বিভাগগুলি

এক আকাশ নক্ষত্র

Photo by Pixabay


ব্রেকথ্রু ডিজিটাল

রাতের আকাশ, যেদিকেই তাকানো যায় দেখা যাবে তারা আর তারা। তারায় ভরা আকাশ, অপূর্ব সুন্দর এক মনোরম দৃশ্য। যেন মাথার উপর পাতা একটা কালো চাদর, আর সেই চাদরের উপর নানা রঙের মণিমুক্তো কেউ সযত্নে সাজিয়ে রেখেছে। কোনটা নীল, কোনটা সবুজ, কোনটা আবার হালকা হলুদ রঙের। আর সবার ঔজ্জ্বল্যকে ছাপিয়ে নিকশ কালো রাতকে স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নার মায়াময়ী আলোতে সাজিয়ে দেয় এক উজ্জ্বল সাদা গোলাকার আলোকপিণ্ড। এত আলোর; মেলার মাঝে, সবাইকে চমকে দিয়ে অতিথির মত বহুদিন অন্তর আবির্ভাব হয় এক ধবধবে সাদা ঝাঁটার মতো আকারের জ্যোতিষ্কেরা।;

এত বর্ণের মেলা দেখেই তো প্রাচীন মানুষজন ভেবেছিল, মহাকাশ বুঝি কালো রঙের একটা চাঁদোয়া। আর তার উপর বসানো বহু রঙের ও বহু ধরনের মণিমুক্তো। সেই সময়ে মানুষজন লক্ষ্য করলেন যে, আমাদের এই পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য সহ অন্যান্য জ্যোতিষ্করা আবর্তন করে চলেছে। আধুনিক বিজ্ঞানের আবির্ভাব তখনও হয়নি, এইসব দেখে সেই সময়কার একদল চিন্তাশীল মানুষেরা ভাবতে শুরু করলেন যে পৃথিবী স্থির আর তাকে কেন্দ্র করেই বুঝি বাকি সব জ্যোতিষ্কের আনাগোনা--- ধারণা দিলেন ভূকেন্দ্রিক বিশ্ব-তত্ত্বের।

এ তো গেলো জ্যোতিষচর্চার গোড়ার কথা। প্রাচীনকালের জ্যোতিষচর্চার শুরু বললে সাধারণ ভাবে এই সময়কালকেই বোঝানো হয়।

ইতিমধ্যেই সভ্যতা- সংস্কৃতি -বিজ্ঞান এগিয়েছে। আর তারই পথবেয়ে জ্যোতিষশাস্ত্রকে ছাড়িয়ে অগ্রগতির শিখরে আজ জ্যোতির্বিজ্ঞান। সেই অগ্রগতির জয়যাত্রার মধ্য দিয়েই আমরা জেনেছি যে, ওই কালো রংয়ের চাঁদোয়া আসলে মহাশূন্য এবং গায়ে বসানো নানা রকমের মণিমুক্তোর গুলি হল গ্রহ-নক্ষত্র সহ মহাকাশের নানান জ্যোতিষ্ক। যারা মিটমিট করে তার হল নক্ষত্র, যাদের আলো স্থির তারা গ্রহ, অন্যের আলোয় আলোকিত হয়। রাতের আকাশের মোহময়ী জ্যোৎস্নার আলো বিকিরণকারী সবচেয়ে উজ্জ্বল আলোকপিণ্ডটি হল আমাদের পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদ। আর ওই ধবধবে সাদা রঙের ঝাঁটার মতো জ্যোতিষ্কটি আসলে বরফ আর ধূলিকনা দিয়ে গঠিত ধূমকেতু।

সমাজ সভ্যতার পরিবর্তনের ধারায় নবজাগরণের প্রভাতে পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ-সিদ্ধান্তকে ভিত্তি করে উত্তরণ ঘটল যুক্তিভিত্তিক মানসিকতার। যদিও এর আগে পর্যন্ত মানুষের বিশ্বাসের আধার ছিল মনগড়া, ব্যাক্তি নির্ভর সনাতন ভাবনা ধারণার ভিত্তিতে।

