বিভাগগুলি

আয়ুর্বেদশাস্ত্রের দার্শনিক ভিত্তি

Credit: Sebastian Duda / Shutterstock


সুব্রত গৌড়ী

আমাদের দেশের প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্র ‘আয়ুর্বেদ’ নামে পরিচিত। এদেশে একটা ধারণা বহুল প্রচলিত যে, আয়ুর্বেদের চিকিৎসা পদ্ধতি অধ্যাত্মবাদী চিন্তা ভাবনার উপর দাঁড়িয়ে আছে। অনেকে মনে করেন, প্রাচীন ভারতের চিকিৎসাশাস্ত্র আয়ুর্বেদ ভগবানের বরপুত্র মুনি ঋষিরা ঈশ্বরের বাণী হিসাবেই লিপিবদ্ধ করেছেন এবং তা যুগ যুগ ধরে মানুষের জীবনকে রক্ষা করে এসেছে। অধুনা হিন্দুত্ববাদীরা এই চিন্তা ও বিচারধারাটিকেই ব্যাপকভাবে প্রচার করছেন এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে তাকে প্রয়োগ করার জন্য সরকারি দপ্তর থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সাধারণভাবে বিজ্ঞান গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দিলেও এক্ষেত্রে সরকার কোনও কার্পণ্য করছে না।

ভারতীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের মূল দুটি সংকলন গ্রন্থ চরক-সংহিতা এবং শুশ্রুত-সংহিতা পড়লে আপাতদৃষ্টিতে এরকমই মনে হতে পারে এবং কিছুটা কিম্ভুতকিমাকার মনে হতে পারে। কারণ তার মধ্যে একদিকে যেমন নির্ভীক বিজ্ঞানের বলিষ্ঠ সমর্থন রয়েছে, অপরদিকে তেমনিই রয়েছে বিজ্ঞানবিরোধী সংস্কারের রীতিমতো ছড়াছড়ি। যেমন, একই বইতে দেখা যায় বারবার দেব-গো-ব্রাহ্মণের প্রতি ভক্তি গদগদ উচ্ছ্বাসের প্রকাশ, আবার রোগ বিশেষে রোগীকে গো-মাংস খাওয়ানোর নির্দেশ, দরকার হলে তার জন্য ধাপ্পা দেবার কৌশলকেও শেখানোর প্রয়াস।

বিজ্ঞান ও প্রতিবিজ্ঞানের এমন সংমিশ্রণ কেন? গ্রন্থদুটির আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য থেকে শনাক্ত করা সম্ভব, কোন কথা আসলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিচায়ক এবং কোন কথা। তারই উপর প্রক্ষিপ্ত। প্রক্ষিপ্ত কথাগুলি শাস্ত্রসম্মত হলেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের মূল প্রতিপাদ্যের সঙ্গে সম্পর্কহীন ও এমনকী তার বিরুদ্ধ।

তাই সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে এ জাতীয় প্রক্ষেপের কারণ কী? বিষয়টি বোঝার জন্য বিজ্ঞানের ইতিহাস থেকে একটি ঘটনার উল্লেখ করব।

আমরা জানি, কোপার্নিকাস যখন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে সূর্যকেন্দ্রিক ধারণার উল্লেখ করলেন, তখন রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান পুরোহিতদের ঘুম চলে গিয়েছিল। কারণ মতটি শাস্ত্রবচনের সাথে মেলে না। অর্থাৎ মতটি শাস্ত্র-বিরুদ্ধ। ফলে ইনকুইজিশনের বিচারে তাঁকে পুড়িয়ে মারার কথা ছিল, যা পরবর্তী সময়ে ব্রুনোর ক্ষেত্রে হয়েছিল। কিন্তু কোপার্নিকাস সে সুযোগ দেননি। কারণ যেদিন তাঁর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, সেদিনই তিনি মারা যান।

কিন্তু ব্রুনোর মতোই গ্যালিলিওকেও পুরোহিতের বিচারসভার মুখোমুখি হতে হয়। কারণ তিনি কোপার্নিকাসের মতটিকে শুধু মৌখিক সমর্থন জানাননি, দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে হাতে-নাতে তা প্রমাণ করলেন। তবে এঁকে পুড়িয়ে মারা হয়নি। অন্ধকার কারাগারে দীর্ঘ সময় কাটাতে হয়েছিল।

কিন্তু গ্যালিলিওর বন্ধু ও এক অর্থে সহকর্মী আর একজন বিজ্ঞানী দেকার্থস-এর ক্ষেত্রে তা হয়নি। তিনি ‘পৃথিবী প্রসঙ্গে’ নামে একটি বই লিখেছিলেন, তার ময়ে অনেক কথাই গ্যালিলিও সম্মত অভিমত। তবু তিনি ইনকুইজিশনের রক্তচক্ষু এড়ালেন কী করে? সেই কৌশলটিই উল্লেখ করতে চাই।

বইটির পান্ডুলিপি যখন ছাপাখানায় পাঠাবার ব্যবস্থ হচ্ছে, তখন দেকার্থস গ্যালিলিও’র ইনকুইজিশন সম্বন্ধে খবর পান। খবর পেয়েই তিনি বইটির ছাপা বন্ধ করে দেন। শুধু তাই নয়, পুরোহিতশ্রেণি পাছে তাঁকেও সন্দেহ করে বসে, এই আশংকায় তিনি নতুন করে বইটি রচনা করলেন। তাতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রভৃতি নানা বিষয়ে বিস্তৃত প্রমাণ দিয়ে দেখাতে চাইলেন, পুরোহিতদের অভিপ্রেত বিশ্বাসের পক্ষে কত জোরদার যুক্তিতর্কের অবতারণা সম্ভব। তাছাড়া বইটি তিনি পুরোহিতশ্রেণির উদ্দেশ্যেই উৎসর্গ করেন এবং উৎসর্গপত্রে দীর্ঘ বিস্তৃতভাবে পুরোহিতদের মহিমা কীর্তন করেন।

ফলে তাঁকে আর ইনকুইজিশনের দুর্ভোগ পোয়াতে হয়নি। অথচ প্রকৃতপক্ষে দেকার্থস ছিলেন সেকালের মহান বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম এবং তাঁর বৈজ্ঞানিক মত প্রচলিত ধর্মসংস্কারের মূলে আঘাত করে।

তাহলে তিনি সংস্কারের সমর্থনে অমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন কেন? একটাই উত্তর – বিজ্ঞানের সরাসরি প্রচারে বিপদ বুঝে ধূর্ত বিজ্ঞানীটি এই কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। ভারতবর্ষের সপ্তম শতকের বিজ্ঞানী ব্রহ্মগুপ্তর রচনাতেও এই কৌশলটি দেখা যায়।

প্রাচীন ভারতে চিকিৎসাশাস্ত্র: সামাজিক প্রেক্ষাপট

প্রাচীন ভারতে প্রকৃতি বিজ্ঞানের যতটুকু চর্চা হয়েছিল তার মধ্যে চিকিৎসাশাস্ত্রই প্রধান। জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিতের ক্ষেত্রেও ভারতীয় বিজ্ঞানীদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু তা তুলনামূলকভাবে পরবর্তীকালের ঘটনা। প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞানের অগ্রগতির কথা আলোচনা করতে হলে চিকিৎসাশাস্ত্রের কথাই প্রথম আলোচনা করতে হয়।

অথচ একটা আশ্চর্য ঘটনা হল, দেশের আইনকাররা চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষ উগরে দিয়েছেন। বিদ্বেষটা এতদূর গড়িয়েছিল যে, শাস্ত্রকারদের ঘোষণা অনুসারে এই বিজ্ঞান নিয়ে উৎসাহের ফলে মর্তের মানুষ তো বটেই, এমনকী খোদ দেবতারাও জাতে মারা পড়েন এবং তাঁদের শাস্ত্র বিহিত প্রায়শ্চিত্তের বিধান দিতে হয়।

আমাদের দেশে আইনের বই মানে ধর্মশাস্ত্র। অনেক শতাব্দী ধরে অনেকের রচনা, অজস্র বই। শুধু আইনের কথা নয়, ধর্মশাস্ত্রে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনের পাশাপাশি আরও নানা বিষয়ের আলোচনা আছে।

