বিভাগগুলি

স্কুল স্তরে বিবর্তনবাদ পড়ানো কেন অতি প্রয়োজনীয়



সৌমিত্র ব্যানার্জী

এবছর (2023 সালের) এপ্রিল মাসে বিজ্ঞানীদের প্রথম নজরে আসে যে NCERT স্কুলস্তরে কয়েকটি বিষয় না পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার মধ্যে আছে জীববিদ্যার ক্ষেত্রে ডারউইনের বিবর্তনবাদ, রসায়নে মেন্ডেলিয়েভের পর্যায় সারণী, ইতিহাসে মোগল আমল, সমাজবিজ্ঞানে গণতন্ত্র ইত্যাদি। এগুলি অতিমারির সময়ে কোর্স কমানোর জন্য বাদ দেওয়া হয়েছিল। এখন অতিমারী না থাকলেও ওগুলি বাদই।

বিজ্ঞানীসমাজে এর সবকটি সম্বন্ধে আপত্তি থাকলেও সিদ্ধান্ত হয় ডারউইনের বিবর্তনবাদ সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদ করা হবে সর্বাগ্রে। সেই মর্মে একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করা হয়, যাতে এখনও পর্যন্ত 5000 এর বেশি বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানপ্রেমী মানুষ সম্মতি জানিয়েছেন। এর মধ্যে আছেন স্বনামধন্য বিজ্ঞানীরা, গবেষণাকেন্দ্রের অধিকর্তা, সায়েন্স অ্যাকাডেমির ফেলোরা। ফলে সরকার চাপে পড়েছে। সরকারি কর্তারা নানা যুক্তি অবতারণা করে তাঁদের সিদ্ধান্তই যে সঠিক তা প্রতিপন্ন করতে চাইছেন।

এই পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানপ্রেমী মানুষকে বিষয়টির গভীরে ঢুকে বুঝতে হবে ডারউইনবাদ পড়ানো ঠিক কোন কারণে প্রয়োজন।

স্কুল স্তরে কী কী বিষয় পড়াতে হবে?

একটা যুক্তি তোলা হচ্ছে : “এতকিছু তো মানুষ জানে। সবকিছু কি স্কুলে পড়ানো হবে? স্কুলে পাঠ্যের বোঝা কমানো প্রয়োজন নয় কি?” তাহলে পড়ানো হবে কোনটা? কতটা? হ্যাঁ, যদি সত্যিই বোঝা হয় তাহলে কোনও কোনও বিষয় কমানোর প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু কী কমানো হবে, কোনটা পড়াতেই হবে, কোনটা সম্ভব হলে পড়ানো যায় কী ভিত্তিতে আমরা এটা বিচার করব? এই প্রশ্নটা কিন্তু আমাদের কাছে খুব পরিষ্কার হওয়া দরকার।

যখন আমাদের বিচার করতে হবে আগামী প্রজন্মকে কোনটা পড়াবো, কোন ধারণাটা দেবো, তখন আমাদের দেখতে হবে অতীতে মানুষ কী কী ভুল চিন্তা করত, যেগুলো আজ আমরা সংশোধন করতে পেরেছি বিজ্ঞান এগিয়েছে বলে। আজকে যারা স্কুলে শিক্ষিত হচ্ছে তাদের সেগুলো জানাতে হবে, যাতে তারা ভ্রান্ত চিন্তার প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।

যখন ডারউইনবাদ বলে কিছু আসেনি, মানবসমাজের একদম শুরুতে, সেই সময়ও কিন্তু মানুষের মনে কিছু কিছু প্রশ্ন ধাক্কা দিয়েছিল। আমরা কোথা থেকে এলাম? পৃথিবী-সূর্য কীভাবে সৃষ্টি হল? এই যে চারপাশে জীবজগতে এত কিছু দেখতে পাচ্ছি, এসব কোথা থেকে এল? এই “কোথা থেকে এলো?” প্রশ্নটা কিন্তু ডারউইন থেকে শুরু হয়নি। তার বহু কাল আগে থেকেই শুরু হয়েছে।

মানুষের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সে তার প্রশ্নের কোনও না কোনও একটা উত্তর খুঁজে নেয়। যদি সঠিক উত্তর না পায় তাহলে বেঠিক উত্তর খুঁজে নেয়। এবং খুঁজে নিয়ে বিশ্বাস করে। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। যখন এই প্রশ্নগুলো মনের মধ্যে ধাক্কা দিয়েছে তখন সে তার মতো করে উত্তর খুঁজে নিয়েছে। পরে সেটাই এক রকম ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গ হয়ে গিয়েছে এবং তারপর সেটা বিশ্বাস না করাটাকেই একটা অপরাধ বলে গণ্য হয়েছে।

এই প্রশ্নটার উত্তর কিন্তু আমরা পেলাম ডারউইনবাদের পরে। বিবর্তনবাদ আসার আগে মনে করা হতো আমরা যেসব জীব চারপাশে দেখছি, সেগুলো চিরকাল এরকমই ছিল এবং চিরকাল এরকমই থাকবে। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছিল। একদিন একজন বিশেষ কেউ এভাবেই সৃষ্টি করেছিল — এই চিন্তাটা সমাজের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে ছিল। সমস্ত কিছুরই যে পরিবর্তন হয় এই চিন্তাটা আসতে বহু সময় লেগেছে।

