বিভাগগুলি

আদিম মানুষের মাইগ্রেশন ও আর্য জনগোষ্ঠীর জন্মবৃত্তান্ত

By Saioa López, Lucy van Dorp and Garrett Hellenthal


সুব্রত গৌড়ী

বিগত কয়েক বছর ধরে এদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে কিছু বিতর্ক উঠেছে। বিশেষ করে প্রাচীন যুগে বিজ্ঞানের বিকাশের ক্ষেত্রে ভারতীয়দের অবদান এবং ইতিহাসের কিছু স্বীকৃত তত্ত্ব সম্পর্কে এই বিতর্ক যথেষ্ট গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে। প্রাচীন যুগে বিজ্ঞানের বিকাশের ক্ষেত্রে ভারতীয়দের অবদান নিয়ে আমরা ইতিমধ্যেই এই পত্রিকায় নানা আলোচনা প্রকাশ করেছি। নতুন করে ইতিহাস লেখা বা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস পুনর্লিখন'-এর যে উদ্যোগ এমনকী শিক্ষা দপ্তরের পক্ষ থেকে নেওয়া হচ্ছে, সে সম্পর্কেও কিছু লেখা আমরা প্রকাশ করেছি। এই প্রবন্ধে আমরা আলোকপাত করব আর্যদের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে। অর্থাৎ আর্যরা কি এদেশেরই আদি বাসিন্দা? নাকি বহিরাগত? যদি বহিরাগত হয়, তাহলে তারা কোথা থেকে এসেছিল?

বহুদিন আগেই এই বিতর্কের সূচনা হয়েছে। বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু আর্য জনগোষ্ঠীর জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে। একদল মনে করত এদেশ থেকেই আর্যদের বাইরের দিকে মাইগ্রেশন হয়েছে। তবে নানা ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণ, প্রাচীন পুঁথিপত্র বিশ্লেষণ প্রভৃতির মাধ্যমে সিংহভাগ ইতিহাসবিদরা ইতিহাস নির্মাণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রমাণ করেছেন যে, আর্যরা বহিরাগত, সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের পরে তারা ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছে। কিন্তু কিছুদিন আগে থেকে নতুন করে এই বিতর্ক তোলা হয়েছে। তাঁরা বলছেন যে, এই ইতিহাস ঔপনিবেশিক শাসকদের তৈরি ইতিহাস। তাই ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে হবে। অর্থাৎ এতদিন সিংহভাগ ইতিহাসবিদ যে মত পোষণ করে এসেছেন, তা আসলে বিকৃত ইতিহাস। এখন 'সঠিক' ইতিহাস লিখতে হবে। তার জন্য উদ্যোগ আয়োজন শুরু হয়েছে। তাই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আলোচনার দাবি রাখে। সেই প্রয়োজনেই বর্তমান প্রবন্ধের অবতারণা।

সেই আলোচনার আগে একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ইতিহাস কোনও ব্যক্তির ব্যক্তিগত মর্জিমতো লেখা যায় না। মানব ইতিহাসের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় মানুষ যে জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছে,তার পিছনে রয়েছে কোনও কিছুকে জানবার ও বোঝবার জন্য যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা দরকার, সেই প্রক্রিয়ার আবিষ্কার। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সেই প্রক্রিয়া হল, প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, প্রত্ন-উদ্ভিদবিদ্যা, প্রত্ন-ভুতত্ববিদ্যা, জীবাশ্মবিদ্যা থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং নানা প্রাচীন পুঁথিপত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলিকে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবিচারের সাহায্যে বিশ্লেষণ করা এবং তার উপর ভিত্তি করেই ইতিহাস রচনা। সম্প্রতি আধুনিক জিনবিদ্যা বিভিন্ন প্রাচীন মানবগোষ্ঠীর জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে আলোকপাত করেছে এবং বিশেষ করে জনজাতি জিনবিদ্যার সাহায্যে বহু অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হয়েছে। আমরা আধুনিক বিজ্ঞানের এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে প্রাচীন মানুষের মাইগ্রেশনের প্রেক্ষাপটে আর্য জনগোষ্ঠীর জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে আলোচনা করব।

প্রাচীনকালে মানবগোষ্ঠীর মাইগ্রেশন ও বিশুদ্ধ জনগোষ্ঠীর ধারণা

মানুষের উদ্ভব কি কোনও একটি নির্দিষ্ট জায়গাতেই হয়েছিল? নাকি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে একই সাথে একাধিক স্থানে মানবপ্রজাতির উদ্ভব? একসময় এই প্রশ্নে বিজ্ঞানীরা দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে সেই বিতর্কের অবসান হয়েছে অনেকটাই। অন্যান্য এভিডেন্সের সাথে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে জিনবিদ্যার গবেষণা। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আধুনিক মানুষের জিনোমের পূর্নক্রম বিশ্লেষণ করবার পরে পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশে তার প্রথম আবির্ভাবের যুক্তিসংগত বৈজ্ঞানিক তথ্য সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে।

এই গবেষণায় এখনকার মানুষের শরীরের এবং পরে প্রাচীন জীবাশ্ম-এর ডিএনএ বিশ্লেষণ করে এই গবেষণাগুলি হয়েছে। এই শতাব্দীর শুরুতে মূলতঃ ইউরোপকে কেন্দ্র করে এই গবেষণা শুরু হলেও বিগত এক দশকে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের তথ্য নিয়েও এই গবেষণা হচ্ছে। ফলে বর্তমানে সারা পৃথিবীতে এই বিদ্যার সাহায্যে নতুন করে মানুষের বিভিন্ন মাইগ্রেশনের ইতিহাস লেখা সম্ভব হচ্ছে।

সাম্প্রতিক কালে ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস অনুসন্ধানে আধুনিক জনজাতি জিনবিদ্যার সহায়তা নেওয়া হয়েছে। শেষ এক দশকে বিভিন্ন দেশি ও বিদেশী জিনবিদরা, দক্ষিণ এশিয়ার মাইগ্রেশনগুলিকে চিহ্নিত করে তার সময়কাল, জনগোষ্ঠী গঠন ও ভারতবর্ষের সভ্যতার উপরে তার প্রভাব নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন। [1] গবেষণা ভারতবাসীর উৎস সন্ধানে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

