বিভাগগুলি

আইনস্টাইনের মহান বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের দার্শনিক ভিত্তি

Albert Einstein, 1944.Popperfoto via Getty Images


সৌমিত্র ব্যানার্জী

আমরা অনেক সময় মনে করি বৈজ্ঞানিকরা বুঝি স্রেফ বুদ্ধির সাহায্যে প্রকৃতির রহস্যের সমাধান করেন। মনে করি, অসাধারণ বুদ্ধির সাহায্যে দুর্বোধ্য গাণিতিক গোলকধাঁধার মধ্য দিয়ে তাঁরা অজানা জগতের পথ নির্ণয় করেন। প্রবাদপ্রতিম বৈজ্ঞানিক প্রতিভাদের সম্পর্কে এমন একটি ধারণাই সাধারণের মনে গেঁথে আছে। এই কারণেই আইনস্টাইনের মতো মহান কিংবদন্তী বৈজ্ঞানিক প্রতিভা এবং তাঁর মস্তিষ্ক সম্পর্কে মানুষের প্রবল কৌতূহল রয়েছে। না জানি কোন বিশেষ উপাদানে সেই মস্তিষ্ক গঠিত। কত আলাদা ভাঁজ, কত অতিরিক্ত স্নায়ু-কোষ সেটিতে রয়েছে।

1955 সালে আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর প্যাথোলজিস্ট টমাস হার্ভে তাঁর মস্তিষ্কটি সংরক্ষণ করেন এবং বিভিন্ন অংশের নমুনা গ্রহণ করেন। মস্তিষ্ক সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ শারীরবিদেরা সেই নমুনাগুলির আকার, আকৃতি, ওজন এবং ভাঁজের গঠন সম্পর্কে বিস্তারিত তদন্ত করেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক সাধারণ মানুষের মস্তিষ্ক থেকে কোন কোন দিক থেকে পৃথক সেটা খুঁজে বার করা।

তাঁদের জন্য চরম বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। মস্তিষ্ক বিশারদেরা দেখলেন আইনস্টাইনের মাথাকে কোনও দিক থেকেই ‘অসাধারণ’ বলা যায় না। তাঁর মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশগুলি সাধারণ মানুষের মতোই এবং বৈচিত্র্য মানুষের গড় সীমার মধ্যেই।

কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব?

এই মাথাটাই তো মাত্র 26 বছর বয়সে পদার্থবিদ্যার পাঁচটি পৃথক ক্ষেত্রে মৌলিক এবং যুগান্তকারী অবদান রেখেছিল। বিজ্ঞানজগতের যে সমস্যাগুলো নিয়ে তাবড় তাবড় বৈজ্ঞানিক প্রতিভাও কোনও পথ খুঁজে পাননি এই মস্তিষ্কই তো সরল, সহজবোধ্যভাবে অভাবনীয় দৃষ্টিকোণের সাহায্যে যুক্তি উপস্থাপন করে সেই রহস্য উন্মোচনে উদ্যোগী হয়েছিল। জীবনের পরবর্তী অধ্যায়েও এই অসাধারণ চিন্তাশীল মস্তিষ্কটি পদার্থবিদ্যার হেন শাখা নেই যেখানে বিচরণ করেনি1। তবে?

ইতিহাসের কোনও পর্বেই অসাধারণ চিন্তাশীল মনীষার অভাব হয়নি। আইনস্টাইনের জীবদ্দশাতেও পৃথিবী এমন বহু বিজ্ঞানীকে পেয়েছে যাঁরা আপন আপন ক্ষেত্রে মহান অবদান রেখে গেছেন। মাখ, পঁয়েকারে, মিনকাওস্কি, প্ল্যাঙ্ক, বোর, হাইজেনবার্গ, শ্রয়েডিংগার, ফাইনম্যান, গ্যামো – এঁদের কেউই কম ধীশক্তির অধিকারী ছিলেন না। তবুও যদি আমরা পদার্থবিদ্যার জগতের দিকে তাকাই তবে অনেক পাহাড়-পর্বতের মধ্যে আমাদের চোখে পড়বে এক মাউন্ট এভারেস্টের সুউচ্চ শিখর। আইনস্টাইন মহানদের মধ্যেও মহোত্তম স্থান অধিকার করে রয়েছেন। যখন প্রতিভাবানেরা সীমাবদ্ধ গণ্ডীর মধ্যে বিচরণ করেছেন, তখন আইনস্টাইন দেখতে পেয়েছেন সমস্ত বস্তুজগতকে, তার বুনিয়াদি সমস্যাগুলিকে, নির্দেশ করেছেন সেগুলির সমাধানের পথ। এইরকম এক মহান ব্যক্তিত্বের মস্তিষ্ক অন্যদের থেকে আলাদা নয় একথা কি বিশ্বাসযোগ্য!

কিন্তু, হ্যাঁ। বিজ্ঞান ঠিক এই অবিশ্বাস্য কথাটাই বলে।

কেন বিজ্ঞান এই কথা বলে সে বিষয়ে আলোকপাত করার আগে কয়েকটি সহজ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক। আচ্ছা, কেন কেউ তাঁর মধ্যে শৈশব থেকে কৈশোর এমনকি যৌবনের প্রথম দিকের দিনগুলোয় কোনও প্রতিভার ঝলকানি দেখতে পেল না? কেন তাঁর ছাত্রজীবনে তিনি কোনও দিন প্রথম বা দ্বিতীয় হননি? আরও ঘটনা হল, কয়েক বছর বেকার হিসাবে কাটিয়ে এবং বেশ কয়েকটি অসফল ইন্টারভিউয়ের পর পেটেন্ট অফিসে সামান্য এক কেরানির চাকরি তাঁর জুটেছিল — সেটাও তাঁর এক বন্ধুর পিতার সৌজন্যে। যদি সত্যিই তিনি একজন প্রতিভাধর হন তবে তার স্বাক্ষর কেন জীবনের গোড়াতেই দেখা গেল না?

আসলে যাঁরা অসাধারণ ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বদের মধ্যে নানা দৈহিক বা শারীরিক ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের সন্ধান করেন তাঁরা প্রকৃতপক্ষে মূল বিষয়টি এড়িয়ে যান। সেটি হল, মানুষ একটি প্রক্রিয়ার ফল। কোনও মানুষের জীবন কোন খাতে বইবে, তিনি কী চিন্তা করবেন, বা তিনি কতটা ক্ষমতার অধিকারী হবেন সেটি সেই মানুষটি জীবনভর কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করেন তার ওপর নির্ভর করে। তাই আইনস্টাইনের মস্তিষ্কে ‘বিশেষ ভাঁজ’ খুঁজতে যাওয়া বাতুলতার সামিল। কোন মহান বিজ্ঞানীর আবির্ভাব কেন হল সেটা জানতে যেমন তাঁর যুগটাকে বুঝতে হবে, তেমনই আমাদের দেখতে হবে কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন।


গড়ে ওঠার বছরগুলি

আইনস্টাইনের জীবনকে কেউ যদি এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন তবে কতগুলি বিষয় তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। প্রথম যেটি তাঁকে অবাক করবে সেটি তাঁর সাদামাটা শিক্ষার্থী জীবন। কিন্তু সেই গড়পড়তা নম্বর পাওয়া ছাত্রের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল। বহু বছর পরে যখন তিনি একজন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী তখন একজন সাংবাদিক তাঁকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। আইনস্টাইন বলেছিলেন তখন থেকেই কোনও বিষয়কে নানা দিক থেকে প্রশ্ন করে নিঃসন্দেহ না হয়ে তিনি সত্য বলে গ্রহণ করতেন না। কিন্তু তাঁর ছাত্রজীবনে জার্মানির শিক্ষাব্যবস্থা ছিল অনেকটা ‘মিলিটারি কমাণ্ড’-এর মতো। বইতে যেটা লেখা আছে সেটা চোখ বুজে মেনে নাও, কোনও বেমক্কা প্রশ্ন করো না। একজনকে শুধু সেগুলো পড়তে হবে, মুখস্থ করতে হবে, বারবার অভ্যাস করতে হবে, আর পরীক্ষার খাতায় উগরে দিতে হবে। আইনস্টাইনের মন সেখানে সবকিছুকে প্রশ্ন করে বুঝতে চায়, যা শেখানো হচ্ছে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার না করে মেনে নিতে পারে না। সেজন্য শিক্ষকরা অনেকেই এই ছাত্রটিকে পছন্দ করতেন না, আবার আইনস্টাইনেরও সেই ‘তোতাকাহিনী’র শিক্ষাব্যবস্থা না-পসন্দ ছিল²।

আমরা খুবই ভাগ্যবান যে তিনি গ্রেড, নম্বর এসবের প্রতি গুরুত্ব দেননি। তা না হলে এক মহান বৈজ্ঞানিক মনের হয়ত জন্মই হত না।

বিদ্যালয়-জীবনের পর যখন তিনি কলেজে এবং উচ্চতর শিক্ষাজীবনে প্রবেশ করলেন তখন তিনি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সেটি হল বৈজ্ঞানিক গবেষণা করার জন্য সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বেছে নেওয়া। বিষয়টি একটু খোলসা করা যাক।