আমরা তো নানা জিনিসের পরিবর্তন দেখতে পাই। নদীর জল এক জায়গা থেকে গড়িয়ে আরেক জায়গায় চলে যায়। একটা গরু থেকে বাছুর জন্ম নেয়, তারপর সে আবার বড় হয়ে যায়। চাঁদটাকে রোজ একরকম দেখায় না, পূর্ণিমা অমাবস্যা হয়। শীত থেকে গ্রীষ্ম আসে, শ্রীষ্ম থেকে শীত।

এসব তো পরিবর্তনই। কিন্তু মনে করা হত, এসব চক্রাবর্ত পরিবর্তন। একই জিনিস ফিরে ফিরে আসে। অর্থাৎ স্থায়ী। গরু থেকে বাছুর, আবার তার থেকে গরু হলেও, গরু প্রাণীটা একই রকম থাকে। আমি বাঁদর দেখছি, ঠাকুরদা বাঁদর দেখেছে, তার বাবাও বাঁদর দেখেছে, সকলেই বাঁদরই দেখছে। বাঁদর বাঁদরই থেকে গেছে। অর্থাৎ জগত পরিবর্তনহীন। এই জগৎটার চিন্তাই মানুষ তখন করেছে।

আজকে মানুষের চিন্তা সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছে। ডারউইনবাদ আসার পর জানলাম, না, এটা দুই-তিন প্রজন্মের কারবার নয়। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে যদি দেখা যায় তাহলে পরিবর্তন হয়। আজকে আমরা জানি যে কিছুই স্থানু নয়। সমস্ত কিছুই পরিবর্তনশীল। যেগুলোকে আমরা পরিবর্তন হতে দেখি না, সেক্ষেত্রেও আমরা আরোহী যুক্তিধারা থেকে বলি ওটাও নিশ্চয়ই পরিবর্তিত হচ্ছে।

ফলে যেগুলোকে আমরা পরিবর্তিত হতে দেখছি না, তারও পরিবর্তন হয়। যখন এই চিন্তাটা মানুষের মনে ধাক্কা দিল, তখন বিজ্ঞানীরা ভাবলেন — আরও তো অনেক কিছু আছে যেগুলোকে আমরা পরিবর্তন হতে দেখি না। যেমন সূর্যটা, চাঁদটা, আকাশের তারাগুলো। সবকিছুই যদি পরিবর্তনশীল হয়, তাহলে এদের মধ্যেও নিশ্চয়ই পরিবর্তন হয়। তারপর এই নিরিখেই মানুষের গবেষণা শুরু হল এবং শেষ পর্যন্ত জানা গেল যে, এগুলোও পরিবর্তনশীল। এদের পরিবর্তনের নিয়মকানুনও জানা গেল। তার মানে ডারউইনবাদ শুধুমাত্র একটা ‘তত্ত্ব’ নয়। এটা মানুষের চিন্তাকে আমূল পাল্টে দিয়েছে।

একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক অধ্যাপক থমাস কুন দেখান যে, বিজ্ঞানের ইতিহাসে কিছু কিছু অগ্রগতি হচ্ছে ছোট ছোট ধাপের, আর কিছু কিছু অগ্রগতি আগের চিন্তাধারাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়ে নতুনকে সৃষ্টি করে। ওনার ভাষায় ‘প্যারাডাইম শিফট’। যখন মানুষের, বিশেষত বিজ্ঞানীদের একরকম চিন্তাপ্রক্রিয়া তৈরি হয়ে যায়, তখন তার চৌহদ্দির মধ্যেই চিন্তা, বিজ্ঞান, এবং আবিষ্কার হয়। এটাকে তিনি বলছেন ‘নরমাল সায়েন্স’। আর কখনও কখনও এমন আবিষ্কার হয় যেটা মানুষের সেই চিন্তাপদ্ধতিটাকেই পাল্টে দেয়। এতদিন ধরে যেভাবে লোকে ভাবতো সেভাবে ভাবলে আর চলে না, পদ্ধতিগুলোও অচল হয়ে যায়। একে তিনি বললেন ‘রেভলিউশনারি সায়েন্স’।

নিউটনের তত্ত্ব এরকমই একটা ধাপ। কেন? কারণ, তার আগে মনে করা হতো সমস্ত বস্তুর গতি — আকাশে চাঁদ ঘুরছে, সূর্য ঘুরছে, তারারা চলছে - এই যে চলা, তাদের কেউ না কেউ নিয়ে যাচ্ছে, কারোর ইচ্ছায় ঘটছে। নিউটনের তত্ত্ব আসার পরে বোঝা গেল যে, না, এই গতিগুলোর একটা নিয়ম আছে। সেই নিয়ম আমরা জানতে পারি। শুধু জানতে পারি তাই নয়, সে নিয়মটাকে জেনে আজকে যদি কোনও বস্তু এখানে থাকে তাহলে কালকে সেটা কোথায় যাবে সেটা নির্ণয় করতেও আমরা পারি। এভাবে গতি নির্ণয় করে আমরা পরীক্ষা করে বাস্তবের সাথে মিলিয়ে দেখতে পারি যে সেটা মিলল কি মিলল না। তার দ্বারা আমার তত্ত্বকে আরো উন্নত করতে পারি। এটা মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রে যে একটা বিশাল বড় অগ্রগতি। নিউটনের গতিবিদ্যা আসার আগে মানুষের চিন্তা এবং এর পরে মানুষের চিন্তা সম্পূর্ণ আলাদা।