এর ভিত্তিতে আজ আমরা জেনেছি যে,আধুনিক মানুষের উদ্ভব আফ্রিকা মহাদেশে। আজ সারা পৃথিবীতে যত মানুষ বাস করে তাদের সকলেরই পূর্বপুরুষ হল আফ্রিকা মহাদেশের মানুষ। আজ থেকে সত্তর হাজার বছর আগে তারা বেরিয়ে পড়েছিল নতুন নতুন এলাকায় খাদ্যের সন্ধ্যানে। কারণ তার কিছুদিন আগে থেকেই ঐসব অঞ্চলের আবহাওয়ার পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। দক্ষিনদিকে হিমবাহর প্রসারের ফলে এখনকার উত্তর মেরুর মতো প্রবল শৈত্যপ্রবাহ বিষুবরেখার কাছাকাছি চলে আসে। পূর্ব আফ্রিকার গ্রেট রিফ্ট ভ্যালি কোনও জীবজন্তু বা সেখানে বসবাসকারী আদিম মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকার অনুপযুক্ত হয়ে যায়। অনুমান করা হয় যে, পঁচাত্তর হাজার বছর আগে পূর্ব আফ্রিকা ভয়াবহ খরার কবলে পড়ে। এই সময় মালাউ লেকের জলের পরিমাণ কমপক্ষে 95 শতাংশ কমে গিয়েছিল।[2] এই সময় মানব জনসংখ্যা একেবারে তলানিতে। বিজ্ঞানীদের অনুমান, পূর্ব আফ্রিকার এই অঞ্চলে তখন আধুনিক মানুষের সংখ্যা দশ হাজারের বেশি নয়। তখন হোমো স্যাপিয়েন্স লুপ্ত হওয়ার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সেইসময় ওদের একদল বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ঠান্ডায় বন্ধ্যা ভুখন্ড ছেড়ে শুরু করেছিল নিরুদ্দেশ যাত্রা।

এরা শুষ্ক ও শীতল আফ্রিকা ছেড়ে চলে আসে ইয়েমেনে। [3] আরবভূমি থেকে একটা দল ইরান হয়ে চলে আসে ভারতে। ভারত অতিক্রম করে ওদের একটি শাখা চলে যায় মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার তৎকালীন যুক্তভূমি সুন্দাল্যান্ডে। তারপর একসময় ভেলায় চড়ে ওরা টিমোর সাগর পার হয়ে চলে যায় অস্ট্রেলিয়াতে। আধুনিক মানুষ ইউরোপে প্রবেশের অনেক আগেই অস্ট্রেলিয়াতে পৌঁছে গেছে।[3ক] মহাপরিযানের আর একটা দল থেকে গিয়েছিল আরবভূমিতে, ইজরায়েলে। বেশকিছু সময় পরে সেখান থেকে এক জনগোষ্ঠী চলে যায় ইউরোপের দিকে। ওরা ইউরোপ পৌঁছে যায় আজ থেকে ছেচল্লিশ হাজার বছর আগে।

যে শাখাটি ইয়েমেন থেকে ভারতবর্ষের দিকে এসেছিল, তাদের একটি উপশাখা আবার ভারতে প্রবেশ না করে চীন ও সাইবেরিয়ার দিকে চলে যায়। তারপর সাইবেরিয়া থেকে একটা অংশ চলে আসে আমেরিকায়।

এই যে প্রাচীনকালে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনগোষ্ঠী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে, বহুসময়ই তাদের মধ্যে সাক্ষাৎ হয়েছে। এই সাক্ষাৎ কখনও হয়েছে ধ্বংসাত্মক। একটা গোষ্ঠী আর একটা গোষ্ঠীকে পরাজিত করে নিশ্চিহ্ন করেছে। আবার কখনও দুটো গোষ্ঠী একে অপরের সাথে মিশে গেছে। ফলে তাদের মধ্যে মিলন হয়েছে, দুটি গোষ্ঠীর মানুষের জেনেটিক মেটিরিয়ালের মেলবন্ধন হয়েছে। জীবাশ্ম-এর ডিএনএ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা সেই সিদ্ধান্তেই এসেছেন। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে মিলনের এই ঘটনা সর্বজনীন। একমাত্র কোনও জনগোষ্ঠী যখন দীর্ঘদিন অন্য কোনও জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকে, কেবলমাত্র তারাই এই 'বিশুদ্ধতা' রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। যেমন আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের জারোয়াদের কথা বলা যেতে পারে। তাদের জেনেটিক মেটিরিয়ালের 'বিশুদ্ধতা' হয়তো তারা রক্ষা করতে পেরেছে। কিন্তু তারা পড়ে থেকেছে সভ্যতার সেই আদিমকালে। সভ্যতার বিকাশের সাথে তাল রেখে যারা এগিয়েছে, তাদের পক্ষে বিশুদ্ধতা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

আর্য জনগোষ্ঠীর পূর্বসূরীদের বাস মধ্য এশিয়ার স্তেপভূমি: ভাষাগত প্রমাণ

পূর্বে কাজাখস্তান থেকে পশ্চিমে রাশিয়া পর্যন্ত ইউরেশিয়ার বিশাল অঞ্চল জুড়ে স্তেপভূমি বিস্তৃত। এর মধ্যে রাশিয়ার নাতিশীতোষ্ণ স্তেপভূমি পশ্চিম দিকে কৃষ্ণসাগর থেকে পূর্বে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত প্রসারিত। স্তেপের এই অংশকে বলে পন্টিক কাস্পিয়ান স্তেপভূমি। ভোলগা ও ডন বিধৌত এই অঞ্চল তৃণভূমি আচ্ছাদিত, মাঝে মাঝে আছে ঝোপঝাড়, গুল্ম। এখানে দেখা যায় বন্য ঘোড়া, ভেড়া, ছাগল, কৃষ্ণসার মৃগ।

পন্টিক স্তেপের পূর্ব দিকে প্রসারিত কাজাখ-স্তেপ। পশ্চিমে উড়াল পাহাড় থেকে পূর্বে আলতাই পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত এই অঞ্চল আংশিক মরুভূমির মতো। তবে সাইবেরিয়া সংলগ্ন অঞ্চলে আছে পাইনের জঙ্গল। এই স্তেপভূমিতেই ঘোড়াকে প্রথম পোষ মানিয়ে যানবাহন হিসেবে ব্যবহার করা হয়।ওই সময়ে এখানে বাস করত ঘোড়ায় চড়া বিভিন্ন অর্ধ যাযাবর জনগোষ্ঠী। পন্টিক-স্তেপ ও কাজাখ-স্তেপ এই দুইয়ে মিলে হল ইউরেশিয়ার বিশাল পশ্চিম স্তেপভূমি।[1] আজ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে পন্টিক কাস্পিয়ান স্তেপভূমি জুড়ে ছিল য়ামনায় (yamnaya) সংস্কৃতির মানুষের বসবাস। রুশ ভাষায় য়াম্ময়া শব্দের অর্থ 'কবর বা গর্ত সম্পর্কিত'। ওরা ওদের মরদেহ সাদাসিধেভাবে সমাধিস্তূপে চাপা দিত। য়াম্ময়া যাযাবর পশুপালকরা পরিবার ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারে বিশ্বাসী ছিল। কথা বলতো এক আদি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায়। ওরা ছিল দীর্ঘদেহী, চোখের রঙ বাদামী, চুল ছিল কালো ও দেহবর্ণ হাল্কা।

এই স্তেপভুমির পশ্চিমদিক অর্থাৎ পন্টিক স্তেপের তৃণভূমিতে বসবাসকারী অর্ধ-যাযাবর গোষ্ঠী আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে আরও পশ্চিমে চলতে চলতে ইউরোপের দিকে চলে যায়। প্রাচীন দেহাবশেষের সংখ্যা থেকে অনুমান করা যায় যে, সেই দলে নারীদের তুলনায় পুরুষদের সংখ্যা 4 থেকে 15 গুণ বেশি ছিল।[4] কিছুটা চলবার পর ওই বিরাট পরিযায়ী গোষ্ঠীর একটা ছোট দল নিজেদের আস্তানা তৈরি করে নেয় পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে, দানিয়ূবের তীরে। বাকিরা এগিয়ে গেছে আরও পশ্চিমে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ যাত্রাপথে ছড়িয়ে আছে প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু, প্রাচীন দেহাবশেষ। সেইসব ঐতিহাসিক উপাদান থেকে ওই গোষ্ঠীগুলোর সংস্কৃতি সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়।

