বিভাগগুলি

লুই পাস্তুর

By Paul Nadar

নীলেশ মাইতি

1892 সালে ফ্রান্সের একজন শ্রেষ্ঠ সন্তানের 70 তম জন্মদিন উপলক্ষে ফ্রান্স সরকার সেদিন জাতীয় ছুটি ঘোষণা করেছে। দেশ বিদেশ থেকে হাজার হাজার অনুরাগী এসেছেন তাঁদের প্রিয় মানুষটিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে। আনন্দ উৎসব মুখর দিনের বিপরীতে যাকে ঘিরে অনুষ্ঠান তাঁর মনে কিন্তু শান্তি নেই। তিনি প্রত্যক্ষ করছেন কীভাবে আগ্রাসী স্বৈরাচারী মনোভাব এক দেশকে অন্য দেশের উপর আক্রমণ করবার মনোভাব যোগায়, যুদ্ধের মারণ লীলায় উন্মত্ত করে তোলে। সামাজিক এই অবক্ষয় তাঁর মনকে করে তুলেছে ব্যথিত। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রেক্ষাগৃহে যখন সবাই এই নিরহংকারী, সরল, সাদাসিধে মানুষটির জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর ভাষ্যের জন্য উন্মুখ, তখন এই মানবতাবাদী, সত্যদ্রষ্টা মানুষটি জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেছিলেন, "আমি সমস্ত জীবন ধরে বিশ্বাস করেছি, একমাত্র বিজ্ঞান আর শান্তির চেতনাই পারে সমস্ত অজ্ঞতা আর যুদ্ধের বিভীষিকাকে দূর করতে। বিশ্বাস করুন, একদিন সমস্ত দেশই সম্মিলিত হবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে, শান্তি-সহযোগিতার পক্ষে থাকবে; আর সেই ভবিষ্যৎ হবে বর্বরদের নয়, শান্তিপ্রিয় মানবজাতির।" বিজ্ঞান ও সত্যনিষ্ঠার প্রতি উৎসর্গীকৃত এই মানুষটির নাম লুই পাস্তুর।

দীর্ঘ কয়েক শতাব্দীর ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও সামন্তীসমাজের কূপমণ্ডূকতাকে ভেঙ্গে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের ইউরোপে শুরু হয়েছে নতুন সূর্যোদয়। অন্ধবিশ্বাসকে বর্জন করে যুক্তিবাদকেই আশ্রয় করেছে মানুষ। অন্ধকারময় মধ্যযুগে ভাববাদী দর্শনের যে একচ্ছত্র শাসন ছিল, ধীরে ধীরে তার অবসান হচ্ছে। দেশে দেশে শুরু হচ্ছে নতুন উদ্যমে বিজ্ঞানের চর্চা। এভাবেই এলেন দাভিঞ্চি (1452-1519), প্যারাসেলসাস (1493-1541), কোপার্নিকাস (1473-1543), কেপলার (1571-1630), গ্যালিলেও (1564-1642)। পরের শতকে এই গবেষণা আরও ব্যাপক ও বহুধা হল। তার পথ ধরেই এলেন নিউটন (1643-1727), লামার্ক (1744-1829), কুভিয়ার (1769-1832), প্রিস্টলি (1733-1804), ক্যাভেন্ডিস (1731-1810), শীলি (1742-1786) ও ল্যাভয়সিয়ারের (1743-1794) মতো বিজ্ঞান সাধকেরা। এর পরবর্তীতেই লুই পাস্তুরের জন্ম।

জন্ম ও শৈশব

1822 সালের 27 ডিসেম্বর ফ্রান্সের জুরা প্রদেশের দোল শহরের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লুই পাস্তুর। তবে তিনি বেড়ে উঠেন আরবোয়া শহরে। তিনি ছিলেন জিন-জোসেফ পাস্তুর এবং জ্যানি-এটিয়েনেট রোকি দম্পত্তির তৃতীয় সন্তান। লুইয়ের বাবা প্রথম জীবনে নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীর সেনাধ্যক্ষ ছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর বাবা নিজের গ্রামে ফিরে এসে পিতামহ-পিতার সূত্রে প্রাপ্ত পেশার ভিত্তিতে একটি ছোট ট্যানারি (চামড়া তৈরির কাজ) কারখানা গড়ে তোলেন এবং পাকাপাকিভাবে বসবাস আরম্ভ করেন। অন্যদিকে তার মা এটিয়েনেট পেশায় ছিলেন বাগানের মালিনী। শৈশবে শিশু পাস্তুরের জীবন শুরু হয়েছিল খুবই সাদামাটাভাবে। কেউ ভাবতেই পারেনি যে এই শিশু একদিন জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী হবে। জোসেফ কোনোদিনই তার পুত্র লুইকে ট্যানারির ব্যবসায়ে যুক্ত করতে চাননি। তার ইচ্ছা ছিল পুত্র উপযুক্ত শিক্ষালাভ করুক।