এরকমই একটা বড় অগ্রগতি হলো ডারউইনবাদ। এই তত্ত্ব আসার আগে লোকে কী করত? তখন কি মানুষ জীবজগৎকে দেখেনি? দেখেছে। গরু দেখেছে, ছাগল দেখেছে, মোষ দেখেছে, টিকটিকি দেখেছে। ভালো করে দেখেছে এবং গবেষণাও করেছে। গবেষণায় কী প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে? তখনকার দিনের লেখাগুলোতে দেখবেন, ‘এই প্রাণীটাকে ভগবান কেন সৃষ্টি করলেন? এইরকমভাবেই কেন সৃষ্টি করলেন?’ এইগুলো বোঝার জন্য তারা ভাবনাচিন্তা করেছে।

যখন ডারউইনবাদ এল তখন ওইভাবে চিন্তা করার পদ্ধতিটাই বাতিল হয়ে গেল। তখন বিজ্ঞানীরা চিন্তা করতে আরম্ভ করলেন, এই যে জন্তুটা, যেটাকে আজকে এখানে দেখছি, সে যদি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে এসে থাকে তাহলে সেই প্রক্রিয়া কীভাবে কাজ করেছে? কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্যটা জীবটাকে কোন বিশেষ পরিবেশে অভিযোজনে সাহায্য করেছে? এই প্রশ্নগুলো নিয়ে তখন লোকে চিন্তা করেছে। অর্থাৎ ডারউইনবাদ আসার ফলে মানুষের চিন্তা প্রক্রিয়াটাই আমূল পাল্টে গেল। কখনো কখনো বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এরকম কিছু কিছু ধাপ আসে যেটা মানুষের চিন্তা প্রক্রিয়াকেই পাল্টে দেয়।

এর নিরিখেই বিচার করতে হবে আমরা কোনটা ছাত্রছাত্রীদের পড়াবো। আমাদের ভাষা আছে এবং ভাষা আছে বলেই আমাদের সংস্কৃতি ক্রমসঞ্চিত। আগের প্রজন্ম যা জানল সেগুলোর ভিত্তিতে পরের প্রজন্ম আরও এগোয়, তার ভিত্তিতে তারপরের প্রজন্ম আরও এগোয় - এভাবেই এগোতে থাকে। তাই প্রত্যেক প্রজন্মের কাছে এতদিনের মানুষের আহরিত জ্ঞানের শাঁসটাকে দিতে হয়, যাতে তার ভিত্তিতে সে সেই সমাজে উপযুক্ত ভূমিকা নিতে পারে, তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে এই শাঁসটা দিতে হয় ধাপে ধাপে। মানুষের আধুনিক চিন্তাপদ্ধতি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এই বস্তুজগৎ ও জীবজগৎ সম্পর্কে যে ধারণা কাজ করেছে, সেটার মধ্যে শাঁস যেটুকু, সেটুকু স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের দিতে হবে। তারপর যখন কলেজে উঠবে তখন তা বিস্তৃতভাবে পড়াতে হবে। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে তখন আরও বিস্তৃতভাবে পড়াতে হবে।

কিন্তু শাঁসটা সকলকেই জানতে হবে। যারা শিক্ষিত হল তারা সকলেই যদি এই শাঁসটা না পায় তাহলে এতদিন পর্যন্ত মানুষের যে সংগৃহীত জ্ঞান, এত সংগ্রামের ফসল, সেটা না জানা থেকে যাবে। তার চিন্তার স্তরটা সেই আবিষ্কার হওয়ার আগে মানুষের চিন্তা যেমন ছিল, সেই স্তরেই রয়ে যাবে। তার মানে, যদি আমরা সমস্ত ছাত্রকে বিবর্তনবাদের ধারণাটা না দিই, তাহলে তার মনের মধ্যে সেই আগের যুগের চিন্তাই গেড়ে বসে থাকবে – চারপাশের জগৎটা পরিবর্তনহীন, যেরকম ছিল সেরকমই থাকবে, এমনটাই কেউ সৃষ্টি করেছিলেন - এসব ধারণাই তার মনে রয়ে যাবে। এটা যে আজকের জ্ঞান অনুযায়ী ভুল সেটা সে জানতেই পারবে না। আমাদের বিবর্তনবাদ স্কুলে পড়াতে হবে এইজন্যেই যে, মানুষের জ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে যে কটা প্রধান ধাপ আছে, যে ধাপের ভিত্তিতে মানুষের আধুনিক চিন্তাপ্রক্রিয়া, তার জ্ঞানভাণ্ডার গড়ে উঠেছে, তার মধ্যে বিবর্তনবাদ একটি। মানুষের সার্বিক জ্ঞানভাণ্ডার গড়ে ওঠার সব ধাপ স্কুলে শেখানো সম্ভব নয়। কিন্তু প্রধান প্রধান ধাপগুলো স্কুলেই শেখাতে হবে।

আপনারা বলতে পারেন, এই যে ডারউইনবাদ, তার মধ্যে ন্যাচারাল সিলেকশন, তার মধ্যে ডিএনএ, ক্রোমোজোম, জিনতত্ত্ব - এতকিছু একটা স্কুলের ছাত্র পারবে?