এখন সে যা দেখছে, তার সত্য-মিথ্যা প্রশ্ন করে, যাচাই করে বুঝে নিতে চাইল। এল বিজ্ঞান চর্চার এক নতুন অধ্যায়। যার ফলশ্রুতিতে প্রাচীন মনগড়া ভূকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বের ধারণা ভেঙে কোপারনিকাস ও জিওর্দানো ব্রুনোর হাত ধরে এল সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বের ধারণা।

এতদিনের সনাতনী ধর্মীয় ধারণা অনুযায়ী পৃথিবী আর স্থির রইল না। বোঝা গেল সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের মতো পৃথিবীও সূর্যকে কেন্দ্র করে অনবরত পাক খেয়েই চলেছে। পাশাপাশি গ্যালিলিওর আবির্ভাব পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা করে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ করল। তিনি তার আবিষ্কৃত দূরবীন যন্ত্রের মাধ্যমে দেখালেন বৃহস্পতির উপগ্রহ, শুক্রের কলা ও আরো অনেক কিছু। এককথায় দূরবীনের আবিষ্কার মহাকাশে প্রবেশের দুয়ার উন্মুক্ত করে দিল।

এই আবিষ্কারের সাথে সাথে মানুষ কোটি কোটি কিলোমিটার দূরের বস্তু দেখলো স্পষ্টভাবে। চিন্তার গন্ডীটা অসীমের সীমায় সীমায়িত হল।

এই আধুনিক বিজ্ঞানের জয়যাত্রার ধারায় যখন মহাকাশের গোপন রহস্য অনুসন্ধানে শতশত অনুসন্ধিৎসু মন আরও কাছ থেকে মহাকাশকে দেখতে শুরু করলো, তখন আবিষ্কার করল পরমশূন্য বলে পরিচিত মহাকাশ আসলে শূন্য নয়। সেখানে রয়েছে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ও ধূলিকণার অত্যন্ত লঘু আস্তরণ।

আরো আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে মহাকাশের বিভিন্ন কোনায় চোখ মেলে দেখতে পাওয়া গেল কালো মহাকাশের কিছু কিছু স্থানে সাদা রঙের ঘন মেঘের আস্তরণ। জ্যোতির্বিদরা বললেন ওগুলো আসলে ঘন গ্যাস আর ধূলিকণার মেঘ। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় এ হল নিহারিকা, তারা সৃষ্টির আঁতুড়ঘর।

মহাশূন্যে ছড়িয়ে থাকা লঘু গ্যাস ও ধূলিকণার ঘনত্ব নানা মহাজাগতিক কারণে কোন কোন স্থানে বেশি হয়। আর তার ফলশ্রুতিতে অভিকর্ষের নিয়মে ওই ঘন গ্যাসের মেঘ তার আশেপাশের অপেক্ষাকৃত কম ঘন গ্যাসকে কাছে টেনে আরও ঘন হয়। ক্রমাগত ঘন হওয়ার এই প্রক্রিয়ায় প্রচন্ড চাপ ও তাপে গ্যাসের কেন্দ্রভাগে নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। আর তার থেকে নির্গত হয় প্রচন্ড শক্তি। এই পদ্ধতিতেই তারার জন্ম। আমাদের সৌরজগতের সৃষ্টিও ঐরকম কোন নীহারিকা থেকেই।

এখন, নক্ষত্র থেকে বিকিরিত (আলো, তাপ ইত্যাদি) প্রচন্ড শক্তির তীব্রতা কেমন? একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা খুব সহজেই অনুমেয় হতে পারে। যেমন- হিরোশিমাতে যে পরমাণু বোমা ফেলা হয়েছিল, তার ক্ষমতা ছিল ০.০১৫ মেগাটন। সেখানে, সূর্যের মতো মাঝারি আকারের নক্ষত্র প্রতি সেকেন্ডে ১ লক্ষ কোটি মেগাটন শক্তি নির্গত করে। ফলে, নক্ষত্রের কাছে গিয়ে তার বিকিরণের শক্তি বোঝার মত বোকামির কাজটা নিশ্চিত আর কেউ করতে যাবে না।

