বিভাগগুলি

বিজ্ঞান গবেষণা সংকটগ্রস্ত

Image: By John Shore for March for Science


প্রদীপ কুমার দত্ত

গত 22 এপ্রিল, 2017 বসুন্ধরা দিবসে গবেষণাগার ও বিজ্ঞানের ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্বের ৫০০ টিরও বেশি শহরে মিছিল করলেন বিজ্ঞানীরা। 6 টি মহাদেশের প্রায় 100 টি দেশে বিজ্ঞানকে রক্ষার ডাকে বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও বিজ্ঞানপ্রেমী মানুষ এই মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। শুরু হয় নিউজিল্যান্ড, তারপর অস্ট্রেলিয়ায়। মূল মিছিলটি হয় ওয়াশিংটনে। ইংল্যান্ড, স্পেন, জার্মানি, জাপান, কানাডা, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি বিভিন্ন দেশেও এই মিছিল হয়। ওয়াশিংটনে 15 হাজার, লস এঞ্জেলসে 12 হাজার, শিকাগোতে 4 হাজার, বার্লিনে 10 হাজার মানুষ এই কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন।

মিছিলের সংগঠকরা মূল উদ্দেশ্য হিসাবে ঘোষণা করেন, আমরা মানুষের জন্য বিজ্ঞানকে তুলে ধরার আহ্বান নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি এবং নীতি-প্রণেতা ও রাষ্ট্রনেতাদের কাছে জনস্বার্থ তথ্যপ্রমাণের ওপর নির্ভরশীল বিজ্ঞানভিত্তিক নীতি প্রণয়ন করার আহ্বান জানাচ্ছি। কর্মসূচীতে অংশগ্রহণকারীরা শপথ নেন- যাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে তাঁদের হয়ে বলার, যাদের ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে তাঁদের অভয় দেওয়ার এবং যারা হতাশ হয়ে পড়েছেন ওঁদের সহযোগিতা করার, বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের পাশে দাঁড়ানোর শপথ নিচ্ছি আমরা। সংগঠকরা কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা রাজনৈতিক দল দ্বারা পরিচালিত না হয়েও এই আন্দোলনকে একটা রাজনৈতিক আন্দোলন বলেই ঘোষণা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, বিজ্ঞান যখন জানায় আপনার জল দূষিত, সেই তথ্যটিই যথেষ্ট নয়। এই দূষণ কেন তা জানা এবং এই দূষণ দূর করার দায়িত্ব প্রশাসন ও পুরসভার। কিন্তু তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজনীতি। তাই রাজনীতি বাঁচিয়ে বিজ্ঞান গবেষণা ও তার ব্যবহার অর্থহীন। তাঁরা আরও ঘোষণা করেছেন যে যখনই কোনও প্রতিষ্ঠান অন্যায় পক্ষপাতিত্ব, অবহেলা, বিজ্ঞানের অপব্যবহার এবং বিজ্ঞানচর্চায় অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ করবে, আমরা তার প্রতিবাদ করব।

মিছিলের সংগঠকরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, সারা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের নানা ধারণাকে রাষ্ট্রনায়করা অস্বীকার করছেন। নানা অবৈজ্ঞানিক ও আস্ত ধারণা প্রচার ও সমর্থন করছেন, এবং বিজ্ঞান গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ অনেক দেশই কমাচ্ছে। তাঁদের মতে বিজ্ঞান এখন এক সংকটের মুখে। তার মোকাবিলাতেই তাঁরা একত্রিত হয়েছেন। গবেষণাগার থেকে বেরিয়ে পথে নেমেছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এমনও বলেছেন, বিজ্ঞানকে পুঁজিবাদের গ্রাস থেকে মুক্ত করতেই তাঁদের এই পথে নামা।

