বিভাগগুলি

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা



পলাশ বরন পাল

আমি যা বলতে চলেছি, তা নিয়ে আমি যে খুব একটা কেতাবি চর্চা করেছি, তা নয়। অর্থাৎ বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার একটা আনুপূর্বিক ইতিহাস এখানে আশা করবেন না, কেননা সে কথা বলার মতো জ্ঞান বা প্রস্তুতি কোনোটাই আমার নেই। আমি যেটা বলবো তা হলো খানিকটা একজন কর্মীর অভিজ্ঞতার কথা। অনেকদিন ধরে বাংলাভাষায় বিজ্ঞান লেখার কাজ করছি—কাজ করতে করতে যেসব কথা মনে হয়েছে নানা সময়ে, সেই নিয়ে চিন্তাভাবনাগুলোই আপনাদের কাছে পৌঁছে দিতে চাই। এর মধ্যে অনেক কথা হয়তো—আপনাদেরও মনে হয়েছে। আমি আমার মতো করে বলবো।

আমার বক্তব্যের কিছু কিছু অংশ বিশেষভাবে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, কিন্তু অনেক কথারই প্রয়োগক্ষেত্র তার চেয়ে বড়ো, প্রায় যেকোনো ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার প্রসঙ্গেই সে সব কথা বলা যেতে পারে। ‘প্রায়’ কথাটা যে ব্যবহার করলাম, তার মানে অধিকাংশ ভাষাই এই উক্তির এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে, অল্প কিছু ভাষা হয়তো পড়ে না। কোন কোন ভাষা এক্তিয়ারের মধ্যে আর কোন কোন ভাষা বাইরে, আমার বক্তব্যটা আর একটু এগোলেই এ প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট হবে আশা করি।

প্রথমে তাহলে বলা যাক, একটা ভাষায় বিজ্ঞানের 'চর্চা' বলতে আমরা কী বুঝবো, অর্থাৎ ঠিক কী অর্থ আমার এই আলোচনার বিষয়বস্তু। আধুনিককালে 'চর্চা' শব্দটার অর্থের বেশ অবনতি হয়েছে দু-একটি সংবাদপত্রের কল্যাণে, যাঁদের সাংবাদিকেরা খুব সম্ভব এই শব্দটার গুরুত্ব অনুধাবন করেন না। তাঁরা লেখেন 'আজকের ক্রিকেট খেলায় কারা জিতবে তাই নিয়ে জোর চর্চা চলছে' বা 'মুখ্যমন্ত্রী দিল্লি যাবেন কিনা তা নিয়ে চায়ের দোকানে চর্চা চলছে' - এইরকমের সব বাক্য। এটাকে আমি 'চর্চা' বলি না। এটা আলোচনা হতে পারে, চর্চা নয়। 'চর্চা' কথাটার সঙ্গে অধ্যবসায়ের একটা অংশ জড়িত থাকে। অর্থাৎ যে আলোচনার পেছনে একটা অধ্যবসায়ের ইতিহাস আছে, সেটাকে আমি 'চর্চা' বলতে চাই।

চর্চা নানাভাবে হতে পারে। বিজ্ঞানের চর্চার কথা বলা যাক। এমন অনেক বিজ্ঞান সংগঠন আছে, যাদের সদস্যরা শহরে-গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে চেষ্টা করেন বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতনতা বা বিজ্ঞানের তথ্য সেখানকার মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে—সেটা এক রকমের বিজ্ঞানচর্চা। সেই ধরনের বিজ্ঞানচর্চার কথা আমি বলবো না, কারণ এ বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার খুব বেশি নেই। আর এক রকমের চর্চা, যেটার কথা আমি বলবো, তা হলো বিজ্ঞান নিয়ে লেখা। এইখানে আমার অভিজ্ঞতা আছে, অতএব আমি কিছু বলবার অধিকারী।

তাহলে প্রথম প্রশ্ন করা যাক—বিজ্ঞান নিয়ে লেখা কীরকমের হয়?

এর উত্তর–নানা রকমের, নানা পর্যায়ের। একটা পর্যায় হচ্ছে একেবারে গবেষণাস্তরের লেখা। অর্থাৎ যাঁরা বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁরা তাঁদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করার জন্য প্রবন্ধ লেখেন। তাঁরা লেখেন অন্য গবেষকদের জন্য, যাতে অন্যরা জানতে পারেন কী কাজ হলো, এবং তার ভিত্তিতে তাঁদের গবেষণার কাজের পরিকল্পনা করতে পারেন। এই লেখাগুলো তাই কোনো অর্থেই জনসাধারণের জন্য লেখা নয়। এই লেখা খুবই একান্ত একটি পাঠকগোষ্ঠীর জন্য।

বিজ্ঞান নিয়ে আর এক রকমের লেখা হলো পাঠ্যপুস্তক। এ জিনিস কার জন্য লেখা তার উত্তর সহজ–যে বিষয়ে লেখা, সেই বিষয়টি যাঁরা শিখতে চাইছেন, তাঁদের জন্য। এখানেও উদ্দিষ্ট পাঠক একেবারে জনসাধারণ নয়। অবশ্য 'জনসাধারণ' বলতে ঠিক কী বুঝাচ্ছি তা হয়তো পরিষ্কার করে বলে নেওয়া ভালো।

আর এক রকমের লেখা হতে পারে, যা হলো এই যে দু-রকমের লেখার কথা বললাম তার বাইরে। মানে, এক অর্থে জনসাধারণের জন্য লেখা, অর্থাৎ যে কেউই সেই সব লেখা পড়তে পারেন। অবশ্যই, এর আগে যে দু-ধরনের লেখার কথা বললাম সেগুলোও যে কেউ পড়তে পারেন, পড়তে চাইলে ঠেকাচ্ছে কে? কিন্তু যে কেউ পড়বেন, সে কথা ভেবে লেখক লেখেন না। কিন্তু তৃতীয় এই যে ধরনের লেখার কথা এখন বলছি, সেগুলো রচনার সময়ে লেখকের আশা বা ইচ্ছে থাকে, যে কোনো লোকেই সেটা পড়বে। যতো বেশি লোকে পড়বে, ততো বেশি আনন্দ হয় লেখকের।

এ রকম লেখারও আবার কিছু স্তরবিভাগ করা যায়। এবং এই স্তরবিভাগের নির্ণায়ক মানদণ্ড হলো "যে কোনো লোক" শব্দগুচ্ছের অর্থ। "যে কোনো লোক" মানে সবাই ঠিক নয়। কী রকম লোক?

বলবার সুবিধের জন্য আমি ধরে নিচ্ছি, যে রচনাটা লেখা হচ্ছে সেটা পদার্থবিদ্যার ওপর। এবারে স্তরবিভাগের ব্যাপারটা দেখা যাক। এমন একটা বইয়ের কথা ভাবা যেতে পারে যেটা লিখছেন পদার্থবিদ্যার কোনো একটা শাখার একজন বিশেষজ্ঞ, এবং এমনভাবে লিখছেন যেন পদার্থবিদ্যার অন্যান্য শাখাতেও যাঁদের যাতায়াত বেশি তারাও বইটি স্বচ্ছন্দে পড়ে ফেলতে পারেন। এরকম বই অনেক লেখা হয়, এবং এর উপযোগিতা অসামান্য। দু-একটা উদাহরণ দেবো, একটু পরে।

দ্বিতীয় যে স্তরের কথা বলা যেতে পারে তাতে লেখক যখন লিখছেন, তখন তাঁর পাঠক যে শুধু পদার্থবিদ হতে হবে, সেরকম ভাবছেন না। মোটামুটিভাবে বিজ্ঞানের কোনো শাখায় যদি পাঠকের দখল থাকে, তাহলেই তিনি পড়তে পারবেন, এরকম একটা কথা লেখক আন্দাজ করছেন। আর তৃতীয় স্তরের লেখায় সেটুকুও দরকার নেই বিজ্ঞানের বাইরের লোকেও পড়ে বুঝতে পারবেন, এই বিশ্বাস নিয়ে লেখক লিখছেন।