আমরা সকলেই চিন্তার উপাদান পাই আমাদের আশেপাশের সমাজ তথা পরিবেশ থেকে। ভাল, মন্দ, ঠিক, বেঠিক- সব ধরনের বোধই এভাবে আমাদের মধ্যে সামাজিক সূত্রে বিকশিত হয়। বইপত্র পড়া, টিভি দেখা, গান শোনা, সিনেমা দেখা, খবরের কাগজ পড়া, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, রাস্তার লোকজনের সাথে কথাবার্তা এসবের মাধ্যমে আমরা অন্যদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচিত হই। এই মত বিনিময়, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের নিজেদের মন, দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন চিন্তাভাবনার সংঘাতের আবর্তে আমাদের মধ্যেও নিজস্ব মনন তৈরি হয়। কোনও চিন্তাকে আমরা গ্রহণ করি, কোনও চিন্তাকে বর্জন করি; আর এভাবেই আমরা হয়ত নিজেদের অজান্তেই সমাজে নিজেদের অবস্থান স্থির করে ফেলি। মনস্তত্ববিদ্যার এই ধারণাকে বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তাবিদ শিবদাস ঘোষ সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন “ব্যক্তিচিন্তা সামাজিক চিন্তারই বিশেষীকৃত প্রকাশ3।”

কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে অসচেতনভাবেই সেই প্রকাশ ঘটে। যখন কেউ বলেন এটা আমার নিজের চিন্তা, নিজের মত, নিজের ব্যক্তিগত বিষয়—তখন তিনি আসলে সমাজে পরস্পরবিরোধী সেই চিন্তাগুলির কোনও একটির পক্ষই অবলম্বন করেন—নিজস্বতা যদি কিছু থাকে তবে কেবলমাত্র সেটি তাঁর প্রকাশ করার ঢংয়ে। কিন্তু চিন্তার উপাদানগুলি অবশ্যম্ভাবীভাবে সমাজ থেকে পাওয়া।

সেজন্য সকল মহান মানুষেরাই তাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা গড়ে তোলেন সচেতনভাবে। সমাজে বিদ্যমান ভাল, খারাপ, সঠিক, বেঠিক, বিভ্রান্তিকর, হানিকারক, জলজ্যান্ত ভুল – এরকম নানা চিন্তার মধ্য থেকে সমাজের পক্ষে উপকারী সঠিক চিন্তা কোনটা সেটা সচেতনভাবে চেনার চেষ্টা করেন। তারপর তাঁরা সেই পথে হাঁটা শুরু করেন, সেভাবে ভাবতে চেষ্টা করেন, চেষ্টা করেন সঠিক চিন্তাপদ্ধতিটিকে নিজের স্বাভাবিক চিন্তা প্রক্রিয়ায় পরিণত করতে। তাঁরা যে চিন্তাগুলি ভুল তাকে চিনে সেগুলিকে নিজস্ব চিন্তার ক্ষেত্র থেকে সচেতনভাবে বর্জন করেন।

বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে সেটা কীভাবে ঘটে?

যখন কোনও বিজ্ঞানী গবেষণা করেন তখন আসলে তিনি কী করেন? তিনি প্রকৃতপক্ষে বস্তুজগতের কোনও এক বিশেষ ক্ষেত্র সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছেন এবং সেই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজছেন। সেই বিষয় সম্পর্কে সত্যানুসন্ধান করেছেন। কিন্তু কী করে কোনও প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয়, সত্যের প্রকৃত রূপ কী, সত্য মিথ্যার মধ্যে প্রভেদ কী করে নির্ণয় করতে হয়—সে সব সম্পর্কে সমাজে পরস্পরবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। সকল বিজ্ঞানীকেই এই প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজস্ব অবস্থান গ্রহণ করতে হয়। তাঁকে নির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করতে হয় এবং তার জন্য গ্রহণ করতে হয় সুনির্দিষ্ট বিচারপদ্ধতি। এছাড়া কেউ এক পাও এগোতে পারে না। বিজ্ঞানের জগতের বেশিরভাগ পথিকই এই কাজটা নিজের অজান্তে করেন; তাঁরা জানেনই না যে আসলে তাঁরা সমাজে বিদ্যমান পরস্পরবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কোনও একটাকে বেছে নিয়েছেন। যদি তিনি একটি ভুল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলেন তবে তাঁর গবেষণার ফলাফলের সাফল্য-ব্যর্থতাকে সেটি প্রভাবিত করবেই।

শুরুর বছরগুলিতে আইনস্টাইন যে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেন তা হল তৎকালীন বিভিন্ন চিন্তার ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য থেকে ভুল চিন্তাগুলিকে বাতিল করা, সঠিক চিন্তাপ্রক্রিয়াকে গ্রহণ করা, আত্মস্থ করা এবং তাকে অনুশীলনের মাধ্যমে অভ্যাসে পরিণত করা। বৈজ্ঞানিক চিন্তার প্রেক্ষিতে একবার নিজের অবস্থান ঠিক করে নেওয়ার পর তাঁর বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের সম্পূর্ণ জীবনে কখনও তিনি সেখান থেকে সরে আসেননি।

এই গুরুত্বপূর্ণ কর্ম সমাধা করতে আইনস্টাইন এবং তাঁর বন্ধু মরিস সলোভিন ও কনরাড হ্যাবিক্ট ‘অলিম্পিয়া অ্যাকাডেমি’ নামে একটি সায়েন্স ক্লাব তৈরি করেছিলেন2’4। ওই ক্লাবের সাপ্তাহিক বৈঠকগুলিতে আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল বিজ্ঞানের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি। সলোভিনের একটি স্মৃতিচারণা থেকে আজ আমরা জানি তাদের সেই বৈঠকে গ্রুপ-রিডিং হত এবং সেই যৌথ পাঠে জন স্টুয়ার্ট মিলের A System of Logic, রিচার্ড অ্যাভেনারিয়াসের Critique of Pure Experience, ডেভিড হিউমের A Treatise of Human Nature, আর্নেস্ট মাখের The Analysis of Sensations and the Relation of the Physical to the Psychical, কার্ল পিয়ারসনের The Grammar of Science এবং হেনরি পঁয়েকারের Science and Hypothesis প্রভৃতি বই পড়া হত। তাঁরা এই দার্শনিক চিন্তাগুলি তর্কবিতর্কের মাধ্যমে যাচাই করতেন। দর্শনের আলোকে বিজ্ঞানের জগতের নতুন অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হত। এই আলোচনাগুলি আইনস্টাইনকে বিজ্ঞানের জগতে প্রাসঙ্গিক দার্শনিক চিন্তাগুলির ঘাত প্রতিঘাতের সঙ্গে পরিচিত করায় এবং তাঁকে নিজ দার্শনিক অবস্থান গ্রহণ করতে সাহায্য করে।

দার্শনিক চিন্তার সঙ্গে অবশ্য এই তাঁর প্রথম পরিচয় নয়, 16 বছর বয়সের মধ্যেই তিনি ইমানুয়েল কান্টের প্রধান কাজগুলি যেমন Critique of Pure Reason, Critique of Practical Reason, এবং Critique of Judgement পড়ে ফেলেছিলেন। যখন তিনি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন, তখন অধ্যয়ন করছেন আর্নেস্ট মাখের দার্শনিক চিন্তা সম্বলিত বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ Mechanics এবং Principles of the Theory of Heat, ফার্দিনান্দ রোজেনবার্গারের Isaac Newtown and His Physical Principles ও ফ্রেডরিখ আলবার্ট লেঞ্জের History of Materialism। তৎকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে যে-সকল ছাত্রছাত্রীরা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করত তাদের বিজ্ঞানের দর্শন সম্পর্কে কিছু ধারণা থাকা ছিল বাধ্যতামূলক এবং আইনস্টাইন যে 1897 সালে শীতকালীন সেশনে “Theory of Scientific Thought” কোর্সে নাম লিখিয়েছিলেন সেই রেকর্ডও আছে। কিন্তু মনে হয়, বিজ্ঞানের জগতে তিনি কোন পক্ষ অবলম্বন করবেন ‘অলিম্পিয়া অ্যাকাডেমি’র পর্বেই তিনি সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।


দার্শনিক বিতর্কগুলি

আইনস্টাইন ‘কোন পক্ষ অবলম্বন’ করেছিলেন সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে দেখে নেওয়া দরকার তাঁর গড়ে ওঠার বছরগুলিতে বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়কে কোন দার্শনিক চিন্তাগুলি প্রভাবিত করেছিল।

এটা আমরা জানি যে আদিম মানুষের চিন্তা ছিল প্রকৃতিকেন্দ্রিক। বস্তুজগতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগবিহীন কোনও কিছু সম্পর্কে তারা চিন্তা করতে পারত না। তারপর, সামাজিক বিবর্তনের বিকাশের সাথে সাথে মানুষের দার্শনিক বীক্ষা দুটি বৃহৎ শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেল – ভাববাদ এবং বস্তুবাদ। এদের মধ্যে প্রথমটিই মধ্যযুগে প্রধান ধারা রূপে অবস্থান করছিল। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের বিচারপদ্ধতি আসার আগে পর্যন্ত দুই শিবিরই কোনও প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে, সত্যকে জানতে চাইত ব্যক্তিগত চিন্তার ওপর নির্ভর করে। সামনে যে প্রশ্নটি রয়েছে গভীরভাবে সে সম্পর্কে ভেবে ব্যক্তির আত্মোপলব্ধিই ছিল সত্য জানার সেদিনের পন্থা। তার কাছে সেটাই সত্য। জ্ঞানী, সাধু, সন্তরা যা উপলব্ধি করেছেন, যে মত প্রচার করেছেন সাধারণ মানুষ সেটাই অনুসরণ করত। যদি দুইজন জ্ঞানী ব্যক্তি কোনও প্রশ্নে ভিন্ন মতে উপনীত হতেন, তবে তাঁদের নিজস্ব শিষ্য বা অনুচরবাহিনী গড়ে উঠত যারা আবার নিজ গুরুর মতবাদকে প্রশ্নাতীত সত্য বলে মনে করত। প্রাচীন ও মধ্যযুগের চিন্তাবিদ তথা মানুষের চিন্তাপদ্ধতিটি এইরকমই ছিল—যাকে আজ আমরা বলি “মনগড়া চিন্তা” বা subjective thought process।