এই ধরনের আইনের বইয়ে বারবার ঘোষণা করা হয়েছে – ডাক্তার এবং সার্জেন, তখনকার ভাষায় ভিষক ও শল্যবিদ – খুবই ঘৃণার পাত্র। শাস্ত্রকারদের মতে এঁদের ছোঁয়া পাপ, এঁদের দেওয়া অন্ন গণিকান্ন বা রক্তপুঁজের মতো ঘৃণ্য। এঁদের উপস্থিতিতে শ্রাদ্ধবাড়ি প্রভৃতির পবিত্রতা নষ্ট হয়, এরকম নানা কথা, তখনকার দিনে নিকৃষ্টতা বোঝাবার জন্য যতরকম প্রকাশভঙ্গি সম্ভব, তার কিছুই যেন বাদ পড়েনি।

আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব 600/500 শতকের প্রখ্যাত ধর্মশাস্ত্রকার আপস্তম্ব, গৌতম, বশিষ্ঠ থেকে শুরু করে আনুমানিক একাদশ/দ্বাদশ শতাব্দীর কুল্লুকভট্ট নামে মনুস্মৃতির ব্যখ্যাকার একথাই বার বার ঘোষণা করেছেন।

কিন্তু চিকিৎসকদের এত অপবিত্র বলে ঘোষণা করা সত্ত্বেও তাদের নিজেদের আদর্শের মধ্যে সত্যিই অপবিত্র বলে কিছু নেই। বরং চরক সংহিতা (3/8/8) এবং শুশ্রুত সংহিতায় (1/10/2) প্রকৃত চিকিৎসকের বর্ণনায় শীল, শৌচ, প্রশান্ত ভাব, আচার-অনুরাগ ইত্যাদি নানা গুণের উল্লেখ আছে। তাহলে চিকিৎসকের আদর্শের মধ্যে কোনও নোংরামির নামগন্ধ নেই।

অথচ আইনকারদের মতে এরা নেহাতই নোংরা লোক। কেন এমন ঘৃণা? ধর্মশাস্ত্রের মধ্যে এর কোনও উত্তর নেই, আছে শুধু ব্যাখ্যাহীন ঘোষণা। তাহলে কারণটা কী হতে পারে?

পরে আমরা আলোচনা করে দেখাব যে, এর একটা বড়ো কারণ অবশ্যই রোগ-নিরাময়ের উদ্দেশ্যে তাঁরা রোগীর পথ্য সম্পর্কে এমন অনেক বিধান দিতে বাধ্য হয়েছিলেন যার সঙ্গে শাস্ত্র-সম্মত আচার অনুষ্ঠানের প্রত্যক্ষ বিরোধ। রয়েছে। শুধু তাই নয়, আমাদের প্রাচীন চিকিৎসকরা চিকিৎসাবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান হিসেবে চর্চা করেছিলেন। তাই বিজ্ঞান হিসাবে তার নানা প্রতিপাদ্য বিষয় প্রাচীন শাস্ত্র সংস্কারের বিরুদ্ধে গিয়েছিল।

এবার একটা ধারণা পাওয়া গেল। ধর্মশাস্ত্র পুরোহিত শ্রেণির সৃষ্টি। ফলে যে সব সংস্কারের উপর এই শ্রেণিটির রুজি-রোজগার থেকে শুরু করে সামাজিক প্রতিপত্তি সবকিছুই নির্ভর করে, কোনও অর্থেই তার বিরুদ্ধে যাওয়া আইনকারদের পক্ষে সম্ভব নয়। সম্ভবত এই কারণেই ধর্মশাস্ত্রে চিকিৎন্সাবিজ্ঞানী ও তাদের বিদ্যাটির বিরুদ্ধে আক্রোশ।

প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্র ও বৈদিক সাহিত্য

আমাদের দেশে ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত শ্রেণির কাছে শাস্ত্রবিশ্বাসের উৎস কী? অবশ্যই বেদ। বেদের চারটি ভাগ – ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব। এর মধ্যে চতুর্থটির বৈদিক মর্যাদা তুলনায় পরবর্তীকালের। তাই পুরানো লেখায় বেদ বলতে ত্রয়ী, বা তিন বেদ। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বেদকে ত্রয়ী-ই বলা হয়েছে। সামবেদের খুব একটা স্বাতন্ত্র নেই। ঋকবেদেরই যেসব কবিতা সুরে গাইবার মতো, সামবেদ হল তারই সংকলন। তাহলে বাকি থাকে ঋকবেদ ও যজুর্বেদ।

প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্রের বিরুদ্ধে শাস্ত্রকারদের বিদ্বেষের উৎস খুঁজতে হলে অল্প কথায় হলেও এই দুই বেদের বৈশিষ্ট্য এবং বিবর্তনকে বুঝতে হবে।

বাস্তব বিচারে ঋকবেদ ও যজুর্বেদের মধ্যে অনেক তফাৎ—বিষয়বস্তু ও রচনাকাল দুদিক থেকেই। ঋকবেদ এক বিশাল কাব্যসংকলন। অবশ্যই আদিমকালের কবিতা—মানুষ যখন প্রকৃতির ছন্দকে ভাষায় প্রকাশ করার চেষ্টা করেছে। সেদিন মানুষ বিশ্ব প্রকৃতিতে যা কিছু পরমাশ্চর্য দেখেছে যা কিছুর উপরই মানুষের বাঁচা-মরা, সুখ-দুঃখ নির্ভর করে তাতেই দেবত্ব কল্পনা করেছে, তার স্তুতি করেছে, তার কাছে প্রার্থনা করেছে। অর্থাৎ এই দেবতা সর্বশক্তিমান অদৃশ্য কোনও ঈশ্বরের প্রতিনিধি নয়। এই দেবতার কল্পনায় প্রকৃতির নানা রূপের প্রকাশ ঘটেছে। যেমন, ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র, বায়ু, অগ্নি, সূর্য থেকে শুরু করে ক্ষয়রোগ- আরোগ্য প্রভৃতি অজস্র দেবতার কল্পনা করা হয়েছে।

হিন্দুধর্মের প্রবক্তারা যতই প্রচার করুন না কেন যে, হিন্দুধর্ম বেদমূলক এবং বেদের মধ্যে ঋকবেদই প্রধান, বাস্তব ইতিহাস বলছে অন্যকথা। দেখা গেছে যে, পরবর্তীকালে এমনকী প্রসিদ্ধতম দেবতাগুলির বিশেষ কোনও চিহ্ন হিন্দুধর্মে টিকে নেই। ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র, বায়ু, অগ্নি বা ঐধরনের কোনও দেবতার মন্দির এদেশে দেখেছেন? ভূ-ভারতে হাজার হাজার মন্দিরের কোথাও এঁদের স্থান হয়নি। যেসব দেবদেবীর পূজা-উপাসনায় প্রচলিত হিন্দুধর্ম ভরপুর, তাদের সঙ্গে ঋকবেদের দেবদেবীদের বিশেষ কোনও সম্পর্কই নেই। অর্থাৎ শাস্ত্রকারদের বিধান ও মতামতের সাথে অন্ততঃ ঋকবেদের কোনও সম্পর্ক নেই।

যজুর্বেদে আমরা অন্য জিনিস পাই। যজুর্বেদের একমাত্র আলোচ্য বলতে বৈদিক যাগযজ্ঞ। যজুর্বেদের অবশ্য অনেক শাখা। যাজ্ঞিকদেরও নানা সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়গুলিই পরবর্তীকালের নানা পুরোহিত গোষ্ঠীর পরিচায়ক। ধর্মশাস্ত্র বলতে পরের যুগের যে বিধিনিষেধের গ্রন্থ, তা ঐ পুরোহিত শ্রেণিরই রচনা। অর্থাৎ ধর্মশাস্ত্রের আদি উৎস খুঁজতে হবে যজুর্বেদের মধ্যে।

শুধু বিষয়বস্তুর দিক থেকেই নয়। যজুর্বেদের রচনাকালও অনেক পরের ঘটনা। ঋকবেদের সারাংশের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতক। কিন্তু যজুর্বেদ অন্তত পাঁচ-ছ’শতক পরের রচনা। বোঝাই যায় এই দীর্ঘ সময়ে পরিবর্তন হয়েছে সমাজ কাঠামোয় এবং অবশ্যই মানুষের চিন্তা ভাবনায়। তারই প্রতিফলন পাওয়া যায় যজুর্বেদের বিষয়বস্তুতে। ঋকবেদের যুগে সমাজব্যবস্থার যে পরিচয় পাওয়া যায় তা আদিম সাম্য সমাজের অনুরূপ ছিল। তারই প্রতিফলন পাই তাদের প্রকৃতি পূজা ও সমষ্টিগত কামনার মধ্যে। কিন্তু যজুর্বেদের রচনাকালে সমাজের সুস্পষ্ট বিভাজন লক্ষ্য করা যায়।