ভেবে দেখতে বলব, আপনারা স্কুলে যা পড়েছেন তার সব কি মনে আছে? না, থাকে না। কিন্তু শাঁসটা থাকে। ডারউইনবাদের শাঁসটা কি? প্রথমত, এই জীবজগৎ পরিবর্তনশীল। পরিবর্তন হয়, বিবর্তন হয়। এটুকুই। এটা মনে থাকবে তো? থাকে। এটা ঢোকে।

দ্বিতীয়ত, এই যে পরিবর্তন, সেটারও কিন্তু নিয়ম আছে। নিয়মহীন, কেউ জানে না কী করে হচ্ছে, কিন্তু হয়ে যাচ্ছে এরকমটা নয়। তার একটা সুসংগত নিয়ম আছে, সেটা বস্তুগত নিয়ম। কারোর ইচ্ছায় সেটা ঘটছে না। এই নিয়মটা মনে নাও রাখতে পারে। কিন্তু নিয়ম যে আছে সেটা তার মনে থাকবে। সে হয়তো বলবে, আমি জানি না, কিন্তু নিয়ম আছে এবং সেটা বিজ্ঞানীরা জানে। এই আস্থাটা থাকবে। এটাও কিন্তু একটা বড় লাভ। ফলে বিবর্তনবাদের তত্ত্ব কতটা তার মাথায় থেকে যাবে সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ তার শাঁসটুকু এই বস্তুজগত পরিবর্তনশীল। এখানে স্থায়ী, অপরিবর্তনীয় বলে কিছু নেই। এই সমস্ত পরিবর্তন নিয়ম-শাসিত। এ নিয়ম জানা যায়। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করে জানেন এবং এর মধ্যে অনেকগুলো নিয়মই জানা গেছে। অন্তত জীবজগতের বিবর্তনের নিয়মটা আমরা জানি।

এই দিক থেকে যদি দেখেন তাহলে দেখবেন যে বিবর্তনবাদ না পড়ালে কিন্তু আমরা অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হব।

NCERT’র সিলেবাস প্রণেতারা এবং নেতামন্ত্রীরা বলছেন, বিজ্ঞানের সিলেবাস rationalization করা হচ্ছে মাত্র। বিবর্তনবাদ দশ-ক্লাসের বদলে পড়ানো হবে বারো-ক্লাসে। এটা বুঝতে অসুবিধে হয় না যে এটা কুযুক্তি, কারণ উচ্চমাধ্যমিকে শুধুমাত্র যারা বিষয় হিসেবে জীববিজ্ঞান নেবে তারাই এটা পড়ার সুযোগ পাবে। মাধ্যমিকের পর সিংহভাগ ছাত্রছাত্রী পড়া ছেড়ে দেয়। যারা উচ্চমাধ্যমিক পড়ে তাদের মধ্যে যারা আর্টস বিষয় নেয় তারা জীববিজ্ঞান পড়ে না। যারা বিজ্ঞান নেয়, তাদের মধ্যেও অনেকেই বায়োলজি নেয় না কারণ ওটা ঐচ্ছিক। ফলে অল্প কিছু ছাত্রছাত্রী যারা বায়োলজি পড়বে তারাই একমাত্র বিবর্তনবাদ জানবে, যদিও এটা সকলের জানা দরকার।

বিবর্তনবাদের ইতিহাস

এবার বিবর্তনবাদের ইতিহাসটা একটুখানি ব্যাখ্যা করে বলি।

আগেই বলেছি, একটা সময় মনে করা হতো সমস্ত কিছু স্থায়ী, পরিবর্তনহীন। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে, এভাবেই আছে, এভাবেই থাকবে। এভাবেই সৃষ্টির একটা উদ্দেশ্য ছিল। মানুষ ঈশ্বরের সর্বোত্তম সৃষ্টি। তার প্রয়োজনেই বাকি সমস্ত কিছু। এভাবেই পুরো জীবজগতের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা হতো। এটাকে বলে ন্যাচারাল থিওলজি।

ধীরে ধীরে নানা জায়গায় ফসিল আবিষ্কার হতে থাকলো। ফসিলগুলো পাওয়া গেল অদ্ভুত অদ্ভুত জায়গায়, যেমন মাছের জীবাশ্ম দেখা যাচ্ছে পাহাড় এর ওপরে। তখন বলা হলো, সৃষ্টিকর্তা যখন সৃষ্টি করছিলেন তখন যেগুলো বেঠিকভাবে সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে, ঠিকঠাক দাঁড়ায়নি, সেগুলিকে প্রাণপ্রতিষ্ঠা না করে ফেলে দিয়েছেন। ওগুলোকেই আমরা ফসিল হিসেবে খুঁজে পাচ্ছি। কিন্তু কিছুদিন পরেই বোঝা গেল যে, এইরকম চিন্তার একটা সমস্যা আছে। সমস্যাটা হচ্ছে, যে ফসিলগুলো আমরা পাচ্ছিলাম তার সংখ্যাটা জীবিত প্রাণীর থেকেও অনেক বেশি। তার মানে ব্যাপারটা দাঁড়ায় যে, যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি ভুল করেছেন বেশি, আর ঠিক করেছেন কম। ফলে এই চিন্তার প্রবক্তারা পড়ছিলেন বেকায়দায়।

এই পরিস্থিতিতে নানা জায়গায় ফসিলের উপস্থিতির কারণটা বোঝার দরকার হয়ে পড়ল। সেই সময় লামার্ক প্রথম বললেন যে বিবর্তন হয়। এগুলো হচ্ছে আগেকার প্রাণী, যারা এখন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তাদেরকেই আমরা এখন ফাসিলের রূপে দেখতে পাচ্ছি। বিবর্তনটা তাহলে কীভাবে হয়? প্রক্রিয়াটা কী? এ সম্পর্কে লামার্ক একটা তত্ত্ব দিয়েছিলেন, কিন্তু আজ আমরা বুঝি যে সেই তত্ত্বটা ভুল ছিল। কিন্তু এর গুরুত্বটা এখানেই যে তিনিই প্রথম টেবিল চাপড়ে বলেছিলেন, জীবজগতে বিবর্তন হয়।