চতুর্দশ এবং পঞ্চদশ শতাব্দীতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোয় যে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আসে সেগুলিই সামাজিক ভাবনা ধারণায় পরিবর্তন এনেছিল, ‘নবজাগরণ’ বা রেনেসাঁস নামে যা সুপরিচিত। এর ফলে প্রাকৃতিক ঘটনাবলীকে নতুনভাবে বিচার করার আগ্রহ তৈরি হল এবং বস্তুজগত সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে বদল এল। মানুষের চিন্তাপদ্ধতি পরিবর্তনের সব থেকে পরিপূর্ণ এবং দৃপ্ত প্রকাশ ঘটল গ্যালিলিও গ্যালিলেইয়ের মধ্য দিয়ে যাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, অনুসন্ধান-প্রক্রিয়া এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পদ্ধতি তৎকালীন সময়ের সমাজমননের বৈপ্লবিক রূপটিরই প্রকাশ।

গ্যালিলিওই মনগড়া চিন্তাপ্রক্রিয়ার ভিত্তিমূলে আঘাত হানেন। তিনি দেখালেন অ্যারিস্টটলের মতো বিদ্বান মানুষ, যাঁর মতবাদ দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রশ্নাতীত সত্য বলে মেনে নেওয়া হয়েছে তাকেও পরীক্ষার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে এবং উত্তীর্ণ হতে হবে। ভারী বস্তু হালকা বস্তুর থেকে আগে মাটিতে পড়ে—অ্যারিস্টটলের এই সিদ্ধান্তকে ভুল প্রমাণিত করতে গ্যালিলিও পিসার হেলানো মিনার থেকে দুটি ভিন্ন ওজনের ধাতব বল ফেলে যে পরীক্ষা করেন সেটি বিজ্ঞানের লোককথায় পরিণত হয়েছে। তাঁর এই পরীক্ষার সারবত্তা হল সত্য জানতে হবে প্রকৃতি থেকেই, মনগড়া ভাবনা থেকে নয়।

এর মাধ্যমে তিনি একটি নতুন পদ্ধতি সৃষ্টি করলেন যাকে বলা হয় বস্তুনিষ্ঠ বা objective চিন্তাপদ্ধতি। ধীরে ধীরে, বৈজ্ঞানিকদের কঠোর পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে এই পদ্ধতি বিজ্ঞানের দুনিয়ায় সুপ্রতিষ্ঠিত হল। কোনও বৈজ্ঞানিক তত্ত্বই পরীক্ষা-পর্যবেক্ষনের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ না হয়ে গৃহীত হবে না এই পদ্ধতি স্বীকৃতি পেল। তখন থেকেই যে কোনও বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টার ভিত্তি হিসাবে বস্তুনিষ্ঠ পদ্ধতিকেই মেনে নেওয়া হয়েছে।

কিন্তু মনগড়া চিন্তাপদ্ধতি কি চিরতরে বিদায় নিল? তার গোড়া শুদ্ধ উপড়ে ফেলা গেল? সেটা দূর অস্ত! অতীতের রেশ হিসাবে সেই মনগড়া চিন্তাপদ্ধতি কিন্তু থেকেই গেল এবং বহু বিজ্ঞানীর চিন্তাভাবনায় এবং প্রকাশের মধ্যে তার প্রতিফলন দেখা যেতে লাগল। এমনকি আজও আমরা দেখতে পাই অনেক বিজ্ঞানীই বিজ্ঞানের প্রত্যক্ষ ক্ষেত্রের বাইরে বিভিন্ন বিষয়ে কাল্পনিক ও অবৈজ্ঞানিক ধারণা প্রকাশ করে চলেছেন।

আইনস্টাইনের সময়েও মনগড়া এবং বস্তুনিষ্ঠ এই দুই চিন্তাধারার মধ্যে সংগ্রাম ছিল। যুবক আইনস্টাইনকে নিজের বিজ্ঞান-সাধনার জন্য এই দুই ধারার মধ্যে সঠিক ধারাকে বেছে নিতে হয়েছিল। তিনি দৃঢ়ভাবে বস্তুনিষ্ঠ চিন্তাপদ্ধতির পক্ষ গ্রহণ করেছিলেন। তাই তাঁর সব তত্ত্বের মূলে রয়েছে বস্তুনিষ্ঠতার সন্ধান। শুধু তাই নয়, কোনও বৈজ্ঞানিক আলোচনায় মনগড়া চিন্তার সুপ্ত চিহ্নকেও তিনি চিনতে শিখেছিলেন এবং নিজের মন থেকে তাকে সচেতনভাবে দূর করতে পেরেছিলেন।

কিন্তু সঠিক পথ নির্বাচন করার সমস্যা এখানেই সমাপ্ত হয়ে যায়নি। বস্তুনিষ্ঠ চিন্তাপদ্ধতি নিয়ে চলেন বলে যাঁরা নিজেদের দাবি করেন তাঁদের মধ্যেও প্রবল মতপার্থক্য ছিল। আইনস্টাইন নিজে যখন ছাত্র তখন বিজ্ঞানমহলে প্রত্যক্ষবাদ (positivism) নামে একটি চিন্তা খুবই প্রভাব বিস্তার করেছিল। অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক আর্নেস্ট মাখ ছিলেন এই মতবাদের একজন প্রখ্যাত প্রবক্তা। প্রত্যক্ষবাদীরা মনে করতেন কেবলমাত্র ‘প্রত্যক্ষযোগ্য’ বিষয় নিয়েই বিজ্ঞানের ভাবা উচিত, কেননা যা ‘প্রত্যক্ষ’ করা যায় না তা বাস্তব (real) নয়। জ্ঞানসাধনাকে মনগড়া কল্পনার হাত থেকে মুক্ত করতে তাঁরা এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে এই মতবাদকে সঠিক বলেই মনে হবে। যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন ডাইনীরা কি ঝাঁটায় চড়ে উড়ে যেতে পারে, তবে তাকে পালটা প্রশ্ন করা যায়—“তুমি কি কখনও এরকম কিছু দেখেছ? কেউ কি দেখেছে? যদি না দেখ তবে তোমায় বুঝতে হবে ডাইনীদের অস্তিত্ব নেই এবং ঝাঁটায় চড়ে কেউ উড়ে যেতে পারে না।”

কিন্তু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গল্পটা অন্যরকম হবে। পাঠকরা নিশ্চয়ই স্কুলজীবনে ডালটনের পারমাণবিক তত্ত্ব পড়েছেন। ডালটন বলেছিলেন যদি আমরা এক খণ্ড বস্তুকে ক্রমাগত ভেঙে যেতে থাকি তবে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর টুকরো পাব এবং এক সময় আসবে যখন বস্তুর এমন এক ক্ষুদ্র অংশ পাব যাকে আর ছোট করা যাচ্ছে না। একে তিনি বললেন পরমাণু এবং বললেন দুনিয়ায় অল্প কয়েকটি জাতেরই পরমাণু আছে (ডালটনের সময়ে অণু ও পরমাণুর মধ্যে পার্থক্য জানা ছিল না)। এই তত্ত্ব রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া বুঝতে, বিশেষত কেন রাসায়নিক পদার্থগুলি সর্বদা একটা নির্দিষ্ট অনুপাতে বিক্রিয়ায় অংশ নেয় তার কারণ বুঝতে রসায়নবিদদের প্রভূত সাহায্য করেছিল। এই কারণে রসায়নবিদেরা বাস্তব প্রয়োজন থেকেই এই তত্ত্ব ব্যবহার শুরু করেন।

কিন্তু অধিকাংশ পদার্থবিদরা অণু, পরমাণুর অস্তিত্ব মেনে নেননি। একজন প্রত্যক্ষবাদীর দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁরা প্রশ্ন করেন, তোমরা কি কখনও অণু বা পরমাণু দেখেছ? কেউ কখন দেখেছ? তা যদি না হয় তবে অণু, পরমাণুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। এটা কি সত্যি যে অণুর ধারণা রসায়নবিদদের গণনায় সাহায্য করে; কিন্তু ওই ধারণাকে একটি কাল্পনিক সহায়ক প্রকল্পের থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া ঠিক হবে না। প্রত্যক্ষবাদীদের ভাবনা ছিল এইরকমই।

পদার্থবিদদের একটি ছোট দল যাঁরা অণু ও পরমাণুর অস্তিত্বকে সত্য ধরে নিজ নিজ গবেষণা করছিলেন এবং তত্ত্ব দাঁড় করাচ্ছিলেন, তাঁরা প্রত্যক্ষবাদীদের ভয়ংকর বিরোধের মুখে পড়েছিলেন। লুডভিগ বোলৎজম্যানের কথাই ধরা যাক। কোনও গ্যাসীয় পদার্থ উচ্চ গতিসম্পন্ন নিরন্তর এলোমেলোভাবে ছুটে চলা অগনিত অণুর সমষ্টি বলে তিনি ধরে নিয়েছিলেন এবং তার নিরিখে অণুর গড় গতির ভিত্তিতে গ্যাসের চাপ, আয়তন ও তাপমাত্রার মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। এইভাবে তিনি পরিসংখ্যানিক গতিবিদ্যার (Statistical Mechanics) ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। সম্ভাবতা সূত্রের (Theory of Probablity) সাহায্যে তিনি এনট্রপির ধারণার ব্যাখ্যাও করেছিলেন। পদার্থবিদ্যার জগতে পরবর্তী অগ্রগতির পিছনে এই কাজগুলি দিকনির্দেশকারী ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু বোলৎজম্যানের জীবিতকালে পদার্থবিদেরা তাঁর মতবাদ গ্রহণ করেননি। কিন্তু কেন? কেননা অণুকে কল্পনা বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। বোলৎজম্যান তাঁর তত্ত্বকে প্রত্যক্ষ করা যায় না এমন কিছুর উপর দাঁড় করানোর ‘ভুল’ করেছিলেন। বৃদ্ধ বিজ্ঞানী তাঁর তত্ত্বের প্রত্যাখান দেখে এতটাই মুষড়ে পড়েছিলেন যে হতাশায় তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। আইনস্টাইনের গড়ে ওঠার বছরগুলিতে পদার্থবিদের ওপর প্রত্যক্ষবাদের এতটাই প্রভাব ছিল।

