বিভাগগুলি

হিমালয়ের পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের সরকারি পরিকল্পনা

Source: Uttarakhand State Disaster Management Authority

নীলেশ মাইতি

উত্তরাখণ্ডে সুড়ঙ্গ বিপর্যয়

উত্তরাখণ্ডে কেন্দ্রীয় সরকারের বহুল প্রচারিত চারধাম হাইওয়ে প্রকল্পের অংশ হিসাবে সিল্কিয়ারা থেকে বারকোট পর্যন্ত 42 কিলোমিটারের রাস্তাকে কমিয়ে 4 কিলোমিটার করার উদ্দেশ্যে জাতীয় সড়ক কতৃপক্ষের (NHAI) পরিকল্পনায় তৈরি হচ্ছিল একটি সুড়ঙ্গ। গত 11 নভেম্বর এই সুড়ঙ্গের একটি অংশে ধস নামে, আটকে পড়ে 41 জন শ্রমিক। সিল্কিয়ারার দিক থেকে প্রায় 2.5 কিলোমিটার সুড়ঙ্গ তৈরির কাজ প্রাথমিকভাবে প্রায় শেষ হয়েছিল। সুত্রের খবর সুড়ঙ্গের মুখ থেকে প্রায় 30 মিটার দুরত্বে ধস নামে। ধসের জায়গা থেকে প্রায় 60 মিটার ভিতরে এই শ্রমিকদের চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে 17 দিন কাটাতে হয়েছে। ধ্বংসস্তূপে পাইপ ঢুকিয়ে তার মধ্যে দিয়ে শ্রমিকদের বের করে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু কাজ শুরু হতেই সুড়ঙ্গের ভিতরে আরেকটি বড়সড় ধস নামায় দুর্ঘটনার 6 দিনের মাথায় সেই প্রচেষ্টা বাতিল করতে হয়েছে। ধসে পড়া সুড়ঙ্গের অন্ধকারে পাইপ দিয়ে পাঠানো অক্সিজেন ও সামান্য খাদ্য-পানীয় সম্বল করে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে এই 41 জন অসহায় শ্রমিক 17 দিন পরে আলোর মুখ দেখলেন। আর ধ্বংসস্তূপের বাইরে ভিড় করে থাকা পরিজনদের দীর্ঘ আশঙ্কা ও উদ্বেগের অবসান ঘটল।

দুর্ঘটনার পর থেকে এই 17 দিন ধরে উদ্ধারকার্যের যে বেহাল দশা দেখা গেল তা থেকে একথা পরিষ্কার যে, কাজ চলার সময়ে দুর্ঘটনা ঘটলে শ্রমিকদের জীবন রক্ষায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তার কোনও আগাম পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষের ছিল না। কারণ, নিয়ম অনুযায়ী সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য তিন কিলোমিটারের বেশি হলেই আপৎকালীন রাস্তা তৈরির ব্যবস্থা করতে হয়, যাতে দুর্ঘটনা ঘটলে সেই রাস্তা দিয়ে শ্রমিকদের বের করে আনা যায়। এই সুড়ঙ্গটি সাড়ে চার কিমি লম্বা হওয়া সত্ত্বেও এবং নকশায় আপৎকালীন রাস্তার কথা থাকলেও বেআইনি ভাবে সে সব বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ভূতাত্ত্বিক, পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানীরা প্রশ্ন তুলেছেন যে, উত্তরাখণ্ডের মতো বাস্তুসংস্থান ও ভূতত্ত্বগত দিক দিয়ে অত্যন্ত সংবেদনশীল অঞ্চলে এই ধরনের কাজ করতে গেলে দীর্ঘ সময় ধরে ভূতাত্ত্বিক ও ভূ-প্রযুক্তিগত পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যে রিপোর্ট নির্মাণ-কোম্পানিকে দিতে হয়, তা নেই কেন? উত্তরাখণ্ড ইউনিভার্সিটি অফ হর্টিকালচার অ্যান্ড ফরেস্ট্রির চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, সুড়ঙ্গ খননে যে ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে, সিল্কিয়ারার এই দুর্ঘটনার পিছনে সেটি একটি বড় কারণ। তাঁর বক্তব্য, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, চারধাম হাইওয়ে প্রকল্পে ভূতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ আদৌ গুরুত্ব দিয়ে করা হয়নি। চারধাম প্রকল্পের পরিবেশগত মূল্যায়নের জন্য সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির চেয়ারম্যান শ্রী রবি চোপরা বলেছেন যে, এই অঞ্চলে এমন বিশাল প্রকল্প শুরুর আগে যে ভূতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ ও সামগ্রিক ভৌগোলিক পরিবেশ গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার ছিল, সরকার তা করেনি। সরকার চেয়েছে তাড়াহুড়ো করে প্রকল্পের কাজ সেরে ফেলতে। ফলে এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে এবং আগামীদিনে আর ঘটবে না তার গ্যারান্টি নেই।