বিশ্বের বিজ্ঞানীদের এই উদ্যোগ ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক কারণ এদেশেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নানা রকম অন্ধতা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, বিজ্ঞানমনস্ততা ধ্বংসের চেষ্টা চলছে, নানা ভ্রান্ত ও চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণা এদেশের রাষ্ট্রনায়করা প্রচার করছেন, সরকার বিজ্ঞান গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ কমাচ্ছে। আশার কথা এ দেশেও এ নিয়ে প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে। হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী রজত ট্যান্ডন সহ দেশের একশোরও বেশি প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান একটি বিবৃতিতে স্বাক্ষর করে বলেছেন, দেশে যেভাবে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদকে ধ্বংস করা হচ্ছে তা বাস্তবিকই বিপদজনক। এই বিবৃতিতে তাঁরা তিনজন প্রখ্যাত যুক্তিবাদী মানুষ, যাঁরা কুসংস্কার ও অন্ধতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তা প্রসারে তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁদের হত্যার কথাও উল্লেখ করেছেন। এ নিয়ে তাঁরা সরকারের নীরব সমর্থনও লক্ষ্য করেছেন। এরপর 2015 সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের তিনটি পৃথক দল এইসব ঘটনার নিন্দা করে এবং এই নৃশংসতায় সরকারের নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদ করে বিবৃতি দিয়েছেন। মোট স্বাক্ষরকারীর সংখ্যা প্রায় এক হাজার। হায়দ্রাবাদের বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর সেলুলার অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত পুষ্প মিত্র ভার্গব বলেছেন, বর্তমান সরকার গণতন্ত্রের পথ থেকে সরে যাচ্ছে, দেশকে নিয়ে যাচ্ছে হিন্দু ধর্মীয় স্বৈরতন্ত্রের পথে। প্রতিবাদে তিনি রাষ্ট্রপতিকে পদ্মভূষণ ফেরত দিয়েছেন। বিজ্ঞানী রজত ট্যান্ডন বলেছেন, আমাদের চারপাশে যা ঘটছে অন্যরা তার প্রতিবাদ করলেও আমরা বিজ্ঞানীরা চুপ করে ছিলাম। এভাবে চুপ করে থাকা মোটেই ঠিক বলে মনে হয় না। ব্যাঙ্গালোর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক শরাথ অনন্তমূর্তি বলেছেন, আমরা যদি চুপ করে থাকি এবং এইসব অবাঞ্ছিত বিষয়গুলির প্রবল প্রতিবাদ না করে চলতে দিই তবে একটি মিথ্যা বারবার বললে তা সত্য বলে মনে হয়। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা উচিৎ।

এবছর জানুয়ারি মাসে তিরুপতিতে অনুষ্ঠিত ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতের বিজ্ঞানীদের আহ্বান করেছেন যাতে 2030 সালের মধ্যে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁরা ভারতকে বিশ্বের প্রথম তিনটি দেশের একটি করে তোলেন। তার জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞান গবেষণায় সরকারি অর্থ বরাব্দ বৃদ্ধি করা। কিন্তু তাঁর তিন বছরের প্রধানমন্ত্রীত্বে বিজ্ঞান গবেষণার জন্য বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ কার্যত বাড়ানো হয়নি। বাস্তবে এক দশকেরও বেশি সময় এর পরিমাণ জিডিপি-র ০.৪ শতাংশে রয়ে গেছে, যদিও তা জিডিপি-র 2 শতাংশ করার কথা একাধিকবার ঘোষণা করা হয়েছে। জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিজ্ঞান-নীতি বিশেষজ্ঞ দীনেশ অ্যাব্রল বলেছেন, ভারতে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দ চিনের ধারে কাছে নেই। চিনে এর পরিমাণ 2 শতাংশ হলেও ভারতে বছরের পর বছর তা জিডিপির 0.9 শতাংশের নিচে আটকে আছে। ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সের রসায়নের অধ্যাপক গৌতম দেসিরাজুও বলেছেন, গত এক দশক ধরে মৌলিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বরাদ্দের পরিমাণ জিডিপি-র 0.9 শতাংশের কাছে রয়েছে, উন্নত দেশগুলিতে যা প্রায় 2 শতাংশ। এটা খুবই কম এবং বাড়ানো দরকার।

