বিভাগগুলি

প্রাচীন ভারতে দর্শনচর্চা ও বিজ্ঞানচর্চার উপর তার প্রভাব—দ্বিতীয় পর্ব (ভাববাদী দর্শন)

source:Click Here

সুব্রত গৌড়ী

ভারতীয় সভ্যতা পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে অন্যতম। স্বাভাবিকভাবেই এই দীর্ঘ সময়কালে নানা ধরনের দার্শনিক মতবাদের উদ্ভব হয়েছে, বহু চিন্তাশীল মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। তাই ভারতীয় দর্শনের ইতিহাস হল সুদীর্ঘ ইতিহাস। এই দীর্ঘ ইতিহাস বিবৃত করা বর্তমান প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। কীভাবে দার্শনিক চিন্তার বিকাশ হয়েছে তার একটা পরম্পরা জানা এবং যুগে যুগে বিজ্ঞানচর্চার বিকাশের ক্ষেত্রে এই সমস্ত দর্শনচিন্তার প্রভাব বোঝার উদ্দেশ্যেই বর্তমান প্রবন্ধের অবতারণা।

দর্শনচিন্তা বলতে বোঝায় একটা চিন্তাপদ্ধতি। চিন্তাপদ্ধতি বা দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে বিচার করলে আমরা এই সমস্ত দর্শনগুলোকে দুটো ক্যাটিগরিতে ভাগ করতে পারি - ভাববাদ ও বস্তুবাদ। যে সমস্ত দর্শন বস্তুবহির্ভূত সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করে এবং তাকে মূল সত্য বলে মনে করে তাদের বলা হয় ভাববাদী দর্শন। এখানে বস্তুর অস্তিত্ব যদি স্বীকার করা হয়ও তবু তার ভূমিকা নিতান্তই গৌণ বলেই মনে করা হয় এবং ধরে নেওয়া হয় যে, ভাব থেকেই তার সৃষ্টি। আর যে সমস্ত দর্শন চিন্তায় বস্তুকেই আদি বা প্রায়র মনে করা হয় এবং বস্তু থেকেই ভাবের উৎপত্তি স্বীকার করা হয়, সেই সব দর্শনচিন্তাকে বলা হয় বস্তুবাদ। এর আগের সংখ্যায় (প্রথম পর্বে) বস্তুবাদী দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বর্তমান সংখ্যায় (দ্বিতীয় পর্বে) আমরা ভাববাদী দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করব।

ভারতে ভাববাদের প্রথম প্রকাশ: উপনিষদ

ভারতবর্ষে দর্শনচিন্তার ইতিহাসে ভাববাদী চিন্তার প্রথম স্পষ্ট প্রকাশ পাওয়া যায় উপনিষদে (খ্রিস্ট পূর্ব সপ্তম – ষষ্ঠ শতক)। উপনিষদে ভাববাদের দার্শনিক চিন্তার বাহক হিসাবে রাজা অজাতশত্রু, ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য এবং এমনকী দেবতা প্রজাপতি ও ইন্দ্রের নাম পাওয়া যায়। পরম সত্যের প্রকাশ হিসাবে এখানে যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, সেটা হল ব্রহ্মণ। যদিও একে অনির্বচনীয় বলা হয়, তবু আত্মার সাথে সমার্থক ধরা হয়। উপনিষদে একে বলা হয় আত্মণ। এই আত্মা বা আত্মণকে উপনিষদের ভাববাদীরা বলেছেন বিজ্ঞান-ঘন (a mass of mere conciousness), বা কেবলমাত্র চেতনা (bare conciousness)। অন্যভাবে একেই বলা হয়েছে আনন্দ বা সৎ।

উপনিষদের প্রাচীন ভাববাদীরা বস্তুজগতের বাস্তব অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছেন, বাস্তব জগতকে অলীক স্বপ্নের সাথে তুলনা করেছেন। ফলে তাঁরা মনে করতেন যে, প্রকৃতি সম্পর্কে কোনও ধারণা গড়ে তোলা যায় না, আমরা যা জানি বলে মনে করি, তা আসলে অলীক কল্পনা।

এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে উপনিষদের যুগে দার্শনিক চিন্তার জন্ম হলেও তাকে সুনির্দিষ্ট দার্শনিক তাত্ত্বিক রুপ দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই সেইসময় ভাববাদী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল নানা ধরনের 'অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা'র বা অতীন্দ্রিয় চিন্তার মাধ্যমে। সেই যুগের চিন্তাবিদরা এটাকে তাঁদের 'অন্তর্নিহিত প্রজ্ঞা' (secret wisdom) হিসাবে দেখেছিলেন। যদিও কেন একে তাঁরা প্রজ্ঞা বলেছেন সে সম্পর্কে কোনো প্রমাণ দেওয়ার কথা ভাবেননি। কখনও কখনও তাঁরা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেই ব্যাখ্যা বা যুক্তিগুলো ছিল একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের। তাই উপনিষদে যে ভাববাদী চিন্তার প্রকাশ পাওয়া যায় অবশ্যম্ভাবীরূপে তা ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে। তখনও কোনও সিস্টেম অফ ফিলজফিক্যাল থট-এর জন্ম হয়নি অর্থাৎ অন্যান্য দার্শনিক চিন্তার সাথে দ্বন্দ-সংঘাতের মধ্য দিয়ে একটি বিশেষ দার্শনিক তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করার যে ঐতিহ্য ভারতীয় দর্শন চিন্তার বিকাশের ইতিহাসে পরবর্তী সময়ে পাওয়া যায়, উপনিষদে তা পাওয়া যায় না।

ভাববাদী দর্শনের প্রথম প্রকাশ : মহাযান বৌদ্ধমত

উপনিষদের যুগের পরবর্তী ছ'শ বছরে অর্থাৎ খ্রিস্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতক পর্যন্ত) আমরা উপনিষদের এই চিন্তার কথা শুনতে পাইনি। ফলে বোঝা যায় এই ছ'শ বছরে উপনিষদ নিয়ে চর্চা বিশেষ হয়নি। প্রথম শতাব্দীতে এই চিন্তার পুনর্জন্ম হয়। বিস্ময়কর হলেও একথা সত্য যে, যে চিন্তবিদরা এই পুনর্জন্ম ঘটালেন, তাঁরা বুদ্ধের অনুগামী। গৌতম বুদ্ধ নিজে নিরীশ্বরবাদী ছিলেন এবং বৌদ্ধধর্মের রক্ষণশীল অংশ, যাদের হীনযান বলা হয়, তাঁরা বৌদ্ধধর্মের সাবেক চিন্তা নিয়ে চললেও আর এক অংশ যাঁরা নিজেদের মহৎপথের পথিক বা মহাযান হিসাবে পরিচয় দিতেন, তাঁরা ভাববাদী চিন্তাকে আশ্রয় করে নতুন দার্শনিক মতবাদের জন্ম দিলেন (বি: দ্র: আদি বৌদ্ধ দর্শন নিয়ে পূর্ববর্তী সংখ্যায় বিস্তারিত আলোচনা আছে)। এই নামকরণটা এদের নিজেদের দেওয়া। যে ধর্মগ্রন্থের উপর নির্ভর করে মহাযান বৌদ্ধরা ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গীকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তার নামকরণও তাঁরা নিজেরাই করেছিলেন।

মহাযান বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থের প্রকৃতি সম্পর্কে দু একটি কথা বলা দরকার। যদিও তাঁরা উপনিষদে যে ভাববাদী চিন্তার প্রকাশ পাওয়া যায়, সেই চিন্তাকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন, তবু উপনিষদের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন নি, বরং তা আড়াল করারই চেষ্টা করেছেন। কারণ বৌদ্ধধর্মের কাছে উপনিষদ ছিল বহিরাগত (alien)।