প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক মারিয়া গিম্বাটাস প্রাচীন নিওলিথিক ও ব্রোঞ্জ যুগের ইউরোপীয় সংস্কৃতি, তাদের ভাষা এবং স্তেপভূমি থেকে পশ্চিম দিকে তাদের বিস্তার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন। পন্টিক-স্তেপ অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের সাহায্যে তিনি দাবি করেছেন যে, ওই অঞ্চল থেকেই এক জনগোষ্ঠী ইউরোপে মাইগ্রেট করেছে। ওই মানুষের ভাষা হিসেবে তিনি আদি প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাকে চিহ্নিত করেন। প্রোটো-ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা হল এক অধুনালুপ্ত প্রাচীন ভাষা, যার থেকে অধিকাংশ ইউরোপীয় এবং উত্তর ভারতীয় ভাষার সৃষ্টি হয়েছে।

কয়েকশো বছর আগে থেকেই ভারতবর্ষে বসবাসকারী ইউরোপীয়রা বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষার সঙ্গে সংস্কৃত ও উত্তর ভারতীয় কিছু ভাষার সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন। 1781 সালে গোয়ায় বসবাসকারী ফিলিপ্পো সসেটি সংস্কৃত ও ইতালীয় সংখ্যাবাচক শব্দের মিল খুঁজে পান।[5] 1786 সালে এশিয়াটিক সোসাইটির তৃতীয় বার্ষিকী সভায় তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাষা তত্ত্ববিদ স্যার উইলিয়াম জোন্স প্রস্তাব করেন যে, সংস্কৃত, গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষার উৎস এক। ইউরেশিয়া জুড়ে বিভিন্ন ভাষাগুলির সাদৃশ্য কোনও এক প্রাচীন সময়ে দৃঢ় সাংস্কৃতিক সংযোগের ইঙ্গিত করে। তিনি অনুমান করেন, সুদূর অতীতে এদের মধ্যে সংযোগ ছিল।[6] ওই সময় আরও দেখা যায় যে, দক্ষিণ ভারতীয় ভাষাগুলির তুলনায় সংস্কৃত ভাষা ইউরোপীয় বিভিন্ন ভাষা, যেমন গ্রীকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। অথচ তুলনামূলকভাবে তামিলনাড়ু ভৌগোলিক দিক থেকে উত্তর প্রদেশের অনেক কাছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন তখন অনেকের মনে উঠেছিল যে, এ কি করে সম্ভব? তাহলে কি কোনও একদিন এই জনগোষ্ঠীগুলির পিতৃপুরুষেরা একই অঞ্চলে বসবাস করত?

ইউরোপীয় ও প্রাচ্যের কিছু ভাষার উৎসের সন্ধানে উনবিংশ শতাব্দী থেকেই এক আদি ভাষার অন্বেষণ চলে। মনে করা হয়, সেই আদি ভাষা থেকে ইউরোপ, ইরান ও ভারতের বিভিন্ন ভাষাগুলির উদ্ভব।

ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ ডেভিড এন্থনি বিভিন্ন ইউরোপীয় ও ভারতীয় ভাষার শব্দভাণ্ডার নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন, এই সমস্ত ভাষার অংশীদারি-শব্দভাণ্ডার 6000 বছরের খুব বেশি আগে তৈরি হতে পারে না।

বিভিন্ন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় মালবাহী শকট, গাড়ির অক্ষ, অক্ষধুরা, চাকা ইত্যাদি শব্দভাণ্ডার তুলনা করলে বোঝা যায় যে, ইতিহাসের কোনও এক সময়ে এই শব্দগুলি একই মূল শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এন্থনি অনুমান করেন ভারত, ইরান ও ইউরোপের বিভিন্ন ভাষা এসেছে এমন এক ভাষা থেকে যারা অশ্ব ও শকট ব্যবহার করত। আর সেই আদি ভাষা 6 হাজার বছরের বেশি পুরোনো হতে পারে না।কারণ প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান থেকে বোঝা যায় যে, ওই সময়সীমার মধ্যেই চাকা, শকট বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহৃত হতে শুরু করে।

শেষ পর্যন্ত নানারকম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে তুলনামূলক ভাষাবিদ্যার সাহায্যে বিভিন্ন ইউরোপীয় এবং এশীয় ভাষার এক ভাষা বৃক্ষ তৈরি করা হয়। আবার এইভাবে বিভিন্ন শাখা প্রশাখার নামকরণ করতে করতে অধুনালুপ্ত আদি এক ভাষাকে সনাক্ত করা হয়। সেই আদি ভাষার নাম দেওয়া হয় প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয়। মনে করা হয়, প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় থেকেই পরবর্তীকালে ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষাগুলির উৎপত্তি। যেহেতু ওই ভাষার কোনও লিখিত রেকর্ড নেই, তাই তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের সাহায্যেই প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার একটা খসড়া করা হয়েছে।

আজকের অধিকাংশ শব্দতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক মনে করেন কাছাকাছি 6500 বছর আগে পন্টিক-স্তেপ অর্থাৎ কৃষ্ণসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী কোনও অঞ্চলে একদল পশুপালক ওই প্রোটো-ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষায় কথা বলত। অনুমান করা হয় যে, সাড়ে ছয় হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার বছর আগে পর্যন্ত সময়কালে অর্থাৎ নব্যপ্রস্তর যুগের শেষে ও ব্রোঞ্জ যুগের প্রাথমিক পর্বে, প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় একটি ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হত। ওদের সঙ্গেই সেই প্রাথমিক ভাষা ও তার থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন উপভাষা কাস্পিয়ান সাগরের পশ্চিম দিকে ও পরবর্তীকালে দক্ষিণ দিকে বিস্তার লাভ করে, ভাষার প্রসারে ঘোড়ার অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ঘোড়ায় চড়ে ইন্দো-ইউরোপীয়রা অতি দ্রুত ইউরেশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে গিয়েছিল। তার সঙ্গে সঙ্গে ওদের ভাষাও প্রচলিত হয়েছিল সেইসব অঞ্চলে।

