বিভাগগুলি

প্রাচীন ভারতে দর্শন চর্চা ও বিজ্ঞান চর্চায় তার প্রভাব – প্রথম পর্ব

source: https://www.dreamstime.com/


সুব্রত গৌড়ী

আমাদের দেশ পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে অন্যতম। স্বাভাবিকভাবেই সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে নানা ধরনের দার্শনিক চিন্তার বিকাশ ঘটেছে। এই দার্শনিক মতবাদগুলিকে দুটি ধারায় ভাগ করা যায় - বস্তুবাদ ও ভাববাদ যে সমস্ত দর্শনে ভাব নিরপেক্ষভাবে বস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় এবং বস্তু থেকেই ভাবের সৃষ্টি বলে মনে করা হয় ,তাদের বলা হয় বস্তুবাদী দর্শন। অন্যদিকে যে সমস্ত দর্শন বস্তু বহির্ভূত সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করে এবং তাকেই মূল সত্য হিসাবে গণ্য করে তাদের বলা হয় ভাববাদী দর্শন। এখানে বস্তুর অস্তিত্ব যদি স্বীকার করা হয়ও তবু তার ভূমিকা নিতান্ত গৌণ বলে মনে করা হয় এবং ধরে নেওয়া হয় যে ভাব থেকেই তার সৃষ্টি।

ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম লিখিত সাহিত্য পাওয়া যায় বৈদিক যুগে। তাই বৈদিক সমাজে মানুষের চিন্তা সংরক্ষিত আছে বৈদিক সাহিত্যে। তাই বৈদিক সমাজের চিন্তা বিশ্লেষণ করে আমরা আমাদের আলোচনা শুরু করব। আমরা জানি বৈদিক সাহিত্য প্রায় এক হাজার বছর ধরে রচিত হয়েছিল। ফলে এটা খুব স্বাভাবিক যে, এই সুদীর্ঘ সময়কালে মানুষের চিন্তা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল না। তার বিকাশের একটা ইতিহাস আছে।

প্রাচীন বৈদিক সমাজের চিন্তা ছিল বস্তুতান্ত্রিক

অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতায় যেমন আদিতে মানুষের চিন্তা ছিল বস্তুতান্ত্রিক ,বৈদিক সমাজের মধ্যে আমরা তার ব্যতিক্রম দেখি না। বৈদিক সমাজেও আদিতে মানুষের চিন্তা ছিল বস্তুতান্ত্রিক। তাই আমরা দেখি ,বৈদিক সাহিত্যের প্রাচীনতম অংশে ,বস্তুত ঋকবেদের প্রধানতম অংশে যে ভাবধারার পরিচয় পাওয়া যায় ,তাকে বস্তুতান্ত্রিক বলাই যুক্তিসম্মত। বৈদিক ঐতিহ্যে ঐ বস্তুতান্ত্রিক ভাবধারার ধ্বংসস্তূপের উপরই কালক্রমে অধ্যাত্মবাদী ভাবধারার আবির্ভাব ঘটেছিল - ঋকবেদ থেকে উপনিষদ পর্যন্ত এই সুবিশাল সাহিত্যে এই চিন্তা বিবর্তনের একটা ধারাবাহিক ইতিহাস সংরক্ষিত হয়েছে এবং এমনকী উপনিষদের মধ্যেও প্রথমদিকের প্রাক অধ্যাত্মবাদী ভাবধারার বহু স্মারক টিকে থেকেছে।

এই বস্তুতান্ত্রিক চিন্তার নিদর্শন হিসাবে আমরা দেখি, আদি পর্যায়ের বৈদিক কবিদের পরম চিন্তাই যেন অন্ন-চিন্তা, তত্ত্ব-জিজ্ঞাসা তাদের রচনার বৈশিষ্ট্য নয়। তাই সমগ্র ঋগ্বেদ জুড়ে কয়েকটি পার্থিব কামনার অন্তহীন পুনরুক্তি দেখা যায় -অন্নের কামনা ,পশুর কামনা ,সন্তানের কামনা ইত্যাদি। পরবর্তীকালে উপনিষদ সাহিত্যে অধ্যাত্মবাদী দর্শনে যে মোক্ষের কামনা পরম প্রাপ্তি বলে স্বীকৃত ,ঋকবেদে তার অভাব চোখে পড়ে।

একথা সত্য যে ঋকবেদে বহু দেবতার কথা আছে। কিন্তু এই দেবতাদের নজির থেকেও ঋকবেদে প্রকৃত অধ্যাত্মবাদ প্রমাণিত হয় না। কারণ এই দেব কল্পনার প্রধান উপাদান হলো পার্থিব কামনা। তাছাড়া এই বৈদিক দেবতা ও বৈদিক মানবদের মধ্যে পার্থক্যও খুব স্পষ্ট নয়। আর বস্তু বহির্ভুত সত্তা হিসাবে দেবতার কল্পনার ভিত্তিতে দার্শনিক তত্ত্ব অন্বেষণ বলতে যা বোঝায় তার কোনও দৃষ্টান্ত ঋকবেদে পাওয়া যায় না।

প্রাচীন কবিদের রচনায় যদি বাস্তবিকই কোনও অস্ফুট দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির আভাস থাকে তাহলে তার পরিচয় পাওয়া যায় ঋতর তত্ত্বে। ঋত‘র কোনও আধুনিক প্রতিশব্দ পাওয়া সম্ভব নয়। ধারণাটিকে বিশ্লেষণ করে প্রাকৃতিক নিয়মানুবর্তিতা ও নৈতিক নিয়মানুবর্তিতার কোনও এক আদিম সমন্বয় বলে অনুমান করা হয়। এই নিয়মানুবর্তিতা কিন্তু দেবতাদের ইচ্ছাধীন বা আয়ত্তাধীন নয়। বরং দেবতারা ঋতর অনুগামী এবং মানুষের মতোই ঋতযুক্ত। তাই ঋতকেও অধ্যাত্মবাদের নজির বলা যায় না।

তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে দেবতা বলতে বস্তু নিরপেক্ষ যে সত্তার কল্পনা করা হয় ,ঋকবেদের যুগে সে ধারণা ছিল না। প্রকৃতির সুন্দর ও বিস্ময়কর দৃশ্য দেখে প্রাচীন বৈদিক মানুষের সরল হৃদয়ে যে ভাবের সঞ্চার হত, তা থেকেই তাদের মধ্যে নানা দেবতার কল্পনা গড়ে উঠেছিল। তাই ঋকবেদের দেবতারা কোনও না কোনও প্রাকৃতিক শক্তি বা বস্তুকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছিল। যেমন ,জোতির্ময় আকাশ (বা দৌঃ) তাদের চিরবিস্ময় বা উপাসনার বিষয় ছিল। সূর্য ,উষা, অগ্নি ,পৃথিবী ,জল ,মেঘ, বজ্র, বাতাস - এইসব পার্থিব বস্তুর উপাসনা ছিল বৈদিক মানুষের নিত্যদিনের অভ্যাস।

পরবর্তী বৈদিক সমাজে চিন্তার সুস্পষ্ট পরিবর্তন চোখে পড়ে উপনিষদের যুগে - যখন বস্তু বহির্ভূত সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস সুস্পষ্টরূপে চোখে পড়ে। কিন্তু উপনিষদ পরবর্তী প্রায় 600 বছর উপনিষদের চিন্তা প্রায় হারিয়ে যায়। এই সময় বেশকিছু বস্তুবাদী দর্শন মানুষের চিন্তাকে প্রভাবিত করে। এই দর্শনগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল - লোকায়ত ,সাংখ্য এবং ন্যায়-বৈশেষিক। এছাড়াও পূর্ব মীমাংসা এবং মহাবীর জৈন ও গৌতম বুদ্ধের চিন্তাতেও বস্তুবাদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

লোকায়ত দর্শন

লোকায়ত নামকরণের তাৎপর্য আলোচনা দিয়েই শুরু করা যাক। কেন লোকায়ত ?লোকেষু আয়তো লোকায়তঃ। জনসাধারণের মধ্যে পরিব্যাপ্ত বলেই লোকায়ত। অর্থাৎ ‘জনসাধারণের দর্শন’ এবং ‘বস্তুবাদী দর্শন’ উভয় অর্থেই লোকায়ত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এই জনসাধারণ বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে ?ইতর জনসাধারণ ,অর্থাৎ নিতান্তই সাধারণ মানুষ ,যারা নির্বিচারে আচরণ করে, যাদের কাছে অর্থ ও কামই বুঝি জীবনের চরম লক্ষ্য। বোঝাই যায় ,এইসব বিশেষণের মধ্যে একটা তাচ্ছিল্যের সুর ফুটে উঠেছে। ওঠবারই কথা। কারণ বিশেষণগুলি চরম ভাববাদী শংকরাচার্য ও তার অনুগামী মাধবাচার্যের।

এই বস্তুবাদী দর্শনটির নামকরণের ক্ষেত্রে আরও একটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। আনুমানিক অষ্টম শতক থেকে এই বস্তুবাদী দর্শনটি চার্বাক নামেই উল্লেখিত হয়েছে। কে এই চার্বাক ?মহাভারতের কাহিনী অনুসারে চার্বাক হল এক রাক্ষস ,দুর্যোধন সখা এবং ব্রাহ্মণ্যমতের তীব্র সমালোচক। তার তীব্র ব্রাহ্মণ বিদ্বেষ এবং তার বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণদের তীব্র আক্রোশ - এই দুটি বৈশিষ্ট্য বস্তুবাদীদের পক্ষে প্রাসঙ্গিক। তাই এই রাক্ষসের নাম থেকে বস্তুবাদী দর্শনটির নামকরণ অসম্ভব নয়। লক্ষ্যনীয় যে, যে সময় থেকে আমাদের দেশে ভাববাদের প্রবল প্রভাব শুরু হল, সেই সময় থেকে এই দর্শনটির চার্বাক নামকরণ হয়েছ। তাই এটা অসম্ভব নয় যে, এই দর্শনটিকে রাক্ষুসে দর্শন হিসাবে দেখিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা হয়েছে ভাববাদীদের পক্ষ থেকে।

তবে প্রাচীন গ্রন্থে লোকায়ত শব্দ সর্বত্রই নিন্দাসূচক নয়। কোনও কোনও লেখায় নামটির সঙ্গে বেশ কিছুটা মর্যাদার সম্পর্কও চোখে পড়ে। তাই নামটা পাল্টে চার্বাক করে নিলে দর্শনটিকে রাক্ষুসে মত বলে প্রচার করার সুযোগ হয়। ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে অষ্টম - নবম শতাব্দীতেই বিতর্ক পর্ব প্রায় তুঙ্গে উঠেছিল। তাই ভাববাদীদের পক্ষ থেকে চরম বস্তুবাদী এই দর্শনটিকে নির্মূল করার চেষ্টা স্বাভাবিক। তাই পালি সাহিত্য বিশারদ রিস ডেভিডস অনুমান করেছেন ,খুব সম্ভবত মহাভারতের চার্বাক রাক্ষসের নাম থেকেই পরবর্তীকালে বস্তুবাদী দর্শনটির চার্বাক নামকরণ করা হয়েছিল।

