বিভাগগুলি

বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু

Courtesy of Falguni Sarkar/The S.N. Bose Project
১৯৩০ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস


ব্রেকথ্রু ডিজিটাল

বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের ইতিহাসে যে কয়েকজন ভারতীয় বিজ্ঞানী আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ বসু অন্যতম। এই দেশের নবজাগরণ আন্দোলনের সময় মানুষের মনে পুরোনো সামন্তী চিন্তা ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে সংস্কৃতিতে, জ্ঞান- বিজ্ঞান জগতে মানবতাবাদী চিন্তার ঢেউ তুলে ছিলেন বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, প্রফুল্লচন্দ্র, জগদীশচন্দ্র। তাঁরা যেসকল ছাত্রদের বিজ্ঞান গবেষণা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ বসু অগ্রগণ্য।

১৯২১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার পদে যোগ দেন। সেখানে নতুন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ শুরু করা, লাইব্রেরী, প্রাথমিক ল্যাবরেটরি তৈরি করা—এসবেই তাকে বেশী মনোনিবেশ করতে হয়েছে। এই সময়ে কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়ানোর সময় ম্যাক্স প্লাঙ্ক কৃষ্ণবস্তু বিকিরণের যে সমীকরণ প্রস্তাব করেছিলেন সে সম্পর্কে ক্লাসরুমে পড়ানোর সময় তিনি তাতে কিছু অসঙ্গতি খুঁজে পান। তিনি বুঝতে পারেন, প্লাঙ্ক যে বিষয়টি ধরে নিয়ে ক্ল্যাসিক্যাল ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিজম সূত্র দিয়ে সমীকরণটি দাঁড় করিয়েছেন এখানে তার দরকার নেই। তিনি স্ট্যাটিসটিকস প্রয়োগ করে সমীকরণটি বের করলেন। কিন্তু তার এই গবেষণা পত্রটি গৃহীত হয়নি। এরপর আইনস্টাইনের সহায়তায় সেটি জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয়, যা সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে রাতারাতি খ্যাতি এনে দিয়েছিল।

১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান নিযুক্ত হয়ে নতুন লাইব্রেরী, ল্যাবরটরি তৈরিতে মনোনিবেশ করেন। এই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু ও মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেল ও মেস একসাথে করার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল সে ক্ষেত্রে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পূর্ববঙ্গে যেভাবে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল সেই অবস্থায় সুষ্ঠুভাবে পঠন-পাঠন গবেষণা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছিল সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কাছে।

দীর্ঘ 25 বছর পর কলকাতায় ফিরে এসে আবার মৌলিক গবেষণা মনোনিবেশ করেন। এই সময়ে মাটির গুণাগুণ, রসায়ন, জীব বিদ্যা সম্পর্কিত নতুন জ্ঞান আরোহণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি বেশি করে ফলিত শাখায় মনোনিবেশ করেছিলেন - তার লক্ষ্য ছিল প্রত্যক্ষভাবে কিভাবে দেশের অর্থনীতিকে সাহায্য করতে পারে। তারই উদ্যোগে বক্রেশ্বর উষ্ণজল প্রকল্পে পরীক্ষামূলকভাবে হিলিয়াম নিষ্কাশন শুরু হয়। ১৯৫৫ সালে তিনি জাতীয় অধ্যাপক সম্মানিত হন।

১৯৫৬ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে নিযুক্ত হন এবং বিজ্ঞান শিক্ষার উচ্চতর পাঠক্রম শুরু করার প্রচেষ্টা করেন। তিনি আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে বিশ্বভারতীকে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। ছাত্রদের হোস্টেলের উচ্ছিষ্ট খাদ্য ও বর্জ্য পদার্থ থেকে কীভাবে চাষের সার তৈরি করা যায় এসব ব্যবহারিক বিষয়ে উৎসাহিত করতেন। কিন্তু সেখানে যান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও অন্ধবিশ্বাস এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে মুক্ত চিন্তা এবং বিজ্ঞানের পরীক্ষামূলক সত্যে বিশ্বাসী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পক্ষে এখানে কাজ করা অসম্ভব হয়ে উঠলো। তাই ১৯৫৮ সালে পদত্যাগ করে কলকাতায় চলে আসেন।

অধ্যাপক বসু শুধুমাত্র স্ট্যাটিস্টিকাল পদ্ধতি প্রয়োগ করে কৃষ্ণবস্তু বিকিরণের প্লাঙ্ক কৃত সমীকরণের অসঙ্গতি দূর করেন, যা বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ফোটন কণা যে স্ট্যাটিসটিকস মেনে চলে, আইনস্টাইন তাকেই গ্যাসের পরমাণুতে প্রয়োগ করে ১৯২৪ থেকে ১৯২৫ সালে চারটি গবেষণা পত্র রচনা করেন এবং তত্ত্বের জন্ম দেন তা বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স নামে পরিচিত। বিজ্ঞানী ডিরাক ১৯২৯ সালে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার যে বই লিখেন সেখানে বোস কৃত স্ট্যাটিসটিকস মেনে চলা কণাদের ‘বোসন’ নামে অভিহিত করেন।

অধ্যাপক বসু গবেষণাগারের ভিতরে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়কাল যে একদল যুবক স্বাধীন ভারতবর্ষকে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে চেয়েছিল তাদেরই একজন ছিলেন তিনি। জীবনভর স্বপ্ন দেখেছেন ভারতবর্ষে কিভাবে আধুনিক শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া যায়। মনেপ্রাণে স্বাধীনচেতা সত্যেন্দ্রনাথ বসু দেশের মানুষের সেবার রাস্তা হিসেবেই বিজ্ঞান চর্চা, গবেষণা ও অধ্যাপনা করেছেন।

মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চায় বিশ্বাসী ছিলেন অধ্যাপক বসু। তাই 1948 সালের 25 জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করলেন বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ। জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকা চালুর উদ্যোগে। তিনি বুঝেছিলেন স্বাভাবিক বিকাশের মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষায় শিক্ষা চাই, তাই তিনি বাংলা ভাষায় শিক্ষা দানের সমর্থক ছিলেন। অনেকেই মনে করেন তাঁর গবেষণার জন্য পরিবেশ, উপকরণ, পত্র-পত্রিকা, পুস্তিকা, যৌথ গবেষণা সংস্কৃতি ও সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল তা থেকে বঞ্চিত ছিলেন অধ্যাপক বসু। কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা, নিজেকে জাহির করা, প্রতিষ্ঠা করার মনোভাব থেকে বিজ্ঞান চর্চা করেননি তিনি, তিনি বিজ্ঞান চর্চা করেছেন ভালোবেসে, দেশের প্রয়োজনে। বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি কেনার খুবই বিরোধী ছিলেন। নিজে ছাত্রদের ও টেকনিশিয়ান ডেকে বাজার থেকে সাধারণ যন্ত্রাংশ কিনে ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি তৈরি করেছেন ও করিয়েছেন।

বিজ্ঞানের জগতে দর্শনের প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে বিশেষ করে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা তত্ত্ব আসার পর কিছু অনিশ্চয়তা, অসঙ্গতি দেখা দেয়—যে সম্পর্কে আইনস্টাইনও সবর হয়েছিলেন, এই সম্পর্কে তিনি বহু প্রশ্ন ভাবি বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্যে রেখে গেছেন।

তথ্যসূত্র:

১. প্রকৃতি, ব্রেকথ্রু প্রকাশিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা

২. ইন্টারনেট