বিভাগগুলি

বৈদিক জ্যোতিষ বা জ্যোতির্বিজ্ঞান বৈদিকও নয়, বিজ্ঞানও নয়



জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকর

2001 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বৈদিক জ্যোতিষশাস্ত্র বিভাগ চালু করার ঘোষণা করেছে এবং একই সাথে কোর্সটির নাম পরিবর্তন করে ‘জ্যোতির্বিজ্ঞান’ করেছে, যাতে বিষয়টির বৈজ্ঞানিক প্রকৃতিকে বোঝানো যায়। ঘোষণাটিতে এই বিষয়টির উদ্দেশ্য, সুযোগ, পাঠ্যতালিকা এবং তার সময়কাল সম্পর্কে বিশদ বিবরণ রয়েছে। ঘোষণাপত্রটিতে ইংরাজির মান দেখলে প্রফেসর হিগিন্স কবরেই নড়ে উঠতেন। ঘোষণায় দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছে যে “বৈদিক জ্যোতিষশাস্ত্র আমাদের ঐতিহ্যগত এবং শাস্ত্রীয় জ্ঞানের প্রধান বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতমই শুধু নয়, এই বিষয়টি সময়ের সাথে সাথে মানুষের জীবনের বিচিত্র ঘটনাগুলিকে এবং মহাবিশ্বের নানান বিষয়কে জানতে সাহায্য করে চলেছে”।

জ্যোতিষশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞান এই দুটি বিষয় নিয়ে মানুষের মনে বিভ্রান্তি রয়েছে। নিশ্চিতভাবেই ইউ-জি-সির সার্কুলারে জ্যোতির্বিজ্ঞান নয়, জ্যোতিষশাস্ত্রের কথাই বলা হয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞান কখনোই মানুষের জীবনের ঘটনাবলীর কথা বলে না, বা এটি “হিন্দু গণিত, বাস্তুশাস্ত্র, আবহাওয়া বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গবেষণার নতুন মাত্রা” যোগ করে না, যেমনটি ইউ-জি-সির বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়েছে। এই ধরনের দাবি জ্যোতিষশাস্ত্রই করে থাকে, কারণ পকেট অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধানে শব্দটির সংজ্ঞা যেভাবে দেওয়া হয়েছে তা হল, “মানুষের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নক্ষত্রমণ্ডলীর গুপ্ত প্রভাবের অধ্যয়ন”। আর পকেট অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধানে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সংজ্ঞা হ‘ল ‘আকাশের জ্যোতিষ্কদের বিজ্ঞান’।

শুরুতেই এই পার্থক্যটি স্পষ্ট করা প্রয়োজন। এই প্রবন্ধটিতে আমি দেখাব, বৈদিক জ্যোতিষ বৈদিক বা বিজ্ঞান কোনোটাই নয়।

কেন জ্যোতিষশাস্ত্র বৈদিক নয়

কয়েক বছর আগে অধ্যাপক এস. জি. দানি এই পত্রিকাতেই বৈদিক গণিতের অসারত্ব প্রমাণ করেছিলেন (EPW, Vol XXVIII, No 31, p1577)। সেখান থেকে একটি শিক্ষা নেওয়া উচিত যে, ‘বৈদিক’ বা প্রাচীন উৎপত্তি বলে ঘোষিত যে কোনো বিষয়ে খুব সতর্ক থাকা উচিত। যেহেতু ভারতে জ্ঞান হস্তান্তরের মৌখিক রীতি প্রচলিত ছিল, তাই কোন প্রাচীন যুগের কোন সময়ে কোন জ্ঞানের অস্তিত্ব ছিল তার খুব কম নির্ভরযোগ্য নথি রয়েছে। অন্যান্য সভ্যতা, যেমন চিন, আরব বা মধ্যযুগীয় ইউরোপে, যেখানে নথিপত্র লিখে রাখার ঐতিহ্য ছিল, সেখানকার থেকে এই পরিস্থিতি আলাদা। আমাদের যতটুকু লিখিত নথিপত্র আছে তাতে অনেক কিছু বিষয় ‘প্রক্ষিপ্ত’ হিসাবে উল্লেখিত থাকতে পারে, কারণ, পাণ্ডুলিপির মূল নির্মাতাদের পরবর্তীকালে অন্যরাও সেগুলিতে সংযোজন করেছেন।