লোকায়ত মতের উৎস

সাধারণতঃ কোনও দার্শনিক মতের পরিচয় পাওয়া যায় সেই মতাবলম্বী কোনও দার্শনিকের রচনা থেকে। কিন্তু লোকায়ত বা চার্বাক দর্শনের কোনও গ্রন্থ পাওয়া যায় না। মনে করা হয় প্রাচীনকালে লোকায়তিক গ্রন্থ বাস্তবিকই ছিল। অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তর মতে অন্তত খ্রিষ্টপূর্ব 150 বছর আগে বা হয়ত খ্রিস্টপূর্ব তিনশ বছর পূর্বে লোকায়তর কোনও না কোনও গ্রন্থ অবশ্যই প্রচলিত ছিল এবং তার উপর ভাগুরি রচিত অন্তত একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ অবশ্যই সুবিদিত ছিল। তাহলে সেই গ্রন্থগুলো বিলুপ্ত হল কিভাবে ?অধ্যাত্মবাদী ও ভাববাদী দার্শনিকদের প্রবল লোকায়ত বিদ্বেষ থেকে এটা অনুমান করা যায় যে ,সাধারণ মানুষের মধ্যে এই মতটির শেকড় অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত ছিল এবং সেই কারণেই লোকায়ত বিরোধীরা এই মতের অনুসারী সমস্ত গ্রন্থই ধ্বংস করেছেন।

তাই লোকায়ত মতের সন্ধান পাওয়া যায় পরোক্ষ উপকরণ থেকে। এগুলি হল (1) ‘অর্থশাস্ত্র’ প্রভৃতি কিছু প্রাচীন গ্রন্থ (2) ,প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত ,অতএব প্রামাণিক কিছু লোকগাথা (3) ,পূর্বপক্ষ হিসাবে চার্বাক বা লোকায়ত বর্ণনা। অর্থাৎ আমাদের দেশের দার্শনিক সাহিত্যের ঐতিহ্য অনুসারে কোনও মত খন্ডন করার আগে মতটা আসলে কী, তা বর্ণনা করে নেওয়ার প্রচলন ছিল। একে বলে পূর্বপক্ষ এবং তা খন্ডন না করে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করা যেত না। ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে বহু দিকপাল দার্শনিক প্রবল উৎসাহে চার্বাক বা লোকায়ত মত খন্ডন করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের লেখায় পূর্বপক্ষ হিসাবে লোকায়ত মতের বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে সেই বর্ণনাগুলিকে নির্বিচারে গ্রহণ করা উচিত নয়। কারণ দর্শনটিকে খেলো প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে পূর্বপক্ষ বর্ণনায় চার্বাকদের সম্পর্কে অনেক অসার কথা গুঁজে দেওয়ার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। তা সত্ত্বেও চার্বাক মত বোঝার ব্যাপারে পূর্বপক্ষ বর্ণনার যথেষ্ট গুরুত্ব আছে।

লোকায়ত মত বলতে কী বোঝায় ?

লোকায়ত মত বলতে যা বোঝাত তার প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি- (1) ভূতবাদ - ক্ষিতি ,অপ, তেজ ও বরুণ - এই চতুৰ্ভূতই চরম সত্য। (2) দেহাত্মবাদ - দেহাতিরিক্ত আত্মার কল্পনা নিতান্তই অলীক। (3) প্রত্যক্ষ প্রাধান্যবাদ - প্রমাণের মধ্যে প্রত্যক্ষই প্রধান ,তাই অপ্রত্যক্ষ বিষয়ের অনুমান অবান্তর। (4) স্বভাববাদ - স্বভাবই জগৎ বৈচিত্রের কারণ, তাই জগৎস্রষ্টা বা ঈশ্বরের চিন্তা অবশ্যই অলীক এবং (5) পরলোক বিলোপবাদ - পরলোকগামী আত্মার অভাবে পরলোকের পরিকল্পনাও অবান্তর।

এবার বিষয়গুলি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। ভূতবাদ ও দেহাত্মবাদ পরস্পর সম্পর্কিত। তাই বিষয় দুটি একই সাথে আলোচনা করা যায়। লোকায়ত মতে দেহ গঠনের মূল উপাদান হল আগুন ,বাতাস ,জল ও মাটি। অর্থাৎ ভূত পদার্থই। কিন্তু এই উপাদানগুলির মধ্যে কোথাও চেতনার প্রকাশ নেই। এগুলি সবই অচেতন ,অর্থাৎ জড় পদার্থ। অথচ মানুষ প্রভৃতির দৃষ্টান্তে চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। তাই চরম ভাববাদী শঙ্করাচার্যের মতে এই চেতনা বা চৈতন্যের দৃষ্টান্ত থেকেই প্রমাণ হয় যে ,মানুষ প্রভৃতির চেতনসত্তার ক্ষেত্রে আত্মা বলে দেহাতিরিক্ত কিছু মানা দরকার ,কারণ আত্মাই চেতন পদার্থ বা চৈতন্য বিশিষ্ট।

এর উত্তরে লোকায়তিকরা বলেন - আত্মা বলে কিছু নেই। নিছক দেহকেই তারা আত্মা বলে বোঝেন। তাদের মতে বাহ্য ভূতবস্তুগুলিতে স্বতন্ত্রভাবে চেতনার প্রকাশ নেই, সেগুলি জড়বস্তুই কিন্তু এই ভূতবস্তুগুলি শরীরাকারে পরিণত হলে তাতে চৈতন্যের উদ্ভব হয়। তারা জ্ঞান বা চৈতন্যের উদ্ভবকে মদশক্তির সাথে তুলনা করেছেন। অর্থাৎ মদ তৈরির জন্য কিন্ব - খামির বা গাঁজ প্রভৃতি বস্তু ব্যবহার করা হয়। এগুলির কোনওটিতেই মদশক্তির পরিচয় নেই। এগুলির কোনওটি খেলেই নেশা হয় না। কিন্তু এগুলি দিয়ে মদ তৈরি করলে বা এগুলিই মদিকাকারে পরিণত হলে তাতে মদশক্তির উদ্ভব হয় বা সেই মদ খেলে নেশা হয়। এইভাবে জড়বস্তুগুলিই দেহ আকারে পরিণত হলে - অর্থাৎ এগুলি থেকেই দেহ তৈরি হলে ,সেই দেহে চৈতন্যের উদ্ভব হয়। তাই লোকায়তিকদের মতে ,মানুষ বলতে চৈতন্য বিশিষ্ট দেহ ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই স্বর্গ গমন বা মোক্ষ লাভে সমর্থ আত্মা নেহাতই কাল্পনিক।

আত্মবাদীরা ,অর্থাৎ যারা দেহ ছাড়াও আত্মা বলে স্বতন্ত্র কিছু মানতে চান ,তাঁরা প্রাণ ,চৈতন্য ,স্মৃতি প্রভৃতিকে এই আত্মার ধর্ম বা গুণ বলে কল্পনা করেন। লোকায়তিকরা বলেন এসবই দেহতে উপলব্ধ হয় ,দেহ ছাড়া আর কোথাওই উপলব্ধ হয় না। তাই দেহকে বাদ দিয়ে এমন কিছু মানা যায় না যার ধর্ম বা গুণ বলতে প্রাণ, চেষ্টা, চৈতন্য, স্মৃতি প্রভৃতিকে আত্মা বলে মানবার সুযোগ আছে। দেহের বর্তমানতায় বর্তমান ,এবং অবর্তমানতায় অবর্তমান বলে এগুলিকে দেহ ধর্ম বলেই মানতে হবে। এই অর্থে দেহই আত্মা বা দেহাত্মবাদ।

ভাববাদী দার্শনিকরা মূলত অনুমান প্রমাণের উপর নির্ভর করেছেন এবং সেই অনুমান অপ্রত্যক্ষ পারলৌকিক অনুমান। পক্ষান্তরে চরম বস্তুবাদী দার্শনিক হিসেবে চার্বাকরা প্রত্যক্ষ প্রমাণের উপর নির্ভর করেছেন। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতায় যা প্রত্যক্ষ করা যায়, সেই ধরণের প্রমাণের উপরই চার্বাকরা নির্ভর করতে বলেছেন।

তবে চার্বাকরা একেবারে কোনওরকম অনুমানই মানতেন না ,এরকম ভাবার কোনও কারণ নেই। বরং অন্যান্য নজির থেকে মনে হয় ,পরলোক ইত্যাদি একান্ত অপ্রত্যক্ষ বিষয়ে অগ্রাহ্য করলেও প্রত্যক্ষ গোচর বিষয়ে সাধারণ বা লৌকিক অনুমান জানবার ব্যাপারে তাদের কোনও বাধা ছিল না। সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত যেভাবে চার্বাক মত ব্যাখ্যা করেছেন তা হ’ল এই রকম —

“(আনুমানিক সপ্তম শতকে) চার্বাক মতানুগামী পুরন্দর নামে দার্শনিক প্রত্যক্ষ সাপেক্ষ পার্থিব বা ইহলৌকিক বিষয়ে অনুমানের উপযোগিতা স্বীকার করেন। কিন্তু প্রত্যক্ষাতীত লোকোত্তর বিষয়ে বা পরলোক ও কর্মফল প্রভৃতি বিষয়ে কোনও মত অনুমানের নজির দেখিয়ে প্রমাণ করা যায় না। সাধারণ অভিজ্ঞতায় জানা ব্যবহারিক জীবনে অনুমানের প্রাধান্য এবং অভিজ্ঞতা বহির্ভূত বা অতীন্দ্রিয় বিষয়ে অনুমানের অনুপযোগিতা - এই দুয়ের পার্থক্য প্রদর্শনের মূল যুক্তি হ’ল, দুটি বিষয়ের মধ্যে নিয়ত সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত না হলে অনুমান সম্ভব নয়। দার্শনিক পরিভাষায় এই দুটিকে বলে লিঙ্গ (যেমন ধূম) এবং সাধ্য (যেমন আগুন বা বহ্নি)। ধূম ও বহ্নির মধ্যে নিয়ত - সম্বন্ধ স্বীকৃত বলেই ধূম থেকে বহ্নির অনুমান হয়। এ ধরণের নিয়ত - সম্বন্ধ স্থাপনের ক্ষেত্রে দুটি শর্ত রয়েছে। প্রথমটি হল বহু দৃষ্টান্তে উভয়কেই একত্রে দর্শন। যেমন ,বহু দৃষ্টান্তে দেখা গেছে যে, যেখানেই ধূম বর্তমান সেখানেই বহ্নি বর্তমান। দ্বিতীয়টি হল বহু দৃষ্টান্তে একটির অভাবে অপরটিরও অভাব দেখতে পাওয়া যায়। যেমন, বহু দৃষ্টান্তে দেখা গেছে বহ্নি-শূন্য স্থানে ধূম অবর্তমান। কিন্তু এই দুটি শর্তপূরণ পারলৌকিক বিষয়ে অসম্ভব। কেননা ,কোনও ক্ষেত্রেই পরলোক প্রত্যক্ষ গোচর হতে পারে না। অতএব পরলোকাদি প্রসঙ্গে কোনও নিয়ত সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নই ওঠে না। তাই পরলোকাদি প্রসঙ্গে অনুমানও অসম্ভব। শুধুমাত্র প্রত্যক্ষ গোচর ইহলৌকিক বিষয়ে দ্বিবিধ দৃষ্টান্ত দর্শনের সম্ভাবনা আছে। তাই প্রত্যক্ষ গোচর লৌকিক বিষয়ে সাধারণ স্বীকৃত অনুমানের উপযোগিতা মানা যায়"।