আয়ুর্বেদের আলোচনা করতে গিয়ে বেদের আলোচনা অনেকটা ‘ধান ভানতে শিবের গীত’-এর মতো মনে হতে পারে। কিন্তু ধর্মশাস্ত্রে চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতি যে বিদ্বেষ তা বোঝবার জন্যে যজুর্বেদ পর্যন্ত ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। ধর্মশাস্ত্রকাররা যজুর্বেদ সম্মত মতাদর্শের উত্তরাধিকারী এবং যজুর্বেদেই প্রথম চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতি ঘৃণার পরিচয় পাওয়া যায়।

যেমন, যজুর্বেদে ঘোষণা করা হয়েছে—ভিষক বা চিকিৎসাবিদ অপবিত্র। পবিত্র যজ্ঞকর্মে তার স্থান নেই, তাই ব্রাহ্মণের পক্ষে চিকিৎসাকাজ নিষিদ্ধ: ‘তস্মাৎ ব্রাহ্মণেন ভেষজংন কার্যম্। অপূতঃ হি এষঃ অমেধ্যঃ যঃ ভিষক্’। (তৈত্তিরীয় সংহিতা, 6/4/9)

কিন্তু ঋকবেদে তা নয়। ঋকবেদে অশ্বীদ্বয় বলে দুজন। যমজ দেবতার গুণগান ফলাও করে কীর্তিত হয়েছে এবং তার কারণ চিকিৎসাবিদ্যায় এরা বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। এঁদের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার ফলেই নামান্তরে এঁরা নাসত্যদ্বয় বলেও উল্লিখিত, অর্থাৎ অসত্যের সঙ্গে এঁদের সম্পর্ক নেই। ঋকবেদে অশ্বীদ্বয় ছাড়াও অন্যান্য প্রসিদ্ধ দেবতাদের চিকিৎসা-বিশারদ বলে অনেক স্তুতি আছে। ঋকবেদের একটি কবির নামই ভিষক এবং তাঁর লেখা স্তুতিটি চিকিৎসাবিজ্ঞান ও চিকিৎসা সামগ্রীর বা ওষধির মহিমা বর্ণনায় মুখর।

ঋকবেদে যাদের এমন গুণকীর্তন, যজুর্বেদে তাদেরই অপবিত্র বলে ঘোষণা করা হয়েছে। যজুর্বেদে বলা হয়েছে, অন্যান্য দেবতারা বলেন, এই দেবতাদ্বয় অপবিত্র, কারণ চিকিৎসা প্রসঙ্গে এরা সাধারণ মানুষের সাথে বড় বেশি মাখামাখি করেছিলেন।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোগীর পরিচয় মানুষ। চিকিৎসকের উদ্দেশ্য হল, রোগীটির রোগ নিরাময় রোগীটি ব্রাহ্মণ, না ক্ষত্রিয়, না বৈশ্য, না শূদ্র তার বিচার নয়। অথচ যজুর্বেদের সময় থেকে জাতপাতের এই বিচারটাই প্রধান কথা। তাই চিকিৎসকের পক্ষ থেকে জাতপাতের এই বিচারকে উপেক্ষা করার মনোভাবটি শাস্ত্রকারদের কাছে অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়েছে। দেবতাদেরও যে অপরাধী গণ্য করে অচ্ছুৎ করা হয়েছিল তা আগেই বলেছি।

কিন্তু তাতে সমস্যা মিটল না। যাঁরা বেদ রচনা করেছিলেন, তাঁদের কল্পনায় রোগভোগ শুধু মর্তের মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। দেবলোকেও তা নিয়ে সমস্যা আছে। প্রজুর্বেদেরই একটা উপাখ্যান অনুযায়ী খোদ 'যজ্ঞ'রই একবার উদারুণ অসুখ হয়। তার মাথাটাই নাকি কাটা পড়েছিল।

এরকম অবস্থায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতেই হল। ফলে দেবতারা গিয়ে অশ্বীদ্বয়কে ধরলেন, যজ্ঞকে ধাঁচাতেই হবে। কিন্তু অর্থীদ্বয় বেঁকে বসলেন। তাঁরা বললেন, প্রাশনারা আমাদের পতিত বলে ঘোষণা করেছেন, অন্যান্য দেবতারা যে মর্যাদা পায়, তা থেকে বঞ্চিত করতে চেয়েছেন, আমরা আপনাদের উদ্ধার করতে যাব কেন? নিরুপায় হয়ে দেবতারা এঁদের দেব-মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হলেন। কিন্তু সরাসরি তার উপায় ছিল না। তাই ঠিক হল, শাস্ত্রসম্মত অনুষ্ঠান বা প্রায়শ্চিত্ত করে প্রথমে এঁদের শুদ্ধ করে নেওয়া দরকার। অর্থীঘয়তে শুদ্ধ করে দেব মর্যাদা দিতে হল। তবেই যজ্ঞ রক্ষা পেল।

এগুলো সবই পৌরানিক উপাখ্যান, একথা ঠিক। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে সেদিনের সমাজ জীবনের মনোভাবটা বুঝতে পারা যায়। এ থেকে একটা কথা বোঝা যায় যে, ঋকবেদ রুনার যুগের সমাজ কাঠামোর থেকে যজুর্বেদ রচনার যুগের সমাজ কাঠামো পালটে গিয়েছিল। ঋকবেদের প্রকৃত প্রাচীন কবিতাগুলি যৌথ সমাজজীবনের আদর্শে ভরপুর, সেখানে জাতিভেদ বা বর্ণাশ্রম প্রথার কোনও চিহ্ন পাওয়া যায় না। 'পুরুষসূক্ত' নামে প্রসিদ্ধ অনেক পরবর্তীকালের কবিতায় তার প্রথম আভাস পাওয়া যায়।

অথচ যজুর্বেদের সমাজ আদর্শের মূল উপজীব্য বলতে জাতিভেদ বা বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা। যজুর্বেদের কর্তারা এটুকু বুঝেছিলেন যে, চিকিৎসাবিজ্ঞান, তথা বিজ্ঞান মাত্রই তাঁদের এই সমাজ আদর্শের পক্ষে নিরাপদ নয়। তাই এই ঘৃণ্য। এই একই কারণে অনেক পরবর্তী কালের রচনা ধর্মশাস্থেও এই ঘৃণার পরিচয় পাওয়া যায়।

উপরে আলোচিত প্রেক্ষাপটটির ভিত্তিতেই আমাদের আয়ুর্বেদের দার্শনিক ভিত্তি খুঁজতে হবে। না হলে আমরা বুঝতে পারব না, কেন আয়ুর্বেদে অধ্যায্যবাদের সমর্থনে এত আলোচনা। অসতর্ক পাঠকের বিভ্রান্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা প্রয়েছে। আর আয়ুর্বেদে অধ্যায়বাদের এই দৃষ্টান্ত দেখিয়ে অনেকেই আয়ুর্বেদকে অধ্যাত্ম্যবাদের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর রচিত গ্রন্থ হিসেবে দেখানোর সুযোগ পেয়ে যান।

ভারতের প্রাচীন চিকিৎসা ব্যবস্থা

প্রাচীন ভারতে চিকিৎসা বিদ্যার প্রথম উদিত পাওয়া যায় অথর্ববেদে। ঋকবেদের সাক্ষ্যে যেসব দেবতার কল্পনা করা হয়েছে, তার মধ্যে চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী দেবতার উল্লেখ পাওয়া যায়, সে কথা আগেই বলেছি। অথর্ববেদের কিছু অংশ অনেক প্রাচীন, এমনকী ঋকবেদের সমসাময়িক। যাই হোক, অথর্ববেদে চিকিৎসা বিদ্যার যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাকে ঠিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বলা যায় না। কারণ প্রকৃত অর্থে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উদ্ভব তখনও হয়নি। মানুষের রোগ। নিরাময়ের জন্য মূলত জাদুবিদ্যা বা নৃতত্ত্ব সঙ্গত ম্যাজিকের সমগোত্রীয় পদ্ধতির উপর নির্ভর করা হত। কোনও এক কালে অথর্ববেদেরই একটি শাখা ছিল, তার নাম চারণবৈদ্য বা ভ্রাম্যমান চিকিৎসক। শাখাটি বিলুপ্ত হলেও নামটি হয়নি। এর মধ্যেই পরবর্তীকালের 'চরক' নামের চিকিৎসক সম্প্রদায়ের পূর্বাভাগ পাওয়া যায়।