তবে 'বিজ্ঞানের বাইরের লোক', বা আগে 'জনসাধারণ' কথাটা ব্যবহার করেছি—এর মানে সত্যি সত্যি একেবারে সবাই নয়। বিজ্ঞান নিয়ে একটা বই লেখা হলে বিশ্বসুদ্ধ সবাই সেটা হুমড়ি খেয়ে পড়বে, এটা কেউ আশা করে না। সেটা হলে যে খারাপ হতো তা আমি বলছি না, বলছি এই লক্ষ্য মনে রেখে কেউ লেখেন বলে আমার মনে হয় না। যেমন ধরুন একটা কথা তো খুব সহজেই বলা যায় যে, যিনি নিরক্ষর তিনি তো পড়বেন না। অথচ তিনি তো জনসাধারণের একটা অংশ। এবং যাঁরা সাক্ষর তারাও সকলেই পড়বেন এ কথাও কেউ আশা করে না। (যাঁরা শিক্ষার এমন একটা স্তরে পৌঁছেছেন যে তাঁরা চিন্তা করতে পারেন, সেইরকম লোকের জন্যই লেখা হয়। সেই ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে আরো একটু প্রয়োজন, চিন্তা করার উৎসাহ। কেউ হয়তো ইচ্ছে করলে চিন্তা করতে পারেন, কিন্তু ফাঁকা সময় পেলেই তখন তিনি ঘুমোন বা টেলিভিশনে কেবল গাঁজাখুরি ধারাবাহিক দেখেন। সে ব্যক্তিও ঠিক অভীষ্ট পাঠক নন।) যিনি বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে চান, এবং একটা বই পড়ে তার বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবার ক্ষমতা ও ইচ্ছে দুটোই যাঁর আছে, এইরকম কোনো পাঠকের কথা ভেবে একজন লেখক বই বা প্রবন্ধ লিখতে পারেন। এই যে তৃতীয় স্তরের বিজ্ঞান রচনার কথা বলছি, এই গোত্রের লেখাকেই ইংরেজিতে বলে 'popular science'। বাংলায় অনেকে তার মাছিমারা অনুবাদ করে বলেন 'জনপ্রিয় বিজ্ঞান'—সেটা একটু অস্বস্তিকর, কেননা এই 'popular'-এর বাংলা 'জনপ্রিয়' নয়। ইংরেজি শব্দটা এসেছে লাতিনের 'populus' থেকে, তার মানে 'জনগণ', যা থেকে 'population' শব্দটাও এসেছে। এর অর্থের মধ্যে প্রিয় কোথাও নেই। তাই 'popular science' মানে জনপ্রিয় বিজ্ঞান নয়, জনগণের জন্য বিজ্ঞান, জনসাধারণের জন্য বিজ্ঞান। আমার মনে হয়, এর বাংলা প্রতিশব্দ করতে হলে, যে অর্থে রবীন্দ্রনাথ 'লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা' চালু করেছিলেন, সেই অর্থটি ব্যবহার করে 'লোকবিজ্ঞান' বলা উচিত। এবং তার মধ্যে স্থান হওয়া উচিত শুধু বিজ্ঞানের নয়, সংশ্লিষ্ট আরো কিছু কিছু ব্যাপারের যেমন প্রযুক্তি, যেমন চিকিৎসা। এই যে দুটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করলাম, অনেকের মতে এগুলোও বিজ্ঞানেরই অংশ, আবার অন্যভাবে দেখলে এগুলো মূল বিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞানের প্রয়োগ। যেভাবেই দেখা হোক, এটুকু অনস্বীকার্য যে প্রযুক্তি এবং চিকিৎসার সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক, তার চরিত্র বিজ্ঞানের অন্যান্য অংশের সঙ্গে যে যোগাযোগ তার চেয়ে অনেকটা অন্যরকম। এমন একজনের কথা ধরা যাক, যিনি স্কুল পাশ করে একটা কারখানায় বা অফিসে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। পদার্থবিদ্যার নতুন নতুন গবেষণার কথা তাঁর না জানলেও চলে, কিন্তু কোন জিনিসটা খেলে তাঁর কী রোগ হতে পারে, বা কোন যন্ত্র ব্যবহার করলে তাঁর কর্মভার লাঘব হওয়া সম্ভব, এ সব বিষয় সম্পর্কে নিত্যনতুন খবর তাঁকে রাখতেই হবে। এই কারণেই বলছিলাম, চিকিৎসা এবং প্রযুক্তির স্থান একটু আলাদা, সেটা মনে রাখতে হবে। তাহলে এবার গুছিয়ে নিয়ে বলা যাক, বিজ্ঞান এবং তার সংশ্লিষ্ট এইসব বিষয় হবে লোকবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। আজকের আলোচনায় আমাদের মূল নজরটা থাকবে এই লোকবিজ্ঞানের দিকে।

এতক্ষণ আমরা যেটা আলোচনা করলাম তা হলো, বিজ্ঞান লেখার পাঠক কে? এর পরে আলোচনা করা যাক, বিজ্ঞানের লেখক কে?

খানিক আগে আমি রচনার যে সব শ্রেণীবিভাগ করলাম, সেগুলোকে অবলম্বন করেই এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করা যেতে পারে। প্রথম ভাগটি ছিলো গবেষণামূলক লেখা, সেগুলো লিখবেন অবশ্যই গবেষকরা—গবেষণা করে তাঁরা তাঁদের গবেষণার ফলাফল লিপিবদ্ধ করবেন। দ্বিতীয় যে ভাগটি আমি করেছিলাম সেটি হলো পাঠ্যপুস্তক। এই ধরনের বই যিনি লিখবেন তাঁর গবেষক না হলেও চলে। যে বিষয়ের ওপর বইটা লেখা হচ্ছে সেই বিষয়ের ওপর তাঁর দখল থাকতে হবে। এর জন্য তাঁকে গবেষণা করতেই হবে তার কোনো মানে নেই, কিন্তু গবেষণায় যে ফলাফলগুলো বেরোচ্ছে—এমনকি সাম্প্রতিক গবেষণাতেও—সেগুলো বোঝবার ক্ষমতা তাঁর থাকা দরকার। হয়তো স্কুল-পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক লেখার জন্য গবেষণার হাল-হকিকত না জানলেও চলে, কিন্তু এখানে আর অতটা সূক্ষ্ম ভাগবিভাগ আমি করছি না, সব পর্যায়ের বইয়ের কথাই একসঙ্গে বলছি। তাছাড়া এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, স্কুলের বই লেখার জন্যও সাম্প্রতিক গবেষণা সম্পর্কে কিছুটা সচেতনতা থাকা ভালো, বিশেষত যে সব বিষয়ের দ্রুত অগ্রগতি হচ্ছে সেগুলোর ক্ষেত্রে।

তৃতীয় যে ভাগটি আমি করেছিলাম, তার মধ্যে কতগুলো উপবিভাগ ছিলো। এর মধ্যে প্রথম যেটির কথা বলেছিলাম, সেটির লেখক কে হতে পারেন তার উত্তর নিয়ে খুব ঝামেলা নেই। মনে করিয়ে দিচ্ছি, এইটা হলো সেইরকম রচনা, যাতে ধরা যাক পদার্থবিদ্যার একটি শাখা সম্পর্কে এমনভাবে আলোচনা করা হচ্ছে যাতে অন্য শাখা-প্রশাখার পদার্থবিদরাও তা বুঝতে পারবেন। বলা বাহুল্য, এই আলোচনা যিনি করতে পারেন তাঁকে হতে হবে তাঁর নিজের শাখার একজন বিশেষজ্ঞ। এরকম কিছু কিছু বই কৈশোরকালে আমাদেরকে বিজ্ঞান সম্পর্কে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে এবং এখনো নতুন কালের ছেলেমেয়েদের জন্য একই কাজ করে। যেমন ধরুন, আমার ছোটোবেলায় পড়া একটি বই, যেটির কথা ভাবলে এখনো বেশ গায়ে কাঁটা দেয়, সেটি হলে জর্জ গ্যামো-র লেখা 'One, two, three, infinity'। এই বইটা আমাদের কিশোরবয়সে প্রায় অবশ্যপাঠ্য ছিলো, 'পথের পাঁচালী' যেমন সকলে পড়তো, তেমনি বিজ্ঞানের প্রতি সামান্যতম আগ্রহও যার থাকতো, সেও পড়তো গ্যামোর লেখা এই বই। এ এক অসাধারণ বই, প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো 1947 সালে। সেই সময়ে পদার্থবিদ্যার পুরোভাগের সমস্যা বলতে গ্যামোর যেগুলোর কথা মনে হয়েছে, সেগুলো নিয়ে তিনি লিখেছিলেন। এ বই থেকে শুধু যে আমার মতো কিশোর ছাত্রছাত্রীরা অনুপ্রেরণা পেয়েছে তা নয়। সেই সময়ে যাঁরা পদার্থবিদ্যা চর্চা করতেনঅর্থাৎ গবেষণা করতেন বা পড়াতেনতাঁরাও পদার্থবিদ্যার ওই সমস্ত বিষয় সম্পর্কে খানিকটা জ্ঞানলাভের জন্য ওই বইটা পড়তেন। শুধু বিষয়গুলো শেখার জন্য নয়। জর্জ গ্যামো ছিলেন অতি বিখ্যাত একজন বিজ্ঞানীতেজস্ক্রিয়তার তত্ত্বে তাঁর অবদান ছিলো যুগান্তকারী, আজকে যেটাকে মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব বলা হয় মহাবিশ্বের বিবর্তন সংক্রান্ত সেই তত্ত্বের তিনি ছিলেন প্রথম প্রবক্তা। এইরকম একজন বিজ্ঞানী কোন সমস্যাগুলো গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন, সেটা জানার জন্যও এই বইয়ের দ্বারস্থ হতেন বিজ্ঞানীরা। আরো সাম্প্রতিক সময়ের একটা উদাহরণ দেওয়া যায়  স্টিভেন ওয়াইনবার্গের লেখা একটি বই। তাঁর নামের সঙ্গে যে সব পাঠকের পরিচয় নেই, তাঁদের জন্য বলে রাখি, মৌল কণা সম্পর্কে গবেষণা করেন এই বিজ্ঞানী, এ ব্যাপারে তিনি সর্বোচ্চ সারির লোক, নোবেল পুরস্কার তো পেয়েছেনই, কিন্তু সে কথা বললেও তাঁর সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না, তাঁর অবদান এতই বেশি। এই ওয়াইনবার্গ 1970-এর দশকে একটা বই লিখেছিলেন, 'The first three minutes'। সেটা বিশ্বতত্ত্ব সম্পর্কিত একটি বই, অর্থাৎ গোটা মহাবিশ্ব কীভাবে বিবর্তিত হয় তা নিয়ে লেখা, গ্যামোর প্রস্তাবিত যে মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের কথা একটু আগে বললাম তা নিয়ে অনেক আলোচনা আছে সেই বইয়ে। সে বইটির এতো অসাধারণ প্রভাব হয়েছিলো পদার্থবিদদের মধ্যে, যে তারপর থেকে বিশ্বতত্ত্বের গবেষণা একটা নতুন গতিবেগ লাভ করে, এবং গত কয়েক দশকে যে বিশ্বতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার এত বিপুল অগ্রগতি হয়েছে তার একটা কারণ হলো ওয়াইনবার্গের এই বইটি। বইটি কিন্তু মোটেই পাঠ্যবই হিসেবে লেখা নয়, গবেষণাপুস্তক হিসেবেও লেখা নয়। সরল সাদা ইংরিজিতে, অঙ্কটঙ্কের জটিলতা বাদ দিয়ে লেখা। শেষকালে পরিশিষ্ট অংশে কিছু কিছু অঙ্ক কষে দেওয়া আছে বিশেষজ্ঞদের জন্য, সে অন্য অংশটা পাঠক না পড়লেও পারেন, তাতেও বইয়ের মূল রস থেকে বঞ্চিত হবেন না। এইরকম দিকদর্শী বই আরো লেখা হয়েছে, আমি আর উদাহরণের মধ্যে যাচ্ছি না।