এর ফলে মহাযান বৌদ্ধরা একটা কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়েছিলেন। ভারতীয় ভাববাদীরা সাধারণ অভিজ্ঞতা ও যুক্তিকে অবজ্ঞা করে এসেছেন এবং শাস্ত্রবচনের উপর নির্ভর করেছেন। অথচ বৌদ্ধধর্মের আদি শাস্ত্রে সাধারণভাবে রহস্যবাদ এবং বিশেষভাবে উপনিষদের বিরোধিতাই পাওয়া যায়। তাই তাঁরা তাঁদের চিন্তার সমর্থনে নতুন করে শাস্ত্রগ্রন্থ লিখতে বাধ্য হয়েছেন। এরই পাশাপাশি তাঁরা নানাধরনের অলৌকিক কাহিনী বর্ণনা করেছেন, যাতে তাদের এই নতুন আমদানি করা চিন্তাকে বৌদ্ধধর্মের অনুসারী করা যায়। এই শাস্ত্রগ্রন্থকে সাধারণভাবে বলা হয় মহাযান সূত্র। এই নতুন শাস্ত্রগ্রন্থে উপনিষদের চিন্তাকে সুচতুরভাবে ঢোকানো হয়েছে, যাতে ঐ চিন্তাকে বৌদ্ধশাস্ত্রের মোড়কে পরিবেশন করা যায়।

কিন্ত মহাযান বৌদ্ধরা উপনিষদে যা ছিল শুধু তারই পুনরাবৃত্তি করেন নি। উপনিষদে যেভাবে ভাববাদী চিন্তার অঙ্কুরকে ভিত্তি করে প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু কথা ঘোষণা করার মতো করে বলা হয়েছে, শুধু তার পুণরাবৃত্তিতে কাজ হত না। উপনিষদের যুগে যা স্বাভাবিক ছিল, ছ'শ বছর পরে তা দিয়ে কাজ চলত না। কারণ এই ছ'শ বছরে বহু দর্শনের জন্ম হয়েছে, বিশেষ করে বস্তুবাদী দর্শন। ফলে উপনিষদের ভাববাদী চিন্তার প্রাথমিক ধারণাকে ভিত্তি করে পূর্ণাঙ্গ দার্শনিক তত্ত্বের জন্ম দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। এই কাজটিই করেছেন মহাযান বৌদ্ধরা। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন দার্শনিক ছিলেন। তাঁরা এও অনুভব করেছিলেন যে মূল চিন্তার পাশাপাশি আনুসঙ্গিক আরও বহু বিষয়ে তাঁদের দর্শনকে সমৃদ্ধ না করলে সময়োপযোগী করা যাবে না। ফলে ভাববাদী দর্শন আর প্রাথমিক পর্যায়েই রইল না। তাঁরা একে একটা সুসংহত দার্শনিক মতবাদে পরিণত করলেন।

মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের দর্শনচিন্তা : শূণ্যবাদ

মহাযান সম্প্রদায়ের ইতিহাসে সবচেয়ে পরিচিত নাম হল নাগার্জুন। খ্রিস্টিয় প্রথম-দ্বিতীয় শতাব্দীতে তিনি বেঁচে ছিলেন। দক্ষিণ ভারতে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম। প্রথম জীবনে তিনি ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। এরপর তিনি বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু পরিতৃপ্ত হতে পারেন নি। তাই তিনি সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং কথিত আছে যে, সমাজের নিচুতলার মানুষের মধ্যে প্রচলিত অলীক প্রাণী নাগ বা সাপের কাহিনী - যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহাযান শাস্ত্র ‘প্রজ্ঞা – পারমিতা’র সংস্পর্শে আসেন, যা তাঁকে সন্তুষ্ট করে। এই কাহিনীর সত্যতা প্রমাণিত নয়। বৌদ্ধরা মনে করে যে, এই গ্রন্থটি তাঁর নিজের লেখা। যাই হোক না কেন, বৌদ্ধ লেখকদের মধ্যে নাগার্জুন খুবই পরিচিত নাম। নাগার্জুনের সাথে তাঁর 'মন্ত্রশিষ্য' আর্যদেবের নাম উচ্চারিত হয়। আর্যদেব সিংহলের রাজপরিবারে জন্মেছিলেন এবং বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার পর ভারতে চলে আসেন। অচিরেই তিনি নাগার্জুনের অনুরাগী হয়ে পড়েন।

নাগার্জুন মাধ্যমিক নামটি গ্রহণ করেছিলেন প্রাচীন বৌদ্ধমত 'মধ্যমা প্রতিপদ' থেকে, যার আদি অর্থ হল মধ্যম পথ। নৈতিক আচরণের ক্ষেত্রে এই মতে বিশ্বাসীরা মনে করত যে কৃচ্ছসাধন ও আমোদ আহ্লাদের জীবন – কোনওটাই কাঙ্খিত নয়, মাঝামাঝি পথে চলা উচিত। কিন্তু নাগার্জুন এই ধারণাটির উপর অলৌকিক-অতীন্দ্রিয় ধারণা আরোপ করলেন। তিনি বললেন, এর অর্থ হল বাস্তবতা সম্পর্কে 'এটা আছে' এবং 'এটা নেই' - এরকম নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। সহজ কথায় এর অর্থ হল বাস্তবতাকে (reality) ব্যাখ্যা করা যায় না। অর্থাৎ বাস্তবতা হল অনির্বচনীয় এবং সেইজন্য বাস্তবতা হল অলীক কল্পনা মাত্র, যে কথা উপনিষদে আর একভাবে বলা হয়েছে।

উপনিষদের চিন্তাবিদ যাজ্ঞবল্ক্য দাবি করেছেন যে, পরম সত্যকে নির্দিষ্ট করে এটা কিংবা ওটা - এভাবে বলার অর্থ হল অজ্ঞানতায় ডুবে যাওয়া। যেমন, তিনি 'পরম সত্য' সম্পর্কে বলেছেন, "It is unseizable, for it is not seized; it is indestructible, for it is not destroyed; it is not attached, for it does not attach itself; it is unbounded, it does not tremble, it is not injured."

পরম সত্য সম্পর্কে নাগার্জুন প্রায় একই বক্তব্য পেশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "It is not destroyed, not produced, not dissolve, not eternal, not one, not many, not inwardly moving, not outwardly moving." এক কথায় আমাদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা দিয়ে পরম সত্যকে বোঝা যাবে না।

নাগার্জুনের দার্শনিক মতবাদের আর এক নাম হল শূণ্যবাদ, অর্থাৎ শূণ্য বা অস্তিত্বহীনতা। 'শূণ্য'-এর অর্থ তাঁর মাধ্যমিক-শাস্ত্রে বর্ণিত ধারণার ভিত্তিতে বুঝতে হবে। এর অর্থ পরম সত্য বাস্তব জগতের ছদ্ম প্রকাশকে অতিক্রম করে বুঝতে হবে। অর্থাৎ বাস্তবে আমরা যা প্রত্যক্ষ করি তার বাইরে গিয়ে বুঝতে হবে। আমাদের চর্মচক্ষুতে যা ধরা পড়ে, তার নিরিখে বিচার করলে সেই সত্যকে বোঝা যাবে না, এক কথায় তা অনির্বচনীয়।

শূণ্য-এর ধারণাকে নাগার্জুন দুটো দিক থেকে বিচার করেছেন - দৃষ্টিগোচরতা এবং বাস্তবতা। দৃষ্টিগোচরতার নিরিখে এর অর্থ হল, বস্তুজগৎ বলে কিছু নেই; আছে শুধু শূণ্যতা এবং অস্তিত্বহীনতা। অন্যভাবে বললে বোঝায়, প্রকৃতি জগৎ আসলে অলীক, শূণ্যগর্ভ। একই সাথে পরম সত্য বা Absolute কে শূণ্যতা হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে, যার অর্থ এর কোনও বিকাশ ও প্রকাশ নেই, নেই বহুমুখিতা বা বৈচিত্র্য। বিকাশ ও প্রকাশ কিংবা বহুমুখিতা ও বৈচিত্র-ময়তা দৃষ্টিগোচর পৃথিবীর বৈশিষ্ট্য। এই সমস্ত গুণাবলী রহিত যে বাস্তবতা, তাকেই শূণ্যতা বলে বুঝতে হবে। এর অর্থ হল, পরম সত্য সম্পর্কে ধারণা জাগতিক ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সবরকমের জাগতিক ভাবনার সম্পূর্ণ বাইরে এর অবস্থান।

