বিভাগগুলি

পরিবেশ-সমস্যা ও আমাদের কর্তব্য

Photo by Markus Spiske

সৌমিত্র ব্যানার্জী

আমাদের পরিবেশ এখন একটা গভীর সংকটের মুখে। আমরা সেটা অনেক সময় নিজেরাও অনুভব করতে পারি। সাধারণ অবস্থায় যতটা দূষণ থাকে, করোনা অতিমারির কারণে লকডাউনের সময় আমরা দেখলাম দূষণের মাত্রা তার থেকে অনেক কম। এটা আমরা অনুভব করতে পারলাম। বুঝতে পারলাম, সাধারণ অবস্থায় আমরা নিশ্বাসে যে বায়ু গ্রহণ করি সেটা ঠিক সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় বায়ু নয়। সমগ্র ভারতবর্ষে জুড়ে সাধারণ মানুষ যে জল পান করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটি ঠিক পানযোগ্য জল নয়। তার কারণ হলো শিল্প-কারখানা নিঃসৃত বর্জ্য পদার্থ বায়ু জল মাটি সবকিছুই দূষিত করে চলেছে।

গ্যাসীয় বর্জ্য বায়ুতে মিশে গিয়ে যখন বৃষ্টি হচ্ছে তখন দেখা যাচ্ছে সেই বৃষ্টির জল আ্যাসিডিক। এর ফলে খাল-বিল-পুকুর-নালা দূষিত হচ্ছে। এর কারণ মূলত যেসব জিনিস কারখানায় পোড়ানো হয় তার মধ্যে সালফার থাকে। তা বায়ুর অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে সালফার এর অক্সাইড তৈরি করে। উচ্চ তাপমাত্রায় পোড়ালে বায়ুর নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেনের মধ্যেও বিক্রিয়া হয়ে নাইট্রোজেনের অক্সাইড তৈরি হয়। সেগুলিই বৃষ্টির জলের সাথে নেমে আসে।

এছাড়াও আরেকটা বড় সমস্যা আছে যেটা আশির দশকে ধরা পড়ে। দেখা গেল যে বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগের ওজোন স্তর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই ওজোন স্তর সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মিকে পৃথিবীতে প্রবেশ করতে দেয় না, এবং জীবজগৎকে এই রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচায়। অতিবেগুনি রশ্মি বেশি পরিমাণে পৃথিবীতে প্রবেশ করলে জীবজগৎ বাঁচবে না এবং মানুষের ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাবে। দেখা গেল এই ওজোন স্তর ছোট হচ্ছে এবং কোনও কোনও জায়গায় এই ওজোন স্তরে ছিদ্র দেখা যাচ্ছে। একে ‘ওজোন হোল’ বলা হয়। সেই সব জায়গা দিয়ে অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে প্রবেশ করছে। আমরা যে রেফ্রিজারেটর এবং এয়ারকন্ডিশনিং মেশিন ব্যবহার করি সেগুলোতে যে রাসায়নিক তরল ফ্রিয়ন বা ক্লোরো-ফ্লুরো-কার্বন ব্যবহার করা হয়, সেটাই এই সমস্যার মূল কারণ। নানাবিধ ব্যবহারের ফলে এই ক্লোরো-ফ্লুরো-কার্বন বায়ুতে মিশে গিয়ে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরকে ধ্বংস করে।

আরেকটা বড় সমস্যা দেখা গেল যে সামগ্রিকভাবে গোটা পৃথিবীর তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ছে। এটা গত কয়েক দশকে আমরা জানতে পেরেছি। মনে রাখতে হবে এটা কোনও বিশ্বাস নয়, এটা মেপে পাওয়া গিয়েছে। এর পেছনে অনেকগুলি কারণ থাকতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। এর মধ্যে একটি হল গ্রিন হাউস এফেক্ট। শীতের দেশে অনেক সময় মানুষজন কাঁচের ঘর তৈরি করে বসবাস করে, এমনকি চাষাবাদও করে, কারণ এরকম ঘর গরম থাকে। এর কারণ, যেসব তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো আমরা দেখতে পাই সূর্য থেকে আসা সেই আলো কাঁচের মধ্য দিয়ে সহজেই ভেতরে প্রবেশ করতে পারে এবং ভেতরের বস্তুকে উত্তপ্ত করে। কিন্তু সেই উত্তপ্ত হওয়া বস্তুগুলি যখন অপেক্ষাকৃত বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তাপরশ্মি বিকিরণ করে সেটা কিন্তু আর কাঁচ ভেদ করে বাইরে যেতে পারে না। অর্থাৎ এই তাপ শক্তি কাঁচের ঘরের ভিতরে আটকে পড়ে। এটাকেই বলে গ্রিন হাউস এফেক্ট।

