও অতি দ্রুত। এর ফলে নদীর প্রবাহপথ বরাবর ভূমির ঢালের পরিবর্তন হয়। ফলে নদীর প্রবাহের গতি বেড়ে যায়। গতি বাড়লে ক্ষয় করবার ক্ষমতাও বেড়ে যায়। ফলে নিজের তৈরি করা চওড়া উপত্যকা ভেতরে সংকীর্ণ গভীর উপত্যকা তৈরি করে। ওই পরিত্যক্ত চওড়া নদী উপত্যকায় বসতি গড়ে ওঠে, কৃষি জমি তৈরি হয়। স্বাভাবিক ভাবে কৃষিজমি, বসতির ঘরবাড়ি বিপর্যয়ে পড়ে। শুধু যে ভূমির আন্দোলনে নদীর পুনর্জীবন ঘটে তাই নয়, নদীর উৎস অঞ্চলে, যাকে catchment basin বলি, সেই এলাকায় অল্প সময়ে প্রবল বর্ষণ অথবা হিমবাহের ধস, যাকে হীমানি সম্প্রপাত বলা হয়, তাহলে নদীর মধ্য দিয়ে প্রবল জলের সরবরাহ ঘটে। এর পরিণতি হল নদীর তীরবর্তী গ্রাম, শহর এবং কৃষিজমি ভেসে যায়। একই কারণে রুদ্রপ্রয়াগ, দেবপ্রয়াগ, তেহরিভয়ানক বিপদের সম্মুখীন হবে। গঙ্গার প্রবাহ বরাবর হারশিল গ্রামের কাছে ডানদিক থেকে সিয়ান এসে গঙ্গায় বিপুল ধসের সামগ্রী নিয়ে মিলিত হয়েছে। গঙ্গা এখানে একাধিক চর তৈরি করেছে, প্রায় অবরুদ্ধ অবস্থা। 2004 সাল থেকে।

এই অবস্থা দেখে আসছি। কিন্তু যদি কখনও অবরুদ্ধ-প্রায় গঙ্গায় বিপুল জলের সরবরাহ হয় তখন সুনামির মতো সব ভাসিয়ে নিচের দিকের বসতি নিশ্চিহ্ন করবে। মনে রাখতে হবে হারসিল কিন্তু নিচু এলাকার একটি বড় গ্রাম, আপেল চাষের জন্য বিখ্যাত। একই রকম ঘটনা বিগত কুড়ি বছর ধরে নেপালের এভারেস্ট অঞ্চলে ঘটছে।

এই অঞ্চলের বিভিন্ন সময়ে মূল হিমবাহ থেকে হিমবাহের অংশ বিশেষ বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে। এভারেস্টের খুম্বু হিমবাহ বেস ক্যাম্প অঞ্চলে প্রায় প্রতিনিয়ত ভেঙে পড়ছে, এই হিমবাহ থেকে কোশী নদী জল পায়। মাঝে মধ্যে খুম্বুর বিরাট অংশ ভেঙে পড়ে, বিপুল জলরাশি নদীতে চলে আসে। আবার আমা দাবলান শৃঙ্গের ঝুলে থাকা হিমবাহ পাঁচ, সাত বছর অন্তর অন্তর ভেঙে পড়ে। যেহেতু এই এলাকায় একাধিক পর্বত শৃঙ্গ আছে, যেমন মাকালু, মানাসলু, চো ইও, এবং একাধিক বৃহৎ হিমবাহ থেকে হিমানি সম্প্রপাতের ঘটনা ঘটে, কোশির বিপুল জলরাশি প্রায়ই সুনামির মতো আছড়ে পড়ে। নেপালের বহু স্টিল ব্রিজ, নদী তীরের বহু বসতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তার চিহ্ন নামচে, থিয়াংবছে, পাংবছে, মাছের মো প্রভৃতি জায়গায় লক্ষ করা যায়। সেই জলস্রোত কিন্তু ভারতের বিহারে ও ঢোকে। কোশী নদী তার প্রবাহপথ পাল্টায়, ভয়ানক বন্যার আগমন ঘটে প্রায় প্রতিবছর। হিমানী সম্প্রপাত, নদীর অববাহিকা অঞ্চলে ধস, উৎস অঞ্চলে প্রবল বর্ষণ, বা তুষারপাত কিংবা ভূ-আন্দোলনের কারণে সংঘটিত বিপর্যয় আসলে প্রাকৃতিক কারণে বিপর্যয়। কিন্তু এই সব বিপর্যয়ে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি পায় মানুষের কার্যকলাপে। নদীর তীর বরাবর বসতির বিস্তার,হোটেল নির্মাণ, রাস্তা তৈরির উদ্দেশ্যে পাহাড়ের শরীর ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া অথবা গাছপালা ধ্বংস করে দেওয়া উপরে উল্লিখিত বিপর্যয়কে আরও ভয়াবহ করে তোলে। দেব প্রয়াগ, রুদ্র প্রয়াগ এই দুটি শহরে অতিরিক্ত গৃহ নির্মাণ একেবারে নদীর বুক থেকেই শুরু হয়েছে।