অথর্ববেদের পর চরক সংহিতা ও শুশ্রুত সংহিতা। চরক সংহিতায় এমন কোনও ইঙ্গিত নেই, যা থেকে অনুমান করা যায় যে, গ্রন্থটি চরক বলে কোনও একজন গ্রন্থকারের রচনা। গ্রন্থটির প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে শুধু বলা হয়েছে, 'অগ্নিবেশ-কৃতে চরক-প্রতি সংস্কৃতে' ইত্যাদি। অর্থাৎ চরক শব্দটি প্রতিসংস্কর্তা বা reviser হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে, গ্রন্থকার হিসেবে নয়।

এই দৃষ্টান্ত থেকেও বোঝা মুশকিল যে, চরক কোনও ব্যক্তিগত না সম্প্রদায় নাম। গ্রন্থকার হিসেবে অগ্নিবেশের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অন্যত্র তাঁকে বহ্নি বেশ বা হুতাশবেশ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে এখানেও ধন্দ থেকে যাচ্ছে, এরা কি একই ব্যক্তি?

তাছাড়া চরক সংহিতায় সুস্পষ্টরূপেই বলা হয়েছে। যে, 'অগ্নিবেশ কৃত', 'চরক প্রতিসংস্কৃত' মূল গ্রন্থটি বহুলাংশেই বিলুপ্ত হয়েছিল। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় অষ্টম/নবম শতকে কাশ্মীরের প্রখ্যাত বৈদ্য কপিলবলের পুত্র দৃঢ়বল হারানো অংশ নিজে লেখেন এবং অবিলুপ্ত অংশটিকেও নবরূপ দান করেন। বর্তমানে চরক সংহিতা বলতে দৃঢ়বলের এই সংস্করণ। কিন্তু তারই স্বীকৃতি অনুসারে 'সংস্কর্তা কুরুতে তন্ত্র্য পুরাণং চ পুনঃ নবম্' (8/12/37)। অর্থাৎ সংস্কারক পুরাতন অস্ত্রকে নতুন করে ঢেলে সাজান এবং এই উদ্দেশ্যে বহু শান্তাস্তর থেকে বিশিষ্ট মতবাদ গ্রহণ করেন (8/12/39)।

এ থেকেই বোঝা যায় যে, অধুনালব্ধ চরক সংহিতাটি নানা সংস্কারকের হার ঘুরে এবং এমনকী শাস্তাস্তর থেকে বিবিধ বিষয় গ্রহণ করে শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে এসে পৌছেছে। এর ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি চরক মধ্যবর্তী কোনও সংস্কার বা সম্পাদক মাত্র।

আর এক দিক থেকেও বিষয়টি আলোচনা করা যেতে পারে। আয়ুর্বেদের আকরগ্রস্থ দুটিতে যে পরিমাণ অভিজ্ঞতা জ্ঞানের পরিচয় গায়গায়ড়ার সংখ্যা এ্যাকারের বেশি, জন্তু-জানোয়ারের সংখ্যা দেড়শ'রও বেশি। কোন অসুখের ওষুধ হিসেবে কোন গাছের ছালবাকল থেকে শুরু করে ফলমূল প্রভৃতি বা জন্তু- জানোয়ারের রক্ত মাংস থেকে শুরু করে মূত্র পর্যন্ত কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, তার আলোচনা রয়েছে।

ঘরে বসে এই বিশাল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার প্রশ্নও ওঠে না। বিশেষ করে প্রাচীন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা যখন দাবি করেছেন 'প্রত্যক্ষ ফলদৃষ্ট' ওষুধ-বিষুব ছাড়া অন্য কোনও নির্দেশ স্বীকার করা উচিত নয়। অর্থাৎ হাতে নাতে মালামাল যাচাই না করে তাঁরা কোনও নিদান দেননি, বা লিপিবদ্ধ করেননি। তাই একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, একের অভিজ্ঞতা নয়, অনেকের অভিজ্ঞতা, এক জায়গার অভিজ্ঞতা নয়, অনেক জায়গার অভিজ্ঞতা একত্রিত হয়েছে আয়ুর্বেদশাস্ত্রে।

তাই চরক শব্দকে কোনও বাক্তি বিশেষের নাম বলে মেনে নেওয়ার উপায় নেই। বরং একথা অনুমান করা বোধহয় খুব ভুল হবে না যে, বুদ্ধ পূর্ব কোনও যুগে ভ্রাম্যমান চিকিৎসকেরা এ ধরনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের কাজে অগ্রসর হয়েছিলেন এবং কালক্রমে তা চরক সংহিতা নামে সংকলিত হয়েছিল। কারণ গৌতম বুদ্ধের নিকট বন্ধু জীবক বালে প্রখ্যাত চিকিৎসকের অজয় কাহিনী সুবিদিত। শুধু তাই নয়, বৌদ্ধদের প্রাচীন পালিগ্রন্থ বিনয়-পিটকের এক সুদীর্ঘ অংশের নাম 'ভেসজ্জক' এই অংশে ওষুধ হিসেবে একের পড়ে। অর্থাৎ চরক সংহিতারই পূর্বাভাস। আর একটা বিষয়ও মনে রাখা দরকার। বৌদ্ধধর্ম সমাজে জাত-পাতের বিভাজনের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিল। ফলে জাতপাতের সমর্থক আহনকারসের রক্তচক্ষু থেকে এই সময় চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মুক্ত ছিল। ফলে অনেক সহজ পরিবেশে তাঁরা কাজ করতে পেরেছিলেন।

সুশ্রুত সংহিতার ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। এতে শল্যবিদ্যা বা সার্জারির আলোচনার পাশাপাশি ওষুধ-বিসুধ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে, তার সঙ্গে চরক সংহিতার বিশেষ পার্থক্য নেই। তাই সুশ্রুত নামে কোনও ব্যক্তি বিশেষ বইটি লিখেছিলেন তা কল্পনা করা শিশু সুলভ হবে। সুশ্রুত কথার অর্থ যিনি বা যারা ভালো করে শুনেছিলেন। তাহলে কি ভ্রাম্যমান অনেক চিকিৎসকের অনেক কথা ভালো করে শুনে যে সংকলন গ্রন্থ লেখা হয়েছিল, তারই নাম সুশ্রুত সংহিতা। একথা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে।

সুশ্রুত সংহিতাও অনেকের হাত ঘুরে লালাভাবে পরিবর্তিত হয়ে অধুনা লভ্য সংকলন গ্রন্থের রূপ পেয়েছে। এদের মধ্যে শেষজন নাগার্জুন বলে উল্লিখিত। তবে এই নাগার্জুন যে প্রখ্যাত মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের প্রবর্তক নন, তার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি ঠিক কে ছিলেন সে বিষয়ে জল্পনা-কল্পনা থাকলেও কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় না।

