বিভাগগুলি

ভারতীয় ভাববাদের উদ্ভব ও উৎস

Created with Dalle-3

সুব্রত গৌড়ী

একটা কথা বহুল প্রচলিত যে, আমাদের সভ্যতা হলো পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা। ইউরোপের সভ্য দুনিয়ার মানুষ যখন বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতো তখন এদেশে মুনি ঋষিরা আশ্রমে বসে জ্ঞানচর্চা করত, পরম ব্রহ্ম-এর সাথে একাত্মতার জন্য ধ্যানে মগ্ন থেকেই দিন যাপন করতো। অনেকেই ধরে নেন মুনি ঋষি মানেই তারা অধ্যাত্মবাদের প্রতিভূ। তাই কিছু মানুষ যখন প্রচার করতে থাকে যে, এই দেশটা হলো অধ্যাত্মবাদের দেশ, ভারতের প্রাচীন সভ্যতার সূচনাপর্ব থেকেই এ দেশে অধ্যাত্মবাদ বা ভাববাদের চর্চা হয়েছে, তখন বহু মানুষই বিভ্রান্ত হন এবং ভাবতে থাকেন, এটাই বোধহয় সত্যি। কিন্তু আমরা যদি প্রাচীন সমাজের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস পর্যালোচনা করি, তাহলে আমাদেরকে এর ঠিক বিপরীত ধারণাতেই উপনীত হতে হবে।

নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে প্রাচীন সমাজের যে ইতিহাস জানা গেছে, তাতে আমরা দেখেছি যে, পৃথিবীর সমস্ত প্রাচীন সমাজে মানুষের চিন্তা ছিল বস্তুতান্ত্রিক। সেই সমাজে মানুষ বস্তুকে নিয়েই চিন্তা করেছে; যখন শক্তির কথা ভেবেছে,তখন বস্তুর শক্তির কথাই ভেবেছে। বস্তু বহির্ভূত কোনও শক্তির কথা মানুষ ভাবেনি, ভাববার মতো পরিস্থিতিও তখন তৈরি হয়নি।

পরবর্তীকালে সমাজ প্রগতির একটা বিশেষ সময়ে যখন স্থায়ী সম্পত্তির সৃষ্টি হয়েছে এবং তাকে কেন্দ্র করে সমাজ শ্রেণি বিভক্ত হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে রাষ্ট্র,রাষ্ট্রের শাসনে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শৃঙ্খলা, তখন মানুষের চিন্তায় এই বিষয়টা ধাক্কা দিয়েছে যে, একজন শাসক আছে বলেই সমাজে শৃঙ্খলা এসেছে,তাই এই বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে যে শৃঙ্খলা কাজ করছে, তার পিছনেও নিশ্চয় এমন কোনও শক্তি বা শাসকের ভূমিকা আছে। এখান থেকেই বস্তু বহির্ভূত শক্তি বা ঈশ্বরের চিন্তার আবির্ভাব। সেই সময় থেকেই এসেছে ভাববাদী চিন্তা।

সমাজবিকাশের এই সাধারণ নিয়মের বাইরে কেউ থাকতে পারেনা। তাই আমাদের দেশের সমাজও এই নিয়মেই বিকশিত হয়েছে। আমাদের দেশে প্রাচীনকালের যে সমাজের একটা ধারাবাহিক ইতিহাস জানা যায়, সেই সমাজ হল আর্য সমাজ বা বৈদিক সমাজ। খ্রিঃপূঃ ১৫০০ সালের কাছাকাছি সময়ে আর্যরা এদেশে এসেছিল। আর্যদের মহান কীর্তি হল বৈদিক সাহিত্য। এটি প্রায় এক হাজার বছর ধরে লেখা হয়েছে।বেদের সবচেয়ে প্রাচীন ভাগ হল ঋক বেদ এবং সবার শেষে লেখা হয়েছে উপনিষদ। তাই একে বেদান্ত নামেও অভিহিত করা হয়। ঋক বেদ থেকে উপনিষদ - ধারাবাহিকভাবে বিশ্লেষণ করলে আমরা চিন্তার ক্রম পরিবর্তনের এক সুস্পষ্ট রূপরেখা পাই। ঋক বেদের মধ্যে বস্তুতান্ত্রিক চিন্তারই প্রতিফলন পাওয়া যায়। কিন্তু উপনিষদের মধ্যে আমরা ভাববাদী চিন্তার সুস্পষ্ট প্রকাশ দেখতে পাই।

এদেশের আদি(অনার্য) সমাজ থেকেও লোকায়ত, সাংখ্যের মতো কয়েকটি দার্শনিক চিন্তার স্ফুরণ ঘটেছিল, যা বস্তুতান্ত্রিক ভাবনাকেই প্রতিফলিত করে।

তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ভারতে প্রাচীনকালে বস্তুতান্ত্রিক চিন্তাই মানুষের চিন্তাজগতকে পরিচালিত করেছিল। সেই বস্তুতান্ত্রিক পরিমন্ডলে কীভাবে ভাববাদী চিন্তার স্ফুরণ হল, সেই বিষয়টি আলোচনা করার লক্ষ্যেই বর্তমান প্রবন্ধের অবতারণা।

মূলত তিনটি দার্শনিক মতবাদ ভারতে ভাববাদী দর্শনকে প্রতিনিধিত্ব করেছে। সেগুলি হল, অদ্বৈত বেদান্তবাদ', 'শূন্যবাদ', ও 'বিজ্ঞানবাদ'। এদের মধ্যে প্রথমটি এসেছে উপনিষদের ঐতিহ্য থেকে এবং শেষের দুটি এসেছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে। এছাড়াও উপনিষদের ঐতিহ্য থেকে আর একটি মতবাদের জন্ম হয়েছিল। সেটি হল দ্বৈতবাদ। বেদান্ত দর্শনের একটি উপশাখা হিসেবে পরবর্তীকালে এই দর্শনের উদ্ভব। আমরা বর্তমান প্রবন্ধে প্রধান তিনটি ভাববাদী দর্শনের উপর আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।

ভারতে ভাববাদের প্রথম প্রকাশ:উপনিষদ

ভারতবর্ষে ভাববাদী চিন্তার প্রথম স্পষ্ট প্রকাশ পাওয়া যায় উপনিষদে (খ্রি:পু: সপ্তম-ষষ্ঠ শতক)।উপনিষদে ভাববাদী দার্শনিক চিন্তার বাহক হিসেবে রাজা অজাতশত্রু, ঋষি যাজ্ঞবল্ক এবং এমনকী দেবতা প্রজাপতি ও ইন্দ্রের নাম পাওয়া যায়। পরম সত্যের প্রকাশ হিসেবে যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, সেটি হল ব্রহ্মণ।উপনিষদে একে আর একটি শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা হয় - আত্মণ। এই আত্মা বা আত্মণকে উপনিষদের ভাববাদীরা বলেছেন বিজ্ঞান-ঘন (a mass of mere consciousness) বা কেবলমাত্র চেতনা(bare consciousness)। অন্যভাবে একেই বলা হয়েছে আনন্দ বা সৎ।

উপনিষদের প্রাচীন ভাববাদীরা বস্তুজগতের বাস্তব অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছেন, বাস্তব জগৎকে অলীক স্বপ্নের সাথে তুলনা করেছেন। ফলে তাঁরা মনে করতেন যে,প্রকৃতি সম্পর্কে কোনও ধারণা গড়ে তোলা যায়না, আমরা যা জানি বলে মনে করি, তা আসলে অলীক কল্পনা।


এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে,উপনিষদের যুগে দার্শনিক চিন্তার জন্ম হলেও তাকে সুনির্দিষ্ট দার্শনিক তাত্ত্বিক রূপ দেওয়া সম্ভব হয়নি। সেইযুগে যাঁরা এই চিন্তাকে নিয়ে এসেছেন, তাঁরা তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।কিন্তু সেই ব্যাখ্যা বা যুক্তিগুলো ছিল একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের। তাই উপনিষদে যে ভাববাদী চিন্তার প্রকাশ পাওয়া যায়, অবশ্যম্ভাবীরূপে তা ছিল প্রাথমিক পর্যায়ের।তখনও কোনও সিস্টেম অফ ফিলজফিক্যাল থটের জন্ম হয়নি। অর্থাৎ অন্যান্য দার্শনিক চিন্তার সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে একটি বিশেষ দার্শনিক তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করার যে ঐতিহ্য ভারতীয় দর্শন চিন্তার বিকাশের ইতিহাসে পরবর্তী সময়ে পাওয়া যায়,উপনিষদে তা পাওয়া যায়না।

ভাববাদী দর্শনের প্রথম প্রকাশ:মহাযান বৌদ্ধমত

উপনিষদের যুগের পরবর্তী ছ'শ বছরে অর্থাৎ খ্রি:পূ: ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতক পর্যন্ত আমরা উপনিষদের এই চিন্তার কথা শোনা যায়নি। ফলে বোঝা যায় এই ছ'শ বছরে উপনিষদ নিয়ে চর্চা বিশেষ হয়নি। অর্থাৎ এই সময়কালে ভারতে বস্তুবাদী চিন্তার প্রাধান্য ছিল।সেইজন্যই এই সময়ে বিজ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে তা সহায়ক ছিল।

খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে ভাববাদী চিন্তার পুনর্জন্ম হয়।বিস্ময়কর হলেও এটা সত্য যে,যে দার্শনিকরা এই পুনর্জন্ম ঘটালেন,তাঁরা বুদ্ধের অনুগামী। গৌতম বুদ্ধ নিজে নিজশ্বরবাদী ছিলেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের রক্ষণশীল অংশ যাদের হীনযান বলা হয়, তারা বৌদ্ধ ধর্মের সাবেক চিন্তা নিয়ে চললেও আরেক অংশ যারা নিজেদের মহাযান হিসেবে পরিচয় দিতেন,তারা ভাববাদী চিন্তাকে আশ্রয় করে নতুন দার্শনিক মতবাদের জন্ম দিলেন। যে ধর্মগ্রন্থের উপর নির্ভর করে মহাযান বৌদ্ধরা ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তার নামকরণও তাঁরা নিজেরাই করেছিলেন।

মহাযান বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থের প্রকৃতি সম্পর্কে দুএকটি কথা বলা দরকার। যদিও তাঁরা উপনিষদে যে ভাববাদী চিন্তার প্রকাশ পাওয়া যায়, সেই চিন্তাকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন,তবু উপনিষদের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেননি, তা আড়াল করারই চেষ্টা করেছেন। কারণ উপনিষদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেই বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান।

এর ফলে মহাযান বৌদ্ধরা একটা কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়েছিলেন।ভারতীয় ভাববাদীরা সাধারণ অভিজ্ঞতা ও যুক্তিকে অবজ্ঞা করে এসেছেন এবং শাস্ত্র বচনের উপর নির্ভর করেছেন। অথচ বৌদ্ধ ধর্মের আদি শাস্ত্রে সাধারণভাবে রহস্যবাদ এবং বিশেষভাবে উপনিষদের বিরোধিতাই পাওয়া যায়। তাই তাঁরা তাঁদের চিন্তার সমর্থনে নতুন করে শাস্ত্র গ্রন্থ লিখতে বাধ্য হয়েছেন। এরই পাশাপাশি তাঁরা নানা ধরনের অলৌকিক কাহিনী বর্ণনা করেছেন, যাতে তাদের এই নতুন আমদানি করা চিন্তাকে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী করা যায়। এই শাস্ত্র গ্রন্থকে সাধারণভাবে বলা হয় মহাযান সূত্র। এই নতুন শাস্ত্র গ্রন্থে উপনিষদের চিন্তাকে সূচতুরভাবে ঢোকানো হয়েছে, যাতে ওই চিন্তাকে বৌদ্ধধর্মের মোড়কে পরিবেশন করা যায়।

কিন্তু মহাযান বৌদ্ধরা উপনিষদে যা ছিল শুধু তারই পুনরাবৃত্তি করেননি। উপনিষদে যেভাবে ভাববাদী চিন্তার অঙ্কুরকে ভিত্তি করে প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু কথা ঘোষণা করার মত করে বলা হয়েছে, শুধু তার পুনরাবৃত্তিতে কাজ হতো না।উপনিষদের যুগে যা স্বাভাবিক ছিল,৬০০ বছর পরে তা দিয়ে কাজ চলত না। কারণ এই ৬০০ বছরে বহু দর্শনের জন্ম হয়েছে বিশেষ করে বস্তুবাদী দর্শনের। ফলে উপনিষদের ভাববাদী চিন্তার প্রাথমিক ধারণাকে ভিত্তি করে পূর্ণাঙ্গ দার্শনিক তত্ত্বের জন্ম দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। এই কাজটিই করেছেন মহাযান বৌদ্ধরা। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন দার্শনিক ছিলেন।তাঁরা এও অনুভব করেছিলেন যে, মূল চিন্তার পাশাপাশি আনুষঙ্গিক আরও বহু বিষয়ে তাঁদের দর্শনকে সমৃদ্ধ না করতে না পার্কে তাকে সময়োপযোগী করা যাবেনা। ফলে ভাববাদী দর্শন আর প্রাথমিক পর্যায়েই রইল না। তাঁরা একে একটা সুসংহত দার্শনিক মতবাদে পরিণত করলেন।