অন্যদিকে, মধ্যযুগে যে বস্তুবাদী ধারা অবহেলিত হয়েছিল, গ্যালিলিওর সময় থেকে তারও যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে। বস্তুবাদীরা মনে করেন এই মহাবিশ্ব বস্তু দ্বারা গঠিত, বস্তু আমাদের চেতনা-নিরপেক্ষভাবেই অবস্থান করে এবং এই বস্তুজগতে বস্তুর ঊর্ধ্বে (supra-matter) কিছু নেই (দার্শনিক পরিধিতে বস্তু বলতে ভর, শক্তি এবং বিকিরণ – যা কিছু চেতনা নিরপেক্ষভাবে অবস্থান করে – সবটাকেই বোঝায়)। বিজ্ঞান যে বিবিধ ঘটনা (phenomena) তদন্ত করে তা প্রকৃতপক্ষে গতিময় বস্তুর গতিরই বিভিন্ন রূপ। সেই কারণে বস্তুর ধর্ম এবং তার বিভিন্ন রূপের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই সকল সত্য পাওয়া যাবে।

প্রত্যক্ষবাদীদের সঙ্গে বস্তুবাদীদের তীব্র পার্থক্যর বিষয় ছিল, যেখানে প্রথম দল প্রত্যক্ষযোগ্য নয় এমন কোনও কিছুকে বাস্তব বলে মনে করতেন না, সেখানে দ্বিতীয় দলের মতে যেহেতু বস্তু আমাদের চেতনা-নিরপেক্ষ তাই আমরা কোনও বিশেষ বস্তুকে দেখতে পাচ্ছি কিনা তার ওপর তার অস্তিত্ব নির্ভর করে না। কোনও ঘটনার সম্পর্কে জানতে বা সত্য ধারণা পেতে বস্তুবাদীরা প্রথমে একটি তত্ত্ব নির্মাণ করেন এবং তারপর পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে তাঁরা সেই তত্ত্বের সপ্রামাণিক প্রতিষ্ঠা করেন, অর্থাৎ তত্ত্বের বস্তুনিষ্ঠতা (objectivity) যাচাই করেন।

আইনস্টাইন পরে বলেছিলেন জীবনের প্রথম দিকে তিনি প্রত্যক্ষবাদের দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এবং পরবর্তীকালে যখন তাঁর বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের জন্য সচেতনভাবে সঠিক দর্শনের অনুসন্ধান করছিলেন তখন তিনি বুঝতে পারেন প্রত্যক্ষবাদ বা অভিজ্ঞতাবাদ সত্যানুসন্ধানের সঠিক পথনির্দেশ দিতে পারে না। তখন থেকেই তিনি বস্তুবাদকে পথনির্দেশকারী দর্শন হিসাবে গ্রহণ করেন।

ধর্ম সম্পর্কে তাঁর কিছু মন্তব্যের উল্লেখ করে তিনি সত্যিই বস্তুবাদী দর্শন গ্রহণ করেছিলেন কিনা সেই বিষয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন। যদি কেউ সত্যই এই প্রশ্নের উত্তর গভীরভাবে সন্ধান করেন তবে দেখতে পারেন সেই সমস্ত মন্তব্যই জার্মানিতে ফ্যাসিবাদ আসার আগে করা। ফ্যাসিবাদের চেহারা দেখার পর তাঁর এই ধরনের কোনও মন্তব্য আর খুঁজে পাওয়া যায় না। উপরন্তু আইনস্টাইনের মতে, স্পিনোজার ঈশ্বরই তাঁর ঈশ্বর—আর স্পিনোজা বস্তুজগতকে, তার সর্বব্যাপী নিয়মকেই ঈশ্বর বলে চিহ্নিত করেছেন5। সেই ঈশ্বরের ধারণা ধর্মীয় মতবাদের ঈশ্বরের ধারণা থেকে একেবারেই আলাদা। ধর্মের ঈশ্বর পুণ্যবানদের পুরস্কৃত করেন এবং পাপীদের শাস্তি দেন- যাকে আইনস্টাইন ‘ব্যক্তিগত ঈশ্বর’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন – তাতে কোনও বিশ্বাসই তাঁর ছিল না। আসলে আইনস্টাইন যেমন তাঁর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী রূপে বস্তুবাদকে চিন্তার জগতে গ্রহণ করেছিলেন (যেটা আমরা একটু পরেই দেখতে পাব), তেমনই ধর্মের প্রতি প্যানথেইস্ট (pantheist) বা সর্বেশ্বরবাদী মনোভাবের সঙ্গেও তিনি ছেদ ঘটাতে পারেননি। তবে বিজ্ঞান গবেষণায় বস্তুনিষ্ঠ সত্যতার এবং কার্যকারণবাদের প্রতি তাঁর অদম্য পক্ষপাতিত্ব কিন্তু দর্শনের বস্তুবাদী ধারার সঙ্গে সম্পূর্ণ তাল মিলিয়ে চলেছে।


অণুর বাস্তবতা

এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তিনি অণুর বিষয়টিকে দেখেছিলেন। তিনি যুক্তি করলেন, যদি অণু, পরমাণু সত্যিই থাকে তবে তার অস্তিত্ব আমাদের চেতনার ওপর নির্ভর করে না, এবং তাই তাদের পর্যবেক্ষণ করতে আমরা পারছি কিনা তার উপরেও তাদের থাকা না থাকা নির্ভর করে না। কিন্তু যদি তারা থাকে এবং তাদের সম্পর্কে আমাদের তত্ত্ব সঠিক হয়, তবে তাদের অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটে এমন কোনও পরীক্ষা বা পদ্ধতি আমাদের বার করতে হবে।

অনেকেই জানেন না যে আইনস্টাইনের প্রথম বৈজ্ঞানিক কাজ এই বিষয় নিয়েই ছিল। বিভিন্ন দিক থেকে অণুর বাস্তবতা প্রমাণ করতে তিনি প্রায় আধ ডজন গবেষণাপত্র লিখেছিলেন যার মধ্যে দুটি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।

একটি জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে 1905 সালের 20 জুলাই জমা দেওয়া “A new determi- nation of molecular dimensions” শীর্ষক তাঁর পিএইচডি থিসিস’। অণুর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে এক নতুন ধরনের যুক্তিধারা এই থিসিসে তিনি পেশ করেছিলেন। তিনি যুক্তি দেখালেন যদি অণুর অস্তিত্ব থাকে তবে যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন তার নিশ্চয়ই মাত্রা (dimension) অর্থাৎ আকার আছে। প্রশ্ন এটাই, সেই মাত্রা কি পরিমাপ করা যায়? অবশ্য আমরা সরাসরি অণুকে পরিমাপ করতে পারি না এবং তাই প্রচলিত পরিমাণ-পদ্ধতি এক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে কিনা। কিন্তু পরোক্ষভাবে আমরা কি অণুকে পরিমাপ করতে পারি?

আইনস্টাইন বললেন, ধরা যাক আপনি কিছু পরিমাণ জল নিলেন। যদি ধরে নেন অণুর অস্তিত্ব আছে, তবে আপনি বলবেন ওই জলের মধ্যে লক্ষ লক্ষ জলের অণু তাপীয় গতিতে প্রতিনিয়ত গুঁতোগুতি করছে। এবার ধরুন ওই জলে আপনি খানিকটা চিনি গুলে দিলেন – তার মানে জলের অণুর সঙ্গে আর এক জাতের অণু মেশানো হল। আলোচনা সরল করার জন্য ধরে নেওয়া যাক উভয় অণুই গোলাকার, শুধু চিনির অণুগুলি জলের অণুর থেকে অনেকটা বড়। এই অনুমান সম্বল করে আইনস্টাইন দেখালেন চিনি মেশানোর ফলে তরলের সান্দ্রতা (viscosity) এবং ব্যাপনাঙ্ক (coefficient of diffusion) পাল্টাবে, এবং সেই পরিবর্তনের মান দ্রাব-অণুর ব্যাসার্ধের ওপর নির্ভর করবে (ছক-1)। যেহেতু সান্দ্রতা ও ব্যাপনাঙ্ক পরিমাপযোগ্য তাই চিনি মেশানোর আগে ও পরে ওই রাশিদ্বয় পরিমাপ করে চিনির অণুর ব্যাসার্ধ নির্ণয় করা যায়।

একটি অতি বিচিত্র যুক্তি। আইনস্টাইনের পিএইচডি থিসিসের পরীক্ষক প্রচলিত বিজ্ঞানের সীমা থেকে এতটা বিচ্যুতি হজম করতে পারেননি এবং “গ্রহণযোগ্য নয়” বলে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সামান্য কিছু সংশোধনের পর অবশ্য সেই থিসিস গৃহীত হয় এবং এই কাজের দৌলতেই আইনস্টাইন হয়েছিলেন ডঃ আইনস্টাইন।