তাহলে আমরা দেখছি যে, প্রকৃত চার্বাক মতে প্রত্যক্ষ অবশ্যই প্রমাণ শ্রেষ্ঠ - অর্থাৎ প্রমাণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু প্রত্যক্ষ অনুগামী ইহলোক প্রসঙ্গে অনুমানকে প্রমাণ বলে মানায় কোনও বাধা নেই। কেবল পরলোক ,কর্মফল ,আত্মা প্রভৃতি বিষয়ে অনুমান নিষ্ফল—একদল ধূর্ত এইসব বিষয়ে অনুমান প্রমাণ দেখাবার চেষ্টা করে লোক ঠকাবার চেষ্টা করে।

এবার স্বভাববাদের প্রসঙ্গে আসা যাক। আগেই বলেছি যে ,চার্বাক মতে ভূতবস্তুগুলি অচেতন হলেও সেগুলিই ‘দেহাকারে পরিণত হলে চৈতন্য বিশিষ্ট‘ হয়। এই পরিবর্তন কেমন করে সম্ভব হয় ?এ প্রসঙ্গেই স্বভাববাদের আলোচনা এসেছে। জল শীতল। কেন ?কারণ জলের স্বভাবই তাই। অগ্নি উষ্ণ। কেন ?অগ্নির স্বভাবই হল উষ্ণ। একইভাবে চার্বাকদের পক্ষ থেকে অনায়াসে বলা যায় ,চতুৰ্ভূতের স্বভাবই হল ,পরিস্থিতি বিশেষে তা 'দেহাকারে পরিণত হয় এবং দেহাকারে পরিণত হলে তাতে চেতনার উদ্ভব হয়’। মনে রাখতে হবে স্বভাববাদের মূল কথাটা হ‘ল ,প্রাকৃতিক নিয়ম। প্রাচীনকালের বিভিন্ন নজির থেকে দেখা যায়, ভূতবাদী চার্বাকরা স্বভাববাদীও ছিলেন। বস্তুতপক্ষে স্বভাববাদ না মানলে ভূতবাদ বা চরম বস্তুবাদ প্রমাণ করা কঠিন। মহাভারতে তো সরাসরি বলা হয়েছে ‘স্বভাবং ভূত চিন্তকামঃ' - যারা শুধু ভূতবস্তু নিয়েই চিন্তা করেন ,বা শুধু ভূত বস্তুকেই মানেন ,তাঁরা স্বভাববাদী। 'বৃহৎ সংহিতা'র ব্যাখ্যায় ভট্ট উৎপল বলছেন - '...লোকায়তিকেরা স্বভাবকেই জগৎ কারণ হিসাবে গ্রহণ করেন ;স্বভাবের জন্যই বৈচিত্র্যময় জগতের উৎপত্তি ,স্বভাববশতই তার বিলোপ।

জৈন দার্শনিক গুণরত্ন স্বভাববাদ প্রসঙ্গে বলেছেন - 'স্বভাববাদীরা নিম্নোক্ত দাবি করবেন, স্বভাব বলতে বোঝায় বস্তুর স্বীয় বা স্বকীয় পরিনাম। স্বভাবের জন্যই সবকিছুর উৎপত্তি। যেমন ,মৃত্তিকার পরিনাম ঘট, পট নয়। তেমনই তন্তু বা সূতো থেকে শুধুই পটই তৈরি হয়। স্বভাব ছাড়া এধরনের পরিনাম নিয়মের কোনও ব্যাখ্যাই সম্ভব নয়। অতএব সবকিছুই স্বভাবের পরিণাম বলতে হবে।

সাধারণত, স্বভাব শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ বলতে বোঝায় নেচার (Nature)। যে কোনও পার্থিব ঘটনার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তার পার্থিব কারণটুকুই পর্যাপ্ত। তার জন্য অতিপ্রাকৃত বা প্রকৃতি বহির্ভূত কোনও কিছু মানবার প্রয়োজন হয় না। স্বভাব বলতে প্রাচীন প্রাচীন বস্তুবাদীরা ’প্রাকৃতিক নিয়ম’ বা অন্তত তারই খুব কাছাকাছি একটা ধারণা অবলম্বন করতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ প্রাচীন লোকায়ত বা চার্বাক মতে জগৎ-বৈচিত্র্যের কোনও অধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা খোঁজার প্রয়োজন নেই ,কেননা স্বভাববাদের মধ্যেই তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

লোকায়ত দর্শনের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল পরলোক বিলোপবাদ। অর্থাৎ লোকায়তিকেরা পরলোকে বিশ্বাস করে না। দেহাত্মবাদের ধারণার সাথে পরলোক বিলোপবাদ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। অর্থাৎ দেহাত্মবাদ মানলে পরলোক বিলোপবাদ মানতেই হবে। এ সম্পর্কে তত্ত্ব আলোচনায় না গিয়ে মাধবাচার্য উল্লিখিত কয়েকটি প্রামাণিক লোকগাথার উল্লেখ করছি ,যেখানে পরলোক বিলোপবাদের যুক্তির ধারাটা বোঝা যায় –

‘জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞে নিহত পশু যদি সরাসরি স্বর্গেই যায় তাহলে ,যজমান কেন তার নিজের পিতাকে হত্যা করে না ?'

'কেউ মারা যাবার পর শ্রাদ্ধ কর্ম ,যদি তার তৃপ্তির কারণ হয় ,তাহলে তো প্রদীপ নিভে যাবার পরেও তেল ঢেলে তার শিখা প্রদীপ্ত করা যেত।'

'যে পৃথিবী ছেড়ে গেছে তার পাথেয় (পিণ্ড) কল্পনা করা বৃথা ,কেননা তাহলে ঘর ছেড়ে কেউ গ্রামান্তরে গমন করলে, ঘরে বসে তার উদ্দেশ্যে পিণ্ড দিলেই তো তার পাথেয় ব্যবস্থা সম্পন্ন হত‘।

‘যিনি স্বর্গে গেছেন তাঁর উদ্দেশ্যে দান নেহাতই বৃথা, কেননা যিনি প্রাসাদের উপরে উঠে গেছেন ,তাঁর উদ্দ্যেশ্যে (মাটিতে বসে) দান করলেও তো তাঁর তৃপ্তি হবার কথা‘।

এই লোকগাথাগুলি থেকে এটা পরিষ্কার যে ,আত্মা, পরলোক, পারলৌকিক ক্রিয়া প্রভৃতিকে লোকায়তিকেরা কী চোখে দেখতেন। তাই বোঝা যায় লোকায়তিকদের চিন্তার অন্যতম উপাদান হল পরলোক বিলোপবাদ।

সাংখ্য দর্শন

সাংখ্য দর্শন হল আদিম বস্তুবাদী দর্শন। সাংখ্য - সম্প্রদায়ের প্রবর্তক হিসাবে কপিলের নাম সুপ্রসিদ্ধ। কিন্ত কপিল সম্পর্কে কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। এ সম্বন্ধে প্রায়ই নানান ধরণের মত পাওয়া যায়। এমনকী পরস্পরবিরোধী মতও অপ্রতুল নয়। এ বিষয়ে পৌরাণিক কাহিনী পাওয়া গেলেও সঠিক ঐতিহাসিক তথ্য প্রায় কিছুই পাওয়া যায় না।

সাংখ্য দর্শনের পুঁথি বলতে দুটি মাত্র পাওয়া যায় – সাংখ্যকারিকা এবং সাংখ্যসূত্র। সাংখ্যকারিকার রচয়িতা ঈশ্বরকৃষ্ণ। এর রচনাকাল নিয়ে মতভেদ আছে। তবে মনে করা হয় সাংখ্যকারিকা রচিত হয়েছিল খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে। আর সাংখ্যসূত্রের রচনাকাল খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে। কিন্তু সাংখ্যসূত্রের মধ্যে প্রকৃত সাংখ্যমত পাওয়া যায় না। সাংখ্যসূত্র প্রকৃতপক্ষে বেদান্তমতে ভরপুর। তাই সাংখ্যের দুটো সংস্করণ পাওয়া যায়। একটি মত, বেদান্ত অনুসারী, সাংখ্যের আদি দার্শনিক মতের উপর ভাববাদী চিন্তার আরোপ। আর একটি হল সাংখ্যের আদি সংস্করণ, যা প্রকৃত বিচারে বস্তুবাদী দার্শনিক চিন্তা।

আদি সাংখ্যের উৎস

আদি সাংখ্যের কোনও পুঁথি পাওয়া যায় না। ঈশ্বরকৃষ্ণের সাংখ্যকারিকায় 'ষষ্ঠীতন্ত্রে'র উল্লেখ পাওয়া যায়। বাচস্পতি মিশ্র তাঁর সাংখ্যকারিকার টীকায় 'বাজবার্তিক' নামক একটি পুরানো পুঁথির উল্লেখ করেছেন। গুণরত্ন আরও দুটি সাংখ্য পুঁথির উল্লেখ করেছেন - ‘আত্রেয়তন্ত্র’ ও ‘সাঠরভাষ্য’। কিন্তু এই পুঁথিগুলির সবকটিই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাছাড়া কপিল, আসুরি, পঞ্চশিখ, বোড় প্রমুখ যে সমস্ত প্রাচীন সাংখ্যাচার্য্যদের নাম পাওয়া যায় তাঁদের কোনও রচনা পাওয়া যায় না।

তবে আদি সাংখ্যের কোনও পুঁথির অভাবে প্রত্যক্ষভাবে এসম্পর্কে কোনও তথ্য প্রমাণ না থাকলেও পরোক্ষ তথ্য প্রমাণের সাহায্যে আমরা একটা সঠিক ধারণা বা তার কাছাকাছি ধারণায় পৌঁছাতে পারি। যেমন, চরক সংহিতায় সাংখ্য মতের পরিচয় পাওয়া যায়। এই সাংখ্য মতের সাথে সাংখ্যকারিকায় বর্ণিত সাংখ্য মতের পার্থক্য রয়েছে এবং অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত মনে করেন যে, চরক সংহিতা একটি ভিন্নধর্মী সাংখ্যের ধারাকে প্রতিফলিত করছে।

এছাড়া মহাভারতে সাংখ্য এবং যোগকে বেদের মতই সনাতন আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে সাংখ্য, যোগ এবং লোকায়তকেই কেবল দর্শনের মর্যাদা দিয়েছেন। অশ্বঘোষ লিখেছেন, গৌতম বুদ্ধের দুজন গুরু আষাঢ় কালাম ও উদ্দক রামপুত্ত সাংখ্য মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। বুদ্ধের বয়োজ্যেষ্ঠ সমকালীন পুকুধ কাচ্চায়নের দার্শনিক মতবাদ বহুলাংশে সাংখ্যের অনুরূপ ছিল। কেউ কেউ মনে করেন যে, সাংখ্য সম্প্রদায়ের প্রবর্তক কপিলের নাম থেকেই বুদ্ধের জন্মস্থান কপিলাবস্তুর নামকরণ হয়েছিল।