বৌদ্ধ ঐতিহ্যে ভাববাদী দর্শন:'শূন্যবাদ' ও 'বিজ্ঞানবাদ'

মহাযান বৌদ্ধরা দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত -- মাধ্যমিক ও যোগাচার্য। মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের দার্শনিক মত হল শূণ্যবাদ এবং যোগাচার্য সম্প্রদায়ের দার্শনিক মত হল বিজ্ঞানবাদ।

মহাজান সম্প্রদায়ের ইতিহাসে সবচেয়ে পরিচিত নাম হল নাগার্জুন খ্রিস্টীয় প্রথম দ্বিতীয় শতাব্দীতে তিনি বেঁচে ছিলেন নাগার্জুন মাধ্যমিক নামটি গ্রহণ করেছিলেন প্রাচীন বুদ্ধমত মধ্যমা প্রতিপদ থেকে যার আদি অর্থ হলো মধ্যমপথ নৈতিক আচরণের ক্ষেত্রে এই মতে বিশ্বাসী রা মনে করতেন যে কিছু সাধন ও আমন আল্লাদের জীবন কোনটাই কাঙ্ক্ষিত নয় মাঝামাঝি পথে চলা উচিত কিন্তু নাগার্জুন এই ধারণাটির উপর অলৌকিক-অতীন্দ্রিয় ধারণা আরোপ করলেন। তিনি বললেন,এর অর্থ হল বাস্তবতা সম্পর্কে 'এটা আছে' এবং 'এটা নেই' - এরকম নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। সহজ কথায় এর অর্থ হল, বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। অর্থাৎ বাস্তবতা হলো অনির্বচনীয় এবং সেই জন্য বাস্তবতা হলো অলীক কল্পনা মাত্র, যে কথা উপনিষদে আরেকভাবে বলা হয়েছে।

নাগার্জুনের দার্শনিক মতবাদের আরেক নাম হল 'শূন্যবাদ',অর্থাৎ শূণ্য বা অস্তিত্বহীনতা। এর অর্থ হল, পরম সত্য বাস্তব জগতের ছদ্ম প্রকাশকে অতিক্রম করে বুঝতে হবে। অর্থাৎ বাস্তবে আমরা যা প্রত্যক্ষ করি তার বাইরে গিয়ে বুঝতে হবে। আমাদের চর্মচক্ষুতে যা ধরা পড়ে তার নিরিখে বিচার করলে সেই সত্যকে বোঝা যাবে না।এক কথায় তা অনির্বচনীয়।

শূন্যের ধারণাকে নাগার্জুন দুটো দিক থেকে বিচার করেছেন - দৃষ্টিগোচরতা এবং বাস্তবতা। দৃষ্টিগোচরতার নিরিখে এর অর্থ হল, বস্তু জগৎ বলে কিছু নেই; আছে শুধু শূন্যতা এবং অস্তিত্বহীনতা। অন্যভাবে বললে বোঝায়, প্রকৃতি জগত আসলে অলীক, শূন্যগর্ভ। একই সাথে পরম সত্য বা এ্যাব সলুটকে শূন্যতা হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে,যার অর্থ এর কোনও বিকাশ ও প্রকাশ নেই, নেই বহুমুখীতা বা বৈচিত্র্য। বিকাশ ও প্রকাশ কিংবা বহুমুখীতা ও বৈচিত্র্যময়তা দৃষ্টিগোচর পৃথিবীর বৈশিষ্ট্য।এই সমস্ত গুণাবলী রহিত যে বাস্তবতা, তাকেই শূন্যতা বলে বুঝতে হবে।এর অর্থ হল, পরম সত্য সম্পর্কে ধারণা জাগতিক ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সব রকমের জাগতিক ভাবনার সম্পূর্ণ বাইরে এর অবস্থান।

তিনি পরম সত্যের উপস্থিতি বিশ্বাস করতেন কিন্তু তিনি মনে করতেন যে এই সত্যের অবস্থান মানুষের চেতনার ঊর্ধ্বে। যদিও এই সত্যের অবস্থান মানুষের সাধারণ চেতনার বাইরে, তবুও একে এক ধরনের অলৌকিক সচেতনতার দ্বারা বোঝা সম্ভব; যাকে তিনি নাম দিয়েছিলেন প্রজ্ঞা-পারমিতা বা অতীন্দ্রিয় সর্বোচ্চ জ্ঞান। এটা অর্জন করার অর্থ হল কল্পিত বস্তুজগৎ থেকে মুক্তি বা নির্বাণ লাভ।

মাধ্যমিক দর্শনের প্রভাব পরবর্তী কয়েক শতকে পাওয়া যায় না নাগার্জুন এবং আর্যদেবের পর এই সময়কালে এই দর্শন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। ষষ্ঠ শতাব্দীতে দুজন গুরুত্বপূর্ণ শূন্যবাদী দার্শনিকের সন্ধান পাওয়া যায় --বুদ্ধ পালিত এবং ভব বিবেক। মধ্যবর্তী এই সময়কালে ভাববাদী দর্শনের অগ্রগতি ঘটেছে মহাযান বৌদ্ধদের আর এক সম্প্রদায় যোগাচার্য সম্প্রদায়ের হাত ধরে। তাদের মতবাদকে বলা হয় বিজ্ঞানবাদ বা বিজ্ঞপ্তি মাত্রতাবাদ বা নিরালম্বনবাদ।

মহাযান বৌদ্ধদের এই সম্প্রদায় নিজেদেরকে যোগাচার্য হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। কারণ তাঁরা দার্শনিক প্রজ্ঞা অর্জনের জন্য বহির্জগত থেকে চেতনাকে সরিয়ে নেওয়ার উপায় হিসেবে যোগ বা ধ্যানের আশ্রয় নিয়েছিলেন। বাস্তব জগতের বন্ধন থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে ধ্যান ও সম্মোহনের অর্থে যোগের কার্যকারিতা নিয়ে যোগাচার্যদের বহু লেখাপত্র পাওয়া যায়।

কিন্তু তাদের দার্শনিক মতবাদ সম্পর্কে আরও পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়, বিজ্ঞানবাদ বা বিজ্ঞপ্তি- মাত্রতা-বাদ নাম থেকে। বিজ্ঞান বা বিজ্ঞপ্তি বলতে মন বা চেতনাকে বোঝানো হয়েছে।এই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মতে মন হল চেতনার স্রোত বা আরও সহজ করে বললে ক্ষণস্থায়ী চেতনার প্রবাহ। বিজ্ঞানবাদীদের মতে এই অর্থে মনই হল সত্য বা কেবলমাত্র চেতনাই হল সত্য। স্বাভাবিকভাবেই এই দর্শনের মূল ঝোঁক হল বস্তুজগতকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করার দিকে। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা,ঘরবাড়ি - এগুলোর বাস্তব অস্তিত্ব আছে এবং এজন্যই এ সম্পর্কে ধারণা গড়ে ওঠে। কিন্তু এই দার্শনিকদের মতে কেবলমাত্র ভাবেরই অস্তিত্ব রয়েছে,ধারণা বা চিন্তার অনুসারী কোনও বাস্তব জিনিসের অস্তিত্ব নেই।

বিষয়টাকে তাঁরা আর একভাবে বলেছেন।তাঁদের মতে ভাব বা চেতনা তাদের নিজস্ব শক্তিতেই অবস্থান করে,কোনও বস্তুগত উপাদানের সাহায্য ছাড়াই। তাই এই দর্শনকে নিরালম্বনবাদও বলা হয়ে থাকে - এর অর্থ ভাব বা চেতনার জন্য কোনও বস্তুগত জিনিসের অবলম্বনে প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ ভাব বা চেতনা হল স্বয়ম্ভু।বস্তুজগতের কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই। যেহেতু ভাবই হল একমাত্র বাস্তবতা,তাই সাধারণভাবে যে বস্তু জগতকে আমরা দেখি তা অবাস্তব বা ভ্রমাত্মক।

বস্তুজগৎ সম্পর্কে ভারতীয় ভাববাদীদের একটা সাধারণ যুক্তি আমরা এখানে পাচ্ছি। তাদের বিচারে বস্তুজগত সম্পূর্ণরূপেই অবাস্তব। কিন্তু বাস্তবে মানুষ তাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় বস্তুজগতকেই প্রত্যক্ষ করে। এর ব্যাখ্যা কি হবে? ভাববাদীরা এর উত্তরে বলেন, বস্তু জগৎটা হল মায়া বা ভ্রম দর্শন - যেমন করে রজ্জুতে সর্পভ্রম হয়, বা মরীচিকায় জল দেখা যায়।

বিজ্ঞানবাদীদের এই বক্তব্য সম্পূর্ণ নতুন নয় এর মূল যুক্তিধারা আমরা ইতিমধ্যেই উপনিষদে পেয়েছি। যেমন যাগ্যবল্ক যে যুক্তি দিয়ে বস্তু জগতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছেন তার সাথে এর মিল পাওয়া যায়। তিনি বস্তু জগতের অবাস্তবতাকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন এইভাবে - স্বপ্নে যে বস্তু জগতকে দেখা যায় তা আত্মা বা মনেরই ক্রিয়া - মনই এসব কিছুর স্রষ্টা। ফলে মূল চিন্তাগত উপাদান উপনিষদেই ছিল। বিজ্ঞানবাদীরা এই ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির একটা তত্বগত ভিত্তি দিয়েছেন। কিন্তু উপনিষদের কাছে তাঁরা ঋণ শিকার করেন নি। কেমন করেই বা তারা প্রকাশ্যে ঋণ শিকার করবেন? কারণ তারা ঘোষিতভাবে বৌদ্ধ ধর্মমতে বিশ্বাসী।

বৌদ্ধ ঐতিহ্য থেকে যে দুটি ভাববাদী দর্শনের সংক্ষিপ্ত আলোচনা এখানে করা হল তা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে,পরিভাষায় পার্থক্য থাকলেও শূণ্যবাদ ও বিজ্ঞানবাদের মধ্যে মৌলিক কোনও পার্থক্য নেই।প্রথম দিকে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক বৈরিতা থাকলেও এই দার্শনিক সম্প্রদায় শেষ পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে ঐক্যমতের কথা স্বীকার করেন এবং তাঁদের আপাত পার্থক্যগুলো সরিয়ে রাখতে সমর্থ হন। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে শান্তরক্ষিত এবং তার শিষ্য ও ব্যাখ্যাকার কমলশীল এই ঐক্য সম্পন্ন করেন,যাদেরকে শূন্যবাদ এবং বিজ্ঞানবাদী দর্শনের সমন্বয়কারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এরই সাথে সাথে আরেকটি ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। এই সমন্বয়ের পর শান্ত রক্ষিত অনুভব করেন যে, মহাযান বৌদ্ধদের উপনিষদের অনুগামীদের সাথে দ্বন্দ্ব সংঘাতের কোনও বাস্তব পরিস্থিতি নেই। কারণ এই দুই দার্শনিক মতই বস্তু জগতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে এবং বিশুদ্ধ ভাব বা চৈতন্যকেই একমাত্র ও পরম সত্য বলে স্বীকার করে।

বিজ্ঞানবাদ ও শূন্যবাদের মধ্যে মৌলিক সমন্বয় স্থাপন এবং উপনিষদীয় ভাববাদের সাথে সাদৃশ্য স্বীকারের পর মহাযান বৌদ্ধদের দর্শন চিন্তা তার শেষ গন্তব্যে পৌঁছে গেল। দর্শন চর্চায় আগ্রহ কমে যাওয়ার পর তারা মুক্তি লাভের সহজ পন্থা অন্বেষণে বেশি করে মনোনিবেশ করল। তারা মনে করল প্রাচীন মন্ত্র তন্ত্র ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বা তন্ত্রসাধনার মধ্য দিয়ে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। পরবর্তী কয়েক শতকে একদিকে যেমন এই প্রবণতা অনেক বেড়ে গেল, আবার অন্যদিকে শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদী ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আক্রমণ তীব্র হল এবং তাদের হাতে বৌদ্ধমঠগুলি ধ্বংস হয়ে গেল। ফলে বৌদ্ধ দর্শনের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ল।

উপনিষদীয় ভাববাদী দর্শন:অদ্বৈত বেদান্ত

শূন্যবাদ ও বিজ্ঞানবাদ সংহত হওয়ার পর একটা সময় এসে গেল যখন ভারতীয় ভাববাদ তার আদি উৎস উপনিষদে ফিরে গেল। যদিও মহাযান বৌদ্ধরা ভাববাদী দর্শনচিন্তার যে পরিণত রূপ তৈরি করেছিল,সেখান থেকেই উপনিষদীয় ভাববাদ তার যাত্রা শুরু করেছিল। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে এটা দানা বাঁধতে থাকে এবং 'অদ্বৈত বেদান্ত'র রূপে তার প্রকাশ ঘটে।