এ তো গেল তারা বা নক্ষত্রের জন্মের কথা। তাহলে তারাদেরও কি মৃত্যু হয়? পরে আসবো আমরা সে আলোচনায়।

কিন্তু যে প্রশ্নটা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে তা হল- কোন সে প্রক্রিয়া, যাকে চোখে দেখা যায় না বা কানে শোনা যায় না অথচ অবিরাম ঘটে চলেছে।

আসলে নক্ষত্রের জীবনকাল কোটি কোটি বছর ধরে চলে। তাই, আমাদের এক জীবনকালে কোন নক্ষত্রের বিবর্তন দেখা বৃথা সে চেষ্টা। কিন্তু, তাই বলে অনুসন্ধানী মন কি থেমে থাকবে? না সে কখনো থেমে থাকতে পারে না। অনেক ভাবনা চিন্তা করে জ্যোতির্বিদরা একটা উপায় বের করলেন। তাঁরা, একসাথে অনেক রকমের নক্ষত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন। কোনটার জন্মের প্রক্রিয়া চলছে, কোনটার সদ্য জন্ম হয়েছে, কোনোটা আবার মৃত্যুর প্রহর গুনছে। অনেক পর্যবেক্ষণ এর পর তারা বুঝলেন যে নক্ষত্রের জন্ম হয়, মৃত্যুও হয়।

নক্ষত্রের জীবনের শেষ প্রহরে যখন ভেতরের তাপনিউক্লিয় বিক্রিয়া প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান দিতে পারেনা, তখন ভেতরের ও বাইরের চাপের অসামঞ্জস্যতার কারণে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মাধ্যমে তা ফেটে পড়ে। যেহেতু এই পর্যায়ে তাপনিউক্লিয় বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়, তাই নক্ষত্রের নিজের অভিকর্ষজ বলকে বাধা দেওয়ার জন্য আর কেউই বেঁচে থাকেনা। ফলে নিজের কেন্দ্র অভিমুখে অভিকর্ষের কারণে নিজেই ক্রমশ ঘনীভূত হতে হতে সে হয়ে যায় সাদা বামন(White Dwarf)। অপেক্ষাকৃত ভারী নক্ষত্রের ক্ষেত্রে তা আরো ঘনীভূত হয়ে হয় কৃষ্ণগহ্বর (Black Hole)।

এই কৃষ্ণগহ্বর আজও বিজ্ঞান গবেষণায় এক বড় বিস্ময়। যদিও সময়ের সাথে সাথে এসেছে কৃষ্ণগহ্বরের নিয়ে নানান ধারণা। অসীম ভর একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকার রহস্য, যার প্রবল মহাকর্ষের টান থেকে আলোও বেঁচে ফিরে আসতে পারে না।

এই যে মহাবিশ্বের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এত নক্ষত্র। তারা প্রত্যেকেই কোন না কোন বৃহত্তর পরিবারের অন্তর্গত। যেখানে একসাথে কয়েক লক্ষ কোটি নক্ষত্র অবস্থান করে। এই যে একসাথে অনেক নক্ষত্রদের পরিবার, তাকে বলা হয় ছায়াপথ (Galaxy)।