তিনি পরম সত্যের উপস্থিতি বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তিনি মনে করতেন যে, এই সত্যের অবস্থান মানুষের চেতনার উর্ধ্বে। যদিও এই সত্যের অবস্থান মানুষের সাধারণ চেতনার বাইরে, তবু একে একধরনের অলৌকিক সচেতনতার দ্বারা বোঝা সম্ভব, যাকে তিনি নাম দিয়েছিলেন প্রজ্ঞা-পারমিতা বা অতীন্দ্রিয় সর্বোচ্চ জ্ঞান। এটা অর্জন করার অর্থ হল কল্পিত বস্তুজগৎ থেকে মুক্তি বা নির্বাণ লাভ।

যোগাচার্য দর্শন বা বিজ্ঞানবাদ

মাধ্যমিক দর্শনের প্রভাব পরবর্তী কয়েক শতকে পাওয়া যায় না। নাগার্জুন এবং আর্যদেবের পর এই সময়কালে এই দর্শন সম্পর্কে বিশেষ কিছু শোনা যায় না। ষষ্ঠ শতাব্দীতে দুজন গুরুত্বপূর্ণ শূণ্যবাদী দার্শনিকের সন্ধান পাওয়া যায় – বুদ্ধপালিত এবং ভববিবেক। মধ্যবর্তী এই সময়কালে ভাববাদী দর্শনের অগ্রগতি ঘটেছে মহাযান বৌদ্ধদের আর এক সম্প্রদায় যোগাচার্য সম্প্রদায়ের হাত ধরে। তাদের মতবাদকে বলা হয় বিজ্ঞানবাদ বা বিজ্ঞপ্তি-মাত্ৰতা-বাদ বা নিরালম্বনবাদ।

মহাযান বৌদ্ধদের এই সম্প্রদায় নিজেদেরকে যোগাচার্য হিসাবে পরিচয় দিয়েছে। কারণ তাঁরা দার্শনিক প্রজ্ঞা অর্জনের জন্য বহির্জগৎ থেকে চেতনাকে সরিয়ে নেওয়ার উপায় হিসাবে যোগ বা ধ্যানের আশ্রয় নিয়েছিলেন। বাস্তব জগতের বন্ধন থেকে মুক্তির উপায় হিসাবে ধ্যান ও সম্মোহনের অর্থে যোগের কার্যকারিতা নিয়ে যোগাচার্যদের বহু লেখাপত্র পাওয়া যায়।

কিন্তু তাদের দার্শনিক মতবাদ সম্পর্কে আরও পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় বিজ্ঞান-বাদ বা বিজ্ঞপ্তি-মাত্ৰতা-বাদ নাম থেকে। বিজ্ঞান বা বিজ্ঞপ্তি বলতে মন বা চেতনাকে বোঝানো হয়েছে। এই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মতে মন হল চেতনার স্রোত বা আরও সহজ করে বললে ক্ষণস্থায়ী চেতনার প্রবাহ। বিজ্ঞানবাদীদের মধ্যে এই অর্থে মনই হল সত্য বা কেবলমাত্র চেতনাই হল সত্য। স্বাভাবিকভাবেই এই দর্শনের মূল ঝোঁক হল বস্তুজগৎকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করার দিকে। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, ঘরবাড়ী - এগুলোর বাস্তব অস্তিত্ব আছে এবং এজন্যই এ সম্পর্কে ধারণা গড়ে ওঠে। কিন্তু এই দার্শনিকদের মতে কেবলমাত্র ভাবেরই অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু ধারণা বা চিন্তার অনুসারী কোনও বাস্তব জিনিসের অস্তিত্ব নেই। সংক্ষেপে, সমস্তটাই হল মানসিক।

বিষয়টাকে তাঁরা আর একভাবে বলেছেন। তাঁদের মতে ভাব বা চেতনা তাদের নিজস্ব শক্তিতেই অবস্থান করে – কোনও বস্তুগত উপাদানের সাহায্য ছাড়াই। তাই এই দর্শনকে নিরালম্বনবাদও বলা হয়ে থাকে - এর অর্থ ভাব বা চেতনার জন্য কোনও বস্তুগত জিনিসের অবলম্বনের প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ ভাব বা চেতনা হল স্বয়ম্ভূ। বস্তুজগতের কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই। যেহেতু ভাবই হল একমাত্র বাস্তবতা, তাই সাধারণভাবে যে বস্তুজগৎকে আমরা দেখি তা অবাস্তব বা ভ্রমাত্মক।

বস্তুজগৎ সম্পর্কে ভারতীয় ভাববাদীদের একটা সাধারণ যুক্তি আমরা এখানে পাচ্ছি। তাদের বিচারে বস্তুজগৎ সম্পূর্ণরূপেই অবাস্তব। কিন্তু বাস্তবে মানুষ তাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় বস্তুজগৎকেই প্রত্যক্ষ করে। এর ব্যাখ্যা কী হবে? ভাববাদীরা এর উত্তরে বলেন, বস্তুজগৎটা হল মায়া বা ভ্রম দর্শন - যেমন করে রজ্জুতে সর্পভ্রম হয়, বা মরীচিকায় জল দেখা যায়।

আর একভাবে ভাববাদীরা বস্তুজগৎকে ব্যাখ্যা করেছেন। আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় পাওয়া বস্তুজগৎকে তাঁরা স্বপ্ন-দর্শনের সাথে তুলনা করেছেন। স্বপ্ন দর্শন সম্পূর্ণরূপেই মনের ক্রিয়া - সম্পূর্ণরূপেই ভাবের জগৎ, যদিও স্বপ্ন দেখার সময় একজন ভাবে যেন বাস্তবেই সেই ঘটনাটা ঘটছে বা বাস্তবেই তা অবস্থান করছে। তাই সাধারণ অভিজ্ঞতায় বস্তুজগৎকে প্রত্যক্ষ করার অর্থ এই নয় যে, বাস্তবে তার অস্তিত্ব আছে।

বিজ্ঞানবাদীদের এই বক্তব্য সম্পূর্ণ নতুন নয়। এর মূল যুক্তিধারা আমরা ইতিমধ্যেই উপনিষদে পেয়েছি। যেমন যাজ্ঞবল্ক্য যে যুক্তি দিয়ে বস্তুজগতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছেন তার সাথে এর মিল পাওয়া যায়। তিনি বস্তুজগতের অবাস্তবতাকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন এইভাবে - স্বপ্নে যে বস্তুজগৎকে দেখা যায় তা আত্মা বা মনেরই ক্রিয়া - মনই এ সবকিছুর স্রষ্টা। ফলে মূল চিন্তাগত উপাদান উপনিষদেই ছিল। বিজ্ঞানবাদীরা এই ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির একটা তত্ত্বগত ভিত্তি দিয়েছেন। কিন্তু উপনিষদের কাছে তাঁরা ঋণ স্বীকার করেন নি। কেমন করেই বা তাঁরা প্রকাশ্যে ঋণ স্বীকার করবেন? কারণ তাঁরা ঘোষিতভাবে বৌদ্ধ ধর্মমতে বিশ্বাসী এবং বৌদ্ধদের কাছে উপনিষদ হল বিদেশী (alien) বা তীর্থিকা।

