বিভাগগুলি

সবানতে পেবোর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি ও মানুষের বিবর্তনের গবেষণায় নতুন দিগন্ত

Svante Pääbo with a skull in hand. © Frank Vinken für Max-Planck-Gesellschaft

সুব্রত গৌড়ী

গত বছর ফিজিওলজি ও মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার প্রাপকের নাম শুনে অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন। কারণ নোবেল কমিটি এক্ষেত্রে যার নাম ঘোষণা করেছে, তাঁর গবেষণার সাথে আপাতদৃষ্টিতে ফিজিওলজির কিছু সম্পর্ক থাকলেও মেডিসিনের কোনও সম্পর্ক নেই। তিনি হলেন জার্মানির লাইপজিগে অবস্থিত ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট অফ ইভোল্যুশনারি এনথ্রোপোলজির অধিকর্তা সাবানতে পেবো (Svante Pääbo)। “অবলুপ্ত মানব প্রজাতির জিনোম নিয়ে গবেষণা এবং মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে তাঁর আবিষ্কার”-এর জন্য এই পুরস্কার। বাস্তবে তাঁর গবেষণা মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে।

তাই মানুষের বিবর্তন এবং সবানতে পেবোর গবেষণা সম্পর্কে আমরা বর্তমান প্রবন্ধে আলোচনা করব।

মানুষের বিবর্তন: প্রাককথন

মানুষের বিবর্তন নিয়ে জানার আগ্রহ বহুদিনের, কিন্তু গবেষণা বেশি দিনের নয়। বাস্তবে মানুষ যেদিন ‘মানুষ’ হয়েছে অর্থাৎ চিন্তা করার ক্ষমতা অর্জন করেছে, সেদিন থেকেই তার মাথায় ধাক্কা দিয়েছে বহু চিন্তা। তার চারপাশের জগৎটায় যে ঘটনাগুলো সে দেখেছে, সেই ঘটনাগুলো কেন হয়, কী করে হয়—এই অনন্ত জিজ্ঞাসা তাকে ভাবিয়েছে। আর ভাবিয়েছে এই প্রশ্ন ‘এলেম কোথা থেকে’। কিন্তু যতদিন না বিজ্ঞানের বিকাশ একটা ন্যূনতম উন্নত অবস্থায় পৌঁছেছে, ততদিন পর্যন্ত এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর মেলেনি। বিজ্ঞানের অনুন্নত অবস্থায় একসময় মানুষ ভেবেছে কোনও এক সৃষ্টিকর্তার কথা। ধর্মগ্রন্থ এই সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে লিখেছে অনেক গল্পকথা, নানা পৌরাণিক কাহিনী। হাজার হাজার বছর ধরে চলে এসেছে এই চিন্তা। ফলে এই চিন্তা মানুষের মনের গভীরে জায়গা করে নিয়েছে। তাই রেনেসাঁর সূচনাপর্বে এই চিন্তার মর্মমূলে যাঁরা আঘাত করেছিলেন, তাঁদের সংগ্রাম খুব সহজ ছিল না।

প্রথমে লামার্ক এবং তারপর চার্লস ডারউইন জৈবজগতের বিবর্তনের বিজ্ঞানসম্মত ধারণা আমাদের সামনে উপস্থাপিত করার পর ধর্মীয় রক্ষণশীলদের দিক থেকে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ এলেও শেষ পর্যন্ত আজ আমরা পৃথিবীতে যা কিছু দেখছি সেটা যে পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই ছিল না, কিছুদিনের মধ্যেই বিজ্ঞানীমহলে সেই চিন্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। 1859 সালে ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পিসিজ’ গ্রন্থ প্রকাশের পরে একটা প্রবল বিতর্ক উঠেছিল—এটা সত্যি। কিন্তু শেষপর্যন্ত বিবর্তনবাদের চিন্তাই জায়গা করে নিয়েছিল।

কিন্তু মানুষের বিবর্তন? কয়েক হাজার বছর ধরে মানুষ যে বিশ্বাস করে এসেছে—মানুষ সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি! তা কি অস্বীকার করা যায়? অনেকেই অস্বীকার করতে চেয়েছেন

কিন্তু বিজ্ঞানের গবেষণা তো থেমে থাকতে পারে না। 1859 সালে প্রকাশিত বইটিতে ডারউইন সাধারণভাবে জৈব বিবর্তনের কথা আলোচনা করলেও মানুষের বিবর্তন নিয়ে বিশেষ কিছু বলেননি। শুধু বলেছিলেন, “মানুষের উৎপত্তি ও তার ইতিহাস সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে”। ফলে অনেকেই আশা করেছিলেন যে, এই বিষয়ে পরবর্তীকালে ডারউইন কিছু প্রকাশ করবেন। প্রতীক্ষার অবসান হল 1871 সালে। ঐ বছর প্রকাশিত হল ডারউইনের ‘ডিসেন্ট অফ ম্যান’ বইটি, যেখানে তিনি দেখালেন যে, অন্যান্য জীবজন্তুর মতো মানুষও বিবর্তনের পথে একটা বিশেষ সময়েই পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হয়েছে। এই বইয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু আলোচনা করেননি, শুধু এইটুকু বললেন, “man is descended from some less highly organized form”। ডারউইন বললেন, প্রাণীগুলির বিবর্তনের ধারায় এক সময় বানর সদৃশ প্রাণীর জন্ম হল। এই বানর-সদৃশ প্রাণীগুলির কোনও কোনও প্রজাতি থেকেই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে উল্লুক, বেবুন, গরিলা, শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাং ও মানুষের উদ্ভব হয়েছে। ডারউইন কতগুলি অভাবনীয় অনুমান করেছিলেন। যেমন, তাঁর সময়ে প্রাপ্ত তথ্যর ভিত্তিতে তিনি বলেছিলেন যে, সমস্ত মানবজাতি হল একটাই প্রজাতি এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরণের যেসব মানুষের আবির্ভাব হয়েছে, তারা সকলে একটি পূর্ব পুরুষ থেকেই উৎপত্তি হয়েছে। তিনি এও বলেছিলেন যে, সম্ভবত মানব প্রজাতির আদি বাসস্থান হল আফ্রিকা। পরবর্তীকালে তা প্রমাণিত হয়েছে।

মানুষের বিবর্তন গবেষণার উপাদান

আমরা জানি, কোনও মনগড়া ধারণা নয়, বিজ্ঞান নির্ভর করে বাস্তব উপাদান, তথ্যপ্রমাণ বা এভিডেন্সের উপর। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস সঠিকভাবে জানার জন্যও কিছু বিজ্ঞানসম্মতভাবে গ্রহণযোগ্য উপাদানের উপর নির্ভর করতে হয়। এই উপাদানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল জীবাশ্ম। লক্ষ-কোটি বছর আগে পৃথিবীতে বিচরণকারী জীবমণ্ডলের যেকোনও সদস্য যখন মাটির নীচে চাপা পড়েছে, সেই দেহ বা দেহাংশ সংরক্ষিত থেকেছে পুরোনো পাথরের স্তরে স্তরে। সেগুলোকেই আমরা বলি জীবাশ্ম। বিবর্তনের ধারণা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই জীবাশ্মের ভূমিকা অপরিসীম।

তাই অনেক অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও বিগত শতকে বহু প্রত্নতত্ত্ববিদ ও নৃতাত্ত্বিক মানুষের প্রাচীন ইতিহাস জানার প্রয়োজনে পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রখর আবহাওয়ায় বা ইন্দোনেশিয়ার গভীর জঙ্গলে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে জীবাশ্ম অনুসন্ধানে ব্যাপৃত থেকেছেন। বিজ্ঞান যত আধুনিক হয়েছে, ততই জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়া সহজ হয়েছে। সেই জীবাশ্ম থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস লেখা হয়েছে, নতুন নতুন তথ্যের ভিত্তিতে তা সংশোধিত হয়েছে।

জীবাশ্ম ছাড়াও প্রাগৈতিহাসিক মানুষের ফেলে যাওয়া ব্যবহারিক জিনিসপত্র ওদের সম্পর্কে অনেক মূল্যবান তথ্য দেয়। তাই প্রত্নতাত্ত্বিকরা পাথরের ব্লেড ও কুঠার, অস্ত্র তৈরির পরে পাথরের অবশিষ্টাংশ, ব্যবহৃত আগ্নেয়শিলা, আবর্জনা, গুহায় আঁকা ছবি, ফেলে রাখা গিরিমাটি, রং কিংবা পাথর ও পাখির ডিম দিয়ে তৈরি শিল্পবস্তু ইত্যাদি উদ্ধার করতে চেষ্টা করেন।