এবছরের বাজেটে বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ সামান্য কিছুটা বাড়লেও মুদ্রাস্ফীতি ও অন্যান্য কারণে বাস্তবে তা বাড়েনি। বিজ্ঞানীরা ভারতে মৌলিক গবেষণায় সরকারি সাহায্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। পুনের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর অধিকর্তা কৃষ্ণ গণেশ বলেছেন, ‘এ বছরও অতীতের ধারাই বজায় রাখা হয়েছে যা আরও হতাশাজনক। বিগত কয়েক বছরে মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণায় অর্থবরাদ্দ টাকার অঙ্কে বাড়লেও বাস্তবে অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধির শতকরা পরিমাণ প্রতি বছর কমছে। এটা ভাল নয়।’

বিজ্ঞান গবেষণায় যেসব মন্ত্রক ও বিভাগ প্রধানত নিয়োজিত সেগুলি হল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা মন্ত্রক, পারমাণবিক শক্তি বিভাগ, মহাকাশ বিভাগ ও ভূবিজ্ঞান বিভাগ। এদের মিলিতভাবে বরাদ্দ করা হয়েছে 3,7435 কোটি টাকা। গত বছরে তা ছিল 33467 কোটি টাকা। অর্থাৎ বরাদ্দ বৃদ্ধি মাত্র 11 শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতি 5.6 শতাংশ বাদ দিলে প্রকৃত বরাদ্দ বৃদ্ধি মাত্র 6 শতাংশও নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা মন্ত্রকের তিনটি বিভাগ - বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা বিভাগ, বায়োটেকনোলজি বিভাগ এবং সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ বিভাগ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা বিভাগের বরাদ্দ 4493 কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে 4836 কোটি টাকা। অর্থাৎ বরাব্দ বৃদ্ধি মাত্র 7.6 শতাংশ। বায়োটেকনোলজি বিভাগের বরাদ্দ 22 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে 2,222.11 কোটি টাকা। সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ বিভাগের বরাদ্দ 4062 কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে 4446 কোটি টাকা। মহাকাশ বিভাগের ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ 21 শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে কারণ 2018 সালে দ্বিতীয়বার চন্দ্রাভিযানের পরিকল্পনা করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে মহাকাশ বিভাগ, বায়োটেকনোলজি বিভাগ ও পুনঃনবীকরণযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে বৃদ্ধি মোটামুটি সন্তোষজনক। কিন্তু ভূবিজ্ঞান বিভাগ, যা আবহাওয়ার পরিবর্তন সংক্রান্ত গবেষণায় নিয়োজিত, তাদের বরাদ্দ বেড়ে হয়েছে 1723 কোটি টাকা, এ ক্ষেত্রে বৃদ্ধির পরিমাণ নগণ্য (মাত্র 2.8 শতাংশ)। পারমাণবিক শক্তি বিভাগ পেয়েছে 4,817.27 কোটি টাকা-বৃদ্ধির পরিমাণ 6.6 শতাংশ; মুদ্রাস্ফীতির কথা বিবেচনা করলে বাস্তবে কোনও বৃদ্ধি হয়নি। এতে অসন্তোষ প্রকাশ করে পারমাণবিক শক্তি কমিশনের সদস্য অনিল কাকোদকর বলেছেন, এর ফলে পরমাণু গবেষণা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা মন্ত্রকের ক্ষেত্রে বরাদ্দ 7.7 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে 12,461.2 কোটি টাকা।