এদিকে ভাষাতত্ত্ববিদ মাইকেল উইটজেল প্রাচীন সাহিত্যগুলি থেকে বিভিন্ন শব্দবন্ধ উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন যে,বেশিরভাগ উত্তর ভারতীয় ভাষা এবং তাদের পূর্ববর্তী ভাষা, যেমন বৈদিক, পালি, প্রাকৃত ইত্যাদি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত। বৃহত্তর পাঞ্জাব অঞ্চলে ইন্দো-ইউরোপীয়রা আসবার সময় যেসব শব্দবন্ধ নিজেদের ভাষায় যুক্ত করেছে তাই দিয়ে ওদের আসার পথ, এদেশে আসার সময়কাল, ঋগ্বেদ রচনার সময়কাল ইত্যাদি অনুমান করা যায়। উইটজেল তাঁর ‘বিয়ন্ড দা ফ্লাইট অফ দা ফ্যালকন্স’ প্রবন্ধে প্রাচীন সাহিত্যগুলি থেকে বিভিন্ন শব্দবন্ধ উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন যে, ঋগ্বেদ ব্রোঞ্জ যুগের শেষের দিকে, আজ থেকে 3200 বছর থেকে 3000 বছর আগে রচিত। উত্তর মেসোপটেমিয়ায় মিত্তানী ভাষা ঋকবেদের একটু পূর্ববর্তী সময়ের। খ্রিস্টপূর্ব 1380 সালের কাছাকাছি মিত্তানী ও হিট্টিয়দের (ব্রোঞ্জ যুগে আনাতলিয়ার ইন্দো-ইউরোপীয়ভাষী) মধ্যে যে চুক্তি হয় তাতে বিভিন্ন বৈদিক দেবতা, যেমন মিত্র, বরুণ, ইন্দ্র ইত্যাদির উল্লেখ আছে। মিত্তানীতে যেসব ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দ আছে সেগুলি বৈদিক ইন্দো-আর্য ভাষার থেকে সামান্য প্রাচীন। সেসব তুলনা করে উইটজেল বলেছেন, ঋগ্বেদ কোনোমতেই 3400 বছরের বেশি আগে তৈরি হতে পারে না। এই সময়কাল ইন্দো-ইউরোপীয়দের নিয়ে ডেভিড রাইখ ও তাঁর সহকর্মীরা প্রাচীন ডিএনএ-এর সাহায্যে যে গবেষণা ও সিদ্ধান্ত করেছিলেন, তার সঙ্গে মিলে যায়।

সাম্প্রতিককালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানী প্রফেসর এন্ড্রু গ্যারেট ও তাঁর সহকর্মীরা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা নিয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে কিছু কাজ করেছেন।[7] বিভিন্ন কাছাকাছি ভাষার মৌলিক শব্দভাণ্ডার তাঁরা পরীক্ষা করেন। এইভাবে সমস্ত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার এক আদি উৎসের সময় তারা গণনা করেন আজ থেকে 6000 বছর আগে নাগাদ। এই সময়কাল আবার ডেভিড এন্থনির অনুমানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

বিভিন্ন শব্দতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে অনুমান করা যায় যে, য়াম্ময়াদের একটি শাখা পরবর্তীকালে এশিয়াতেও মাইগ্রেট করেছে। 4900 থেকে সাড়ে চার হাজার বছর আগে মধ্য রাশিয়ার আলতাই পর্বতমালার নিকটবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে য়াম্ময়া সংস্কৃতির রেশ ও জিনগত সংযোগের প্রমাণ মিলেছে। অর্থাৎ যে য়াম্ময়ারা ককেসাস পর্বতের কাছে থাকতো তাদের এক শাখা আরো পূর্বদিকে চলে গিয়েছিল। সেখানে আলতাই পাহাড়ের কাছাকাছি অঞ্চলে তারা বসবাস করত। আলতাই পাহাড়ের কাছের এই জনগোষ্ঠী য়াম্ময়া সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল।এরা পরবর্তীকালে দক্ষিনে তুরানের দিকে যেতে শুরু করে। আলতাই পাহাড় হল রাশিয়ার পূর্বদিকে। এটি চীন, মঙ্গোলিয়া ও কাজাখস্তানের মিলনস্থানে অবস্থিত। এর উত্তর ভাগে আছে সাইবেরিয়া। এই অঞ্চলই ওব, ইনেসি ও ইরটিস নদীর উৎস। রাশিয়ার পশ্চিমে য়াম্ময়াদের বসতি ককেশাস পর্বত অঞ্চল থেকে এই স্থানের দূরত্ব প্রায় 4700 কিলোমিটার। আর প্রথম ঘোড়া প্রতিপালক বোতাইদের বাসস্থান উড়াল পর্ব থেকে এই স্থানের দূরত্ব 2000 কিলোমিটারের মতো। (মানচিত্র-1)


সেই সময় ওই অঞ্চল ছিল শীতল ও শুষ্ক। তখন ওখানে বন এবং জলাভূমি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে ও স্তেপভূমি আরও প্রসারিত হচ্ছে। স্তেপ অঞ্চলের পশুপালকদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো শীতের সময়ে বরফের থেকে সুরক্ষা পাওয়া, পশুর খাদ্য যোগান ও পশুর চরণভূমি জোটানো। ওদের পশুর পালে ছিল ঘোড়া, মেষ, ছাগল ও গবাদি পশু। যাতায়াতের জন্য ওরা ঘোড়া ব্যবহার করত। শুষ্ক ও শীতল আবহাওয়া ওই অঞ্চলের উপজাতি অধিবাসীদের উপরে নিশ্চয়ই চরম অর্থনৈতিক আঘাত হেনেছিল।

ক্রমহ্রাসমান জলাভূমি ও চারণভূমি প্রতিদ্বন্দ্বী উপজাতি দলগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে তুলেছিল। সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংঘাত এবং প্রতিযোগিতা হয়তো রূপ নিয়েছিল গোষ্ঠী সংঘর্ষে। অধিবাসীদের কৃষিকাজের সুযোগ চলে যায়, আর তারা সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে পশুপালনের ওপরে। ফলে আলতাই পর্বত অঞ্চল থেকে দক্ষিণ দিকে এই যাযাবর পশুপালকদের এক বিশাল অংশ দেশান্তরে গমন শুরু করে।

মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় জনগোষ্ঠীর উৎস সন্ধানে জেনেটিক গবেষণা ও তার ফলাফল

সারা পৃথিবীর জিনবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মিলে মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার জনগোষ্ঠীর উৎস সন্ধানে এক বিরাট প্রকল্প নিয়েছিলেন। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের প্রফেসর জনজাতি জিনবিদ ডেভিড রাইখের নেতৃত্বে এই প্রকল্প সম্পন্ন হয়। এই প্রকল্পের অধীনে ছিল সাইবেরিয়া থেকে ইরান, তুরান ও দক্ষিণ এশিয়ার বিরাট অঞ্চল। গবেষকরা সম্প্রতি হরিয়ানার রাখিগরহি নামে এক পুরাতাত্ত্বিক স্থান থেকে 4500 বছর আগের সিন্ধু সভ্যতার সময়ে বেঁচে থাকা এক নারীর কানের জীবাশ্ম-র ডিএনএ পরখ করেছেন। রীখের দল এই ডিএনএ বিশ্লেষণের ফলাফল 'কোষ (Cell)' পত্রিকায় বিশ্লেষণ করে প্রকাশ করেন। অন্যদিকে তাঁরা 'বিজ্ঞান (Science)' পত্রিকায় আর একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেন, যেখানে বিগত 8000 বছরেরও বেশি সময়কালীন পর্বে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে ইউরোপীয় স্তেপ তৃণভূমির মোট 523 টি প্রাচীন জীবাশ্মের ডিএনএ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ওই তথ্যের সাহায্যে তাঁরা স্তেপভূমি থেকে ইউরেশীয় পশুপালকদের দক্ষিণ দিকে তুরান অঞ্চলে আগমন, ব্যাকট্রিয়া অঞ্চল পেরিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবেশ ও মিশ্রণের তথ্য প্রমাণ তুলে ধরেন।[8]