সাংখ্য দর্শনের মূল বৈশিষ্ট্য

কার্যকারণ সম্পর্ক প্রসঙ্গে সাংখ্য দর্শনে একটি সুনির্দিষ্ট মতবাদ আছে। তার নাম সৎকার্যবাদ বা পরিণামবাদ। এই মত অনুসারে কার্য একান্তভাবেই কারণের পরিনাম। কার্যের মধ্যে এমন কিছু থাকতে পারে না, যা কারণের মধ্যে, অন্ততঃ অস্ফুট বা বীজাকারে হলেও বর্তমান নেই। তাই একথা বলা যায় যে, কার্যের মধ্যে যা বর্তমান কারণের মধ্যেও তার অনুমান করা যায়। পরিদৃশ্যমান জগৎ আসলে কার্য এবং তা জড়রূপ। সাংখ্যে এই জড়রূপ জগৎকারণকে প্রকৃতি বা প্রধান আখ্যা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রকৃতিকে primordial matter বলা হয়। মনে রাখতে হবে, এই প্রকৃতি বলতে যে জগৎকে আমরা দেখি, সেই স্থূল জগৎ নয়। প্রকৃতির উপাদান ত্রিবিধ - সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ। এগুলিকে পারিভাষিক অর্থে গুণ বলা হয়। তিনটি গুণের মধ্যে সাম্যাবস্থা বিচ্যুত হলে প্রকৃতি থেকে ক্রমশঃ স্থূল জগতের উদ্ভব হয়। ক্রমবিকাশ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রকৃতির যে আদিম অবস্থা তার নাম অব্যক্ত। অর্থাৎ পরিদৃশ্যমান জগৎ যে প্রকৃতি থেকে সৃষ্টি, তা জড়পদার্থই, কিন্তু তা ব্যক্ত নয়। সাংখ্যের এই পরিচয় বস্তুবাদেরই পরিচয়।

কিন্তু সাংখ্য মতের যে পরিচয় আজ ব্যাপক তাতে অচেতন প্রকৃতি ছাড়াও পুরুষের কথা আছে। যদিও এই পুরুষ উদাসীন, অপ্রধান ও বহু। অর্থাৎ এই পুরুষ নিষ্ক্রিয় এবং বাস্তবে তার কোনও ভূমিকা নেই। ভাববাদীরা পরম ব্রহ্মের ধারণার সমতুল্য হিসাবে এই পুরুষের ধারণা নিয়ে এলেও বাস্তবে এই পুরুষ একক নয়, বহু। সাংখ্যের প্রচলিত ব্যাখ্যা অনুযায়ী পুরুষ বলতে চেতন আত্মা বোঝায়। সাংখ্যের এই পরিচয়ে নিখাদ বস্তুবাদের পরিচয় পাওয়া যায় না। অনেকে মনে করেন, সাংখ্যের যে আদিরূপ তাতে পুরুষ তত্ত্বের এই সংস্করণ ছিল না। যেমন, সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ও সুখলালজী সাংভির মতো সুপ্রসিদ্ধ পণ্ডিতরা দাবি করেছেন, বিশেষত চরক সংহিতায় সাংখ্য দর্শনের প্রাচীনতর কোনও সংস্করণ রয়েছে এবং সেই সংস্করণে প্রকৃতি থেকেই পুরুষের উৎপত্তি, অতএব অচেতন পদার্থ থেকেই চেতন পদার্থের উৎপত্তি—এই মতটিই রয়েছে। সেক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, দর্শনটির আদিরূপ ছিল বস্তুবাদ গোত্রীয়।

সাংখ্য দর্শনে স্বভাব স্বীকৃত। স্বভাব বলতে স্বভাববাদ। লোকায়ত আলোচনায় স্বভাববাদ কী - সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সাংখ্য দর্শন সম্পর্কে সাংখ্যকারিকার ভাষ্যে গৌড়পাদ মন্তব্য করেছেন, সাংখ্য দর্শনের অনুগামীদের মতে স্বভাব নামের একরকম কারণ আছে। শঙ্করাচার্যও সাংখ্য মত খণ্ডন করতে গিয়ে বার বার মতটিকে স্বভাববাদের উপর নির্ভরতার কথা উল্লেখ করেছেন।

এই নজিরগুলির ভিত্তিতে বলা যায়, পরবর্তীকালে সাংখ্য দর্শনে 'প্রকৃতি' বা 'প্রধান' হিসাবে উল্লিখিত আদিম অচেতন কারণটির সঙ্গে 'পুরুষ' নামের এক চেতনতত্ত্ব সংযোজিত হলেও দর্শনটির আদি রূপে হয়তো তা ছিল না; অচেতন প্রধান থেকে স্বভাবের নিয়ম (অর্থাৎ প্রাকৃতিক নিয়ম) অনুসারেই জগতের উৎপত্তি। হয়তো এই কারণেই পরবর্তীকালে সাংখ্যে পুরুষ সংযোজিত হলেও তা উদাসীন বা অপ্রধানের চেয়ে বেশি মর্যাদা পায়নি। এই প্রেক্ষাপটে বিচার করলে অধ্যাপক দাশগুপ্ত ও সুখলালজী সাংভির সাংখ্যকে বস্তুবাদ গোত্রীয় দর্শন হিসাবে ব্যাখ্যা করবার প্রয়াস যুক্তিযুক্ত মনে হয়। জৈন দার্শনিক শীলাঙ্ক তো সরাসরি একথাই বলেছেন।

তান্ত্রিক ধ্যান-ধারণায় সাংখ্য

আমাদের দেশের সমাজ বিকাশের ইতিহাসে পাশাপাশি দুটি ঐতিহ্য দীর্ঘদিন সমান্তরালভাবে চলে এসেছে। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় দুটি ঐতিহ্যের মধ্যে আদান-প্রদান হয়েছে, তেমনি স্বতন্ত্রতা বজায় থেকেছে ,এই দুটি ধারার একটি হল বৈদিক ঐতিহ্য এবং আর একটি হল এদেশের আদি সমাজ অর্থাৎ অনার্য সমাজ থেকে উদ্ভূত প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারা। এই ধারাটি থেকেই এসেছে তান্ত্রিক সাধনা।

সাংখ্যের মতোই পুরুষ ও প্রকৃতি নিয়েই তন্ত্র এবং তন্ত্রেও প্রকৃতির ভূমিকা এত বেশি এবং তার পাশে পুরুষের ভূমিকা এতই নগণ্য যে ,আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, নেহাতই কৃত্রিম ও অসংলগ্নভাবেই তন্ত্রে পুরুষের কথা প্রবেশ করেছে। মূল তত্ত্বের দিক থেকে সাংখ্যের সঙ্গে তন্ত্রের সাদৃশ্য বিস্ময়কর।

তন্ত্রের সঙ্গে তত্ত্বগতভাবে সাংখ্যের সাদৃশ্য এবং প্রাচীন পুঁথিপত্রে সাংখ্যকে তন্ত্র বলে উল্লেখ করার নজির থেকে বলা যায়, সাংখ্য হল আদিম তন্ত্রের দার্শনিক সংস্করণ। বেদান্ত যেখানে বৈদিক ঐতিহ্যবাহী, আদি ও অকৃত্রিম সাংখ্য সেখানে অবৈদিক তথা তান্ত্রিক ঐতিহ্যবাহী।

শুধু তাই নয় ,উৎপাদন পদ্ধতিতেও বৈদিক সংস্কৃতি ও তান্ত্রিক সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। পশুপালন নির্ভর অর্থনীতির জন্য বৈদিক সমাজ পুরুষপ্রধান এবং তার প্রতিফলন হিসাবে বৈদিক চিন্তাধারাও পুরুষপ্রধান। অন্যদিকে কৃষিনির্ভর মাতৃপ্রধান সমাজের প্রতিফলন হিসেবে তান্ত্রিক চিন্তাধারা শক্তিপ্রধান বা মাতৃপ্রধান। তন্ত্রের সঙ্গে সাংখ্যের সাদৃশ্য মৌলিক বলে বৈদান্তিক চিন্তাধারার সঙ্গে সাংখ্যের বিরোধটিও মৌলিক। তাই কোনও কোনও সাংখ্য ব্যাখ্যাকার সাংখ্যকে বৈদান্তিক চিন্তাধারার অনুসারী করার যে চেষ্টা করেছেন, তার সাথে আদি সাংখ্যের কোনও সম্পর্ক নেই। বৈদান্তিক চিন্তাধারার প্রবল জোয়ারের সময় বা তার পরবর্তীকালে বৈদান্তিকরা এই চেষ্টা করেছেন।

প্রসঙ্গক্রমে আর একটা কথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন। সাংখ্যের মতো লোকায়ত দর্শনের মূলও তান্ত্রিক ঐতিহ্যে প্রোথিত। সাংখ্য আদিতন্ত্রের আচারমূলক দিকগুলির তাত্ত্বিক ভিত্তি এবং লোকায়তিক বিশ্বাস সমূহের সাথে তন্ত্রের সুগভীর সম্পর্ক রয়েছে। তাই মনে করা হয় আদি সাংখ্য লোকায়ত ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে। হয়তো এই কারণেই জৈন টীকাকার শীলাঙ্ক সাংখ্যের সঙ্গে লোকায়তের কোনও মৌলিক পার্থক্য করতে রাজি হননি।

আমরা দেখেছি, লোকায়তের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ইহলোকবাদ, দেহবাদ বা বস্তুবাদ। তন্ত্রের দেহতত্ত্ব এবং সাংখ্যের অচেতনকারণবাদ) অর্থাৎ অচেতন বা জড় বস্তু থেকেই জগতের উৎপত্তি) চিন্তাগত ক্ষেত্রে এই কথাটি প্রতিফলিত করে। একথা সত্যি যে ,পরবর্তীকালে তন্ত্রের উপর অধ্যাত্মবাদ বা ভাববাদের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তার আদিরূপটি যে দেহবাদ বা বস্তুবাদই, তা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। অবশ্যই সেই বস্তুবাদ ছিল মূক ও অব্যক্ত, ছিল তার জ্ঞানের দৈন্য। আদি সাংখ্যের প্রধান কারণবাদ বা অচেতন কারণবাদ এই অস্ফুট বস্তুবাদেরই পরিচ্ছন্ন দার্শনিক সংস্করণ। তাই বৈদান্তিকরা বা চেতনকারণবাদীরা (অর্থাৎ যারা মনে করেন যে, চেতনা থেকেই জগতের উৎপত্তি) তার বিরুদ্ধে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে লড়াই করেছেন।

ন্যায়-বৈশেষিক দর্শন

বৈশেষিক ও ন্যায় সম্প্রদায়ের দার্শনিকদের মতাদর্শের মধ্যে সাদৃশ্য এতটাই যে, নৈয়ায়িক ও বৈশেষিক আচার্যরা ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনকে সমানতন্ত্র হিসাবে স্বীকার করেছেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকলেও ন্যায় দর্শনের পদার্থসকল বৈশেষিকদের এবং বৈশেষিক দর্শনের পদার্থসকল নৈয়ায়িকদের অনুমিত ও অঙ্গীভূত। ন্যায় ও বৈশেষিকদের যেটুকু পার্থক্য দেখা যায় তাও গুরুত্বে গৌণ - সূত্রগুলির মধ্যে পার্থক্য এইটুকুই যে ন্যায়সূত্রে তর্কবিদ্যার উপরই গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, বৈশেষিক সূত্রে অধিবিদ্যা (Metaphysics) ও পদার্থবিদ্যার উপর। তাই আজকাল সাধারণতঃ উভয়ের কথা একসঙ্গে করে ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায় বলেই উল্লেখ করা হয়।