আগেই বলেছি যে উপনিষদে ভাববাদী চিন্তা প্রাথমিক এবং সরলীকৃত রূপে ছিল,ভাববাদী দর্শনের উপাদান হিসেবে ছিল। কিন্তু একটা সুললিত ও সুসংবদ্ধ দার্শনিক মতবাদ হিসেবে ছিল না। মহাযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দার্শনিকরা ঐতিহাসিকভাবে প্রথম এই উপাদানগুলিকে ভিত্তি করে সুসংবদ্ধ দার্শনিক মতবাদের জন্ম দিয়েছিলেন। অদ্বৈত বেদান্তবাদীরা এই মতবাদ মহাযান বৌদ্ধদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন। যদিও হুবহু কপি করে নয়। অদ্বৈত বেদান্তবাদীরা তাদের মত করে কোথাও বেশি জোর দিয়েছেন, কোথাও নতুন পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। সেই অর্থে মহাযান বৌদ্ধ সম্প্রদায় যেমন উপনিষদের কাছে ঋণী, তেমনি অদ্বৈত বেদন্তবাদীরা মহাযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে ঋণী।কিন্তু নিজেদের গোষ্ঠী মানসিকতার জন্য কেউই কারোর কাছে ঋণ স্বীকারে প্রস্তুত নয়। আগেই বলেছি খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে মহাযান বৌদ্ধ দার্শনিক শান্ত রক্ষিত এই মত ব্যক্ত করেছিলেন যে,শূন্যবাদ ও বিজ্ঞানবাদের মধ্যে পার্থক্য যেমন মামুলি, তেমনি এই দুই দর্শনের সাথে অদ্বৈত বেদান্তের পার্থক্য তুচ্ছ,মৌলিক ধরনের নয়। এই বিষয়টাই উপলব্ধি করেছিলেন গৌড়পাদ, যিনি অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের প্রথম প্রকৃত প্রতিনিধি। তাঁর সময় কাল শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক - খ্রিস্টীয় অষ্টম শতক। অর্থাৎ মহাযান বৌদ্ধদের শেষ প্রতিনিধি প্রসিদ্ধ দার্শনিক শান্ত রক্ষিত যেমন উপনিষদের সাথে তাঁর দর্শনচিন্তার নৈকট্য ব্যক্ত করেছিলেন, তেমনি অদ্বৈত বেদান্ত সম্প্রদায়ের প্রথম প্রসিদ্ধ প্রতিনিধি গৌড়পাদ মহাযান বৌদ্ধদের সাথে তাঁর দার্শনিক মতবাদের সাদৃশ্যের কথা ব্যক্ত করেছেন।

ভারতীয় ভাববাদী দর্শনের পরবর্তী ইতিহাসে অদ্বৈত বেদান্তই সবচেয়ে প্রভাবশালী দর্শন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। অদ্বৈত বেদান্তের প্রভাব বেড়েছিল শঙ্করাচার্যের ভূমিকার দ্বারা। তিনি হয় পৌড়পাদের প্রত্যক্ষ শিষ্য অথবা তার শিষ্যের শিষ্য ছিলেন। কেরালার একটি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তার দর্শন চিন্তা প্রচারের জন্য তিনি সারা ভারত ভ্রমণ করেছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ভারতের চার প্রান্তে চারটি আশ্রম বা মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই মঠগুলিতে শঙ্কর বৌদ্ধ মঠের সাংগঠনিক নিয়ম নীতি প্রয়োগ করেছিলেন। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল পূর্ণ সময়ের ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তার প্রচারক রাখার বিধি। তার সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে এই মঠগুলি গড়ে তোলা ও তার পরিচালনার জন্য আর্থিক সংস্থান সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে তিনি যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়।এর পাশাপাশি তিনি তাঁর দার্শনিক চিন্তা অদ্বৈত বেদান্তকে ব্যাপক মানুষের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য বহু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সহজ সংস্কৃত গদ্যে সহজ করে দার্শনিক বিষয়ে লেখার ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে তুলনীয় ভূভারতে আর কেউ ছিল না। কিন্তু তিনি বেশিদিন বেঁচে থাকেননি, ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৩২ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন।

যে বিষয়ে সত্যিই বিতর্কের কোনও সুযোগ নেই সেটা হল তার দার্শনিক দক্ষতা।যদিও তিনি উপনিষদীয় ভাববাদকে উন্নত আঙ্গিকে পুনর্ব্যাখ্যা করেছিলেন,কিন্তু তার মধ্যে এমন কোনও মৌলিক বিষয় ছিল না যা তিনি মহাযান বৌদ্ধদের কাছ থেকে গ্রহণ করেননি। কিন্তু শংকর নিজে এই নেওয়াটাকে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন,তাদের প্রতি ঘৃণা ও অবজ্ঞাসূচক মন্তব্যের দ্বারা। বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে তিনি যেসব অভিযোগ এনেছেন দেখা গেছে যে, সেই একই বক্তব্য তিনি অনেক বেশি জোরের সাথে প্রচার করেছেন।যেমন, তিনি ঘৃণাভরে মন্তব্য করেছেন যে, শূন্যবাদীদের সাথে দার্শনিক আলোচনা করার কোনও উপযোগিতাই নেই,কারণ বাস্তব জ্ঞানের কোনও উৎস সম্পর্কে তাদের কোনও বিশ্বাস নেই এবং যারা কোনও যুক্তির ধার ধারে না,তাদের সাথে কিভাবে দর্শন আলোচনা করবেন?অথচ বাস্তবে জ্ঞানের অস্বীকৃতি এবং সাধারণভাবে যুক্তির অস্বীকৃতি হল শঙ্করের নিজের দার্শনিক মতের ভিত্তি। এমনকী তিনি তাঁর দার্শনিক আলোচনা শুরুই করেছেন এটা ঘোষণা করেই যে,তিনি যে দার্শনিক প্রজ্ঞার প্রতিনিধিত্ব করছেন সেখানে কোনও প্রকারের প্রমাণ বা বাস্তব জ্ঞানের কোনও স্থান নেই। তাঁর মতে শ্রুতি-স্মৃতির উপর নির্ভর না করে স্বাধীন যুক্তি তর্কের প্রতি যে কোনও প্রবণতাই অজ্ঞানের কুহেলিকায় দিশেহারা হতে বাধ্য। আবার বিজ্ঞানবাদীদের বিরুদ্ধে বলেছেন যে, তারা তাদের নিজের মায়ের বন্ধ্যাত্ব প্রমাণ করতে চায়; কারণ তারা খাদ্য খেয়েই বেঁচে থাকে, আবার সেই খাদ্যের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে।অথচ তাঁর নিজের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি দার্শনিকরা যে খাবার খায় বস্তুজগতের অন্যান্য জিনিসের মত সেই খাদ্যবস্তুকেও মায়া বলেই ব্যাখ্যা করেছেন এবং বিজ্ঞানবাদীদের মতো তার কাছেও এর কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই। শঙ্করের আধুনিক অনুগামীরা তাঁর অবস্থানকে রক্ষা করার জন্য বলেন যে, ব্যবহারিক জীবনের অর্থে তিনি যুক্তি বা বস্তু জগতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন না। শুধুমাত্র অতীন্দ্রিয় দৃষ্টিকোণ থেকে এদের সত্যতাকে অস্বীকার করেছেন। কিন্তু বাস্তবে এই দ্বৈত সত্যের ধারণাটিও মহাযান দার্শনিকদের উদ্ভাবন, শঙ্করের মৌলিক উদ্ভাবন নয়।

ভারতীয় ভাববাদী দর্শনের ইতিহাসে এরপর আমরা দেখেছি যে, অদ্বৈত বেদান্তবাদীরা, মায়া বা অবিদ্যা, যা বস্তু জগতের ছদ্ম প্রকাশের মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করে - সে বিষয়ে নানা ধরনের দার্শনিক আলোচনা করেছেন।

তাহলে এতক্ষণ ভারতীয় ভাববাদী দর্শনের যে রূপরেখা দেওয়া হল তা থেকে আমরা কি পেলাম? এদেশের ইতিহাসে প্রথম অনুমান মূলক চিন্তা বা ভাববাদী চিন্তার উপাদান পাওয়া যায় উপনিষদে। কিন্তু তখনও সুসংহত দার্শনিক তত্ত্বের উদ্ভব হয়নি। ভাববাদী চিন্তার যে অংকুর উপনিষদে ছিল তাকে পূর্ণাঙ্গ দার্শনিক তত্ত্বের রূপ দেন শূন্যবাদী এবং বিজ্ঞানবাদী দার্শনিকরা,যাঁরা মহাযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন অদ্বৈত বেদান্তবাদীরা,যাঁদের মায়াবাদীও বলা হয় এবং যাঁরা নিজেদেরকে উপনিষদের প্রত্যক্ষ অনুগামী বলে পরিচয় দেন।

বৈদিক ঐতিহ্যে ভাববাদী দর্শনের উৎস

ভারতীয় ঐতিহ্যে ভাববাদী দর্শনের উৎস বলতে আমরা উপনিষদকেই জানি। বেদের অর্থ হলো জ্ঞান। যে জনগোষ্ঠী নিজেদের আর্য বলে পরিচয় দিত, তাদের সাহিত্যকর্মের ফল হল বেদ। এরা উত্তর-পশ্চিম ভারতে এসেছিল যাযাবর মানব গোষ্ঠী হিসেবে। তাদের মূল জীবিকা ছিল পশু পালন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা একই সাথে সাহিত্যিক ক্ষমতা ও যুদ্ধবিগ্রহের পারদর্শী ছিল।

বেদের প্রথম দিকের লেখাগুলো ছিল কাব্যিক ঢঙে। তাদের কোনও লিপি ছিল না। মুখে মুখে তারা কবিতা তৈরি করত এবং কানে শুনে পরের প্রজন্ম তা জেনে যেত। তাই বেদের অপর নাম শ্রুতি বা 'যা শোনা যায়'। আমরা এগুলোকেই সংহিতা রূপে পাই। এদের মধ্যে প্রাচীনতম অংশকে বলা হয় ঋকবেদ। এছাড়াও আরো তিনটি বেদের কথা শোনা যায় - সামবেদ,যযুরবেদ ও অথর্ববেদ।

ঐতিহ্য অনুসারে বেদের দুই ভাগ - মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ। মন্ত্র ভাগ ছন্দোবদ্ধ কাব্য এবং বহু প্রাচীন। মন্ত্র সংকলন গুলিকে সাধারণত স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করার উদ্দেশ্যে সংহিতা আখ্যা দেওয়া হয়। ব্রাহ্মণ ভাগ গদ্যে রচিত এবং তুলনায় তা অনেক পরবর্তী হলেও প্রাচীন মন্ত্র সংকলন গুলির সাথে সংযোজিত হয়েছে। বিভিন্ন ব্রাহ্মণ গ্রন্থ বিভিন্ন মন্ত্র সংকলনের সাথে সংযুক্ত। কিন্তু সমস্ত ব্রাহ্মণ গ্রন্থেরই প্রধানতম আলোচ্য বিষয় হল বৈদিক ক্রিয়াকান্ড বা যাগযজ্ঞ।

এই ব্রাহ্মণ গ্রন্থ গুলির শেষে আর এক ধরনের রচনা সংযোজিত হতে দেখা যায়,তার নাম আরন্যক।আবার আরণ্যকগুলির শেষে আর এক ধরনের রচনা সংযোজিত - তার নাম উপনিষদ।

আরণ্যক ও উপনিষদ গুলিতে যাগযজ্ঞ বা ক্রিয়াকাণ্ড বিষয়ে আলোচনার পরিবর্তে দার্শনিক বা তত্ত আলোচনাই চোখে পড়ে। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক না কেন, বৈদিক দর্শনের ব্যাখ্যায় প্রাচীন আচার্য বা আধুনিক বিশেষজ্ঞরা আরণ্যক গুলির উপর খুব বেশি গুরুত্ব আরোপ করেননি, অন্তত তুলনামূলকভাবে উপনিষদ গুলির উপরই বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

ঋকবেদের প্রাচীন অংশের গান বা শ্লোক গুলিতে বেঁচে থাকার সমস্যা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠতে দেখা যায়। এগুলিতে অন্তহীনভাবে খাদ্য, সন্তান ও যুদ্ধজয়ের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়েছে। প্রাকৃতিক যে বিষয়গুলো তারা বুঝতে পারত না, সেইসব বিষয় সম্পর্কে নানা পৌরানিক কল্পনা করত।নানা প্রাকৃতিক ঘটনা ও বস্তু, যেমন সূর্য, বায়ু, অগ্নি, অরণ্য ও যোদ্ধাদের সম্পর্কে দেবত্ব কল্পনা করত।মনে রাখতে হবে যে, ঋকবেদের এই দেবতারা প্রকৃতি বহির্ভূত কোনও শক্তির প্রতিনিধি ছিলনা। তবু দেবতারা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ তারা মনে করত দেবতারা তাদের জীবনের প্রয়োজনীয় উপাদানের ব্যবস্থা করে তাদের জীবনকে সুরক্ষিত রাখবে।

খুব স্বাভাবিক সমাজ বিকাশের এই স্তরে দার্শনিক চিন্তার উদয় হওয়া সম্ভব ছিল না। পরবর্তীকালের কিছু সুক্ত (প্রথম ও দশম মন্ডল এর কিছু সুক্ত, যা ঋকবেদের মূল রচনার অনেক পরে রচিত হয়েছিল) বাদ দিলে ঋকবেদের ১০,৫৫২ টি সুক্তের সিংহভাগের মধ্যে দর্শন চিন্তার কোনও আভাসমাত্র পাওয়া যায় না।