এছাড়া প্রত্ন-উদ্ভিদবিদ্যা বা পালিওবটানি প্রাগৈতিহাসিক সময়কালকে বুঝতে সাহায্য করে। পৃথিবীতে কৃষিকাজের শুরু, রকমারি শস্য ও উদ্ভিদের প্রথম কৃষিজাত করার সময় ও স্থান, বিভিন্ন প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও জীবিকা বুঝতে এই বিদ্যাচর্চা সাহায্য করে।

আর একটি বিষয় এক্ষেত্রে সাহায্য করে। সেটি হল প্রত্ন-ভূতত্ত্ববিদ্যা বা প্যালিও-জিওলজি। এর সাহায্যে অতীতের জলবায়ু, বিভিন্ন সময়ে প্রাচীন পৃথিবীর তাপমান, প্রাকৃতিক বিপর্যয়—যেমন খরা, আগ্নেয় বিস্ফোরণ, তুষারপাতের পরিমাণ ইত্যাদি বিষয় জানতে পারা যায়।

মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে আমাদের ধারণায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে জিনবিদ্যা বা জেনেটিক্স। বিংশ শতকে বংশগতিতে জিনের ভূমিকা ও জিনের গঠন সম্পর্কে মানুষের জানার পরিধি বাড়তে থাকে। জিন হল ডিএনএ নামক জৈব অণুর বিশেষ বিশেষ অংশ, যা কোনও জীবের শরীরগঠন সম্পর্কে তথ্য ধরে রাখে। বিগত কুড়ি বছরে জেনেটিক্সের কিছু প্রকৌশল আধুনিক মানুষের উৎস সন্ধানে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং খুব কম সময়ের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অধিকার করেছে। জেনেটিক্স প্রাণীর প্রজনন ও বংশগত বৈচিত্র্য, উত্তরাধিকারের বৈশিষ্ট্য ও প্রজাতির উৎপত্তি, তাদের বিবর্তন নিয়ে চর্চা করে। এই চর্চা আধুনিক মানুষের উদ্ভব ও বিবর্তন, তার পৃথিবীব্যাপী পরিযান ও বিভিন্ন অঞ্চলে জনগোষ্ঠীর উৎস নির্ধারণের সাহায্য করে।

মানুষের বিবর্তনের ক্ষেত্রে জেনেটিক্সের ভূমিকা এবং সবানতে পেবোর গবেষণা

এই বিষয়টি বুঝতে হলে জিনবিদ্যার প্রাথমিক ধারণার প্রয়োজন আছে। সেই বিষয়টি এখানে প্রথমে আলোচনা করে নেওয়া যাক।

1865 সালে অস্ট্রিয়ান জীববিজ্ঞানী গ্রেগর যোহন মেন্ডেল প্রথম মটর শুঁটি গাছের উপর কিছু পরীক্ষা করেন। সেই পরীক্ষা থেকে তিনি অনুমান করেন যে, বংশগতির কিছু বিচ্ছিন্ন এককের মাধ্যমে মা-বাবার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। এই একককে পরবর্তীকালে বংশাণু বা জিন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। জিন হল ডিএনএ নামক জৈব অণুর লম্বা শৃংখলের এক একটি অংশ।

আজ আমরা জেনে গেছি যে, যেকোনও জীবের বংশগতির বাহক হল এই ডিএনএ (DNA)। কোনও কোনও জীবাণুতে এই কাজটি করে আরএনএ অণু, তবে সেরকম জীবাণুর সংখ্যা খুবই কম। তাই ডিএনএ অণুকে বংশগতির বাহক ধরে নিয়েই বাকি আলোচনা করছি। এই অণুর মধ্যে রয়েছে ডিঅক্সিরাইবোজ (এটি এক ধরনের সুগার), ফসফেট এবং চার ধরনের নাইট্রোজেন বেস (base)। এই চারটি বেস হল অ্যাডেনিন (A), থায়মিন (T), গুয়ানিন (G) এবং সাইটোসিন (C)। আবার আরএনএ (RNA) অণুতে রাইবোজ সুগার, ফসফেট এবং অ্যাডেনিন (A), ইউরাসিল (U), গুয়ানিন (G) এবং সাইটোসিন (C) দিয়ে তৈরি।

ডিএনএ অণুগুলো আকারে বেশ বড়ো হয়, দুটো লম্বা সুতো যেমন জড়িয়ে থাকে তেমনই ডিএনএ’র দুটো স্ট্রান্ড পরস্পরকে জড়িয়ে থাকে। এই মডেলটি 1953 সালে বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটসন ও ফ্রান্সিস ক্রিক আবিষ্কার করেছিলেন, যা ডিএনএ ডবল হেলিক্স নামে পরিচিত। ডিএনএ ডবল হেলিক্স এর ভেতর A জোড় বেঁধে থাকে T এর সাথে, আর C জোড় বেঁধে থাকে G এর সাথে। এই চারটি মাত্র ‘অক্ষরের’ সামগ্রিক বিন্যাসে সকল জীবের জিনোম রচিত হয়েছে। জিনোম বলতে কোনও জীবের সামগ্রিক ডিএনএকে বোঝায়। ডিএনএ অণুর প্রতিটি স্ট্রান্ডে দুটি প্রান্ত থাকে। একটি প্রান্ত 3′ নামে চিহ্নিত যেখানে ডিঅক্সিরাইবোজ সুগারের 3′ হাইড্রক্সিল গ্রুপ থাকে, অন্য প্রান্তটি 5′ নামে চিহ্নিত যেখানে ডিঅক্সিরাইবোজ সুগারের 5′ হাইড্রক্সিল গ্রুপের সঙ্গে ফসফেট গ্রুপ থাকে। যখন ডিএনএ’র দুটো স্ট্রান্ড একত্রে থাকে তখন তারা বিপরীতমুখীভাবে পরস্পরকে জড়িয়ে থাকে।

জিনোমের ডিএনএ’র পুরোটাই কিন্তু জিন (gene) হিসাবে কাজ করে না। জিন বলতে জিনোমের ডিএনএ’র সেই অংশকেই বোঝায় যেটা নির্দিষ্ট কোনও প্রোটিন তৈরির সংকেত বা কোড ধারণ করে। মজার ব্যাপার হলো, জিনোমের শতকরা 99 ভাগ অংশই হচ্ছে কোডবিহীন ডিএনএ। মানুষের জিনোমের তিন বিলিয়ন বেস জোড়ের ভেতর থেকে মাত্র 25 হাজারের মতো জিন খুঁজে পাওয়া গেছে। এই জিনগুলো সম্মিলিতভাবে মানুষের সকল বৈশিষ্ট্যকে বহন করে।

আমাদের শরীরে কোষের মাইটোকনড্রিয়ার মধ্যেও আছে এক বিশেষ ডিএনএ। একে বলে ‘মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ’। নারী পুরুষ উভয়ের মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ তাদের মায়ের থেকেই প্রাপ্ত। তাই তা মায়ের মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএর অনুরূপ হয়। শুধু মায়ের মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ প্রবাহিত হয় সমস্ত সন্তানের মধ্যে। তাই আমার মা বহন করেন তার মায়ের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ। আর আমি বহন করি আমার মায়ের মা অর্থাৎ আমার দিদিমার মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ। অন্যান্য ডিএনএর মতো মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএতেও মিউটেশন হয়।

পূর্ববর্তী লক্ষ লক্ষ বছরে এই মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএর কিছু নির্দিষ্ট মিউটেশন হয়েছে। আর মিউটেশন সহ মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ মা থেকে তার সন্তানদের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। মিউটেশনের জন্য মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএর মধ্যে যে পার্থক্যগুলি হয়েছে তার সাহায্যে মায়ের দিক দিয়ে সমস্ত আধুনিক মানুষকে কিছু নির্দিষ্ট জেনেটিক গোষ্ঠীতে ভাগ করা যায়। সাধারণত ইংরেজি বর্ণমালার অক্ষর দিয়ে এই গোষ্ঠীগুলির নামকরণ করা হয়েছে। সেই গোষ্ঠীর শাখা-প্রশাখাগুলিকে বিস্তারিত ভাবে বোঝাতে আবার অক্ষরের সঙ্গে অতিরিক্ত সংখ্যার সমন্বয় করা হয়। মাতৃক্রমের দিক দিয়ে কিছু প্রচলিত জেনেটিক গোষ্ঠী হল KE, U8, M3 ইত্যাদি।

আবার পুরুষের প্রজনন কোষের ওয়াই (Y) ক্রোমোজোম ডিএনএ একমাত্র পিতার থেকে পুত্রতে প্রবাহিত হয়। এই ডিএনএ কোনও নারীর শরীরে থাকে না। তাই মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ দিয়ে যেমন মাতৃক্রমের (maternal lineage) উৎসের সন্ধান পাওয়া যায়, তেমনি ওয়াই ক্রোমোজোমের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে পিতৃক্রমের (paternal lineage) খোঁজ পাওয়া যেতে পারে। 'ওয়াই ক্রোমোজোম ডিএনএ'অনুসারে কিছু প্রচলিত জেনেটিক গোষ্ঠী হলো J1, O2, R1 ইত্যাদি।