বৈশেষিক দর্শন - প্রবক্তা ও তাঁর দর্শন চিন্তার মূল বৈশিষ্ট্য

বৈশেষিক দর্শনের প্রবর্তক বা সূত্রকার কণাদ। তিনি উলুক নামেও বিখ্যাত ছিলেন। এই কারণে বৈশেষিক দর্শনকে ঐলুক্য দর্শন নামেও অভিহিত করা হয়েছে। উলুক মানে পেঁচা। পেঁচা থেকে দার্শনিক সম্প্রদায়টির নামকরণ প্রসঙ্গে অনেকে মনে করেন, উলুক নামটি কোনও প্রাচীন গোত্রনামের পরিচায়ক হতে পারে। কারণ প্রাচীন ভারতে পশুপাখির নাম থেকে গোত্রনামের উদ্ভব হতে দেখা যায়।

বৈশেষিক সূত্রের সময়কাল নিয়ে মতভেদ আছে। গার্বে অনুমান করেছেন ,খ্রিষ্টীয় 200 থেকে 400 সালের মধ্যে বৈশেষিক সূত্র রচিত হয়েছিল। তবে দাশগুপ্তের মতে বৈশেষিক সূত্র আরও অনেক প্রাচীন। তাঁর মতে এই সূত্রগুলি বুদ্ধ-পূর্ব এবং সম্ভবত ভারতের দার্শনিক সাহিত্যের ইতিহাসে প্রাচীনতম সূত্রের নিদর্শন। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে পদার্থের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা বৈশেষিক দর্শনের পদার্থসমূহের অনুরূপ। তাই দাশগুপ্ত'র মতটিকেই গ্রহণযোগ্য মনে হয়।

বৈশেষিক দর্শনের মূল বিষয় বলতে সাত রকম পদার্থ। বিশ্ব সংসারের সমস্ত কিছুকে এই সাতটি শ্রেণীতে বিভক্ত করতে হবে। পদার্থগুলির নাম হল - দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায় এবং অভাব। অবশ্য এই অভাব পদার্থটি বৈশেষিক সম্প্রদায়ের প্রাচীন পর্যায়ে স্বতন্ত্র পদার্থ হিসেবে স্বীকৃত হয়নি। এটি পরবর্তীকালের সংযোজন। তার আগে পর্যন্ত বৈশেষিক দর্শনে শুধু প্রথম ছয়টি পদার্থ স্বীকৃত হয়েছিল। তাই অনেক সময় বৈশেষিক দর্শনকে ষট-পদার্থ বর্ণন বলা হয়ে থাকে। দ্রব্য নামের পদার্থ আবার নয় রকম - পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ, কাল, দিক, আত্মা ও মন। এর মধ্যে প্রথম পাঁচটি দ্রব্য অর্থাৎ পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু ও আকাশকে পঞ্চভূত বলে। অর্থাৎ এই পাঁচটি দ্রব্যের সাধারণ সংজ্ঞা হল ভূত বা matter। পঞ্চভূতের মধ্যে আকাশ ছাড়া প্রথম চারটির মূলে চার রকম পরমাণু। পৃথিবী হল, আসলে পরমাণুপুঞ্জই। পরমাণু নিত্য - তার উৎপত্তি নেই, বিনাশ নেই। তাই বৈশেষিক দর্শনকে পরমাণুবাদ আখ্যা দেওয়া হয়, যার মূল কথা হল - অচেতন ও নিত্য পরমাণুপুঞ্জই সমস্ত দ্রব্যের মূল উপাদান।

তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ,বৈশেষিক দর্শনে বস্তুবাদেরই পরিচয় পাওয়া যায়। তাই অদ্বৈত বেদান্তবাদী শংকরাচার্য এই দর্শন সম্পর্কে বলেছেন, “মন্বাদি ঋষিগণ প্রধান কারণবাদের (সাংখ্যের) কোনও অংশ বৈদিক সৎকার্যবাদী অংশের উপজীবনার্থ গ্রহণও করেছেন ;কিন্তু পরমাণু কারণবাদের কোনও অংশই কোনও ঋষি কর্তৃক গৃহীত হয়নি। এ নিমিত্ত বেদবাদীর নিকট পরমাণুবাদ অত্যন্ত অনাদরণীয়“। শংকরের উত্তরসূরী রামানুজের বক্তব্যও মোটামুটি একই রকম। তিনি বলেছেন, “শ্রুতি ও যুক্তি বিরুদ্ধ বলে কপিলের পক্ষ পরিতক্ত হলেও তার সৎকার্যবাদ প্রভৃতি কোনও কোনও অংশে বেদানুযায়ী পণ্ডিতগণের সম্মতি আছে; কিন্তু এই কণাদপক্ষটি কোনও অংশে শিষ্ট পরিগৃহীত না হওয়ায় এবং যুক্তির বিরুদ্ধে হওয়ায় এতে মোক্ষার্থীদের অত্যন্ত অনপেক্ষ বা উপেক্ষা করা আবশ্যক"।

কিন্তু তা সত্ত্বেও অন্যান্য বস্তুবাদী দর্শনের ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে ,বৈশেষিক দর্শনকেও শ্রুতিসম্মত বা শ্রুতিমূলক সাজাবার প্রচেষ্টা হয়েছে। এমনকী পরমাণুবাদের পক্ষেও শ্রুতির নজির দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু শংকর প্রভৃতি সমস্ত বেদান্তবাদীরাই যেভাবে বৈশেষিক মত খন্ডন করেছেন তা থেকে এটা স্পষ্ট যে, এই দর্শন বলতে তারা পদার্থ বর্ণনা বুঝতেন। তাই আধুনিক বিশেষজ্ঞ হিরিয়ান্না বলেছেন, "বৈশেষিক দর্শন আদিতে নাস্তিক ছিল। পরবর্তীকালে তাকে বেদপন্থী করা হয়েছে। তবে একথা মনে রাখা দরকার যে, বৈশেষিককে মোক্ষপন্থী করার এই প্রচেষ্টা বরাবরই কৃত্রিমতার পরিচায়ক থেকেছে। কারণ ধর্মের সাথে পদার্থ বর্ণনের প্রকৃত সমন্বয় সম্ভবই নয়" ।

ন্যায় দর্শন - প্রবক্তা ও তাঁর দর্শন চিন্তার মূল বৈশিষ্ট্য

ন্যায় দর্শনের প্রবর্তকের নাম গোতম। অনেকে তাঁকে গৌতম বলেছেন। আবার তিনি অক্ষপাদ বলেও পরিচিত। অক্ষপাদ শব্দের অর্থ পায়ের চোখ। তাই তিনি চরণাক্ষ বা পদাক্ষক নামেও উল্লিখিত হয়েছেন। কোনও কোনও বিদ্বজ্জন মনে করেছেন, ন্যায়সূত্র ও বৈশেষিক সূত্র উভয়েরই রচনাকাল সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে। অন্যেরা ন্যায়সূত্রের তুলনায় বৈশেষিক সূত্রকে অনেক বেশি প্রাচীন মনে করেছেন।

ন্যায় সম্প্রদায়ের সাহিত্য সুবিশাল। ন্যায়ের ইতিহাসকে আবার দু'ভাগে ভাগ করা হয় - প্রাচীন ন্যায় ও নব্য ন্যায়। ন্যায়সূত্র ছাড়া প্রাচীন ন্যায়ের অন্যান্য প্রামাণিক গ্রন্থগুলি হ’ল বাৎসায়নের ন্যায়ভাষ্য (আনুমানিক 400 খ্রিস্টাব্দ), উদ্যোত-করের ন্যায়বার্তিক (আনুমানিক খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী), বাচস্পতি মিশ্রের ন্যায়বার্তিক তাৎপর্যটীকা (খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী), জয়ন্ত ভট্টের ন্যায় মঞ্জরী (খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী)। নব্য ন্যায়ের শুরু হয় বাংলাদেশে। গঙ্গেশ রচিত তত্ত্বচিন্তামণি থেকে এর শুরু (খ্রিস্টীয় 1200 সাল)। এটা ঠিক যে, ন্যায় সম্প্রদায়ে তর্কবিদ্যার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু প্রাচীন ন্যায়ে অধিবিদ্যা ও পদার্থবিদ্যা অবশ্যই অবহেলিত হয়নি। বস্তুত এই তর্কবিদ্যা সপ্তপদার্থমূলক নির্দিষ্ট দার্শনিক মত প্রতিপন্ন করবার উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কিত ছিল। কিন্তু নব্য ন্যায়ের ক্ষেত্রে সে উদ্দেশ্য সম্পূর্ণভাবেই বিলুপ্ত হয়েছে। গঙ্গেশের রচনায় ন্যায়ের চূড়ান্ত পরিণতি দেখা যায়। কিন্তু তারপর থেকে সম্প্রদায়টিতে কোনও নির্দিষ্ট দার্শনিক মত চর্চা করবার উৎসাহ প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে।

এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। অন্যান্য বস্তুবাদী দর্শনের মতো ন্যায় দর্শনকেও বেদপন্থী প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে। ন্যায় সম্প্রদায়ের গ্রন্থাবলীতে শ্রুতির প্রতি মৌখিক আনুগত্যের পরিচয় পাওয়া যায়। কোথাও কোথাও শ্রুতি সম্মত পুরুষার্থ প্রভৃতির গৌরব কীর্তিত হয়েছে। বিশেষ করে আধুনিককালের বিদ্বানদের মধ্যে ন্যায় দর্শন শ্রুতিসম্মত প্রমাণ করবার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত দার্শনিক বিচারে একথা বলা যায় না। অর্থশাস্ত্র প্রভৃতি গ্রন্থে কৌটিল্য যে চার রকমের বিদ্যার কথা বলেছেন, তাতে আন্বীক্ষিকী অন্যতম। আন্বীক্ষিকী (অর্থাৎ অনুমানমূলক দর্শন) বলতে শুধুমাত্র তিনটি দর্শনের কথাই বলা হয়েছে - সাংখ্য, যোগ এবং লোকায়ত। যোগ বলতে কৌটিল্য ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন সে বিষয়ে কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলেও এখন আমরা জানি, পরবর্তীকালে যে দার্শনিক মতকে আমরা ন্যায় বৈশেষিক নামে শনাক্ত করতে অভ্যস্ত প্রাচীনকালে তাকেই যোগ নামে অভিহিত করা হত। দ্বিতীয়ত ,আন্বীক্ষিকী বলতে যে তর্কবিদ্যা বোঝাত, বেদান্তবাদী ব্রহ্মসূত্রে সেই তর্কবিদ্যাকে শ্রুতিবিরুদ্ধ বলেই প্রত্যাখ্যান করার নির্দেশ আছে। তৃতীয়ত ,মনে রাখা দরকার যে, অত্যন্ত প্রাচীনকাল থেকেই প্রকৃত বৈদিক ঐতিহ্যে তর্কবিদ্যা নিন্দিত ও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। মনু হেতুশাস্ত্র বা তর্কবিদ্যার কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং তর্কাবলম্বীদের বৈদিক দল থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছেন। উপনিষদেও তর্কের নিন্দা দেখা যায় - "নৈষাতর্কের মতির পালেয়া।" চতুর্থত, শংকর তর্কপরায়ণদের সমালোচনা প্রসঙ্গে কপিল, কণাদ প্রভৃতির নাম উল্লেখ করেছেন। রামানুজ এই তালিকা দীর্ঘতর করেছেন। সেই তালিকা থেকেও কণাদ ও গোতমের নাম বাদ পড়েনি।