এইভাবে বিবর্তনের ধারণাটা যখন প্রথম দানা বাঁধছে, তখনই একটা খুব প্রভাবশালী বই প্রকাশিত হয়। লেখক হচ্ছেন একজন পাদ্রি, উইলিয়ান প্যালী। তাঁর যুক্তিধারাটা লক্ষ্য করুন। তিনি লিখছেন, ধরুন আপনি একটি জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন। যেতে যেতে দেখলেন, একটা পাথর পড়ে আছে। আপনার মনে কি কোনও প্রশ্ন জাগবে? না। কারণ পাথর তো থাকতেই পারে। পাথর তো আছেই জঙ্গলের এখানে ওখানে। কিন্তু মনে করুন, জঙ্গলে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন এবং দেখলেন যে একটা হাতঘড়ি পড়ে আছে। তাহলে কি আপনার মনে কোনও প্রশ্ন জাগবে না? অবশ্যই জাগবে। হাতঘড়িটার তো ওখানে থাকার কথা নয়। তাহলে আপনি কী করবেন? হাতঘড়িটা তুলে দেখবেন। তুলে যখন ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখবেন, তখন বুঝবেন যে এটার মধ্যে একটা যান্ত্রিক ব্যবস্থা আছে, সেই অনুযায়ী এটা কাজ করে। আপনি অবশ্যই বুঝতে পারবেন যে এর একটা ডিজাইন বা নকশা আছে, এটার পেছনে একটা পরিকল্পনা আছে। প্যালী বলছেন, ডিজাইন যদি থাকে তো ডিজাইনার থাকতে বাধ্য। মানে এই যে ঘড়িটা, তার কেউ না কেউ একজন পরিকল্পনাকার আছে।

তারপর তিনি বললেন, আপনি আপনার চারিদিকে জীবজগতের দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন। বেশি জায়গায় তাকাতে হবে না, মানুষের চোখের দিকেই তাকিয়ে দেখুন। চোখটা একটা জটিল মেশিন। লেন্স আছে, রেটিনা আছে, সেখানে গিয়ে আলোটা পড়ে, সেটাকে ফোকাস হতে হয়। আমরা যখন কাছে তাকাচ্ছি তখন একরকম ফোকাস, দূরের জিনিসের জন্য আরেক রকম। এত কিছু করতে পারছে এই চোখ জিনিসটা, কারণ তার পিছনে একটা পরিকল্পনা আছে। ইফ দেয়ার ইজ এ ডিজাইন, দেয়ার ইজ এ ডিজাইনার।

আজকের দিনেও কিন্তু এই ধরনের চিন্তার লেজটাকে ধরে অনেকে চলছেন এবং একে বলছে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন। ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন তত্ত্ব বলছে, এই জীবজগতে যা দেখতে পাচ্ছি সমস্তটাই একজন বুদ্ধিমান পরিকল্পনাকারের সৃষ্টি।

ডারউইন যখন বিগল জাহাজে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছেন তখন তাঁর হাতে যে বইগুলো ছিল মধ্যে লায়েলের জিওলজি বইএর প্রথম খণ্ড ছিল (দ্বিতীয় খণ্ডটা পরে আনিয়েছিলেন) আর প্যালীর লেখা ওই বইটাও ছিল। এবং তখন তিনি খ্রিষ্ট-ধর্মাবলম্বী এবং মোটামুটি এই বইটার যুক্তিধারায় সন্তুষ্ট। কিন্তু তিনি ছিলেন খোলা মনের মানুষ। তাই সন্তুষ্ট হলেও তিনি সারাক্ষণ নিজেকে প্রশ্ন করছেন; যেগুলো দেখছেন সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন করছেন। গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে যখন গেলেন, দেখলেন সেখানে নানা রকমের ফিঞ্চ পাখি। এক এক প্রজাতির ফিঞ্চের ঠোঁটগুলো আলাদা আলাদা রকম। তাঁর মনে প্রশ্ন উঠল, এমন কেন হলো?

এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে আমরা যখন আশপাশটা দেখি, তখন শুধুই দেখি, পর্যবেক্ষণ করি না। এটা আমাদের একটা শিক্ষার মধ্যে থাকা উচিত — আশেপাশে যা দেখি সেটা দেখবো না শুধুমাত্র, পর্যবেক্ষণও করব। তিনি দেখলেন যে নানা রকম ঠোঁটের ফিঞ্চ পাখি আলাদা আলাদা জিনিস খায়। কেউ ঘাসের দানা খায়, কেউ পোকা খায়, এরকম নানান রকমের জিনিস খায়। এগুলো খাওয়ার জন্য তাদের ঠোঁটগুলো বিশেষভাবে বিবর্তিত হয়েছে। ওই দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন দ্বীপে তিনি গিয়ে দেখলেন যে বড় বড় কচ্ছপ আছে। ডারউইন লক্ষ্য করলেন এক একটা দ্বীপের কচ্ছপের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। কী করে হলো? এটাই হল দেখা আর পর্যবেক্ষণ এর পার্থক্য।

এই ‘কী করে হল?’ প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনি ধীরে ধীরে পৌঁছলেন বিবর্তন-তত্ত্বে। 1836 সালে ইংলন্ডে ফেরার পর বছর তিনেকের মধ্যে তাঁর তত্ত্বের রূপরেখাটা দাঁড় করিয়ে ফেলেন। কিন্তু প্রকাশ করলেন তার কুড়ি বছর পরে। কেন? এটাই হচ্ছে বিজ্ঞানের একটা বড় শিক্ষা : কোনও চিন্তা মাথায় এলেই হয় না, সেটা সঠিক না বেঠিক তা নানাভাবে পরীক্ষা করতে হয়। তিনি নানাভাবে নিজের তত্ত্বটাকে পরীক্ষা করে গিয়েছেন। তিনি যেভাবে এটা করছেন তা আজকের দিনেও বিজ্ঞানীদের কাছে শিক্ষনীয়। তিনি নিজের তত্ত্বকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেননি, নিজের তত্ত্বের ভুল ধরার চেষ্টা করেছেন। কোন প্রশ্নটার উত্তর দিতে পারছেন না সেটা তিনি বারবার নোট করছেন। এটা গুরুত্বপূর্ণ।