শিক্ষা ও গবেষণা

1831 সালে পাস্তুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডিতে প্রবেশ করেন। এই সময় তিনি বিদ্যালয়ের রুটিনমাফিক পড়াশোনার প্রতি তেমন মনোযোগী ছিলেন না। বরং পড়াশোনার বদলে এসময় তাঁর বিশেষ আগ্রহের জায়গা ছিল মাছ ধরা এবং ছবি আঁকা। তার পরিবার ইতিমধ্যে নিজগ্রাম পরিত্যাগ করে বেসানকনের কাছে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে পাস্তুর বেসানকনের একটি স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর 1838 সালের অক্টোবরে পেনশন বারবেটে ভর্তির উদ্দেশ্যে প্যারিসে চলে যান।

কিন্তু মুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠা লুই প্যারিস শহরের একঘেয়ে জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে পারেননি। সেই কারণে শহরের বন্ধ পরিবেশে মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। স্মৃতিচারণ করে তিনি একবার এক চিঠিতে লিখেছিলেন, "যদি আবার বুক ভরে চামড়ার গন্ধ নিতে পারতাম, কয়েক দিনেই আমি সুস্থ হয়ে উঠতাম।" এই কারণে নভেম্বরেই প্যারিস ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসেন। ফিরে এসে 1839 সালে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের উদ্দেশ্যে রয়‍্যাল কলেজে ভর্তি হন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে 1840 সালে দর্শনশাস্ত্রে ব্যাচেলর অব আর্টস ডিগ্রি অর্জন করেন। নিজের কলেজেই তিনি একদিকে গণিতে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন, অন্যদিকে বিজ্ঞানে ডিগ্রি অর্জনের জন্য পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। এর ঠিক দুই বছর পর 1842 সালে রসায়নশাস্ত্রে ব্যাচেলর অব সায়েন্স ডিগ্রি অর্জন করেন।

1842 সালে প্যারিসের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ইকোল নরমলে সুপেরিওর-এর প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন। তিনি প্রথম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, তবে তার র‍্যাঙ্কিং কম ছিল। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন পরবর্তী বছর আবার পরীক্ষা দেবার। যে প্যারিস ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, সেই প্যারিসে তার পুনরাগমন ঘটে। পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য তিনি পেনশন বারবেটে ফিরে যান। 1843 সালে ভাল ফলাফল নিয়েই পাস করেন এবং ইকোল নরমলে সুপেরিওরে প্রবেশ করেন। 1845 সালে তিনি বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

অধ্যাপনা ও গবেষণা

1846 সালে টর্নন কলেজ (Collège de Tournon)-এ পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত হন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে পাস্তুরের অন্যতম প্রিয় একটি বিষয় ছিল রসায়ন। তিনি এই সময় পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন এবং সেই সাথে দিজোঁ ও স্ত্রাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। 1847 সালে পাস্তুর ফ্রান্সের ইকোল নরমল থেকে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে তিনি জৈব যৌগের আলোক সমাণুতা নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি দেখান যে, আলো যখন জৈব যৌগের দ্রবণের ভেতর দিয়ে যায় তখন এর দিক পরিবর্তন ঘটে। তিনি প্রস্তাব করেন যে, একই জৈব যৌগ যাদের গঠন এক, তারা সমাণু হতে পারে যদি তারা একে-অপরের আলো প্রতিবিম্ব হয়। এরপর কিছুদিন ডিজন লাইসিতে (Dijon Lycée) পদার্থবিদ্যায় অধ্যাপনা করার পরে 1848 সালে স্ট্যাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের অধ্যাপক হিসেবে অধ্যাপনা করার ডাক পান। এই প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করেন পাস্তুর।

পারিবারিক জীবন

1848 সালে দিজোঁ লিসিতে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য লুই পাস্তুর রসায়নের অধ্যাপক হিসেবে চাকরি করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর মঁসিয়ে লরেস্টের কন্যা মেরি লরেন্তের সাথে প্রণয়ে আবদ্ধ হন 1849 সালে। মেরি লরেন্তে শুধু তার স্ত্রী হিসেবেই যোগ্য ছিলেন না, ছিলেন একজন যোগ্য সহচরী। বিজ্ঞান-তপস্বী স্বামীর সাধনায় নিজেকেও যুক্ত করেছিলেন মেরি। পাস্তুর তার নিজ স্ত্রী সম্পর্কে গর্ব করে বলতেন, একজন স্ত্রী হবার জন্য যত গুণাবলী দরকার তার সবই আমি তার মধ্যে খুঁজে পাই। এই দম্পত্তির ঘর আলো করে জন্ম নেয় পাঁচ সন্তান, এদের মধ্যে তিনজন শৈশবে টাইফয়েডের কারণে মারা যায়। নির্মম এ ঘটনায় তিনি মুষড়ে না পড়ে এর প্রতিকারে মনোনিবেশ করেছিলেন।

বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে পাস্তুরের অবদান

উনবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের গবেষণায় নিজেকে উৎসর্গ করা বিজ্ঞানীদের মধ্যে লুই পাস্তুর অন্যতম। সেকালে দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের (ফ্রান্স ও জার্মানি) রাষ্ট্রপ্রধানরা যখন পরস্পরকে শত্রু বিবেচনা করে একে অন্যের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দিতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ, ঠিক তখন এই বিজ্ঞানী দিন রাত এক করে, সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মানবজাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে নিজেকে গবেষণায় মগ্ন রেখেছিলেন। তাঁর আবিষ্কার কখনও বাঁচিয়ে দিয়েছে লক্ষ লক্ষ জীবন, কখনও বা পুনরুদ্ধার করেছে প্রায় ডুবতে বসা ব্যবসা, কারও জীবনে এনে দিয়েছে স্বস্তির নিঃশ্বাস। নিছক জ্ঞানচর্চা, ডিগ্রি অর্জন বা পদক লাভই পাস্তুরের কাছে বিজ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি ছাত্রদের বলতেন, "বিজ্ঞান বলতে তুমি কী বোঝ? গুচ্ছের যন্ত্র, রাশি রাশি পরীক্ষানল, পাতন প্রক্রিয়া, পরীক্ষার পর পরীক্ষা, রাসায়নিকের একগুচ্ছ তালিকা, নামি জার্নালে গবেষণা পত্র ছাপানো এই যদি বিজ্ঞান হয়, তাহলে তার মধ্যে আমি নেই। বিজ্ঞান বলতে একটা বোধই কাজ করে আমার ভেতর। আর তা হল মানুষের কল্যাণের জন্য কিছু করা, যে মানুষ দেশ কাল পাত্র নির্বিশেষে ছড়িয়ে আছে সারা পৃথিবীতে"। পাস্তুরের সারা জীবনের বিজ্ঞান সাধনা এই মন্ত্রটিকে সামনে রেখেই। তাই বিভিন্ন জৈব যৌগের স্ফটিক নিয়ে কাজ করতে করতেই একসময় তিনি জীবাণু নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন।

মদ শিল্প: ইউরোপে মদ তৈরি একটি প্রধান শিল্প, যার সঙ্গে বহু মানুষের রুটি-রুজি জড়িত। 1854 সালে মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে লিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগের ডিন এবং প্রধান অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন লুই পাস্তুর। তখন থেকেই তিনি স্থানীয় মদের কলগুলোতে গাঁজন প্রক্রিয়া (fermentation) নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তিনি দেখান অ্যালকোহল উৎপাদন ইস্টের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। সেই সময়ে দামী মদ তৈরিতে ফ্রান্সের বিশ্বব্যাপী বেশ খ্যাতি ছিল। আর সেই সুবাদে লিলের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য মদ তৈরির কারখানা। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে মদে টক ভাব আসছিল, যার কারণে ফ্রান্সের মদ ব্যবসাতে এক বিশাল সমস্যা হচ্ছিল। এতে শুধুমাত্র মদ ব্যবসায়ীরাই নয়, সরকারও প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিল, কারণ সরকার মদ থেকে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব পেত। মদ নষ্ট হবার কারণ অনুসন্ধানের দায়িত্ব এসে বর্তায় লুই পাস্তুরের উপর। তিনি এই সমস্যাটি সমাধানের জন্য গবেষণা শুরু করলেন। দিনের পর দিন মদের আড়তে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে আনতেন এবং তাঁর ছোট অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করতেন। তিনি আবিষ্কার করলেন যে মদ নষ্ট হবার জন্য দায়ী হল একধরণের ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া। শুধু মদ নষ্ট হবার কারণ অনুসন্ধান করেই ক্ষান্ত হননি, এই সমস্যা হতে পরিত্রাণের উপায়ও বের করে ফেললেন। তিনি মদকে 120 ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় গরম করার পরামর্শ দিলেন। এতে ক্ষতিকর জীবাণু নষ্ট হয়ে যাবে। তার এই আবিষ্কারের কারণে ফ্রান্সের লক্ষ লক্ষ টাকার মদের ব্যবসা রক্ষা পায়। তাঁর এই আবিষ্কার আজ পৃথিবী জুড়ে পাস্তুরাইজেশন (Pasteurization) নামে সমাদৃত। এই যুগান্তকারী আবিষ্কার পরবর্তীতে বহুজন চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য কাজে লাগিয়েছেন।