আমি নিজেও একবার এই পরিস্থিতির কারণে বিভ্রান্ত হয়েছিলাম। আম ‘শুক্রনীতি’র শ্লোকগুলি পড়ে খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম, যেখানে মালিক কর্মচারীদের কল্যাণমূলক কাজের জন্য সুপারিশ করেছে, যেমন প্রভিডেন্ট ফান্ড, কর্মচারীর বিধবাকে সাহায্য ইত্যাদি। আমি লিখেছিলাম, “দেখুন পঞ্চম শতাব্দীতেও মানুষ কিভাবে মালিক-কর্মচারী সম্পর্কের মতো আধুনিক সমস্যাগুলির বিষয়ে চিন্তা করেছিলেন”। পরে পণ্ডিতরা আমাকে দেখিয়েছিলেন যে, এই শ্লোকগুলি অনেক পরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অনুশীলিত নিয়মগুলি অনুসরণ করে আধুনিক যুগে কেউ এটা করেছিলেন।

বৈদিক সাহিত্য অত্যন্ত মনোযোগের সাথে পড়ে কোথাও নয়টি গ্রহ সম্পর্কে ধারণা এবং মানুষের ভাগ্য নির্ধারণে তাদের প্রভাব সম্পর্কে কিছু পাওয়া যায়নি। বছরের কোন কোন সময়ে নক্ষত্রমণ্ডলীর বিশেষ অবস্থান অশুভ এবং তার জন্য পশুবলির উল্লেখ রয়েছে। সাত দিনে সপ্তাহ ধারণাটি পশ্চিম থেকে ভারতে এসেছিল, গ্রিস থেকে আরবদের মাধ্যমে। এটি ‘গ্রহের’ সাথে সম্পর্কিত (সূর্য এবং চন্দ্রও এই নয়টি গ্রহের অংশ ছিল)। গ্রহগুলির যে গুপ্ত ক্ষমতা আছে, এই ধারণাটির উৎস ইউরোপ। সূর্য-সিদ্ধান্তের একটি শ্লোকে সেই ইঙ্গিত রয়েছে। এখানে সূর্য (সূর্য দেবতা (অসুর মায়াকে বলছে "আপনার নিজের শহর রোমে চলে যান (যা গ্রিক-রোমান সংস্কৃতির প্রতীক)। ব্রহ্মার অভিশাপের কারণে আমি যবন (বিদেশী বা অ-ভারতীয়কে দেওয়া নাম (এর ছদ্মবেশে আপনাকে এই শিক্ষাটি দেব”। সংস্কৃত পণ্ডিত সি কুনহান রাজা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন: “বৈদিক সভ্যতায় কোনো জ্যোতিষশাস্ত্র নেই” এবং আরো বলেছেন যে বাইরের থেকে বৈদিক সভ্যতায় এই জ্ঞান এসেছে) Survey of Sanskrit Literature, Bombay, 1962, pp275-277)। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ গ্রীস থেকে ভারতে জ্ঞান প্রবাহের (ভাল বা মন্দ!) পথ খুলে দেয়।

বাস্তবে, কিছু প্রামাণিক পাণ্ডুলিপি থেকে বৈদিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে আমরা অনেক কিছু জানতে পারি। নক্ষত্র ও নক্ষত্রমণ্ডলী পর্যবেক্ষণ, সূর্য ও চন্দ্রের অবস্থান পর্যবেক্ষণ এবং এর ভিত্তিতে ক্যালেন্ডার এবং পঞ্জিকা তৈরির কাজ খুবই উল্লেখযোগ্য। এখানেও বিতর্ক রয়েছে। কিছু পণ্ডিত দাবি করেন যে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান মূলত পশ্চিম থেকে ধার করা। আবার অন্যান্য পণ্ডিতরা এই দাবিকে অস্বীকার করেন এবং তাঁদের মতে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান মূলত বেদাঙ্গ জ্যোতিষ থেকে শুরু হয় এবং এর স্বর্ণযুগে, অর্থাৎ আর্যভট্ট প্রথম (পঞ্চম শতাব্দী) থেকে ভাস্কর দ্বিতীয় (দ্বাদশ শতাব্দী( পর্যন্ত সময়ে, এর যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছিল। কিন্তু এই সমস্ত দাবিগুলি জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে, জ্যোতিষশাস্ত্র বিষয়ে নয়।

বস্তুত, গ্রিক শব্দ ‘planet’ এর অর্থ ‘ভবঘুরে’। গ্রীকরা দীর্ঘকাল গ্রহগুলিকে পর্যবেক্ষণ করে এই ধারণায় পৌঁছেছিলেন যে আকাশের এই বস্তুগুলি নিজেদের ইচ্ছামত আকাশের তারকাখচিত চাঁদোয়ায় তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে। এই আবিষ্কারের ফল হল দ্বিমুখী, একটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে এবং অন্যটি জ্যোতিষশাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে।