বিজ্ঞানবাদ ও শূণ্যবাদের সাদৃশ্য ও পার্থক্য

বিজ্ঞানবাদীরা শূণ্যবাদের সাথে তাদের মতপার্থক্যকে অনেক বড় করে দেখাতে চায়। কিন্তু বাস্তবে তাদের মধ্যে কতখানি পার্থক্য ও সাদৃশ্যই বা কতখানি তা বুঝে নেওয়া দরকার। মূল পার্থক্য হিসাবে যে বিষয়টা দেখানো হয়, তা হল, বিজ্ঞানবাদীরা মনকে নির্গুণ, নির্বিশেষ বিশুদ্ধ চেতনা হিসাবে বাস্তব বলে স্বীকার করে এবং একে আত্মপ্রকাশমান পরম সত্য বলে মনে করে - যৌগিক ধ্যানের মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞানের পথে বাধাগুলোকে দূর করে যার উপলব্ধি সম্ভব। অন্যদিকে শূণ্যবাদীরা মনের বাস্তব অস্তিত্বকেই সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। অর্থাৎ বিজ্ঞানবাদীদের বক্তব্য ইতিবাচক, কিন্তু শূণ্যবাদীদের বক্তব্য নেতিবাচক। এটা ঠিক যে, শূণ্যবাদীদের বক্তব্যে মনের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এটা তাদের করতে হয়েছে বস্তুজগতের বাইরে অবস্থিত Absolute-এর একমাত্র অস্তিত্বকে রক্ষা করার জন্য, যে Absolute কে শূণ্যবাদীরা রহস্যজনকভাবে (mystically) বোঝা যায় বলে মনে করে। বিষয়টি দার্শনিক কুমারিল পরিষ্কার করে বলেছেন – “যোগাচার্য দার্শনিকরা বাস্তব জগত নিরপেক্ষভাবে ভাবের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে, কিন্তু মাধ্যমিক দার্শনিকরা ভাবের অস্তিত্বকেও অস্বীকার করে। আবার এই দুটি মতবাদই বাস্তব জগতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে।”

ফলে বিজ্ঞানবাদী ও শূণ্যবাদীরা তাদের পারস্পরিক পার্থক্যকে যত বড় করেই দেখাক না কেন, দার্শনিক বিচারে সেই পার্থক্য মৌলিক পার্থক্য নয়। এই দুটি ভাববাদী দর্শনেরই মূল উদ্দেশ্য হল বস্তুজগতের বাস্তব অস্তিত্বকে অস্বীকার করা এবং বস্তুজগৎকে এক ধরনের ভ্রম হিসাবে দেখা। এই আত্মা বা চৈতন্যের অতীন্দ্রিয় উপলব্ধির পথ হিসাবে দুটি দর্শনেই মুক্তি বা নির্বাণের কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও দুটি দর্শনেই দুধরনের সত্যের কথা বলা হয়েছে - 'আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত তথাকথিত বাস্তব জ্ঞান' এবং 'সর্বোচ্চ দার্শনিক জ্ঞানের প্রকাশ হিসাবে পরম সত্য সম্পর্কে জ্ঞান।' এই বক্তব্যের ভিত্তিতে শূণ্যবাদী ও বিজ্ঞানবাদী উভয়েই দ্বৈত সত্যের ধারণায় উপনীত হয়েছেন, যাকে তাঁরা নাম দিয়েছেন 'সম্বৃতি-সত্য' এবং 'পরমার্থ-সত্য'। প্রথমটি হল ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত সত্য এবং দ্বিতীয়টি হল পরম সত্য বা আধিভৌতিক সত্য (metaphysical truth)।

শূণ্যবাদ ও বিজ্ঞানবাদে বিশ্বাসী দার্শনিক শেষপর্যন্ত মৌলিক বিষয়ে তাদের ঐক্যমতের কথা স্বীকার করেন এবং তাদের আপাত পার্থক্যগুলো সরিয়ে রাখতে সমর্থ হন। খ্রিস্টিয় অষ্টম শতাব্দীতে শান্তরক্ষিত এবং তাঁর শিষ্য ও ব্যাখ্যাকার কমলশীল এই ঐক্য সম্পন্ন করেন, যাঁদেরকে মাধ্যমিক এবং যোগাচার্য দর্শনের সমন্বয়কারী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে । এরই সাথে সাথে আর একটি ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। এই সমন্বয়ের পর শান্তরক্ষিত অনুভব করেন যে, মহাযান বৌদ্ধদের উপনিষদের অনুগামীদের সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কোনও বাস্তব পরিস্থিতি নেই। কারণ এই দুই দার্শনিক মতই বস্তুজগতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে এবং বিশুদ্ধ ভাব বা চৈতন্যকেই একমাত্র ও পরম সত্য বলে স্বীকার করে।

বিজ্ঞানবাদ ও শূণ্যবাদের মধ্যে মৌলিক সমন্বয় স্থাপন এবং উপনিষদীয় ভাববাদের সাথে সাদৃশ্য স্বীকারের পর মহাযান বৌদ্ধদের দর্শনচিন্তা তার শেষ গন্তব্যে পৌঁছে গেল। দর্শনচর্চায় আগ্রহ কমে যাওয়ার পর তারা মুক্তিলাভের সহজপন্থা অন্বেষণে বেশি করে মনোনিবেশ করল। তারা মনে করল প্রাচীন মন্ত্রতন্ত্র ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বা তন্ত্রসাধনার মধ্য দিয়ে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। পরবর্তী কয়েক শতকে একদিকে যেমন এই প্রবণতা অনেক বেড়ে গেল, আবার অন্যদিকে শংকরাচার্যের অদ্বৈতবাদী ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আক্রমণ তীব্র হল এবং তাদের হাতে বৌদ্ধ মঠগুলি ধ্বংস হয়ে গেল। ফলে বৌদ্ধদর্শনের স্বতন্ত্র অস্বিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ল।

উপনিষদীয় ভাববাদী দর্শন : অদ্বৈত বেদান্ত

বৌদ্ধদর্শনের ক্ষয় হওয়ার অর্থ এই নয় যে, ভারতীয় ভাববাদের অবসান হয়ে গেল। শূণ্যবাদ ও বিজ্ঞানবাদ সংহত হওয়ার পর একটা সময় এসে গেল, যখন ভারতীয় ভাববাদ তার আদি উৎস উপনিষদে ফিরে গেল। যদিও মহাযান বৌদ্ধরা ভাববাদী দর্শনচিন্তাকে যেখানে পুষ্ট করেছিল, সেগুলোকে নিয়েই উপনিষদীয় ভাববাদ তার যাত্রা শুরু করেছিল। খ্রিস্টিয় অষ্টম শতকে এটা দানা বাঁধতে থাকে এবং 'অদ্বৈত বেদান্ত'-র রূপে তার প্রকাশ ঘটে। Stcherbatsky এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, "we see in the next period the old Vedanta remodelled and equipped with fresh arguments by an adaptation to it of the methods elaborated in the Vijnan-vada and Sunya-vada schools of Buddhism."

তাই অদ্বৈত বেদান্ত সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে হলে এর দ্বৈত উৎস সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকতে হবে। ভারতীয় ঐতিহ্যে উপনিষদের একদল রক্ষণশীল অনুগামী অদ্বৈত বেদান্তকে ছদ্ম বৌদ্ধমত বলে (Buddhism in disguise) বর্ণনা করেছেন। অদ্বৈত বেদান্তকে এভাবে ব্যাখ্যা করার পেছনে গোষ্ঠী মানসিকতা কাজ করেছে। এভাবে ব্যাখ্যা করা ভুল, কারণ মহাযান বৌদ্ধমতের থেকে বহুকিছু গ্রহণ করলেও অদ্বৈত বেদান্তের মূল দৃঢ়ভাবে প্রোথিত আছে উপনিষদের মধ্যে। অদ্বৈত বেদান্তের মূল যে উপনিষদের মধ্যে প্রোথিত আছে, তা প্রমাণ করার জন্য এই দর্শনের প্রধান প্রবক্তা শংকরাচার্য তাঁর দার্শনিক মতের সমর্থনে উপনিষদ থেকে উদ্ধৃত করেছেন। শুধু তাই নয়, প্রধান উপনিষদগুলির ভাষ্য রচনা করেছেন। প্রথম মতের সম্পূর্ণ বিপরীতে শংকরের মতে অদ্বৈত বেদান্ত হল উপনিষদের চিন্তাকে ভিত্তি করে একমাত্র দর্শন। এই বক্তব্যও অতিরঞ্জনে দুষ্ট।

