বিভাগগুলি

সত্যিই কি ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন ভারতে গবেষণার উপকার করবে?

Photo by Matthew Henry from Burst

সম্পাদকীয়, প্রকৃতি

ইতিমধ্যেই আপনার জেনেছেন যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা জাতীয় শিক্ষা নীতি (NEP)-2020-এর সুপারিশ অনুসারে ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন (NRF) বিল, 2023 লোকসভার অনুমোদনের জন্য পেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখনও পর্যন্ত গবেষণার ক্ষেত্রে অনেকগুলি সরকারি অনুদান সংস্থা রয়েছে, যেমন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ (DST), পারমাণবিক শক্তি বিভাগ (DAE), বায়ো-টেকনোলজি বিভাগ (DBT), ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচার রিসার্চ (ICAR), ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ (ICMR), ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টরিক্যাল রিসার্চ (ICHR), বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (UGC), ইত্যাদি, যেগুলি তাদের নিজস্ব ক্ষেত্রে গবেষণায় আর্থিক সাহায্য দিত। এছাড়া বিভিন্ন কেন্দ্রীয় মন্ত্রকও তাদের নিজস্ব ক্ষেত্রে গবেষণা-খাতে খরচ করত। এখন থেকে NRF হবে গবেষণাক্ষেত্রে আর্থিক অনুদানের প্রধান উৎস। বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষণা বোর্ড (SERB)-এর অস্তিত্ব থাকবে না এবং NRF-এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। যদিও DST, CSIR, DAE, ইত্যাদি সংস্থাগুলি তাদের অধীনস্থ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলিকে তহবিল দেওয়া অব্যাহত রাখবে, এখন থেকে NRFই বিজ্ঞানীদের নিজস্ব গবেষণা-প্রস্তাবগুলির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং অর্থ সাহায্য করার প্রাথমিক সংস্থা হয়ে উঠবে।

NRF গবেষণার ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তার সার্বিক কেন্দ্রীকরণের একটি পরিকল্পনা। এতদিন একজন গবেষকের গবেষণা প্রস্তাব নানা সংস্থার কাছে পেশ করা যেতো। একটি সংস্থা প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করলে, অন্য সংস্থাগুলির কোনও একটির থেকে আর্থিক অনুদান পাওয়ার সুযোগ ছিল। গবেষণা তহবিলের কেন্দ্রীকরণ হলে সেই সম্ভাবনা থাকবে না।

বেশিরভাগ অনুদান-সংস্থাই কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করে, এবং সেই চিহ্নিত ক্ষেত্রগুলির মধ্যে আসা গবেষণা প্রস্তাবগুলির আর্থিক অনুদান পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এই প্রক্রিয়ায় মানুষের কৌতুহল-প্রসূত মৌলিক গবেষণা—যার সাফল্য আগে থেকে অনুমান করা যায় না—আর্থিক অনুদান পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকত। কিন্তু তবুও, বেশ কয়েকটি সংস্থা থাকার কারণে গবেষণার জন্য আর্থিক অনুদান পাওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে বেশি হতো, কারণ প্রত্যেকটি সংস্থারই চিহ্নিত ক্ষেত্রের তালিকা ভিন্ন। কিন্তু গবেষণাক্ষেত্রে আর্থিক অনুদানের জন্য যদি একটিমাত্র সংস্থা থাকে, সেক্ষেত্রে অনুদান পাওয়ার সুযোগ খুব সীমিত হয়ে যাবে। সমাজ বিজ্ঞান এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের যে ক্ষেত্রগুলিতে গবেষণার ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যে শিল্পক্ষেত্রে কোনও মুনাফার সুযোগ নেই, সেগুলি নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

একটি সংবাদ সম্মেলনে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিভাগের মন্ত্রী শ্রী জিতেন্দ্র সিং ইঙ্গিত দিয়েছেন যে আগামী পাঁচ বছরে (2023-28) NRF বাবদ 50,000 কোটি টাকা খরচ করা হবে। প্রাথমিকভাবে, এই পরিমাণ অর্থ প্রচুর বলে মনে হতে পারে। কিন্তু লক্ষ্য করুন, এটি গবেষণার জন্য পরিকল্পিত সরকারি ব্যয় নয়। সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী আরও জানান যে, বেসরকারি খাত থেকে 36,000 কোটি টাকা আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। অর্থাৎ পাঁচ বছরে সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ 14,000 কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রতি বছর প্রায় 2,800 কোটি টাকা। ভারতে পরিচালিত গবেষণার পরিমাণ সম্পর্কে যাদের কিছু ধারণা আছে তারা জানেন যে এই পরিমাণ আর্থিক বরাদ্দ গবেষণাক্ষেত্রে অতি নগণ্য স্তর বজায় রাখার জন্যও অপর্যাপ্ত।