গবেষকরা দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আগত স্বতন্ত্র তিনটি মূল জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করেছেন। এদের ভৌগোলিক অবস্থান ছিল ভিন্ন। স্বভাবতই জিনগতভাবেও এরা ছিল স্বতন্ত্র। পরবর্তী সময়ে মাইগ্রেশনের ফলে এদের দক্ষিণ এশিয়ায় মিশ্রণ হয়। এই তিনটি জনগোষ্ঠী হল -

  1. ‘আন্দামানি শিকারী-সংগ্রাহক’ জনগোষ্ঠী: এরা আনুমানিক পঁয়ষট্টি হাজার বছর আগে সরাসরি ভারতে এসেছে।

  2. ‘প্রাচীন ইরান-সম্পর্কিত শিকারী-সংগ্রাহক’ জনগোষ্ঠী: এরা ইরানের শিকারী-সংগ্রাহকদের এক শাখা, যারা বারো হাজার বছর আগে ভারতে প্রবেশ করে। এবং

  3. সেন্ট্রাল স্তেপভূমির ‘ইন্দো-ইউরোপীয়’ জনগোষ্ঠী: এই জনগোষ্ঠী ছিল অর্ধ যাযাবর পশুপালক। স্তেপভূমি থেকে ঘোড়ায় টানা রথে চড়ে এরা ভারতবর্ষে এসেছে। এদেরকেই আর্য বলা হয়ে থাকে। এদের ভাষা ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর বৈদিক সংস্কৃত।

‘আন্দামানি শিকারি সংগ্রাহক’রা (অর্থাৎ আফ্রিকা থেকে 65 হাজার বছর আগে আসা জনগোষ্ঠী) সারা ভারতে দীর্ঘদিন একাধিপত্য বজায় রেখেছে। তারপরে হলোসিন যুগের একেবারে শুরুতে, বারো হাজার বছর আগে আবার শুরু হয় সিন্ধু নদীর তীরে নতুন মানুষের আগমন। ওরা এসেছিল ইরান দেশ থেকে। ওরাও ছিল শিকারি সংগ্রাহক। ওদের বলা যায় ‘প্রাচীন ইরান-সম্পর্কিত শিকারি সংগ্রাহক’। ভারতের ‘আন্দামানি শিকারি সংগ্রাহক’ অধিবাসীদের সঙ্গে এদের কিছু মিশ্রণ হয়েছে চার থেকে ছয় হাজার বছর আগে। আনুমানিক চার হাজার ছ’শ বছর আগে এই মিশ্র জনগোষ্ঠী শুরু করেছিল হরপ্পা সভ্যতা। রাখিগরহি ও অন্যান্য কাছাকাছি প্রত্নস্থলের দেহাবশেষের ডিএনএ বিশ্লেষণে বোঝা যায় হরপ্পা সভ্যতার মানুষেরা ছিল মূলত ‘প্রাচীন ইরান-সম্পর্কিত শিকারী সংগ্রাহক’। যদিও তাদের সঙ্গে অল্প মিশ্রণ হয়েছিল ‘আন্দামানি শিকারি সংগ্রাহক’দের। এই মিশ্র জনগোষ্ঠীকে ‘সিন্ধু নদীর মিশ্র জনগোষ্ঠী’ বলা যেতে পারে। ইন্দো-ইউরোপীয়রা এই অঞ্চলে প্রবেশ করেছে আরও পরে। হরপ্পার শিলালিপির ভাষা উদ্ধার করতে পারলে এ বিষয়ে আরও বিশদভাবে বলা যাবে।

‘সিন্ধু নদের মিশ্র জনগোষ্ঠী’ তিন হাজার ন'শ বছর আগে থেকে ভারতের নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরা দক্ষিণ ভারতে এসে ওখানকার প্রাচীন ভারতের অধিবাসী ‘আন্দামানি শিকারি সংগ্রাহক’দের সঙ্গে আরও একবার মিশ্রিত হয়। এই মিশ্র জনগোষ্ঠীকে বলে ‘প্রাচীন দক্ষিণ ভারতের মিশ্র জাতি’। এই মিশ্রণ, বলা বাহুল্য, আন্দামানে ততটা হয়নি আর তা হয়নি বলেই আন্দামানের কিছু জনজাতির মধ্যে অবিমিশ্র ‘আন্দামানি শিকারি সংগ্রাহক’দের উত্তরসূরিদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।

এরপর প্রায় চার হাজার বছর থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়ার স্তেপ অঞ্চল থেকে ইন্দো-ইউরোপীয় পশুপালকরা দলে দলে প্রবেশ করে উত্তর ভারতে।

রাখিগরহি থেকে প্রাপ্ত একটি নারীর কানের জীবাশ্ম থেকে প্রাপ্ত ডিএনএ বিশ্লেষণের কথা আগেই বলেছি। সেই গবেষণার সাহায্যে ওই নারীর জিনোম সিকোয়েন্সিং করে তার জিনোমিক প্রোফাইল তৈরি করা হয়েছে। (1200 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এক হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। তাতে ইন্দো-ইউরোপীয় ডিএনএ পাওয়া যায়নি। রাখিগরহির নারীর সময়কালের নমুনার মাত্র এক হাজার বছর পরে পাকিস্তানের সোয়াট উপত্যকার সাতটি প্রত্নস্থল থেকে বিভিন্ন দেহাবশেষের যে জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়েছিল তাতে ইন্দো -ইউরোপীয় হ্যাপ্লগ্রুপের সন্ধান পাওয়া যায়।

উত্তর ভারতের মিশ্র মানুষ যারা হরপ্পা সংস্কৃতির ধারক, তাদের সঙ্গে এই নতুন অভিবাসীদের মিশ্রণে তৈরি হয় ‘প্রাচীন উত্তর ভারতের মিশ্র জাতি’। এই মিশ্রণ মূলত ছিল সিন্ধু উপত্যকার মানুষের সঙ্গে ইন্দো- ইউরোপীয় পশুপালকদের। এরাই যাবতীয় উত্তর ভারতীয় মানুষের উৎস। প্রাচীন মানুষের জীবাশ্ম'র বর্তমান বিভিন্ন ভারতীয় প্রজাতির ডিএনএ গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করেই ঐতিহাসিক ও জিনতত্ত্ববিদরা এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছেন।

আর্যদের ভারত আগমন: ডিএনএ গবেষণার ফলাফল

এই বিষয়ে আলোচনার আগে কিছু পরিভাষা সম্পর্কে জেনে নেওয়া দরকার। যেমন,'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ' বলতে কী বোঝায়? পুরুষ ও নারী উভয়ের মধ্যে ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’ থাকে। তবে নিষেকের সময় বাবার দেহ থেকে আসা শুক্রাণুর ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ভ্রূণের মধ্যে থাকে শুধু মায়ের ডিম্বাণুর ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’। অর্থাৎ ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’ শুধুমাত্র মায়ের থেকে সন্তানদের মধ্যে চলে আসে। এর অর্থ যেকোনও নারী বা পুরুষ তার মায়ের ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’ বহন করে। তাই আমার মা বহন করেন তার মায়ের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ। আর মায়ের সূত্রে আমি বহন করি আমার দিদিমার মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ। এভাবে দিদিমা আবার বহন করেন বহু প্রজন্ম আগের থেকে মাতৃবংশের ধারায় প্রবাহিত মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ। নিউক্লিয়াসের ডিএনএর মতো মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ'রও মিউটেশন ঘটে।