বাস্তবটা কী? বাস্তবে উপনিষদে ভাববাদী-চিন্তা প্রাথমিক এবং সরলীকৃতরূপে ছিল, ভাববাদী-দর্শনের উপাদান হিসাবে ছিল। কিন্তু একটা সুললিত ও সুসংবদ্ধ দার্শনিক মতবাদ হিসাবে ছিল না। মহাযান বৌদ্ধসম্প্রদায়ের দার্শনিকরা ঐতিহাসিকভাবে প্রথম এই উপাদানগুলিকে ভিত্তি করে সুসংবদ্ধ দার্শনিক মতবাদের জন্ম দিয়েছিলেন। অদ্বৈত বেদান্তবাদীরা এই মতবাদ মহাযান বৌদ্ধদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন। যদিও হুবহু কপি করে নয়। অদ্বৈত বেদান্তবাদীরা তাঁদের মতো করে কোথাও বেশি জোর দিয়েছেন, কোথাও নতুন পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। সেই অর্থে মহাযান বৌদ্ধসম্প্রদায় যেমন উপনিষদের কাছে ঋণী, তেমনি অদ্বৈত বেদান্তবাদীরা মহাযান বৌদ্ধসম্প্রদায়ের কাছে ঋণী। কিন্তু নিজেদের গোষ্ঠী মানসিকতার জন্য কেউই কারোর কাছে ঋণ স্বীকারে প্রস্তুত নয়। আগেই বলেছি, খ্রিস্টিয় অষ্টম শতাব্দীতে মহাযান বৌদ্ধ দার্শনিক শান্তরক্ষিত এই মত ব্যক্ত করেছিলেন যে, শূণ্যবাদ ও বিজ্ঞানবাদের মধ্যে পার্থক্য যেমন মামুলি, তেমনি এই দুই দর্শনের সাথে অদ্বৈত বেদান্তের মধ্যে পার্থক্যও তুচ্ছ, মৌলিক ধরনের নয়। এই বিষয়টাই উপলব্ধি করেছিলেন গৌড়পাদ, যিনি অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের প্রথম প্রকৃত প্রতিনিধি। তাঁর সময়কালও শান্তরক্ষিতের সমসাময়িক - খ্রিস্টিয় অষ্টম শতক। অর্থাৎ মহাযান বৌদ্ধদের শেষ প্রসিদ্ধ দার্শনিক শান্তরক্ষিত যেমন উপনিষদের সাথে তাঁর দর্শনচিন্তার নৈকট্য ব্যক্ত করেছিলেন, তেমনি অদ্বৈত বেদান্ত সম্প্রদায়ের প্রথম প্রসিদ্ধ প্রতিনিধি গৌড়পাদ মহাযান বৌদ্ধদের সাথে তাঁর দার্শনিক মতবাদের সাদৃশ্যের কথা ব্যক্ত করেছেন।

ভারতীয় ভাববাদী দর্শনের পরবর্তী ইতিহাসে অদ্বৈত বেদান্তই সবচেয়ে প্রভাবশালী দর্শন হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। কারণ এই সময় মহাযান বৌদ্ধসম্প্রদায়ের মধ্যে, বিশেষ করে শান্তরক্ষিতের পর দর্শনচর্চায় আকর্ষণ ভীষণভাবে কমে যায়। পরবর্তীকালে অদ্বৈত বেদান্তের প্রভাব বেড়েছিল শংকরের ভূমিকার দ্বারা। তিনি হয় গৌড়পাদের প্রত্যক্ষ শিষ্য, অথবা তাঁর শিষ্যের শিষ্য। কেরালার একটি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর দর্শনচিন্তা প্রচারের জন্য তিনি সারা ভারত ভ্রমণ করেছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ভারতের চারপ্রান্তে চারটি আশ্রম বা মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই মঠগুলিতে শংকর বৌদ্ধমঠের সাংগঠনিক নিয়ম-নীতি প্রয়োগ করেছিলেন। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল পূর্ণ সময়ের ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তার প্রচারক রাখার বিধি। তার সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে এই মঠগুলি গড়ে তোলা ও তা পরিচালনার জন্য আর্থিক সংস্থান সংগ্ৰহ করার ক্ষেত্রে তিনি যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এর পাশাপাশি তিনি তাঁর দার্শনিক চিন্তা অদ্বৈত বেদান্তকে ব্যাপক মানুষের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য বহু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সহজ সংস্কৃত গদ্যে সহজ করে দার্শনিক বিষয়ে লেখার ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে তুলনীয় ভূভারতে আর কেউ ছিল না। কিন্তু তিনি বেশিদিন বেঁচে থাকেন নি। 788 খ্রিস্টাব্দে মাত্র 32 বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন।

যে বিষয়ে সত্যিই বিতর্কের কোনও সুযোগ নেই, সেটা হল তাঁর দার্শনিক দক্ষতা। যদিও তিনি উপনিষদীয় ভাববাদকে উন্নত আঙ্গিকে পূণর্ব্যাখ্যা করেছিলেন, তার মধ্যে এমন কোনও মৌলিক বিষয় ছিল না, যা তিনি মহাযান বৌদ্ধদের কাছ থেকে গ্রহণ করেন নি, কিন্তু শংকর নিজে এই নেওয়াটাকে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও অবজ্ঞাসূচক মন্তব্যের দ্বারা। বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে তিনি যেসব অভিযোগ এনেছেন, দেখা গেছে যে সেই একই বক্তব্য তিনি অনেক বেশি জোরের সাথে প্রচার করেছেন। তিনি ঘৃণাভরে মন্তব্য করেছেন যে, শূণ্যবাদীদের সাথে দার্শনিক আলোচনা করার কোনও উপযোগিতাই নেই, কারণ বাস্তব জ্ঞানের কোনও উৎস সম্পর্কে তাদের কোনও বিশ্বাস নেই এবং যারা কোনও যুক্তির ধার ধারে না, তাদের সাথে কীভাবে দর্শন আলোচনা করবেন? অথচ বাস্তবে জ্ঞানের অস্বীকৃতি এবং সাধারণভাবে যুক্তির অস্বীকৃতি হল শংকরের নিজের দার্শনিক মতের ভিত্তি। এমনকী তিনি তাঁর দার্শনিক আলোচনা শুরুই করছেন এটা ঘোষণা করেই যে, তিনি যে দার্শনিক প্রজ্ঞার প্রতিনিধিত্ব করছেন সেখানে কোনও প্রকারের প্রমাণ বা বাস্তব জ্ঞানের কোনও স্থান নেই। তাঁর মতে শ্রুতি-স্মৃতির উপর নির্ভর না করে স্বাধীন যুক্তি-তর্কের প্রতি যে কোনও প্রবণতাই অজ্ঞানের কুহেলিকায় দিশেহারা হতে বাধ্য। আবার বিজ্ঞানবাদীদের বিরুদ্ধে বলেছেন যে, তারা তাদের নিজের মায়ের বন্ধ্যাত্ব প্রমাণ করতে চায়; কারণ তারা খাদ্য খেয়েই বেঁচে থাকে, আবার সেই খাদ্যের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। অথচ তাঁর নিজের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি দার্শনিকরা যে খাবার খায়, বস্তুজগতের অন্যান্য জিনিসের মতো সেই খাদ্যবস্তুকেও মায়া বলেই ব্যাখ্যা করেছেন। এবং বিজ্ঞানবাদীদের মতো তাঁর কাছেও এর কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই। এই ঘটনা তুর্গেনেভের উপন্যাসের সেই চালিয়াতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যে বলেছিল, "তোমার নিজের যত কুকর্ম আছে তাকে চাপা দিতে হলে সেগুলোর বিরুদ্ধেই তুমি বেশি করে বলো।" শংকরের আধুনিক অনুগামীরা তাঁর অবস্থানকে রক্ষা করার জন্য বলেন যে, ব্যবহারিক জীবনের অর্থে তিনি যুক্তি বা বস্তুজগতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন না। শুধুমাত্র অতীন্দ্রিয় দৃষ্টিকোণ থেকে এদের সত্যতাকে অস্বীকার করেছেন। কিন্তু বাস্তবে এই দ্বৈত সত্যের ধারণাটিও মহাযান দার্শনিকদের উদ্ভাবন, শংকরের মৌলিক উদ্ভাবন নয়।

এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। শংকরের কয়েক শতাব্দী পরে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতার মনোভাব ধীরে ধীরে চলে যায়। মহাযান বৌদ্ধ দার্শনিকরা অদ্বৈত বেদান্তবাদীদের সাথে মতৈক্যে পৌঁছে যায়। যেমন দ্বাদশ শতাব্দীর বেদান্তবাদী শ্রীহর্ষ অদ্বৈত বেদান্তের অবস্থানকে সুদৃঢ় করার জন্য নাগার্জুনের অনস্তিত্বের ধারণাকে পুনর্জাগরিত করেন এবং বলেন, "তাঁর দার্শনিক মতের সাথে মাধ্যমিক বৌদ্ধদের মতের পার্থক্য অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর।"

ভারতীয় ভাববাদী দর্শনের ইতিহাসে এরপর আমরা দেখেছি যে, অদ্বৈত বেদান্তবাদীরা মায়া বা অবিদ্যা, যা বস্তুজগতের ছদ্ম প্রকাশের মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করে - সে বিষয়ে নানা ধরণের দার্শনিক আলোচনা করেছেন।

তাহলে এতক্ষণ ভারতীয় ভাববাদী দর্শনের যে রূপরেখা দেওয়া হল তা থেকে আমরা কী পেলাম? এদেশের ইতিহাসে প্রথম অনুমান-মূলক চিন্তা বা ভাববাদী চিন্তার উপাদান পাওয়া যায় উপনিষদে। কিন্তু তখনও সুসংহত দার্শনিক তত্ত্বের উদ্ভব হয়নি। ভাববাদী চিন্তার যে অঙ্কুর উপনিষদে ছিল তাকে পূর্ণাঙ্গ দার্শনিক তত্ত্বের রূপ দেন শূণ্যবাদী ও বিজ্ঞানবাদী দার্শনিকরা, যাঁরা মহাযান বৌদ্ধসম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং শেষপর্যন্ত তা পুনর্প্রতিষ্ঠিত করেন অদ্বৈত বেদান্তবাদীরা, যাদের মায়াবাদীও বলা হয় এবং যারা নিজেদেরকে উপনিষদের প্রত্যক্ষ অনুগামী বলে পরিচয় দেন।

বিষয়টাকে আর একভাবে বলা যায়। উপনিষদে শুধু ঘোষণা করা হয়েছিল যে একমাত্র আত্মা বা চৈতন্যই সত্য, আর কিছু নয়। পরবর্তীকালে ভাববাদী দার্শনিকদের উপর এই বক্তব্যকে প্রমাণ করার দায়িত্ব এসে পড়ে। ভাববাদী দার্শনিকরা যে পদ্ধতিতে এই বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন, তাতে তাদের মৌলিক বক্তব্যের মধ্যে কোনও পার্থক্য ছিল না। পার্থক্য ছিল মূলত পরিভাষায়। শূণ্যবাদীদের কাছে বস্তুজগতের কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই, সবই শূণ্য বা অস্তিত্বহীন। বিজ্ঞানবাদীদের কাছে বস্তুজগৎ হল অলীক, যা নিছক কল্পনা, যাকে তাঁরা বলেছেন কল্প বা বিকল্প। আর অদ্বৈত বেদান্তবাদীরা দাবি করেন যে, এই বস্তুজগৎকে যে আমরা দৃশ্যমান দেখি, তা আমাদের অজ্ঞানতার ফল, যাকে তাঁরা বলেছেন অবিদ্যা বা মায়া। অর্থাৎ সমস্ত ভাববাদীদের বক্তব্যের পার্থক্য শুধু পরিভাষায়, কিন্তু মূল বক্তব্য একই - বস্তুজগতের অস্তিত্ব নেই।

জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে ভাববাদী দর্শন অন্তরায় কেন

জ্ঞান বলতে আমরা কী বুঝি? জ্ঞান বলতে বুঝি বস্তুজগতের জ্ঞান। বস্তুজগৎ, সমাজজীবন - এককথায় যা কিছুই আমাদের চেতনা নিরপেক্ষভাবে অবস্থান করছে তাকেই আমরা আমাদের চেতনা দিয়ে, বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে জানবার, বোঝবার চেষ্টা করি। আমরা জানি, সবকিছুই নিয়মে চলে, যে নিয়ম আমরা কেউ সৃষ্টিও করতে পারি না, কেউ ধ্বংসও করতে পারি না। মানুষ তার উন্নত মস্তিষ্কের সাহায্যে বস্তুজগতের সেই অন্তর্নিহিত নিয়মকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করে চলেছে এবং এভাবেই সে নিয়মকে জানছে। এই জানার ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হল বিজ্ঞান।

এখন বস্তুজগৎ সম্পর্কে ভাববাদী দর্শনের ধারণা কী? প্রথমত, ভাববাদী দর্শন মনে করে বস্তুজগতের বাস্তব কোনও অস্তিত্বই নেই, সবই মায়া বা অলীক কল্পনা । তাই বস্তুকে যদি বাদ দেওয়া যায়, তাহলে সমগ্র বস্তজগৎকে অবাস্তব বা মায়া বলে প্রমাণ করতে কোনও অসুবিধা হয় না ।

বস্তুর অস্তিত্বের সমর্থনে ভারতীয় দর্শনের প্রধানত তিনটি মতবাদ পাওয়া যায় - (i) চতুৰ্ভূত, অর্থাৎ পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বাতাস - এগুলো দিয়েই বস্তুজগৎ গঠনের তত্ত্ব। এই তত্ত্বটি প্রধানত লোকায়ত দর্শনের সাথে যুক্ত। (ii) প্রধান বা প্রকৃতির তত্ত্ব, যার অর্থ প্রকৃতি হল আদি বস্তু, যা থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে। এই ভাবনা সাংখ্য দর্শনের সাথে যুক্ত। (iii) পরমাণুর তত্ত্ব, যার অর্থ বস্তুজগৎ ক্ষুদ্রতম কণা পরমাণু দ্বারা গঠিত। ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে অনেক দার্শনিক এই মত পোষণ করলেও সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দার্শনিক মতবাদ হল ন্যায় বৈশেষিক।

তাই দেখা যায় বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে এই তিনটি মতবাদ খণ্ডনের জন্য ভাববাদীরা অবিরাম প্রয়াস চালিয়েছেন। তাই যতই ভাববাদী দর্শনের প্রভাব বেড়েছে ততই বস্তু সম্পর্কে আগ্রহ কমেছে, তার অন্তর্নিহিত নিয়ম জানার আগ্রহ ও প্রচেষ্টা কমেছে, বিজ্ঞানচর্চার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। ভাববাদী দার্শনিকদের মধ্যে শংকরাচার্য সবচেয়ে সহজভাবে, অর্থাৎ সহজবোধ্যভাবে বস্তুবাদী ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধে তাঁর দার্শনিক মত প্রচার করেছেন। তাই দেখা যায়, যে প্রাচীন ভারতে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা হয়েছে, সেই যুগের পরিপ্রেক্ষিতে তখনকার বিদ্বান ব্যক্তিরা বহু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেছেন, সেই ভারতে শংকরের পর জ্ঞানচর্চার পরিবেশ স্তিমিত হয়েছে।