এই জেনেটিক গোষ্ঠীগুলোকে বলে হ্যাপলোগ্রুপ। হ্যাপলোগ্রুপ হল পিতৃক্রম বা মাতৃক্রম থেকে আগত এক একটি ডিএনএ-শৃঙ্খল। এই শৃঙ্খলে কী কী নির্দিষ্ট পরিবর্তন বা মিউটেশন অতীত থেকে আজ পর্যন্ত হয়ে এসেছে তা জানার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। হ্যাপলোগ্রুপ বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর উৎস সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে।

মিউটেশন খুবই ধীর এক প্রক্রিয়া। বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ ও ওয়াই ক্রোমোজোম ডিএনএ’র মিউটেশনের একটা নির্দিষ্ট হার আছে। মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে পরে এদের মিউটেশন হয়। তাই মিউটেশনের হার থেকে ঠিক কয়টি প্রজন্ম আগে সেই আদিমাতা বা আদি পিতার হ্যাপলোগ্রুপের সূচনা হয়েছে সেটাও মোটামুটি হিসাব কষে বলে দেওয়া যায়। আর একটি প্রজন্মের গড় আয়ু থেকে আনুমানিক কত বছর আগে ওই হ্যাপলোগ্রুপের আবির্ভাব, তা নির্ণয় করা সম্ভব।

জীবাশ্মের ডিএনএ নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিয়েছেন সবানতে পেবো। আমরা জানি, জীবন্ত প্রাণীর জিনোম নিয়ে চর্চা করা অনেক সহজ। কিন্তু জীবাশ্মের জিনোম নিয়ে পরীক্ষা করা অনেক বেশি কঠিন। সময়ের সাথে সাথে ডিএনএ রাসায়নিকভাবে পরিবর্তিত হয় এবং ধীরে ধীরে ছোট ছোট টুকরোয় ভেঙ্গে যায়। ফলে হাজার হাজার বছর পরে যখন কোনও হাড়ের জীবাশ্ম পাওয়া যায়, তা থেকে ডিএনএর কেবলমাত্র কিছু টুকরোই পাওয়া যায়। তাছাড়া অনেকসময় এই সব জীবাশ্মতে ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের ডিএনএ মিশে যায়। সবানতে পেবো এবং তার টিম এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করে অত্যন্ত ধৈর্য্য সহকারে প্রাচীন ডিএনএ টুকরো থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আহরণের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন।

পেবো তাঁর এই গবেষণা শুরু করেছিলেন গোপনে। তিনি যখন উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির জন্য গবেষণা করছিলেন, তখন এই কাজ শুরু করেন। তাঁর সুপারভাইজার তাঁর এই কাজ সমর্থন করবেন কিনা এ বিষয়ে তিনি যথেষ্ঠ সন্দিহান ছিলেন। তাই তিনি রাত্রে গোপনে 2400 বছরের পুরনো একটি মিশরীয় মমির কোষ থেকে ডিএনএ বিচ্ছিন্ন করে সেগুলি বিশ্লেষণ করেছেন। এই কাজের ভিত্তিতে তাঁর গবেষণাপত্র নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল 1985 সালের 18 এপ্রিল। জীবাশ্মের কোষের ডিএনএ নিয়ে এটাই প্রথম গবেষণাপত্র।

এরপর আর তিনি পিছনে তাকাননি। সময়ের সাথে সাথে তিনি এবং তাঁর টিম জীবাশ্ম থেকে ডিএনএ বিচ্ছিন্ন করা ও বিশ্লেষণ করার কাজে নিপুণতা অর্জন করেন। তাঁরাই প্রথম 2010 সালে কিছু ফাঁক সহ নিয়েন্ডারথাল নামের মানব প্রজাতির পূর্ণ ডিএনএ সিকোয়েন্স নির্ধারণ করেন। এরপর 2014 সালে তিনি সাইবেরিয়ার অলতাই পর্বত থেকে প্রাপ্ত একটি নিয়েন্ডারথাল মেয়ের জীবাশ্মর পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ সিকোয়েন্স নির্মাণ করতে সক্ষম হন। জীবাশ্মর ডিএনএ সিকোয়েন্স নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে এগোতে থাকে। বর্তমানে 8000-এরও বেশি নিয়েন্ডারথাল মানব প্রজাতির ডিএনএ সিকোয়েন্স পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে সবানতে পেবোর অন্যান্য আবিষ্কার ও মানুষের বিবর্তন বোঝার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা নিয়ে পরে আলোচনা করব। তার আগে দেখে নেওয়া যাক, মানুষের বিবর্তনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

মানব প্রজাতির উদ্ভব ও বিবর্তনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

আধুনিক মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম হল হোমো স্যাপিয়েন্স। স্যাপিয়েন্সের এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাচীনতম জীবাশ্ম পাওয়া গেছে আফ্রিকাতে। আজ থেকে তিন লক্ষ ত্রিশ হাজার থেকে তিন লক্ষ বছর আগের কোনও একটা সময়ের এই জীবাশ্ম মিলেছে উত্তর আফ্রিকার মরক্কোর জেবেল এরহুড গুহায়। আফ্রিকায় সেই অতি প্রাচীন মানুষের মুখের বৈশিষ্ট্যগুলি আজকের মানুষের সঙ্গে তুলনীয় হলেও খুলির পেছনের অংশ ছিল চ্যাপ্টা, দীর্ঘায়িত। করোটির আকৃতিতে পার্থক্য ইঙ্গিত দেয় যে, মস্তিষ্কের আকৃতি এবং সম্ভবত মস্তিষ্কের কিছু ক্রিয়া আধুনিক মানুষের মধ্যে তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিককালে বিকশিত হয়েছে। জেবেল এরহুডের সেই প্রাচীন মানুষকে আজ বলে এনাটোমিক্যালি মডার্ন হিউম্যান। ওদের থেকে বিবর্তিত হয়ে আধুনিক মানুষের আজকের রূপ এসেছে। কিন্তু কেমন করে এল সেই প্রাচীন হোমো স্যাপিয়েন্স? এবার আমরা সংক্ষেপে সেই আলোচনা করব।

প্রায় কুড়ি কোটি বছর আগে প্রথম স্তন্যপায়ী জীবের আগমন হয় পৃথিবীতে। সেই স্তন্যপায়ী থেকে অন্তত সাড়ে পাঁচ কোটি বছর আগে আসে প্রাইমেট। প্রাইমেট হল স্তন্যপায়ীদের সেই গোষ্ঠী যাদের মধ্যে আছে বানর, লেমুর এবং এপ ও বিভিন্ন মানব প্রজাতি। বিবর্তনের ধারায় পরের দিকে প্রাইমেটদের মধ্যে এসেছে এপ। এই এপ থেকেই জন্ম নিয়েছে মানব প্রজাতি।

গরিলা, মানুষ ও শিম্পাঞ্জির পূর্বসূরী থেকে গরিলা বংশ আলাদা হয়ে যায় প্রায় নব্বই লক্ষ বছর আগে। তারপর শিম্পাঞ্জি ও মানুষের পূর্বসূরী থেকে একটি শাখা চল্লিশ লক্ষ বছর আগে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের শিম্পাঞ্জি ও বনোবোর জন্ম দিয়েছে। আর অন্য শাখাটি থেকে এসেছে ‘মানব প্রজাতির সমষ্টি’। মানব প্রজাতি সমষ্টির একেবারে শেষ দিকে এসেছে হোমো স্যাপিয়েন্স। হোমো জেনাসের অন্তর্ভূক্ত প্রজাতিগুলিকেই এখানে ‘মানব প্রজাতি সমষ্টি’ বলা হচ্ছে

এই মানব প্রজাতি সমষ্টির কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। এরা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত। দু’পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারত। এদের মস্তিষ্ক ছিল এপ-দের তুলনায় বড়। আর এরা হাতের ব্যবহার জানত। এপ্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই ডারউইনের বইয়ে ব্যবহৃত একটি রূপক। তিনি তাঁর অরিজিন অফ স্পিসিজ বইয়ে বলেছিলেন, “একই শ্রেণির সকল জীবের পারস্পরিক সম্বন্ধ অনেক সময় এক বৃহৎ বৃক্ষ দিয়ে বোঝানো হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি এই উপমা অনেকাংশে সত্য। সবুজ ও মুকুলিত শাখাগুলি বিদ্যমান প্রজাতির প্রতিনিধিত্ব করে এবং পূর্বের বছরগুলিতে জন্মানো শাখাগুলি বিলুপ্ত প্রজাতিসমূহের দীর্ঘ উত্তরাধিকারের প্রতিনিধি।

মানব প্রজাতি সমষ্টির বংশতালিকায় আর সব ডাল শুকিয়ে গেছে, টিকে আছে শুধু একটি প্রজাতি হোমো স্যাপিয়েন্স।