‘ওয়াই ক্রোমোজোম ডিএনএ’: পুরুষের প্রজনন কোষের 'ওয়াই ক্রোমোজোম ডিএনএ আবার একমাত্র পিতার থেকে পুত্রকে প্রবাহিত হয়। এই ডিএনএ কোনও নারীর শরীরে থাকে না। [9]

তাই 'মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ' ও 'ওয়াই ক্রোমোজোম ডিএনএ' বিশ্লেষণ করে যথাক্রমে মাতৃক্রম (maternal lineage) ও পিতৃক্রম (paternal lineage)-এর সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।

হ্যাপ্লগ্রুপ: হ্যাপ্লগ্রুপ হল একটি জিনগতভাবে সম্পর্কিত জনগোষ্ঠী, যাদের মা বা বাবার দিক দিয়ে এক সাধারন পূর্বপুরুষ আছে। হ্যাপ্লগ্রুপ শুধুমাত্র মাতৃক্রম বা পিতৃক্রম ধরে হয়েছে। সেই গোষ্ঠীর শাখা প্রশাখা গুলিকে বিস্তারিতভাবে বোঝাতে অনেক সময়ে অক্ষরের সঙ্গে অতিরিক্ত সংখ্যার সমন্বয় করা হয়।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা জেনেছি হ্যাপ্লগ্রুপ হল পিতৃক্রম বা মাতৃক্রম থেকে আগত একেকটি ডিএনএ শৃংখল। এই শৃঙ্খলে কি কি নির্দিষ্ট পরিবর্তন বা মিউটেশন সুদূর অতীত থেকে আজ পর্যন্ত হয়েছে তা জানার পদ্ধতি আছে। আর সেই পরিবর্তনগুলি থেকে বোঝা যায় বর্তমান কোনও জনগোষ্ঠী কিভাবে অতীতের একটি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত থাকতে পারে। 'মাইটোকনড্রিয়াল ডি এন এ' হ্যাপল্লগ্রুপ দিয়ে মাতৃক্রম অনুসারে এই সম্পর্ক বোঝা যায়। আবার 'ওয়াই ক্রোমোজোম ডিএনএ' থেকে বোঝা যায় পিতৃক্রম অনুসারী সম্পর্ক।

আজকের ভারতীয়দের 'মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ' হ্যাপ্লগ্রুপ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে' মাতৃক্রম অনুযায়ী অধিকাংশ ভারতীয় 'আন্দামানি শিকারি সংগ্রাহক'দের সঙ্গে সম্পর্কিত 'মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ' বহন করছে। কিন্তু পিতৃক্রম অনুসারে চিত্রটা একটু ভিন্ন। পুরুষদের 'ওয়াই ক্রোমোজোম ডি এন এ' বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে পিতৃক্রম অনুসারে তারা এসেছে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে।

এই বৈপরীত্য থেকে বোঝা যায় যে, পরবর্তী কালের মাইগ্রেশনগুলিতে নারী ছিল তুলনায় কম। 'প্রাচীন ইরান-সম্পর্কিত শিকারী সংগ্রাহক' জনগোষ্ঠী বা স্তেপের অর্ধ যাযাবর পশুপালক ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী - এই দুই অভিবাসী দলগুলিতে নারীর সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। ফলে এই দুই জনগোষ্ঠীর পুরুষেরা আদি 'আন্দামানি শিকারি সংগ্রাহক' নারীর সঙ্গে মিলিত হয়ে পরবর্তী প্রজন্ম সৃষ্টি করেছে। ভারতীয় পুরুষের 'ওয়াই ক্রোমোজোম ডিএনএ' আর 'মাইটোকন্দ্রিয়াল ডিএনএ'র এই ভিন্নতা আমাদের দেশের প্রাচীন ইতিহাসে পুরুষ প্রধান মাইগ্রেশনের সুস্পষ্ট প্রমাণ নির্দেশ করে।

ডেভিড রাইখ ও তাঁর সহকর্মীদের সংগৃহীত জীবাশ্মগুলির সময়কাল হল 6500 থেকে 300 খ্রিস্টপূর্বাব্দ। অর্থাৎ আজ থেকে 8500 বছর থেকে 2300 বছর আগে এরা জীবিত ছিল। অধিকাংশ জীবাশ্ম ইউরোপ, ইরান, তুরান ও রাশিয়া থেকে সংগৃহীত হয়েছে। ওরা এই গবেষণাপত্রে ইন্দো- ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর উৎস এবং মাইগ্রেশন-এর গতিপথ নিরূপনের চেষ্টা করেছিলেন।

এর কিছুদিন আগেই একটি গবেষণায় তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল বের হয়। 2015 সালে ইয়ান মাথেসন ও তাঁর সহকর্মীরা একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন।[10] তাঁদের সংগ্রহে ছিল কাস্পিয়ান সাগরের উত্তরে মধ্য ভোলগার কাছে স্তেপভূমির জঙ্গলে প্রাপ্ত ব্রোঞ্জ যুগের 2710 খ্রিস্টপূর্বাব্দের এক পুরুষের জীবাশ্ম। জায়গাটির নাম অনুসারে ওই জীবাশ্ম'র নাম রাখা হয়েছে ‘Poltyavka sample 10432’। তার 'ওয়াই ক্রোমোজোম ডিএনএ' হ্যাপ্লগ্রুপ ছিল R1a-এর এক উপশাখা R1a-Z93। এই হ্যাপ্লগ্রুপ মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াতে সর্বজনীন। কিন্তু বর্তমান ইউরোপীয়দের মধ্যে এটি বিরল। ব্যাপারটা খুবই আকর্ষণীয়। কারণ এই বিশেষ হ্যাপ্লগ্রুপটি মিউটেশনের ফলে যখন প্রথম উদ্ভূত হয় তার সামান্য পরেই ওই পুরুষটি সেটি পিতৃসুত্রে পেয়েছে। এটি এখনও পর্যন্ত কোনও পুরুষের R1a-Z93 মার্কার যুক্ত প্রাচীনতম দেহাবশেষ। পরবর্তীকালে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াতে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর পুরুষের মধ্যে এই হ্যাপ্লগ্রুপ পাওয়া গেছে।

পুরুষটির 'মাইটোকনড্রিয়াল ডি এন এ'র হ্যাপ্লোগ্রুপ হল U5a1c। এই হ্যাপ্লগ্রুপ আবার ভারতবর্ষে পাওয়া যায় না। তবে ইউরোপের মানুষের মধ্যে অত্যন্ত বেশি পরিমাণে দেখা যায়। আমরা আগেই দেখেছি যে, ‘মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ’ মাতৃক্রমের দিক থেকে আসে। অর্থাৎ এই পুরুষটির মাতা এবং সহোদরা বোনেরা মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ-তে U5a1c বহন করেছে। কিন্তু সেই সব নারীদের বংশজাত কেউ ভারতে এসেছে এমন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না; খুব সম্ভবত তারা ভারতে আসেনি।