অণুর অস্তিত্ব নিয়ে দ্বিতীয় গবেষণাপত্রটি⁶ ঐ একই বছরে অর্থাৎ 1905 সালে প্রকাশিত হয় জার্মান জার্নাল Annalen der Physik-এ। সেটির নামকরণ ছিল- “On the motion of small particles suspended in liquids at rest required by the molecular-ki- netic theory of heat” (আণবিক তাপীয় গতিতত্ত্ব অনুযায়ী স্থির তরলে ভাসমান ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার গতি প্রসঙ্গে)। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে রবার্ট ব্রাউন নামে এক ব্রিটিশ উদ্ভিদবিদ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় দেখেছিলেন এক ফোঁটা জলের মধ্যে ভাসমান পরাগরেণুগুলি এলোমেলোভাবে অন্তহীন ছোটাছুটি করছে। প্রথমে লোকজন ভেবেছিল পরাগরেণুগুলি বুঝি জীবন্ত, তাই তারা জলের মধ্যে সাঁতার কেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু শীঘ্রই পরিষ্কার হয়ে গেল যে গতির ভঙ্গিটা মোটেই সাঁতার কাটার মতো নয়, বরং পরাগরেণুগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সরলরৈখিক পথে পরিভ্রমণ করছে এবং নিরন্তর দিক বদলে চলেছে। আবিষ্কর্তার নাম অনুযায়ী এই গতিকে বলা হয় ব্রাউনীয় গতি; কিন্তু এই অদ্ভুত গতির কারণ সেদিন ছিল রহস্যের চাদরে মোড়া।

আইনস্টাইন দেখালেন পরাগরেণুর এই আঁকাবাঁকা গতি (zigzag motion) অণুর অস্তিত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। আপাতভাবে স্থির জলের ফোঁটাটিতে যদি লক্ষ লক্ষ অণু থাকে, তবে তাপীয় গতিতত্ত্ব অনুসারে তাপজনিত গতির কারণে সেই অণুগুলি প্রচণ্ড গতিবেগে ছুটবে। এখন যদি সেই জলের অণুগুলির মাঝে তাদের থেকে আকারে বহু গুণ বড় একটি পরাগরেণুকে রাখা হয় তবে তার সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে অগণিত জলের অণুর সংঘাত হবে – সেটা তাকে গতিশক্তি দেবে। যেহেতু জলের অণুগুলি সবদিক থেকেই ধাক্কা দেবে তাই তাদের লব্ধ প্রতিক্রিয়ায় পরাগরেণুর গতি হবে এলোমেলো। কোনও এক ধাক্কার ফলে সে যাবে সরলরেখায় যতক্ষণ না পর্যন্ত পরবর্তী এক ধাক্কায় তার গতির অভিমুখ বদলে আর এক দিকে তাকে নিয়ে যায়। এইভাবেই ক্রমাগত পরপর ধাক্কায় তার গতিমুখ পাল্টাতে থাকবে। যদি সত্যিই অণু থাকে তবে তার গতি এইরকমই হবে বলে আশা করা যায়। যেহেতু পরাগরেণুর গতি আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি, তাই আইনস্টাইন যুক্তি সহকারে বললেন এমনটা ঘটছে কারণ অণুগুলি আছে এবং তাদের সক্রিয়তার জন্যই এরূপ হচ্ছে।

কিন্তু এ তো একটা ব্যাখ্যা মাত্র। বিজ্ঞানে কোনও একটা বিতর্কিত বিষয় প্রতিষ্ঠা করতে এটা যথেষ্ট নয়। কোনও একটা পরিমাণের বা মাত্রার ভিত্তিতে কথা বলা দরকার, যাতে পরীক্ষা ও পরিমাণ করে তত্ত্বটা প্রতিষ্ঠা করা যায়। আইনস্টাইন প্রশ্ন করলেন, অণুগুলির ধাক্কাধাক্কি ও তার জন্য পরাগরেণুর গতি যদি এলোমেলো (random) হয়, তাহলে কোনও এক জায়গা থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট সময় বা নির্দিষ্ট সংখ্যক ধাক্কার পরে পরাগরেণুটি গড়পড়তা কত দূর যেতে পারে তা বলা যায় কি? আইনস্টাইন দেখালেন যদিও গতির ধরন এলোমেলো (random), তবুও সম্ভাব্যতা সূত্রের নিরিখে অতিক্রান্ত দূরত্বের পরিমাপ করা যায়। এর মানে হল, যদি কেউ নির্দিষ্ট সময় পর মোট অতিক্রান্ত দূরত্ব বারবার পরিমাপ করে, গড় মুক্ত পথের মান নির্ণয় করা সম্ভব-তত্ত্বের সঙ্গে মিলে যায়। এটা কিন্তু হাতে-কলমে অর্থাৎ বস্তুনিষ্ঠভাবে নির্ণয় করা যায়। পরীক্ষা করা হল এবং দেখা গেল পরাগরেণুর গতি আইনস্টাইনের সমীকরণের সাথে মিলে যাচ্ছে (ছক-2)।

এরকম বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণের পর অণুর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা অসম্ভব।




বিকিরণের কোয়ান্টাম ধারণার সত্যতা

এরপর তিনি বস্তুবাদী অবস্থান থেকে আর একটি বিষয়ে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হন। একটি বস্তু থেকে তাপ-বিকিরণ দীর্ঘদিন ধরেই বিজ্ঞানীদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। ম্যাক্সওয়েলের আবিষ্কারের পর থেকে এটা জানা গেছে যে তাপ-বিকিরণও তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ, অর্থাৎ তার কম্পাঙ্ক এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্য আছে যারা কিনা পরিমাপযোগ্য রাশি। এটা দেখা গেছে যে উত্তপ্ত বস্তু থেকে বিকীর্ণ তাপ-তরঙ্গের একটিই তরঙ্গদৈর্ঘ্য থাকে না; বরং সেটি ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তরঙ্গের মিশ্রণ। ফলে প্রশ্ন ওঠে, উত্তপ্ত বস্তু থেকে কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তরঙ্গ কী অনুপাতে বার হবে?

ছবি-1 : বিভিন্ন তাপমাত্রায় তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও প্রাবল্যের লেখচিত্র

মূল প্রশ্ন থেকে নজর সরে যাওয়ার মতো বেশ কয়েকটি বিষয়ও ছিল। উদাহরণস্বরূপ উত্তপ্ত বস্তুটি লোহা, তামা, কাঠ অথবা অন্য যে-কোনও পদার্থ নির্মিত হতে পারে। বিকিরণ এইসব ক্ষেত্রে একইরকম হবে না। উপরন্তু একটি লাল রঙের এবং একটি কালো রঙের বস্তুর বিকিরণের মান এক হবে না। তাই বিজ্ঞানীরা বিকিরক বস্তুতে এই বিষয়গুলির জন্য যাতে পার্থক্য না হয়ে যায়, বিশেষ করে মূল প্রশ্নটির উত্তর পেতে অসুবিধা না হয় সেইজন্য একটি নতুন ধারণা আনলেন। তাঁরা এক আদর্শ বিকিরকের কল্পনা করলেন- সেটি হল তথাকথিত কৃষ্ণ বস্তু (black body)। পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী কৃষ্ণ বস্তু তার ওপর আপতিত সকল বিকিরণকে শোষণ করতে পারে এবং তার নিজের তাপীয় বিকিরণ কেবলমাত্র নিজের তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে। পরীক্ষার ফলাফল থেকে দেখা গেছে আদর্শ কৃষ্ণ বস্তুর খুব কাছাকাছি মানের কোনও বিকিরকের বিকিরণ প্রাবল্য এবং কম্পাঙ্কের মধ্যে নির্দিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিটি বিশেষ তাপমাত্রার জন্য বস্তুর বিকিরণের মাত্রা একটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে সর্বোচ্চ হয়। বিশেষ তাপমাত্রার এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (অথবা কম্পাঙ্ক) মধ্যে যে লেখচিত্র আঁকা যায় তার থেকেই ওই সর্বোচ্চ বিকিরণ মাত্রা জানা যায়। (ছবি–1)


কেন কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ এই বিশেষ লেখচিত্র অনুসরণ করে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পরবর্তী ধাপে বিজ্ঞানীরা সমস্যায় পড়লেন। এইখানেই মহা সমস্যা দেখা দিল। পদার্থবিদেরা দেখলেন যদি প্রচলিত তত্ত্বকে মেনে চলা হয়, অর্থাৎ যদি কেউ মনে করেন তরঙ্গের মতো নিরবিচ্ছিন্নভাবে শক্তি নির্গত হয়, তবে তার ভিত্তিতে অঙ্কিত লেখচিত্র পরীক্ষার ফলের সঙ্গে মেলে না।