পাস্তুর এবার মদে ব্যক্টেরিয়ার উৎস নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তৎকালীন সময়ে অনেকে মনে করতেন ব্যাক্টেরিয়া নির্জীব বস্তু থেকে আপনা আপনি সৃষ্টি হয়। এর বিপক্ষেও অনেকে বিজ্ঞানী ছিলেন। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের সময় থেকেই এই বিতর্ক ছিল, কিন্তু কোনও বিজ্ঞানসম্মত উত্তর ছিল না। পাস্তুর পরীক্ষার মাধ্যমে দেখান, নির্জীব বস্তু থেকে ব্যাক্টেরিয়া বা কোনও রকম জীবনের সূত্রপাত হতে পারে না। তিনি প্রমাণ করেন, বাতাস ও অন্যান্য মাধ্যম থেকে মদে ব্যাক্টেরিয়া আসে। পাস্তুর তার বিখ্যাত পরীক্ষার সাহায্যে যেটা দেখিয়েছিলেন তা হল, জীবাণুমুক্ত নিয়ন্ত্রিত (পাস্তুর প্রদত্ত) পরিবেশে প্রাণ আপনা আপনি জন্ম নেয় না। কিন্তু পরিবেশে জীবাণু থাকলে তা থেকে জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে।

পাস্তুরের পরীক্ষা স্বতঃজননবাদকে (Theory of spontaneous generation) ভুল প্রমাণ করেছে। এই স্বতঃজননতত্ত্বের মূল কথা হল- জটিল জীব তার পূর্ণ অবয়বে নিজে নিজেই 'সৃষ্টি' হয়। পাস্তুরের গবেষণা মূলত এই ধরনের 'সৃষ্টিবাদী' ধারণাকেই বাতিল করে দেয়।

রেশম শিল্প পুনরুদ্ধার : সেকালে ফ্রান্সের অন্যতম প্রধান একটি শিল্প ছিল রেশম শিল্প। কিন্তু কোনও এক অজানা রোগে হাজার হাজার গুটিপোকা নষ্ট হচ্ছিল। এক মহামারীতে রেশম পোকার উৎপাদন হ্রাস পেয়েছিল। শুধু 1861 সালেই রেশম গুটির মড়কের জন্য ফ্রান্সকে এক কোটি ত্রিশ লক্ষ ফ্রাঁ ক্ষতি সইতে হয়েছে। রেশম চাষিদের ঘরে ঘরে পড়ে গেছে হাহাকার। এই নিয়ে গবেষণাও কম হয়নি। তবে কেউ এর কারণ বা প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেননি। 1861 সালে ফ্রান্স সরকার পাস্তুরকে ফ্রান্সে রেশম শিল্পের সমস্যা সমাধানে আহ্বান জানায়। কিছু যন্ত্রপাতি, বই ও কাগজ নিয়ে পাস্তুর রওনা হয়ে গেলেন দক্ষিণ ফ্রান্সের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায়। দিনে টানা আঠারো ঘণ্টা কাজ করে গেলেন, খুব স্বল্পই বিশ্রাম নিতেন। টানা তিন বছর নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে এই রোগের কারণ ও সমাধান দুই-ই আবিষ্কার করে ফেললেন। পাস্তুর লক্ষ্য করেন, রেশম পোকার এই সমস্যাটি বংশগত অর্থাৎ মায়ের থেকে পরবর্তী প্রজন্মে সংক্রামিত হয়। তাই তিনি কেবলমাত্র রোগমুক্ত গুটি বাছাই করার প্রস্তাব করেন।

তার এই সিদ্ধান্তে ঠাট্টা-বিদ্রূপ এলেও তিনি ছিলেন তার সিদ্ধান্তে অটল। যার সুফল সেই বছর রেশম চাষিরা পেয়েছিল। এই অমানুষিক পরিশ্রমের বিনিময়ে যৎসামান্য পারিশ্রমিক লাভ করলেও তাঁর এবিষয়ে কোনও অভিযোগ ছিল না। দুর্দিনে দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছিলেন এতেই তাঁর আত্মতৃপ্তি। এই গবেষণা চলাকালেই পাস্তুরের পারিবারিক জীবনে নেমে এল বিপর্যয়। তাঁর পিতা মারা গেছেন, ছেলেও মারা গেছে এবং তিনি নিজে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে শরীর ও মস্তিষ্কের একদিকের কার্যকারিতা হারালেন। কিন্তু বিজ্ঞানচর্চা থামল না, থামতে পারে না। কারণ তাঁর জীবনটাই যে মানবকল্যাণে নিয়োজিত। চোখের সামনে সমস্যা দেখবেন আর তিনি চুপচাপ থাকবেন, তা কি কখনও হয়?