মৌলিক বিজ্ঞানের গবেষণায় সরকারি অর্থ বরাদ্দ নিয়ে দেশের বিজ্ঞানী মহল দ্বিধা-বিভক্ত। যেমন নতুন দিল্লির ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী এবং সি এস আই আর-এর প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল কৃষ্ণ যোশীর মনে হয়েছে যে বিভিন্ন বিভাগের বাজেট বরাদ্দ বিভাগগুলির কাজের ফলাফলের ওপর নির্ভর করে করা হয়েছে এবং তা সঠিক ভাবেই করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, মধ্যমানের মৌলিক গবেষণা করা অর্থহীন যদি না তার প্রায়োগিক ও উন্নয়নমূলক ভূমিকা থাকে। আবার অনেকে এর তীব্র বিরোধিতা করেছেন। কৃষ্ণ গণেশ বলেছেন, 'গত 5/10 বছরে দেশে বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, মানব সম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের অধীনে অনেকগুলি আই আই টি, ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউট, এন আই টি এবং আই আই টি স্থাপিত হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রতিভাবান তরুণ বিজ্ঞানীর সংখ্যাও বেড়েছে। 600/700 প্রতিভাবান তারা বিজ্ঞানী দেশে ফিরে এইসব প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেছে। এরা মৌলিক বিজ্ঞানে উন্নত মানের গবেষণা করতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানীর সংখ্যা যত বেড়েছে সেই অনুপাতে গবেষণা খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়েনি, বাজেট বরাদ্দ তাদের স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, 2015- 16 অর্থবর্ষের তুলনায় 2016-17 অর্থবর্ষে আই আই টিগুলির বরাদ্দের পরিমাণ অনেকটা বাড়লেও (4953 কোটি টাকা থেকে 7171 কোটি টাকা), ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ, ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স এবং কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলি, যে সব জায়গায় উন্নত মানের মৌলিক গবেষণা হয় সেগুলির ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ সামান্যই বেড়েছে। বরং ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স, এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চগুলির ক্ষেত্রে বরাদ্দ কমেছে: 2016 সালের 720 কোটি টাকার জায়গায় বর্তমান বছরে হয়েছে 600 কোটি টাকা, যদিও ব্রহ্মপুরে একটি নতুন IISER স্থাপিত হয়েছে। একে তিনি অন্যায় বলে অভিহিত করেছেন। এটি ভারতীয় বিজ্ঞানীদের পক্ষে দুঃখের। তাদের মাথাপিছু বরাদ্দের পরিমাণ বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় খুবই কম। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার জন্য ভারতের মোট বাজেট বরাদ্দ স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও কম। তবুও ভারতীয় বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ভালই করছেন।'

ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সের রসায়নের অধ্যাপক গৌতম দেসিরাজু ইউ জি সির ভূমিকার সমালোচনা করে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অনেক গবেষক আছেন যাদের অবহেলা করা হচ্ছে; বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে অবহেলা করা উচিৎ নয়। আর একটি উদ্বেগের বিষয়, বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণাকে সার্বিকভাবে দেখা হচ্ছে না। অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রেও তা প্রতিফলিত হচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যাকে মানব সম্পদ উন্নয়নের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেখা ঠিক নয়। বিজ্ঞান ও শিক্ষার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং বিজ্ঞানে শিক্ষা ভাল হলে তা উচ্চশিক্ষা ও বিজ্ঞান গবেষণার ভিত্তি হবে। তিনি আরও বলেছেন যে বর্তমান ব্যবস্থা সৃজনশীল প্রতিভাবান গবেষকদের চিহ্নিত করার সহায়ক নয়।

কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ-এর অধীনে দেশে যে ১৪ টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলি সরকারি নীতির কল্যাণে তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন। CSIR-এর প্রধান সংস্থার অধীন গবেষণাগারগুলিকে বলেছেন তাদের খরচ মেটানোর জন্য অন্যত্র খোঁজ করতে। ইতিমধ্যেই CSIR-এর নিদান অনুযায়ী কয়েকজন বিজ্ঞানী মৌলিক গবেষণা ছেড়ে এমন গবেষণায় নিয়োজিত যা থেকে অর্থ উপার্জন করা যায়। 2015 সালে বিজ্ঞান মন্ত্রী হর্ষ বর্ধনের নেতৃত্বে CSIR সিদ্ধান্ত নেয় যে তাদের বাজেটের 50 শতাংশ বাইরে থেকে সংগ্রহ করতে হবে। এ থেকে বোঝা যায় সরকার গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ করা থেকে হাত গুটিয়ে নিতে চাইছে ও সেগুলিকে বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর ফলে মৌলিক গবেষণা ক্ষতিগ্রস্ত হবে যা আদৌ বাঞ্ছনীয় নয়। সেইসঙ্গে IISER-এর পি এইচ ডি করার খরচ বিপুল পরিমাণে বাড়ানো হচ্ছে। অন্যদিকে গবেষকদের স্কলারশিপ কমানো হচ্ছে। মে মাসে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী প্রকাশ জাভেদকরের সভাপতিত্বে একটি সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে IISER-এর ফি বর্তমানে খুবই কম এবং তা প্রতি বছর 10 শতাংশ হারে বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এর ফলে মেধাবী মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত ছাত্রছাত্রীদের গবেষণার পথ রুদ্ধ হবে।

ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার সংকটের কারণ শুধুমাত্র অর্থ বরাদ্দ না বাড়ানো বা হ্রাস করা নয়, বিজ্ঞান গবেষণায় যেটা সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সেই যুক্তিবাদী মননকে নানাভাবে ধ্বংস করার প্রয়াস চালাচ্ছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার। নানা ধরনের ভ্রান্ত এবং চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণা এ দেশের রাষ্ট্রনায়করা প্রচার করছেন। এমন সব বিষয়ে গবেষণার প্রস্তাব করেছেন। যা শাসক দলের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যেমন, আইআইটিগুলিতে পঞ্চগব্যের গুণ খোঁজার কর্মশালা, বা সরস্বতী নদীর খাত খোঁজা। এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সমস্ত পুঁজিবাদী দেশেই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। নবজাগরণের যুগে উদীয়মান পুঁজিপতি শ্রেণী যুক্তিবাদের চর্চায় উৎসাহ দিত। আর আজ পুঁজিবাদের সংকট যত বাড়ছে ততই শাসক শ্রেণী নানাভাবে যুক্তিবাদী মনকে মেরে দিতে চেষ্টা করছে, তাদের মনে অন্ধ কুসংস্কার ঢুকিয়ে দিতে চাইছে যাতে মানুষ তাদের জীবনের সংকটের কারণ যে পুঁজিবাদ তা ধরতে না পারে এবং তা পরিবর্তনের তাগিদ অনুভব না করে। এভাবে পুঁজিবাদের আয়ুষ্কালকে তারা দীর্ঘায়িত করতে সচেষ্ট। তাই লেখার শুরুতে যে মিছিলের উল্লেখ করা হয়েছিল তার সংগঠকদের একাংশ যে বিজ্ঞানকে পুঁজিবাদের গ্রাস থেকে মুক্ত করতে পথে নেমেছেন আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরাও বিজ্ঞানকে রক্ষা করার জন্য গবেষণাগারে আবদ্ধ না থেকে সেই পথে এগিয়ে এসেছেন। গত ৭ আগস্ট, 2017 কলকাতা, বাঙ্গালোর, দিল্লী, মুম্বাই, চেন্নাই সহ দেশের চল্লিশটি শহরের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার প্রথিতযশা বিজ্ঞানী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গবেষক, ছাত্র India March for Science-এ অংশগ্রহণ করেন। বিজ্ঞানের প্রাণসত্তাকে বাঁচানোর দাবিতে এত বড় বড় মিছিল আগে কখনও এদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেনি। মিছিলের উদ্যোগ নেয় ব্রেকছু সায়েন্স সোসাইটি। তাঁরাও বিজ্ঞানকে বাঁচানোর আন্তর্জাতিক উদ্যোগের অংশীদার। তাঁরা দাবি করছেন, জিডিপির অন্তত দশ শতাংশ শিক্ষাক্ষেত্রে ও অন্তততিন শতাংশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় বরাদ্দ করতে হবে, উৎসাহ দিতে হবে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার বিকাশে, কেবলমাত্র প্রামাণ্য বৈজ্ঞানিক তথ্য ও যুক্তিসিদ্ধ বিষয় শিক্ষা দিতে হবে, সংবিধানের 51 নম্বর ধারা মেনে চলতে হবে।

তথ্যসূত্র:

1. Scientific American, February 3, 2016

2. Budget for Science & Technology - Press In- formation Bureau, Government of India, Min- istry of Sciency & Technology, 13-February- 2017

3. https://thewire.in/105887/research-budget-biotech-iiser

লেখক পরিচিতিঃ ডঃ দত্ত পূর্বতন প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রধান ছিলেন।

“বিজ্ঞান গবেষণা সংকটগ্রস্ত” শীর্ষক প্রবন্ধটি ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি প্রকাশিত ‘প্রকৃতি’ পত্রিকার ত্রয়োদশ বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, আগস্ট 2017 থেকে নেওয়া।