ওয়াই ক্রোমোজোমে R1a1a-Z93 ডিএনএ ভারতের উচ্চবর্ণের মধ্যে দেখা যায়। বিশেষ করে উত্তর ভারতের ব্রাহ্মনদের মধ্যে এই ডিএনএ বা তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডিএনএ-র প্রাধান্য অবিংশবাদিত। মধ্য এশিয়াতেও এই ডিএনএ যথেষ্ট পাওয়া যায়। অর্থাৎ যারা নিজেদের আর্যদের উত্তরসূরী বলে দাবি করেন তারা সকলেই বহন করছেন মধ্য এশিয়ার প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর ডিএনএ।

বিভিন্ন আনুষঙ্গিক তথ্যের উপরে ভিত্তি করে বলা যায়, সম্ভবত আজ থেকে চার হাজার থেকে তিন হাজার আটশ' বছর আগের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে R1a1a-Z93 প্রবেশ করেছে।[11] আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়ার ব্রোঞ্জ যুগের জনগোষ্ঠী ইউরেশিয়ার পূর্ব ও দক্ষিনদিকে প্রসারিত হয়েছিল।

একটা বিষয় লক্ষ্য করার মতো – মধ্য এশিয়ার সেই জনগোষ্ঠীর প্রাচীন দেহাবশেষে (‘Poltyavka sample 10432) দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনও জেনেটিক চিহ্ন পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ তাদের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার ‘আন্দামানি শিকারী-সংগ্রাহক’ বা ‘প্রাচীন ইরান-সম্পর্কিত শিকারী-সংগ্রাহক’ জনগোষ্ঠীর ডিএনএ উপস্থিত নেই।

এখনও পর্যন্ত যেসব প্রাচীন ডিএনএ পাওয়া গেছে তার সঙ্গে বর্তমান মানুষদের ডিএনএ তুলনা করে মনে হয় মধ্য এশিয়ার মানুষ, মূলত পুরুষ মানুষ চার হাজার বছর আগে দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতের দিকে এসে এখানে বসতি স্থাপন করেছে। এবং এর বিপরীত তত্ত্বটি ঠিক নয়। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মধ্য এশিয়াতে গমনের ফলে ভারতীয় সংস্কৃতি বা ভারতের মানুষের জিন ওখানে বিস্তার লাভ করেছিল, - এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তা যদি সত্যি হত, তাহলে ‘Poltyavka sample 10432’ পুরুষটির মধ্যে ‘আন্দামানি শিকারী সংগ্রাহক’ বা ‘প্রাচীন ইরান সম্পর্কিত শিকারী-সংগ্রাহক’ দের ডিএনএ পাওয়া যেত।

প্রাচীন ইউরোপ বা প্রাচীন দক্ষিণ এশিয়ার জীবাশ্ম বিশ্লেষণ করে হ্যাপ্লগ্রুপ R ও তার উপশাখা গুলি পাওয়া যায়নি। তবে য়াম্মায়াদের ইউরোপ আগমনের পরে এই হ্যাপ্লগ্রুপ ও তার উপশাখা সেখানে পাওয়া গেছে। ভারতের ক্ষেত্রেও হ্যাপ্লগ্রুপ R আসে য়াম্ময়াদের সঙ্গে দূর সম্পর্কিত ইন্দো- ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর থেকে আগমনের সঙ্গে।

আর সেজন্যই হরপ্পা সভ্যতার রাখিগরহি থেকে প্রাপ্ত নারীর অটোজোমাল ডিএনএ বিশ্লেষণ করে স্তেপভূমির কোনও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। কারণ হরপ্পা সভ্যতা যখন শিখরে তখনও ইন্দো-ইউরোপীয় রা ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করেনি। আগেই বলেছি যে, তার মাত্র এক হাজার বছর পরে হরপ্পা সভ্যতার কাছাকাছি পাকিস্তানের সোয়াট অঞ্চলের প্রত্নস্থল থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন দেহাবশেষের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে ইন্দো-ইউরোপীয় ডিএনএর সন্ধ্যান পাওয়া গেছে।[8] অর্থাৎ বোঝা যায় যে, এই মধ্যবর্তী সময়েরই ইন্দো-ইউরোপীয়দের আগমন হয়েছে।

আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে ঘোড়ায় চড়ে বৈদিক ভাষাভাষী স্তেপভূমির অর্ধ-যাযাবর পশুপালকরা সিন্ধু উপত্যকায় প্রবেশ করে। ওদের দলে পুরুষের সংখ্যাই ছিল বেশি। তাই ভারতীয়দের মাতৃক্রমে ওদের প্রভাব পিতৃক্রমের তুলনায় অনেক কম পড়েছিল।

ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী, যাদের আর্য বলে অভিহিত করা হয়, তারা যখন উত্তর পশ্চিম সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেছে, তখন এখানকার আদি বাসিন্দাদের (যারা হরপ্পা সভ্যতার সাথে যুক্ত মানুষ ছিলেন) সাথে যোগাযোগ হয়েছে। তাকে ভিত্তি করে মিশ্রণ হয়েছে। এই মিশ্রিত মানুষ তৈরি করেছে ‘প্রাচীন উত্তর ভারতের মিশ্র জাতি’। আবার সংঘর্ষও হয়েছে। ফলে তারা ক্রমাগত দক্ষিণ দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা যত দক্ষিণে মাইগ্রেট করেছে, ততই তারা মিশ্রিত হয়েছে প্রাচীন ভারতীয় অধিবাসীদের (যারা 'আন্দামানি শিকারী সংগ্রাহক'দের জেনেটিক উপাদান বহন করছিল) সঙ্গে। এই মিশ্রিত মানুষ তৈরি করেছে ‘প্রাচীন দক্ষিণ ভারতের মিশ্র জাতি’।

আর একটা বিষয়ও উল্লেখ্য। ইন্দো-ইউরোপীয়রা, অর্থাৎ আর্যরা ভারতে একবারে আসেনি, এসেছে দলে দলে। তাদের মধ্যে একটি দল হয়তো বেদের একটা অংশ বহন করে এনেছে। অধ্যাপিকা সুকুমারী ভট্টাচার্য্য মনে করেন, তারাই শেষ বৃহৎ দল।