তারপরে আমি যে উপবিভাগটির কথা বলছিলাম সেটা এইরকম  ধরুন একজন পদার্থবিদ লিখছেন, কিন্তু তিনি যে শুধু অন্য পদার্থবিদদের কথা ভেবেই লিখছেন তা নয়, সামগ্রিকভাবে বিজ্ঞানের অন্য শাখার কেউও পড়তে পারেন এইরকম ভেবে লিখছেন। এর মধ্যে একটা বিশেষ ধরনের যই থাকবে যেগুলোকে হয়তো ঠিক বিজ্ঞানের বই বলা যায় না, বরং বিজ্ঞানের সঙ্গে অন্য সব সারস্বত বিষয়ের কীরকম যোগাযোগ আছে, বা সমাজের বা ইতিহাসের সম্পর্ক কীরকম আছে, তা নিয়ে আলোচনা করার জন্য রচনা। এইখানে কিন্তু লেখক যে বিজ্ঞানীই হবেন তার কোনো মানে নেই। এমন হতেই পারে যে লেখক অন্য কোনো একটা বিষয়ের বিশেষজ্ঞ, তিনি তাঁর বিষয়ের সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্ক খুঁজছেন। বিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজ ও সংস্কৃতির সম্পর্ক নিয়ে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বইয়ের কথা আমরা জানি, যেমন জন ডেসমন্ড বার্নালের 'ইতিহাসে বিজ্ঞান', বাংলায় সমরেন্দ্রনাথ সেনের 'বিজ্ঞানের ইতিহাস'। এরকম আরো অনেক নাম করা যায়।

তৃতীয় যে উপবিভাগটির কথা আমি বলেছিলাম, যেখানে উদ্দিষ্ট পাঠকের গণ্ডি আরো অনেক ব্যাপক, সেরকম ক্ষেত্রে লেখক হওয়ার যোগ্যতা কার আছে সে প্রশ্নের উত্তর আরো অনেক গোলমেলে। প্রথমত, এই গোত্রের রচনা যিনি লিখছেন তাঁরা যে সবাই বিজ্ঞানী তা তো একেবারেই নয়, তাঁরা যে মূলত বিজ্ঞান নিয়ে লেখেন সেরকমও কোনো বাধকতা নেই। বিজ্ঞান ছাড়া আরো অনেক কিছু লেখার জন্য এই রকমের লেখক প্রয়োজন হয়। একটা খুব সহজ উদাহরণ হলো খবরের কাগজ। খবরের কাগজে বিজ্ঞানের সংবাদ পরিবেশনের জন্য কিছু লেখালেখির প্রয়োজন হয়। সেগুলো যাঁরা করেন তাঁরা অনেকেই হয়তো এক সময়ে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেনবিজ্ঞানের খানিকটা জ্ঞান না থাকলে তাঁরা ওই কাজটা করতে পারতেন নাকিন্তু তারপরে তাঁরা যে লেখাপড়ার জগতের সঙ্গে জড়িত আছেন তা নয়, অন্তত হওয়ার কোনো প্রয়োজন থাকে না। এবং তাঁরা যেখান থেকে তাঁদের রচনার রসদ সংগ্রহ করেন, সেও ঠিক বিজ্ঞানের গবেষণাপত্র বা বিজ্ঞানের বই নয়, সাধারণত সংবাদ সংস্থার রিপোর্ট থেকে তাঁরা খবর সংগ্রহ করেন, এবং তা পরিবেশন করেন। অর্থাৎ এইভাবে যা পরিবেশিত হয় তার মধ্যে কোনো বিজ্ঞানীর সরাসরি কোনো হাত থাকে না।

বিজ্ঞানীরাও অবশ্য নিজেদের বিষয়টি জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করার জন্য বই লেখেন। এইখানে আমরা একটু বাংলার কথাতেই চলে আসবো  এতক্ষণ যে উদাহরণগুলো দিচ্ছিলাম তার মধ্যে সমরেন্দ্রনাথ সেনের বইটি ছাড়া কোনোটাই বাংলায় লেখা নয়। আমি নিজে 1988 সালে একটা বই লিখেছিলাম, যার নাম 'কী দিয়ে সমস্ত কিছু গড়া।' তার মোটামুটি এক দশক আগে থেকে যে বিষয়ে আমি গবেষণা করতে শুরু করেছিলাম, সেই বিষয়টার একটা পরিচিতি দেওয়ার জন্য লেখা। আমার ইচ্ছে হয়েছিলো যে সেই বিষয়টি নিয়ে জনসাধারণ পড়ুক। আপামর সকলে বইটি পড়বে তা আমি ভাবিনি, কোনো লেখকই ভাবেন না, তবে আমার এই বইটি অনেকে পড়েছিলেন। অনুরূপ কারণে অন্য অনেক বিজ্ঞানীও অনেক বই লেখেন, এবং সেগুলোও লোকে পড়ে। এই যে 'লোকে' কথাটা বললাম, এর মধ্যে একটা বড়ো অংশ হলো ছাত্র, তাদের কেউ কেউ এই ধরনের লেখা পড়ে আরো জানবার অনুপ্রেরণা পায়। এই ধরনের পাঠক জোটা খুব ভাগ্যের কথা। কিন্তু শুধু যে কেউ উচ্চশিক্ষার অনুপ্রেরণা পাওয়ার জন্যই পড়বে, বা কোনো বই পড়ে সেই বিষয়ে উচ্চশিক্ষার পথে যাবে, এ কথা মনে করে বই লেখা হয় না। বিষয়টা সম্পর্কে পাঠকের খানিকটা কৌতূহল থাকবে এবং বইটা পড়ে সে বিষয়ে তার কিছু ধারণা জন্মাবে, সেটা সংস্কৃতিবোধের একটা অঙ্গএইটা ভেবে বইগুলো লেখা হয়।

পাঠক হলো, লেখক হলো। এর পরে আমি যে কথা আলোচনা করতে চাই তা হলো, লেখার বিষয়বস্তু কী হবে। এইখানে আমি যা বলবো তার অনেকটাই বলবো বিশেষভাবে বাংলা ভাষার দিকে চোখ রেখে।

বাংলায় বিজ্ঞান লেখা শুরু হয়েছিলো ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকে। তার পরে, ওই শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, যখন স্বদেশপ্রেম বা স্বাদেশিকতার একটা জোয়ার এলো, সেই সময়ে অনেক কিছু কল্পনা করা হয়েছিলো। এবং তার রেশ বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্তও ছিলো। সেই কল্পনার মধ্যে এ কথাও ছিলো যে সবাই সমস্ত কাজ নিজের মাতৃভাষায় করবে, বা অন্তত যে যেখানে থাকে সেখানকার আঞ্চলিক ভাষায় করবে। এই যে 'সমস্ত কাজ', এর মধ্যে লেখাপড়া তো আছেই, কিন্তু উচ্চাশা সেখানেই থেমে থাকেনি, এ কথাও ভাবা হয়েছে যে যাঁরা গবেষণা করবেন তাঁরাও তাঁদের গবেষণার ফলাফল মাতৃভাষায় লিখে প্রকাশ করবেন।

সে কালে এই মানসিকতার কোনো যৌক্তিকতা ছিলো কিনা সে কথায় আমাদের দরকার নেই। এখনকার কথা যদি ধরা যায়, তাহলে আমার মনে হয়, এই লক্ষ্য থাকাটা উচিত নয়। গবেষণার ফল কেউ যখন লিখতে চান, তখন তার উদ্দিষ্ট পাঠক তো শুধু বাঙালি পাঠক হতে পারে না। তার পাঠক হবে আন্তর্জাতিক, তাই সেটা প্রকাশের মাধ্যমও হওয়া উচিত এমন কোনো ভাষা যেটা আন্তর্জাতিক। সে জিনিস বাংলায় লেখা মানে হলো, লেখক তাঁর পাঠকের সংখ্যা ও পরিধি কমিয়ে ফেললেন, তিনি তাঁর গবেষণার ফল যে দরবারে পেশ করার কথা সে দরবারে গেলেন না, ফলত তিনি তাঁর গবেষণাটিকে প্রচারিত হতে দিলেন না। কাজেই, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের গবেষণার ফলাফলও লেখা হবে, এ কথা ভাববার কোনো অর্থ হয় না।