বৈদিক সাহিত্যের পরবর্তী পর্যায় হল যজুর্বেদের যুগ। কিন্তু এটা চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল ব্রাহ্মণ সাহিত্যের মধ্যে।এতে বিষয়বস্তুর পরিবর্তন লক্ষণীয়। এখানে আগ্রহ পরিবর্তিত হয়ে যজ্ঞের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা চোখে পড়ে। যজ্ঞের আচার অনুষ্ঠানের সাথে আদিম যাদু বিশ্বাসের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।যাদু বিশ্বাসের মূল ভাবনা হল, একটি নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানের সাথে একটি নির্দিষ্ট ফল পাওয়া যাবে - এই বিশ্বাস।যেমন, অনাবৃষ্টির সময় আকাশে বৃষ্টির একটা নকল তুলতে পারলেই বৃষ্টি হবে। প্রকৃতির উপর জাগ্যিক ক্রিয়াকর্মের কোনও প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল না। কিন্তু যারা যজ্ঞ-কর্মে অংশগ্রহণ করতো,সেই মানুষগুলোর উপর প্রভাব পড়ত।যজ্ঞ তাদের ঈপ্সিত লক্ষ্য পূরণ করবে - এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে তারা অনেক বেশি শক্তি ও ইচ্ছা শক্তির প্রয়োগ করতে পারতো।ফলে পরোক্ষভাবে তার একটা প্রভাব ছিল।

এই অর্থে যজ্ঞ কর্মের সাথে যুক্ত যাদু বিশ্বাস প্রকৃতির সাথে মানুষের লড়াইয়ের সাথে যুক্ত ছিল। ব্রাহ্মণ সাহিত্যের ভিত্তিতে আমরা জেনেছি যে, কালক্রমে এই যজ্ঞের সাথে যুক্ত আচার অনুষ্ঠান তাদের আদিভিত্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এবং তাদের কার্যাবলী বিপরীত মেরুতে চলে গেল। অর্থাৎ এগুলোর সাথে বস্তু বহির্ভূত কোনও অলৌকিক শক্তির ভূমিকার ভাবনা এসে গেল।

এরই সাথে আমরা লক্ষ্য করি যে, বৈদিক সাহিত্যের বিষয়বস্তু পরিবর্তনের সাথে সাথে তার আঙ্গিকের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন হয়ে গেছে। ঋকবেদের কবিতার পরিবর্তে আমরা ব্রাহ্মণ সাহিত্যে পাই গদ্য রচনা। রচনাশৈলির দিক থেকে দুর্বল প্রকৃতির। এর নীরসতার একটা কারণ এটা হতে পারে যে, এই সময় থেকে জাগ্গিক ক্রিয়া কর্মের খুঁটিনাটি আচার অনুষ্ঠানের সাংকেতিক ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে। তবে এগুলো আমাদের কাছে যতই অর্থহীন মনে হোক না কেন, কোনও মতেই তা অপ্রাসঙ্গিক নয়। কারণ এর মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণ সাহিত্যের লেখকরা একটা নতুন সমাজ ব্যবস্থাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, যে সমাজব্যবস্থা সেদিন গড়ে উঠেছিল প্রাচীন উপজাতীয় সমাজের ধ্বংসস্তূপের উপর। নতুন ব্যবস্থায় শ্রেণী সমাজের বৈশিষ্ট্য এসে গেল, যেখানে ক্ষমতা ও সুযোগ সুবিধা সংরক্ষিত হল রাজা ও অভিজাতদের জন্য এবং তাদের আদর্শগত রক্ষক অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের জন্য। এই নতুন ব্যবস্থাকে যুক্তিসঙ্গত করার জন্য তারা প্রাচীন পৌরাণিক গল্পগাথার আশ্রয় নিয়েছিল। তাই শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে -"বরুণ নিঃসন্দেহে অভিজাত সম্প্রদায়ের এবং মরুৎ হল সাধারণ মানুষ। তাই পুরোহিত অভিজাত সম্প্রদায়কে জনগণের উপর স্থান দিলেন।তাই সাধারণ মানুষ তাদের উপরে অবস্থিত ক্ষত্রিয়দের সেবা করে।"অর্থাৎ ঋকবেদের যুগের দেবতাদের অবস্থানও পাল্টে গেল।বরুণের চরিত্রের পরিবর্তন লক্ষণীয়। ঋগ্বেদ সংহিতার যুগে বরুণকে দেখানো হয়েছে দাতা হিসেবে, মিথ্যার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে। ব্রাহ্মণ সাহিত্যে সেই বরুণ হয়ে গেল অভিজাত এবং শাসক।

এইভাবে আমরা ব্রাহ্মণ সাহিত্যে প্রত্যক্ষ করি একটা নতুন সামাজিক ব্যবস্থার উত্থান এবং তার সমর্থ্যনে একটা নতুন রাজনৈতিক দর্শনের উদ্ভব। এই রাজনৈতিক দর্শনের প্রকাশ হচ্ছে চতুরবর্ণের মাধ্যমে - ক্ষত্রিয়(রাজা ও অভিজাত), ব্রাহ্মণ (পুরোহিত সম্প্রদায়), বৈশ্য (ব্যবসায়ী ও কৃষক), এবং শূদ্র। প্রথম তিনটি বর্ণের মানুষ সরাসরি উৎপাদনে অংশগ্রহণ করে না। এই প্রথম তিনটি বর্ণের মিলিতভাবে সমাজের খুবই নগণ্য অংশকে প্রতিনিধিত্ব করে। তাহলে ব্রাহ্মণ সাহিত্যে যাদের শূদ্র বলা হয়েছে, তারাই জনসাধারণের সিংহভাগ অংশ, যারা প্রকৃতপক্ষে উৎপাদন করে। তাই ঐতরেয় ব্রাহ্মণে ঘোষণা করা হয়েছে যে, শূদ্ররা হল মনুষ্যেতর প্রাণী। তাদের জন্মই হয়েছে অন্যদের সেবা করার জন্য। ইচ্ছে হলে তাদের ছুঁড়ে ফেলা যায় এবং চাইলে মেরে ফেলা যায়, যদিও এটা উল্লেখ করা দরকার যে একটি মাত্র শ্লোকে এটি পাওয়া যায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, চতুরবর্ণের উদ্ভব হয়েছিল উৎপাদনকে কেন্দ্র করে সামাজিক স্তরবিন্যাসের মাধ্যমে। কিন্তু যত শ্রেণীবিভাজন পাকাপোক্ত হয়েছে ততই বর্ণাশ্রম প্রথা কঠোর হয়েছে এবং এর মধ্য দিয়ে শ্রেণীবিন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।

যারা দৈহিক শ্রম করে তাদের প্রতি ঘৃণা এবং সেই জন্য দৈহিক শ্রমের প্রতি ঘৃণা যে কত গভীরে চলে গিয়েছিল তা স্পষ্টতই বোঝা যায়। এর বিপরীতে বৌদ্ধিক শ্রমকে এবং তার ভিত্তিতে চিন্তা চেতনা ও বিশুদ্ধ যুক্তিকে উচ্চ মর্যাদা দেওয়ার ঘটনা একই সাথে ঘটতে দেখা যায়। এখানেই আমরা উপনিষদীয় ভাববাদের উৎস খুঁজে পাব।

ব্রাহ্মণ সাহিত্যের সাথে যুক্ত হয়ে আর এক ধরনের পুঁথি পাওয়া যায়, যাকে বলা হয় আরন্যক বা অরণ্য পুঁথি। আরণ্যকের যে পুঁথিগুলো আমরা পাই তাতে দেখা যাচ্ছে যে এতে রয়েছে সেই সব জিনিসের আলোচনা, যা গোপনীয় ও রহস্যময় চরিত্রের এবং অনভিজ্ঞ লোকের পক্ষে সম্মোহনের বিপদ নিয়ে আসতে পারে। সেই জন্যই অরণ্যে এগুলো শিক্ষা দেওয়া নেওয়া সম্ভব,গ্রামের জনবসতিতে নয়।আরণ্যক সম্পর্কে এ ধরনের অলৌকিক ধারণা প্রচলিত,বাস্তবে যা যাদু বিশ্বাসের সাথে যুক্ত এবং এর শব্দগুলির অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাসের সাথে যুক্ত। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব এখানেই যে এতে অনুমানমূলক দার্শনিক প্রশ্নের প্রথম স্পূরণ দেখা যায়। এই প্রবণতা আরও পরিস্ফুট হয়েছে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য উপনিষদে,যা আরণ্যকের সাথে যুক্ত হয়েছে।

উপনিষদের মধ্য দিয়েই বৈদিক সাহিত্যের পরিসমাপ্তি ঘটে।তাই একে বেদান্ত বলা হয়। ব্রাহ্মণ সাহিত্যে যে নতুন সামাজিক ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল, যা যজ্ঞের আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে তার যৌক্তিকতা খুঁজে পেয়েছিল, উপনিষদ সাহিত্যের যুগে সেই সামাজিক ব্যবস্থা স্থিতিশীল হয়েছে। এই নতুন ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তত্ত্বগত মেজাজের পরিপূরক দার্শনিক রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় উপনিষদে বর্ণিত সৃষ্টি সম্পর্কিত আলোচনায়।

উপনিষদে বলা হয়েছে, শুরুতে এই বিশ্ব ছিল ব্রহ্ম, একমাত্র একক বলেই তার বিকাশ হয়নি। তিনি সৃষ্টি করলেন তার চেয়েও শ্রেষ্ঠতর রূপ - ক্ষত্রিত্ব তাই ক্ষত্রিয়র চেয়ে বড় কেউ নেই। তাই অভিষেক উৎসবে ক্ষত্রিয়ের চেয়ে নিচে বসেন ব্রাহ্মণরা। ক্ষত্রিয়ত্বর উপরেই তিনি এই সম্মান প্রদর্শন করেন। একই বিষয়, অর্থাৎ ক্ষত্রিয়ত্ব ব্রহ্মণত্বের উৎস। তাই এমনকী রাজা যদি সর্বোচ্চ কতৃত্ব অর্জন করেন, তাহলে তিনি শেষ পর্যন্ত নির্ভর করেন ব্রাহ্মণত্বের উপর....

তিনি এখনও বিকশিত হননি, তিনি সাধারণত্ব সৃষ্টি করলেন..........

তিনি এখনও পূর্ণতা লাভ করেননি, তিনি শূদ্র সৃষ্টি করলেন.......

তিনি এখনও পূর্ণতা লাভ করেন নি। তিনি এর চেয়েও উন্নততর আকারে প্রকাশিত হলেন। তা হল,Law, অর্থাৎ আইনকানুন। তাহলে ক্ষত্রিয় শ্রেণির ক্ষমতার উৎস হল সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিধি(Law)। তাই Law - এর চেয়ে উন্নততর কিছু নেই। তাই একজন দুর্বল ব্যক্তি শক্তিধর ব্যক্তিকে শাসন করতে পারে। যেমন একজন রাজা করে। তাই যা আইন বা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিধি তাই সত্য। তাই তারা বলেন, যে ব্যক্তি সত্যের কথা বলে সে আইনের কথা বলে। আবার যে আইনের কথা বলে সে সত্যের কথা বলে অর্থাৎ দুটোই একই কথা।

উপরের বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার যে দর্শনচিন্তার সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতার সম্পর্ক রয়েছে। দার্শনিকরা কি খোঁজার চেষ্টা করেন সত্য খোঁজার চেষ্টা করেন। কিন্তু শ্রেণিবিভক্ত সমাজে সত্য সামাজিক বিধি বা আইনেরই আর এক নাম এবং এই আইনের শাসনের সাহায্যেই রাজা বা অভিজাতরা তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করেন। তাই বোঝা যায় উপনিষদের যুগের কর্তৃত্বকারী চিন্তার সাথে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সংযোগ রয়েছে।

চৈতন্যের উদ্ভব

আগেই বলেছি যে বৈদিক সাহিত্য প্রায় ১০০০ বছর ধরে রচিত হয়েছিল এবং দীর্ঘ সময় ধরে রচিত হলেও এর একটার সাথে আর একটার যোগসূত্র রয়েছে। তাই এই সাহিত্য পর্যালোচনা করে আমরা বুঝতে পারি কিভাবে ক্রমবিকাশের ধারায় বৈদিক সমাজে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যখন একজন ব্যক্তি মানুষ তার বেঁচে থাকার জন্য নূন্যতম যা প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছিল।এই পরিস্থিতিতে সমাজে একদল মানুষ নিজেরা কোনও পরিশ্রম না করেই বেঁচে থাকার সুযোগ পেয়ে গেল।অন্যের শ্রমের বিনিময়ে বেঁচে থাকার সুযোগ পাওয়া এই মানুষগুলো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা করার ফুরসৎ পেল। এর আগে পর্যন্ত প্রতিটি মানুষকেই শুধু টিকে থাকার জন্য দিবারাত্রি পরিশ্রম করতে হতো। কিন্তু উৎপাদনের অপেক্ষাকৃত উন্নত অবস্থায় এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হল যার ফলে কিছু মানুষ সরাসরি উৎপাদনে অংশগ্রহণ না করেও বেঁচে থাকার সুযোগ পেল। শুধুমাত্র চিন্তা করার সুযোগ পাওয়া এই মানুষগুলো পূর্ববর্তী সময়ের মানুষের মত শুধু খাওয়া পরার চিন্তার মধ্যে আটকে থাকল না। তারা অনুমানমূলক ভাবনাচিন্তা চিন্তা করার দিকে এগোতে পারল।