তাঁর পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য। করলেন। প্রথমত, প্রাণী জগতে প্রত্যেকটা প্রজাতির মধ্যে প্রকারণ বা ভেরিয়েশন আছে। দুটো হরিণ একরকম নয়, দুটো বাঘও একরকম নয়। কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য তাদের হরিণ বা বাঘ বলে চেনা যায়, কিন্তু কিছু পার্থক্য থাকেই। দ্বিতীয়, প্রত্যেক জীবেরই যত বাচ্চা জন্মায় তার একটি অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশই বড় হয়ে পরবর্তী প্রজন্মের জন্ম দিতে পারে। তৃতীয় পর্যবেক্ষণ হল এই যে, প্রত্যেকটা প্রাণীই তার আশেপাশের জগতের সাথে দ্বন্দ্বে অবস্থান করে। বেঁচে থাকতে তাকে খাদ্য সংগ্রহ করতে হয়, শিকারী প্রাণী থেকে আত্মরক্ষা করতে হয়। এই খাদ্য সংগ্রহ ও আত্মরক্ষা, অথবা বাঁচার জন্য যা প্রয়োজন সেগুলো করতে তারাই সফল হবে যারা পরিবেশের সঙ্গে ঠিকভাবে মানিয়ে নিতে পেরেছে, অর্থাৎ অভিযোজিত বা অ্যাডাপটেড হয়েছে। এই দিক থেকে প্রকারণগুলির মধ্যে পার্থক্য থাকে। কেউ বেশি অভিযোজিত, কেউ কম। তাই প্রকারণগুলির মধ্যে কোনওটির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি, কারও কম।

তাহলে কোনও প্রজাতির মধ্যে প্রকারণগুলির কোনও কোনওটি প্রাকৃতিক পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারবে, পরবর্তী প্রজন্মের জন্ম দিতে পারবে, আর কেউ পারবে না। যারা পরবর্তী প্রজন্মের জন্ম দিতে পারবে তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য অপত্যের মধ্যে সঞ্চারিত হবে। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রজাতিটির মধ্যে প্রকারণগুলির অনুপাত পাল্টাতে থাকবে। যে যে প্রকারণ সেই পরিবেশে অভিযোজনে সহায়ক নয়, সেগুলি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। পরিবেশই নির্বাচন করছে কী কী শারীরিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত জীব টিকে থাকবে। একে তিনি বললেন প্রাকৃতিক নির্বাচন। দেখালেন, এই প্রাকৃতিক নির্বাচনই জীববিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি।

এটা বললেন বটে, কিন্তু তিনি নিজে তাঁর বইতে লিখছেন, আমার তত্ত্বের ভিত্তিই হচ্ছে প্রত্যেক প্রজাতিতে প্রকারণের অস্তিত্ব, অথচ প্রকারণ কেন হয় তা আমার তত্ত্ব থেকে পাওয়া যায় না। তিনি নিজে বুঝতে পেরেছেন যে এটা তাঁর তত্ত্বের একটা দুর্বলতা। বের করতে হবে এর উত্তর। এটাও কিন্তু বিজ্ঞানের চিন্তাধারার একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক : কুড়ি বছর ধরে তিনি তাঁর তত্ত্বের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। তারপর যখন প্রকাশ করছেন তখন পরিষ্কারভাবে বলছেন এই প্রশ্নটার উত্তর এখনও পর্যন্ত আমি জানি না। এটা বিজ্ঞানের নৈতিকতার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। যে উত্তর তিনি দিতে পারেননি, সে উত্তর পরে জানা গেছে জিনতত্ত্ব আসার পরে। ছাত্ররা ডারউইনের আবিষ্কার সম্বন্ধে জানলে বিজ্ঞানের নৈতিকতার এই গুরুত্বপূর্ণ দিকও শিখবে।

বর্তমানে একটা প্রশ্ন এসেছে এটা তো শুধুমাত্র একটা তত্ত্ব, এমন একটা তত্ত্ব, যাকে প্রমাণ করা যায় না। না, তা নয়! বিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে? আমরা যখন কোনও একটা বিষয় পর্যবেক্ষণ করি, সেটাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। এই ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রাথমিকভাবে যেটা করেন তা হচ্ছে, এখনও পর্যন্ত যা জ্ঞান আছে তার ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক অনুমান করা। এটাকে বলে হাইপোথিসিস। কোনও অলীক কল্পনা নয়, বৈজ্ঞানিক অনুমান। একজন যখন হাইপোথিসিস তৈরি করেন, তখন সেটাকে সে নিজে বা অন্য বিজ্ঞানীরা হাজারভাবে পরীক্ষা করে দেখেন। যখন অনেকগুলো এরকম তত্ত্ব থাকে তখন আরও সুবিধে। প্রত্যেকটা তত্ত্বের ক্ষেত্রেই বার করা হয় সেই তত্ত্বটি ঠিক হলে কোন পরীক্ষায় কী দেখতে পাওয়ার কথা। পরীক্ষা করে দেখা হয় যে এগুলো সত্যি সত্যি হচ্ছে কিনা। যদি না হয় তাহলে সেই তত্ত্বটা ভুল। অর্থাৎ বিজ্ঞানের এগোনোর পদ্ধতি হচ্ছে যে কোনও একটা বিষয়কে ব্যাখ্যা করার জন্য যতগুলো সম্ভাব্য হাইপোথিস আছে সেগুলোকে তৈরি করা। তারপর পরখ করে যেগুলো ভুল, সেগুলোকে বাতিল করা। এভাবেই কিন্তু বিজ্ঞানের সমস্ত তত্ত্ব নির্মাণ হয়।