তাহলে অনিবার্য প্রশ্ন উঠবে, কোন ভাষাকে আন্তর্জাতিক ভাষা বলে গণ্য করা হবে? এই প্রশ্নের উত্তর উনবিংশ শতাব্দীতে বা বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেও খুব স্পষ্ট ছিলো না, কিন্তু এখন এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে কোনো মতপার্থক্য হবে বলে মনে হয় না। ইংরিজি ভাষার যে প্রভাব এবং প্রচার এখন সারা বিশ্বে হয়েছে, তাতে এখন আর এ নিয়ে কোনো চিন্তাই করতে হয় না। এই পরিস্থিতি যে তৈরি হয়েছে, তার জন্য একটি লোকের কাছে সমস্ত ইংরিজিভাষীর নতমস্তকে ঋণ স্বীকার করা উচিত, তিনি হলেন অ্যাডল্ফ হিটলার। তিনি এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি করলেন যে ইউরোপ থেকে বহু লোক পালিয়ে চলে গেলো আমেরিকায়। তাঁদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী অনেকে ছিলেন, যাঁরা গিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন আমেরিকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ইউরোপে থাকাকালীন তাঁরা অনেকেই নিজের গবেষণার ফলাফল নিজের ভাষায় লিখতেন, কিন্তু আমেরিকায় আসার পরে তাঁদের সবকিছু ইংরিজিতে লিখতে শুরু করতে হলো। ফলে ইংরিজি ভাষার যে দাপট শুরু হলো শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে, সে দাপট আজও চলেছে।

গবেষণার দিক থেকে দেখতে গেলে, এতে ভালোই হয়েছে। ইংরিজির দাপট হয়েছে বলেই ভালো হয়েছে সে কথা বলছি না। যে কোনো একটা ভাষা যদি সারা পৃথিবীর গবেষণার ভাষা হয়, তাহলে তার কিছু সুবিধে আছে। কেউ বলতে পারবেন না যে অমুক ভাষায় লেখার ফলে তাঁর কাজ প্রচার পায়নি, পরে অন্য কেউ একই কথা ইংরিজিতে লিখে সবার হাততালি কুড়িয়ে নিয়েছে। সবাই যদি গবেষণার কথা একই ভাষায় লেখেন, তাহলে এ জাতীয় অবিচারের সম্ভাবনা থাকে না। এখন এমন হয়ে গেছে যে ফরাসি এবং জার্মানীয়রাও যখন গবেষণাপত্র লেখেন, ইংরিজিতেই লেখেন। এমনকি ফরাসি দেশ থেকে বা জার্মানি থেকে যে সব অগ্রণী পত্রপত্রিকা বেরোতো গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করার জন্য, সেই সব পত্রিকাতেও এখন পরিষ্কার বলে দেওয়া থাকে, যে সেখানে লেখা পাঠাতে হলে ইংরিজিতে পাঠাতে হবে, অন্য কোনো ভাষায় লেখা পাঠালে তা গ্রাহ্য হবে না। এই হচ্ছে অবস্থা। কাজেই এই পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের ফলাফল লেখা হবে কিনা, এটা চিন্তা করার দরকার নেই। (বিজ্ঞানের বাইরের অন্যান্য চিন্তাক্ষেত্রে এ কথা একইরকম প্রযোজ্য না হতে পারে, সে কথায় পরে আসবো। আপাতত শুধু এটুকুই বলা যাক যে সে সব বিষয়ের কথা এখানে আমার আলোচ্য নয়, আমি বলছি বিজ্ঞানের কথা।)

গবেষণার পরে আসবে শিক্ষাদানের প্রসঙ্গ। আমার মনে হয়, উচ্চতম স্তরের যে শিক্ষা – তার সম্বন্ধেও এই একই কথা প্রযোজ্য। উচ্চতম স্তর বলতে আমি বলছি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরের কথা, অর্থাৎ যখন লোকে এম-এস-সি পড়ছে তার কথা। সেই স্তরেও ব্যাপারটা একই রকম এই কারণে যে, ইংরিজিতে যত বই আছে, এমনকি শুধু যত পাঠ্যপুস্তক আছে, সেই পরিমাণ বই তো বাংলা বা ফরাসি বা ইতালীয় কোনো ভাষায় হবে না, হওয়া সম্ভব না। গবেষণাক্ষেত্রে যাঁরা লব্ধপ্রতিষ্ঠ, তাঁরা উচ্চতম স্তরের পাঠ্যবই লিখতে গেলে নিজের গবেষণার ভাষা ব্যবহার করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কাজেই অত পাঠ্যবই, তাতে বিবিধ চিন্তার প্রকাশ – তা যদি কোনো শিক্ষার্থী পড়তে না পারে, তবে সেটা তার ক্ষতি। সবাই সবকিছু পড়বে—তা নয়। কথাটা হচ্ছে, অনেক কিছু পড়ার সুবিধা যাতে সবাই পায়, তার তো চেষ্টা করতে হবে। সেই সুবিধাটা থেকে শিক্ষার্থীকে বঞ্চিত করলে তার ক্ষতি করা হয়।

এ সম্পর্কে আমি একটা বেশ মনে রাখার মতো কথা শুনেছিলাম আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে। সেও পদার্থবিদ্যার গবেষক, তার দেশ হলো স্পেন। তাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, "আচ্ছা, ধরো স্পেনে যখন ছাত্রছাত্রীরা কলেজে বি-এস-সি পড়ে, তখন তাদের মধ্যে কত ভাগ ইংরিজিতে মোটামুটি স্বচ্ছন্দ?" পড়াশোনা তারা করে তাদের দেশের ভাষাতেই, অর্থাৎ স্পেনীয় ভাষাতেই, তা আমি জানি। কিন্তু ইংরিজি শিখতে তো বাধা নেই, কত শতাংশ ছেলেমেয়ে ইংরিজিতে অনায়াসে কথাবার্তা বলতে বা বই পড়তে পারে—সেটাই ছিলো আমার জিজ্ঞাস্য। প্রশ্ন। শুনে আমার বন্ধু একটু ভেবে বললো, "আমি কোনো পরিসংখ্যান জানি না। তবে আমার আন্দাজ, মোটামুটি শতকরা কুড়ি ভাগ।" এর পর আমি জানতে চাইলাম, "আর এম-এস-সি যারা পড়ছে, তাদের মধ্যে?" সে বললো, "একশো।" আমি অবাক হয়ে বললাম, "সে কী! তিন না চার বছর বি-এস-সি পড়তে পড়তে বাকি আশি ভাগ পড়ুয়া ইংরিজি শিখে ফেলছে?" সে বললো, "না, তা নয়। ওই যে কুড়িভাগ ইংরিজি জানে, শুধু তারাই এম-এস-সি পড়তে যাচ্ছে।"

আমার তাই মনে হয়, পদার্থবিদ্যার মত বিষয়ে যে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে চাইবে, তাকে ওইটুকু কাজ করতে হবে। যেহেতু এই বিষয়ের আকরগ্রন্থগুলো ইংরিজিতে পাওয়া যাচ্ছে, অতএব তাকে ইংরিজিটা শিখতে হবে। এটা এমন কিছু শক্ত ব্যাপার নয়। এখানে বাংলা-বাংলা করে ঝান্ডা উঁচিয়ে স্বদেশপ্রীতি দেখাতে গেলে তাতে কিচ্ছু লাভ নেই।

তাহলে বাকি রইলো কোথায়? বাকি রইলো এর থেকে নিচের সমস্ত ধাপে, সেখানে মাতৃভাষা বা নিজের চেনাজানা কোনো ভাষা হলেই সুবিধে হয়। আরো একটা কথা বলে রাখি, আমি এতক্ষণ ধরে অনেক কথা বলতে গিয়েই পদার্থবিদ্যা-পদার্থবিদ্যা করছি, সেটা কিন্তু এই বিষয়টির ওপর কোনোরকম বাড়তি গুরুত্ব আরোপ করার জন্য নয়। পদার্থবিদ্যা ছাড়া অন্যান্য বিষয় আলোচনার পদবাচ্য নয়—এরকম কোনো বক্তব্য আমার নেই, একেবারেই নেই। আমি নিজে পদার্থবিদ বলে এই বিষয়টির সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা, এই বিষয়টি আমি জানি, তাই এর কথা একটু বেশি করে আসছে। কথাগুলো এই একইভাবে অন্য একটা বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। সে ব্যাপারে আমার জ্ঞান বিশেষ নেই বলেই সে নিয়ে আমি কিছু বলছি না। এটুকু নিশ্চয়ই বলা যেতে পারে যে, এই কথাগুলো ইতিহাস সম্পর্কে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। কেননা, আমি যদি বাংলা ইতিহাস চর্চা করতে চাই, তাহলে হয়তো সেটা বাংলা ভাষাতেই করতে হবে। আমি যদি ভাষাতত্ত্ব চর্চা করতে চাই, বিশেষত বাংলা ভাষার প্রকৃতি বিষয়ে আলোচনা করতে চাই, তার একটা বড়ো অংশ। বাংলা ভাষাতেই হতে হবে। সেখানে অনুবাদ করতে গেলে হয়তো আলোচনা বিষয়টিই লঘু হয়ে যাবে, তাতে কোনো লাভ নেই। কিন্তু বিজ্ঞানের সে সমস্ত বিষয় খানিকটা বিশ্বজনীন, মানে তার অধিতব্য বিষয়ে কোনো দেশবিভাগ নেই, সেই রকম বিষয়ের কথা আমি বিশেষভাবে বলছি, কেননা যে কথা বললাম, আমার যেটুকু যা বিশেষজ্ঞের দক্ষতা আছে তা সেই রকম একটা বিষয়েই।