আমাদের সূর্য বা সৌরমন্ডল যে ছায়াপথের অন্তর্গত, তা হল আকাশগঙ্গা (Milky Way)। এই আকাশগঙ্গার আকারের একটা ধারণা পেলেই আমাদের বিশ্বয়ে অবাক হতে হয়। উদাহণস্বরূপ বলা যায়, যে আলোর সূর্যপৃষ্ঠ থেকে পৃথিবীতে আসতে ৮.৩ মিনিট লাগে (সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার), সেই আলোর গতি আমাদের ছায়াপথ (আকাশগঙ্গা) অতিক্রম করতে লাগবে এক লক্ষ বছরেরও বেশী সময়। আমাদের এই যে এত বৃহৎ সৌরজগত, যার থেকে সবচেয়ে দূরের গ্রহ থেকে সূর্যকে মনে একটা বিন্দুসম। সেখানে সৌরজগতের আকার, আকাশগঙ্গার আকারের ১৬ কোটি ভাগের মাত্র এক ভাগ।

আর আমাদের ছায়াপথের সবচেয়ে কাছের ছায়াপথটি হলো অ্যান্ড্রোমিডা, আমাদের থেকে যার দূরত্ব ২৪ লক্ষ আলোকবর্ষ। তার মানে হল এই যে, এখন যদি আমাদের নিকটতম গ্যালাক্সি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে আমরা তা ২৪ লক্ষ বছর পর বুঝতে পারবো।

এইরকম কোটি কোটি গ্যালাক্সি মিলে এক অদ্ভুত শৃঙ্খলায় শৃঙ্খলিত আমাদের মহাবিশ্ব- এতটাই বড় যে, তাকে তুমি ভাবছো যত বড় তার থেকেও সে ঢের বড়। কি, কেমন লাগছে এখন? বেশ মজার না ব্যাপারটা, মহাবিশ্বয়ে মহাকাশ।

তাহলে এই যে এত কিছু সমগ্র বিশ্বজগতে আবির্ভূত হচ্ছে, বিলীন হয়, সেই মহাবিশ্ব এলই বা কিভাবে? কবেই বা তার জন্ম হল? বলতে হয়- তার হদিসে, তার প্রমাণ দিতে বিজ্ঞান আজও হন্নে হয়ে নিরবচ্ছিন্ন কার্য কারণের চুল-চেরা বিশ্লেষণ চলেছে।

আজ থেকে প্রায় ১৩০০কোটি বছর আগের মহাবিশ্বের সমস্ত শক্তি এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত ছিল। বিজ্ঞানের আবিষ্কার একটু একটু করে আমাদের সামনে তা উন্মোচিত করে চলেছে। এবছর পদার্থবিদ্যায় নোবেল পাওয়া আবিষ্কারও সেই বিষয়ে আশা দেখাচ্ছে। আমরা প্রচণ্ড শক্তিধর যে সূর্যকে দেখি, যার বিকিরিত শক্তির মাত্র ০.০০০,০০০০২ শতাংশ আমরা পৃথিবীতে পাই। এইরকম কোটি কোটি নক্ষত্র নিয়ে আমাদের গ্যালাক্সি। আর এইরকম কোটি কোটি গ্যালাক্সি নিয়ে আমাদের মহাবিশ্ব। হা, ভাবতে অবাক লাগলেও তা একেবারেই সত্যি। এতক্ষনে নিশ্চই বুঝতে পারছো কি প্রবল শক্তি তার! অবশেষে বলতেই হয় সত্যিই মহাবিশ্বের অবস্থান মহাবিশ্বয়ে মহাবিশ্ব!!

কেন সে ঐভাবে অবস্থান করছিল? আর তার আগেই বা তা কেমন ছিল? এই মহাবিশ্বের শুরুর প্রক্রিয়া, তার শেষই বা কোথায়?-- উত্তরের নিশ্চিত পাব, বিজ্ঞান এর ওপর পূর্ন ভরসায় অপেক্ষায় রইলাম।

আগামী নিবন্ধে পরবর্তী বিষয়ে তোমাদের অগ্রিম আমন্ত্রণ জানিয়ে, আজ আমরা আমাদের আলোচনা এখানে শেষ করছি। কি জানলে, কি শিখলে-- মতামত দিতে ভুলো না যেনো।