কোথা থেকে এল এই মানব প্রজাতি গোষ্ঠী? সেই পূর্বপুরুষের কি কোনও চিহ্ন টিকে আছে পৃথিবীর বুকে? এই প্রশ্নের উত্তর মিলল 1959 সালে। অনেকেই তখন আফ্রিকার বুকে খুঁজে চলেছেন সেই পূর্বপুরুষকে। খুঁজে পেলেন লিকি দম্পতি, যাঁরা জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়ে দিয়েছিলেন আফ্রিকার রুক্ষ ভূমিতে মানুষের পূর্বপুরুষদের জীবাশ্ম অন্বেষণের লক্ষ্য নিয়ে।

লুই লিকি তাঞ্জানিয়ার অলডুভাই গিরিসংকটে পাওয়া এই প্রজাতির নামকরণ করেন ‘অস্ট্রালোপিথেকাস বইসেই’

1974 সালে ইথিওপিয়ায় পাওয়া গিয়েছিল একটি জীবাশ্ম। তার নাম দেওয়া হয়েছিল লুসি। লুসির কঙ্কাল প্রায় 40 শতাংশ সম্পূর্ণ অবস্থায় পাওয়া গেছে। এই প্রজাতির নামকরণ করা হয় ‘অস্ট্রালোপিথেকাস অফারেন্সিস’। এরা হল প্রারম্ভিক হোমিনিন প্রজাতিগুলির মধ্যে একটি

আজ থেকে বত্রিশ লক্ষ বছর আগে লুসি মারা গেছে। তখন তার বয়স ছিল মাত্র 12 বছর। সে ছিল ছোটখাটো পূর্ণ নারী। শিম্পাঞ্জির মতো মুখ ও দেহকাণ্ড, কিন্তু ওর কোমর থেকে নিচের অংশ মানব প্রজাতির মতো। ওরা দুপায়ে দাঁড়াতে ও হাঁটতে পারত। আটত্রিশ থেকে উনত্রিশ লক্ষ বছর পর্যন্ত ওরা পৃথিবীতে ছিল। পূর্ব আফ্রিকার ইথিওপিয়া, কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়াতে ওদের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। এই প্রজাতির সদস্যদের নাক ছিল চ্যাপ্টা, নিচের চোয়াল দৃঢ়ভাবে বেরিয়ে আসা এবং মস্তিষ্ক ছিল ক্ষুদ্র। ওদের মস্তিষ্ক ছিল 500 কিউবিক সেন্টিমিটার(সিসি) এর কম। ওরা খেত নরম খাবার, যেমন পাতা, উদ্ভিদ, ফল।

অস্ট্রালোপিথেকাসরা মানব বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বেশিরভাগ বিজ্ঞানী মনে করেন যে, সম্ভবত ত্রিশ থেকে পঁচিশ লক্ষ বছর আগে ওদের থেকে অথবা হয়তো ওদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হোমিনিন থেকে হোমো গণের সদস্যরা এসেছে।

দ্বিপদ হওয়ার সাথে সাথে অস্ট্রালোপিথেকাসদের হাতের বুড়ো আঙুলের পরিবর্তন হতে থাকে। গরিলার বুড়ো আঙুল হল বাঁকানো ও ছোট। লুসির বুড়ো আঙুল ছিল তুলনায় কিছুটা বাঁকানো তবে গরিলার মতো অতটা বাঁকানো নয়। আবার আধুনিক মানুষের মতো সম্পূর্ণ সোজা বা লম্বাও নয়। ওরা ওদের শক্ত আঙুল দিয়ে ডাল ধরে গাছে উঠতে পারতো এবং সম্ভবত নুড়িও কুড়াতে পারত। গাছের ডাল ও ভূপৃষ্ঠ উভয় পরিবেশেই ওরা অভিযোজিত ছিল। এজন্য জলবায়ু এবং পরিবেশের পরিবর্তন সত্ত্বেও অন্তত দশ লক্ষ বছর ধরে ওরা বেঁচে থাকতে পেরেছে।

বিবর্তনের পথে একসময় হাত দুটো পুরো স্বাধীন হয়ে গেল। গাছের ডাল ধরে ঝুলবার জন্য ওদের হাত আর আটকে থাকল না। হাত হয়ে গেল স্বাধীন। হাত স্বাধীন হওয়ার পরেই কিন্তু তা আমাদের হাতের মতো দক্ষ হয়ে ওঠেনি; তা ছিল আজকের শিম্পাঞ্জির হাতের কাছাকাছি। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এমন পরিবেশে ওরা নিজের ঠাঁই গড়ে নেবার চেষ্টা করল, যেখানে হাতকে দিয়ে নানা নতুন কাজ করানো দরকার। হাতের গঠন ও দক্ষতার উপর বিবর্তনের চাপ তৈরি হল। গাছ বেয়ে ওঠার কাজের জন্য যে হাত ছিল উপযুক্ত, সেই হাতের গঠন বদলে হল হাতিয়ার ধরার আর সূক্ষ্ম কাজ করার জন্য উপযুক্ত। ওরা বাহু ও হাত ব্যবহার করল বিভিন্ন জায়গা থেকে খাদ্য সংগ্রহ ও বহন করতে আর বিভিন্ন হাতিয়ার (Tools) তৈরি করতে। শিখল পাথর দিয়ে নানা সরঞ্জাম তৈরি করতে।

ওরা আগে ছিল শুধু সংগ্রাহক। প্রথমে শুধু নুড়ি, পরে পাথরের ফলক ও কুঠার ব্যবহার করে ধীরে ধীরে ওরা হয়ে উঠল শিকারি ও সংগ্রাহক। এইরকম এক মানব প্রজাতি হলো ‘হোমো হাবিলিস’। হোমো হাবিলিসরা থাকত আফ্রিকার পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে। মেরি লিকি ও তার জ্যেষ্ঠ পুত্র জোনাথন তাঞ্জানিয়ার গিরিসংকটের কাছেই হোমো হাবিলিসের প্রথম জীবাশ্ম আবিষ্কার করেছিলেন। 1964 সালে লুই লিকি, ফিলিপ টোবিয়াস ও জন নেপিয়ার নেচার পত্রিকায় এক গবেষণা পত্রে দাবি করেন হোমো হ্যাবিলিস হল প্রথম দিকের মানব প্রজাতি এবং এরা ছিল সত্যিকারের সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক। এদের মস্তিষ্কে ব্রোকাস এরিয়া পাওয়া গেছে, যা এদের চিন্তা করার ক্ষমতার ইঙ্গিত দেয়। এরা অস্ট্রালোপিথেকাসদের থেকে গুণগতভাবে আলাদা ও উন্নততর ছিল।

এই ধারাতেই বিবর্তনের পথে মানুষের মস্তিষ্কের আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছে, দাঁত হয়েছে ক্ষুদ্রতর। ধীরে ধীরে তাদের একটি প্রজাতির দেহের গঠন হল অনেকটা আধুনিক মানুষের মতো। এমনই এক মানব প্রজাতির নাম দেওয়া হল ‘হোমো ইরেক্টাস’। ওদের হাত ও পা ছিল আগের প্রজাতিগুলির তুলনায় দীর্ঘ, অনেকটা আজকের মানুষের মতো। ওরা সেইসময় রীতিমতো শিকার করতে শুরু করে এবং খাদ্য তালিকায় আসে মাংস। নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেন, মানব প্রজাতিসমূহের খাদ্য তালিকায় মাংস আসার ফল হয় সুদূরপ্রসারী। মানবদেহের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল মস্তিষ্ক। এটি মানুষের দেহের ওজনের মাত্র 2 শতাংশ দখল করে, কিন্তু একে সচল রাখতে মোট প্রয়োজনীয় ক্যালোরির 25 শতাংশ পর্যন্ত আবশ্যক হয়।

এতদিন মানবপ্রজাতিগুলির গতিবিধি আফ্রিকায় সীমাবদ্ধ ছিল। হোমো ইরেক্টাসই সম্ভবত প্রথম মানব প্রজাতি যারা আফ্রিকার বাইরে আসে। পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছিল ওদের পদচারণা। আঠারো থেকে পনেরো লক্ষ বছরের পুরনো হোমো ইরেক্টাসের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে ইউরেশিয়াতে। ওদের বাসস্থান ছিল মূলত উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকা। কুড়ি লক্ষ বছর আগে থেকে আড়াই লক্ষ বছর আগে পর্যন্ত ওরা বেঁচে ছিল।