জ্যোতির্বিজ্ঞান অংশটি অ্যারিস্টটলের মহাবিশ্ব প্রকল্পের কাঠামোর মধ্যে দৃশ্যত গ্রহগুলির অনিয়মিত গতিকে খাপ খাওয়াতে চেয়েছিল। এই প্রকল্পে গ্রহগুলির গতিপথ বৃত্তাকার এবং পৃথিবী এই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে স্থির রয়েছে। তাই সেদিনের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে সমস্যা ছিল, পৃথিবী স্থির এবং গ্রহগুলি বৃত্তপথে চলাচল করে এটা ধরে নিয়ে গ্রহের গতি ব্যাখ্যা করা। ফলে তাঁরা এক বৃত্তের উপর আরেক বৃত্ত (এপিসাইকেল) তার উপর আরেকটা—এইভাবে কল্পনা করে এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেন। এই কল্পনায় বৃত্তের একটি সারি আছে, এই সারির প্রতিটি বৃত্তের কেন্দ্রটি সারির পূর্ববর্তী বৃত্তের উপর অবস্থান করছে, এবং গ্রহটি শেষ বৃত্তের উপর ঘূর্ণায়মান অবস্থায় থাকছে। সেই সময়ের নিরিখে এটি একটি কষ্টসাধ্য কাজ। এইভাবে গ্রহের গতির ব্যাখ্যায় প্রতিভার পরিচয় ছিল, আজকের পদার্থবিজ্ঞানীরা একে হয়ত ‘প্যারামিটার ফিটিং’ বলবেন। কিন্তু কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, কেপলার এবং নিউটনের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্বের আবিষ্কারের সাথে সাথে এই ধারণাটি অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়।

অন্যদিকে জ্যোতিষশাস্ত্র অংশটি ধরে নিয়েছিল যে গ্রহগুলির মধ্যে একটি বিশেষ শক্তি আছে যার কারণে তাদের অনিয়মিত গতি, এবং তারা ইচ্ছামতো চলাফেরা করে। পরের ধাপে এই বিশ্বাস এলো যে এই শক্তি মানুষের উপরও প্রভাব বিস্তার করে, এবং তাদের ভাগ্য পরিচালনা করে। তাই এখানে আমরা জ্যোতিষশাস্ত্রীয় বিশ্বাসের উৎপত্তির কিছু কারণ দেখতে পাই। আজ গ্রহের গতি সম্পূর্ণরূপে ব্যাখ্যা করা যায়। এটা সুপ্রতিষ্ঠিত যে তাদের ইচ্ছামতো চলাচল করার কোনো ক্ষমতা তাদের নেই, গ্রহগুলির গতি সূর্যের মহাকর্ষ বলের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং সুনির্দিষ্ট কক্ষপথে তারা আবর্তিত হয়ে চলেছে। মানুষ এখন গ্রহগুলিকে খুব নিকট থেকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য মহাকাশযান পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু মানুষের মনের গতিপ্রকৃতি এমনই যে, এই সমস্ত বাস্তব তথ্য জ্যোতিষশাস্ত্রীয় বিশ্বাসকে নির্মূল করতে পারেনি। সংক্ষেপে, গোড়ার দিকে জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাসের পক্ষে কেউ কিছু যুক্তি করতে পারতো, তা যতই বিভ্রান্তিকর হোক না কেন, কিন্তু নিউটনের পরবর্তী যুগে (1685 সালের পরবর্তী সময়ে) সেই বিশ্বাসকে সমর্থন করার কোনো যুক্তি নেই।

তা সত্ত্বেও এই প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে আমরা জ্যোতিষশাস্ত্রে আজও কেন বিশ্বাস আছে তার কারণগুলি খতিয়ে দেখব। এবং এখানেই আমাদের দ্বিতীয় প্রশ্ন: জ্যোতিষশাস্ত্র কি বিজ্ঞান?