কার্বন ডাইঅক্সাইডেরও কাঁচের মতো এই একই ধর্ম আছে। সেই কারণেই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে যদি কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যায় তবে ভূপৃষ্ঠ থেকে বিকীর্ণ তাপ রশ্মি বায়ুমণ্ডলের ভেতরে আটকে পড়বে। মেপে দেখা গেছে যে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে।

এটা ঠিক যে বিশ্ব-উষ্ণায়ণের কারণ নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে কিছুটা দ্বিমত আছে, কারণ অতীতে প্রাকৃতিকভাবেই পৃথিবীর তাপমাত্রা কখনো বেড়েছে আবার কখনো কমেছে। যখন কমেছে তখন তুষার যুগ এসেছে, তারপর আবার তাপমাত্রা বেড়েছে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক ভাবে এবং মানুষ্য-সৃষ্ট কারণে ― এই দুইভাবেই বিশ্ব-উষ্ণায়ণ হতে পারে। যদি কোনটির প্রভাব কতটা তা আলাদা করে চিহ্নিত করতে না পারি তাহলে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বলাটা মুশকিল যে এই বিশ্ব উষ্ণায়ণের সঠিক কারণ কী। কিন্তু তা সত্ত্বেও বেশিরভাগ বিজ্ঞানী মনে করেন যে বর্তমানের এই বিশ্ব-উষ্ণায়ণ মানুষসৃষ্ট কারণেই ঘটছে। এর কারণ, আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকেই জানি যে বায়ুমণ্ডলে যদি কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়ে তবে তাপ আটকে পড়বে এবং আমরা মেপেও দেখছি যে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে। আমরা এটাও জানি যে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়ার জন্যে প্রচুর পরিমাণে জ্বালানি পোড়ানোটাই দায়ী।

আবার আমরা জানি যে গাছ সালোক সংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে এবং অক্সিজেন ছেড়ে দেয়। এর দ্বারাই এতদিন বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের একটা সমতা রক্ষিত হতো। কিন্তু আমরা যেভাবে বনভূমি ধ্বংস করছি তাতে সেই সমতা নষ্ট হচ্ছে। ফলে এই কারণেও কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণটা বাড়ছে। কার্বন ডাইঅক্সাইড সমুদ্রের জলে দ্রবীভূত হয়। কতটা পরিমাণে দ্রবীভূত হবে তা নির্ভর করে সমুদ্রের জলের তাপমাত্রার উপরে। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের দ্রবীভূত হওয়াও কমে যায়। অর্থাৎ যদি দেখা যায় যে কার্বন ডাইঅক্সাইড বেড়ে যাওয়ার কারণে সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা সামান্য পরিমাণে বাড়লো, তবে আগে যতটা কার্বন ডাইঅক্সাইড দ্রবীভূত হতো সমুদ্রের জলে এখন তার থেকে কম দ্রবীভূত হবে। অর্থাৎ গুণিতক হারে এই প্রভাবটি বৃদ্ধি পায়। এই কারণেও সমুদ্রের জলে দ্রবীভূত না হতে পেরে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই সব কারণেই বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা যে মানুষসৃষ্ট কারণেই বিশ্ব উষ্ণায়ণ হচ্ছে।

ব্যাপক বন ধ্বংসের মারাত্মক প্রভাব পড়ছে নদীগুলির ওপর। মাটির ওপর গাছ থাকলে বৃষ্টির ফোঁটা গাছের ওপর পড়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু গাছ না থাকলে সরাসরি তীব্রবেগে মাটিতে আঘাত করে ভূমিক্ষয় ঘটায়। সেই মাটি বৃষ্টির জলের সঙ্গে বয়ে গিয়ে নদীতে গিয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে নদীর নিচে পলি জমতে থাকে, নাব্যতা নষ্ট হয়, শেষে নদী মজে যায়। ভারতের বেশিরভাগ নদীর এই অবস্থা। নদীর গভীরতা না থাকায় বর্ষায় যখন প্রচুর জল নদী দিয়ে বয়ে যেতে চায় তখন কুল ছাপিয়ে প্লাবন হয়।

হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে বন ধ্বংসের প্রভাব আরও মারাত্মক। ভূ-তাত্ত্বিক অর্থে হিমালয় খুব একটা পরিণত পর্বত নয়। এখনও এর গঠন চলছে। পাথরগুলির মধ্যে জোড় খুব মজবুত নয়। এই অবস্থায় পাহাড়ের স্থায়ীত্ব অনেকটা বজায় রাখে বড় বড় গাছের শেকড়। উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত ভাবে গাছ কাটা, সড়ক নির্মাণ, আর পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদির ফলে এই স্থায়ীত্ব বিঘ্নিত হচ্ছে। বাস্তুতন্ত্র তো নষ্ট হচ্ছেই, ধ্বস নামার সংখ্যা বেড়ে গেছে, হড়কা বান বা ফ্ল্যাশ ফ্লাড হচ্ছে মাঝে মাঝেই।

তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নদীগুলিতে বড় বড় বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন। যেহেতু পাহাড়গুলির গঠন সুস্থায়ী নয়, তাই উঁচুতে বিশাল বিশাল জলাধারে বিশাল পরিমাণ জলের ভার ধরে রাখার ক্ষমতা এইসব পাহাড়ের নেই। ভুল পরিকল্পনার ফলে তাই পাহাড় আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

আমরা যে প্লাস্টিক ব্যবহার করি সেটা প্রয়োজনে‌র থেকেও অপ্রয়োজনীয় কারণেই বেশি ব্যবহার করা হয়। যে বর্জ্য পদার্থ জমা হয় তার বেশিরভাগটাই হলো প্লাস্টিক-নির্মিত অপ্রয়োজনীয় বস্তু যেটা আমাদের না হলেও চলত। বেশিরভাগটাই মোড়ক। মোড়ক না থাকলেও কিন্তু আমরা জিনিস কিনতে পারতাম। এই মোড়কের জন্যই কিন্তু বেশিরভাগ প্লাস্টিক দূষণ হচ্ছে। এই প্লাস্টিকগুলো যেখানে সেখানে জমা হচ্ছে, জলের প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে। শুধু তাই নয় প্লাস্টিক এমন একটা জিনিস যেটা জীবাণুবিয়োজ্য (biodegradable) নয়। ফলে সেটি মাটিতে থেকে যায়। দেখা যায় অনেক জায়গায় পশু-পাখি না বুঝে সে সব খেয়ে মারা পড়ছে।

ফলে সব মিলিয়ে প্রকৃতি একটা ভয়ঙ্কর সমস্যার মধ্যে আছে। মানুষ পরিবেশকে এমনভাবে ব্যবহার করছে যে তাতে বাকি জীবজগতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে এবং তার ফলে দেখা যাচ্ছে একের পর এক উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আপনারা যদি লক্ষ্য করেন তবে দেখবেন যে, কয়েক বছর আগেও পুজোর সময় শ্যামা পোকা দেখা যেত। সবুজ রঙের একটা পোকা যার ডানায় দুটো ফুটকি। দেখবেন, এখন সেটা আর দেখা যাচ্ছে না, কারণ সেগুলো আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। চারপাশের সমস্ত জীবজন্তু উদ্ভিদের জীববৈশিষ্ট্য তৈরি হয়েছে কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের ফলে। তা নানা ভাবে প্রকৃতিতে কাজে লাগে। একটি প্রাণী শুধুমাত্র একটি প্রাণীমাত্র নয়, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে সে নিজে যেমন খাদ্য, জল, বায়ু সংগ্রহ করে তেমনি তার দেহ নিসৃত বর্জ্য অন্য বহু প্রাণীর পুষ্টির যোগায়। এরকম পারস্পরিক সম্পর্ক দিয়ে প্রজাতিগুলি নিজেদের একটি সুশৃঙ্খল চক্রে আবদ্ধ করেছে।