আয়ুর্বেদে বস্তুবাদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব

একথা প্রমাণিত যে, প্রকৃত অর্থে টিকিপার বিজ্ঞানের চর্চা, অর্থাৎ কোন বিশেষ রব্যের (গাছ-গাচড়া বা জন্তু-জানোয়ার) কোন বিশের রোগ নিরাময়ের কার্যকারিতা রয়েছে, তার বিস্তারিত আলোচনা আয়ুর্বেেদে পাওয়া যায়। যেমন, চরক সংহিতায় 153 রকম জম্বলানোয়ারের উল্লেখ আছে, মাংসের আটটি বেলিতে ভাগ কথা থাকলেও এখানে ধর্মান্ডর্মের কথা নেই। জয় জানোয়ারদের শুধু জন্তুজলনোয়ার হিসেবেই দেখানো হয়েছে এবং তাদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে। কিন্তু চরক সংহিতায় প্রাধাবিজ্ঞানের আলোচনা কেন। কারণ কিভাবে পথ্য ও ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তা বোলা সরকার। চরক সংহিতায় এই আলোচনা মোটামুটি সুলাতে বিভক্ত। একভাগে জানোয়ারটি যে শ্রেণিতে পড়ে সাধারণভাবে সেই শ্রেণির অন্যান্য জানোয়ারদের মাসে প্রকৃতির গুণাগুণ ও সাধারণ উপযোগিতা নিয়ে আলোচনা। চিকিৎসা বিজ্ঞানসম্মত গুণাগুণের আলোচনা। এ প্রসঙ্গেই গোমাংসের গুণাগুণ নিয়ে আলোচনা রয়েছে। গোরক্ষকরা চমকে যাবেন, যে আয়ুর্বেদকে তারা অধ্যাত্মবাদ প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন, সেই আয়ুর্বেদের আকরগ্রন্থ চরক সংহিতায় বলা হয়েছে- "শরীরে মাংস বৃদ্ধির জন্য গোরুর মাংস শুকর, মোষ প্রভৃতির সমতুল্য। শুয়রোগীর পক্ষে শরীরে মাংস বৃদ্ধির বিশেষ প্রয়োজন - যেমন প্রয়োজন যাঁরা কায়িক শ্রম করেন, তাদের জন্যও। এক্ষেত্রে গরুর মাংসের বিশেষ উপযোগিতা আছে।" যেমন, গব্যাং কেবল-বাতেষু পীনসে বিষম জ্বরে।

শুষ্ককাস-শ্রম-অত্যগ্নি-মাংসক্ষয়-হিতং চ তৎ।।(1/27/79-80)

কিন্তু শুধু নিদান দিলেই তো হবে না, তাকে কার্যকর করতে হবে। তাঁরা একথা ভালো করেই জানতেন যে, এদেশে ধর্মশাস্ত্রকারদের সুদীর্ঘ প্রচারের ফলে রোগীকে এতরকম মাংস খাওয়ানো সহজ কাজ নয়। জোর করে খেলাতে গেলেও বমি করে দেওয়ার সম্ভাবনা। তাহলে উপায় কী?

উপায় হিসেবে তাঁরা বস্তুনিষ্ঠ পদ্ধতির কথাই ভেবেছিলেন। বিজ্ঞানী হিসেবে চিকিৎসকদের একমাত্র উদ্দেশ্য হল, রোগীর রোগ সারানো, নীতিশাস্ত্র বা সত্য-মিথ্যার তত্ত্বগত বিচার নয়। তাই কৌশলের আশ্রয় নিতেও তাঁর পিছপা হননি। শুধু ভালো ডাক্তার নয়, ভালো ডাক্তার হতে গেলে ভালো রাঁধুনি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এমনই রাঁধুনি যে, শাস্ত্রনিষিদ্ধ ও সুরুচি বিরুদ্ধ রকমারি মাংস এমন কায়দায় রাঁধতে হবে যে, রোগীর কাছে তা সংস্কার সংগত খাদ্য বলে মনে হবে।

তাই চরক সংহিতায় গো-মাংসের উপযোগিতা আলোচনা করার পরই বলা হয়েছে – ‘বিধানজ্ঞ চিকিৎসক জীণমাংস যক্ষ্মা রোগীকে বিশেষরূপে রসাদি ধাতু বর্ধক মসে ভক্ষক জন্তুর মাংস নানাপ্রকারে কল্পনা করিয়া প্রদান করিবেন। যক্ষ্মারোগীকে ময়ূর অথবা ময়ূরের নাম করিয়া বৃত্র, উলুক (পেঁচা) ও অন্যান্য চাষ প্রভৃতি পক্ষীর মাংস বিধিপূর্বক ব্যঞ্জনাদি রূপে কল্পনা করিয়া খাইতে দিবে। যত্মারোগীকে সেইরূপ তিত্তির মাংস বলিয়া কাকের মাংস, বর্মি (বান) মৎস্য বলিয়া সর্পের মাংস এবং মৎস্যের নাড়ি বলিয়া গণ্ডুপদ (কেঁচো) ভাজিয়া খাইতে দিবে’+ ইত্যাদি।

‘যে সকল মাসে অনভ্যাস বশতঃ অপ্রিয়, সেই সকল নাসে ছলপূর্বক প্রয়োগ করিলে ভক্ষণ সুখকর হইতে পারে। এজন্য ছলপূর্বক এঐ সকল মাসে প্রয়োগ করা কর্তব্য। কিন্তু যদি জানিতে পারাতে ভোগী ঘৃণা করিতে থাকে তবে ঐরূপ মাংস ভক্ষণ করানো উচিত নহে। অতএব ছলপূর্বকই এই সকল মাংস যক্ষ্মা রোগীকে দেওয়াইবে। (তন্মাৎ ছয়োপসিদ্ধানি মাংসান্যেতানি দাপয়েৎ।)

এখানে যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাই, তা বাহ্য বস্তুবাদের প্রতি নির্ভরতার পরিচায়ক। অর্থাৎ ধর্মশাস্ত্রের নিদানের উপর নির্ভরতা নয়, প্রকৃতিজগতে প্রাপ্ত জৈব-অজৈব বস্তুসমূহের উপর নির্ভরতা।

চিকিৎসা পদ্ধতিতেও এর প্রতিফলন পাওয়া যায়। আগেই বলেছি যে, চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রথম পরিচয় পাওয়া যায় অথর্ববেদে। কিন্তু তখনও বস্তুভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভব হয়নি। রোগের কারণ হিসেবে ভূত-প্রেত জাতীয় অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত কিছুর উপদ্রব বলেই কল্পনা করা হত। রোগমুক্তির আশায় তাই মন্ত্রতন্ত্র, তাগা তাবিজ প্রভৃতির উপরই নির্ভরতা দেখতে পাওয়া যায়। অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত দেখিয়েছেন, অথর্ববেদে ভেষজ বা ওষধির কথা উল্লেখ থাকলেও তার অর্থ আসলে তাগা তাবিজ। তাছাড়া অবশ্যই রকমারি মন্ত্রতন্ত্রের নির্দেশ, ওষুধ বা পথ্য হিসেবে প্রাকৃতিক বস্তু নয়। চরক সংহিতায় এ ধরনের চিকিৎসা দৈব-ব্যাপাশ্রয় বলে উল্লিখিত হয়েছে। চিকিৎসা পদ্ধতির এহেন কল্পনা ছেড়ে আয়ুর্বেদের আকরগ্রন্থে রোগভোগের প্রাকৃতিক কারণ অনুসন্ধানের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। চিকিৎসা পদ্ধতিতেও তাই প্রাকৃতিক দ্রব্য ব্যবহারেরই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই পার্থক্যটি বোঝাবার জন্য চরক সংহিতায় দৈব ব্যাপাশ্রয় ভেষজ্ঞ ছেড়ে যুক্তি ব্যাপাশ্রয় ভেষজের দিকে এগোবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ অতিপ্রাকৃত সত্তার উপর নির্ভরতা ছেড়ে প্রাকৃতিক বস্তুর উপর নির্ভরতার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আয়ুর্বেদশাস্ত্রের দার্শনিক ভিত্তি

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বাদ দিয়ে বিজ্ঞান সম্ভব নয় এবং নির্ভুল যুক্তি কৌশল লঙ্ঘন করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবশ্যই অসম্ভব। প্রাচীন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা একথা বুঝেছিলেন বলেই চরক সংহিতায় যুক্তিবিদ্যা সম্বন্ধে সুদীর্ঘ আলোচনা রয়েছে। তারই নজির থেকে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত অনুমান করতে চেয়েছেন, তুলনায় পরবর্তীকালের ন্যায় দর্শনের প্রকৃত উৎস বলতে আয়ুর্বেদই স্বীকার্য।

আয়ুর্বেদের আকরগ্রন্থে যুক্তিবিদ্যার যে সুদীর্ঘ বিচার আছে। তার বিস্তৃত আলোচনা করার সুযোগ এখানে নেই। দু-একটি উদাহরণ দেওয়া সম্ভব। যুক্তিবিদ্যার বিশিষ্ট বিষয় বলতে বুঝি নির্ভুল চিন্তা-পদ্ধতির নিয়মকানুন। তাই তা লঘন করলে যেসব ভূলভ্রান্তি হয় তার আলোচনাও রয়েছে। এধরনের ভূলভ্রান্তির পারিভাষিক নাম হেত্বাভাস। চরক সংহিতায় হেত্বাভাসের তালিকা দীর্ঘ। তার মধ্যে এখানে দুটির উল্লেখ করা হচ্ছে।