ডারউইন কুড়ি বছর ধরে সেটাই চেষ্টা করে গিয়েছেন। বিবর্তনের ব্যাখ্যা হিসেবে প্রাকৃতিক নির্বাচন ছিল তাঁর হাইপোথিসিস। সেইটাকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করে গিয়েছেন। পারেননি। তখন তিনি বলছেন যে এটাই তাহলে আমার তত্ত্ব।

বিবর্তনবাদ বিজ্ঞানমনস্কতার ভিত্তি

ডারউইনের তত্ত্ব দেখালো, জীবজগৎ পরিবর্তনশীল। সেই পরিবর্তনের বাস্তব নিয়ম আছে। তার ভিত্তিতে প্রত্যেকটা জীবের উদ্ভবই ব্যাখ্যা করা যায়। তার জন্য ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইনের কল্পনার প্রয়োজন হয় না। তাঁর তত্ত্ব দিয়ে প্রথম আমরা বিবর্তন কেন হয় তার একটা যুক্তিসিদ্ধ বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা পেলাম।

ডারউইন সেটা প্রকাশ করার পর থেকে প্রবল বিতর্ক হয়েছে। ডারউইন তত্ত্বের ফলে তখনকার দিনের যে ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতা ছিল, তার ওপরে এক বড় আঘাত পড়েছিল। তাই তখন বিভিন্নভাবে ডারউইনবাদকে খণ্ডন করার চেষ্টা হয়েছে। ডারউইন তাঁর ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ বইটা প্রকাশ করেছেন 1859 সালে। 1860 সালেই একটা বিতর্ক সভার আয়োজন করা হয়। ডারউইন নিজে কোনও বিতর্কে অংশগ্রহণ করতেন না। তাঁর হয়ে তাঁর একজন সমর্থক থমাস হাক্সলি বিতর্কে অংশগ্রহণ করলেন। এবং তার উল্টোদিকে ডারউইন-বিরোধী পক্ষের হয়ে বিশপ উইলবারফোর্স বলে একজন অবতীর্ণ হলেন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে কতগুলো বিতর্ক ঐতিহাসিক হয়ে আছে। একেকটা বিতর্ক সেসময়ের চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দেয়, এটিও সেরকমই একটি বিতর্ক। সেখানে বিশপ উইলবারফোর্স হাক্সলিকে ব্যঙ্গ করে বলছেন, আচ্ছা আপনি কোন দিক থেকে বাঁদর থেকে এসেছেন? মায়ের দিক থেকে না বাবার দিক থেকে? আপনার কোন দিকের পূর্বপুরুষ বাঁদর ছিল? এরকম ব্যঙ্গাত্মক আক্রমণের সামনেও হাক্সলি কিন্তু খুব শান্তভাবে যুক্তি দিয়ে ডারউইনবাদকে দাঁড় করিয়েছেন।

সেখানে তিনি জিতেছিলেন কি হেরেছিলেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেমন গ্যালিলিও জিতেছিলেন কি হেরেছিলেন, তাকে কী শাস্তি দেওয়া হয়েছিল সেটা বড় কথা নয় কারণ দেখা গেল যে গ্যালিলিওর জীবৎকালের অল্পদিনের মধ্যেই চিন্তাশীল মানুষ তাঁর বক্তব্য গ্রহণ করেছে। তাঁর মৃত্যুর বছর চল্লিশেকের মধ্যেই তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে জন্ম নিল নিউটনের গতিসূত্র।

ডারউইনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। চিন্তাশীল মানুষ তাঁর বক্তব্য গ্রহণ করেছে। গ্রহণ করেছে কেন? কারণ যতজন যতভাবে সেটাকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে তারা সবাই ব্যর্থ হয়েছে। এই কারণে গ্রহণ করেছে। কিন্তু লোকের মনে যদি অন্ধতা কুসংস্কার গোঁড়ামি গেঁথে থাকে তাহলে কিন্তু সে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করে না। তাহলে শুধুমাত্র সে ভুল বলতেই থাকে। এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।

অনেকেই মনে করে যে আমেরিকা খুব অগ্রসর দেশ, কিন্তু সেখানেও কিছু কিছু রাজ্য আছে যেখানে ডারউইনবাদ পড়ানো হয় না। কিছু রাজ্য আছে যেখানে ডারউইনবাদ এবং ঈশ্বরের সৃষ্টিতত্ব দুটো পাশাপাশি পড়ানো হয়। ছাত্রছাত্রীরা যেটা বিশ্বাস করতে চায় করুক। সে দেশে একটা সময় ডারউইনবাদ পড়ানো হবে কি হবে না সেটা নিয়ে কোর্ট কেস হয়েছে। ডারউইনবাদ যেখানে পড়ানোর কথা নয় সেখানে একজন শিক্ষক তা পড়াচ্ছিলেন, এবং সেই জনা তাঁকে জরিমানা দিতে হয়েছে। অনেক ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে এখনও ডারউইনবাদ পড়ানো হয় না। আধুনিক যুগেই এত বাধা পেরিয়ে সত্যকে এগোতে হয়েছে। ফলে যেখানে অন্ধতা-গোঁড়ামি দিয়েই পরবর্তী প্রজন্মের মন তৈরি করার চেষ্টা করা হয়, সেখানে ডারউইনবাদ যাতে পড়ানো না হয় সেই প্রচেষ্টা থাকে। ইতিহাস তাই বলছে।