যে কথা বলছিলাম, বিশেষজ্ঞের স্তরটা ছেড়ে দিলে তার তলায় যতগুলো স্তর থাকে, সেখানে বাংলায়মানে যেখানকার যা ভাষা তাতেচর্চা হওয়া ভালো। এবং 'বিশেষজ্ঞের স্তর' বলতে আমি একেবারে এম-এস-সি পর্যায় থেকেই ধরছি। এর আগে যে আশিভাগ-কুড়িভাগের গল্পটা বলেছিলাম, সেটার আশিভাগ যাঁরা—যাঁরা ইংরিজিতে স্বচ্ছন্দ নন—তাঁদের জন্য এ ব্যবস্থা ভালো। যাঁরা বাকি কুড়িভাগ, তাঁদের জন্যও ভালো, যাতে পরে যখন তাঁরা বিশেষজ্ঞ হবেন তখন জনসাধারণের কাছে তাঁরা তাঁদের বিষয়ের কথা বলতে পারেন।

শুধু পাঠ্যপুস্তক নয়, সেই সংক্রান্ত আলোচনা, সারস্বত কিছু আলোচনা, সংস্কৃতি নিয়ে কিছু আলোচনা, তার ইতিহাস সম্বন্ধে আলোচনা  এগুলোও সেই ভাষাতে থাকা উচিত। এ প্রসঙ্গে আপনাদের মনে পড়তে পারে, ব্রেশটের 'গালিলেয়ো' নাটকে একটা জায়গায় ছিলো, গালিলেয়োর সঙ্গে পোপের দপ্তর থেকে দেখা করতে এসেছেন একজন দূত—কিছু একটা বার্তা নিয়ে। গালিলেয়ো তাঁর বৈঠকখানা ঘরে তাঁকে বসিয়েছেন। সেই দূত তারপর লাতিনে তাঁর বক্তব্য পেশ করছেন, গালিলেয়ো নিজের ভাষায়—অর্থাৎ ইতালীয় ভাষায়—তার উত্তর দিচ্ছেন। তখন সেই পোপের দূত বলছেন, "আমরা তো এখানে একটা গুরুতর বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি, কাজেই এই আলোচনাটা একটা সমৃদ্ধ ভাষাতেই হওয়া উচিত। আপনি কেন ইতালীয় ভাষায় উত্তর দিচ্ছেন? আমি লাতিনে বলছি, আপনি লাতিনে উত্তর দিন।" বাড়ির পরিচারিকার বাচ্চা ছেলে আন্দ্রেয়া ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলো, তার দিকে আঙুল দেখিয়ে গালিলেয়ো তখন বলছেন, "আপনি ওই ছেলেটাকে দেখছেন? আমি এমনভাবে কথা বলতে চাই যাতে ওই ছেলেটাও বুঝতে পারে।"

শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যটা এই হওয়া উচিত। ওই আন্দ্রেয়াও যাতে বুঝতে পারে, তার চেষ্টা করা উচিত। বিজ্ঞানকে সেই পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে আমাদের। কেউ বলতে পারেন, তার জন্য তো বি-এস-সি পর্যন্ত বাংলায় পড়ার দরকার নেই। অতদূর পর্যন্ত যাওয়ার দরকার কী? দরকার আছে, যাতে ওই আন্দ্রেয়াদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য উপযুক্ত লোক আমরা তৈরি করতে পারি। এমন শিক্ষক তৈরি করতে হবে, যাঁরা বাংলায় বলতে বা লিখতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।

এই স্বচ্ছন্দ বোধের কথা থেকে একটা প্রসঙ্গে আমি আসতে চাই, যেটা আমি খানিকটা দ্বিধা এবং সঙ্কোচের সঙ্গে উত্থাপন করছি, কেননা এতে বেশ কিছু অপ্রিয় কথা বলতে হবে। যাঁরা আমাকে চেনেন, আমার দুর্মুখতায় তাঁরা মোটেই আশ্চর্য হবেন না, তা জানি। তবে এই সভায় তো অনেকে আছেন যাঁরা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না, তাঁদের কাছে তাই এই দুর্মুখতার জন্য আগাম একটু মার্জনা চেয়ে রাখছি।

ব্যাপারটা হচ্ছে, বাংলায় বিজ্ঞান যাঁরা লেখেন, তাঁদের মধ্যে একটা বড়ো অংশ, বা অন্তত একটা বেশ ভালো রকমের অংশ, তাঁরা বাংলায় কখনো বিজ্ঞান পড়েন না। তাঁরা ইংরিজিতে বিজ্ঞান পড়েন, তার থেকে টুকে হোক বা নিজে চিন্তা করে নিজের মতো করে হোক, সেটাকে তাঁরা বাংলায় পরিবেশন করেন। তাঁরা যখন বিজ্ঞানের কোনো একটা বিষয় জানতে চান, তখন তাঁরা পলাশ বরন পালের লেখা পড়েন না, কেননা সে তো আন্দ্রেয়ার ভাষায় কথা বলে। তাঁরা পড়েন পোপের ভাষায়। মানে, উপমাটা ছাড়িয়ে বলতে গেলে, ইংরিজিতে পড়েন, তারপরে বাংলায় লেখেন। ইংরিজিতে পড়ার মধ্যে কোনো ক্ষতি নেই, কোনো দ্বিধা বা গ্লানি থাকার কথা নয়, কোনো আপত্তির প্রশ্ন ওঠে না। ইংরিজিতে তাঁরা পড়তেই পারেন। আমিও পড়ি। সকলেরই পড়া উচিত। ইংরিজি যিনি জানেন, তিনি এতো ঐশ্বর্যশালী একটা ভাষায় পড়বেন না কেন? সেটা কথা নয়। কথা হচ্ছে এই যে, বাংলায় কোনোদিন যে বিজ্ঞান নিয়ে লেখা হয়েছে এই ব্যাপারটা সম্পর্কেই তাঁরা খুব একটা অবহিত বলে মনে হয় না। আমি এমন বই দেখেছি, এবং এক-আধটা নয়, তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি, যার ভূমিকায় লেখা থাকে যে বাংলায় তো এই সব ব্যাপার নিয়ে বই লেখা হয়নি, অতএব... বাকিটা আমি সেই সব লেখকের ভাষায় বলছি না, আমার নিজের ভাষায় বলছি অতএবআমি লিখে ফাটিয়ে দিলাম।

এই মনোভাবটা অত্যন্ত নিন্দনীয়। সত্যি কথা যদি ভেবে দেখেন, বাংলায় কিন্তু নয়-নয় করে বিজ্ঞানের কথা কম লেখা হয়নি। বাংলায় বিজ্ঞান লেখার ঐতিহ্যটা বেশ পুরোনো। ভারতীয় ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা এ ব্যাপারে অগ্রণী ছিলো যে শুধু তাই নয়, এখনো আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে বাংলায় বিজ্ঞান নিয়ে লেখা হয়েছে। একেবারে শুরুতে যা লেখা হয়েছে সেগুলো পাঠ্যপুস্তক জাতীয় লেখা। সেগুলোর মূল্য কম তো নয়ই, বরং অত্যন্ত বেশি, কিন্তু আমি সেগুলোর আলোচনায় যাচ্ছি না। তারপরে, অক্ষয়কুমার দত্তর সময় থেকে শুরু করে অন্য রকমের লেখার ধারাও চালু হলো। অক্ষয়কুমার যা লিখেছিলেন সেগুলো তো পাঠ্য বই নয়সেই কারণে সেগুলোকে অপাঠ্য বই বলা যায় কিনা জানি নাসেগুলো হলো সাধারণ বিজ্ঞানমনস্ক পাঠকের কাছে বিজ্ঞান উপস্থাপনা করার প্রচেষ্টা। তিনি একা ছিলেন না। এইখানে বাংলা ভাষার একটা বৈশিষ্ট্যের কথা আমরা বলতে পারি, যেটার জন্য বাঙালি হিসেবে আমাদের সকলের গর্বিত হওয়া উচিত। বাংলা ভাষায় একটা অসাধারণ ঐতিহ্য আছেযাঁরা সাহিত্য করে বিখ্যাত হচ্ছেন, তাঁদেরও মনের মধ্যে একটা চাড় থাকে বিজ্ঞান নিয়ে কিছু লেখার জন্য, এবং শিশুসাহিত্য কিছু লেখার জন্য। শিশুদের জন্য লেখার কথাটা কেন এখানে উত্থাপন করলাম, সে প্রসঙ্গে আমি এক্ষুনি আসছি। তার আগে অন্য কয়েকজনের কথা বলে নিই। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা ধরুন। বিজ্ঞান লেখার কোনো প্রয়োজন ছিলো না তাঁর। তাঁর উপন্যাস হাজারে হাজারে বিক্রি হচ্ছিলো, কাজেই লেখকখ্যাতি পাওয়ার জন্য অন্য বিষয়ে তাঁর লেখার দরকার ছিলো না। তিনি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, টাকার দরকারেও তিনি লেখেননি। তাঁর একটা আন্তরিক চাড় ছিলো, বিজ্ঞান ব্যাপারটাকে জনসমক্ষে আনতে হবে। বিজ্ঞান নিয়ে তিনি যা লিখেছিলেন, আজকের যুগে দেখলে তা খানিকটা কালক্লিষ্ট মনে হতে পারে। তাঁর ভাষা পুরোনো মনে হতে পারে। আর বিষয়বস্তুও খানিকটা পুরোনো তো মনে হবেই – সেটা তো বঙ্কিমের দোষ নয়, সেটা বিজ্ঞানের অগ্রগতির পরিচায়ক। কিন্তু যে মনোভাব থেকে তিনি লিখেছিলেন, সেটাকে কুর্নিশ না জানিয়ে কোনো উপায় নেই। শুধু বন্ধিমচন্দ্র নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিজ্ঞান নিয়ে বই লিখলেন। সেই বই, 'বিশ্বপরিচয়', বেরোলো 1930 সাল নাগাদ, এবং এখনো পড়ার পক্ষে সেইটা অসাধারণ ভালো একটি বই। এ তো তাঁর সত্তর বছর বয়েসের কাজ, তার আগে তিনি কী করেছেন? তিনি শাস্তিনিকেতনে বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন তার বহু আগে। সেই বিদ্যালয়ের ইতিহাস পড়ে দেখবেন- সেখানে রবীন্দ্রনাথ বাচ্চাদেরকে কী পড়াতেন। ইংরিজি এবং বিজ্ঞান। অর্থাৎ অনেক আগে থেকেই তাঁরও মনের মধ্যে এ কথাটা ছিলো যে বিজ্ঞানের প্রচার করতে হবে।