কেন জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান নয়

ইউ-জি-সির এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে বিজ্ঞানী সমাজ লড়াই করছে শুধুমাত্র জ্যোতিষশাস্ত্রের বৈদিক হওয়া বা না হওয়ার বিষয়ে নয়, বরং বিজ্ঞান হিসাবে তাকে উপস্থাপনা করার বিরুদ্ধে। আসুন প্রথমে জ্যোতিষশাস্ত্রের সমর্থকরা জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞান হিসাবে গ্রহণ করার জন্য যে যুক্তিগুলি উপস্থাপনা করে তা আমরা পরীক্ষা করি। এগুলি সাধারণত নিম্নলিখিত ধরণের হয়:

  1. জ্যোতিষশাস্ত্র বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ দ্বারা প্রাপ্ত গ্রহের অবস্থানকে ব্যবহার করে কাজ করে, ঠিক যেমন জ্যোতির্বিদ্যা করে থাকে। তাহলে জ্যোতির্বিজ্ঞান যদি বিজ্ঞান হয়, কেন জ্যোতিষশাস্ত্র নয়?
  2. এমন মানুষ সর্বত্র আছেন যিনি এমন জ্যোতিষীর কথা শুনেছেন এবং যার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছে। এই সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য, জ্যোতিষশাস্ত্রকে কি বিজ্ঞান হিসাবে কৃতিত্ব দেওয়া উচিত নয়?
  3. আবহাওয়াবিদ্যা এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের দিকে তাকান। আবহাওয়ার পূর্বাভাস ভুল হয়ে থাকে, চিকিৎসাবিদ্যাতেও রোগনির্ণয় কখনও কখনও ভুল হয়, এবং এক ডাক্তার থেকে আর এক ডাক্তারের মধ্যে চিকিৎসার তারতম্য হতে পারে। এই বিষয়গুলিকে যদি বিজ্ঞান হিসাবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে কেন জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞান বলা হবে না?
  4. কিছু জ্যোতিষী ব্যর্থ, কারণ তারা বিষয়টির সঠিক অনুশীলনে ব্যর্থ হয়েছেন। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে এই ক্ষেত্রটিতে এখন অনেক বুজরুক রয়েছে, কিন্ত তত্ত্বটি সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক।
  5. বিজ্ঞানীরা অহংকারী, যারা জ্যোতিষশাস্ত্রকে অধ্যয়ন বা পরীক্ষা না করেই প্রত্যাখ্যান করেছেন।

এইসব যুক্তি বিচার করতে একটি বিষয়কে ‘বিজ্ঞান’ হতে হলে কী কী প্রয়োজন তা বোঝা দরকার। বহু শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানের বিকাশ হয়েছে তত্ত্ব (T), পরীক্ষা (E) এবং পর্যবেক্ষণ (O) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। প্রক্রিয়াটি চক্রাকার, বা বলা যেতে পারে অনেকটা ঘোরানো সিঁড়ির মতো, যেখানে কোনো একজন এক অন্তহীন প্রক্রিয়া (T...E...O...T...E...O...) মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে। এখানে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার অর্থ এই প্রকৃতিজগতের নিয়মগুলিকে আরো সুন্দরভাবে জানা। এই অনুশীলনে অনেক বাধা এবং ভুল পথ আছে। বিজ্ঞানের ইতিহাস বহু ভুল তত্ত্ব, বিভ্রান্তিকর পরীক্ষা বা ভুল পর্যবেক্ষণে ভরে আছে। বিজ্ঞানীরা এই সত্যটি প্রথমেই স্বীকার করেন। তাঁরা এটাও স্বীকার করেন যে বিজ্ঞান কখনোই সবকিছু সমাধান করেছে বলে দাবি করে না। বরং, অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে যে আপনি যখন এই সিঁড়িতে উঠছেন নতুন প্রশ্ন আপনার সামনে আসে যা আগে আপনার কাছে আসেনি, কারণ আগে আপনার এই বিষয়ে যথেষ্ট উপলব্ধি ছিল না। তাহলে যাকে আমরা বিজ্ঞান বলছি তার শক্তি, কি তা হচ্ছে এর স্ব-আরোপিত একটি নীতি যা নিম্নলিখিত উপায়ে কাজ করে।

একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের প্রস্তাবনার ক্ষেত্রে তার প্রাথমিক অনুমানগুলিকে অবশ্যই স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হয় এবং সেগুলিকে এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হয়। এর ভিত্তিতে একটি যৌক্তিক কাঠামো তৈরি করতে হয় যার ভিত্তিতে কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব যা ঠিক না ভুল তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করা যায়।

ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য তত্ত্বটিরই পুনরুক্তি বা মূল নীতিগুলির পরিবর্তন কোনোটাই বাঞ্ছনীয় নয়। অন্য কথায়, অনুমানগুলি হবে নির্দিষ্ট। তত্ত্বটি যাচাই করতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পূর্বাভাসগুলির পরীক্ষার প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়ার একটা অন্তর্নির্মিত বস্তুনিষ্ঠতা রয়েছে। এটি এমন নয় যে, শুধুমাত্র বিজ্ঞানী X প্রয়োজনীয় ফলাফল খুঁজে পেতে পারেন, কিন্ত বিজ্ঞানী Y বা Z তার পরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ পুনরাবৃত্তি করতে পারেন না। পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণগুলি নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে পরিকল্পনা করা হয়, যাতে পরীক্ষার ফলাফল পরিসংখ্যান-তত্ত্বের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা যায়। এত সব সুরক্ষা সত্ত্বেও, কোনো তত্ত্ব নিখুঁত হয়েছে বলে দাবি করা যায় না। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রকে উন্নত করেছে, কিন্তু কেবলমাত্র বহু সংখ্যক নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেই আইনস্টাইনের তত্ত্বকে বিজ্ঞান মেনে নিয়েছে। এই সাফল্য সত্ত্বেও আজ কোনো বিজ্ঞানী মনে করেন না যে, মহাকর্ষের ব্যাখ্যায় আপেক্ষিকতাবাদই শেষ কথা। কোয়ান্টাম তত্ত্বের সঙ্গে মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বের মিলন পরবর্তী সমস্যা হিসাবে সামনে এসেছে, যার সমাধান হয়তো সাধারণ আপেক্ষিকতা-বাদকেও আরও উন্নত করবে।

এবার আমরা জ্যোতিষশাস্ত্রের ক্ষেত্রে উপরের মন্তব্যগুলিতে আসি। প্রথমে 1 নম্বর বিষয়টি নেওয়া যাক। জ্যোতির্বিজ্ঞান উপরে বর্ণিত বিজ্ঞানের নীতিগুলিকে কঠোরভাবে অনুসরণ করে। জ্যোতিষশাস্ত্র কি তা করে?

জ্যোতিষশাস্ত্রের কি নির্দিষ্ট মৌলিক নিয়ম আছে? এমন কোনো যুক্তিসিদ্ধ পদ্ধতি জ্যোতিষশাস্ত্রে আছে কি যার দ্বারা বিভিন্ন তথ্যকে সম্পূর্ণরূপে বস্তুনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করা যায়? যা কোনো বিশেষ জ্যোতিষীর উপর নির্ভর করে না? ব্যর্থ ভবিষ্যদ্বাণী কি তত্ত্বের খণ্ডন হিসাবে গৃহীত হয়? এই সবকটি প্রশ্নেরই উত্তর হল “না”। বরং জ্যোতিষশাস্ত্রের সমর্থকদের মনোভাব হল যে তাদের তত্ত্ব নিখুঁত, এবং যদি এটি ব্যর্থ হয় তার কারণ এটিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাহলে ব্যাখ্যা কি ব্যক্তিভেদে আলাদা আলাদা হয়? তা যদি হয়, আপনি কিভাবে প্রস্তাবিত কোর্সের জন্য পাঠ্যপুস্তক পরিকল্পনা করবেন বা অভিন্ন পদ্ধতির সাথে একমত এমন শিক্ষক খুঁজে পাবেন?

2 নম্বর বিষয় সম্পর্কে বলি, জ্যোতিষীরা সম্ভবত কার্ল পপারের কথা শোনেননি, এবং যদি তারা শুনেও থাকেন তবে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সম্পর্কে তিনি যা বলেছিলেন তা উপেক্ষা করতে চাইবেন। পপারের বক্তব্য হ‘ল, কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যদি মাত্র একটি ভবিষ্যদ্বাণীতেও ব্যর্থ হয় তবে সেই তত্ত্ব পরিত্যাগ করতে হবে। ফলে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণীগুলি অবশ্যই প্রয়োজনীয় কিন্তু তত্ত্বের বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট নয়। তার মৃত্যুর জন্য একটি ভুল ভবিষ্যৎবাণীই যথেষ্ট। যদি আপনি জ্যোতিষে বিশ্বাসী কাউকে জিজ্ঞাসা করেন যে কোনও জ্যোতিষী ক’টি অসফল ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, তার কাছে উত্তর পাবেন না।