মানুষ আজ পরিবেশকে এমন ভাবে ব্যবহার করছে যে বাস্তুতন্ত্রের এই শৃঙ্খল ভেঙে পড়ছে। প্রকৃতির এই জৈব-বৈচিত্র কে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনটা শুধুমাত্র কিছু শৌখিন কারণে নয়। প্রকৃতিতে বাঘ, হরিণ, শকুন, চড়াই, বা পোকামাকড় থাকা প্রয়োজন কি শুধুমাত্র সুন্দর লাগে বলে? অভয়ারণ্যে বেড়াতে যাওয়া যায় বলে? ব্যাপারটা কি এমন যে এরা না থাকলেও চলে, মানুষরা বেঁচে থাকলেই হল? ব্যাপারটা এমন একেবারেই নয়।

যেমন ধরুন, যে ছত্রাকটি থেকে পেনিসিলিন আবিষ্কার হয়েছিল তা যদি আবিষ্কার হবার আগেই বিলুপ্ত হয়ে যেত তবে কি পেনিসিলিন আবিষ্কার করা সম্ভব হতো? হতো না। আজকে হয়তো প্রকৃতিতে এমন অনেক উদ্ভিদ বা প্রাণী রয়েছে যেগুলি থেকে আগামী দিনে আমরা জীবনদায়ী কোনও ওষুধ তৈরি করতে পারব। কিন্তু সেই প্রজাতিটি যদি প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় তবে কিন্তু সে ওষুধ আবিষ্কার করা সম্ভব হবে না। কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের ফলে যে জীব-বৈচিত্র তৈরি হয়েছে তার বেশিরভাগটাই এখনো আমাদের অজানা। আমরা এখনো জানিনা যে কী সম্পদ লুকিয়ে আছে প্রকৃতিজগতে। ফলে আমাদের প্রকৃতির এই জীব-বৈচিত্রকে এমনভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আমরা এবং আমাদের আগামী প্রজন্ম এই জীব-বৈচিত্রের সুবিধা লাভ করতে পারে।

পরিবেশ ধ্বংসের আসল কারণ

তাহলে দেখা যাচ্ছে সমস্ত দিক থেকেই একটা সংকটজনক পরিস্থিতি। বিশ্ব পরিবেশ দিবস আজ আমাদের এভাবে উদযাপন করতে হচ্ছে, চিন্তা করতে হচ্ছে যে পরিবেশকে কীভাবে বাঁচানো যায়। তার কারণ এই সমস্যাটা আজকে অনেক বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। কিন্তু এরকম কেন হল? কেউ কেউ বলবেন যে আমরা তো সেই শিল্পবিপ্লবের সময় থেকেই কয়লা পোড়াচ্ছি। গত শতকের শুরু থেকে তেল পোড়াচ্ছি। নানাবিধ জিনিস তৈরি করার জন্য প্রকৃতি থেকে আমরা সম্পদ আহরণ করছি। সবশেষে বর্জ্য পদার্থ হিসেবে প্রকৃতিতে ফেলে দিচ্ছি। হ্যাঁ এগুলো কারণ অবশ্যই, কিন্তু তার থেকেও একটা বড় কারণ আছে।

এই যে ধরুন আপনি যে কাপড়টা পরে আছেন, মাথার উপরে যে পাখা ঘুরছে, রাস্তা দিয়ে যে গাড়ি চলছে — এসব কিছুর জন্য কিন্তু প্রকৃতিকে কোনও না কোনও ভাবে ব্যবহার করতে হয়েছে। কাপড়টা তৈরি করতে তুলোর প্রয়োজন। সেই তুলো থেকে সুতো তৈরি করতে হয়েছে। সেজন্যে একটি শিল্প কারখানায় বিদ্যুতের ব্যবহার করতে হয়েছে এবং এই বিদ্যুৎ তৈরি করতে গিয়ে কয়লা পোড়াতে হয়েছে। আমাদের আধুনিক জীবন-যাপনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবকিছুর উৎপাদনের জন্য কোথাও না কোথাও কোনও না‌ কোনওভাবে প্রকৃতিকে ব্যবহার করতে হয়েছে। এর বিরোধিতা আমরা করবো না।