শিশুসাহিত্যের কথা উল্লেখ করেছিলাম একটু আগে। বাংলায় যখন শিশু ও কিশোরদের জন্য পত্রিকা চালু হলো, তার উষালগ্নে 'সন্দেশ' পত্রিকা বেরোলো। পত্রিকার সম্পাদক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বিজ্ঞান নিয়ে লিখতে শুরু করলেন। সেগুলো বেশ ভালো লেখা। 'সেকালের কথা' বলে যে বইটি তাঁর আছে সেটা এখনকার ছেলেমেয়েদেরও সকলের পড়া উচিত। সুকুমার রায়ের রচনাবলীতে আমরা সব সময়েই 'আবোল তাবোল', 'ঝালাপালা', 'পাগলা দাশু', 'খাই খাই' পড়ি। কারুর সমালোচনা করে বলছি না, আমি নিজেও তাই পড়ি। কিন্তু তাঁর রচনাবলীর অর্ধেক অংশ জুড়ে রয়েছে বিজ্ঞান ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বাচ্চাদের জন্য লেখা। এইটাই, যে কথা বলছিলাম, বাংলা ভাষার একটা অসাধারণ ঐতিহ্য, যেটার জন্য আমরা গর্বিত হতে পারি, সেটা হলো  যাঁরা বিজ্ঞানী নন, যাঁরা মূলত সাহিত্যিক, তাঁদের মনের মধ্যেও এই প্রেরণা বা আকাঙ্খা ছিলো যে, বিজ্ঞান নিয়ে লিখতে হবে।

সাহিত্যিকরা ছাড়াও অনেকে লিখেছেন। এমন অনেকে লিখেছেন যাঁরা শুধু বিজ্ঞান নিয়েই লিখেছেন, বা অন্তত বিজ্ঞান নিয়ে লেখাই ছিলো তাঁদের প্রধান কাজ। তাঁরাও ভুলে যাওয়ার মতো লেখক নন। যেমন একজনের কথা ধরা যাক, যাঁর নাম আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি, তিনি হলেন অমল দাশগুপ্ত। তিনি নিজে বিজ্ঞানী ছিলেন না, ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু বিজ্ঞান নিয়ে তিনি কয়েকটি বই লিখেছিলেন, সেগুলোকে অসাধারণ বললেও হয়তো কম বলা হয়। 'মহাকাশের ঠিকানা', 'মানুষের ঠিকানা', 'পৃথিবীর ঠিকানা', 'প্রাণের ইতিবৃত্ত'  এই কটির কথা মনে পড়ছে। সবগুলো হয়তো এখন আর পাওয়া যায়। না। এই বইগুলো সম্পর্কে আমার নিজের একটা বিশেষ রকমের দুর্বলতা আছে। তার কারণ, আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, তখন এর প্রথম বইটি ইস্কুল থেকে পুরস্কার হিসেবে পাই, পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য। সেই বইটা পড়ে প্রথম বিজ্ঞান সম্পর্কে আমার একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়েছিলো, মনে হয়েছিলো, বিজ্ঞানের মধ্যে দারুণ আনন্দের একটা সন্ধান পাওয়া যায়। ইস্কুলের পাঠ্য বই তো খানিকটা নীরস হয়, তার মধ্যে তো আনন্দের ব্যাপারটা বা রসের ব্যাপারটা ঠিক বোঝা যায় না। বোঝা গেলে ভালোই হতো, কিন্তু হয় না সেরকম। আমার ক্ষেত্রেও হয়নি। ওই বইটা পড়ে আমি প্রথম বুঝেছিলাম যে বিজ্ঞান ব্যাপারটার মধ্যে একটা আনন্দ আছে, একটা উত্তেজনা আছে। তখনই আমার প্রথম মনে হয়েছিলো যে বড়ো হয়ে আমি বিজ্ঞানী হতে চাই। অন্য যাঁরা বিজ্ঞানের পথে চলেন, তাঁদেরও এরকম একটা অনুভূতি হয়েছে নিশ্চয়ই। কিছুদিন আগেকার একটা ঘটনা মনে আছে, বলছি। আমি যেখানে কাজ করি সেখানে একদল নতুন ছাত্র এলো, যেমন প্রতি বছরেই আসে। তাদের মধ্যে একজন আমার কাছে এসে বললো, "স্যার, আপনার সঙ্গে তো আমার আগে দেখা হয়নি কখনো, আলাপও হয়নি, কিন্তু আপনার লেখা বই আমি পড়েছি।" আমি খুব আনন্দিত হয়ে বললাম, "ভালো কথা, তোমার পছন্দের প্রশংসা করতে হয়।" সে বললো, "একটা কথা আপনাকে বলার ছিলো। আমি যে আজকে এখানে গবেষণা করতে ঢুকলাম, তার কারণ, ক্লাস টেনে আপনার 'কী দিয়ে সমস্ত কিছু গড়া' বইটা পড়েছিলাম। সেটা পড়ে আমার মনে হয়েছিলো, আমি এই বিষয় নিয়ে রিসার্চ করতে চাই।" আমি বেশ অভিভূত হয়ে বললাম, "এই যা তুমি বললে, এটা যে কতো বড়ো পুরস্কার আমার কাছে, তা হয়তো তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। আমি জীবনে এর থেকে ভালো পুরস্কার আগে পাইনি, হয়তো আর পাবোও না।" অর্থাৎ এই যে আমি লিখি বাংলায়, আমার মতো আরো অনেকে লেখেন, তাতে কিছু তো কাজ হয়। এই কাজগুলো হওয়াটা দরকার। এবং এই কাজটা মাতৃভাষার মাধ্যমে যতো ভালোভাবে হতে পারে, ততোটা হয়তো অন্য কোনো ভাষার মাধ্যমে হয় না, কেননা আমাদের আবেগ তো মাতৃভাষা-নির্ভর।

এবারে শেষ প্রসঙ্গে চলে আসি। হয়তো অনেকে ভেবেছিলেন যে এটা প্রথম প্রসঙ্গ হবে, কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই এটাকে শেষে রেখেছি। এই তো বলছি যে বিজ্ঞান লেখা হওয়া দরকার। প্রশ্নটা হলো, ঠেকাচ্ছে কে? অবশ্যই কেউ ঠেকাতে পারে না, বিজ্ঞান নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে এবং হবে। কিন্তু যে ব্যাপারটাকে এর প্রধান অন্তরায় বলে মনে করা হয়, তা হলে পরিভাষার সমস্যা।

পরিভাষা কী? কোনো একটা বিষয় আলোচনা করতে গেলে যে বিশেষ শব্দগুলোর প্রয়োজন হয়, যেগুলো ওই বিষয়ের বাইরে দরকার হয় না, সেই শব্দগুলোকে বলা হয় পরিশব্দ, আর সেগুলোর সমষ্টিকে বলা হয় ওই বিষয়টির পরিভাষা। এটা ভাষার একটা অঙ্গ, কিন্তু একটা বিশেষ অঙ্গ যেটা সবার প্রয়োজন হয় না।