পরিবেশবিদ, ভূতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা ও নিষেধ অগ্রাহ্য করে সমুদ্রতল থেকে সাড়ে তিন হাজার মিটার ওপরে, হিমালয় সংলগ্ন উত্তরাখণ্ডে 12 হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প- 'চারধাম পরিযোজনা' রূপায়ণ করতে চলেছে কেন্দ্রের সরকার। এই প্রকল্পে 900 কিলোমিটার দীর্ঘ হাইওয়ে জুড়বে গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, বদ্রিনাথ ও কেদারনাথ- চার তীর্থস্থানকে। এর জন্য ধ্বংস করা হচ্ছে সুবিশাল বনভূমি কেটে ফেলা হচ্ছে হাজার হাজার বৃক্ষ। বহু ছোট নদী ও ঝর্ণার স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে। মারা পড়ছে অসংখ্য বন্যপ্রাণী ও কীটপতঙ্গ। একের পর এক জোরালো বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাহাড় ফাটিয়ে তৈরি হচ্ছে টানেল।

সব মিলিয়ে হিমালয় সংলগ্ন এই অঞ্চলের সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্র বিপর্যস্ত করে, গোটা পরিবেশ ও সেখানকার বাসিন্দাদের জীবনে বিপর্যয় ঘটানোর পরিকল্পনা সুনিপুণভাবে করা হয়েছ। শুধু তাই নয়, পরিবেশ সংক্রান্ত আইন থেকে বাঁচতে চালাকির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। যেহেতু আইন অনুযায়ী 100 কিলোমিটারের কম দৈর্ঘ্যের হাইওয়ে নির্মাণে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের প্রয়োজন পড়ে না, তাই প্রায় 900 কিলোমিটার দীর্ঘ চারধাম প্রকল্পের হাইওয়ে নির্মাণ প্রকল্পকে রাস্তা পরিবহণ ও হাইওয়ে মন্ত্রক 53টি ভাগে ভাগ করে নিয়েছে যাতে প্রতিটি অংশ 100 কিলোমিটারের কম দৈর্ঘ্যের হয়। সরকারের এই চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার ফলে গত কয়েক বছর ধরে পাহাড়ি এই এলাকায় একের পর এক ধস, হড়পা বানের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে চলেছে। এ বছরের গোড়ার দিকেই যোশীমঠ শহরটির ধীরে ধীরে ভূমিগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার সূচনা কাঁপন ধরিয়েছে মানুষের বুকে।

প্রশ্ন হল, পরিবেশবিদ-বিজ্ঞানীদের শত নিষেধ উপেক্ষা করে ভয়াল প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্ঘটনা ও ব্যাপক জীবনহানির আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও কীসের তাড়নায় চারধাম প্রকল্প হাতে নিল কেন্দ্রের সরকার? এক কথায় এর উত্তর হল, চারধাম হাইওয়ে প্রকল্প আসলে হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডারই একটি অংশ। 2024 সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে চার তীর্থস্থানকে হাইওয়ে দিয়ে জুড়ে দিতে পারলে হিন্দুত্ববাদী প্রচার আরও জোরদার হবে। অন্যদিকে উত্তরাখণ্ডের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে চিনের। প্রকল্প শেষ হলে এই হাইওয়ে দিয়ে সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম পরিবহণে সুবিধা হবে। ফলে বহিঃশত্রুর আক্রমণের আতঙ্ক ছড়িয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের 'হিড়িক তুলতেও সাহায্য করবে এই চারধাম প্রকল্প।

চারধাম প্রকল্প রূপায়ণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ধনকুবেরদের মুনাফার স্বার্থও। উত্তরাখণ্ডের সৌন্দর্যময় প্রাকৃতিক পরিবেশে চারধাম প্রকল্পের মাধ্যমে যদি যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো যায়, তাহলে পর্যটন ব্যবসার রমরমা ঘটতে পারে। কিন্তু এর ফলে যে পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাবে বা এলাকার নিরীহ বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হবে সে বিষয়ে কেন্দ্র বা উত্তরাখণ্ড সরকারের কোনও চিন্তা নেই।

সিকিমে বিপর্যয়

গত ও অক্টোবর, গভীর রাত থেকে উত্তর সিকিমের দক্ষিণ লোনক লেকের ওপর শুরু হয় মেঘভাঙা বৃষ্টি। জলের চাপ বাড়তে বাড়তে ভোরের দিকে ফেটে যায় লেক। যার জেরে হুড়মুড়িয়ে নেমে আসে জল। ভেঙে যায় চুংথাং ড্যাম। উত্তর সিকিমের ঘুম ভাঙার আগেই হড়পা বান নেমে আসে তিস্তায়। ভোরের আলো আসার আগেই নেমে এল 15 থেকে 20 ফুট উঁচু জলের স্রোত। ভাসিয়ে নিয়ে যায় রাস্তা, ঘর, বাড়ি, গাড়ি- সব কিছু। উত্তর সিকিমের সিংতামের কাছে বরদাংয়ের সেনাছাউনিতে কাদাজলের নীচে চাপা পড়ে যায় সেনাবাহিনীর 41টি গাড়ি। ডুবে যায় সেনা ছাউনি। বহু সেনা জলের তোড়ে ভেসে যায়।