হোমো ইরেক্টাসরা ছুরির মতো ধারালো পাথরের পাতলা ফলক তৈরি করতে পারত। এই নতুন যন্ত্রপাতি ওদেরকে প্রচুর সুবিধা দিল, যা অন্য কোনও প্রাণীর নেই। দাঁতের সাহায্য ছাড়াই ওরা বুনো কুকুরের মতো পশুর মৃতদেহ থেকে শক্ত মাংস ছিঁড়ে নিতে পারত। ওরা ধীরে ধীরে সর্বভুক হয়ে উঠল। ওরাই প্রথম আগুনের ব্যবহার শিখেছিল। অন্ততপক্ষে দশ থেকে পাঁচ লক্ষ বছর আগে ওরা আগুনের সাহায্যে মাংস পুড়িয়ে খেতে শিখেছে।

হোমো ইরেক্টাসের যে মূল শাখাটি আফ্রিকাতে থেকে গিয়েছিল, তাদের উত্তরসূরি হল ‘হোমো হাইডেলবার্গেন্সিস’।

হোমো হাইডেলবার্গেন্সিসরা পৃথিবীতে ছিল আট থেকে তিন লক্ষ বছর আগে পর্যন্ত। থাকত পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকা, ইউরোপ, চিন, জাপানে। ওরাই প্রথম ঠান্ডা আবহাওয়াতে বাস করা মানব গোষ্ঠী। ওদের বেঁটেখাটো, প্রশস্ত দেহ সম্ভবত তাপ সংরক্ষণের জন্য উপযোগী ছিল। ওরা আগুনের ব্যবহার জানত। হাতে থাকত কাঠের বল্লম। সম্ভবত প্রথম কোনও মানব প্রজাতি যারা বল্লম দিয়ে শিকার করেছে বড় পশু।

হোমো হাইডেলবার্গেন্সিস থেকেই তিন জ্ঞাতিভাই আধুনিক মানুষ, নিয়েন্ডারথাল ও ডেনিসোভান উদ্ভূত হয়েছে। ডিএনএ বিশ্লেষণ করে বোঝা গেছে যে, এই তিন জ্ঞাতিভাই সম্পূর্ণ আলাদা প্রজাতি নয়। এদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে পরে আলোচনা করব।

সাত লক্ষ সত্তর হাজার থেকে পাঁচ লক্ষ বছর আগে হোমো হাইডেলবার্গেন্সিসের একটি গোষ্ঠী আফ্রিকা ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তার দীর্ঘদিন পরে চার লক্ষ সত্তর হাজার বছর থেকে তিন লক্ষ আশি হাজার বছরের মধ্যে কোনও এক সময়ে ওরা আবার বিভক্ত হয়ে যায়। একটি শাখা উত্তর-পশ্চিম দিকে ইউরোপে ঢুকে পড়ে। এদের বলা হয় ‘নিয়েন্ডারথাল’। অন্য শাখাটি পূর্ব দিকে এশিয়াতে চলে যায়। এই শাখা থেকেই বিবর্তনের পথে ‘ডেনিসোভান’-এর সৃষ্টি। ‘নিয়েন্ডারথাল’ ও ‘ডেনিসোভান’রা আফ্রিকার বাইরে উদ্ভূত হয়েছে। আর আফ্রিকাতে থেকে যাওয়া শাখাটি থেকে আনুমানিক তিন লক্ষ ত্রিশ হাজার বছর থেকে তিন লক্ষ বছর আগে আধুনিক মানুষের উদ্ভব হয়েছে।

প্রায় সাড়ে চার লক্ষ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার বছর আগে পর্যন্ত নিয়েন্ডারথালরা বেঁচে ছিল। ইউরোপ, মধ্য ও পশ্চিম এশিয়াতে দীর্ঘকাল ধরে ওরা বাস করেছে। চলে গিয়েছে রাশিয়ার উত্তরে সাইবেরিয়ায়। ওদের মুখ ছিল চ্যাপ্টা, ঠান্ডা শুষ্ক বায়ুকে উষ্ণ করার জন্য ছিল বিশাল নাক, গাঁট্টাগোট্টা, বেঁটেখাটো চেহারা। যখন ইউরোপে খুব ঠান্ডা ছিল, তখন ওরা সেখানে থেকেছে। বিবর্তনের প্রক্রিয়াতে ওদের চওড়া শরীর উত্তাপ ধরে রাখতে সাহায্য করেছে। হাত পা ছোট হওয়ার জন্য শরীরের তাপ বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল কম।

ওরা নিয়ন্ত্রিতভাবে আগুনের ব্যবহার জানত, নিজেদের বাসস্থানে আগুনকে রক্ষা করতে পারত। পরিকল্পনা করে দক্ষতার সঙ্গে বড় প্রাণী শিকার করতে পারত। পশুর চামড়া গায়ে জড়িয়ে নিত। মৃতদেহকে কবর দিত। সম্ভবত ওরা সামান্য আঁকতেও পারত।

তবে ওরা সেলাই করতে পারত না। স্যাপিয়েন্সরা কিন্তু সূচ দিয়ে পশুর চামড়া সেলাই করে পরত। এই প্রযুক্তি শীতের মধ্যে স্যাপিয়েন্সকে ইউরোপে টিকে থাকতে ও আমেরিকায় নিজেদের বিস্তৃত করতে সাহায্য করেছে। ‘নিয়েন্ডারথাল’-দের পাথরের সরঞ্জামও স্যাপিয়েন্সের তুলনায় নিকৃষ্টতর ছিল।

আর এক মানব প্রজাতি ‘ডেনিসোভান’-দের সম্পর্কে জানা যায় অতি সাম্প্রতিক কালে, মাত্র 2008 সালে। মঙ্গোলিয়ার কাছে সাইবেরিয়ার পর্বতে ডেনিসোভা নামে এক গুহায় পাওয়া গিয়েছিল হায়েনার দ্বারা চিবানো বিভিন্ন হাড়ের গুঁড়ো আর টুকরো হাড়। সেখান থেকে কিছু হাড়ের টুকরো ও দাঁত উদ্ধার করে তার ডিএনএ বিশ্লেষণ করে জানা যায় প্রাচীন এক মিশ্র কিশোরীর জন্মবৃত্তান্ত। এই গবেষণায় সবানতে পেবো এবং তাঁর টিমের কাজ উল্লেখযোগ্য। দেখা গেল, এটি ছিল এক 13 বছরের কিশোরীর আঙ্গুল, যে বেঁচে ছিল নব্বই হাজার বছর আগে। কিশোরীর মা ছিল আমাদের পূর্ব পরিচিত নিয়েন্ডারথাল। কিন্তু তার বাবার কোনও পরিচিতি এতদিন জানা ছিল না। সেই পিতৃবংশের নাম দেওয়া হয় ‘ডেনিসোভান’।

সবানতে পেবোর গবেষণা এবং মানুষের বিবর্তনের কিছু অমীমাংসিত প্রশ্নের সমাধান

আমরা আগেই বলেছি, নিয়েন্ডারথাল মানবপ্রজাতির জীবাশ্মর ডিএনএ বিশ্লেষণ করে বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। নিয়েন্ডারথাল জীবাশ্মের ডিএনএর সাথে আধুনিক মানুষের ডিএনএর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে আধুনিক মানুষের ডিএনএর নিউক্লিওটাইডে কোনগুলি নিয়েন্ডারথাল থেকে এসেছে তা নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। আধুনিক মানুষের মধ্যে প্রায় 1,35,000টি জেনেটিক উপাদান পাওয়া গেছে, যা নিয়েন্ডারথাল থেকে এসেছে।

আধুনিক মানুষের মধ্যে নিয়েন্ডারথাল থেকে প্রাপ্ত নিউক্লিওটাইড বিশ্লেষণ করে পেবো এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, এই দুটি মানব গোষ্ঠীর মধ্যে যৌন মিলন হত। এর ফলে নিয়েন্ডারথাল মানব প্রজাতির অবলুপ্ত হওয়ার কারণ হিসেবে আধুনিক মানুষের সাথে তাদের লড়াই ও তার ফলে নিশ্চিহ্ন হওয়ার ধারণা বাতিল হয়ে গেছে। বিভিন্ন মহাদেশে বসবাসকারী আধুনিক মানুষের জেনেটিক সিকোয়েন্স এবং নিয়েন্ডারথাল জীবাশ্মর জেনেটিক সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, আফ্রিকার বাইরের আধুনিক মানুষের জিনের মধ্যে 1-4 শতাংশ নিয়েন্ডারথাল ডিএনএ বর্তমান। নিয়েন্ডারথাল আফ্রিকার বাইরেই উদ্ভূত হয়েছিল এবং সম্ভবত আফ্রিকায় তারা যায়নি। তবে আফ্রিকা মহাদেশের কিছু কিছু মানুষের মধ্যে খুব অল্প পরিমাণ (এক শতাংশেরও কম) নিয়েন্ডারথাল ডিএনএ পাওয়া গেছে। এটা সম্ভবত এই কারণেই হয়েছে যে, প্রাচীনকালে ইউরোপে বসবাসকারী হোমো স্যাপিয়েন্সের একটা অংশ, যাদের সাথে নিয়েন্ডারথাল মানবের মিলন হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে তারা নিয়েন্ডারথাল ডিএনএ বহন করে আফ্রিকায় ফিরে গিয়েছিল এবং সেখানকার মানুষের সাথে মিশেছিল।