যখন পদার্থবিদেরা এই সমস্যার উত্তর খোঁজার জন্য অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন, তখন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক বললেন নিরবিচ্ছিন্নভাবে শক্তি নির্গত হওয়ার বদলে যদি আমরা ধরে নিই শক্তি আলাদা আলাদা বিভিন্ন ‘প্যাকেটে’ নির্গত হয় তবে তত্ত্বের সঙ্গে ফলাফল হুবহু মিলে যায় এবং একই লেখচিত্র পাওযা যায়। বিজ্ঞানের জগতের লোকেরা কিন্তু আদৌ খুশি হলেন না। তারা বললেন এই অনুমানের ভিত্তি কী? কেউ কি শক্তির ওই প্যাকেট দেখেছে? কেউ কি মাপতে পেরেছে? যদি কেউ যুক্তির খাতিরে ধরে নেয় প্লাঙ্কের কথা সত্যি, তবে সেই প্যাকেটে শক্তির পরিমাণ হবে খুবই কম- এতটাই কম যে তারা কখনওই আলাদাভাবে দৃশ্যমান হবে না। কিন্তু প্রত্যক্ষণবাদ অনুযায়ী যা দেখা যায় না, এক একটি প্যাকেটের অস্তিত্ব নেই। বিরোধিতার সুর এতটাই চড়া ছিল যে বিজ্ঞানীদের মূল শিবির প্ল্যাঙ্কের গণনা গ্রহণ করেনি। প্ল্যাঙ্কও নিজের তত্ত্বের সমর্থনে জোরালোভাবে দাঁড়াতে পারেননি। (প্ল্যাঙ্ক নিজে প্রত্যক্ষবাদী ছিলেন না। তবে নিজের তত্ত্ব রক্ষায় অনীহার কারণ ছিল অন্যত্র। তিনি দেখেছিলেন অভিজ্ঞতালব্ধ ফলের সঙ্গে সঙ্গতিবিধান করতে কোনও তাত্ত্বিক ভিত্তি ছাড়াই কিছু একটা অনুমান করতে হচ্ছে। তাই নিজের কাছে তাঁর গণনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল অন্ধ অভিজ্ঞতাবাদ।)

এই পরিস্থিতিতে আইনস্টাইন সমস্যাটির দিকে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাকালেন। যদি শক্তির কোয়ান্টাম সত্যিই থেকে থাকে তবে তার অস্তিত্ব আমাদের দেখতে পাওয়া না পাওয়া, আমরা আলাদা করে সেই কোয়ান্টামের প্রত্যেকটিকে আলাদা করে চিনতে পারছি কিনা তার উপর নির্ভর করে না। অবশ্যই বিকিরণের কোয়ান্টাম এত ক্ষুদ্র যে তা প্রত্যক্ষ করা যায় না। কিন্তু প্ল্যাঙ্কের অঙ্কটা যে পরীক্ষালব্ধ ফলের সঙ্গে মিলে গেল এটাই কোয়ান্টামের বাস্তবতার একটা পরোক্ষ সাক্ষ্য।

তবুও সরাসরি প্রমাণ চাই। কোয়ান্টাম যদি বাস্তব হয় তবে তার অবশ্যই আরও কিছু অভিব্যক্তি থাকবে যার সাহায্যে তার বাস্তব অস্তিত্ব প্রমাণ করা যাবে। তার জন্য অবশ্য তাঁকে বেশি দূর যেতে হল না। পরীক্ষালব্ধ তথ্য হাজিরই ছিল, শুধু সেদিন পর্যন্ত সেইগুলি ব্যাখ্যা করা হয়নি অথবা যায়নি। প্রতিপ্রভার (fluorescence) ঘটনা কিংবা সেই সংক্রান্ত স্টোকের নিয়ম (Stoke’s rule) অথবা নিঃসৃত বিকিরণের ঘটনা যথাযথভাবে উপলব্ধি করা যায়নি। এও দেখা গেছে যে গ্যাসের ওপর যদি অতি-বেগুনি রশ্মি এসে পড়ে তবে গ্যাস আয়নিত হয়; কিন্তু কেন এইরকম হয় সেই ব্যাখ্যাও সঠিকভাবে দেওয়া যায়নি। তারপর আলোক-তড়িৎ ক্রিয়ার (photo-electric effect) বিষয়টাও ছিল। আইনস্টাইন ঐ একই বছর Annalen der physik পত্রিকায় সেইসব আপাত রহস্যগুলি সমাধান করলেন এবং দেখালেন এইগুলি প্রমাণ করে কোয়ান্টামবাদ নিছক সুবিধাজনক একটা অনুমান নয়, সেটা বাস্তব সত্য ।

আলোক-তড়িৎ ক্রিয়ার ঘটনা কিছুটা খ্যাতি অর্জন করেছিল, কারণ আইনস্টাইন এর সফল ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এবং এই অবদানের জন্যই তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। সেটা অবশ্য অনেক পরে 1921 সালের কথা। ততদিনে অবশ্য তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী রূপে স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন। (যদিও তাঁর মূল কাজটি ছিল কোয়ান্টার অস্তিত্বকে প্রমাণ করা এবং আলোক-তড়িৎ ক্রিয়ার উপর কাজটি সেই গবেষণাপত্রের ৪নং অধ্যায়ে উল্লিখিত একটি ক্ষুদ্র অংশ ছিল)। এখন আলোক-তড়িৎ ক্রিয়ার ঘটনাটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।

বছর কয়েক আগে কয়েকজন বিজ্ঞানী লক্ষ্য করেছিলেন যে কিছু ধাতুর পাতে যদি আলো এসে পড়ে তবে তাদের থেকে ইলেকট্রন নির্গত হয়। একেই বলে আলোক-তড়িৎ ক্রিয়া। প্রথমে এতে অস্বাভাবিক কিছুই ঠেকেনি। কারণ আলোকে শক্তি আছে, তাই ধাতুর পাত আলো শোষণ করলে তাতে শক্তি সঞ্চিত হবে। আর সঞ্চিত শক্তি যখন ইলেকট্রন ও নিউক্লিয়াসের আকর্ষণ বলকে অতিক্রম করবে তখন ধাতুর পাত থেকে ইলেকট্রন ছিটকে যাবে। শুধু একটা কথা—সনাতন গতিবিদ্যা (Classical Mechanics) অনুযায়ী আলো এসে পড়া মাত্র সেই পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত হবে না, হতে সময় লাগবে। তাই আলো এসে পড়ার কিছুক্ষণ পরে ইলেকট্রন নির্গত হবে সেইটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। ইলেকট্রন নিঃসরণ একেবারে তাৎক্ষণিক (instantaneous)। যে মুহুর্তে আলো এসে পড়ছে, ইলেকট্রন বেরোচ্ছে সেই মুহূর্তে। রীতিমত ধাঁধা।

বিজ্ঞানীরা ব্যাপারটা আরও খতিয়ে দেখলেন। আপতিত আলো যদি একবর্ণী (monochromatic) হয় তবে তার বিশেষ কম্পাঙ্ক (frequency) থাকবে যার মান পরিবর্তন করা যেতে পারে। আবার সেই আলোর নির্দিষ্ট প্রাবল্য (intensity) থাকবে যাও বাড়ানো বা কমানো যেতে পারে। এ তো গেল ইনপুটের কথা। আউটপুটেও দুটি পরিমাপযোগ্য রাশি আছে—নির্গত ইলেকট্রনের সংখ্যা এবং ইলেকট্রনের গড় গতিশক্তি। নানাভাবে পরীক্ষা করে দেখা গেল একটি বিশেষ কম্পাঙ্কের নিচে ইলেকট্রন একেবারেই বেরোয় না। সেই বিশেষ কম্পাঙ্ককে বলে প্রারম্ভিক কম্পাঙ্ক (threshold frequency)। প্রারম্ভিক কম্পাঙ্কের থেকে কম কম্পাঙ্কবিশিষ্ট কোনও আলো যদি এমনকি খুব বেশি প্রাবল্যেরও হয়, ধাতুপৃষ্ট থেকে একটিও ইলেকট্রনকে মুক্ত করতে পারে না। যদি প্রারম্ভিক কম্পাঙ্কের থেকে বেশি কিন্তু কম প্রাবল্যের আলোও এসে পড়ে তাহলেও আলোক-তড়িৎ ক্রিয়া হয়। এখন যদি আমরা প্রারম্ভিক কম্পাঙ্কের থেকে বেশি কম্পাঙ্কের আলোর প্রাবল্য বাড়াই কমাই, তবে নির্গত ইলেকট্রনের সংখ্যা বাড়ে-কমে; কিন্তু প্রতিটি ইলেকট্রনের শক্তি একই থাকে। আবার যদি আলোর প্রাবল্য (intensity) ধ্রুবক (constant) রেখে কম্পাঙ্ক বাড়াই কমাই, তাহলে নির্গত ইলেকট্রনের সংখ্যা একই থাকলেও ইলেকট্রনের গতিশক্তি পরিবর্তিত হয়। কিন্তু আলোক-তড়িৎ ক্রিয়ার সম্পূর্ণ বিষয়টা সনাতন গতিবিদ্যা অনুযায়ী ব্যাখ্যার অসাধ্য। কেন আলো এসে পড়ার সাথে সাথে ইলেকট্রন বার হয়, আর কেনই বা কম প্রাবল্যের কিন্তু বেশি কম্পাঙ্কের আলো ইলেকট্রন নিঃসরণ করতে পারে, অথচ বেশি প্রাবল্যের কিন্তু কম কম্পাঙ্কের আলো পারে না সেটাও চিরায়ত গতিবিদ্যা বলতে পারে না।