জীবাণু তত্ত্ব: 1867 সালে পাস্তুর সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের প্রধান অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। এসময় তিনি জীবাণু তত্ত্ব (Bacteriology) নিয়ে তার গবেষণা শুরু করেন। তিনি তাঁর তত্ত্বে দেখান যে, অণুজীব দ্বারা কিছু রোগ সংঘটিত হতে পারে এবং সেগুলো জল ও বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাঁর এই তত্ত্বের মূল কথা ছিল, অণুজীব কোনও বৃহদাকার জীবের শরীরে রোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম।

পোল্ট্রি শিল্প ও গবাদি পশু রক্ষা: 1877 সালের কথা। ফ্রান্সে মুরগির মধ্যে ব্যাপক আকারে কলেরার প্রভাব দেখা দিল। খুব স্বল্প সময়ে তা মহামারি আকারে এক ফার্ম থেকে পার্শ্ববর্তী ফার্মে ছড়িয়ে পড়ছিল এতে পোলট্রি ব্যবসা বিপুল পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হতে থাকে। তিনি এই বিষয় নিয়ে অনুসন্ধানের কাজ শুরু করে দেন এবং রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করেন। একই সময়ে এল আর এক মড়ক। দুরারোগ্য অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ গবাদি পশু। পশু ব্যবসায়ীদের লোকসান হচ্ছে কোটি কোটি ফ্রাঁ। সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে? আবারও ডাক পড়ল পাস্তুরের। প্রতিবন্ধী বিজ্ঞানী শুরু করলেন গবেষণা। বুঝতে পারলেন অ্যানথ্রাক্স ব্যাসিলি নামক একটি জীবাণু এই মহামারির জন্য দায়ী। এই জীবাণু অ্যানথ্রাক্স রোগের কারণ, যার কারণে চারদিকে গবাদি পশুর মৃত্যু অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তিনি এই রোগের প্রতিষেধকও আবিষ্কার করে ফেললেন। এক্ষেত্রে তিনি কিছু নিষ্ক্রিয় জীবাণু ভেড়ার শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেখেন, সেই ভেড়াগুলি পরবর্তীতে আর রোগ সৃষ্টিতে সক্ষম জীবাণু দিয়ে সংক্রমিত হয় না।

জলাতঙ্ক বা হাইড্রোফোবিয়া: 1880-র দশকের মাঝামাঝি পাস্তুর জলাতঙ্ক বা হাইড্রোফোবিয়া নিয়ে কাজ করা শুরু করেন এবং তাঁর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ হল জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার। সিদ্ধান্তটি একদমই আকস্মিক ছিল না কারণ জলাতঙ্ক ছিল সে যুগের এক আতঙ্কের নাম। কোনও মানুষকে পাগলা কুকুর কামড়ালে অধিকাংশ সময়েই সেই ক্ষত কিছুদিনেই মধ্যেই শুকিয়ে যেত। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরেই প্রকাশ পেত জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ, ফল নিশ্চিৎ মৃত্যু। অনেকেই এই রোগ নিয়ে গবেষণা করছিলেন, কিন্তু কেউ তখন পর্যন্ত সফল হতে পারেননি। সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছেন কত জলাতঙ্ক রোগীর মর্মান্তিক মৃত্যু, দেখেছেন কেমন অসহায়ের মতো আত্মীয় পরিজনদের সামনে তিল তিল করে মরে যেতে হয় রোগীকে, কারুর কিছু করার থাকে না। সেই সব ছবি তিনি জীবনে কখনও বিস্মৃত হননি। কিন্তু এনিয়ে কাজ করার অবসর পাননি।