তাই একথা অনুমান করাই যুক্তিসঙ্গত যে, এই সম্প্রদায়ের আদি দার্শনিকেরা শ্রুতি বা বেদ নিরপেক্ষভাবেই বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত্বে উপনীত হয়েছিলেন। যদিও পরবর্তীকালে শ্রুতির প্রতি মৌখিক নিষ্ঠা অঙ্গীকার করে বা অত্যন্ত কৃত্রিমভাবে কষ্টকল্পিত শ্রুতি ব্যাখ্যার সাহায্যে সম্প্রদায়গুলিকে বেদপন্থী সাজাবার চেষ্টা হয়েছিল।

ন্যায়-বৈশেষিকদের ভাববাদ খন্ডন

আমাদের দেশে ভাববাদী দর্শন বলতে বৌদ্ধ মাধ্যমিক, বৌদ্ধ যোগাচার এবং অদ্বৈত বেদান্ত। এদের পরস্পরের মতপার্থক্য যাই থাকুক না কেন, মূল দার্শনিক বিচারে প্রতিটি দর্শন চিন্তাই এক জায়গায় একমত। বৌদ্ধ ভাববাদ এবং বৈদিক ভাববাদ - উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই বহির্জগৎ মিথ্যা, লোকব্যবহারমূলক সমস্ত জ্ঞানই ভ্রম, প্রমাণ প্রমেয় ব্যবহার অজ্ঞান বা অবিদ্যামিশ্রিত। ভাববাদ খন্ডন বলতে এই মূল দাবিগুলিরই খণ্ডন বোঝায়। যেমন অদ্বৈত বেদান্তবাদী শঙ্করাচার্যের মতে, আত্মন বা ব্রহ্মণই একমাত্র সত্য। বস্তু হিসাবে যার আপাত প্রতীতি ঘটে অর্থাৎ আপাত দৃষ্টিতে যাকে বস্তু বলে মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে তার কোনও স্বাধীন সত্তা থাকতে পারে না।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে ভাববাদীরা বহির্জগৎ সম্পর্কে বলেন যে, তা ’স্বপ্নাদিবৎ মিথ্যা’, অর্থাৎ স্বপ্নের মতোই মিথ্যা। ন্যায়-বৈশেষিকেরা এর বিরুদ্ধে যুক্তি করেছেন - "স্বপ্নাবস্থার সমস্ত জ্ঞান যে ভ্ৰমজ্ঞান তা পরে তার বাধক কোনও জ্ঞান ব্যতীত প্রতিপন্ন হয় না। সুতরাং জাগ্রত অবস্থার জ্ঞানকেই তার বাধক বলতে হবে। তাহলে সেই জ্ঞানকেও যথার্থ বলে স্বীকার করতে হবে। কারণ যথার্থ জ্ঞান ব্যতীত ভ্রম জ্ঞানের বাধক হতে পারে না। তাহলে জাগ্রত অবস্থার সেই যথার্থ জ্ঞানকে দৃষ্টান্ত করে প্রমাণ ও প্রমেয় বিষয়ক জ্ঞান যথার্থ, এটাও তো বলতে পারি।"

আবার 'স্বপ্ন' সম্পর্কে ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়ের মত হচ্ছে যে, তা নিরালম্বন (অর্থাৎ অবলম্বনহীন) বা মিথ্যা নয়, তার বিষয় হল, দেশান্তর-কালান্তরে অবস্থিত পূর্বানুভূত বাহ্য বস্তুই। নৈয়ায়িক ও বৈশেষিক সম্প্রদায়ের কথা এই যে, স্বপ্নের পরে জাগরিত হলে 'আমি হাতি দেখেছিলাম', 'আমি পাহাড় দেখেছিলাম', ইত্যাদি রূপেই ওই স্বপ্নদর্শনের মানসজ্ঞান জন্মে অর্থাৎ পূর্বের কোনও বাস্তব অভিজ্ঞতাই স্বপ্নে দৃষ্ট হয়; তার দ্বারা বোঝা যায় যে ঐ স্বপ্নজ্ঞান প্রত্যক্ষ বিশেষ।

উপরের আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে, ন্যায়- বৈশেষিকেরাও স্বপ্নের বিষয়কে বাহ্যবস্তু বলেই প্রমাণ করতে চেয়েছেন এবং এইভাবে ভারতীয় দর্শনে ভাববাদের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নজিরটি খন্ডন করেছেন।

ন্যায়-বৈশেষিকদের ঈশ্বর বিশ্বাস

ভাববাদ বিরোধিতায় অনেক বলিষ্ঠ মতবাদ রাখলেও আশ্চর্যের বিষয় ন্যায় -বৈশেষিকেরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে মত দিয়েছেন, বিশেষ করে মধ্যযুগের নৈয়ায়িক ও বৈশেষিকেরা। তবে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, 'বৈশেষিক সূত্রে' ঈশ্বরের কোনও উল্লেখ নেই এবং কণাদ দর্শনের আদিরূপ খুব সম্ভব নিরীশ্বরবাদী ছিল। পরবর্তীকালের ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা শুধু যে সৃষ্টি প্রলয়ের কারণ হিসাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন তাই নয়, এমনকী দীর্ঘ বিস্তৃত যুক্তি বিন্যাসের সাহায্যে এই ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতেও প্রয়াসী হয়েছেন।

তাছাড়া গৌতমের ন্যায়সূত্র ও বাৎসায়ন ভাষ্য থেকে শুরু করে উদয়নের ‘আত্মতত্ত্ববিবেক’ পর্যন্ত করে র্যন্ত ন্যায় দর্শনের প্রায় সমস্ত গ্রন্থে আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণের পরম উৎসাহ চোখে পড়ে। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের সামাজিক পরিবেশ বিচার করলে আমরা দেখতে পাব ,এই সময় স্মৃতি ও শ্রুতির প্রবল দাপটের সময়। চরম বস্তুবাদী চার্বাকদের বিরুদ্ধে তাদের বিষোদগার কারোর অবিদিত ছিল না। তাই একথা ভেবে নেওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে, তাঁদের দর্শনের বস্তুবাদী তত্ত্বকে ভাববাদীদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য গৌতম তাঁর ন্যায় সূত্রে আত্মার কথা উল্লেখ করেছিলেন তাদের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য। তাই আত্মা সম্পর্কে তাঁদের আলোচনা থেকেও এটা বোঝা যায় যে, তারা বিষয়টা নিয়ে সিরিয়াস ছিলেন না। তাই দেখা যায়, ন্যায় মতে আত্মা বলতে ঠিক কী বোঝানো হয়েছে? আত্মা কি সত্যিই চেতন পদার্থ? আত্মা কি স্বয়ং চেতন, যা ভাববাদীরা বিশ্বাস করেন? নাকি কোনওরকম বিশিষ্ট পরিবেশে আত্মার মধ্যে চৈতন্য বলে গুণের জন্ম বা উদ্ভব বা আবির্ভাব হয়? উত্তরে নৈয়ায়িকেরা বলেন ,আত্মার স্বরূপ বলতে জড়বস্তুই। তার মধ্যে চৈতন্যের পরিচয় নেই। শুধুমাত্র একরকম বিশেষ অবস্থায় আত্মার মধ্যে চৈতন্য বলে গুণটি ফুটে ওঠে। কি রকম অবস্থা? প্রথমত ,আত্মার সাথে দেহের সংযোগ। দ্বিতীয়ত, দেহের মাধ্যমে অন্তঃইন্দ্রিয়ের সংযোগ, তৃতীয়ত অন্তঃইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বহিঃইন্দ্রিয়ের (অর্থাৎ দর্শন, ইন্দ্রিয়, ষ্রবণ ইন্দ্রিয়, ঘ্রাণ ইন্দ্রিয় প্রভৃতির) সংযোগ। চতুর্থত, বহিঃইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বিষয় বা বাহ্যবস্তুর সংযোগ। এই সংযোগ পরম্পরার অভাবে আত্মা তার স্বীয় স্বভাব অনুসারে যে জড়বস্তু সেই জড়বস্তুই থেকে যায় - মাটির ঢেলা বা কাঠের টুকরোর মতোই। তাহলে এখান থেকে আমরা কী পেলাম? ন্যায় মতে বহিঃইন্দ্রিয় এবং বিষয় বা বাহ্যবস্তুর উপাদান বলতে পঞ্চভূতই। বহিঃইন্দ্রিয় এবং বাহ্য বস্তুর সংযোগ ছাড়া চেতনার উদ্ভব সম্ভব নয়। তাহলে পঞ্চভূত ছাড়া ন্যায় মতে চৈতন্যই সম্ভব নয়।

সমস্ত দিক থেকে বিচার করে আমরা একথা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, ন্যায় -বৈশেষিক সম্প্রদায়ের মতটি বলিষ্ঠভাবে বাহ্য-বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে। বৈশেষিক সম্প্রদায়ের মূল মতটি পরমাণুতত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। নৈয়ায়িকরাও তা গ্রহণ করেছেন। এই মত অনুসারে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বস্তুপুঞ্জ দ্বারাই গঠিত। বেদান্তবাদীদের মায়াবাদের বিপরীতে বস্তুর অস্তিত্বের পক্ষে তাঁরা যুক্তি করেছেন। তাই এই তত্ত্ব ঈশ্বরতত্ত্বের সাথে ঠিক খাপ খায় না। কারণ ঈশ্বরতত্ত্বের সাথে বস্তুজগতকে বস্তু বহির্ভূত কোনও শক্তি পরিচালনা করছে - এই ধারনাটি যুক্ত। সম্ভবত এই কারণেই বৈশেষিক সূত্রে ঈশ্বরের কোনও কথা নেই এবং কণাদের দার্শনিক তত্ত্বের আদিরূপ নিরীশ্বরবাদী ছিল। পরবর্তীকালে ঈশ্বরবাদী দর্শনের প্রবল জোয়ারের সময় তারই প্রভাবে এই দর্শনের সাথে ঈশ্বরতত্ত্বের কথা যুক্ত হয়েছে।

আরও কয়েকটি দর্শন, যাদের মধ্যে বস্তুবাদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় –

বৌদ্ধ দর্শন

গৌতম বুদ্ধ নিজে কোনও দার্শনিক মত প্রচার করেন নি। কিন্তু তাঁর চিন্তাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ভাববাদী দর্শনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে যে দুটি ভাবনা - ঈশ্বরে বিশ্বাস ও বস্তুবহির্ভূত আত্মার স্বীকৃতি, বুদ্ধ এর বিরোধিতা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ভাববাদের আর একটি ভাবনা - নিত্যতা বা শাশ্বত চিন্তার বিরোধী ভাবনা পাওয়া যায় বুদ্ধের অনিত্যতার ভাবনার মধ্যে।

বুদ্ধের নিজের কথায়, "এ এক অটল নিয়ম.... রূপ (চতুৰ্ভূত), বেদনা (সুখ দুঃখের অভাব), সংজ্ঞা (মনের মধ্যে থেকে যাওয়া ছাপ), বিজ্ঞানের (চেতনা ও মন) সমস্ত সংস্কার (কৃত বস্তু রাশি) অনিত্য।"

বুদ্ধের চিন্তার সবচেয়ে যুগান্তকারী ভাবনা হল, প্রতীত্য সমুৎপাদ, যার অর্থ সমস্তকিছুই পরিবর্তনশীল এবং এই পরিবর্তন কার্য-কারণ নিয়মের বিচ্ছিন্ন প্রবাহ। একের বিনাশের পর অন্যের উৎপত্তি - বুদ্ধ এই নিয়মের নাম দিয়েছিলেন 'প্রতীত্য-সমুৎপাদ'।