1905 সালে একটি গবেষণাপত্রে আইনস্টাইন দেখালেন এই আলোক-তড়িৎ ক্রিয়াই বিকিরণের কোয়ান্টাম রূপের একটি প্রমাণ। শক্তি যদি বিকিরিত হয় কোয়ান্টামের বিচ্ছিন্ন প্যাকেটে তবে শক্তি শোষিতও হবে সেইভাবেই। অর্থাৎ ইলেকট্রন আলো শোষণ করলে তার শক্তি বৃদ্ধি হবে এক প্যাকেটে যতটা শক্তি থাকে ততটাই। আধা, বা সিকি, বা কোনও ভগ্নাংশ পরিমাণ শক্তির প্যাকেট শোষণ সম্ভব নয়। তাই নিরবচ্ছিন্ন শক্তি বৃদ্ধি অসম্ভব। যদি শক্তি বৃদ্ধি হয় তবে তা হবে এক ধাক্কাতেই। আর সেই শক্তি নিউক্লিয়াসের আকর্ষণ বলকে অতিক্রম করলেই ইলেকট্রন ছিটকে যাবে। সেইজন্য যে মুহূর্তে আলো পড়ে, ইলেকট্রন নির্গত হয় সেই মুহূর্তে। কোয়ান্টামতত্ত্ব সত্যি হলে সেটাই স্বাভাবিক।



আবার প্ল্যাঙ্কের অঙ্ক অনুযায়ী এক একটি আলোর প্যাকেটের শক্তি তার কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক। তাই প্রাবল্য ঠিক রেখে আলোর কম্পাঙ্ক বাড়ালে শক্তি প্যাকেটের সংখ্যা বাড়বে না, কিন্তু এক একটি প্যাকেটে শক্তির পরিমাণ বাড়বে। তাই ঠিকরে যাওয়া ইলেকট্রনের সংখ্যা বাড়বে না, কিন্তু এক একটি ইলেকট্রনের শক্তি বাড়বে। আবার কম্পাঙ্ক সমান রেখে প্রাবল্য বৃদ্ধি করলে এক একটি প্যাকেটের শক্তি বাড়বে না, কিন্তু প্যাকেটের সংখ্যা বাড়বে। ফলে নির্গত ইলেকট্রনের শক্তি একই থাকবে, কিন্তু তাদের সংখ্যা বাড়বে। বোঝাই যাচ্ছে আলোর কোয়ান্টাম ধর্ম মেনে নিলে পুরো ব্যাপারটাই জিগ-স ধাঁধার মতো খাপে খাপে মিলে যায়। আইনস্টাইন আলোক-তড়িৎ ক্রিয়ার এই সহজ-স্বাভাবিক ব্যাখ্যা তুলে ধরলেন এবং প্রমাণ করলেন আলোর কোয়ান্টাম ধর্ম কল্পকাহিনী নয়, বাস্তব। আমরা কোয়ান্টামকে আলাদা করে দেখতে না পারলেও কোয়ান্টাম তত্ত্ব সত্যকেই প্রতিফলিত করছে।


আপেক্ষিকতাবাদ

তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ—আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব বিশদে ব্যাখ্যা করার সুযোগ এখানে নেই। কিন্তু যে বিষয়টি উল্লেখ করা উচিত সেটি হল এখানেও তাঁর অবস্থান কঠোরভাবে বস্তুনিষ্ঠ। তাঁর প্রধান প্রতিপাদ্য ছিল সত্য দর্শকসাপেক্ষ হতে পারে না। তাই কোনও দর্শক যদি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে আর অন্যজন সচল হয় তবে তাদের সাপেক্ষে বস্তুজগতের নিয়মগুলো একই থাকতে হবে।

এখন, ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎ-চুম্বকীয় তত্ত্ব থেকে জানা গেছে আলোর গতি নির্ভর করে কেবলমাত্র মাধ্যমের চরিত্রের উপর, বিকিরণের বা দর্শকের গতির উপর নয়।

c=1/√(∈μ)

(যেখানে, ∈ হল বিদ্যুৎশীলতা এবং μ হল চুম্বকশীলতার মান)

অর্থাৎ শূন্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগ ধ্রুবক যা আলোক-উৎস বা দর্শকের ওপর নির্ভর করে না। অথচ গ্যালিলিও-নিউটনীয় আপেক্ষিক বেগের ধারণা অনুযায়ী যদি আলোর গতিবেগ হয় এবং দর্শক তার দিকে গতিবেগে ধাবমান হয়, তবে দর্শকের সাপেক্ষে আলোর আপেক্ষিক বেগ হবে c+v; তাহলে দেখা গেল দুটি সুপ্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব থেকে পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়। এই সমস্যাটি দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীদের ভাবিয়েছে।

আইনস্টাইন বুঝেছিলেন ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব ফ্যারাডে, অ্যাম্পিয়ার এবং ওহমের মতো বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরীক্ষিত তড়িৎ ও চুম্বকের আভ্যন্তরীন সম্পর্কের তথ্যের সুদৃঢ় জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এর অর্থ ১নং সমীকরণটিতে প্রকৃতিরই নিয়ম বিধৃত রয়েছে। তাই যদি হয় তবে বস্তুনিষ্ঠতা (objectivity) দাবি করে এই সমীকরণের বৈধতা (সেই সঙ্গে আলোর গতিবেগও) দর্শকের গতিবেগ নিরপেক্ষ হবে। এর অর্থ হল নিউটনের তত্ত্বের কাঠামোর মধ্যেই কোথাও ভুল রয়েছে।

এটা ভাবা সত্যিই কঠিন যে ছাব্বিশ বছর বয়স্ক পেটেন্ট অফিসের একজন অজানা অচেনা কেরানির এতদূর স্পর্ধা যে নিউটনের মতো মহাবিজ্ঞানীর তত্ত্ব যা দুশ বছরের বেশি সময় ধরে প্রকৃতি জগতের রহস্যকে উন্মোচিত করে আসছে, তাকে নিয়ে প্রশ্ন তুলছে! কত শত পরীক্ষা নিউটনের সেই তত্ত্বকে সমর্থন জুগিয়েছে। এই তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়েই তো জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নিখুঁতভাবে গ্রহদের কক্ষপথ, অবস্থান আগাম বলে দিতে পারেন যার ফলে মহাজাগতিক বস্তুদের ঘিরে রহস্যের মেঘ শেষ পর্যন্ত সরে গেছে, যার ফলে গ্রহ-নক্ষত্রদের ঘিরে জ্যোতিষ সহ নানা প্রকারের যে সকল কুসংস্কার ছিল তাত্ত্বিকভাবে তাদের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গিয়েছে। সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে ঘড়ির কাঁটা ধরে সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়েছে। নিউটন বেঁচে থাকতেই তাঁর তত্ত্বকে ব্যবহার করে তাঁরই বন্ধু এডমণ্ড হ্যালি একটি উজ্জ্বল ধূমকেতুর অবস্থান এবং ভরবেগ মেপে ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে সেই ধূমকেতুটি 76 বছর পরে আবার ফিরে আসবে। 76 বছর পর এমনটাই ঘটেছিল এবং তারপর থেকে ঐ ধূমকেতুটি 76 বছর বাদে বাদে পৃথিবীর আকাশে ফিরে আসছে। এরকম একটি ‘সফল’ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে গেলে সত্যিই বুকের পাটা লাগে।

এবং প্রশ্ন তুললেন কোনখানে? যেখানে কেউ কোনদিন সন্দেহ প্রকাশ করেনি। নিউটন তাঁর প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকায় বলেছিলেন, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সময়ের পরিমাপ সকল বস্তুর ক্ষেত্রে একই, এবং কোনও কিছুতেই তার পরিবর্তন হওয়ার জো নেই। আচ্ছা, এমনটাই কি আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতা নয়? অথছ এইখানেই আইনস্টাইন প্রশ্ন তুললেন। নিউটন দেশকে (Space) আপেক্ষিক ধরেছিলেন; বেগ, ত্বরণ, বলকে আপেক্ষিক বলে ধরেছিলেন। কিন্তু উপরোক্ত বিবৃতির দ্বারা নিউটন সময়কে পরম (absolute) বলে ধরে নিয়েছিলেন। আর এখানেই ভুল হয়েছিল নিউটনের তত্ত্বে।

এই জায়গা থেকে চলা শুরু করে আইনস্টাইন প্রথমে বললেন সময় আমরা পরিমাপ করি দুটি ঘটনার যুগপতন (simultaneity) দিয়ে এবং তারপর দেখালেন যুগপতনও আপেক্ষিক; এবং আরও দেখালেন পরস্পরের সাপেক্ষে গতিশীল দুইজন দর্শক যদি দুটি ঘটনার মধ্যবর্তী সময় পরিমাপ করে তবে তার মধ্যেও পার্থক্য থাকবে। যে মুহূর্তে এই বাধাটা সরে গেল, দেখা গেল আরও অনেকগুলি রাশি যাদেরও পরম বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল, যেমন বস্তুর দৈর্ঘ্য বা ভর, তারাও আপেক্ষিক; দর্শকের গতি পাল্টালে তাদের মানও পালটে যায়। সন্দেহাতীতভাবে এটা প্রতিষ্ঠিত হল যে পদার্থবিজ্ঞানের পরিধির মধ্যে সকল সত্যই বস্তুনিষ্ঠ কিন্তু আপেক্ষিক(objective but relative)।