উপসংহার

এতক্ষণ আমরা আলোচনা করে দেখলাম যে, ঐতিহাসিকরা প্রত্নতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক ও প্রাচীন পুঁথিপত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, জেনেটিক বিজ্ঞানের গবেষণা সেই সিদ্ধান্তকেই মান্যতা দিয়েছে। অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদীরা যে দাবি করে চলেছে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান তাকে সমর্থন করে না। আর্য জনগোষ্ঠীর আদি বাসস্থান ভারতীয় ভূখণ্ড নয় বা আর্যদের মাইগ্রেশন ভারত থেকে বাইরের দিকে হয়নি। বাস্তব ঘটনা ঠিক তার বিপরীত। রাশিয়া-ইউক্রেন-কাজাখস্তানের কয়েক হাজার কিমির দীর্ঘ স্তেপভূমিতে ইন্দো-ইউরোপীয় বা আর্য জনগোষ্ঠীর জন্ম। এই স্তেপ অঞ্চলের পশ্চিম অংশ থেকে একদল (যাদের য়াম্ময়া বলা হয়) আরও পশ্চিমে মাইগ্রেট করে ইউরোপের দিকে যায় এবং সেখানে বসতি স্থাপন করে। আর এই স্তেপ অঞ্চলের পূর্ব অংশ থেকে আর একদল (যাদের আর্য বলা হয়) দক্ষিনদিকে মাইগ্রেট করে ইরান হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে। এই দুই জনগোষ্ঠী, অর্থাৎ য়াম্ময়া ও আর্যরা জিনগতভাবে সংযুক্ত। এরা একটি প্রাচীন ভাষায় কথা বলত, যাকে বলা হয় প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা। এই ভাষা থেকেই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার সৃষ্টি। সেই কারণেই ভাষাতাত্ত্বিকরা সংস্কৃত, গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষার মধ্যে সাদৃশ্য পেয়েছেন এবং এই ভাষাগুলি থেকে সৃষ্ট আধুনিক ইউরোপীয় ও উত্তর ভারতীয় ভাষার মধ্যেও সাদৃশ্য লক্ষ্য করা গেছে।

প্রসঙ্গত একটি বিষয় আলোচনা করে এই প্রতিবেদন শেষ করব। মানুষের চিন্তা প্রক্রিয়া যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা এই প্রবন্ধে উল্লেখিত দুটি গবেষণা পত্র (Cell ও Science পত্রিকায় প্রকাশিত) সম্পর্কে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের মূল্যায়ন পড়লে বোঝা যায়। ইকোনোমিক টাইমস পত্রিকায় এই গবেষণা সম্পর্কে বলা হয় যে, গবেষণাপত্র দুটি নাকি ‘দক্ষিণ এশিয়ায় আর্য আগ্রাসন বা অভিবাসন বিষয়ক দীর্ঘ দিনের তত্ত্ব’ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। ভারতের হিন্দি সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে বৃহত্তম পত্রিকাগুলোর একটি 'অমর উজালা' আরও একধাপ এগিয়ে বলেছে, “ভারতে আর্য আগমন তত্ত্ব পুরোপুরি মিথ্যা প্রমাণিত; ভারত দক্ষিণ এশিয়ার গুরু”। [12]

এমনকী দুটো গবেষণারই সহ লেখক বসন্ত সিন্ধে (প্রত্নতাত্ত্বিক ও ডেকান কলেজের উপাচার্য) একটি প্রেস বিবৃতিতে এই যুক্তি দিয়েছেন যে, এই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য ‘পুরোপুরি ভাবে আর্য অভিবাসন/আগ্রাসন তত্ত্ব বাতিল করে’ এবং এটাও জানান যে, 'হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরাই ছিল বৈদিক জনতা।' এমনকী তিনি ভাষাতাত্ত্বিক অনুমানের উপসংহার সম্পর্কে তাঁর মতদ্বৈততার কথা জানান এবং দাবি করেন যে, এই ফলাফলের কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

যে কেউ যেকোনও দাবি করতেই পারেন। কিন্তু কেউ কিছু দাবি করলেই তা সত্য প্রমাণিত হয় না। বিজ্ঞান ও ইতিহাসের কষ্টিপাথরে সেই দাবির সত্যতা যাচাই করতে হয়। মানব ইতিহাসের চলবার পথে এভাবেই অসত্যকে পরাস্ত করে যুগে যুগে বিজ্ঞান এগিয়েছে। মিথ্যা বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি। সত্যের আলোয় চিরকালই মিথ্যা পর্যুদস্ত হয়েছে, সত্যসন্ধানী মানুষ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মিথ্যাকে পরাস্ত করেছে। আজ আমাদের সামনে মিথ্যাকে পরাস্ত করে সত্যের পতাকাকে উর্দ্ধে তুলে ধরার দায়িত্ব এসে পড়েছে। আমাদের ভূমিকার উপরই নির্ভর করছে কত দ্রুত আমরা সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পারব।

লেখক পরিচিতি: শ্রী গৌড়ী একজন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক এবং ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির সর্ব-ভারতীয় কমিটির সহ-সভাপতি।

তথ্যসূত্র

[1] মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় - প্ৰাগিতিহাস: ভারতবর্ষে পরিযান ও জাতিগোষ্ঠী গঠন; গাঙচিল, কলকাতা।

[2] Christopher A.Scholz et al, “East African megadroughts between 135 and 75 thousand years ago and bearing on early modern human origins,” PNAS, 104(42), (2007): 16416 - 16421.

[3] Amanual Beyin, “Upper Pleistocene Human Dispersals out of Africa: A Review of the current state of the Debate,” Int J Evil Biol., 615094 (2011).

[3ক] Chris Clarkson et al. “Human occupation of northern Australian by 65000 yrs ago,” Nature, 547, (2017): 306 - 310)

[4] Anna Jurass et al., “Mitochondrial genomes reveal an east to west cline of steppe ancestry in Corded Ware populations,” Scientific Reports, 8, 11603, (2018).

[5] Nunziatella Alessandrini, “Images of India through the Eyes of Filippo Sassetti, a Florentine Humanist Merchant in the 16th Century,” Sights and Insights: Interactive images of Europe the Worldwide/edited by Mary N.Harris and Csaba Kebaikan (2007).

[6] Garland Cannon, “Sir William Jones, Persian, Sanskrit and the Asiatic Society,” Histoire pistmologie Langage, Anne (1984).

[7] Andrew Garret, “New Perspective on Indo-European Phylogeny and Chronology,” Proceedings of the American Philosophical Society, 162(1), (2018).

[8] V.M.Narshiman et al., “The formation of human populations in South and Central Asia,” Science, 365 (6457), (2019).

[9] Marine Silva et al., “A genetic chronology for the Indian Subcontinent points to heavily sex-biased dispersals,” BMC Evol. Biol. 17 (88), (2017).

[10] Iain Mathieson et. al., “Genome-wide patterns of selection in 230 ancient Eurassians,” Nature, 528 (2015): 499 - 503.

[11] Peter.A Underhill et. al., “The Phylogenetic and Geographic structure of Y-chromosome haplo group R1a,” Eur J of Human Genet, 23(2015):124-131.

[12] শোয়েব দানিয়েল – “স্তেপ তৃণভূমি থেকে ভারতবর্ষ: আর্যরাই কি ধ্বংস করেছিল সিন্ধু সভ্যতা?” অনুবাদ-অদিতি ফাল্গুনী (বাংলাদেশ) (‘জনান্তিক’ থেকে সংগৃহীত)।

“আদিম মানুষের মাইগ্রেশন ও আর্য জনগোষ্ঠীর জন্মবৃত্তান্ত” শীর্ষক এই প্রবন্ধটি ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি প্রকাশিত ‘প্রকৃতি’ পত্রিকার সপ্তদশ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, ডিসেম্বর 2023 থেকে নেওয়া।