1880 সালে হঠাৎ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন এই মহান বিজ্ঞানী। তার অর্ধেক শরীর অবশ হয়ে যায়। এই অবস্থাতেই রেবিস ভাইরাস বা জলাতঙ্ক রোগের উপর গবেষণা শুরু করলেন তিনি। গবেষণার প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নিলেন পাস্তুর। বাড়িতে পুষলেন হিংস্র পাগলা কুকুর। বহু কষ্টে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেললেন সেই হিংস্র কুকুরটিকে। তারপর একটা টেবিলের ওপর শুইয়ে মুখটা নিচু করলেন এবং মুখের সামনে একটা কাচের পাত্র ধরলেন, টপটপ করে তার মধ্যে গড়িয়ে পড়তে লাগল বিষাক্ত লালা। আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন পাস্তুর। ওই বিষাক্ত লালা দিয়েই তৈরি হলো জলাতঙ্কের সিরাম। কতটা পরিমাণ ওষুধ দিলে রোগী সুস্থ হয়ে উঠবে তার কোনও সঠিক ধারণা নেই। সামান্য পরিমাণের তারতম্যের জন্য রোগীর প্রাণ বিপন্ন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যু অনিবার্য, আর সমস্ত দায় এসে বর্তাবে তাঁর ওপর। হাতে নাতে পরীক্ষা করে যাচাই না করলে তো বিজ্ঞানে কোনও কিছুই সত্য হতে পারে না। তাই নিস্তেজ ভাইরাসযুক্ত সিরাম তিনি প্রয়োগ করলেন পাগলা কুকুর কামড়ানো একটি পশুর ওপর। পশুটি বেঁচে গেল। ফলে পরীক্ষার প্রথম ধাপটি সফল হল। মানুষের ক্ষেত্রে যে সিরামটি একইভাবে কাজ করবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? আর মানুষকে তো গিনিপিগের মতো ব্যবহার করা যায় না। অবশেষে অপ্রত্যাশিতভাবেই একটা সুযোগ এসে গেল। 1885 সালের জুলাই মাসে আলাস্কা থেকে ন'বছরের ছেলে যোসেফ মিস্টারকে কুকুরে কামড়েছিল। ছেলেটির মা তাকে এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার তাকে পাস্তুরের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

পাস্তুর যোসেফকে পরীক্ষা করে বুঝতে পারলেন তার মধ্যে রোগের বীজ সংক্রমিত হয়েছে। অল্পদিনের মধ্যেই মৃত্যু অনিবার্য। পাস্তুর স্থির করলেন যোসেফের ওপরই তাঁর আবিষ্কৃত সিরাম প্রয়োগ করবেন। নয় দিন ধরে বিভিন্ন মাত্রায় ওষুধ প্রয়োগ করতে লাগলেন পাস্তুর। একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে যোসেফ। অবশেষে তিন সপ্তাহ পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠল যোসেফ। এক ভয়াবহ মৃত্যুর হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করলেন পাস্তুর। দাবানলের মতো দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ল পাস্তুরের এই অবিস্মরণীয় আবিষ্কারের কথা। সারা পৃথিবীতে হৈ চৈ পড়ে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল জলাতঙ্ক রোগীদের ভিড়ে প্যারিস শহর মহাতীর্থ হয়ে উঠেছে।

তিনি আবিষ্কার করলেন যে জলাতঙ্ক আক্রান্ত কোনও পশুর স্পাইনাল কর্ডের নির্যাসের মাধ্যমে অপর কোনো প্রাণীকে জলাতঙ্কে আক্রান্ত করা যায়। তিনি প্রাণীদেহে রোগ তৈরিতে অক্ষম এমন কিছু জলাতঙ্ক ভাইরাস উৎপাদন করে তা পশুর দেহে প্রয়োগ করেন এবং অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেন।

যোসেফ সারা জীবন পাস্তুরের সঙ্গেই ছিলেন। পাস্তুরের মৃত্যুর পরও পাস্তুর ইন্সটিটিউটের কেয়ারটেকার ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান ফ্যাসিস্ট বাহিনী পাস্তুর ইন্সটিটিউটে জোর করে ঢুকতে চাইলে গেট আটকে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। তাকে গুলি করে হত্যা করে তবেই ফ্যাসিস্ট বাহিনী ইন্সটিটিউটে ঢুকতে পারে।

পদক ও সম্মাননা

পাস্তুর নিজ জীবদ্দশায় অসংখ্য সামরিক ও বেসামরিক পদক, উপাধি, সম্মাননা ও পুরষ্কারে ভূষিত হন। এত নাম-ডাক ও আবিষ্কারের কারণে কিছু মানুষ তাঁর প্রতি বিরুপ হয়ে উঠেছিলেন। তারা কারণে-অকারণে পাস্তুরের নানা দোষ কীর্তন করতেন। কিন্তু নিজের কাজ ফেলে নিন্দা হোক কিংবা প্রশংসা উভয় ক্ষেত্রেই এই বিজ্ঞানী ছিলেন সমানতালে উদাসীন। লুই পাস্তুরের পদ্ধতি অনুসরণ করে পরবর্তীকালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বহু প্রতিষেধক ও ঔষধ ইত্যাদি আবিষ্কৃত হয়েছে।

দেশে লুই পাস্তুরের জনপ্রিয়তা ছিল বিস্ময়কর। একবার ফ্রান্সে লুই পাস্তুরের জনপ্রিয়তার পরিসংখ্যান নেওয়া হয়। সেই পরিসংখানে তিনি পেয়েছিলেন সর্বাধিক সংখ্যক ভোট। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছিলেন যথাক্রমে সম্রাট নেপোলিয়ান ও ভিক্টর হুগো।