একরকম ভুলভ্রান্তিকে বলা হয়েছে 'অধিক' দোষ। সহজ ভাষায় অবান্তর কথা। যেমন, আয়ুর্বেদের আলোচনা প্রসঙ্গে বৃহস্পতি বা উশনস নামের প্রাচীন আইনকারদের মতামত উদ্ধৃত করা 'অধিক' দোষে দুষ্ট (3/8/54)। এঁদের মতামত এদেরই বিশিষ্ট বিষয়ে প্রামাণ্য হতে পারে। কিন্তু আয়ুর্বেদের নিজস্ব আলোচ্য বিষয় বলতে চিকিৎসা বিজ্ঞান। অর্থাৎ রোগের কারণ নির্ণয় করা এবং তা নিরাময়ের ব্যবস্থা নিরূপণ করা। তাই আয়ুর্বেদের আলোচনায় বৃহস্পতি বা উশনসের মত উল্লেখ করা অবশ্যই অবান্তর হবে।

কয়েকটি বিষয় আয়ুর্বেদশাস্ত্রের সঙ্গে অপরিহার্য। মূলত তিনটি কথা (1) কারণ, (অর্থাৎ প্রতি রোগের নির্দিষ্ট কারণ) বর্তমান। (2) রোগ আছে (অর্থাৎ অসুখ বিসুখ বলে ব্যাপারটা মানতেই হবে।) এবং (3) আরোগ্য যোগ্য। রোগের আরোগ্য উপায় আছে (3/8/37)।

এ ধরণের দাবি থেকে সহজেই বোঝা যায়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রকৃষ্ট বিষয়বস্তু বলতে ঠিক কী বোঝায়। কিন্তু তা অগ্রাহ্য করে কেউ যদি আয়ুর্বেদের আলোচনায় শাস্ত্রের আলোচনা পাড়েন এবং সেই সব শাস্ত্রের প্রবক্তার কোনও উক্তি উদ্ধৃত করেন, তাহলে ঐ প্রবক্তার নিজশাস্ত্রে অধিকার যতই হোক না, আয়ুর্বেদ প্রসঙ্গে তা অবান্তর। তা 'অধিক' দোষে দুষ্ট হবে।

এই দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যায় যে, শাস্ত্রকারদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য আয়ুর্বেদশাস্ত্রে অহিনকারদের আলোচনা করা হলেও তা থেকে বেরিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রকৃত কথাটা বোঝার উপায়ও বাতলে দিয়েছে। আর এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা নিয়েছে যুক্তিবিদ্যা।

চরক সংহিতায় এরকম আর একটি হেত্বাভাস বা যুক্তিবিভ্রমের কথা এখানে আলোচনা করা জরুরী। হেত্বাভাসটি 'বিরুদ্ধ' নামে অভিহিত। বিরুদ্ধ দোষ অনেক রকম। তিন রকমের নজির আলোচিত হয়েছে – 'দুষ্টাত্ব বিরুদ্ধ', 'সিদ্ধান্ত-বিরুদ্ধ' ও 'সময়-বিরুদ্ধ'। 'সময়' বলতে এখানে বিশিষ্ট আলোচ্য বিষয় বা পরিপ্রেক্ষিত বোঝানে হয়েছে। সাধারণভাবে এরকম 'সময়' তিন রকমের হতে পারে আয়ুর্বেদিক-সময়, যান্ত্রিক-সময় এবং মোক্ষশাস্ত্রিক-সময়। (3/8/54)।

আয়ুর্বেদের বিশিষ্ট 'সময়' প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, 'চতুষ্পাদং ভেষজম ইতি': আয়ুর্বেদ যে চারটি পায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। আয়ুর্বেদের এই চারটি পা বা মূল স্তম্ভ বলতে বোঝায়- (1) চিকিৎসক, (2) পথ্য-ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত দ্রব্য, (3) শুশ্রূষাকারী বা নার্স, এবং (4) রোগী।

যজ্ঞের বিশিষ্ট 'সময়' বলতে বোঝায় যজমানের হিতকল্পে পশুবলি। মোক্ষ-ধর্মের 'সময়' বলতে বোঝায় সর্বপ্রাণীর প্রতি অহিংসা।

সংক্ষেপে, চরক সংহিতায় বলা হয়েছে, বিদ্যার আলোচ্য বিষয় মূলত তিন রকম হতে পারে- চিকিৎসা, যজ্ঞ এবং মোক্ষ। এই তিন রকমের আলোচনা সম্পূর্ণ পৃষত, তাই একটি প্রসঙ্গে অপর কোনওটির কথা বিরুদ্ধ হবে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যজ্ঞ প্রসঙ্গে কোনও কথা মোক্ষ প্রসঙ্গে আলোচনায় সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ হতে বাধ্য। যজের মূল কথা হল পশুবলি, হিংসা। মোক্ষধর্মের মূল কথা অহিংসা। স্বভাবতই একটি আলোচনার সময়ে অপরটির কথা প্রকটভাবেই বিরুদ্ধ। তেমনিই আয়ুর্বেদের আলোচনর সময়ে অপরটির কথা প্রকটভাবেই বিরুদ্ধ। তেমনিই আয়ুর্বেদের আলোচনার সময় যজ্ঞ সময়ের এবং মোক্ষধর্ম-সময়ের কোনও কথা উভয়ই বিরুদ্ধ হবে।

দৃষ্টান্তগুলি বিচার করে দেখলে বোকা যায় অত্যন্ত চতুরভাবে এগুলি বাছাই করা হয়েছে। আমরা জানি, বৈদিক মতে, বেদ মূলতই দুভাবে বিভক্ত। একটিকে বলে কর্মকাণ্ড অর্থাৎ যাগযজ্ঞের কথা। অপরটিকে বলে জ্ঞানকাণ্ড, অর্থাৎ মূলতই মোক্ষর আলোচনা। এই পরিস্থিতিতে যদি দাবি করা হয় যে, যন্ত্র ও মোক্ষ উভয়ের আলোচনাই আয়ুর্বেদের আলোচনা প্রসঙ্গে তুলতে গেলে বিরুদ্ধ-দোষ হবে, তাহলে তার তাৎপর্য দাঁড়ায় যে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোচনার সময় পুরো বৈদিক ঐতিহ্যটাই বাদ দেওয়ার কথা। অন্ত সংকলন গ্রন্থটি বারবার যখন তখন কারণে-অকারণে এই বৈদিক ঐতিহ্যসঙ্গত যজ্ঞকথা ও মোক্ষকথার অবতারণা করা হয়েছে। এর তাৎপর্য কী? আগেই বলেছি, ধর্মশাস্ত্রকারদের চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতি তীর বিদ্বেষের হাত থেকে সংকলনগ্রন্থটিকে রক্ষা করার জন্য বৈদিক ঐতিহ্যের অনুসারী ও শাস্ত্রসম্মত অনেক কথা এতে ঢোকানো হয়েছে। কিন্তু তার প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে চিকিৎসা-বিজ্ঞানের সারাংশটুকুকে চিনতে পারার কৌশলটাও বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে সাহায্য করেছে যুক্তিবিদ্যা। এতক্ষণ আমরা আয়ুর্বেদশাস্ত্রে ন্যায় দর্শনের পরিপূরক যুক্তিবিদ্যার প্রভাবের কথা আলোচনা করলাম। এবার আমরা দেখব, বৈশেষিক দর্শনের প্রভাব।

ঋষি ভরদ্বাজ চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে যে উপদেশ দিয়েছিলেন, তার সাথে রোগের কথা, বা রোগমুক্তির কৌশল সম্পর্কে কোনও কথা ছিল না, ছিল মাত্র দেড়টা শ্লোক –