বুদ্ধের চিন্তার রক্ষনশীলতার দিক হল, পুনর্জন্মের ধারণা। এর মধ্যেই রয়েছে ভাববাদ অনুপ্রবেশের পথ। তাই বুদ্ধের মৃত্যুর পর বৌদ্ধ ধর্ম দুটি পৃথক সম্প্রদায়ে ভাগ হয়ে যায় - হীনযান এবং মহাযান। প্রথম সম্প্রদায় থেকে দুটি দার্শনিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল - সৌত্রান্ত্রিক ও বৈভাসিক। এদের চিন্তায় বস্তুবাদী ভাবনা প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। মহাযান সম্প্রদায় থেকে উদ্ভব হয় দুটি ভাববাদী ধারা - শূণ্যবাদ ও বিজ্ঞানবাদ।

জৈন দর্শন

মহাবীর জৈনের চিন্তায় নিরীশ্বরবাদী চিন্তা প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। জৈন দর্শনের মূল কথা হল, সাধারণ অভিজ্ঞতায় আমরা জগতকে যেভাবে জানি, তাই সত্য বা যথার্থ। এই জগতে বস্তুর অস্তিত্ব আছে। তাই কোনও এক বা অদ্বিতীয় পরমসত্তার কথা কল্পনা করা নিরর্থক। এই বস্তু সমূহ দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত - জীব এবং অজীব। জীবন্ত প্রত্যেক বস্তুর মধ্যেই জীব বা আত্মা আছে - তার দেহ যেমনই হোক না কেন। সমস্ত জীবের প্রতি অহিংসাই জৈন ধর্মের মূল উপদেশ।

তাঁদের দর্শনের একটা মূলকথা হল স্যাৎবাদ। সত্তার বহুমুখী দিক সম্বন্ধে সামগ্রিক উক্তি একমাত্র পূর্ণজ্ঞানীর পক্ষেই সম্ভব। আমরা পূর্ণ জ্ঞানী নই। সেজন্যই প্রত্যেক বিষয়ে আমাদের প্রতিটি উক্তিই সম্ভাবনামূলক। এই সম্ভাবনার নির্দেশক শব্দ হল স্যাৎ। তাই আমাদের প্রতিটি উক্তির সাথে স্যাৎ শব্দ ব্যবহার করা প্রয়োজন। তাছাড়া সমস্ত রকম বিকল্প সম্ভাবনার কথা মনে রাখা প্রয়োজন। অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহালনবীশ বলেছেন, এই স্যাৎবাদের মধ্যেই আধুনিক স্ট্যাটিসটিকস বিজ্ঞানের মূল সূত্রের আভাস পাওয়া যায়।

খ্রিস্টিয় প্রথম শতাব্দীতে উমস্বতী জৈন ধর্মের দার্শনিক বিচারকে প্রথম সুসংবদ্ধভাবে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। দার্শনিক অকলাংক অষ্টম শতাব্দীতে লজিকের ব্যাপক চর্চা করেছেন।

ফলে বোঝা যায়, যুক্তিবাদ চর্চার ক্ষেত্রে বা বস্তুজগতকে বস্তুনিষ্ঠভাবে বিচার করার ক্ষেত্রে জৈন দর্শনের মধ্যে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। আবার একইসাথে আত্মার ধারণার মধ্যে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

পূর্বমীমাংসা

আরেকটি দার্শনিক সম্প্রদায় ভাববাদী চিন্তার বিরোধিতা করেছে। সেটি হল পূর্বমীমাংসা। মীমাংসা দর্শনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়নি। মীমাংসা দর্শনের প্রবক্তা হিসাবে জৈমিনির নাম পাওয়া যায়। জৈমিনি ঈশ্বরের উল্লেখ করেন নি। স্বর্গকে মীমাংসকেরা যজ্ঞফল বলে স্বীকার করেছেন। এর মধ্যে লোকোত্তরের ধারণা আরোপ করার চেষ্টা করেন নি। মীমাংসা মতে সুখলাভই মানুষের চরম উদ্দেশ্য। যজ্ঞ এই সুখলাভের উপায় মাত্র। এই সুখ বলতে ইহলৌকিক সুখকেই বোঝানো হয়েছে। পূর্ব মীমাংসার নামান্তর কর্ম মীমাংসা। বেদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে এই দর্শনের মূল প্রোথিত। যজ্ঞের ধারণার মধ্যে প্রাচীন যাদুবিশ্বাসের প্রভাব পাওয়া যায়। তাই বেদান্তের মোক্ষর ধারণা মীমাংসা-দর্শন পাওয়া যায় না।

মীমাংসকদের পক্ষে ভাববাদ খন্ডন অপরিহার্য। কারণ প্রত্যক্ষসিদ্ধ বহির্জগৎ বাস্তব বা যথার্থ না হলে যজ্ঞকর্ম, যজ্ঞফল প্রভৃতি সবই অর্থহীন হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। মীমাংসা দার্শনিকদের মধ্যে কুমারিল সবচেয়ে বলিষ্ঠভাবে ভাববাদ খন্ডন করেছেন।

কিন্তু মীমাংসা দর্শনের রক্ষণশীলতার দিকও রয়েছে। অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে ভাববাদ খন্ডন করলেও মীমাংসা-দর্শন দাঁড়িয়ে আছে বেদের অভ্রান্ততার উপর। অর্থাৎ বেদকে তাঁরা সনাতন ও শাশ্বত হিসাবে গ্রহণ করেছে। এর উদ্ভবই হয়েছে বৈদিক যাগযজ্ঞের বৈধতা প্রমাণের উদ্দেশ্যে। তাই বেদের বৈধতা প্রমাণ তাদের দর্শনচর্চার অন্যতম উদ্দেশ্য হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে।

প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞানচর্চা ও বস্তুবাদী দর্শন

বিজ্ঞান বলতে আমরা কী বুঝি? যুগ যুগ ধরে মানুষ তার চারপাশের পরিবেশকে, বিশ্বপ্রকৃতিকে, সমাজকে এবং সর্বোপরি নিজেকে জানবার ,বুঝবার চেষ্টা করেছে। কী জানবার চেষ্টা করেছে ? এই সমস্ত কিছুর ভিতরে যে বাস্তব নিয়ম বা objective law কাজ করে, তাকে জানার, বোঝার চেষ্টা করেছে এবং জেনে বুঝে তার উপর ক্রিয়া করেছে। এভাবেই সমাজ এগিয়েছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে। তাহলে বিজ্ঞান নির্ভর করেছে objectivity বা বস্তুজগতের বাস্তব অস্তিত্বের উপর। তাই যে সমস্ত দর্শনচিন্তা বস্তুজগতের বাস্তব অস্তিত্বে বিশ্বাস করে, সেই দর্শনগুলো, অর্থাৎ বস্তুবাদী দর্শনগুলো বিজ্ঞানচর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।

এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, আজকের দিনে আধুনিক বিজ্ঞান যে পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে, তা একদিনে আকাশ থেকে পড়েনি। তারও একটা সূচনা আছে, একটা ইতিহাস আছে। প্রাচীন ভারতে বহু পরস্পর বিরোধী চিন্তার মধ্যে কোন সেই চিন্তা, যারই ধারাবাহিকতায় আজকের বিজ্ঞানের অগ্রগতি তা চিহ্নিত করা জরুরী। কারণ এটা ঠিক ঠিক ভাবে নির্ধারণ করতে পারলে ইতিহাসটাও আমরা ঠিক ঠিক ভাবে বুঝতে পারব। সেই দিক থেকে বিচার করলে আমরা দেখতে পাব যে, এদেশে বহু দার্শনিক চিন্তার মধ্যে ধারাবাহিকভাবে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলীর বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে লোকায়ত বা চার্বাক দর্শন। মনে রাখতে হবে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রকৃতি বিজ্ঞানের যতটুকু উন্নতি ঘটেছিল, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার জমি তৈরিতে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন ছিল। বস্তুজগতের বাস্তবতা সম্পর্কে লোকায়ত ছাড়াও সাংখ্য, ন্যায়-বৈশেষিক দর্শন সুনির্দিষ্ট বক্তব্য রেখেছিল। এছাড়াও বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম যে নিরীশ্বরবাদী চিন্তা এনেছিল, সেই চিন্তাও বস্তুজগৎ নিয়ে চর্চার ক্ষেত্রে সদর্থক ভূমিকা নিয়েছিল।

ভারতীয় ঐতিহ্যে প্রকৃতিবিজ্ঞানের দিকে সবচেয়ে অগ্রগামী চেতনার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছিল আয়ুর্বেদ। আয়ুর্বেদের আদিগ্রন্থ হল চরক সংহিতা ও সুশ্রুত সংহিতা। যে অবস্থায় গ্রন্থদুটি পাওয়া গেছে তাতে বোঝা যায় যে, এগুলো কোনও একটা সময়কালে একজন লেখকের লেখা নয়। বিভিন্ন সময়কালে বহু লেখকের অবদানের ভিত্তিতে গ্রন্থদুটির বর্তমান কলেবর তৈরি হয়েছে। তাই বোঝা যায় অনেকভাবে পরিবর্তিত হয়ে শেষ পর্যন্ত তা আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। বাস্তবে আমরা দেখেছি পরবর্তীকালে এমন বহু বিষয় সংযোজিত হয়েছে যার সাথে আয়ুর্বেদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের কোনও সম্পর্ক নেই। বিশেষ করে শঙ্করাচার্যের মায়াবাদের প্রবল জোয়ারের সময় এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। আবার আর একটি বিষয়ও ঘটে থাকতে পারে। আমরা দেখেছি বস্তুবাদী দর্শন চিন্তাকে শাসকশ্রেণি প্রবল বিরোধিতা করেছে এবং লোকায়ত দর্শনের মূল গ্রন্থ নষ্ট করে দিয়েছে। তাই সরাসরি বস্তুবাদের কথা বললে আয়ুর্বেদের গ্রন্থেরও সেই পরিণতি আশঙ্কা করে এই গ্রন্থের লেখকেরা ভাববাদের মোড়কে তাদের বক্তব্য বিষয় উপস্থাপন করে শাসক শ্রেণীর চোখে ধূলো দিতে চেয়েছে, যাতে ভাববাদের আড়ালে আয়ুর্বেদের প্রকৃত বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাটি সুরক্ষিত থাকতে পারে। তাই ‘চরক সংহিতা’ বা সুশ্রুত সংহিতা’ থেকে যেকোনও কথা উদ্ধৃত করে তা আয়ুর্বেদ সম্মত ঘোষণা করা নিরাপদ নয়। বরং কখনও কখনও তা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে।

এখন প্রকৃতিবিজ্ঞানের বিকাশের নিরিখে বস্তুবাদী দর্শনের ভূমিকা আলোচনা করতে গেলে বস্তুবাদী দর্শনের যে বৈশিষ্ট্যগুলি গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার ,সেগুলি হল -