বিদেশেও লুই পাস্তুর অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। 1882 সালে পাস্তুর জাতীয় কংগ্রেসের এক অধিবেশনে ফ্রান্সের প্রতিনিধি হয়ে লন্ডনে যান। লুই পাস্তুর যখন অধিবেশন হলে গিয়ে পৌঁছলেন তখন লোকে একেবারে ভেঙে পড়েছে। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। লুই পাস্তুর ভাবছিলেন, রাজা বোধ হয় আসছেন সম্মেলন কক্ষে অধিবেশন উদ্বোধন করতে। লুই পাস্তুর পাশে বসা সভাপতিকে বললেন, নিশ্চয় এখন রাজা আসছেন, তাই সবাই এমন জয়ধ্বনি করছে। সভাপতি জানালেন, না রাজা আসছেন না। ওরা আপনাকেই অভিনন্দন জানাচ্ছেন। ওরা আপনাকেই এক নজর দেখার জন্য এতো ভিড় করেছে। আপনি এ অধিবেশনে আসছেন, এ সংবাদ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

পৃথিবীতে সর্বকালে সর্বযুগে যে মানুষটি মানবসমাজের সর্বাধিক কল্যাণ সাধন করে গেছেন, তিনি হলেন বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর।

দেশপ্রেম

দেশের প্রতি লুই পাস্তুরের মনে ছিল গভীর ভালোবাসা। সমাজ ও দেশের প্রয়োজনে যখনই বিজ্ঞানের গবেষণা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসার প্রয়োজন হয়েছে তখন এক মুহূর্ত দ্বিধা করেননি। তাঁর বিজ্ঞান সাধনার শুরুতে 1848 সালের বিপ্লবের সময় এ পরীক্ষা তিনি দিয়েছেন। তখনও তিনি প্রতিষ্ঠিত হননি, আর্থিক অনটনের মধ্যেই তাঁদের দিন কাটে কিন্তু স্বাধীনতার প্রয়োজনে তিনি তাঁর জমানো দেড়শ ফ্রাঁ বিপ্লবী তহবিলে দিয়েছিলেন এবং কলেজের চাকরি ছেড়ে ন্যাশনাল গার্ডে নাম লিখিয়েছিলেন সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য। 1870 সালে জার্মানির স্বৈরাচারী শাসক কাইজার ফ্রান্স আক্রমণ করে। তিনি পিতৃভূমি রক্ষার স্বার্থে সংগ্রামে ফ্রান্সের সেনাদলে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু তখন তিনি অর্ধপঙ্গু, তাই তিনি সুযোগ পাননি। যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে না পারলেও জার্মান বাহিনীর আগ্রাসন কিছুতেই মুখ বুজে সহ্য করতে পারেননি তিনি।

জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডক্টর অব মেডিসিন উপাধি দেওয়ার সিদ্ধন্ত নেয়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এক চিঠিতে লিখলেন, আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে উপাধি দেওয়া হয়েছে তা গ্রহণ করতে আমি অক্ষম, কারণ আপনাদের সম্রাট শুধুমাত্র পৈশাচিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য দুটি দেশকে মহাযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তিনি নিজে সরাসরি যুদ্ধে যেতে না পারলেও তাঁর পুত্রকে ফরাসী সৈন্যদলে পাঠিয়েছিলেন।

তিনি মানবকল্যাণে নিয়মিত কাজ করে গেছেন, বিনিময়ে খুব স্বল্পই নিয়েছেন। কিন্তু লোকমুখে এমনও কথা প্রচলিত আছে যে, এক জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধের কারণে ফ্রান্সের যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল, শুধুমাত্র লুই পাস্তুরের অ্যানথ্রাক্স রোগের প্রতিষেধক ফ্রান্সকে তার থেকে বেশি অর্থ এনে দিয়েছিল। অথচ লুই শুধু নিজ দেশের দুর্দিনে কিছু করতে পেরেছিলেন- এটা ভেবে সন্তুষ্ট ছিলেন। দেশ-বিদেশের কত সম্মান, উপাধি, পুরস্কার, মানপত্র পেলেন। কিন্তু কোনও কিছুতেই বিজ্ঞান সাধক পাস্তুরের জীবন সাধনার সামান্যতম পরিবর্তন ঘটেনি। আগের মতোই নিরহংকার সরল সাদাসিধা রয়ে গেলেন।

তৃতীয় নেপোলিয়নের দরবারে সম্রাট পাস্তুরের কাছে তার পারিশ্রমিক সম্পর্কে জানতে চান। তার উত্তরে সম্রাট আশ্চর্য হয়ে এত বেশি পরিশ্রম করে, এত কম পারিশ্রমিক নেওয়ার কারণ জানতে চান। সম্রাটের প্রশ্নের উত্তরে তাঁর জবাব ছিল, "একজন বিজ্ঞানী কখনো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য কাজ করে না।"