3 নম্বর বিষয়ে, আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং চিকিৎসা নির্ণয় পদ্ধতি যে নিখুঁত নয় এটি স্বীকার করা হয়েছে, তবুও, এই বিষয়গুলি বিজ্ঞানের নিয়ম নীতি অনুসরণ করে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসের জন্য বায়ুমণ্ডলের এবং ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অবস্থার তথ্য সংগ্রহ করে অত্যন্ত জটিল গণনা করতে হয়। যত দিন যাচ্ছে, নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিগুলিকে আরও ভালভাবে বোঝা যাচ্ছে। বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থার তথ্য আরও ভালোভাবে সংগ্রহ করা যাচ্ছে কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে। এমনকি যারা আবহাওয়াবিদ্যাকে বিজ্ঞান হিসাবে ধরতে নারাজ, তারাও স্বীকার করবে যে, তাত্ত্বিক অগ্রগতি ও তথ্য সংগ্রহে উন্নতির কারণে আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মান ক্রমাগত উন্নত হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানও ত্রুটিহীন বলে দাবি করে না, কিন্তু জীববিজ্ঞান এবং জৈবপ্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে আমরা মানব দেহকে আরও ভালভাবে বুঝতে পারছি। ফলে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান ধারাবাহিকভাবে উন্নত হচ্ছে। মনে রাখতে হবে একটি নতুন ওষুধ বাজারে আসার আগে সেটিকে নিয়ন্ত্রিতভাবে পরীক্ষা করা হয়, প্রয়োজনে এর জন্য কয়েক বছর লাগতে পারে। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে জ্যোতিষশাস্ত্র কি তার কর্মক্ষমতার কোনো উন্নতি দেখিয়েছে?

4 নম্বর বিষয়টি ইতিমধ্যে বিবেচনা করা হয়েছে। যদি বিষয়টিকে এইভাবে বিচার করা হয় যে, যেসব ক্ষেত্রে ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে জ্যোতিষশাস্ত্র একটি বিজ্ঞান, কিন্তু না মিললেই জ্যোতিষী একজন বুজরুক, তাহলে সব জ্যোতিষীই বুজরুক বলে চিহ্নিত হবেন। বিষয়টির যারা চর্চা করেন তাঁদের নিজেদের বক্তব্যের খুঁটিয়ে বিচার করার সময় কি আসেনি?

শেষ সমালোচনাটি একদমই অনুপযুক্ত, কারণ বিজ্ঞানীরা জ্যোতিষশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন, পরীক্ষা করেছেন এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের পূর্বাভাসের যথার্থতা যাচাই করার জন্য যে পরীক্ষাগুলি করা হয়েছে তা জ্যোতিষশাস্ত্রের পক্ষে ইতিবাচক ফলাফল দেয়নি। উল্লেখযোগ্য গবেষণাপত্রগুলি নানা পত্রিকায় ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।

মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী বার্নি সিলভারম্যান পরিচালিত গবেষণাটি একটি উদাহরণ হিসাবে বিবেচনা করার জন্য রাখছি। পরীক্ষাটি হল, জ্যোতিষশাস্ত্রের দাবী অনুযায়ী যে দম্পতিদের জন্মপত্রিকার মিল বা সামঞ্জস্য আছে, তাদের বিবাহিত জীবনের সাফল্যে বা অসাফল্যে তার কোনো প্রভাব আছে কিনা দেখা। গবেষণায় 2978 জন দম্পতি বেছে নেওয়া হয়েছিল যারা সুখীভাবে বিবাহিত ছিল এবং 478 জন যাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছিল। তাদের জন্মপত্রিকা দুজন প্রতিষ্ঠিত জ্যোতিষীকে দেওয়া হয়েছিল, কোন রাশিফল সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং কোনটি নয়, এবিষয়ে নিজেদের মধ্যে একমত হওয়ার জন্য (তাদের জানানো হয়নি এই রাশিফলগুলির জাতক কারা( তাঁদের সিদ্ধান্ত এবং ওই দম্পতিদের বিবাহিত জীবনের তথ্যের মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল টেস্টের ভিত্তিতে কোনো উল্লেখযোগ্য মিল পাওয়া যায়নি।

1975 সালে 18 জন নোবেল বিজয়ী সহ 186 জন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী জ্যোতিষশাস্ত্রের বিরুদ্ধে একটি বিবৃতিতে এটিকে স্পষ্টভাবে অবৈজ্ঞানিক ঘোষণা করেন। তারা যা বলেছেন তার থেকে নির্যাসটুকু দেওয়া হল: “… জ্যোতিষীরা প্রকাশ্যে এবং ব্যক্তিগতভাবে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করেন ও পরামর্শ দেন সেগুলি প্রশ্নাতীতভাবে গ্রহণ করা সম্পর্কে আমরা নিচে স্বাক্ষরকারী জ্যোতির্বিজ্ঞানী, জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের বিজ্ঞানীরা জনসাধারণকে সতর্ক করতে চাই। যারা জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস করতে চান তাদের একথা উপলব্ধি করা উচিত যে এই শাস্ত্রের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই...। এই অনিশ্চিত সময়ে অনেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য পরামর্শের কামনা করে। মানুষের নিয়ন্ত্রণাতীত মহাজাগতিক শক্তি দ্বারা পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যে বিশ্বাস করতে চায়। যাইহোক, আমাদের বিশ্বের মুখোমুখি হতে হবে , এবং অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদের হাতেই রয়েছে, নক্ষত্রের হাতে নয়” (The Humanist, September /October 1975)

কেন মানুষ জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস করতে পছন্দ করে?