কোয়ান্টাম বলবিদ্যা সম্পর্কে আইনস্টাইন

যদিও কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে আইনস্টাইন একজন ছিলেন, তবুও 1920 এবং 1930-এর দশকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জগতে এমন কিছু ধারণা আসতে থাকে যার সাথে তিনি একমত হতে পারেননি। তাঁর মতপার্থক্য কোথায় ছিল সেটি বর্তমান নিবন্ধের পরিধির মধ্যে আলোচনা করা সম্ভব নয়। তাই প্রখ্যাত পদার্থবিদ এবং গণিতজ্ঞ রজার পেনরোজের একটি উদ্ধৃতি আমি এখানে উল্লেখ করব। Einstein’s Miraculous Year গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন, “যখন আইনস্টাইন কোয়ান্টাম তত্ত্ব উপলব্ধির ক্ষেত্রে তাঁর সমকালীন বিজ্ঞানীদের থেকে সূচনার দিকে এগিয়ে ছিলেন, তখন কেন কোয়ান্টাম তত্ত্বের পরবর্তী বিকাশের ক্ষেত্রে অন্যরা তাঁকে পিছনে ফেলে দিয়েছিলেন? অনেকে মনে করেন যখন আইনস্টাইনের চিন্তা তাঁর ‘সেকেলে’ বাস্তববাদী (realist) দৃষ্টিভঙ্গি বাধা দিয়েছিল, তখন অণু, পরমাণু বা ক্ষুদ্রতর কণার কোয়ান্টাম স্তরে ‘ভৌতিক বাস্তবতা’-কে অস্বীকার করে অন্যরা বিশেষ করে নিল্স বোর এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবুও এটা পরিষ্কার যে 1905 সালে আইনস্টাইন আণবিক এবং অণুতর পদার্থবিদ্যার জগতে যে বুনিয়াদি অগ্রগতি ঘটিয়েছিলেন তা সম্ভব হয়েছিল ওই জগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলির বাস্তব অস্তিত্ব সম্পর্কে তাঁর সুগভীর প্রত্যয়ের জন্য’। পেনরোজ আরও বলেছেন, “যথার্থ অর্থে এটা কি সত্য হতে পারে যে বোরের অনুগামীরা যেভাবে ভাবেন আইনস্টাইন সেইরকম বিরাট ‘ভুল’ করেছেন? আমি এটা বিশ্বাস করি না। বরং অণুতর বাস্তবতার বিষয়ে আমি প্রবলভাবে আইনস্টাইনের পক্ষ অবলম্বন করব এবং আজকের কোয়ান্টম বলবিদ্যা যে বুনিয়াদি দিক থেকে অসম্পূর্ণ তাঁর এই বিশ্বাসের সঙ্গে সহমত পোষণ করব।” পেনরোজ এই বিষয়ে একা নন। আরও অনেকে মনে করেন কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মূল বিষয়গুলি নিয়ে এখনও বহু কিছু করা বাকি আছে এবং আইনস্টাইনের দার্শনিক যুক্তির ওপর দাঁড়িয়ে এই ক্ষেত্রে গবেষণার রাস্তা খোলা রয়েছে।


সিদ্ধান্ত

একটা বিষয় এখানে খুবই উল্লেখযোগ্য। ব্রাউনীয় গতি অথবা আলোক-তড়িৎ ক্রিয়া যাইহোক না কেন পরীক্ষালব্ধ ফলাফল কিন্তু সকলের সামনেই ছিল। কিন্তু আইনস্টাইনই অন্ধকারের মধ্যে আলো দেখতে পেয়েছিলেন।

আইনস্টাইনের সেই বিস্ময়কর বছর 1905 সালের কয়েক বছর আগেই মাইকেলসন এবং মর্লি পৃথিবীর আহ্নিকগতিকে কাজে লাগিয়ে পরীক্ষা করে দেখিয়েছিলেন পৃথিবীর গতির দিকে এবং বিপরীত দিকে আলোর আপেক্ষিক গতি একই। বিজ্ঞানের অনেক ইতিহাসকার এখন বিশ্বাস করেন আইনস্টাইন সেই সময় এই পরীক্ষাগুলি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন না। আপাতভাবে মনে হয় যে শূন্য-মাধ্যমে আলোর গতিবেগ দর্শকের গতিবেগ নিরপেক্ষ সেটা তাঁর জানা ছিল না। তবুও তিনি শুধুমাত্র যুক্তির ওপর দাঁড়িয়ে বুঝতে পেরেছিলেন তৎকালীন পদার্থবিদ্যার তাত্ত্বিক কাঠামোর কিছু আমুল পরিবর্তন দরকার।

তিনি পেরেছিলেন কীভাবে? এই গভীর অন্তর্দৃষ্টি তিনি পেলেন কেমন করে? এই প্রশ্নটাই আইনস্টাইনের মহান অবদানের স্মরণে আয়োজিত আন্তর্জাতিক পদার্থবিজ্ঞান বর্ষে (2005 সাল) অথবা তার পরেও হাজারো সেমিনার সিম্পোজিয়ামে স্তুতিবাক্যের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। আইনস্টাইন এই যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হতে পেরেছিলেন স্বচ্ছ বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ ও অনুশীলন করার মাধ্যমে। বিজ্ঞানের দর্শন গভীরভাবে চর্চার মাধ্যমে সঠিক বিজ্ঞানভিত্তিক দর্শন গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে।

সম্প্রতি Physics Today পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে ডন এ. হাওয়ার্ড একটি আকর্ষণীয় ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। 1944 সালে পুয়ের্তো রিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ অধ্যাপক পদার্থবিদ্যার সিলেবাসে বিজ্ঞানের দর্শনকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। যখন তিনি তাঁর সহকর্মীদের কাছ থেকে প্রবল বাধা পেলেন, তখন সেই নারাজ সহকর্মীদের রাজি করানোর অনুরোধ জানিয়ে আইনস্টাইনকে একটি চিঠি লেখেন। উত্তরে আইনস্টাইন বলেছিলেন, “বিজ্ঞানের বিচারপদ্ধতির তাৎপর্য এবং তার শিক্ষাগত মূল্য সম্পর্কে ও বিজ্ঞানের ইতিহাস এবং দর্শনের গুরুত্ব সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ সচেতন। আজ বহু মানুষকে দেখলে, এমনকি পেশাদারি বিজ্ঞানীদের দেখলেও আমার মনে হয় তাঁরা হয়ত হাজার হাজার গাছ দেখেছেন কিন্তু কখনও একটিও অরণ্য দেখেননি। সঠিক ইতিহাস এবং দার্শনিক জ্ঞানই তাঁদের প্রজন্মের সংস্কার থেকে মুক্ত হওয়ার স্বাধীনতা দিতে পারত, অধিকাংশ বিজ্ঞানীই যার শিকার। আমার মতে দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টি থেকে এই যে স্বাধীনতা বোধের জন্ম হয় তাই একজন সাধারণ দক্ষ কর্মীর সঙ্গে একজন সত্যসন্ধানীর তফাৎ গড়ে দেয়।”

1949 সালে একটি বই প্রকাশিত হয় যার শিরোনাম ছিল- “অ্যালবার্ট আইনস্টাইন : দার্শনিক-বিজ্ঞানী”⁸। মজার কথা হল, সেই সংখ্যার জন্য আইনস্টাইনকেও লেখা দিতে অনুরোধ করা হয়। তিনি লিখেছিলেন, “জ্ঞানতত্ত্ব এবং বিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক খুবই উল্লেখযোগ্য। তারা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞানের সংস্পর্শরহিত জ্ঞানতত্ত্ব ঘোলাটে।”

আজ আমরা দেখি বিজ্ঞানীদের বেশিরভাগই বিজ্ঞানের দর্শনটা ভাল করে বোঝার প্রয়োজনই মনে করেন না। এদিকটা যে তাঁরা জানেন না সেটাই তাঁরা জানেন না। তখন বুঝি, বিজ্ঞানচর্চার জগতটা আইনস্টাইনের পথ থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। আইনস্টাইনকে আমরা অনেকটা cult figure-এর স্থানে, celebrity-র স্থানে বসিয়েছি। কিন্তু তাঁর দেখানো পথে হাঁটিনি। চটজলদি সাফল্যের শর্টকার্ট পথ খুঁজেছি। আজ বিজ্ঞানী বলে নিজেদের পরিচয় দেন, বিজ্ঞানচর্চাকে পেশা হিসাবে নিয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। গত একশ বছরে নোবেলজয়ীও কম হলেন না। কিন্তু 1905 সালে আইনস্টাইনের সেই বিস্ময় বছর থেকে আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন যদি কিছু থেকে থাকে, তবে তা হল বিজ্ঞানচর্চা যাঁরা করেন তাঁদের দর্শন-অনীহা। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে এর পশ্চাদমুখী প্রভাব থাকতে বাধ্য। আজ আমাদের অঙ্গীকার হোক এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে বেরিয়ে আসার, আইনস্টাইনের পথে হাঁটার।


লেখক পরিচিতি : অধ্যাপক ব্যানার্জী ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমানে তিনি আইআইএসইআর-কলকাতার পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ও প্রাক্তন ডিরেক্টর।

তথ্যসূত্র:

1. Abraham Pais, “Subtle is the Lord – The Science and the Life of Albert Einstein,” Oxford University Press, Oxford, 1983.

2. B. Kuznetsov, “Einstein,” Progress Publishers, Moscow. 1965.

3. Shibdas Ghosh, “Selected Works,” Vol. II, SUCI (C) publication, Calcutta,1988.

4. Don A. Howard, “Albert Einstein as a Philosopher of Science,” Physics Today, December 2005.

5.Albert Einstein, “Ideas and Opinions,” Rupa & Co. Calcutta, 1984.

6. John Stachel (editor), “Einstein’s Miraculous Year: Five Papers that Changed the Face of Physics,” Scientia, Delhi and Princeton Univ. Press, USA, 1998.

7. Max Planck, “The Philosophy of Physics,” George Allen & Unwin Ltd., London, 1936.

8. P. A. Schilpp (Editor), “Albert Einstein: philosopher-scientist”. The li- brary of Living Philosophers, Evanston, Illinois, USA, 1949.

"আইনস্টাইনের মহান বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের দার্শনিক ভিত্তি" এই প্রবন্ধটি ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি প্রকাশিত 'বিজ্ঞান ও দর্শন' বই থেকে নেওয়া।