আর একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। হিমালয়ের নদীগুলিকে অসংখ্য জায়গায় বাঁধ দিয়ে নদীর গতিরোধ করা হয়েছে এবং সম্ভাব্য বিপদকে নিশ্চিত করেছে।

হিমালয়ে বৃহদাকৃতির ড্যাম নির্মাণ কর্মসূচি

আশির দশকের প্রথমে, 1984 স্থানীয় অধিবাসীদেরপ্রবল প্রতিরোধ অগ্রাহ্য করে ভিলাঙ্গনা ও ভাগীরথীর মিলনস্থলে তেহরিতে ড্যাম তৈরির কাজ হল। দীর্ঘ কুড়ি বছর পরে 2004 সালে গিয়ে দেখা গেল তখনও কাজ চলছে। দুটি নদীর সংযোগস্থল ছিল প্রাচীন সমৃদ্ধ জনপদ এবং কৃষির জন্য বিখ্যাত। গ্রামের পর গ্রাম জলের তলায় চলে গেল, হারিয়ে গেল কৃষিজমি এবং গভীর অরণ্য। অধিবাসীদের নিয়ে যাওয়া হল পাহাড়ের মাথায় নিউ তেহরি এলাকায়। বসবাসের অনুপযুক্ত এই এলাকা। ভূবিজ্ঞানীদের সতর্ক বার্তা কোনও কাজে এলো না। দানবীয় এই তেহরি ড্যাম যদি একটু চিড় খায়, তাহলে বিপুল জলরাশি উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। মনে রাখা দরকার সমগ্র হিমালয় অঞ্চল অত্যন্ত ভূমিকম্প প্রবণ বলে এটা ঘটে যাওয়া অসম্ভব নয়।

একইভাবে যোশীমঠেও অলকনন্দা, বিষ্ণুগঙ্গা, অববাহিকা অঞ্চলে বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির জন্য নদী বক্ষে ড্যাম তৈরি করা হয়েছে। তপোবন, ঋষিগড়ে NTPC বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে প্রবলভাবে সমালোচিত হয়েছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ বা সাবধানবাণীকে NTPC কোনো গুরুত্ব দেয়নি। নদীগুলি এই এলাকায় আবার কেন্দ্রীয় চ্যুতিকে অতিক্রম করছে। অর্থাৎ অত্যন্ত অস্থির, গতিশীল এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এবং নানা ধরনের নির্মাণকার্যের ফলে অবরুদ্ধ হয়ে বিপদকে ত্বরান্বিত করেছে।

আলোচনায় সমস্যার রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করা হল। এর মধ্যে থেকেই বোঝা যায় আমাদের করণীয় কি। আমাদের কি হিমালয়কে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে রক্ষা করার কাজ করব না? আমরা কি তীর্থকেন্দ্র-গুলিতে বিপুল নির্মাণ কাজে বিরতি দেব না? হিমালয় জুড়ে রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য নিয়মিত ডিনা-মাইট blasting অব্যাহত রাখব? নদী তীর ঘেঁষে বসতি সম্প্রসারণ করে যাব? হিমালয়ের নদী অবরুদ্ধ করে জলাধার নির্মাণ করেই যাব? নাকি যে কোনও প্রকল্প নির্মাণে ভূতত্ত্ববিদ, বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদদের মতামতকে গুরুত্ব দেব?

লেখক পরিচিতি: শ্রী দাস রানাবেলিয়াঘাটা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক (অবসরপ্রাপ্ত)।