সামান্যং চ বিশেষং চ গুণান দ্রব্যানি কর্মচ।

সমবায়ং চ………… (চরক সংহিতা, 1/1/28-29)।

সোজা কথায়: সামান্য, বিশেষ, গুণ, দ্রব্য, কর্ম ও সমবায়। ভারতীয় দর্শনের ছাত্রদের কাছে তালিকাটি সুপরিচিত। বৈশেষিক দর্শনের ছয়টি মূল পদার্থের তালিকা। অবশ্য মনে রাখা দরকার, বৈশেষিক দর্শনে পদার্থগুলি যে অর্থে আলোচিত চরক সংহিতায় হুবহু সে অর্থে নয়। যেমন, দর্শনটিতে 'সামান্য' universal অর্থে এবং 'বিশেষ' particular অর্থে ব্যবহৃত। কিন্তু চরক সংহিতায় দুটি পদার্থের অর্থ আলাদা। তা সুনিশ্চিতভাবেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রাথমিক শর্ত। 'সামান্য' অর্থে বৃদ্ধিকর, বিশেষ অর্থে হ্রাসহেতু। শরীরে মাংস বৃদ্ধির প্রয়োজনে যা খেলে মাংস বাড়বে তাই মাংসের পক্ষে সামান্য। শরীরে মাংস কমানোর জন্য যা খেলে মাংস কমবে, তাই মাংসের পক্ষে বিশেষ। কিন্তু শরীরের পক্ষে যা বৃদ্ধিকর এবং হ্রাসহেতু তার উভয়েই প্রাকৃতিক বস্তু- দার্শনিক পরিভাষায় 'দ্রব্য'। তাই 'দ্রব্য'-র আলোচনাও একান্তই প্রাসঙ্গিক। দেহই হোক, আহার ও ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রাকৃতিক বস্তুই হোক সবকিছুই পঞ্চভূতাত্মক। অর্থাৎ সবকিছুরই উপাদান বলতে পঞ্চভূত। তাই সামান্য ও বিশেষ বৃদ্ধিকর বা হ্রাস হেতু যেকোনও প্রব্যই হোক না কেন, তা সবই শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় শরীরের উপাদান যে পঞ্চভূত তারই হ্রাসবৃদ্ধি। এই হ্রাসবৃদ্ধির কারণও পঞ্চত্বতাত্মক প্রাকৃতিক ব্যাপার। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সমস্যাটা যে পদ্মভূত দিয়ে দেহ গঠিত এবং যে পঞ্চভূত দিয়ে সমস্ত প্রাকৃতিক বন্ধ গঠিত সেই পঞ্চভূতের মধ্যে আদান প্রদান বা পারস্পরিক প্রভাব, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

এখন দেখা দরকার, প্রাকৃতিক বস্তুগুলির পাঞ্চভৌতিক উপাদানের সমস্যাটা চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা কীভাবে বুঝেছেন? প্রথমত, প্রাচীন বিজ্ঞানীদের কাছে প্রাকৃতিক বস্তুর পাঞ্চভৌতিক উপাদান বুঝবার একমাত্র নিদর্শক হল তার 'গুণ'। এই গুণ দুরকমের হতে পারে। একটা নেহাতই বাহাগুণ, যার ইতর বিশেষে বস্তুটির পাঞ্চভৌতিক উপাদানে বিশেষ তারতম্য হয় না। অর্থাৎ গুণটির সাথে পাঞ্চভৌতিক উপাদানের সম্পর্ক মূলতঃ বাহ্যিক। আর একটা হল, দ্রব্যটির সাথে গুণের সম্পর্ক এমনই অবিচ্ছেদ্য যে, কখনওই তার ইতর বিশেষ সম্ভব নয়। এ ধরনের সম্পর্ককে সমবায় আখ্যা দেওয়া হয়েছে। দ্রব্যের সাথে সমবায় সম্পর্কে আবদ্ধ গুণই বস্তুকে বোঝার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক।

তাহলে বৈশেষিক দর্শনে আলোচিত ষট্ পদার্থের মধ্যে পাওয়া গেল – 'সামান্য', 'বিশেষ', 'দ্রব্য', 'গুণ' ও 'সমবায়'। বৈশেষিক দর্শনে আলোচিত এই পাঁচটি পদার্থের ব্যাখ্যা যতই আলাদা হোক না কেন, পদার্থগুলোকে বুঝবার প্রথম অঙ্কুর আয়ুর্বেদের আকরগ্রন্থে পাওয়া যায়। বাকি থাকে 'কর্ম'। 'কর্ম' কথাটির সাথে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যাকে যাচাই করা বোঝায়, তার সম্পর্ক রয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পক্ষে দ্রব্য ও গুণের আলোচনা নিছক দার্শনিক কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য হতে পারে না। শরীরের অভ্যন্তরে এই দ্রব্যের পরিণামে রোগমুক্তি হচ্ছে কিনা, তা খোঁজার চেষ্টাই চিকিৎসা-বিজ্ঞানের ন্যূনতম উদ্দেশ্য। অর্থাৎ শরীরের উপর দ্রব্যের প্রভাব বা কর্মই তাদের বিশেষ জিজ্ঞাস্য। তাই কর্মের আলোচনাও প্রাসঙ্গিক।

এইভাবে বৈশেষিক দর্শনের ছটি পদার্থই চিকিৎসা বিজ্ঞানের পক্ষে প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হতে পারে। এই কারণে আয়ুর্বেদের সংক্ষিপ্তসার হিসেবে ভরদ্বাজের বিবৃতি অবান্তর বলে মনে হয় না। অবশ্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে ছয় পদার্থের যে আলোচনা তার সঙ্গে দার্শনিক মত হিসেবে বৈশেষিকদের আলোচনা হুবহু এক নয়। তা হওয়ার কথাও নয়। তবু পাশাপাশি এই দুই মতের মধ্যে সাদৃশ্য তাৎপর্যপূর্ণ। অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত যদি আয়ুর্বেদের মধ্যেই ন্যায়-দর্শনের আদিরূপ অনুসন্ধান করে থাকেন, তাহলে ন্যায় ও বৈশেষিকের মধ্যে নিবিড় সম্পর্কের কথা মনে রেখে বৈশেষিকের প্রথম সূত্রপাত আয়ুর্বেদ ছাড়া অন্য কোথাও খোঁজার চেষ্টা কি সঙ্গত হবে?

চরক সংহিতায় যুক্তিবিদ্যা বা তর্কবিদ্যার উপস্থিতির কথা আগেই আলোচনা করেছি। এতে অনেকগুলি বিতর্কসভার বিবরণ পাওয়া যায়। একই বিষয়ে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। সাধারণতঃ সেগুলিকে পর্যালোচনা করে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রধান প্রবক্তা আত্রেয়-সংহিতা সম্মত মূল বক্তব্যের উল্লেখ করেছেন।

চৈত্ররথ বনে আয়োজিত এরকম একটি বিতর্কসভায় আলোচনা শেষে গ্রহণ যোগ্য মত হিসেবে আত্রেয় বলছেন (1/26/10): এই শাস্ত্র (অর্থাৎ আয়ুর্বেদ) মতে সমস্ত দ্রব্যই পাঞ্চভৌতিক (পঞ্চভূত দিয়ে গড়া), তার মধ্যে কোনওটা বা চেতনাযুক্ত, কোনওটা অচেতন – ‘সর্বং দ্রব্যং পাঞ্চভৌতিকম্ অস্মিন্ অর্থে; তৎ চেতনাবৎ অচেতনং চ।’ অর্থাৎ আয়ুর্বেদ মতে সবকিছুরই উপাদান বলতে পঞ্চভূত, তার কোনওটা বা চেতনাযুক্ত, আর কোনওটা বা অচেতন।

কথাটা কার মতো শোনাচ্ছে? অবশ্যই বস্তুবাদীদের মতো। মনে হবে চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনের কথাই। কিন্তু একটু তফাৎ আছে। চার্বাক মতে সাধারণত চতুর্ভুতের কথা বলা হয়- মাটি, জল, আগুন এবং বাতাস। আকাশ বলে পঞ্চম ভূতটির কথা সাধারণতঃ চার্বাক মতে আলোচিত হয় না।

তাহলেও এই কারণে আয়ুর্বেদ সম্মত মতকে বস্তুবাদ-বহির্ভূত ভাবার কোনও কারণ নেই। কারণ এখানে আকাশকেও ভূতবস্তু হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, চার্বাক মতে চতুর্ভুতেরই কোনও একরকম বিশিষ্ট পরিণামের ফলে চেতনার উৎপত্তি হয় – গুড়, কিন্তু প্রভৃতির বিশিষ্ট পরিণামের ফলে মদশক্তি উৎপন্ন হওয়ার মতো।

যদিও আয়ুর্বেদে চেতনার উৎপত্তি প্রসঙ্গে একথা বলা নেই, কিন্তু যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তাকে বস্তুবাদ সম্মতই বলতে হবে। আয়ুর্বেদ মতে চেতন এবং অচেতন পদার্থের মধ্যে পার্থক্য কী? উত্তরে বলা হয়েছে চেতন-দ্রব্যের বৈশিষ্ট্য হল ইন্দ্রিয়ের বর্তমানতা, অচেতন অর্থে ইন্দ্রিয়ের অভাব- 'সেন্দ্রিয়ং চেতনং দ্রব্যং; গিরিন্দ্রিয়ম্ অচেতনম্' (1/1/48)। আয়ুর্বেদ মতে এই ইন্দ্রিয়গুলিও পঞ্চভূত থেকে উৎপন্ন। তাই এই চিন্তাকে বস্তুবাদী চিন্তা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে?