  1. শাস্ত্র শাসনের শৃংখল মুক্তি।

  2. ভূতবাদ বা ভূতচৈতন্যবাদ! অতএব আত্মা প্রসঙ্গে ঔদাসীন্য।

  3. প্রত্যক্ষ প্রাধান্যবাদ।

  4. স্বভাববাদ।

  5. প্রমাণ প্রসঙ্গে প্রবৃত্তি সামর্থ্যবাদ।

আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের প্রেক্ষাপটে বিষয়গুলি বিচার করা যাক। চরক সংহিতায় একাধিকবার একটি বিষয়ে আলোচনা চোখে পড়ে ’দৈব-ব্যপাশ্রয় ভেষজ’ এবং ‘যুক্তি ভেষজ’ - এর মধ্যে পার্থক্য। সোজা কথায় চিকিৎসা ব্যবস্থা দু'রকম। প্রথমটির বৈশিষ্ট্য হল, মন্ত্র, তাগা, তাবিজ, শান্তি স্বস্ত্যয়ন ইত্যাদি। অর্থাৎ অথর্ববেদে যে চিকিৎসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ‘চরক সংহিতায়’ এ ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থার কৌশল ছেড়ে ‘যুক্তি ব্যপাশ্রয় ভেষজে’র দিকে অগ্রসর হওয়ার লক্ষণ চোখে পড়ে। যেমন, ওষুধ বা আহার হিসাবে সেবন রার যে নির্দেশ রয়েছে তার তালিকায় 165 রকমের জীবজন্তুর রক্ত, মাংস, মেদ, অস্থি, মূত্র, দুধ ইত্যাদি ছাড়াও 910 রকমের গাছ গাছড়ার ছাল, মূল, ফল প্রভৃতি রয়েছে। আহার বা ওষুধ হিসাবে সেবনীয় দ্রব্যের এই বিশাল তালিকায় ক্ষয়রোগ প্রভৃতি নিরাময়ের উদ্দেশ্যে গোমাংস জাতীয় শাস্ত্র-নিষিদ্ধ খাদ্যের উপরও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। অর্থাৎ শাস্ত্র শাসনের শৃংখল মুক্তির মধ্যেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির প্রশ্নটি যুক্ত ছিল এবং আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে তার আয়োজনও চোখে পড়ে।

দ্বিতীয়ত ,ভূতবাদ বা চৈতন্যবাদ। এ বিষয়ে চরক সংহিতায় স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে - 'সর্বং দ্রবং পঞ্চভৌতিকম অস্মিন অর্থে ;তৎ চেতনাবৎ, অচেতনং চ‘।(1/26/10)। এর অর্থ হল ,এই শাস্ত্রে অর্থাৎ আয়ুর্বেদে সব দ্রব্যই পঞ্চভূতে গড়া ;তার মধ্যে কোনওটা চেতনাযুক্ত কোনওটা বা অচেতন। কিন্তু চেতনা যুক্ত দ্রব্য বলতে কী বোঝায়? উত্তরে বলা হয়েছে - সেন্দ্রিয়ং চেতন, দ্রব্যম; নিরিন্ত্ৰিম অচেতনম।(1/1/48)। অর্থাৎ, ইন্দ্রিয়যুক্ত দ্রব্যই চেতন; অচেতন বলতে ইন্দ্রিয়হীন। এবার প্রশ্ন আসবে - ইন্দ্রিয়ের উপাদান বলতে আসলে কী? এ বিষয়ে চরক সংহিতায় বিস্তৃত আলোচনা করে প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, ইন্দ্রিয়গুলিও ভূতবস্তু দিয়ে গড়া। অতএব চেতন পদার্থের নজির থেকে বস্তু-বহির্ভূত কিছুর প্রমাণ হয় না। একইভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে কোন মতবাদের উপর নির্ভর করতে হবে - এই প্রশ্নে সুশ্রুত সংহিতাতেও বলা হয়েছে যে ,দার্শনিক বিচারের দৃষ্টিকোণ থেকে যে মতের যাই মূল্য থাক না কেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতাদর্শগত দাবির দিক থেকে বস্তুবাদই অপরিহার্য। তাই সুশ্রুত সংহিতায় বলা হয়েছে - ‘ভূতেভ্যঃ হি পরং যস্মাৎ নাস্তি চিন্তা চিকিৎসিতে’।(3/1/17)। অর্থাৎ যে মতে ভূতবস্তুই পরম সত্য। তাছাড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রয়োজনে আর কোনও চিন্তার অবকাশ নেই।

তৃতীয়ত, প্রত্যক্ষ প্রাধান্যবাদের কথা। আয়ুর্বেদের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যক্ষজ্ঞানের উপর পদে পদেই নির্ভর করতে হয়। রোগীর প্রকৃত রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে কোন দ্রব্য কীভাবে ব্যবহার করলে রোগ নিরাময় সম্ভব তা একমাত্র প্রত্যক্ষজ্ঞানের উপরই নির্ভর করে। চরক সংহিতায় এ বিষয়ে দীর্ঘ মন্তব্য ব্যাখ্যা করে উপসংহারে বলা হয়েছে - সম্যক উপদিশামঃ ‘সম্যক পশ্যম চ ইতি’ আমরা সম্যকভাবে পরিদর্শন করব এবং তারই উপর নির্ভর করে সম্যক উপদেশ দেবো।(3/3/36)। আবার বলা হয়েছে ,অন্নই হচ্ছে প্রাণীদের প্রাণ, ‘প্রাণঃ প্রাণভূতম অন্নম’ এবং এ বিষয়ে চরম প্রমাণ হ’ল ‘প্রত্যক্ষ ফল দর্শনাং’ কেননা এ বিষয়ে প্রত্যক্ষ ফল দেখা যায়।(1/27/3)। আর সুশ্রুত সংহিতায় আছে - হাজার যুক্তিতর্কের বিচার করেও প্রত্যক্ষফল - দৃষ্ট কোনও বিষয় অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। যেমন, অন্বষ্ঠ জাতীয় ফল থেকে চোখে দেখা যায় যে, আমাশয় প্রভৃতি রোগে মল রোধ হয় - কিন্তু সহস্র যুক্তি প্রদর্শন করেও এই ফলকে বিরোচক বলা অসম্ভব।

প্রত্যক্ষ প্রমাণের ক্ষেত্রে সুশ্রুতের নজির দুঃসাহসিকতার পর্যায়ে পড়ে। শরীরের অভ্যন্তরীণ সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কথা অবশ্যই আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বর্ণিত। কিন্তু সুশ্রুতের মতে শুধুমাত্র সেই পুঁথিগত জ্ঞানের ভিত্তিতে শল্যবিদ্যা শেখা সম্ভব নয়। অর্থাৎ শব ব্যবচ্ছেদ করে হাতে কলমে তার পরীক্ষা করা দরকার। এ'কথা বলাটা সেই যুগে সহজ ছিল না। কারণ ধর্মশাস্ত্রের শাসন অনুসারে লাশ ছুঁলেও স্নান করতে হয়।

চতুর্থত, স্বভাববাদ। চরক সংহিতা সুশ্রুত সংহিতার থেকে অনেক উদ্ধৃতিই দেওয়া যায়, যেখানে স্বভাববাদের কথা বলা হয়েছে। যেমন, আয়ুর্বেদ মতে খাদ্য বিশেষে গুরুপাক ও লঘুপাক। কিন্তু কেন? সুশ্রুত সংহিতায় শুধু একটাই জবাব আছে। স্বভাব। ’গুরু—লাঘব—চিন্তা ইয়ং স্বভাবং ন অতিবর্ততে’।(1/46/448)। দেবেন্দ্রনাথ ও উপেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত এর তর্জমা করেছেন এই রকম “গুরুত্ব ও লঘুত্ব স্বভাবকে অতিক্রম করে না। অর্থাৎ যদি জিজ্ঞাসা করা যায় জঙ্ঘাল ও জঙ্গল পশুর মাংস কেন লঘু? - তাহা হইলে অবশ্যই বলিতে হইবে যে, স্বভাব“। চরক সংহিতাতেও লবণ, জল প্রভৃতি বিবিধ দ্রব্যের কারণ হিসাবে স্বভাবের কথাই বলা হয়েছে।(1/27/4)।

পঞ্চমত, প্রমাণ প্রসঙ্গে প্রবৃত্তি সামর্থবাদ। অর্থাৎ বাস্তব কর্মজীবনে একটা কথা খাটে কিনা তা থেকেই প্রমাণ হবে কথাটা সত্যি কিনা। সত্যি - মিথ্যা নির্ণয়ের আসল মাপকাঠি বলতে প্রয়োগ ক্ষেত্রে সাফল্য। চরক সংহিতায় প্রায় আগাগোড়া যে এই কথা স্বীকৃত, তা নিয়ে বিস্তৃত বিচারের দরকার নেই। নমুনা হিসাবে শুধু একটা উদ্ধৃতিই যথেষ্ট হবে। ডাক্তার ভালো কি মন্দ - কিংবা কতটা ভালো তার আলোচনায় বলা হয়েছে –

স চ এব ভিষজং শ্রেষ্ঠঃ রোগেভ্যঃ জঃ প্রমোচয়েঃ।।

সম্যক - প্রয়োগং সর্বেষাং সিদ্ধি অখ্যাতি কর্মনাম।

সিদ্ধি অখ্যাতি সবৈ চ গুনৈ যুক্ত্ ভিষকতমম।।(1/1/134-5)।

এর অর্থ খুবই সহজ। রোগ বাস্তবিকই সারাতে পারলেন কিনা তা থেকেই বোঝা যাবে ডাক্তার এবং তার ডাক্তারি কোন দরের। সোজা কথায়, কর্মজীবনে সাফল্য থেকেই বোঝা যায়, কোন কথার কত দৌড়।

অর্থাৎ এতক্ষণের আলোচনায় দেখা গেল চিকিৎসা বিজ্ঞানচর্চায় সমস্ত দিক থেকে বস্তুবাদী দার্শনিক মতবাদই প্রভূত সাহায্য করেছে। লোকায়ত বা চার্বাক দর্শন তো বটেই, সাংখ্য দর্শনের প্রধান কারণবাদ ও ন্যায় -বৈশেষিক দর্শনের পরমাণুবাদও বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞানচর্চায় সাহায্য করেছিল। ভারতীয় বিজ্ঞানের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাব খ্রিস্টীয় চতুর্থ-সপ্তম শতকে বিজ্ঞানের বিকাশ সর্বোচ্চ স্তর অর্জন করেছিল। কারণ এই সময় বস্তুবাদী দর্শন, বিশেষ করে যে দর্শন ,প্রকৃতির বাস্তব নিয়ম অন্বেষণে সাহায্য করেছিল, সেই ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনের বিকাশ হয়েছে। এই দার্শনিক সম্প্রদায় লজিক ও পরমাণুবাদের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানচর্চার পথ প্রশস্ত করেছিল।

লেখক পরিচিতি: শ্রী গৌড়ী একজন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক এবং ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির সর্ব-ভারতীয় কমিটির সহ সভাপতি।

তথ্যসূত্র:

(1) ভারতীয় দর্শন, প্রথম খন্ড, - দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।

(2) ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে - দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।

(3) প্রাচীন ভারতে চিকিৎসা বিজ্ঞান - দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।

(4) দর্শন-দিগদর্শন - রাহুল সাংকৃত্যায়ন।

(5) What is Living and What is Dead in Indian Philosophy - Debiprasad Chottopadhyay.

(6) A History of Indian Philosophy, 5 Vol - Prof S N Dasgupta.

“প্রাচীন ভারতে দর্শন চর্চা ও বিজ্ঞান চর্চায় তার প্রভাব – প্রথম পর্ব” শীর্ষক এই প্রবন্ধটি ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি অনুমোদিত ‘প্রকৃতি’ পত্রিকার পঞ্চদশ বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, জুলাই 2021 থেকে নেওয়া হয়েছে।