এই ঘটনা সমাজ জীবনে একটা বিরাট তাৎপর্য নিয়ে এল। এর মধ্য দিয়ে যুক্তির ক্ষমতা সম্পর্কে বা চেতনার সৃজনশীল ভূমিকা সম্পর্কে উপলব্ধি গড়ে উঠলো। শুধুমাত্র টিকে থাকার ভাবনার বাইরে চেতনার উদ্ভব - যাকে আমরা তত্ত্বগত চর্চা বলি তার সূচনা হতে পারত না, যদি কিছু মানুষ এইভাবে উৎপাদনে অংশ গ্রহণের ভূমিকা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে না পারতো। ঋকবেদে আমরা পেয়েছি সেই সব কবিদের যারা বেঁচে থাকার উপকরণের অভাব মোচনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের ভাবনাতেই তারা বুঁদ হয়ে থাকতো,তাকে দার্শনিক ভিত্তি দেওয়ার ফুরসৎ তাদের ছিলনা। অবশ্যই ব্রাহ্মণ সাহিত্য রচনার দীর্ঘ সময়ে এমন একটা সময় এসেছিল যখন শুধুমাত্র টিকে থাকা বা বেঁচে থাকার চিন্তার বাইরে অন্য কিছু নিয়ে ভাবার জন্য কিছু কিছু অবকাশ মিলতো। কিন্তু সেই সময় তাদের ব্যয় হয়ে যেত নতুন শ্রেণী সমাজে রাজা এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার কাজে অর্থাৎ ভয় দেখিয়ে আপামর জনসাধারণকে নিয়ন্ত্রণ করার কাজে। এই সময়ের সাহিত্যে যে বৌদ্ধিক পরিবেশের কথা বিবৃত হয়েছে তাতে দর্শন চিন্তা আভাস পাওয়া গেলেও তখনও দার্শনিকদের দেখতে পাওয়া যায়নি।

দার্শনিকদের প্রথম দেখতে পাওয়া যায় উপনিষদের যুগে, যখন সুবিধাভোগী শ্রেণী তাদের কর্তৃত্ব পুরোপুরি কায়েম করতে সক্ষম হয়েছে এবং তারা দৈনন্দিন ক্রিয়া-কলাপের বাইরেও কল্পনা করার সুযোগ পেয়েছে। এই সময়েই উপনিষদের প্রথম দার্শনিকরা তত্ত্বগত তাৎপর্য সম্পন্ন প্রশ্ন তুলেছেন এবং সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন।

একই সাথে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, তাত্ত্বিক চিন্তার এই স্ফুরণ যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, তা একটা বিপদের সম্ভাবনাও নিয়ে এসেছে। এই সময়ে এমন একটা সমাজ নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যখন দৈহিক শ্রমের মর্যাদা ক্ষুন্ন করা হয়েছে। উৎপাদনের যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তি এই উৎপাদকদের কাছেই ছিল; কিন্তু তারা পেছনে চলে গেল এবং তাদের সাথেই পেছনে চলে গেল তাদের অভিজ্ঞতা এবং উৎপাদনের প্রক্রিয়া থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান।

অন্যদিকে দার্শনিক ক্রিয়াকর্ম এই অভিজ্ঞতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এবং তার ফলে প্রকৃতির সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকলো না। এর ফলে প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্পর্কে অবজ্ঞার মনোভাব সৃষ্টি হল। জ্ঞান আর বস্তু জগতের জ্ঞান হিসেবে থাকলো না। জ্ঞান বলতে দাঁড়িয়ে গেল নিজের সম্পর্কে জ্ঞান, মনগড়া ধারণার উপর ভিত্তি করে যার সৃষ্টি।তাই উপনিষদের দার্শনিক ঘোষণা করেন, "দার্শনিকের আদর্শ হলো নিজের উপর ইচ্ছা শক্তির প্রয়োগ..... নিজের সাথে খেলা করা।এই যে অন্তর্মুখীতা, তা এক ধরনের মায়াজাল, নিজের শক্তির বিশালতা সম্পর্কে মোহগ্রস্ততা সৃষ্টি করল।এই অহম, এই আত্মা বাস্তব জগতকে পরিচালনা করে এবংএকেই একমাত্র বাস্তবতা বলে দাবি করে।উপনিষদীয় ভাববাদী ঘোষণা করেন, "আমি সেই পরম বাস্তবতা।" এর ফল হল দার্শনিক নিজে যে বস্তুজগতে বাস করেন তার প্রতি সৃষ্টি হল অসীম ঔদাসীন্য।

প্রকৃতির সাথে দ্বন্দ্ব সংঘাতের সুযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে তাদের চিন্তাও ক্রমাগত এমন একটা পরিস্থিতিতে পৌঁছে গেল, যেখানে কেবল চিন্তার অস্তিত্বই থাকলো এবং যে বস্তু জগতকে ভিত্তি করে চিন্তার সূচনা হয়েছিল,তা হারিয়ে গেল। ফলে এই চেতনা কোনও কিছু বিষয়ের চেতনা নয়, চেতনা যেন স্বয়ম্ভু,..... শুধুমাত্র চেতনা........ প্রকৃতির সাথে প্রত্যক্ষ সংঘাতরত নর-নারীর চেতনা এবং সেই জন্য ক্রমাগত বিকাশশীল চেতনা নয়। চেতনা এখানে দেবত্ব আরোপিত পরম ব্রহ্ম....... এতটাই অতীন্দ্রিয় যে, ইহজগতের চিন্তা দিয়ে তাকে বোঝা যায় না এবং এমন বিস্ময়কর যে, সাধারণ ভাষায় তাকে বর্ণনা করা যায় না।

তবে এ কথা সত্য নয় যে দার্শনিক চিন্তার উদ্ভবের এটাই একমাত্র পরিণতি হতে বাধ্য। বাস্তবে তা হয়ওনি। উপনিষদের যুগে এমন মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে যারা চেতনার দেবত্ব আরোপিত দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অর্থে প্রকৃতিকে দেখতে পেয়েছিলেন। ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে তারা হলেন পথপ্রদর্শক।

কিন্তু উপনিষদের যুগে ভাববাদী চিন্তার দাপটের কাছে এই ধরনের চিন্তা চাপা পড়ে যায়। নতুন সামাজিক বিধিব্যবস্থায় বস্তুজগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন চেতনার ধারণা প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে। এরকম একজন দার্শনিক ছিলেন যজ্ঞবল্ক, যিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, বাস্তবতা হলো শুধুমাত্র কিছু চেতনার সমাবেশ;একে সাধারণ জ্ঞানেন্দ্রিয় দিয়ে বোঝা যায় না এবং সাধারণ ভাষায় একে প্রকাশ করা যায় না। এর সম্পর্কে বলবার একমাত্র পদ্ধতি হলো 'এটা তা নয় এটা তা নয়' বলা। যেমন মানুষ যখন স্বপ্ন দেখে প্রথম রাতে স্বপ্ন দেখার পর স্বপ্ন ব্যতিরেকে ঘুমায়, তেমন করেই বস্তু জগতের বাধা পেরিয়ে এই বাস্তবতার স্বাদ পাওয়া যেতে পারে। এই দার্শনিক চিন্তার প্রতি ক্ষমতাসীন শ্রেণীর সমর্থন ছিল। এই দার্শনিকরা ছিলেন সমাজের সম্মানীয় ব্যক্তি। ফলে এই চিন্তা খুব অহযেই সমাজ মননে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল।

এইভাবেই ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে ভাববাদী চিন্তার জন্ম। আমরা দেখেছি বৈদিক যুগের প্রথম দিকে এই ধরনের চিন্তার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। তার কারণ শুধু এটা নয় যে, সেই যুগের মানুষ তাদের চিন্তাকে সুসংহত রূপ বা দার্শনিক রূপ দেওয়ার কাজে অক্ষম ছিল।তার পাশাপাশি সেই মানুষগুলোর প্রকৃতির সাথে প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল। তাই বস্তু থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন চিন্তা করার পরিবেশ পরিস্থিতিও সেদিন ছিল না।

এতক্ষণ আমরা বৈদিক চিন্তার বিকাশের পথে কিভাবে ভাববাদী চিন্তার জন্ম হয়েছিল, সংক্ষেপে তাই আলোচনা করেছি।উপনিষদে বর্ণিত এই ভাববাদী চিন্তাই বিকাশের পথে এদেশে ভাববাদী দর্শনের জন্ম দিয়েছিল।

এবার আমরা আলোচনা করে দেখব কিভাবে নিরীশ্বরবাদী গৌতম বুদ্ধের শিষ্যরা ঈশ্বরবাদী ভাববাদী চিন্তার জন্ম দিতে সক্ষম হল।

বৌদ্ধ ঐতিহ্যে কেমন করে ভাববাদী দর্শনের জন্ম হল

বৌদ্ধ ধর্মের প্রথম যুগের, বিশেষ করে গৌতম বুদ্ধের মূল বক্তব্যের সাথে যারা পরিচিত তাদের কাছে এটা বিস্ময়কর মনে হয় যে, গৌতম বুদ্ধের উত্তরসূরীরা কিভাবে ভাববাদী দর্শনের জন্ম দিতে পারলেন। কারণ বুদ্ধ সম্পর্কে আমরা জানি যে তিনি সাধারণভাবে অধিবিদ্যার প্রবণতা এবং বিশেষ করে উপনিষদীয় ভাববাদের বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁর শিক্ষার নির্যাস রয়েছে চারটি মহৎ সত্যের মধ্যে। এগুলি হল সমস্তই দুঃখ, দুঃখের হেতু আছে, দুঃখের বিনাশ আছে, দুঃখ নিরোধের পথ আছে।

প্রথম প্রশ্নটি ধরা যাক।বুদ্ধ কেন সমস্ত কিছুতেই দুঃখ দেখতে পেয়েছিলেন? কারণ বুদ্ধের সময়টা ছিল একটা বড় মাপের সমাজ পরিবর্তনের সময়। এই সময়ে উত্তর ভারতে অত্যাচারী রাষ্ট্রশক্তির উদ্ভব হয়েছে। বুদ্ধ নিজে দেখেছেন কিভাবে পুরানো শ্রেণীহীন উপজাতীয় সমাজের ধ্বংসস্তূপের উপর মগধ ও কোশল রাজাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে এই সময়ের বৈশিষ্ট্য হিসেবে পুরানো সমাজের স্বাধীনতা সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের স্থান নিয়েছিল লোভ, যৌথ সম্পদের উপর বলপূর্বক ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠা, স্বার্থপরতা, কর চাপানো, যা এতদিন মানুষের অজানা ছিল। এই সাম্রাজ্যের প্রতিবেশীদের মধ্যে তখনো উপজাতীয় সমাজের বৈশিষ্ট্য টিকে ছিল। উদীয়মান রাষ্ট্রশক্তির কাছে উপজাতীয় সমাজের গণতান্ত্রিক রীতি নীতি বিপজ্জনক ছিল। তাই উদীয়মান রাষ্ট্রশক্তির কাছে এই উপজাতীয় জনগোষ্ঠীগুলোকে দমন করা ও নিশ্চিহ্ন করা অবশ্য প্রয়োজনীয় ছিল।

বুদ্ধ নিজেই শাক্য উপজাতীয় সমাজের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং এর জন্য তিনি গর্ববোধ করতেন। কিন্তু তাঁর নিজের জীবদ্দশাতেই কোশল রাজ বিদুভব শাক্যদের উপর অত্যাচার নামিয়ে এনেছিলেন। বুদ্ধ তার সংঘের রীতিনীতি তৈরি করেছিলেন বাজ্জিদের মধ্যে তখনো প্রচলিত গণতান্ত্রিক নীতির ভিত্তিতে। আজাতশত্রু ঘোষণা করেছিলেন," আমি বাজ্জিদের উৎখাত করব, আমি বাজ্জিদের ধ্বংস করব, বাজ্জিদের আমি নিঃশেষ করে দেবো।" এবং রাজা সেটা করেওছিলেন।

উপজাতীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে গভীর অনুরাগ সম্পন্ন বুদ্ধ সীমাহীন লোভের দ্বারা প্ররোচিত রাষ্ট্রশক্তির আগ্রাসী রূপ দেখে উদ্বেগবোধ করেছিলেন। প্রশ্ন এল, দুঃখ কি শুধু জনসাধারণের জন্য, রাজাদের জন্য নয়, যে দুঃখকে বুদ্ধ সর্বব্যাপী আখ্যা দিয়েছিলেন? বুদ্ধ বললেন, না রাজারাও দুঃখ বোধের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত নয়। সেই একই লোভ রাজাদের জীবনকে দুঃখ মনে করে তোলে। প্রথম দিকে বুদ্ধর দুজন বন্ধু ছিলেন - কোশলরাজ প্রসেনজিৎ এবং মগধরাজ বিম্বিসার। প্রথমজন তার ছেলে বিদুভবের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং দ্বিতীয় জনকে তার ছেলে অজাতশত্রু অনাহারে হত্যা করেছিল। তাই বুদ্ধ বলেছিলেন," যে রাজারা রাজ্য শাসন করছে তারা ধন-সম্পদের অধিকারী, কিন্তু তাদের লোভ লালসা একের বিরুদ্ধে অন্যকে প্ররোচিত করছে। লোভ এবং জাগতিক কামনার দ্বারা প্ররোচিত হয়ে এই ক্রিয়াকলাপ যদি সমস্ত কিছুকেই ক্ষণস্থায়িত্বের স্রোতে ভাসিয়ে দেয়, তাহলে কে এই পৃথিবীতে শান্তিতে বাস করতে পারবে? "বুদ্ধ নিজের অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন।ফলে সমস্ত জায়গায় এবং সমস্ত কিছুতেই দুঃখ ছাড়া তিনি আর কী দেখতে পারেন?