একইভাবে সমসাময়িক হোমো স্যাপিয়েন্স, নিয়েন্ডারথাল ও ডেনিসোভানদের ডিএনএ সিকোয়েন্সের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হোমো স্যাপিয়েন্স ও ডেনিসোভানদের পরস্পরের মধ্যে যৌন মিলন হত এবং তার মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক অপত্য শিশুর জন্ম হত। দেখা হয়েছে যে, আফ্রিকার বাইরে বসবাসকারী আধুনিক মানুষের ডিএনএর মধ্যে 4-6 শতাংশ ডেনিসোভান ডিএনএ রয়েছে।

আগে উল্লেখিত কিশোরীর দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যায় যে, নিয়েন্ডারথাল ও ডেনিসোভানদের পরস্পরের মধ্যে যৌন মিলন হত এবং স্বাভাবিক অপত্য শিশুর জন্ম দিত।

এখন প্রশ্ন হল, নিয়েন্ডারথাল ও আধুনিক মানুষের যৌন মিলনের মধ্য দিয়ে যে শিশুর জন্ম হত, তাদের অবস্থান কী হত? ডিএনএ সিকোয়েন্সের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে, তারা আধুনিক মানুষের গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেত, নিয়েন্ডারথালের নয়। কারণ, যদি এই শিশুরা নিয়েন্ডারথাল গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হত তাহলে সুনির্দিষ্টভাবে আধুনিক মানুষের ডিএনএ-এর নিউক্লিওটাইড নিয়েন্ডারথালের ডিএনএ সিকোয়েন্সে পাওয়া যেত। কিন্তু এই ধরনের কোনও তথ্য এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এই ঘটনা থেকে নিয়েন্ডারথালের অবলুপ্তির একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায়না যে, দুটি গোষ্ঠীর মিলনের প্রক্রিয়ায় ক্রমাগত নিয়েন্ডারথালদের সংখ্যা কমেছে এবং একসময় তারা অবলুপ্ত হয়েছে। অবশ্যই এটা সম্ভব যে, অন্যান্য ফ্যাক্টরও তাদের অবলুপ্তিকে ত্বরান্বিত করেছে।

ফলে এটা আমরা বলতে পারি যে, বিবর্তনের পথে আধুনিক মানুষ কোনও এক সময় আফ্রিকার বাইরে এসেছে এবং অন্যান্য মানব প্রজাতির সাথে সংযোগ ঘটেছে। এই সংযোগের প্রক্রিয়ার একটা সম্ভাবনা হল, সেইসব মানব গোষ্ঠীকে আধুনিক মানুষ নিজেদের মধ্যে অঙ্গীভূত করে নিয়েছে। আর কী হয়েছে, সেই বিষয়টা পরে আলোচনা করছি।

প্রসঙ্গক্রমে আর একটা প্রশ্ন আলোচনা করে নিতে চাই - হোমো স্যাপিয়েন্স, নিয়েন্ডারথাল ও ডেনিসোভানরা কি পৃথক প্রজাতি?

আমরা জানি, ভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য কোনও প্রজাতির দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে যদি দীর্ঘদিন যৌন সম্পর্ক না থাকে, তবে বিবর্তনের মাধ্যমে ওরা আলাদা প্রজাতি হয়ে যেতে পারে। এটা নির্ভর করে সময়ের উপরে। বহু প্রজন্মের বিছিন্নতার ফলে কিছু শারীরিক ও জিনগত পার্থক্য দেখা দেয়। সেই পার্থক্য বেশি হয়ে গেলে দুটি শাখার স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে যৌন মিলন অসম্ভব হয়ে পড়ে বা যৌন মিলন হলেও সেই মিলনের ফলে বংশরক্ষা করার মতো সন্তান হয় না। আধুনিক মানুষ, নিয়েন্ডারথাল ও ডেনিসোভানদের মধ্যে শুধু যৌন মিলন হত তাই নয়, তার ফলে জন্ম নিত স্বাভাবিক ও যৌন মিলনে সক্ষম অপত্য শিশু। তাই আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, এরা প্রজাতি হিসাবে পৃথক হওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকলেও পৃথক প্রজাতিতে ভাগ হয়ে যায়নি।

এখন প্রশ্ন হল, আধুনিক মানুষের সাথে নিয়ান্ডারথাল ও ডেনিসোভানদের মিলন হল কখন, কোথায় ও কীভাবে? এই তিন ধরনের মানুষের জেনেটিক মেটিরিয়াল বিশ্লেষণ করে অনুমান করা যায় যে, আফ্রিকাই আধুনিক মানুষের উৎস এবং পরবর্তীতকালে তারা দফায় দফায় পৃথিবীর অন্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ছড়িয়ে পড়ার সময় সম্ভবত আরব ভূখণ্ডে বা দক্ষিণ লেভান্তে নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে আধুনিক মানুষের মিলন হয়েছে। অর্থাৎ শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে ও তার ফলে বংশপরম্পরায় সন্তানাদি এসেছে। সেটা প্রায় সত্তর হাজার বছর আগেকার কথা। পরবর্তীকালে ওরা বিভক্ত হয়ে যায় বিভিন্ন পথে। এশিয়ার আরও পূর্বদিকের ভূখণ্ডে এই মিলন হলে এশিয়ার সকল মানুষ ওদের জিন বহন করত।

আধুনিক মানুষ ইরান হয়ে সিন্ধু নদী পার হয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে আসার পরে তার থেকে ছোট একদল মানুষ আবার চলে গেছে সুন্দারল্যান্ডের দিকে। সেখান থেকে মেলানেশিয়াতে গিয়ে সম্ভবত ওদের মিলন হয়েছে ডেনিসোভানদের সঙ্গে। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ফিজি, পাপুয়া নিউগিনি, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ ও ভানুয়াতু দ্বীপ নিয়ে হল মেলানেশিয়া। তাই পাপুয়া-নিউগিনি ও অস্ট্রেলিয়ার আদি অধিবাসীদের মধ্যে ডেনিসোভানদের জিন সর্বাধিক পরিমাণে (5 শতাংশ) পাওয়া যায়। সম্ভবত সংখ্যায় ওরা কম ছিল, তাই ওদের জীবাশ্ম বিশেষ পাওয়া যায়নি। তবে ওরা ছড়িয়ে ছিল এশিয়া জুড়ে।

আধুনিক মানুষ ও তার ঘনিষ্ঠ মানবগোষ্ঠীদের পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন ছিল

আধুনিক মানুষের সাথে নিয়েন্ডারথাল মানবগোষ্ঠীর সাদৃশ্য অনেক,আবার পার্থক্যও কম নয়। যেমন এই দুই ধরনের মানবগোষ্ঠীর মস্তিষ্কের আয়তন অন্যান্য মানব প্রজাতির তুলনায় অনেক বেশি। এই দুই মানবগোষ্ঠীর মস্তিষ্কের আয়তন প্রায় সমান, নিয়েন্ডারথালদের সামান্য বেশি। কিন্তু মস্তিষ্কের গঠনে পার্থক্য আছে। দুই ধরনের মানুষেরই সেরিব্রাম বড়। সেরিব্রামের অনেক কাজের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল, দেহের পেশির চলাফেরার সূচনা ও সমন্বয় করা। নিয়েন্ডারথালদের দেহ আধুনিক মানুষের থেকে অনেকটা চওড়া ও বড়সড় ছিল। তাই তাদের অধিক পেশির নিয়ন্ত্রণের জন্য মস্তিষ্কের সেরিব্রামের আয়তন তুলনামূলকভাবে বড় হওয়া প্রয়োজন ছিল।

সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে যে, জ্ঞানীয় নমনীয়তা (cognitive flexibility), মনোযোগ, ভাষা প্রক্রিয়াকরণ, কার্যকরী স্মৃতিশক্তির ক্ষমতা, ইত্যাদি দক্ষতাগুলি সেরিবেলামের আয়তন বাড়ার সঙ্গে তাল রেখে বাড়ে। সেরিবেলামের হেমিস্ফিয়ারগুলি স্মৃতিসংক্রান্ত নিউরাল মডিউলগুলির সাথে সম্পর্কিত। তাই বড় সেরিবেলাম জ্ঞানীয় তথ্য প্রক্রিয়াকরণের জন্য অধিক ক্ষমতা ধারণ করতে পারে। আধুনিক মানুষের সেরিবেলাম নিয়েন্ডারথালের থেকে তুলনামূলকভাবে বৃহত্তর ছিল। সেরিবেলামের পার্থক্য দুই ধরনের মানব গোষ্ঠীর মধ্যে জ্ঞানীয় ও সামাজিক ক্ষমতার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যের কারণ হতে পারে এবং প্রাথমিকভাবে হোমো স্যাপিয়েন্সের দ্বারা নিয়েন্ডারথালদের প্রতিস্থাপনে ভূমিকা থাকতে পারে।