উপরে যে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে তার শেষ অংশটিতে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কেন জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান হিসাবে বাতিল হলেও এখনও টিকে আছে। এটিকে মনোরোগের চিকিৎসা হিসেবে দেখা হয়, যা সিদ্ধান্ত গ্রহণের মুহূর্ত, দুঃখ, হতাশা ইত্যাদির মুখোমুখি হলে মানুষের মনে সান্ত্বনা এনে দেয়। কঠিন বিষয় নিয়ে চিন্তা বা উদ্বেগের পরিবর্তে, এটি দোষ চাপায় গ্রহদের ওপর বা যিনি গ্রহদোষ ব্যাখ্যা করেন তার ওপর। এই সমস্ত ক্ষেত্রে কারুর মনে যুক্তির কথা স্থান পায় না।

আরেকটি মনস্তাত্ত্বিক দিক আছে যাকে ‘বার্নাম এফেক্ট’ বলা হয়। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, জ্যোতিষশাস্ত্রের নানা ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ থেকে একজন মানুষের মন সেইগুলি বেছে নেয় যা তার জন্য প্রযোজ্য এবং যেগুলি মেলে না সেই অংশগুলিকে উপেক্ষা করে। আর জ্যোতিষশাস্ত্রের পূর্বাভাসগুলি প্রায়শই এমনভাবে বলা হয় যে প্রায় সবকিছুই যে কারও ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। (যখন, ‘বার্নাম এবং বেইলি’ সার্কাসের মালিক পি টি বার্নামকে তার সাফল্যের রহস্য জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে, তাঁর সার্কাসে বিভিন্ন ধরনের আইটেম রয়েছে এবং তাই দর্শকদের মধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন বিষয় পছন্দ করলেও প্রত্যেকেই সন্তুষ্ট হয়ে যায় কারণ প্রত্যেকেই তার রুচি অনুযায়ী মনোরঞ্জক কিছু দেখেছে। তাই এই প্রক্রিয়াটির নাম বার্নাম এফেক্ট)।

জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীদের উপর বার্নাম এফেক্ট এর পরীক্ষা করা হয়েছে। একটি পরীক্ষায়, একটি গ্রুপের প্রত্যেক ব্যক্তিকে চরিত্রের একটা বিবরণ তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। প্রথমটা একজন জ্যোতিষীকে দিয়ে রাশিফলের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা, দ্বিতীয়টা অন্য কোনো ব্যক্তির চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের বিবরণ এবং তৃতীয়টি সম্পূর্ণ কৃত্রিম এবং অস্পষ্ট শব্দযুক্ত (বার্নাম) প্রোফাইল। প্রত্যেককে দেওয়া বিবরণ একই। বার্নাম প্রোফাইল কিছুটা এই লাইন বরাবর চলে, (দেখুন এটি আপনার জন্য কতটা প্রযোজ্য):

আপনি চান অন্যেরা আপনাকে পছন্দ করুক ও শ্রদ্ধা করুক। আপনার নিজেকে সমালোচনা করার প্রবণতা রয়েছে। আপনার ক্ষমতা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি কিন্ত আপনি আপনার সুবিধামতো তা ব্যবহার করতে পারছেন না। আপনার ব্যক্তিত্বের কিছু দুর্বলতা রয়েছে, আপনি সেটা কোনোভাবে পূরণ করে দিতে সক্ষম। বাইরে আপনি সুশৃঙ্খল এবং স্ব-নিয়ন্ত্রিত, কিন্তু ভিতরে ভিতরে আপনি উদ্বিগ্ন এবং নিরাপত্তাহীন। মাঝে মাঝে আপনার সন্দেহ হয়, আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তো, অথবা সঠিক কাজ করেছেন তো? আপনি কিছুটা পরিবর্তন এবং বৈচিত্র্য পছন্দ করেন এবং বিধিনিষেধ এবং সীমাবদ্ধতার মধ্যে আটকে থাকতে অসন্তুষ্ট বোধ করেন। আপনি স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারেন বলে গর্ব বোধ করেন এবং সন্তোষজনক প্রমাণ ছাড়া অন্যের বক্তব্য গ্রহণ করেন না। আপনি অন্যদের কাছে নিজেকে বেশিমাত্রায় প্রকাশ করাটা অনুচিত মনে করেন। মাঝে মাঝে আপনি বহির্মুখী, স্নেহশীল এবং মিশুক, অন্য সময়ে আপনি অন্তর্মুখী, সতর্ক এবং সংরক্ষিত। আপনার কিছু আকাঙ্ক্ষা বেশ অবাস্তব। নিরাপত্তা আপনার জীবনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।