কিন্তু সমস্যাটা হল, যে পদ্ধতিতে আমাদের দেশে এবং পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই উৎপাদন হয় তা নিয়ে। যাদের প্রচুর টাকা আছে এমন কেউ একজন বিনিয়োগ করে জমি কেনে, কারখানা তৈরি করে, তারপর সেখানে মানুষজনকে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করে এবং প্রকৃতি থেকে আহরিত নানা ধরনের কাঁচামাল ব্যবহার করে কারখানায় পণ্য উৎপাদন করে। সেই উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি করে যে আয় হয় সেই আয়ের একটা সামান্য অংশ শ্রমিককে তার মজুরি হিসেবে দেয়, কিছু অংশ কাঁচামাল কেনার টাকা হিসেবে খরচ হয় আর বাকি অংশটা তার লাভ হয়। এই পুরো উৎপাদন পদ্ধতি চলে একটা নীতির ওপর ― সর্বোচ্চ লাভের নীতি।

শিল্পপতি মূলত তিনটে জিনিস কেনে ― জমি, শ্রমিকের শ্রম ও কাঁচামাল। এসবের জন্য যে খরচা সে করে তার থেকে অনেক বেশি দামে সে বিক্রি করে। তার থেকে যে লাভ, তাকে সবচেয়ে বেশি করতে হলে যেখানে যেখানে সে খরচ করেছে সেগুলো যতটা পারা যায় কমাতে হবে। অর্থাৎ যে জমিটা সে কিনেছে সেটা কত কম খরচে কেনা যায় সেটা সে দেখবে। যে শ্রমিককে মজুরি দিচ্ছে তাকে কতটা কম মজুরি দিলে সে কোনও রকমে বেঁচে থেকে কারখানায় কাজটা শুধুমাত্র করে দিতে পারবে সেটা সে দেখবে। আর কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য প্রকৃতিকে সে যত সহজে, যত কম খরচে, যত অনায়াসে নিজের উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করতে পারবে ততই তার লাভ বাড়বে। এর ফল হ’ল মানুষকে আরো বেশি শোষণ, প্রকৃতিকে আরো বেশি শোষণ। এই শোষণের ফলে যেমন সমাজের বেশিরভাগ মানুষ গরিব থেকে আরো গরিবতর হতে থাকে এবং অল্প কিছু মানুষ ধনী থেকে ধনীতর হতে থাকে, তেমন প্রকৃতির ওপরেও এর একটা প্রত্যক্ষ প্রভাব আছে।

যেমন ধরুন, যখন ওজোন স্তরের ক্ষতিটা বোঝা গেল, তখন ক্লোরো-ফ্লুরো-কার্বন এর ব্যবহার বন্ধ করাটা প্রয়োজন। অর্থাৎ এটি ব্যবহার না করে অন্যভাবে রেফ্রিজারেটর এবং এয়ার কন্ডিশনার মেশিন তৈরি করতে হবে। এর জন্য প্রচুর পরিমাণে গবেষণায় খরচ করতে হবে। প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু পুঁজিপতিরা তাতে রাজি হবেন কেন? তাতে তো তাদের মুনাফা কমে যাবে। ফলে দেখুন, সারা পৃথিবীর ভালোর জন্য যেটা প্রয়োজন, সেটা অল্প কিছু ধনী মানুষের মুনাফার জন্য সুবিধাজনক নাও হতে পারে। এই পুঁজিপতিরা শাসন ব্যবস্থায় এমন প্রভাব নিয়ে আছে যে তারা সেটাকে আটকে দিতে পারে। ওজোন স্তরে ছিদ্রের ব্যাপারটা আজ থেকে অন্তত 15-20 বছর আগে জানা গিয়েছিল। এতগুলি বছরের মধ্যে নানান চুক্তি হয়েছে। অথচ এখনও আমরা যে এয়ারকন্ডিশনার অথবা রেফ্রিজারেটর ব্যবহার করি সেখানে কিন্তু ক্লোরো-ফ্লুরো-কার্বনই ব্যবহার হয়। অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু সমাজের সামগ্রিক স্বার্থের কথা মাথায় রেখে একটা পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হলাম। কারণটা হলো সেই সর্বোচ্চ লাভের নীতি।

ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে টিস্যুপেপার নানান কাজে প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার হয়। তার মধ্যে কিছু প্রয়োজনীয়, কিছু অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু এই টিস্যু পেপার তৈরির জন্য কাঁচামাল হলো গাছ। ফলে ওদের গাছ কাটতে হয়। কিন্তু এই গাছ কোথা থেকে কাটা হবে? যে সমস্ত দেশগুলি এখনো অনুন্নত এবং প্রচুর বনভূমি রয়েছে, সেখান থেকে। সেই জঙ্গলগুলিকে যদি কাটানো যায় তাহলেই উৎপাদনটা সহজ হয়। এবং এই কাজটা কত কম খরচে করা যায় সেটাই তাদের লক্ষ্য।

এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার রয়েছে। আগে শিল্প কারখানা স্থাপনের জন্য যে পুঁজির প্রয়োজন তা ছিল জাতীয় (National) পুঁজি অর্থাৎ শিল্পপতিরা ছিল এক একটা দেশের শিল্পপতি যেমন ভারতবর্ষের শিল্পপতি, ইতালির শিল্পপতি, আমেরিকার শিল্পপতি। কিন্তু এখন ব্যবস্থাটা যেভাবে এগিয়েছে তাতে এই পুঁজি বহুজাতিক (Multi-national) পুঁজির রূপ নিয়েছে। অর্থাৎ শুধু একটি দেশের মধ্যে নয়, সমস্ত বিশ্বের মধ্যে যেখান থেকে বেশি মুনাফা করতে পারবে সেখানেই পুঁজিপতিরা পুঁজির বিনিয়োগ করবে। দেখা যায় এমন জায়গাগুলো থেকেই সে বেশি মুনাফা করতে পারবে যেখানে মানুষ দারিদ্র্যের কারণে হোক, অশিক্ষার কারণেই হোক অথবা অসচেতনতার কারণেই হোক‌, সে নিজেই এই প্রকৃতি ধ্বংসের কাজে হাত লাগায়। ফলে সেই সমস্ত বহুজাতিক কোম্পানিরা সেই সমস্ত জায়গাতেই বিনিয়োগ করবে যেখানে মানুষকে সহজেই বুঝিয়ে দেওয়া যাবে যে এখানের এই জঙ্গল তার প্রয়োজন নেই। বরং গাছ কেটে বিক্রি করলেই তার লাভ বেশি।

আপনারা যদি ভারতবর্ষের বিভিন্ন বনভূমি এমনকি সংরক্ষিত বনভূমির মধ্যের রাস্তা দিয়ে যান তাহলে রাস্তা থেকে দেখবেন চমৎকার অরণ্য। কিন্তু যদি স্যাটেলাইট ছবি দেখেন তাহলে দেখবেন ভিতরটা ন্যাড়া হয়ে গিয়েছে। ন্যাড়া হয়ে গিয়েছে কারণ মানুষ গাছ কেটে ফেলেছে। তার দৈনন্দিন জীবন চলার জন্য যে টাকাটা প্রয়োজন সেটা তাকে একজন দিচ্ছে, গাছ কাটার জন্য দিচ্ছে। এবং দেখা যাবে এই গাছগুলো কোনো না কোনো ভাবে কোনো বৃহৎ পুঁজিপতির কারখানায় কাজে লাগছে। অর্থাৎ এই যে বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে সেটার পেছনেও কিন্তু এই সর্বোচ্চ মুনাফা নীতিই উদ্দেশ্য হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।

উৎপাদনের ফলে যে বর্জ্য পদার্থ তৈরি হয় সেটা প্রকৃতির ক্ষতি করে। তাই প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করে উৎপাদন করতে হলে বর্জ্যপদার্থ পরিশোধনের জন্য অতিরিক্ত ইউনিট বসাতে হয়, যার জন্য খরচ হয়। এই অতিরিক্ত ইউনিট বসানোটা বর্তমান ব্যবস্থায় বাস্তবে হয় না, কারণ এই অতিরিক্ত খরচটা পুঁজিপতির লাভ কমিয়ে দেবে। তাই দেখা যায় কারখানা থেকে দূষিত বর্জ্য সরাসরি নদী-নালায় ফেলে দেওয়া হয়, বা চিমনির মাধ্যমে বায়ুতে মিশিয়ে দেওয়া হয়।

অর্থাৎ ভূপরিবেশ ধ্বংসের প্রধান কারণ মুনাফাভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা। এই মূল জায়গাটা না ধরতে পারলে পরিবেশ-রক্ষার নামে হাজার কথার কচকচি হবে, চোখের জল পড়বে, কিন্তু সমস্যাটার সমাধানের রাস্তা আমরা খুঁজে পাবো না।