ভাষার ব্যবহার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। স্পষ্টভাবে কথা বলার জন্য প্রয়োজন স্বরযন্ত্রের ও মুখগহ্বরের বিকাশ ও সূক্ষ্ম নিয়ন্ত্রণ। বিবর্তনের পথে এই বিকাশের ফলেই আধুনিক মানুষ কথা বলতে শিখেছিল। এখন প্রশ্ন হল, কোনও জিনের বিবর্তনের ফলে কি আধুনিক মানুষ কথা বলতে শিখেছিল? 2002 সালে এঁবাদ, পেবো এবং তাঁর সহকর্মীরা মনে করেছিলেন FOXP2 জিন মানুষের ভাষা ও কথা বলার মুখ্য বিবর্তনীয় কারণ। আধুনিক মানুষ যে অন্যান্যদের তুলনায় কথা বলার ক্ষেত্রে এগিয়ে গিয়েছিল, তার পিছনের কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ওঁদের গবেষণায় এই জিনটির দুটি মিউটেশনকে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীকালে ওই জিনে পঞ্চাশ হাজার বছর আগের আরও একটি মিউটেশনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। উপকারী এই মিউটেশন স্বাভাবিক নিয়মেই দ্রুত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য একেবারে সাম্প্রতিককালে নতুন গবেষণায় ব্যপারটা এত সহজ সরল বলে মনে করা হচ্ছে না। তবুও এই জিন যে ভাষার বিকাশের সঙ্গে জড়িত রয়েছে, সেরকম দিকনির্দেশ রয়েছে।

একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, ভাষা খুবই জটিল এক বিবর্তনের ফসল। FOXP2 জিন ইত্যাদি হয়তো এই বিরাট ধাঁধায় একটি খণ্ডচিত্র মাত্র। অধুনালুপ্ত বিভিন্ন মানব প্রজাতির প্রাচীন ডিএনএ থেকে পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্সিং করে তাদের সাথে আধুনিক মানুষের তুলনা করলে হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।

এখন প্রশ্ন হল, নিয়েন্ডারথালরা কি কথা বলতে পারত? এর উত্তর পাওয়া সহজ নয়। তবে ওদের আচরণে যে সামাজিকতার বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়, (যেমন ওরা জামাকাপড় পরত, গলায় মালা ঝুলিয়ে নিজের দিকে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করত, ঈগলের নখ দিয়ে শিল্প তৈরি করত, হাতিয়ার ব্যবহার করত ইত্যাদি), তা থেকে মনে হয় ওদের নিজেদের মধ্যে ভাবনার আদানপ্রদান হত। হয়তো ওরাও জটিল কণ্ঠস্বর নির্গত করতে ও অনুধাবন করতে পারত। হয়তো তার সঙ্গে ব্যবহার করত কোনও ইশারা-ভাষা।

তবে আধুনিক মানুষ সেরিবেলামের নানা দক্ষতায় নিয়েন্ডারথালদের থেকে এগিয়ে ছিল। স্বরযন্ত্রের অভিযোজনের ফলে, স্বরযন্ত্র ও মুখগহ্বরের বিকাশ ও সূক্ষ্ম নিয়ন্ত্রণের ফলে স্বরক্ষেপন করতে পারত অধিক অনায়াসে।

শারীরিক এই পরিবর্তনগুলি একত্রিতভাবে আধুনিক মানুষকে সাংস্কৃতিক বিকাশে সাহায্য করেছিল। যদিও নিয়েন্ডারথাল ও আধুনিক মানুষের মস্তিষ্কের মোট আয়তন তুলনামূলক ভাবে সমান ছিল, তবুও জ্ঞানীয় ক্রিয়াতে নিয়েন্ডরথাল ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে। অপরদিকে আধুনিক মানুষ প্রযুক্তির উন্নতি করতে পেরেছে। অন্যদের থেকে উন্নত হাতিয়ার তৈরি করতে পেরেছে। আর সেই উন্নতি সম্ভবত হয়েছে এক লক্ষ বছর আগে আফ্রিকাতে।

সত্তর হাজার বছর আগে, আফ্রিকা থেকে অন্যান্য মহাদেশে মহাপরিযান শুরু করার পরে আধুনিক মানুষ নিঃসন্দেহে অনেকগুলি মানব গোষ্ঠীর মুখোমুখি হয়েছে। খাদ্যের জন্য, বাসস্থানের জন্য তাদের মধ্যে চরম প্রতিযোগিতা হয়েছে। আধুনিক মানুষের কোনও এক গোষ্ঠী যে সময়ে তার প্রতিবেশী এক নিয়েন্ডারথাল গোষ্ঠীর সঙ্গে মরণপণ লড়াই করেছে, ঠিক তখনই হয়তো ওদের অন্য কোনও গোষ্ঠী আরেকটি নিয়েন্ডারথাল গোষ্ঠীর সঙ্গে তুলনামূলকভাবে সহযোগিতা করেছে। নিয়েন্ডারথালদের সঙ্গে আধুনিক মানুষের যৌন সম্পর্ক হয়েছে, তবে সেটা সবসময় সহযোগিতামূলক নাও হতে পারে। হয়তো কখনো দুই গোষ্ঠীর মধ্যে নর-নারীর স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে, কখনো বা নারীদের লুট করা হয়েছে। আধুনিক মানুষ ও নিয়েন্ডারথাল — এরা উভয়ই ডেনিসোভানদের সঙ্গেও মিশ্রিত হয়েছে। ভৌগোলিকভাবে কেবল নয়, সামাজিকভাবে কিছুটা কাছাকাছি না আসলে এই সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয়; সেই সামাজিক সম্পর্ক শত্রুতামূলক হোক বা বন্ধুত্বের হোক। জেনেটিক উপাদান থেকে মনে হয় যে, আধুনিক মানুষ, নিয়েন্ডারথাল ও ডেনিসোভানরা কাছাকাছি এসেছিল।

আধুনিক মানুষ ও তার দুই ঘনিষ্ঠ মানবগোষ্ঠীর আচরণগত পরিবর্তনও লক্ষনীয়। ডেনিসোভানদের ব্যাপারে এই বিষয়ে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। সেই তুলনায় নিয়েন্ডারথালদের সম্পর্কে অনেককিছু জানা গেছে। তাই এই প্রশ্নে আধুনিক মানুষের সাথে নিয়েন্ডারথালদের তুলনামূলক আলোচনা কিছুটা করা যায়। আফ্রিকার শিবুদু গুহায় 61 হাজার বছর আগের যে প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু পাওয়া গেছে তার থেকে বোঝা যায় যে, ওই সময়ে আধুনিক মানুষ সেলাই করতে, ধারালো ফলক লাগানো বর্শা নিক্ষেপ করতে, হারপুন, তীর ও ধনুক তৈরি করে শিকার করতে জানত। সেই সময় থেকে নিয়েন্ডারথালদের সঙ্গে আধুনিক মানুষের জীবনযাত্রায় ক্রমবিস্তারমান ব্যবধান এসে যায়।

হাতিয়ারের ক্রমোন্নতি আধুনিক মানুষের খাদ্য শিকারে সহায়ক হল। সম্ভবত তার কিছু সময় উদ্বৃত্ত হল। সে রঙের ব্যবহার করে খুব সুন্দর ছবি আঁকতে শিখল।

65 হাজার বছর আগে ভেলায় চড়ে আধুনিক মানুষ পৌঁছে গেছে অস্ট্রেলিয়াতে। কিন্তু নিয়েন্ডারথালরা ভেলা বানাতে পারেনি। সমুদ্র পার হয়ে ওরা ইউরোপ ছেড়ে অন্য ভূখণ্ডে যেতে পারেনি। ওদের বাসভূমি ক্রমাগত সংকুচিত হয়েছে।

তাই এই সিদ্ধান্তে আসা কঠিন যে, একমাত্র শত্রুতার মনোভাবের জন্য আধুনিক মানুষের হাতে অন্যান্য মানবগোষ্ঠীগুলি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সম্ভবত খাদ্য, বাসস্থানের প্রতিযোগিতায় অন্যান্য কিছু মানবগোষ্ঠী হেরে গিয়েছিল। সংখ্যায় কমে গিয়েছিল। শেষে একসময় ওরা লুপ্ত হয়ে গেছে। আধুনিক মানুষ কিছু সংখ্যক নিয়েন্ডারথালদের নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করে নিয়েছে, বিলীন করে দিয়েছে। তাই নিয়েন্ডারথালরা সামান্য পরিমাণে আজও বেঁচে আছে আধুনিক মানুষের জিনোম প্রোফাইলে।