প্রতিটি চরিত্র-বিবরণের সাথে তার কতটা মিল আছে তা প্রতিটি গ্রুপের সদস্যকে 1 থেকে 5 স্কেলে জানাতে বলা হয়েছিল। যদিও প্রথম দুই ধরনের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা যায়নি, দুটিই বার্নাম প্রোফাইলের ভালোরকম নিচে স্থান পেয়েছে। এই অনুসন্ধানটি জ্যোতিষীদের দেওয়া চরিত্র বিবরণের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে অনেক কিছু বলে দেয়। বোঝা যায় কেন মানুষ এদের বিশ্বাস করে।

অনেকে মনে করেন, জ্যোতিষশাস্ত্রের অস্তিত্ব এবং বিকাশ অব্যাহত থাকবে, কারণ মানুষ একটা কিছু সান্ত্বনা পেতে চায় এবং এটা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে। যাই হোক, যদি মানুষ ‘বুদ্ধিমান প্রাণী’ হবার দাবি করতে চায়, তাহলে দুশ্চিন্তার কারণ আছে। এখন পর্যন্ত জ্যোতিষশাস্ত্রীয় বক্তব্যের কোনো যৌক্তিকতা পাওয়া যায়নি। তবু একে উচ্চশিক্ষার অংশ হিসেবে নিয়ে আসা এবং স্থাপত্য, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ ইত্যাদির জন্য এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করার অর্থ হল সময়ের সঙ্গে সামনে না এগিয়ে পিছিয়ে যাওয়া। পশ্চিমের দেশগুলিতে জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি বিশ্বাস একটা মজা করার বিষয়, এবং সেখানে শ্রদ্ধার কোনো চিহ্ন নেই। আমাদের দেশে, সমাজের সর্বস্তরে এটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয় এবং বর্ণ, শিক্ষা, আয়, রাজনীতি ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রকে ছাপিয়ে যায়। লোকেরা বিয়ে ঠিক করার জন্য, মন্ত্রী হওয়ার জন্য, নতুন ব্যবসা শুরু করার জন্য জ্যোতিষীদের সাথে পরামর্শ করে। যে দেশ উন্নত দেশের সমতুল্য হতে চায়, সেখানে মানবসম্পদের যৌক্তিক ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য। মানুষকে আরও কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে এই লক্ষ্য অর্জন করা যেতে পারে বলে মনে হয় না।

অধ্যাপক জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জ্যোতির্পদার্থ বিজ্ঞানী। মহাবিশ্ব-তত্ত্বের ক্ষেত্রে হয়েল এবং নারলিকরের ‘কোয়াসি স্টেডি স্টেট থিওরি’ বিজ্ঞানী মহলে সাড়া ফেলেছি। উচ্চমানের বিজ্ঞান গবেষণা ছাড়াও তিনি বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার কাজে এবং বিজ্ঞান মনস্কতা প্রচারেও সক্রিয় ছিলেন এবং বহু প্রবন্ধ ও বই লিখেছেন। প্রতিষ্ঠাতা-অধিকর্তা হিসেবে তিনি ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার অফ অ্যাস্ট্রোনমি এন্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স IUCAA গড়ে তুলেছেন। এই প্রবন্ধটি লেখার সময়ে তিনি ছিলেন IUCAAর অধিকর্তা, অর্থাৎ সরকারি সংস্থার অধিকর্তা হয়েও সরকারি নীতির সমালোচনা করতে পিছপা হননি।

(এই প্রবন্ধটি Economic and Political Weekly, June 16, 2001, pp2113-15, থেকে অনুমতিক্রমে সংগৃহীত এবং তা অনুবাদ করা হয়েছে – সম্পাদক, প্রকৃতি)

“বৈদিক জ্যোতিষ বা জ্যোতির্বিজ্ঞান বৈদিকও নয়, বিজ্ঞানও নয়” শীর্ষক এই প্রবন্ধটি ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি প্রকাশিত ‘প্রকৃতি’ পত্রিকার পঞ্চদশ বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, নভেম্বর 2021 থেকে নেওয়া।