কিন্তু যে পরিবেশ পরিস্থিতিতে তিনি জীবন অতিবাহিত করেছেন তাতে কি তার পক্ষে দুঃখ থেকে মুক্তির কোনও পথ দেখানো সম্ভব ছিল? সামাজিক পরজীবীদের মায়াজালের ধারণাকে সমর্থন না করার ফলে তিনি কোনও কাল্পনিক দেবতার কাছে প্রার্থনা করা বা কোরবানি করার পরামর্শ দেননি, কিম্বা কোনও অতীন্দ্রিয় মায়ার সাহায্যে বাস্তব জগতের দুঃখকে মুছে দিতে চাননি। তিনি ভগবানে বিশ্বাস করতেন না এবং বিশুদ্ধ আত্মার অতীন্দ্রিয়বাদের উপরও তার কোনও বিশ্বাস ছিল না। তাই তিনি বাস্তবে দুঃখ মোচনের জন্য কিছু কার্যকরী এবং বাস্তব পন্থা অবলম্বন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময়কার পরিস্থিতিতে বাস্তবে দুঃখ থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করার কোনও প্রশ্নই ছিল না। এমনকী বুদ্ধ নিজেও ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ধাপগুলোকে লাফ দিয়ে পার হয়ে সোজা সমাজতন্ত্রে চলে যেতে পারতেন না, মানুষের উৎপাদনশীলতার অনেক উন্নতমান অর্জন করা ও শ্রেণী শোষণ অবসানের ভিত্তিতে একমাত্র যে সমাজতন্ত্রেই মানুষ বাস্তব জীবনের দুঃখ দুর্দশা থেকে মুক্ত হতে পারে। তাঁর কাছে একটা বিকল্পই খোলা ছিল - প্রকৃত সমস্যার ভাবগত সমাধান বা বাস্তব দুঃখের কাল্পনিক বা মনগড়া সমাধান।এক কথায় মানুষের এমন এক মানসিক পরিবর্তন যার ফলে দুঃখবোধ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।তিনি যে জীবনকে দেখেছিলেন,বাস্তবে তা সহ্য করা ছিল কঠিন। ঐতিহাসিকভাবে তার পক্ষে যা সম্ভব ছিল তা হল, এই কষ্ট লাঘবের জন্য কিছু সাময়িক উপশমের উপায় অবলম্বনে পরামর্শ দেওয়া। এটাই তিনি করেছিলেন।

তাই তিনি ঘোষণা করলেন, "বর্তমান জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে যে মানসিক যন্ত্রণা সৃষ্টি হচ্ছে, তার উপশমের জন্য আমি একটা নতুন মতবাদ প্রচার করছি।" তিনি বললেন যে, তাঁর উদ্দেশ্য হল হৃদয়ের প্রশান্তি আনা, এটা যখন আনা সম্ভব হবে তখনই দুঃখের বিনাশ হবে। একেই বুদ্ধ বলেছিলেন 'নির্বাণ'।

বুদ্ধ বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন - জ্বরা ব্যাধিতে বা নিকটজনের মৃত্যুতে মানুষ কষ্ট পায় কেন? কারণ একজন জ্বরাগ্রস্থ বা অসুস্থ মানুষ যখন কোনও সুস্থ দেহের যুবাকে দেখে তখন তার সঙ্গে নিজের অবস্থান তুলনা করে কষ্ট পায়। ভাবে, আমার শরীর কেন এমন হলো না? বুদ্ধ বলছেন, এভাবে ভেবো না। অন্যের সঙ্গে নিজের তুলনা করো না। যা আছে তাকে স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করো। এটা যদি পারো তাহলে কষ্টের বোধটা থাকবে না। হৃদয়ের এই প্রশান্তি এলে দুঃখের বিনাশ হবে।

বুদ্ধের বক্তব্যের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল এর সহজত্ব অথবা সারল্য। একে সেই অর্থে একটা ধর্মমত বলা যাবে না। এর ধর্মীয় দিক অর্থাৎ একটা পথের শিক্ষা হলো সম্পূর্ণ মানবিক। মানুষ তার নৈতিক ও বৌদ্ধিক উৎকর্ষতার মধ্য দিয়েই মুক্তি পেতে পারে। সেই সময়ে বৌদ্ধ ধর্মে উপাসনার বিশেষ প্রচলন ছিল না। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষের কোনও পরিবারও ছিল না, সম্পত্তিও ছিল না। তারা মাসে দুবার মিলিত হতেন। সেখানে তারা নিজের পাপের স্বীকারোক্তি করতেন এবং সংযম ধ্যান ও দার্শনিক আলোচনায় নিমগ্ন হতেন। তাদের বার্ষিক অনুষ্ঠানের আড়ম্বর ছিল না, কোনও কুসংস্কারে বিশ্বাস ছিল না এবং কোনও ঐশ্বরিক-অতীন্দ্রিয় কল্পনায় আগ্রহ ছিল না। একমাত্র দার্শনিক বিষয়, যা বুদ্ধ নিজে আগ্রহ দেখাতেন তা হল, দুঃখ,তার কারণ এবং তার বিনাশের উপায়।

বুদ্ধের মৃত্যুর কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের চিন্তা ভাবনায় একটা নাটকীয় পরিবর্তন হয়ে গেল। এর একটা দিক হল, নানা ধরনের কুসংস্কার ও তমসাচ্ছন্ন চিন্তাভাবনার আমদানি এবং সেটা এতটাই হল যে, তাকে আর বৌদ্ধ মত বলে চেনাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়ালো। ফলে এটা আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, বৌদ্ধমতের এই নতুন সংস্করণের একটা নতুন দেওয়ার দরকার হয়ে পড়ল। সেই নাম আবিষ্কারও হল - মহাযান।

মহাযান বৌদ্ধরা এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তাভাবনার মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের আবরণ দিয়ে উপনিষদীয় ভাববাদের ভাবনাকে নিয়ে এলেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই বুদ্ধের বাস্তব এবং কিছুটা অর্থে যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তাদের বাস্তবকে অস্বীকার করার দৃষ্টিভঙ্গি খাপ খায় না। এর বিপরীতে কুসংস্কারে পরিপূর্ণ একটা অধ্যাত্মবাদী পরিবেশ তাদের দার্শনিক ভাববাদের জন্য অনেক বেশি কার্যকরী।

এর জন্য তাদের প্রথম যেটা প্রয়োজন ছিল সেটা হল বৌদ্ধমতের ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠাতা অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কে যে স্মৃতিগুলো টিকে ছিল, তার বিকৃতি ঘটানো। এটার জন্য তারা একটা নতুন তত্ত্ব আমদানি করলেন। যাকে সাধারণভাবে বৌদ্ধবাদ (Buddhalogy) বলা হয়। এক বুদ্ধের জায়গায় তারা বহু বুদ্ধের ধারণা নিয়ে এলেন - তাদের মধ্যে কিছু ঐতিহাসিক বুদ্ধের আগে এবং কিছু তার পরের, যাদের বলা হলো বোধিসত্ত্ব বা ভবিষ্যৎ বুদ্ধ। এই বুদ্ধদের বাস্তব জগৎ বলে কিছু নেই, তাদের সবকিছুই ঐশ্বরিক। তাঁরা যদি ভাবেন, কথা বলেন, ক্রিয়ার করেন এবং আমাদের মত কষ্ট ভোগ করেন, তাহলে সেটা আমাদের দুর্বলতার সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য কেবলমাত্র condescension হিসাবে। আমাদের চর্মচক্ষুতে তাদের বাহ্যিক প্রকাশ হিসেবে যা দেখা যায় আসলে তা শুধুমাত্র মন দিয়ে তৈরি(মনোমায়া)। বোধিসত্ত্ব শেষ পর্যন্ত মানুষের ছদ্ম রূপ নিয়ে আসেন,অনেকটা স্বর্গীয় অবস্থান থেকে পৃথিবীতে নেমে আসার মত। বাস্তবের মানুষের কাছে তিনি যে দেহ হিসেবে দেখা দেন, সেটা তার প্রকৃত চরিত্রকে আড়াল করে। এই ভাবনার ধারাবাহিকতাতেই কেউ ভাবতেই পারেনি যে,বোধিসত্ত্বের এই যে দেহ,চর্মচক্ষুতে যা দৃষ্টিগোচর হয়, তার আসলে কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই, সেটা একটা ভ্রম বা মায়া।

ঐতিহাসিক বুদ্ধকে অদৃশ্য করে দেওয়ার জন্য এটা একটা দার্শনিক কৌশল। মহাযান বুদ্ধদেবের অন্যান্য বিষয়ের মত বহুবুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের ধারণা নিয়ে বহু বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ধর্ম কায়া, নির্মাণ কায়া এবং রূপ কায়া।

ধর্ম কায়ার ধারণাকে অনেক সময় 'বুদ্ধের মহাজাগতিক দেহ' হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এর মূল রয়েছে ধর্মতা সম্পর্কে মহাযান ধারনার মধ্যে, যার অর্থ হল পরম সত্য বা absolute। এই পরম সত্য বা absolute কে সাধারণ জ্ঞানের সীমানার বাইরে এবং সাধারণ ভাষায় ব্যক্ত করার ঊর্ধ্বে ধরা হয়। এই absolute-এর বাস্তবতা সম্পর্কে নিশ্চিতরূপে বলা যায় না, যাকে মহাযান বৌদ্ধরা বলেন তথাত বা 'bare suchness'।তাদের দৃষ্টিতে সমস্ত বস্তুকেই সাধারণত কেবল অনস্তিত্ব(sheer nothingness) ধরা হয়, যার ভিত্তিতে তারা ধর্মতাকে শূন্যতার সাথে একাকার করে ফেলেন। 'পরম সত্যে'র দৃষ্টিতে এই শূন্যতার অর্থ বাস্তব জগতের অনস্তিত্ব। একমাত্র প্রকৃত সাধু সন্ন্যাসীরা তাদের অন্তিম মুক্তি বা নির্বাণের মধ্য দিয়ে এই অতীন্দ্রিয় এবসলিউটকে উপলব্ধি করতে পারেন। উপলব্ধির সেই স্তরে এবসলিউট ছাড়া আর কিছুই থাকে না। তাই ধর্মতার আর এক নাম নির্বাণ।

মহাযান সম্প্রদায়ের মতে ধর্ম কায়া বলতে বোঝায় ধর্মতার সাথে বুদ্ধের পরিপূর্ণ একাত্মতা। কিন্তু এরকম একটা তত্ত্ব সাধারনের কাছে এত দুর্বোধ্য যে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা কঠিন। তাছাড়া ঐতিহাসিক বুদ্ধ সম্পর্কে সাধারণের যে বিশ্বাস আছে যে তিনি শাক্য বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং মানুষের দুঃখমোচনের জন্য কাজ করেছিলেন তাকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এজন্যই মহাযান বৌদ্ধরা ধর্ম-কায়ার সাথে নির্মাণ-কায়ার ধারণা যুক্ত করেছিলেন। নির্মাণ-কায়ার ধারণা অনুযায়ী এ্যাবসলিউট মানুষরূপে বুদ্ধের মধ্য দিয়ে সাময়িকভাবে আবির্ভূত হয়েছিল। যদিও প্রকৃতপক্ষে তা ছিলো অস্তিত্বহীন, কিন্তু মনে করা হতো তার বাস্তব অস্তিত্ব আছে - যেমন একজন জাদুকর স্টেজে হস্তি দর্শন করায় যদিও বাস্তবে হাতির কোনও অস্তিত্ব থাকে না। কিন্তু এবসলিউট অলীক দেহ ধারণ করে কেন? এই নতুন ধর্মমতে এই অ্যাবসলিউট বা ধর্ম-কায়া সমস্ত জীবের প্রতি অনুকম্পা বসত এই ছদ্মদেহের আকৃতি ধারণ করে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয় এবং সমস্ত জীবের মুক্তির জন্য কাজ করে। এই ছদ্মরূপ রক্ত মাংস দিয়ে গড়া শরীর বলে মনে হয়, তাকেই বলা হয় রূপ-কায়া। অর্থাৎ বুদ্ধের জড়দেহ(physical body)।