পরিবেশ আন্দোলনের নানা ধারা

শুধু বনভূমি নয়, সারা পৃথিবীর সমস্ত জল-জঙ্গল-জমি-ই আজ চরম সংকটে আছে। এটা যে শুধু আপনার আমার নজরে পড়েছে তাই নয়, বহু মানুষের নজরে পড়েছে। লক্ষ্য করে দেখবেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে একটা আন্দোলন চালু হয়েছে, যে আন্দোলনটাকে বলে গ্রিন মুভমেন্ট। ‘গ্রিন পার্টি’ আছে সেসব জায়গায়। জার্মানির এবং কিছু কিছু দেশের নানা রাজ্যে তারা ক্ষমতায়ও এসেছে। অর্থাৎ তাদের রাজনৈতিক শক্তি আছে, ক্ষমতা আছে। এই গ্রিন পার্টি বলে যে আমাদের পরিবেশকে সংরক্ষণ করতে হবে। বেশ ভালো কথা। কিন্তু সংরক্ষণ করতে গেলে যে কারণে পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে ― অর্থাৎ সর্বোচ্চ মুনাফা নীতি ― এটার বিরুদ্ধে কথা বলে কি? বলে না। ফলে আসলে দেখা যায় যে এই সব গ্রিন পার্টি কোনও কোনও জায়গায় ক্ষমতায় আসা সত্ত্বেও সে সব জায়গায় পরিবেশ ধ্বংসের ব্যাপারটা একই ভাবে ঘটে চলেছে, তার কোনো সমাধান হয়নি।

তেমনি পরিবেশ আন্দোলনের একজন পরিচিত নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি এ্যালবার্ট গোর। তিনি দেশে-বিদেশে ঘুরে ঘুরে বক্তৃতা দেন, মানুষকে পরিবেশ-রক্ষায় আহ্বান করেন। তাঁর ভিডিও দেখে অনেকে উদ্বুদ্ধও হয়েছেন। কিন্তু তিনি পরিবেশ সমস্যার মূল কারণটা নিয়ে মুখ খোলেন কি? না। পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ-প্রকাশটা তাঁর জনপ্রিয়তা অর্জনের মাধ্যম মাত্র। ফলে পরিবেশ নিয়ে তিনি গলা ফাটালেও পরিবেশ সমস্যা যে তিমিরে সেই তিমিরেই।

আর এক ধরনের চিন্তা আমরা দেখতে পাচ্ছি যেটাকে বলা যায় আল্ট্রা-এনভারমেন্টালিজম বা অতি-পরিবেশবাদ। এনারা বলেন, পরিবেশকে কোনওভাবেই বিঘ্নিত করা চলবে না। আর সেই কারণেই যারা অতি-পরিবেশবাদী তারা সমস্ত ধরনের উন্নয়নমূলক পরিকল্পনার বিরোধিতা করে। তারা বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির বিরোধিতা করে, রাস্তা বা রেললাইন তৈরির বিরোধিতা করে, কলকারখানা তৈরির বিরোধিতা করে।

পরিবেশ আন্দোলনের আর একটা ধারা আছে, যেটাকে বলে ‘ইকো-ফেমিনিজম’। এই নারীবাদীরা বলেন, পুরুষ যেমন নারীকে দাবিয়ে রাখে, তার ওপর অত্যাচার করে, প্রকৃতির ওপর মানুষের দখলদারি সেই দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখতে হবে। যেহেতু প্রকৃতি-লুন্ঠনটা হয় আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সাহায্যে, তাই তাঁরা দোষী ঠাউরান বিজ্ঞানকেই। সেই রেনেসাঁসের সময় থেকে যে বিজ্ঞান এগিয়েছে, আধুনিক প্রযুক্তির জন্ম দিয়েছে, তাকে তাঁরা বলেন পুরুষতান্ত্রিক বিজ্ঞান। আহ্বান করেন একে বর্জন করবার। আধুনিক বিজ্ঞানকে বর্জন করলে, গ্রহণ করব কাকে? এই প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা বলেন, গ্রহণ করতে হবে প্রাচীন জ্ঞানকে। আধুনিক সমাজকে পথ দেখাবে উপনিষদের চিন্তা, কনফুসিয়াসের উপদেশ, অ্যারিস্টটলের দর্শন — কেন না এঁদের সময় প্রকৃতিকে লুন্ঠন করা হয়নি।