1887 সালে প্যারিসে তাঁর সম্মানে তৈরি করা হয় পাস্তুর ইন্সটিটিউট, সংক্রামক রোগের উপর গবেষণার কাজ চালানোর জন্য। পাস্তুর অনুভব করতে পারছিলেন তাঁর দেহ আর আগের মতো কর্মক্ষম নেই। মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। সকলের অনুরোধে কর্মজীবন থেকে অবসর নিলেন। মাঝে মাঝেই তাঁর ছাত্ররা তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসত। তিনি বলতেন তোমরা কাজ করো, কখনও কাজ বন্ধ কোরো না।

তাঁর প্রতিটি অবদান তৎকালীন বৈজ্ঞানিক সমাজে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছিল। কেবলমাত্র পাস্তুরের দ্বারা চালিত এক কঠোর সংগ্রামের জন্যই এটা বাস্তবে সম্ভব হয়েছিল। পর্যাপ্ত তথ্য ও পরীক্ষামূলক প্রমাণের সমর্থন ছাড়া তিনি কখনও বিবৃতি দিতেন না। তিনি ছিলেন পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানী। কোনও নতুন সমস্যা সম্পর্কে দিনরাত ভেবেছেন, গবেষণাগারে রাত কাটিয়েছেন, পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করে যতক্ষণ না সত্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন, ততক্ষণ কিছুই তাঁকে থামাতে পারত না। এই মহান বিজ্ঞানী বলেছিলেন, “পূর্বধারণাগুলি হলো সার্চলাইটের মতো যা পরীক্ষার্থীদের পথকে আলোকিত করে এবং তাকে প্রকৃতির পথে পরিচালিত করে। কিন্তু ধারণাগুলি স্থির এবং অপরিবর্তনীয় হয়ে দাঁড়ালেই তারা বিপজ্জনক হয়ে উঠবে... মস্তিষ্কের সর্বাধিক অবনমন হল কোনও কিছুতে বিশ্বাস করা, কারণ মস্তিষ্ক বিশ্বাসই বেশি করে মানতে চায়.."।

পাস্তুর ছিলেন একজন যথার্থই মানবতাবাদী বিজ্ঞানী। তিনি বলেছিলেন, "মানুষের মনে যতদিন অসীমের রহস্য অজ্ঞাত থাকবে ততদিন অসীমের উদ্দেশ্যে মন্দির গড়ে উঠবে....."। 1892 সালে 27 ডিসেম্বর তাঁর 70তম জন্মদিনে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় এক মহোৎসবের আয়োজন করেছিল। সেই সভায় তিনি নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, "Say to yourself first: what have I done for my instruction? And as you gradually advance, 'what have I done for my country?' Until the time comes when you may have the immense happiness of thinking that you have contributed in some way to the progress and good of humanity।" এই উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী, যিনি পরবর্তীকালে মাদাম কুরি নামে সারা বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছিলেন এবং পাস্তুরের মতোই আজীবন মানব কল্যাণে নিজের বিজ্ঞান সাধনাকে নিয়োজিত করেছিলেন।


অন্তিম সময়

Lamiot
পাস্তুর ইনস্টিটিউট

1868 সালে পাস্তুর এক গুরুতর স্ট্রোকের শিকার হন। তিনি প্রাণে বেঁচে যান বটে, তবে তার দেহের বাম দিক পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়। এই দফায় তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। 1894 সালে আবার একটি স্ট্রোক বা ইউরেমিয়ার কারণে পাস্তুরের স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তাররাও তাঁর জীবনের আশা প্রায় ত্যাগ করলেন। নিষ্ঠার সাথে কর্মমগ্ন থাকা মানুষটির শারীরিক অবস্থার দিন দিন অবনতি হতে থাকে। অবশেষে 1895 সালের 28 সেপ্টেম্বর 73 বছর বয়সে এই মনীষীর মৃত্যু হয়। ফ্রান্সের প্যারিস শহরে তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত গবেষণাকেন্দ্র পাস্তুর ইনস্টিটিউট চত্বরেই মহান বিজ্ঞানীকে সমাহিত করা হয়। আজও লাখ লাখ অনুরাগী ভক্ত তাঁকে প্রতিদিন শ্রদ্ধা জানায়। মহান মানবতাবাদী ও কর্মযোগী এই বিজ্ঞানীর জন্মের দ্বিশতবর্ষে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানাই।

[লেখক পরিচিতি: ডঃ মাইতি শিশুরাম দাস কলেজের (দঃ 24 পরগণা) অধ্যক্ষ এবং ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির কার্যকরী সভাপতি এবং প্রকৃতি পত্রিকার সম্পাদক।]