পৌরাণিক কাহিনী ও অতীন্দ্রিয়বাদের এই সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে মহাযান বৌদ্ধরা একটা বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে গেল--এর মধ্য দিয়ে তারা সফলভাবে ঐতিহাসিক বুদ্ধকে ঝেড়ে ফেলতে পারল। শুধু তাই নয়, এর মধ্য দিয়ে বৌদ্ধ মতাদর্শ থেকে বুদ্ধের নিজের নিরীশ্বরবাদকে সহজে বাতিল করা সম্ভব হলো। তারা যুক্তি করলো এইভাবে যে, যদিও ধর্ম-কায়ার ধারণার প্রেক্ষিতে এ্যাবসলিউট অবর্ণনীয়,তবু সাধারণ মানুষের বোঝার জন্য কিছু কথা বলা দরকার। তাদের জন্য ধর্ম-কায়া ব্রহ্মাণ্ডের নির্যাস বিরোকণা, অমিতাভ, দেবী তারাএবং অন্যান্য দেবদেবীর মাধ্যমে ব্যক্তিকৃত করা এবং আরাধনা করার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। বৌদ্ধমত সাথে সাথেই সর্বেশ্বরবাদী বা ঈশ্বরবাদী হয়ে পড়ল। বুদ্ধ নিজে নিরীশ্বরবাদী ছিলেন,মহাযান বৌদ্ধরা সেখান থেকে বিচ্যুত হয়ে ঈশ্বরবাদী হয়ে পড়লেন।

ধর্ম-কায়ার ধারণার সাথে মহাযান বৌদ্ধরা দেবদেবীর ধারণাকে যুক্ত করলেন।একটাই ব্যতিক্রম। ধর্ম-কায়া হলেন সর্বজ্ঞ, সর্বত্রগ্রামী এবং দয়ালু ইত্যাদি। কেবলমাত্র তাকে ব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা হিসেবে অস্বীকার করা হল। মহাযান বৌদ্ধমতের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক নাগার্জুন ঈশ্বরবাদীরা যে ঈশ্বরকে ব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা হিসেবে দেখেন, তাদের বিরুদ্ধে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন।

এর মধ্য দিয়ে তাদের দ্বৈত উদ্দেশ্য সাধিত হল। একদিকে ঈশ্বরকে জগতের স্রষ্টা হিসেবে ভাবনার বিরোধিতা করে তারা যেন বুদ্ধের মৌলিক ধারণা অর্থাৎ নিরীশ্বরবাদ স্বীকার করে নিলেন, অন্যদিকে এটা তাদের দার্শনিক অবস্থানকে সুদৃঢ় করল অর্থাৎ বাস্তব জগত যে কেবল ভ্রম বা মায়া সেই ধারণাকে পাকাপোক্ত করল। স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করলে সৃষ্টির কিয়াকে স্বীকার করতে হয় এবং তাহলে সৃষ্ট জগতের বাস্তব অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিতে হয়। তাই স্রষ্টার ধারণা বাতিল করে মাহাযান বৌদ্ধরা এটা প্রমাণ করতে প্রয়াসী হয়েছেন যে, সৃষ্টির ক্রিয়া এবং সেজন্যই সৃষ্ট জগত হল আসলে একটা কল্পনা মাত্র। এই বিষয়টি পরবর্তীকালে অদ্বৈত বেদন্তবাদী গৌড়পাদ পুনরাবৃত্ত করেছেন, যাঁর দার্শনিক মতকে বলা হয় অজাত-বাদ বা জগতের অনস্তিত্বের তত্ত্ব, জগত কখনোই বাস্তবে দেখা দেবে না। তাই স্রষ্টার ধারণা অস্বীকার করলেও এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, মহাযান বৌদ্ধরা বৌদ্ধমতে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ধারণা আমদানি করেছিল,যে ধারণা বুদ্ধ নিজে সরাসরি বাতিল করেছিলেন।

এইভাবে বৌদ্ধ মতাদর্শে ঈশ্বরের ধারণা আমদানি করার ফলে সেই পথ ধরে অতিপ্রাকৃতিক শক্তির সাথে যুক্ত সমস্ত ধারণাই এসে গেল - দেব দেবী, শয়তান এবং জিনের ধারণা এসে গেল। কেউ যদি মহাযান বৌদ্ধমঠে যান, তাহলে তিনি দেখতে পাবেন যে, বুদ্ধের ছবি এবং স্ট্যাচুর উপর বিরাট দেব লোকের ধারণা কিভাবে আরোপিত হয়েছে।

মতাদর্শের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী রূপে মহাযান বৌদ্ধদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের উপরও প্রভাব ফেলল। ঈশ্বর এবং অন্যান্য দেবদেবীর করুণা পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করা ও তাদের প্রসন্ন করার রীতি চালু হলো এবং শয়তান ও জিনদের কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নানা ধরনের আচার অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার নিদান দেওয়া হলো।মহাযান বৌদ্ধরা বাস্তবে প্রার্থনা, জাদুক্রিয়া এবং সমস্ত ধরনের অলৌকিক আচার অনুষ্ঠানের সম্মেলন ঘটিয়েছিল। বৌদ্ধ মতবাদ এইভাবে তত্ত্ব ও ক্রিয়ায় হাস্যকর অলৌকিকতাবাদ এর রূপ নিয়েছিল। এই সমস্ত কিছুর আবরণের সাহায্য নিয়ে মহাযান বৌদ্ধরা উপনিষদীয় ভাববাদের মূল বৈশিষ্ট্যগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। একেই তারা আখ্যা দিয়েছিলেন উন্নততর বৌদ্ধ মতাদর্শ হিসাবে।

এর অর্থ এই নয় যে, দার্শনিকরা শুধুমাত্র অতিপ্রাকৃতবাদের উপর নির্ভর করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে এমন কয়েকজন দক্ষ অধিবিদ্যাবিদ ছিলেন যাঁরা উপনিষদের প্রাথমিক ভাববাদী চিন্তাকে পরিশীলিত দার্শনিক মতবাদে রূপান্তরিত করেছিলেন। কিন্তু এই একই দার্শনিকরাই নতুন কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভাবনাকে প্রসারিত করেছেন। কেন করেছেন? কারণ সাধারণ মানুষ তাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যে বাস্তব জগতকে অনুভব করে, তাকে অস্বীকার করতে বলার অর্থ তেতো বড়ি খাওয়ানোর শামিল। সূক্ষ্ম দার্শনিক কুটকাচালির মধ্যে যতই কৌশল থাকুক না কেন, তা এই লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম নয় এজন্যই কুসংস্কারের শক্তিতে ভর করে এই তেতো বড়ি খাওয়ানোর উদ্যোগ। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে মহাযান দার্শনিক মতবাদ প্রচারের জন্য মহাযান ধর্ম প্রচার অপ্রাসঙ্গিক নয়।

এখন প্রশ্ন হল, ধর্মমত এবং দার্শনিক মত উভয়দিক থেকেই বৌদ্ধ মতাদর্শের এই রূপান্তর হওয়ার বাস্তব প্রেক্ষাপট কি এখনও খুঁটিনাটি সমস্ত বিষয়টা জানা না গেলেও একটা বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, ব্যবসায়ী-রাজা-মহারাজাদের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন বৌদ্ধ ধর্মের পিছনে কাজ করেছিল।এই পৃষ্ঠপোষকতা এবং সক্রিয় সহযোগিতার ফলে বৌদ্ধধর্ম দ্রুত বিস্তার লাভ করেছিল। ফলে এই মতাদর্শ ক্রমাগত পরজীবীতার পক্ষপুটে আশ্রয় নেয় এবং এই মতাদর্শকে এমনভাবে পুনর্গঠিত করার প্রয়োজন দেখা দেয় যাতে তা রাজন্যবর্গের কার্যকরী সহযোগিতা করতে পারে। এটা করতে গিয়ে তারা এই মতাদর্শকে এতটাই রূপান্তরিত করে যে, তার অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তিকে মেরে দেয় এবং বুদ্ধের মৌলিক শিক্ষাগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে।

বণিক ও রাজন্যদের এই পৃষ্ঠপোষকতা নতুন নয়। বুদ্ধের জীবদ্দশাতেও আমরা এটা দেখেছি। তিনি বাস্তব সমস্যার কাল্পনিক সমাধান দিতে পেরেছিলেন, যার মধ্য দিয়ে হৃদয়ের প্রশান্তি লাভ করা সম্ভব এবং বাস্তব জীবন থেকে উদ্ভূত দুঃখকে জয় করা সম্ভব। কিন্তু তার জন্য তিনি অতিপ্রাকৃত সত্তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করার বা দেব দেবীর আরাধনার নিদান দেননি। কিন্তু পরবর্তীকালে যত রাষ্ট্র শক্তির প্রভাব বেড়েছে তার শাসন শোষণের মাত্রা বেড়েছে ততই বাস্তব জীবন থেকে উদ্ভূত সমস্যার সমাধানের রাস্তা খোঁজার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এটা করতে গিয়ে মহাযান বৌদ্ধরা আশ্রয় নিয়েছেন উপনিষদ এবং নানা অলৌকিক ধ্যান- ধারণার,বুদ্ধ নিজে যেগুলো প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ফলে একটা সময় উপনিষদীয় বা বেদন্তমতের সাথে তাদের বাস্তবে কোনও পার্থক্য থাকলো না। ফলে ভারতে তারা বেদান্ত দর্শনের কাছে আত্মসমর্পণ করল এবং নিজেদের প্রাসঙ্গিকতায় হারিয়ে ফেলল।

কেমন করে বৌদ্ধ মতাদর্শের বিচ্যুতি শুরু হল

এর সূচনা হয় বুদ্ধের মৃত্যুর প্রায় ১০০ বছর বাদে। বৌদ্ধদের মধ্যে একাংশ,মূলত বৈশালীর বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা গৌতম বুদ্ধ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের আচার-আচরণের ক্ষেত্রে সংযমের যে শিক্ষা দিয়েছিলেন,সেগুলো মেনে চলার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এগুলোর প্রয়োজনীয়তা নেই - এই প্রশ্ন তুলে তা মেনে চলতে অস্বীকার করেন। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একজন সিনিয়র নেতা জাসস (Yasas) এটা জানতে পেরে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের সমাবেশ আহ্বান করেন, যা দ্বিতীয় কাউন্সিল হিসেবে পরিচিত। স্বাভাবিকভাবেই এই সমাবেশে মূল আলোচ্য বিষয় হিসেবে রাখা হলো, বৈশালীর বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের বৌদ্ধ মতাদর্শ অনুসারী আচরণবিধি লঙ্ঘন। কাউন্সিল তাদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তারা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে অস্বীকার করেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে তারা আলাদা সমাবেশ আহ্বান করেন এবং বলা হয় এই সমাবেশে দশ হাজার সন্ন্যাসী উপস্থিত হন। এটাকে তারা বলেন মহাসমাবেশ এবং যারা এতে যোগ দিয়েছিলেন তাদের বলা হলো মহসাংঘিক। কয়েক দশকের মধ্যে জনপ্রিয়তা এবং শক্তি - উভয় দিক থেকেই এদের প্রতিপত্তি বেড়ে যায়। তারা শুধু যে সন্ন্যাসীদের আচরণবিধির পরিবর্তন করেন তাই নয়, পুরানো বৌদ্ধ শাস্ত্রের মধ্যেও তারা তাদের নিজেদের তত্ত্বগত উদ্ভাবনের ভিত্তিতে পরিবর্তন আনেন।এই প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত ফসল হল মহাযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উদ্ভব।

কিন্তু প্রশ্ন হল,মহাসাংঘিকরা বুদ্ধের মৌলিক পথ থেকে বিচ্যুত হলেন কেন? বৌদ্ধ ঐতিহ্য অনুসারে দশটি নিষিদ্ধ কর্মের (ten prohibitions) বা দশ অকথনীয়ের কথা বলা হয়েছে, বৌদ্ধদের ক্ষেত্রে যা লঙ্ঘন করা অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু বৈশালীর সন্ন্যাসীরা এর মধ্যে অন্তত কিছু বিষয় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাতিল করা উচিত বলে মনে করেছিলেন এবং সেজন্য সেগুলোকে তারা লংঘন করেছিলেন।

এর প্রকৃত কারণ পুরোটা জানা না থাকলেও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বিদ্রোহী সন্ন্যাসীরা বৌদ্ধদের জন্য যে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা আসত তাকে ব্যক্তিগতভাবে ভোগ করতে চেয়েছিলেন। 'বিনয়পিটক' গ্রন্থে এর কারণ বর্ণিত আছে এইভাবে - "ধনীকা নগর থেকে যাসস নামের একজন এরহাট(arhat) পাঁচশত অনুগামী নিয়ে এসেছিলেন। বৈশালীতে পৌঁছে তিনি দেখলেন, সেখানকার সন্ন্যাসীরা ভালো পরিমান আয় করে এবং এই আয়ের একটা বড় অংশ তারা নিজেরা নিয়ে নেয়।" এই গ্রন্থে আরও বলা হয়েছে যে,যাসস খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন যে, এই সন্ন্যাসীরা সংযমের অভ্যাস নিজেদের জীবনে পরিহার করেছেন।