পরিভাষা নিয়ে বলতে গিয়ে আমি পদার্থবিদ্যার উদাহরণই বেশি দেবো, কারণটা বুঝতেই পারছেন আশা করি। অনেকেই খেদোক্তি করেন, "হ্যাঁ, বাংলায় তো লিখলেই হয়, কিন্তু পরিভাষা নিয়েই তো সমস্যা।" আগেই বলেছিলাম, বাংলার এই ঐতিহ্যটা যদি দেখেন এবং অনুসরণ করেন, তাহলে বুঝবেন যে খুব বড়ো সমস্যা নেই। অবশ্যই নতুন নতুন পরিশব্দের প্রয়োজন হচ্ছেযে কোনো ভাষাতেই হচ্ছেজ্ঞানের সীমা বেড়ে বেড়ে যাচ্ছে বলে। সেখানে নতুন শব্দ তৈরি করতে হবে এটা তো ঠিক সমস্যার মধ্যে পড়ে না। এটা করতে হয়, ইংরিজিতে লিখতে গেলেও করতে হয়। অনেক পরিশব্দ তৈরি হয়ে কিছুদিন পরে বাতিলও হয়ে যাচ্ছে। ইংরিজিতেও হচ্ছে। এটা খুবই স্বাভাবকি ব্যাপার, এটা হবেই। এটা আশ্চর্যের কিছু নয়, এ নিয়ে ভারাক্রান্ত হয়ে বসে থাকারও কোনো দরকার নেই, ভাবতে হবে না যে অতএব আর কিছুই করা যাবে না। কিছু যেগুলো তৈরি জিনিস, তার পরিভাষা মোটের ওপর আমাদের তৈরিই রয়েছে। খালি যেটা দরকার সেটা হলো অনুশীলন, যেটার কথা 'চর্চা' শব্দের অর্থপ্রসঙ্গে প্রথমদিকে বলছিলাম। ওই অধ্যবসায়টুকু দরকার। নিজেকে বোঝাতে হবে যে আমি ওইগুলো পড়বো, এবং বাংলাতে পড়বো। কিছুদিন আগে আমার এক পরিচিতর পরিচিত ব্যক্তি, প্রবাসী বাঙালি, তাঁর লেখা একটি বই আমাকে খুব উৎসাহভরে দিলেন, বাংলায় লেখা। আমাকে বললেন, "বাংলায় তো এইসব বিষয় নিয়ে বই নেই, আমি একটু চেষ্টা করেছি, দেখুন।" বইটা পড়ে আমি ওনাকে একটা চিঠি লিখলাম। আগেই বলেছি, দুর্মুখতার জন্য আমি খানিকটা খ্যাতি বা কুখ্যাতি অর্জন করেছি। চিঠিতে লিখলাম, "আপনার লেখার হাত খুব ভালো, আপনি আরো লিখুন আমি এই কামনা করছি। কিন্তু আমার নিবেদন, আপনি লেখার আগে কিছু পড়ুন। আপনি বাংলায় একটা বই লিখেছেন অথচ আপনার জানা নেই যে 'energy'-র বাংলা করা হয় 'শক্তি', হিন্দিতে শুনে আপনি 'উর্জা' বসিয়ে দিয়েছেন, এভাবে চলবে না।" বাংলায় তো 'উর্জা' শব্দটা ব্যবহৃত হয় না এবং 'শক্তি' শব্দটা হয়, এবং সেটা তো বেশ ভালো শব্দ, চালু শব্দ, মুখের ভাষার কাছাকাছি শব্দ—তাহলে সেটা ব্যবহার না করার তো কোনো সঙ্গত কারণ দেখা যাচ্ছে না।

এখন দেখুন, পরিভাষা তো ব্যবহার দিয়ে হয়। পরিভাষার অভিধান করে তাতে শব্দ গুঁজে রেখে দিলে তো তার জোর বোঝা যায় না, ব্যবহার করতে হয়। অতএব ব্যবহার করতে হবে। বলতে হবে, লিখতে হবে। এই ব্যবহার করার ব্যাপারে সবচেয়ে বড়ো যে অন্তরায় আছে আমাদের মনে তা হলো, আমরা অনেকেই মনে করি যে ইংরিজি শব্দগুলো এতো সহজ, তার জায়গায় বাংলায় দাঁতভাঙা সব শব্দ তৈরি করা হয়েছে, কারা এসব করে কে জানে। একেবারে সকলেই এরকম ভাবেন তা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, উচিতও নয়, তবে এইরকমের একটা চিন্তার রেশ ব্যাপক আমাদের সমাজে।

ইংরিজি শব্দগুলো সহজ? এই কথা যাঁরা বলেন তাঁরা ইংরিজি ভাষা জানেন না, অথবা বিষয়টি নিয়ে বিন্দুমাত্র ভেবে দেখেননি। পদার্থবিদ্যার কথা ধরা যাক। এ শাস্ত্রটি পড়তে গেলে শুরু করা হয় গতিবিদ্যা দিয়ে, সেখানে প্রায় প্রথমেই যে শব্দটি পড়তে হয় তা হলো 'গতিবেগ'। তার ইংরিজি কী? মানে, ইংরিজিতে লেখা পদার্থবিদ্যার বইয়ে কী লেখা হয়? লেখা হয় 'velocity'। একবার চেষ্টা করে দেখবেন তো, ইংরিজিভাষী কোনো দেশে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে 'velocity' কথাটা বলে দেখতে। কারুর দিকে তাকিয়ে যদি বলেন হয়তো সে তেড়ে আসবে বা পুলিশ ডেকে আনবে, ভাববে তাকে গালাগালি দেওয়া হচ্ছে। ইংরিজির কথ্য ভাষায় 'velocity' বলে কোনো শব্দ নেই। শুধু কথ্য ভাষা কেন, পদার্থবিদ্যার বাইরে কোথাও এ শব্দটি ব্যবহার করা হয় না। সেখানে বাংলায় আমরা বলি 'গতিবেগ', চমৎকার। অথচ আমাদের ধারণা যে 'গতিবেগ' শব্দটা এতোই লজ্জাজনক একটা শব্দ যে জনসমক্ষে তা উচ্চারণ করা যায় না। এটা এক ধরনের দাসমনোবৃত্তি- আমরা মনে করছি ইংরিজির সবই ভালো। আমি তো বহুদিন মার্কিন দেশে ছিলাম, সেখানে ছাত্রদের পড়াতে গিয়ে দেখেছি যে 'atom' কাকে বলে আর 'molecule' কাকে বলে এ মনে রাখতে তারা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে, 'atom' জুড়ে 'molecule' হয় নাকি 'molecule' জুড়ে 'atom' হয় তা তাদের কেবলই গুলিয়ে যাচ্ছে। কারণ কোনো শব্দেরই মানে তারা জানে না, দুটোই তাদের কাছে অর্থহীন কিছু ধ্বনিসমষ্টি। বাংলায় 'molecule' হচ্ছে 'অণু', আর 'atom' হলো 'পরমাণু'। এ কথা ঠিক যে 'অণু' শব্দটা কথ্য বাংলায় ব্যবহৃত হয় না, তবে খুব যে বাক্সবন্দী শব্দ তেমনও নয়। যাই হোক, 'অণু' শব্দটার অর্থ যে জানবে সে সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারবে 'পরমাণু' মানে কী –'অণু' মানে ছোটো, 'পরমাণু' মানে 'আরো ছোটো'। বিভ্রান্তির বা সংশয়ের কোনো প্রশ্নই নেই।

আরো কিছু শব্দ আছে ইংরিজিতে, যেগুলো হয়তো যখন তৈরি হয়েছিলো তখন তাদের ব্যবহার ঠিক কীরকম হবে তা স্পষ্ট ছিলো না, তাই যে নামটা দেওয়া হয়েছিলো সেটা তেমন জুতসই হয় নি। বাংলায় আমরা যখন প্রতিশব্দ তৈরি করছি তখন সেই জ্ঞানটা কাজে লাগিয়ে আমরা খানিকটা ভালো শব্দ তৈরি করতে পারি। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ইংরিজেতে 'photosynthesis' একটা শব্দ। বাংলায়, 'সালোকসংশ্লেষণ'। এর প্রথমের 'স'-টা লক্ষ্য করুন। 'স+আলোক', অর্থাৎ সালোক সহযোগে যে সংশ্লেষণ হচ্ছে সেই প্রক্রিয়ার কথা বলা হচ্ছে। ইংরিজিতে এই 'স'-টা নেই। 'Photosynthesis' বললে যা বোঝানো হচ্ছে, সেটা কি আলোরই সংশ্লেষণ, নাকি আলোর সাহায্যে অন্য কিছুর সংশ্লেষণ, সেটা ইংরিজি শব্দটার দিকে তাকিয়ে বুঝবার উপায় নেই। বাংলা শব্দটা দেখে কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, উদ্দিষ্ট অর্থটি কী। এই কারণেই বাংলা প্রতিশব্দটি চমৎকার হয়েছে, ইংরিজির চেয়ে ভালো হয়েছে।

সমস্ত পরিশব্দই বাংলায় অপূর্ব হয়েছে এ কথা আমি বলছি না। অনেক শব্দ হয়তো আরো ভালো করা যেতো। কিন্তু এটাও মানতে হবে, যে কথাটা আমি ইংরিজির উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চাইছি, যে পরিভাষার শব্দগুলো সব খুব সহজ শব্দ হয় না, কোনো ভাষাতেই হয় না। কিছু শক্ত শব্দও থাকে, তার জন্য মজবুত দাঁত তৈরি করার প্রয়োজন আছে। ইংরিজিতে 'hydrostatics' বেশ শক্ত কথা, সাধারণ ইংরিজিভাষীর মনে 'hydro' কথাটা খুব একটা অর্থ বহন করে না। তার থেকে বাংলা করা হয়েছে। 'উদস্থিতি বিদ্যা', যেটা বাংলা পদার্থবিদ্যার বইয়ে থাকে। বলতে পারেন, 'উদক' কথাটা তো বাংলা কথ্যভাষায় নেই, ওটা সংস্কৃত শব্দ। কিন্তু ওরকম কয়েকটা শব্দ থাকবেই, ইংরিজিতে 'hydro' অংশটাও ওইরকম। একটু আগে যে 'photosynthesis' বললাম তার 'photo' অংশটাও সেরকম শব্দ। এখন ফটোগ্রাফি ঘরে ঘরে, বা হয়তো বলা ভালো হাতে হাতে, ছড়িয়ে পড়েছে, তাই 'photo' শুনলে কেউ ঘাবড়ান না। কিন্তু যখন এ শব্দ বিজ্ঞানে ব্যবহার করা হয়েছিলো, তখন ইংরিজিতে এর মানে কেউ জানতো না। এখনো বিশেষ করে প্রাচীন ভাষা চর্চা যাঁরা করেন না তাঁরা হয়তো জানেন না যে এর অর্থ 'আলো'। এটা এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে। কাজেই, শক্ত শব্দ কিছু ব্যবহার করতেই হবে, এর কোনো প্রতিকার নেই। 'পরিভাষা' মানেই তো বললাম, ভাষার এমন একটা অঙ্গ যেটা অন্য জায়গায় ব্যবহার হয় না। তার জন্য কিছু শব্দ থাকবেই যা অন্যত্র ব্যবহার হয় না, অতএব শক্ত। আপনি যদি জীবনে প্রথমবার রান্না করতে ঢোকেন এবং বলেন, "কালোজিরে? কই, এ শব্দটা তো ভাই কখনো আগে শুনিনি!"—ঠিক আছে, সেটা দোষের কিছু নয়, কিন্তু রান্না করতে গেলে শব্দটা আপনাকে শিখতে হবে, এবং ব্যবহারও করতে হবে। ঠিক তেমনি, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যদি আপনি থাকেন, তাহলে কিছু কিছু বিশেষ শব্দ পাবেন যেগুলো আপনাকে ব্যবহার করতে হবে। এতে লজ্জার বা কুণ্ঠার কিছু নেই। শুধু বিজ্ঞান নয়, জ্ঞানের যে কোনো শাখা সম্পর্কেই এ কথা প্রযোজ্য।