ভাববাদের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল, অভিজ্ঞতা এবং যুক্তিকে বাতিল করা। শংকর তাঁর দার্শনিক রচনার শুরুই করছেন এই কথা বলে যে, অভিজ্ঞতা ও যুক্তির কোনও কার্যকারিতা নেই। প্রকৃত জ্ঞানের উৎস যে বাস্তব অভিজ্ঞতা, শংকর তাকে নাকচ করেছেন। ভারতীয় পরিভাষায় এর অর্থ হল, প্রকৃত জ্ঞানের উৎস হল 'প্রমাণ' এবং বস্তুবাদী দার্শনিকরা বলেছেন যে, প্রমাণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল প্রত্যক্ষ প্রমাণ বা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। জ্ঞানের দ্বিতীয় উৎস হল অনুমান, পুরাতন কোনও অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে অনুমান। শংকর এই দুধরনের প্রমাণকেই নস্যাৎ করেছেন। কারণ যে বস্তুজগৎ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বা অনুমানের কথা বলা হচ্ছে, শংকরের মতে তার তো কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই, সেটা অবিদ্যা বা মায়া। তাই এধরনের প্রমাণ তো একজনকে অজ্ঞানতায় নিমজ্জিত করবে। স্পষ্টতই এই চিন্তাধারা কাউকে কি বস্তুজগতের নিয়ম আবিষ্কারের অর্থে যে জ্ঞানচর্চা, তাতে উদ্বুদ্ধ করবে? শুধু তাই নয়, ভাববাদী দার্শনিকদের আর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট হল - তাঁরা কার্য-কারণ সম্পর্কের ধারণাকে বাতিল করেছেন। কার্য-কারণ সম্পর্কের ধারণাকে বাতিল করার জন্য প্রথম যে বক্তব্য দিয়ে শুরু করেছেন, সেটা এইরকম - যা কোনোদিনই বাস্তবায়িত হবে না, তাকে অবাস্তব বলে ধরতে হবে। ভাববাদী দার্শনিকরা বন্ধ্যা নারীর সন্তানের সাথে একে তুলনা করেছেন। এর অর্থ যাকে বাস্তব বলে ধরে নেওয়া হবে, তাকে ভবিষ্যতে কোনও না কোনও সময় পরিস্ফুট হতে হবে (coming into being)। তাই যদি কোনও কিছুর বাস্তবে পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে তা ঐ বন্ধ্যা নারীর ছেলের মতোই অবাস্তব হবে।

এই যুক্তিধারার ভিত্তিতে নাগার্জুন এবং তাঁকে অনুসরণ করে গৌড়পাদ ও শংকর coming into being - এর ধারণাকে নস্যাৎ করার মাধ্যমে বস্তুজগৎকে অবাস্তব প্রতিপন্ন করার প্রয়াস করেছেন। কীভাবে করেছেন তার বিস্তৃত বিবরণ দেওয়ার সুযোগ একটি প্রবন্ধের পরিসরে দেওয়া সম্ভব নয়।

বস্তুজগতের কোনও কিছুই coming into being - এই ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় - এটা তাঁরা তাঁদের দার্শনিক যুক্তি বিচারের মাধ্যমে 'প্রমাণ' করেছেন। এর অর্থ হল কার্য-কারণ সম্পর্কের ধারণাকে বাতিল করা। অর্থাৎ এই পৃথিবীতে কোনও কিছুরই 'কারণ' নেই, কোনও কিছুই নতুন করে তৈরি হয় না এবং সেজন্যই তা অবাস্তব। নাগার্জুন বিষয়টিকে এভাবে বলেছেন - 'কারণ মুক্ত এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমরা কোনও কিছুই ধারণা করতে পারি না।'

এমনকী গৌতম বুদ্ধের 'প্রতীত্য-সমুৎপাদের' তত্ত্ব, যার মূল বক্তব্য হল সমস্ত প্রকৃত বস্তুরই একটা কারণ আছে, সেই তত্ত্বকে বিকৃত করে মাধ্যমিক বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন প্রমাণ করতে প্রয়াসী হয়েছেন যে, যার পেছনে কোনও কারণ থাকে, তা অবাস্তব হতে বাধ্য। তিনি একদিকে যেমন কার্য-কারণ সম্পর্কের সমর্থনে যে দুটি দার্শনিক মতবাদ রয়েছে, অর্থাৎ সৎকার্যবাদ (সাংখ্য) এবং অসৎকার্যবাদ (ন্যায় বৈশেষিক) ব্যাখ্যা করেছেন, এবং তাদের খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন, তেমনি causality সম্পর্কে বুদ্ধের তত্ত্বকে নতুন করে ব্যাখ্যা করে কার্য-কারণ সম্পর্কের ধারণাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছেন।

আমরা জানি কার্য-কারণ সম্পর্কের ধারণা বা law of causality বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে একটা বুনিয়াদি পদ্ধতি। ফলে এইদিক থেকেও ভাববাদী দর্শন বিজ্ঞানচর্চার পথে প্রভূত অন্তরায় সৃষ্টি করেছে।

ভাববাদীদের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল তত্ত্ব ও ক্রিয়ার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান সৃষ্টির প্রয়াস। বাস্তব অভিজ্ঞতাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে গিয়ে তাঁরা দ্বৈত সত্যের ধারণার আশ্রয় নিয়েছেন - সম্বৃতি সত্য বা ব্যবহারিক সত্য এবং পারমার্থিক সত্য। ব্যবহারিক সত্যকে তাঁরা সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে না পারলেও তাকে যথার্থ বাস্তবতার স্বীকৃতি দিতে পারেন নি, ফলে শেষপর্যন্ত ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার কোনও মূল্য তাদের কাছে নেই। তাই তত্ত্ব ও ক্রিয়ার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান ভাববাদী দর্শনের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য হিসাবে থেকে গিয়েছে, যা বিজ্ঞানচর্চায় বাধা সৃষ্টি করেছে। বাস্তবে আমরা দেখেছি, অষ্টম - নবম শতাব্দীতে শংকরাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত বা মায়াবাদের প্রবল জোয়ারের সময় প্রকৃত জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল।

উপসংহার

ভারতের দর্শনচর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ। যুগে যুগে বহু চিন্তাবিদের আবির্ভাব হয়েছে, যাঁরা সমাজে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন চিন্তার উপাদানকে সুসংহত দার্শনিক চিন্তায় রূপদান করেছেন। একটা প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে তার সবকিছু অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। তাই বিভিন্ন চিন্তাধারার প্রধান প্রবনতাকে ভিত্তি করে মূল বিষয়টিকে বলবার চেষ্টা হয়েছে। আবার এক একজন দার্শনিক তাঁর নিজের দার্শনিক মতকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অন্য মতকে খণ্ডন করার উদ্দেশ্যে যেসব যুক্তিজাল বিস্তার করেছেন তাও বেশ সমৃদ্ধ।

দার্শনিক চিন্তার বিকাশের বিভিন্ন পর্বে এই চিন্তাগুলি বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। কখনও দার্শনিক চিন্তা বিজ্ঞানচর্চায় সহায়ক হয়েছে, আবার কখনও বিজ্ঞানচর্চায় তা অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। এসম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে আলোচনাও করেছি।

এখন কালাণুক্রমে এই চিন্তাগুলো কীভাবে বিজ্ঞানচর্চায় প্রভাব বিস্তার করেছে, তা সংক্ষেপে আলোচনা করব। বৈদিক যুগেই জ্ঞানচর্চার লিখিত রূপ আমরা প্রথম পাই। তাই বৈদিক যুগের জ্ঞানচর্চার কথা দিয়েই শুরু করা যায়। বৈদিক যুগের ব্যাপ্তি প্রায় এক হাজার বছর। প্রকৃতপক্ষে এই যুগের প্রথমভাগে মননক্রিয়ার যে ব্যাপক চর্চা ও উৎকর্ষ হয়, শেষভাগে তার ধারা অনেকাংশে ক্ষীণ হয়ে পড়ে। প্রধানত, বেদের সংহিতা অংশগুলি এই প্রথমভাগে রচিত হয়। ঋকবেদ সংহিতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখনীয়। আর শেষভাগে ক্রমে ক্রমে রচিত হয় ব্রাহ্মণ অংশগুলি, উপনিষদ ও সূত্র সাহিত্য।