এই ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ হোল লোনাক হ্রদের বিস্ফোরণ। কী কারণে এই হ্রদের বিস্ফোরণ হয় এবং বাঁধ ভেঙে পড়ে তা নিয়ে একাধিক কারণ উঠেছে। অনেকেরই মতে, নেপালে যে ভূমিকম্প হয় তার প্রভাব এসে পড়ে সিকিমে। এছাড়াও ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসাবে চিহ্নিত, ওই হ্রদে বিপদ দেখা দিচ্ছিল অনেকদিন ধরেই বলেও অনেকেরই মত।

কেন এই হ্রদে বিস্ফোরণ হোল তা নিয়ে, স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে ইসরোর (ISRO) 'ন্যাশনাল রিমোট সেনসিং সেন্টার'। একাধিক ছবি বিশ্লেষণ করে ইসরো জানায় যে, দক্ষিণ লোনাক হ্রদে ক্রমাগত আকার এবং চরিত্রের পরিবর্তন হচ্ছিল। তাদের মতে, সেখানকার পাহাড়গুলিতে বড়সড় ধস নেমেছিল। তারফলেই সম্ভবত বড় বড় পাথর ভেঙে এসে পড়ে দক্ষিণ লোনাক হ্রদের উপরে। এই ধসই বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। আচমকাই হ্রদের উপরে নেমে আসে ধস, যা হ্রদটি সহ্য করতে পারেনি। তার ফলে, হ্রদের দক্ষিণ- পশ্চিম পাড় ভেঙে প্রবল বেগে জল বেরোতে শুরু করে। তার জেরেই, হড়পা বান এসে ভেঙে দেয় চুংথাং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধ। এইসঙ্গে তিস্তা নদীর জলস্তর বেড়ে বিপর্যয় ডেকে আনে। অনেকের মতে, অধিক উচ্চতায়, তিস্তার জল আটকে, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করার কারণে বাড়ছে বিপদ। এছাড়াও, লোনাক হ্রদ ভাঙার আর এক কারণ হল হিমবাহ গলে ধস, প্রবল মেঘভাঙা বৃষ্টি এবং ভূমিকম্প। ভূবিজ্ঞানীরা জানান, দক্ষিণ লোনাক হ্রদের 150 কিলোমিটারে মধ্যে সেপ্টেম্বরের শেষ দুসপ্তাহে দুটি মাঝারি এবং দুটি ছোট ভূমিকম্প হয়। তাতে হ্রদের তলদেশে বড় ফাটল বা হ্রদের কোনও অংশ ভেঙে বিশাল জলরাশি নিচে নেমে আসতে পারে বলেই আশঙ্কা। 

হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ডের পর কেন বিপর্যয় নেমে এল উত্তর সিকিমে? বিশেষজ্ঞদের মতে নদী ও প্রকৃতির ক্ষতি করে গড়ে ওঠা বেআইনি, বেহিসেবি নির্মাণই এরজন্য দায়ী। গত জুলাই আগস্ট মাসেই ভয়ানক বিপর্যয় ঘটেছিল হিমালয়ের দুই রাজ্য উত্তরাখণ্ড এবং হিমাচল প্রদেশে। মেঘভাঙা বৃষ্টি, ধস, বন্যার মতো ঘটনায় লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল ওই দুই রাজ্যের বহু এলাকা। মৃত্যু হয়েছিল বহু মানুষের।

শিমলা-মানালি, উটি, দার্জিলিং-কালিম্পং বা গ্যাংটক- পেলিং - পাহাড়ের কোলে সর্বত্র চলছে নির্মাণের সারি! অভিযোগ, নিয়ম না মেনেই চলছে এই সমস্ত নির্মাণকাজ। শুধু তাই নয়, তৈরি হচ্ছে একের পর এক টানেল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভঙ্গিল পর্বত হিমালয়ে প্রতি মুহূর্তে ভাঙাগড়া চলছে। এলাকা ভূমিকম্প প্রবণ। তাই বিপদের আশঙ্কা আছে প্রতিটি মুহুর্তে। একথা আজ নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, ধনকুবেরদের মুনাফার স্বার্থে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে নির্বিচারে পরিবেশের উপর এভাবে অত্যাচার চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর প্রশাসক ও দেশের সরকারগুলি। তাই উন্নয়নের নামে প্রকৃতিকে ধ্বংস আর সাধারণ মানুষের জীবনকে বলি দেওয়ার প্রতিবাদে সোচ্চার হতে হবে দেশের মানুষকে।

[লেখক পরিচিতি: ডঃ মাইতি ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি পঃ বঃ রাজ্য কমিটির কার্যকরী সভাপতি এবং প্রকৃতি পত্রিকার সম্পাদক।]