দরকার হলে এ কাজের জন্য নতুন কিছু শব্দও তৈরি করতে হবে। নতুন শব্দ তৈরি হয় ভাষায়, বিজ্ঞানের বাইরেও তৈরি হয়। আজকে আমরা এমন অনেক শব্দ বাংলা কথ্যভাষায় ব্যবহার করি, যেগুলো কিছুদিন আগে ছিলো না। ধরুন 'সহানুভূতি' শব্দটা ছিলো না রবীন্দ্রনাথের আমলের আগে। 'সংস্কৃতি', যে শব্দটা বেশ কয়েকবার আমি এখানে ব্যবহার করেছি, সে শব্দটাও ছিলো না। তার পরিবর্তে যে শব্দ ব্যবহার করা হত 'কৃষ্টি' শব্দটি। ইংরিজি 'culture' এসেছে লাতিন 'culture' থেকে, যার মূলে যে ক্রিয়াটি সেটার মানে 'চাষ করা', যা থেকে 'agriculture' মানে 'জমি চাষ'। বাংলায় সেই কাজের ভালো শব্দ 'কর্ষণ', তা থেকে 'কৃষ্টি'। কথাটা অনেকে পছন্দ করতেন না। রবীন্দ্রনাথ 'তাসের দেশ' নাটকে লিখলেন, "কৃষ্টি। কথাটা তো মিষ্টি শোনাচ্ছে না।" শুধু তো এই শব্দটাই নয়! 'culture' যদি 'কৃষ্টি' হয় তাহলে তো 'cultural' অর্থ করতে হবে 'ক্রৈষ্টিক' সেটা উচ্চারণ করতে গেলে লোকের দাঁত আর টিকবে না। এর চেয়ে ভালো কোনো শব্দর সন্ধান শুরু হলো তখন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় খবর আনলেন, মারাঠীতে 'সংস্কৃতি' শব্দটার ব্যবহার আছে। তাদের উচ্চারণ একটু অন্য রকম, কিন্তু সে আমরা আমাদের মতো করে উচ্চারণ করলে ঠেকায় কে? তাহলে 'cultural' হবে 'সাংস্কৃতিক', নির্ভয়ে উচ্চারণ করা যাবে। এরকম অনেক কথা আমরা ব্যবহার করি। একেবারে হালে 'পরিষেবা' কথাটা চালু হয়েছে, 'প্রতিবন্ধী' চালু হয়েছে। এগুলো খুব সহজ শব্দ কিনা তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু এগুলো লোকে ব্যবহার করছে যে তা নিয়ে তো কোনো তর্ক নেই। বলতে বলতেই কথাগুলো সহজ হয়। বিজ্ঞানের পরিভাষার ক্ষেত্রেও এইরকম হবে। ইংরিজি একেবারে দেবতার মুখ থেকে বেরিয়েছে আর আমরা একেবারে ইতর সন্তান, এইটা ভাববার কোনো মানে হয় না। বাংলায় যে পরিশব্দগুলো হয়েছে, সেগুলো মোটের ওপরে যথেষ্ট ভালো। তার মধ্যেও যদি আরো উন্নতি কিছু করা যায়, বেশ তো, প্রস্তাব দিন। আমিও যেমন দু-একটা জায়গায় বলেছি নতুন শব্দের কথা, কিন্তু অপ্রচলিত পরিশব্দ অগ্রাহ্য করে, বা জানবার চেষ্টা না করে, বলিনি। যেমন আমি এক সময়ে একটা বই অনুবাদ করছিলাম, তার মধ্যে এক রকমের প্রাণীর উল্লেখ আছে যাকে ইংরিজিতে বলে 'annelid'। ইংরিজিতে এ শব্দ দেখে এর কোনো অর্থ বোঝা যায় না – এটা কীরকমের প্রাণী, বা আদৌ প্রাণী নাকি অন্য কিছু – তাও বোঝা যায় না। ফরাসিভাষীর পক্ষে অর্থ বোঝা সহজ, কেননা তাদের ভাষায় 'আংটি'-কে বলে 'anneau' (আনো)। আংটির মতো গোল বলয় জুড়ে জুড়ে যে সব প্রাণী, যেমন কেঁচো, তারা এই গোত্রের সদস্য। বাংলায় নাম করা হয়েছে 'অঙ্গুরীমাল'। দেখে আমার মনে হয়েছিলো, 'অঙ্গুরী' ব্যবহার করার কোনো দরকার ছিলো না, 'আংটিমালা' হলেই চলতো, সে কথা আমি লিখেছিলাম ভবিষ্যতের লোকেদের চিন্তায় খোঁচা দেওয়ার জন্য, কিন্তু আমি 'অঙ্গুরীমাল' কথাটাই ব্যবহার করেছিলাম। যাই হোক, ইংরিজিভাষী 'annelid' শুনলে যা বোঝে তার চেয়ে 'অঙ্গুরীমাল' বললে বাঙালি অনেক বেশি বুঝবে। ইংরিজিতে 'arthropod' শুনে কারুর বা সাধ্য নেই কী ধরনের প্রাণীর কথা বলা হচ্ছে। সে জায়গায় বাংলা 'সন্ধিপদ' শুনলে আমার মতো গোমুখ্যুও (মানে জীববিদ্যায় গোমুখ্যু—অন্যান্য কিছু কিছু ব্যাপারে আমি গরুর চেয়ে বেশি বুদ্ধি ধরি বলে আমার বিশ্বাস) বুঝতে পারে।

ভাষার কাজ তো বোঝানো। যেখানে একটা পরিশব্দ দেখলেই তার অর্থ সম্বন্ধে অন্তত একটা আবছা ধারণা জন্মায়, সেটা লাভ। কখনো কখনো সেই প্রাথমিক ধারণাটাকে একটু ছেঁটেকেটে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হয়, কিন্তু প্রাথমিক ওই বোধটুকুকে অগ্রাহ্য করার কোনো কারণ নেই।

সুতরাং বিজ্ঞান নিয়ে লেখার ব্যাপারে আমরা যে খুব একটা পিছিয়ে আছি, বা আমাদের যে খুব একটা প্রতিবন্ধকতা আছে – এ কথা ভাববার আমি কোনো কারণ দেখি না। প্রতিবন্ধকতা যেটুকু আছে, সেটা মানসিক, সেটা আমাদের অধ্যবসায়ের অভাব থেকে উৎপন্ন। কিন্তু এ কথাও তো ঠিক, যে, এর মধ্যেও বাংলা ভাষার প্রকাশনার ক্ষেত্রে আমরা নানারকমের উদ্যম দেখতে পাচ্ছি, নানা রকমের বই বেরোচ্ছে। এমন কিছু প্রকাশক আছেন, যাঁরা মোটামুটি শুধু বিজ্ঞানের বই-ই বার করেন। বিজ্ঞান নিয়ে পত্রিকা বেরোয়। একটা নয়, অন্তত গোটা তিনেকের কথা তো এক্ষুনি আমার মনে আসছে। এতগুলো বিজ্ঞান-পত্রিকা বাংলার মতো একটা ভাষায় আছে, এটা খুব কম গর্বের কথা নয়।

আমি আশা করবো, আমার তুলনায় বয়েস যাঁদের অনেক কম, বাংলায় বিজ্ঞানের এই ঐতিহ্য এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে তাঁদের সচেতনতা অনেক বেশি হবে। তাঁরা আরো বেশি করে বাংলায় লিখবেন এবং অন্যদের বাংলা লেখা পড়বে, এবং তাঁদের হাত ধরে বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা আরো বিকশিত হবে, এই আমার আশা, আমার প্রার্থনা।

লেখক পরিচিতি: অধ্যাপক পাল SINP-র অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী এবং বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের Emeritus Professor

(2017 সালের জানুয়ারি মাসে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি আয়োজিত আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় স্মারক বক্তৃতায় অধ্যাপক পালের বক্তব্যটি পরিমার্জিত আকারে প্রকাশ করা হল)

“বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা” শীর্ষক এই প্রবন্ধটি ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি প্রকাশিত ‘প্রকৃতি’ পত্রিকার চতুর্দশ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, জুলাই 2018 থেকে নেওয়া।