তবে এখনও অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে। মনে রাখতে হবে মাত্র কয়েক দশক আগে জিনবিদ্যা ও অন্যান্য অতি আধুনিক বিজ্ঞান চর্চা শুরু হয়েছে। মানব প্রজাতির উত্তরণের বিজ্ঞানভিত্তিক সময়কাল ও অন্তর্নিহিত কারণ নির্ণয়ের জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।

সবানতে পেবোর গবেষণা ও বিশুদ্ধ জাতির ধারণা

আজকের ভারতবর্ষে খাঁটি আর্য রক্তের পক্ষে প্রচার চলছে জোরকদমে। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের নানা ধর্মীয় গোষ্ঠী তো করছেই, এমনকী কেন্দ্রীয় সরকার বিশুদ্ধ আর্য রক্তের অন্বেষণে গবেষণায় উৎসাহ দিচ্ছে। কিন্তু সত্যিই বিশুদ্ধ কোনও জাতির (race) অস্তিত্ব আছে কি?সবানতে পেবোর গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, বিশুদ্ধ জাতি বলে কিছু হতে পারে না। যারা এনিয়ে আস্ফালন করছেন, তাদের দেহেও আছে আফ্রিকার শিকারী-সংগ্রাহক ও প্রাচীন ইরানীয় শিকারী- সংগ্রাহকের জিন। আছে ইন্দো-ইউরোপীয় রক্ত। জিনবিদ্যার তাবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে সেটাই পাওয়া গেছে।

একমাত্র আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ওঙ্গে ও জারোয়া বা অস্ট্রেলিয়ার আদি অধিবাসীরা হল ব্যতিক্রম। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের সেই আদি অধিবাসীরা সভ্যতার আদিম স্তরে রয়ে গেছে। অথচ ওরাও তো আদতে আফ্রিকা থেকে শুরু হওয়া সেই মহা-পরিযানের উত্তরসূরি।

এর কারণ আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের আদি অধিবাসীরা দীর্ঘদিন থেকেছে সম্পূর্ণ নির্জনে। ভারতের বিভিন্ন সভ্যতার উত্থান-পতন হয়েছে, বিভিন্ন সময়কালে দলেদলে মানুষ এসেছে, মিশেছে, নিজেদের মধ্যে আদানপ্রদান করেছে এবং সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু ওরা থেকে গেছে পর্দার আড়ালে। এই কিছুদিন আগে 1789 সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ওই দ্বীপপুঞ্জ রিদর্শন করে। তখনই সভ্য মানুষ ওদের কথা জেনেছে। ওদের সঙ্গে অন্যদের মেলামেশা হয়নি, মিশ্রণ হয়নি, জ্ঞানের আদানপ্রদান হয়নি।

অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। আন্দামানের আদিম অধিবাসীদের মতো ওরাও ইতিহাসের বিচিত্র গতিতে চলে গেছে পৃথিবীর হৃৎপিণ্ড থেকে দূরে, বহু দূরে। অস্ট্রেলিয়াতে প্রথম মানুষ গেছে 65 হাজার বছর আগে। তারপরে সকলে ওদের ভুলে গেছে। কিছুদিন আগে 1770 সালে জেমস কুক পূর্ব অস্ট্রেলিয়া পরিভ্রমণ করেন। তখন বিশ্ববাসী জানতে পারে ওদের কথা।

যারা সভ্যতার অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে, তাদের বিশুদ্ধতা রক্ষা করার কোনও উপায় নেই। এটা কারোর মস্তিষ্কপ্রসূত ধারণা নয়, জিনবিদ্যার সাম্প্রতিকতম গবেষণালব্ধ ফল।

রোগনির্ণয়ে সবানতে পেবোর গবেষণার অবদান

সবানতে পেবো তাঁর গবেষণার মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন যে, আধুনিক মানুষ ও নিয়েন্ডারথালের মধ্যে সংমিশ্রণ আধুনিক মানুষের শরীরে সূক্ষ্ম, কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। আমেরিকার নয়টি হাসপাতাল নিয়ে গঠিত সহায়-সংঘ (consortium) দ্বারা গঠিত Electronic Medical Records and Genomics (eMERGE) এর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই এই গবেষণা সম্ভব হয়েছে। ইউরোপে বসবাসকারীদের উত্তরসূরি 28000 রোগীর মেডিকেল ও জেনোমিক তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। প্রত্যেক রোগী যে, জেনেটিক ভ্যারিয়েন্ট বহন করছে তার উপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত গবেষকরা এমন 12টি ঝুঁকিপূর্ণ বৈশিষ্ট চিহ্নিত করেন যা নিয়েন্ডারথাল জেনেটিক ভ্যারিয়েন্ট-এর সাথে যুক্ত। তারমধ্যে রয়েছে হার্ট এটাক ও ধমনীর দেওয়াল মোটা হয়ে যাওয়ার সমস্যা। এমনও হতে পারে যে, কিছু নিয়েন্ডারথাল জেনেটিক ভ্যারিয়েন্ট আধুনিক মানুষের জন্য উপকারী হতে পারে, কারণ তারা আফ্রিকার বাইরে প্রথম এসেছিল। সেই একই ভ্যারিয়েন্ট পরবর্তীকালে পাশ্চাত্যের আধুনিক পরিবেশে ক্ষতিকারক হয়ে পড়েছে।

একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। নিয়েন্ডারথাল ডিএনএ-র একটা ভ্যারিয়েন্ট-এর কথা বলা যায় যা রক্ত দ্রুত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। শরীরের কেটে যাওয়া জায়গায় রক্ত দ্রুত জমাট বাঁধার ফলে শরীরে রোগজীবাণু প্রবেশ করতে পারেনা। প্রথম দিকে যখন নিয়েন্ডারথাল ও আধুনিক মানুষ শিকার করে খাদ্য সংগ্রহ করত তখন এই বৈশিষ্ট্য খুবই সাহায্য করেছে। আধুনিক মানুষ কৃষি আবিষ্কারের পরে এই ধরনের ক্ষত সৃষ্টির সম্ভাবনা কমেছে এবং প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র বেরিয়েছে। রক্ত দ্রুত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে যে জেনেটিক ভ্যারিয়েন্ট, তা ও আর উপকারী থাকলো না। বরং স্ট্রোক প্রভৃতি রোগের ক্ষেত্রে ঝুঁকির সম্ভাবনা বেড়ে গেল। অতি সম্প্রতি জেবার্গ ও পেবো আধুনিক মানুষের ক্রোমোজোম 3-এ এমন একটি জেনোমিক না সেগমেন্ট চিহ্নিত করেছেন যা করোনা রোগীর জীবন বিপন্ন করতে পারে। তারা দেখিয়েছেন যে, এই জেনেটিক সেগমেন্ট এসেছে নিয়েন্ডারথাল থেকে। এশিয়ার 50 শতাংশ এবং ইউরোপের 16 শতাংশ মানুষ এই সেগমেন্ট বহন করে চলেছে।

সবানতে পেবোর গবেষণা নিঃসন্দেহে মানব-ইতিহাস গবেষণায় একটা নতুন দিক উন্মোচন করেছে। আগামীদিনে এই পদ্ধতি অনুসরণ করে আরও গবেষণা হবে, নতুন নতুন মানব-ফসিলের আবিষ্কার এই গবেষণার বিষয়বস্তু যোগান দেবে। যেসব প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত আছে তার উপর আলোকপাত হবে। আমরা আরও নিশ্চিৎভাবে জানতে পারব মানুষের উদ্ভবের ইতিহাস, অন্যান্য মানবগোষ্ঠীর সঙ্গে আধুনিক মানুষের আদানপ্রদানের ইতিহাস। নোবেল কমিটিকে ধন্যবাদ, প্রচলিত প্রথার বাইরে গিয়ে ফিজিওলজি এন্ড মেডিসিনের পুরস্কার এমন একজনকে দেওয়ার জন্য, যিনি শারীরবিদ্যায় বা ওষধিবিদ্যায় প্রত্যক্ষ কোনও অবদান রাখেননি, কিন্তু যার গবেষণা এইসব বিষয়ে প্রভূত উন্নতির দরজা খুলে দিল।

লেখক পরিচিতি: শ্রী গৌড়ী একজন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক এবং ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির সর্ব-ভারতীয় কমিটির সহ-সভাপতি।

তথ্যসূত্র:

[1] বিবর্তন যুগে যুগে - ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি (2009)

[2] And as We Moved, We Embraced, and We Absorbed - Partha Pratim Majumder,RESONANCE, January,2023

[3] প্রাগিতিহাস: ভারতবর্ষে পরিযান ও জাতিগোষ্ঠী গঠন - মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়, গাংচিল

[4] The Origin of the Human Race _ V P Alexeev, Progress Publishers, Moscow.

[5] Man makes Himself - V. Gordon Childe, Watts & Co., London.

[6] মানুষের উদ্ভব ও বিবর্তন - অনিশ রায়, পথিকৃৎ, ফেব্রুয়ারি 2023