সুশ্রুত-সংহিতাতেও বস্তুবাদের প্রতি আনুগত্য সুস্পষ্ট ভাবেস্বীকৃত। যেমন, সুশ্রুত-সংহিতায় স্পষ্টই বলা হয়েছে (3/1/17): 'ভূতেভ্যঃ হি পরং যম্মাৎ নাস্তি চিন্তা চিকিৎসিতে।' সোজা কথায় ভূতবাদ বা বস্তুবাদ বাদ দিয়ে চিকিৎসা সম্ভব নয়।

আর এক দিক থেকে আয়ুর্বেদে বস্তুবাদের প্রভাব প্রমাণ করা যায়। ভাববাদী চিন্তার মূল আধার হল, অনুমান-প্রমাণ, যার সাথে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। আর বস্তুবাদী চিন্তার মূল আধার হল প্রত্যক্ষ লব্ধ জ্ঞান। চরকসংহিতায় কোন ধরনের প্রমাণের উপর নির্ভরতা (1) 27/3)- সবরকম সাক্ষ্যের মধ্যে প্রত্যক্ষ লব্ধ সাক্ষ্যই সবচেয়ে মূল্যবান। ওষুধ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: 'সম্যক উপদিশামঃ, সম্যক পশ্যামঃ চ ইতি' (3/3/36)। অর্থাৎ সম্যকভাবে চোখে দেখার উপরই আমাদের সম্যক উপদেশ। যেমন, চিকিৎসকরা চোখে দেখেছেন, আমাশয় প্রভৃতি ঘন ঘন মলত্যাগের চিকিৎসায় মলত্যাগ রোধের জন্য অন্বষ্ঠ জাতীয় ফল বিশেষ উপযোগী। এক্ষেত্রে কেউ যদি হাজারো তর্ক করে প্রমাণ করতে চান যে, অন্বষ্ঠ জাতীয় ফল মলত্যাগের উপযোগী তাহলে তাঁর কথায় কান দেওয়ার প্রয়োজন নেই, (1/40/12-13)

তাহলে কি প্রাচীন চিকিৎসকরা অনুমান প্রমাণের মূল্য পুরোপুরি অস্বীকার করতে চেয়েছেন? না, সে কথা মনে করারও কোনও কারণ নেই। রোগ নির্ণয় প্রভৃতি প্রসঙ্গে তাঁরা অবশ্যই নানাভাবে অনুমান লব্ধ জ্ঞানের উপর যথাযথ এবং যুক্তিযুক্তভাবে নির্ভর করেছেন। কিন্তু সেই অনুমানের অনিবার্য শর্ত হল, সেই অনুমান পূর্ব-প্রত্যক্ষ কোনও জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। যেমন, ধোঁয়া চোখে দেখছি, কিন্তু আগুন দেখছি না। এক্ষেত্রে ধোঁয়া থেকেই আগুন অনুমান করা যায়। কারণ আগে দেখেছি, আগুন ছাড়া ধোঁয়া সম্ভবই নয়। বর্তমান বীজ থেকে আমরা ভবিষ্যৎ ফল উৎপত্তি অনুমান করতে পারি। কারণ বহু দৃষ্টান্ত থেকে আমরা জানি, বীজ থেকেই ফল হয়। তাই চরক সংহিতায় অনুমান প্রসঙ্গে বলা হয়েছে –

প্রত্যক্ষ-পূর্বং ত্রিবিধং ত্রিকালং চ অনুমীয়তে।

এবং বহ্নিঃ নিগূঢ়ঃ ধূমেন, মৈথুনং গর্ভ-দর্শনাথ।।

ব্যবস্যণ্ডী অতীতং বীজাৎ ফলম্ অনাগতম্।

দৃষ্টবা বীজাৎ ফলং জাতম ইহ এব সদৃশং বুধেঃ।। (1/11/21/22)

প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার যে, ভারতীয় যুক্তিবিদ্যার আকরগ্রন্থ ন্যায়সূত্র বাৎস্যায়ন ভাষ্যেও মূলত একই কথা পাওয়া যায়, যদিও দৃষ্টান্তগুলিতে তফাৎ আছে।

তাহলে একথা বলা কি অসঙ্গত হবে যে, আয়ুর্বেদশাস্ত্রের বিচার ধারায় চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়?

উপসংহার

এতক্ষণের আলোচনায় আমরা কী পেলাম? প্রাচীন ভারতের চিকিৎসাশাস্ত্র আয়ুর্বেদের বিকাশের ক্ষেত্রে বস্তু নির্ভর চিন্তা প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটা না হয়ে উপায়ও ছিল না, বিজ্ঞান হিসেবে যতটুকু বিকাশ ঘটেছে তা ঘটবার সুযোগ হত না। আবার একথাও সত্য। যে, চরক সংহিতা এবং সুশ্রুত সংহিতায় অধ্যাত্মবাদের অনেক কথা আছে। কিন্তু যখন রোগ নির্ণয় ও তার নিরাময়ের প্রশ্ন এসেছে, তখন তাঁরা বস্তু নির্ভর পদ্ধতির কথাই বলেছেন। তাহলে অধ্যাত্মবাদের কথা কেন? তৎকালীন সময়ে যাঁরা আইনকার এবং প্রাচীন সংস্কারের সংরক্ষক চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে তাঁদের আক্রোশের কথা আমরা আগেই দেখেছি। সেই দাপট ও আক্রোশ থেকে প্রকৃত বিজ্ঞানকে রক্ষা করার জন্য এই কৌশল তাদের নিতে হয়েছিল। তাই এই গ্রন্থদুটি উলটো পালটা কথায় ভরপুর। একদিকে বিজ্ঞান, আর একদিকে প্রতিবিজ্ঞান। তা সত্বেও চরক সংহিতাতে সুকৌশলে বলা আছে, প্রকৃত বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিবিজ্ঞানের আবর্জনাকে সনাক্ত করার পদ্ধতিটা আসলে কী? দুটি সংকলন গ্রন্থকেই এই কৌশলে বিচার করলে আমরা প্রাচীন সংকলন গ্রন্থ দুটির বৈজ্ঞানিক সারাংশ সনাক্ত করতে পারি। এই গ্রন্থ দুটির দার্শনিক ভিত্তি বিচার করলে আমরা দেখতে পাই, যে, এদেশের বস্তুবাদী দর্শনে প্রধান ধারা লোকায়ত বা চার্বাক দর্শনের সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়াও এদেশে বস্তুবাদী দর্শনের আর একটি ধারা ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনের বিচার ধারার এই গ্রন্থ দুটির বিচার ধারা খুব কাছাকাছি। অনেকে মনে করেন যে, পরবর্তীকালে ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনরূপে যার আত্মপ্রকাশ, তার প্রথম স্ফূরণ হয়েছিল আয়ুর্বেদের এই দুটি আকর গ্রন্থেই।

তথ্যসূত্র

[1] প্রাচীন ভারতে চিকিৎসাশাস্ত্র – দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

[2] বিজ্ঞানের ইতিহাস - সমরেন্দ্রনাথ সেন

[3] প্রাচীন ভারতে বস্তুবাদের চর্চা – ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি প্রকাশনা

[4] প্রাচীন ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে – দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

[5] History of Indian Philosophy - Prof. Surendranath Dasgupta.

লেখক পরিচিতি: শ্রী গৌড়ী একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞান প্রাবন্ধিক এবং ব্রেকছু সায়েন্স সোসাইটির পশ্চিমবঙ্গ কমিটির অন্যতম সহ-সভাপতি।

“আয়ুর্বেদশাস্ত্রের দার্শনিক ভিত্তি” শীর্ষক এই প্রবন্ধটি ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি প্রকাশিত ‘প্রকৃতি’ পত্রিকার চতুর্দশ বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা, জানুয়ারি 2020 থেকে নেওয়া।