এই প্রসঙ্গে স্মরণ করাতে চাই যে, 2022-23 আর্থিক বছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের জন্য বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছিল 16,361 কোটি, যার মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ (DST) পেয়েছিল 7931.05 কোটি, বায়োটেকনোলজি বিভাগ (DBT) পেয়েছিল 2683.86 কোটি, এবং বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা বিভাগ (DSIR) পেয়েছিল 5746.51 কোটি। লক্ষ্য করুন, সবকটা সংস্থার অর্থবরাদ্দই NRF-বাবদ প্রস্তাবিত সরকারি বার্ষিক ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি।

আমেরিকা এবং ইউরোপের উন্নত দেশগুলির তুলনায় ভারতে বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য বেসরকারি আর্থিক অনুদান নগণ্য, যদিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসকরা এবিষয়ে যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। কিছু প্রশংসনীয় ব্যতিক্রম বাদ দিলে, সাধারণভাবে ভারতীয় শিল্পপতিদের মধ্যে গবেষণায় খরচ করার জন্য প্রয়োজনীয় দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গির অভাব রয়েছে, যেসব গবেষণাপ্রসূত জ্ঞান শিল্পক্ষেত্রে প্রযুক্ত হতে কয়েক দশক লেগে যেতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে, সরকারের চেয়ে কর্পোরেট সেক্টর বেশি অর্থ দেবে — এটা অলীক স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। বাস্তবে যা ঘটবে তা হল, এই ব্যবস্থায় গবেষণাকে কার্যকরভাবে উৎসাহিত করার জন্য অর্থ সংস্থানের অভাব ঘটবে। শিল্পক্ষেত্র থেকে যে অল্প পরিমাণ অনুদান আসবে তা শুধুমাত্র স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্যের গবেষণাকেই সাহায্য করবে এবং পুরো NRF-এর লক্ষ্য সেদিকেই চলে যেতে পারে।

NRF-এর পরিচালনা ব্যবস্থাটি কী হবে? NEP-2020 (অনুচ্ছেদ 17.10) প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে "NRF পরিচালিত হবে সরকারের থেকে স্বাধীনভাবে, বিভিন্ন ক্ষেত্রের সেরা গবেষক এবং উদ্ভাবকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বোর্ড অফ গভর্নর দ্বারা।" কিন্তু কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে NRF-এর গভর্নিং বোর্ডের সভাপতিত্ব করবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী পদাধিকারবলে সহ-সভাপতি হবেন। এমনকি কার্যনির্বাহী কমিটি, যেটি NRF-এর দৈনন্দিন কার্য পরিচালনা করবে, তারও নেতৃত্বে থাকবে একজন সরকার-নিযুক্ত ব্যক্তি (প্রধান বিজ্ঞান উপদেষ্টা)। অর্থাৎ NRFকে সরকারের থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার কোনও পরিকল্পনাই নেই।

সরকারী প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যে NRF-এর উদ্দেশ্য হল দেশের বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য "উচ্চ-স্তরের কৌশলগত দিকনির্দেশ" করা। আমরা দেখেছি যে, গত কয়েক বছর ধরে, সরকারের কৌশলগত দিকনির্দেশ পঞ্চগব্যের মতো বিশ্বাস-ভিত্তিক ধারণা এবং তথাকথিত 'ভারতীয় জ্ঞান ব্যবস্থা'-তে গবেষণার দিকেই গেছে। হাজার হাজার বছর আগের বিমানের অস্তিত্ব, ইন্টারনেট, টেলিভিশন, স্টেম সেল গবেষণা, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং প্লাস্টিক সার্জারির অস্তিত্ব ইত্যাদি যা সরকারি মন্ত্রী বা পদাধিকারীরা দাবি করছেন, সেই রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্বে বিজ্ঞান গবেষণার ভবিষ্যত দিকনির্দেশের বিষয়টি বিজ্ঞানীদের সন্দিগ্ধ করে তুলেছে।

বর্তমান গবেষণা-সহায়তা ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করার এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সমস্ত বিজ্ঞানী, গবেষক, ছাত্র ছাত্রী এবং বিজ্ঞান অনুরাগী সমস্ত মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদ প্রয়োজন এবং দাবি উঠুক গবেষণার জন্য সরকারি আর্থিক সহায়তা দেশের জিডিপি (GDP)’র কমপক্ষে 3% করতে হবে।

“সত্যিই কি ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন ভারতে গবেষণার উপকার করবে?” এই প্রতিবেদনটি ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি প্রকাশিত ‘প্রকৃতি’ পত্রিকার ষোড়শ বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা, আগস্ট 2023 থেকে নেওয়া।