এরকম আরও নানা কাহিনী বৌদ্ধ সাহিত্যের নানা জায়গায় উল্লেখ আছে। তার মধ্যে না গিয়েও আধুনিক গবেষকদের বক্তব্যকে অস্বীকার করা যায় না। তাঁরা বলেন, "বৈশালীর সন্ন্যাসীরা বৌদ্ধ সংঘের কিছু শৃঙ্খলা লঙ্ঘন করেন। বিশেষ করে তারা তাদের অনুগামীদের কাছ থেকে সোনা, রুপা এবং অর্থ সংগ্রহ করেছেন।.........বিনয়-পিটকের সমস্ত সংস্করণে স্বীকার করা হয়েছে যে, বিতর্কের মূল বিষয় ছিল সন্ন্যাসীদের আর্থিক অনুদানের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে।"

তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রত্যক্ষ আর্থিক অনুদান পাওয়ার ঘটনার সাথে সাথে বিদ্রোহী সন্ন্যাসীদের মধ্যে পরজীবীতার মানসিকতা তৈরি হতে দেখা যায় এবং সে জন্যই বৌদ্ধ মতাদর্শের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে অনাগ্রহের মনোভাব সৃষ্টি হতে দেখা যায়। কারণ বৌদ্ধ মতাদর্শের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা যাই থাকুক না কেন,সূচনা পর্বে বৌদ্ধ ধর্ম পরজীবীতার মানসিকতা থেকে উদ্ভূত হয়নি। মহসাংঘিকরাই বা তাদের একটা অংশ প্রথম বৌদ্ধ মতের মানবিক প্রতিষ্ঠাতার স্মৃতিকে সরিয়ে রেখে 'অতিপ্রাকৃত বুদ্ধ'র তত্ত্ব(লোকোত্তর বুদ্ধ) আমদানি করেছেন। এই তত্ত্বের ধারাবাহিকতাতেই ঘটনা পরম্পরায় মহাযান বৌদ্ধরা কাল্পনিক বুদ্ধ তত্ত্বের(fantastic Budhhology) জন্ম দিয়েছেন। তাছাড়া অতীন্দ্রিয়বাদী কল্পনার প্রতি তাদের অনুরাগ বৃদ্ধি হতে দেখা যায়, যা পুরোপুরি ভাববাদী চিন্তা না হলেও ভাববাদের খুব কাছাকাছি চিন্তা বলা যায়। এটা একটা আন্দোলনের সূচনা, যার পরিণতিতে শেষপর্যন্ত মহাযান সম্প্রদায়ের ভাববাদী দর্শনের উদ্ভব হয়।

এমন নয় যে, ভারতীয় দার্শনিক ঐতিহ্যে তাদের কোনও অবদান নেই। বরং দার্শনিক তত্ত্ব বিচারের ক্ষেত্রে পরিশীলিত ব্যাখ্যার যে দক্ষতা তাঁরা অর্জন করেছিলেন,তা মুন্সিয়ানার পরিচয় দেয়। এই অর্থে তাঁদের একটা সদর্থক ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভাববাদী চিন্তার পুনরূজ্জিবন ঘটিয়ে এবং তমসাছন্ন চিন্তাভাবনার চর্চা করে ভারতীয় দর্শনের ঐতিহ্যে তাঁরা যে ক্ষতি করেছেন সেই বিষয়টা মনে রাখা দরকার। মহাযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দার্শনিক চিন্তার উৎস হিসেবে এই সন্ন্যাসী দার্শনিকদের স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন মঠ জীবনের মধ্যে খুঁজতে হবে।

বণিক এবং রাজাদের দানের উপর ভিত্তি করে জীবন নির্বাহ করার সুযোগ তৈরি হওয়ায় তাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন মেটানোর জন্য ভাবতে হলো না। এর ফলে চিন্তা করার জন্য তারা অখন্ড অবসর পেলেন - আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের অবকাশ পেলেন। ফলে দার্শনিক ক্রিয়াকলাপকে উচ্চস্তরে নিয়ে যাওয়ার বাস্তব পরিবেশ তৈরি হলো। এটা তাদের সদর্থক অবদান। এখন তাঁরা শুধু তাঁদের মতবাদের পক্ষে যুক্তি তৈরি করতে সক্ষম হলেন তাই নয়, বিরোধী মতবাদকে খন্ডন করার জন্যও যুক্তিজাল বিস্তার করার সুযোগ পেলেন, যার ফলে বিরোধী মতবাদের প্রবক্তারা আবার তাদের নিজের নিজের মতবাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য নতুন নতুন যুক্তি তুলে ধরতে বাধ্য হলো। এইভাবে সামগ্রিকভাবে দার্শনিক চিন্তার বিকাশে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

এর পাশাপাশি আর একটি বিষয়ও ভুলে গেলে চলবে না। দৈহিক শ্রম বা বস্তুগত উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করার ফলে প্রকৃতির সাথে সজীব ও প্রত্যক্ষ সংযোগের সুযোগ থেকে তাঁরা বঞ্চিত হলেন।ফলে প্রকৃতির সাথে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেন এবং প্রকৃতির অন্তর্নিহিত নিয়ম জানার সুযোগ হারালেন। প্রকৃতি তাঁদের দর্শনে অনস্তিত্বে (nothingness) পরিণত হলো এবং তাঁরা মুক্তি বা নির্বাণ লাভের কথা কল্পনা করলেন কেবলমাত্র প্রকৃতির অস্তিত্বের ঘটনাকে অস্বীকার করে। তাই তাঁদের দর্শন বুঝতে হলে তাঁদের যুক্তির সূক্ষ্মতা বোঝাই যথেষ্ট নয়, তাঁরা কিভাবে বাস্তবে উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন সেটাও জানার প্রয়োজন রয়েছে। অর্থাৎ যে বাস্তব পরিবেশে সেই সময় মঠগুলিতে তাঁরা তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিকে দার্শনিক চিন্তার রূপ দিয়েছিলেন সেটা দেখাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

সমস্ত মঠের ঘটনার বিবরণ জানা না গেলেও সেই সময়ে মহাযান বৌদ্ধদের প্রধান কেন্দ্র নালন্দা সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায় চীনা পরিব্রাজক উয়াংচুয়াং- এর বিবরণ থেকে। জানা যায় যে,নালন্দা মঠের জায়গাটি ৫০০ বণিক ১০ কোটি স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে কিনেছিল এবং পাঁচ প্রজন্মের পাঁচজন রাজা এর সুন্দর হল প্রভৃতি নির্মাণ করতে অর্থ দান করেছিল, যেখানে উয়াং চুয়াং - এর বিবরণ অনুযায়ী ১০হাজার ছাত্র ও পনেরশ' শিক্ষক থাকতে পারত। তারা সারাদিন নানাবিধ শিক্ষা গ্রহণ এবং আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত থাকতো কিন্তু এতগুলো মানুষ শুধুমাত্র চিন্তাভাবনা করার জন্য এত রসদ পেতো কোথা থেকে

আর এক চিনা পরিব্রাজক টি সিং(T Sing) এর বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,তারা এই রসদ সংগ্রহ করত ২০০ গ্রামের রাজস্ব থেকে যে গ্রামগুলো বিভিন্ন প্রজন্মের রাজারা তাদের দান করেছিল। ফলে অবশ্যই এই গ্রামগুলোতে কয়েক হাজার মেহনতী মানুষ ছিল যাদের উদ্বৃত্ত উৎপাদন দিয়ে এই সন্ন্যাসীদের বেঁচে থাকার রসদ তৈরি হত।ফলে উৎপাদনের কষ্টসাধ্য কাজের পরিশ্রম থেকে তারা মুক্ত ছিল।অন্যান্য বৌদ্ধ বিহারের ক্ষেত্রেও তা সত্য।

এইভাবে বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহের কাজ থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়ে এই সন্ন্যাসীরা বা তাদের একটা অংশ বিশুদ্ধ কল্পনার কাজে নিয়োজিত হতে পেরেছিল। দৈহিক শ্রমের কষ্টসাধ্য কাজ থেকে মুক্ত হওয়ার ফলে তারা দার্শনিক মতবাদ তৈরি করার কাজে দক্ষতার অর্জন করতে পেরেছিলেন, একথা যেমন সত্য, তেমনি এও সত্য যে, এই প্রক্রিয়ায় তারা তাদের দর্শনকে এমনভাবে গড়ে তুললেন, যেখানে শুধু চিন্তাই থেকে গেল; কিন্তু যে বিষয়ে চিন্তা করা হলো সেই বাস্তব জগতের অস্তিত্বই অস্বীকার করা হলো। এইভাবেই বৌদ্ধ ঐতিহ্যের মধ্য থেকে ভাববাদের জন্ম হয়েছিল।

উপসংহার

বিজ্ঞান ও ইতিহাসের শিক্ষা থেকে আমরা জানি, কোনও চিন্তাই আকাশ থেকে আসে না।চিন্তার জন্ম হয় বাস্তব পরিবেশের সাথে মানব মস্তিষ্কের দ্বন্দ্ব সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে অর্থাৎ কোনও বিশেষ চিন্তার উদ্ভবের পেছনে থাকে একটা সুনির্দিষ্ট বাস্তবতা বা বাস্তব পরিবেশ। আমরা এও জানি যে, মানুষের আদিম চিন্তা ছিল বস্তুতান্ত্রিক, তখন ভাববাদী চিন্তা ছিল না। তাই এই প্রশ্নটা খুব স্বাভাবিক যে প্রাচীন সমাজের বস্তুতান্ত্রিক চিন্তার পরিমণ্ডলে কিভাবে ভাববাদী চিন্তা এবং ভাববাদীর দর্শনের উদ্ভব হল? ভারতীয় ভাববাদী দর্শনের উৎস রয়েছে কোন বাস্তব পরিবেশের মধ্যে

এতক্ষণ আমরা আলোচনা করে দেখিয়েছি যে, ভারতে ভাববাদী দর্শনের উৎস হলো উপনিষদ বা বেদান্ত। ঋক বৈদিক যুগের যৌথ সম্পত্তি ও যৌথ জীবনের ধ্বংসস্তূপ-এর উপর উপনিষদীয় ভাববাদের উদ্ভব। বৈদিক সমাজে শ্রেণীবিভাজন সৃষ্টি হওয়ার পর যে সমাজ বাস্তবতার উদ্ভব হয়েছিল, তার ওপর ভিত্তি করেই ভারতীয় ভাববাদের জন্ম।

পরবর্তী কয়েক শতাব্দী বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রবল প্রভাবের ফলে উপনিষদীয় চিন্তা চাপা পড়ে যায়। আবার খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে উপনিষদীয় চিন্তার পুনর্জন্ম হয় বৌদ্ধদের একটি সম্প্রদায়ের (মহাযান বৌদ্ধ) হাত ধরে। তারপরে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে বেদান্ত দর্শনের উদ্ভব হয় এবং অষ্টম শতকে অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন শংকরাচার্যের প্রবল প্রতাপে সারা ভারতে ব্যাপ্তি লাভ করে। তার আগে পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্মের সাথে যুক্ত চারটি দার্শনিক মতবাদ বিজ্ঞানবাদ ও শূন্যবাদ (মহাজান বৌদ্ধদের দার্শনিক মত) এবং বৈভাসিক ও সৌত্রান্ত্রিক (হীনযান বৌদ্ধদের দার্শনিক মত) যথেষ্ট ব্যাপ্তি নিয়ে প্রচলিত ছিল। এছাড়াও বেশ কয়েকটি বস্তুবাদী দর্শনেরও (যেমন, ন্যায় - বৈশেষিক, সাংখ্য, লোকায়ত প্রভৃতি) যথেষ্ট প্রভাব ছিল।বৌদ্ধ ঐতিহ্য থেকে আসা চারটি দর্শনের মধ্যে প্রথম দুটি দর্শন ভাববাদী এবং শেষের দুটি দার্শনিক মতবাদে বস্তুতান্ত্রিক চিন্তার প্রতিফলন পাওয়া যায়। শংকরাচার্যের অনুগামীরা বৌদ্ধদের উপর ব্যাপক অত্যাচার চালায় এবং বহু বৌদ্ধমঠ ধ্বংস করে। ফলে যে ভারতবর্ষে একসময় বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক প্রসার লাভ হয়েছিল সেখানে বৌদ্ধরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। এছাড়া অন্যান্য বস্তুবাদী দার্শনিকদের উপরেও একই রকম আক্রমণ নেমে এসেছিল। তাছাড়া শংকরাচার্য সাধারণ মানুষের বোঝার মতো করে তাঁর দার্শনিক মতবাদকে উপস্থাপিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।এই সবকিছুর মিলিত প্রভাবে অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন সমাজ মননকে ছেয়ে ফেলে। শংকরাচার্জের মায়াবাদ কার্যত মানুষের মধ্যে বস্তুজগতকে খুঁটিয়ে জানবার আকাংখ্যাকেই মেরে দেয়। ফলে আমরা দেখেছি যে,প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞানচর্চার যে উন্নতি ঘটেছিল,তা তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি।

তথ্যসূত্র:

  • What is living and what is dead in Indian philosophy _ Debiprasad Chattopadhyay, People's Publishing House, New Delhi,2010
  • প্রাচীন ভারতে বস্তুবাদের চর্চা - ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির প্রকাশনা; ২০১৪
  • ভারতীয় দর্শন - দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, এন বি এ, ২০১১
  • বৌদ্ধ দর্শন - রাহুল সাংকৃত্যায়ন, চিরায়ত প্রকাশন, ১৯৯৯
  • A History of Indian Philosophy - Prof.Surendranath Dasgupta, Cambridge, 1922-55