সংহিতার রচনাকালে ভারতীয় আর্য সমাজে বৃত্তি অবলম্বনের ব্যাপারে কোনও রকমের বাধ্যবাধকতা ছিল না। প্রত্যেকেই নিজের নিজের রুচি ও সুযোগ সুবিধা অনুসারে স্বাধীনভাবে বৃত্তি নির্বাচন করত। দ্বিতীয়ত, এই সময় মানুষের চিন্তার প্রধান ধারা ছিল বস্তুতান্ত্রিক। ফলে এই যুগের মানুষ বস্তুর প্রকৃতি ও চরিত্র বোঝার জন্য বস্তুজগৎকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করেছেন। ফলে বস্তুর চরিত্র বহুক্ষেত্রে তারা বুঝতেও পেরেছেন। ঐ সময়েই ভারতীয়রা রাশিচক্র আবিষ্কার করেছেন, প্রথমদিকে 360 দিনে বছর গণনা করতেন, পরে 366 দিনে। বছরকে 6টি ঋতুতে ভাগ করেছিলেন। সম্ভবতঃ সূর্যের কর্কটক্রান্তিতে অবস্থানের সময়কে বছরের শুরু হিসাবে গ্রহণ করা হত। সূর্য ও চন্দ্র উভয়ের হিসাবেই মাস-গণনা ও পঞ্জিকা-প্রণয়ন হত। এছাড়াও জ্যোতির্বিজ্ঞানের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ তারা করেছিলেন। গণিতেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু আবিষ্কার এই সময়ই হয়।

কিন্তু পরবর্তীকালে বৈদিক সমাজের অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে। সমাজে এই সময়ে জাতিভেদ প্রথা প্রবল আকার ধারণ করে। জাতি ও বৃত্তি নির্নয় হত জন্মনির্ভর, কেবলমাত্র উচ্চবর্ণের পুরুষরাই বিদ্যাচর্চার অধিকার লাভ করত, এবং বিভিন্ন কারিগরি বৃত্তিগুলি নীচ বলে গণ্য হতে থাকে। সংহিতার সূত্রগুলিতে আর্যঋষিদের যে মুক্ত বুদ্ধি, সত্যসন্ধানী মনোভাব ও স্বাধীন চিন্তাধারার প্রতিফলন পাওয়া যায় ব্রাহ্মণাদি সাহিত্যে তার অভাব অত্যন্ত স্পষ্ট। বৈদিক যুগের শেষভাগে ঘোষণা করা হয় বেদ 'অপৌরুষেয়' অর্থাৎ তা মানুষের রচনা নয়। এই সময়ই উপনিষদে 'আত্মণ' বা 'ব্রহ্মণ'-এর ধারণা তৈরি হয়; বস্তুজগতের বাস্তবতা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। তাই দেখা গেছে, এই সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সকল শাখার মান অবনত হয়ে পড়েছে। বেদী নির্মাণের কাজে জ্যামিতি ও কাল নির্ধারণের জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রয়োজন থাকায় বিজ্ঞানের এই দুই শাখায় কিছুটা উন্নতি হলেও এই সময়ে বিজ্ঞানের সার্বিক উৎকর্ষ ব্যাহত হয়।

এর পরের সময়কালকে বেদোত্তর যুগ বলা হয়। সামাজিক ক্ষেত্রে শেষ বৈদিক যুগের শ্বাসরোধকারী পরিবেশের অবসান ঘটিয়ে চিত্তকে ভয়শূণ্য ও জ্ঞানকে মুক্ত করে যাঁরা বেদোত্তর যুগের সূত্রপাত করেন তাঁরা হলেন বেদ-বিরোধী ধর্ম-আন্দোলনের প্রবক্তা। নব-প্রচারিত ধর্মগুলির মধ্যে গৌতম বুদ্ধ প্রবর্তিত বৌদ্ধ ধর্ম ও মহাবীর জৈন প্রচারিত জৈন ধর্ম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম বেদের অভ্রান্ততা ও জাতিভেদ প্রথা অস্বীকার করে। এঁরা দুজনেই ছিলেন নিরীশ্বরবাদী। জাতিভেদ প্রথার অবসান ও বেদের অভ্রান্ততা অস্বীকার করে এই দুই ধর্মমত সমাজে মুক্ত চিন্তা বিকাশের পরিবেশ তৈরি করে এবং বেদের কর্তৃত্ব, বিশেষ করে উপনিষদ বা বেদান্তের কর্তৃত্ব খর্ব করে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার উপযোগী সমাজ পরিবেশ গঠনে সাহায্য করে। তাই পরবর্তী ছ'শ বছর উপনিষদের চিন্তার চর্চা হতে দেখা যায় না, তার বিপরীতে বেশ কয়েকটি বস্তুবাদী দর্শনের বিকাশ ঘটে। একে ভিত্তি করে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চারও বিকাশ ঘটে।

প্রথম-দ্বিতীয় শতাব্দীতে আমরা উপনিষদের চিন্তাকে ভিত্তি করে প্ৰথম দার্শনিক মতবাদের উদ্ভব হতে দেখি। কিন্তু সে মতবাদ বৈদিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাতে গড়ে ওঠেনি। বেদ বিরোধী ধারা বৌদ্ধ দার্শনিকদের চিন্তায় তার স্ফূরণ ঘটে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবও তখন অনেক স্তিমিত। এরপর খ্রিস্টিয় চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীতে বৌদ্ধ যোগাচার সম্প্রদায় ভাববাদী মতবাদ প্রচার করেন। কিন্তু খ্রিস্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যবর্তী সময়ে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুনরুত্থান শুরু হয়। এই সময়কালেই ভগবৎ গীতা রচিত হয়। ফলে বৌদ্ধ ধর্মের আগেকার প্রভাব কমতে থাকে। আবার এই সময় কয়েকটি বস্তুবাদী দর্শনেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ।(এই প্রথম পর্বে আলোচিত)। তাই সমাজে দুটি বৌদ্ধ ভাববাদী দর্শন চিন্তা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তাই দেখা যায় খ্রিস্টিয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত বিজ্ঞানচর্চা অব্যাহত থাকে। বেদোত্তর যুগেই ভারতীয়রা গণিতে শূণ্য ও ডেসিমেল সিস্টেম আবিষ্কার করেছে। ভারতীয় বিজ্ঞানী আর্যভট্টের চিন্তা ও পর্যবেক্ষণ প্রসূত কয়েকটি ফলাফল বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রাচীন জগতের শ্রেষ্ঠ অবদান হিসাবে সম্মানিত হওয়ার যোগ্য। তিনিই প্ৰথম পৃথিবীর আহ্নিক গতির কথা ঘোষণা করেন। আর্যভট্টের বেশ কয়েকজন শিষ্য ও অনুগামী পরবর্তীকালে বিশেষ খ্যাতির অধিকারী হন। তাঁদের মধ্যে লাটদেব, ভাস্কর, পাণ্ডুরঙ্গস্বামী, নিঃশঙ্ক প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

কিন্তু এরপর বিজ্ঞানচর্চায় ভাটা পড়ে যায়। আমরা আগেই দেখিয়েছি যে, অষ্টম-নবম শতাব্দীতে অদ্বৈত বেদান্তবাদী শংকরাচার্য মায়াবাদের ব্যাপক প্রচারের ফলে মানুষের মধ্যে বাস্তব জগৎকে জানার আগ্রহ চলে যেতে থাকে। ফলে এই সময়ের পর থেকে এদেশে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা স্তিমিত হতে থাকে।

তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বস্তুবাদী দার্শনিক মতবাদ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সদর্থক ভূমিকা পালন করে। এর বিপরীতে ভাববাদী দার্শনিক মতবাদ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে।□

লেখক পরিচিতি: শ্রী গৌড়ী একজন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক এবং ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির সর্ব-ভারতীয় কমিটির সহ-সভাপতি।

তথ্যসূত্র :

[1] ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে - দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, অনুষ্টুপ; 2010

[2] প্রাচীন ভারতে বস্তুবাদের চর্চা - ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি প্রকাশনা; 2014

[3] প্রাচীন ভারতের গণিতচিন্তা - রমাতোষ সরকার

[4] ভারতীয় দর্শন - দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, NBA, 2011

[5] A History of Indian Philosophy - Prof. Surendranath Dasgupta, 5 vols. Cambridge, 1922-55

[6] What is living and what is dead in Indian Philosophy - Debiprasad Chattopadhyay, New Delhi, 2010

[7] বৌদ্ধ দর্শন - রাহুল সাংকৃত্যায়ন, চিরায়ত প্রকাশন, 1999