আমাদের দেশে অন্তত এই পরিস্থিতিটা ছিল না। আজকে আমাদের সেইটার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যে শিক্ষাব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেছিলেন বিদ্যাসাগরের মতো মানুষেরা, শিক্ষাক্ষেত্রে যেগুলো বুনিয়াদি চিন্তা, যেগুলো স্কুলে পড়ানো উচিত, সেগুলোকে ঠিকভাবে চিহ্নিত করে পাঠ্য বই লিখে, যে শিক্ষাব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিলেন সেটাকে ভাঙাটা সহজ হয়নি। কিন্তু আজকে সেই ভাঙার প্রচেষ্টাই দেখছি নানা দিক থেকে। শিক্ষা ব্যবস্থাটাকেই পাল্টে দেবার চেষ্টা হচ্ছে এমনভাবে, যাতে আগামী প্রজন্মে বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ে না ওঠে।

বিজ্ঞানমনস্কতার প্রধান ধাপটাই হচ্ছে যৌক্তিকতা। যুক্তি দিয়ে সমস্ত কিছুকে চিন্তা করা। আর ধর্মীয় কুপমন্ডুকতা থেকে মুক্ত হয়ে যুক্তি দিয়ে চিন্তা করার সুন্দর প্রকাশ আমরা দেখেছি ডারউইনবাদের মধ্যে। সেটা পড়ানো হবে না তাহলে কীভাবে যুক্তিভিত্তিক চিন্তা ভাবনা তৈরি হবে? বস্তুজগতের সবকিছুই পরিবর্তনশীল, এই পরিবর্তনের বস্তুগত নিয়ম আছে, কারো ইচ্ছা-অনিচ্ছায় তা হয় না, বস্তুর পরিবর্তনের নিয়মকানুন মানুষ জেনেছে এই ধারণাগুলোই হল বিজ্ঞানমনস্কতার ভিত্তি।

ফলে যুক্তিভিত্তিক চিন্তাপদ্ধতিকে ভেঙে দেওয়াই আসল উদ্দেশ্য। এতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ে উঠতে না দেওয়ার চেষ্টা নানাভাবে হয়েছে। এবারে একটা খুব সুপরিকল্পিত, সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে যাতে যৌক্তিকতাকে এগোতে না দেওয়া হয়।

আমাদের দেশে বহুদিন আগে থেকেই দুটো চিন্তার মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব চলছে। একটা হল যুক্তিসঙ্গত বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা, আরেকটা হলো অন্ধতা-গোঁড়ামির চিন্তা। তাদের মধ্যে এই যে দ্বন্দ্ব-বিরোধ, তার ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে দেশটা এগোবে না পিছোবে। কোনও একটি সমাজ এগোবে কি এগোবে না সেটা নির্ভর করে মুক্তিবাদ-বিজ্ঞানমনস্কতা সেখানে জায়গা করে নিতে পারছে কি পারছে না তার ওপরে।

ফলে আমাদের আজকে চিন্তা করতে হবে, আমরা কি আমাদের দেশকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব? নাকি ওনাদের হাতে ছেড়ে দেবো যারা দেশকে পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? এটা আমাদের প্রত্যেককে নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

সরকারপক্ষের দুরভিসন্ধি আমাদের রুখতে হবে। আমাদের প্রত্যেককে এই লড়াইয়ে সৈনিকের ভূমিকা নিতে হবে। আমরা আশেপাশের সকলকে বলবো। রাস্তাঘাটে, হাটেবাজারে, বাসে-ট্রেনে গল্পগুজবের মধ্যে প্রশ্ন তুলবো। আমরা যে যেখানে আছি, সেখানেই কিছু না কিছু করার চেষ্টা করব। সমস্ত স্কুল-কলেজে আলোচনাসভা সংঘটিত করার চেষ্টা করব যেখানে ডারউইনবাদের সম্পর্কে আলোচনা হবে, কেন পড়ানো দরকার সেটা নিয়ে আলোচনা হবে। সর্বত্র যদি আলোচনাটা হয়, এই নিয়ে চিন্তাভাবনা হয়, বিতর্কে আসে, তাহলে ওরা শিক্ষানীতি পরিবর্তন না করে পারবে না।

লেখক পরিচিতি: অধ্যাপক ব্যানার্জী IISER-কলকাতার পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপনায় যুক্ত এবং ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির সর্বভারতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক।

ইন্ডিয়া মার্চ ফর সায়েন্স - কলকাতা অর্গানাইজিং কমিটির আহবানে 31 মে, 2023 NCERT'র দশম শ্রেণীর পাঠ্যক্রম থেকে ডারউইনের বিবর্তনবাদ ও বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অধ্যায় বাতিলের প্রতিবাদে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের মেঘনাদ সাহা অডিটোরিয়ামে আয়োজিত কনভেনশনে অধ্যাপক সৌমিত্র ব্যানার্জী যে বক্তব্য রেখেছিলেন তা পরিমার্জিত আকারে প্রকাশ করা হল। এই কাজে সাহায্য করেছেন শ্রী সুরজিত সাহা।