পরিবেশ আন্দোলনের বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি

প্রকৃত সত্য হচ্ছে, বিজ্ঞান পরিবেশ সমস্যার সমাধানেও পথ দেখাতে পারে। বিজ্ঞানের সাহায্যে আমরা প্রকৃতি জগতের নিয়মকানুন জানতে পারি, এবং সে জ্ঞানকে মানবজাতি এবং ভূপ্রকৃতির কল্যাণার্থে ব্যবহার করতে পারি। জ্ঞান কখনও ক্ষতিকর নয়। অজ্ঞানতাই ক্ষতিকর। কিন্তু জ্ঞান কীভাবে ব্যবহৃত হবে তা ঠিক করে সমাজ। সমাজব্যবস্থা যদি মানুষের স্বার্থে কাজ করে তবে জ্ঞানের ব্যবহার হবে একরকম, আর যদি সমাজব্যবস্থা মুনাফার স্বার্থে কাজ করে তবে তা হবে অন্যরকম। বর্তমানে তাই ঘটছে। বিজ্ঞান মানুষের, সমাজের, এবং প্রকৃতির স্বার্থে ব্যবহৃত না হয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে অল্প কিছু মানুষের লোভ ও উচ্চতম মুনাফার স্বার্থে।

সত্যিই কি আধুনিক মানুষের জীবন সেই অরণ্যের জীবনে ফিরে যেতে পারে? মানুষ হাজার হাজার বছরের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রকৃতিকে চিনতে শিখেছে। প্রথমে মনে করা হতো প্রকৃতিকে জয় করতে হবে। এখন মনে করা হয় প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে বাস করতে হবে। প্রকৃতিকে চেনার মাধ্যমে জীবনযাত্রাকে উন্নত করতে হবে। এই উন্নত করার জন্য যেগুলো করা প্রয়োজন সেগুলো আমাদের করতে হবে। আমাদের গাড়ি চালানোর জন্য রাস্তার প্রয়োজন, রেললাইন প্রয়োজন, রেলগাড়ি প্রয়োজন, বিদ্যুৎ তৈরি করা প্রয়োজন এবং দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি তৈরি করা প্রয়োজন। মানুষের সমস্ত ক্রিয়াকলাপে প্রকৃতি কোনও না কোনও ভাবে বিঘ্নিত হয়ই। যেমন ধরুন একটি স্কুল যদি তৈরি হয় তবে সেই স্কুল বিল্ডিং এর নিচে কিছু কেঁচো চাপা পড়বে। অর্থাৎ প্রকৃতির কিছু না কিছু ক্ষতি হবে। কিন্তু যদি দৃষ্টিভঙ্গিটা এমন হয় যে এই স্কুল বিল্ডিং তৈরি করতে দেব না, তাহলে কি সেটা সঠিক হবে? একটা কলম তৈরি করতেও তো কিছু জিনিস লাগে আর সেই জিনিসগুলি আমাদের প্রকৃতি থেকেই নিতে হয়। এগুলির বিরোধিতা করাটা সঠিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়। অর্থাৎ, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর’ এরকম দৃষ্টিভঙ্গিটা সঠিক নয়।

প্রকৃতিকে সর্বোচ্চ মাত্রায় সংরক্ষণ করে মানবজাতির সামগ্রিক স্বার্থে উৎপাদন করাটাই হলো বিজ্ঞানসম্মত। আগে শিল্প বিপ্লবের সময় আমরা হয়তো বুঝতাম না, কিন্তু আজ আমরা বুঝি যে সামগ্রিক স্বার্থ মানে সেখানে প্রকৃতির স্বার্থও যুক্ত হয়ে আছে।

আজ যে ব্যাপকহারে পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে তার মূল কারণটা হলো বর্তমানের প্রচলিত উৎপাদন ব্যবস্থা, যাকে বলা হয় ‘পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা’। এর থেকে যদি কোনও দেশ মুক্ত হয়, তবে মানুষের যা প্রয়োজন তার সব কিছুরই উৎপাদন হবে, কিন্তু সেটা সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য নয়, একান্তই মানুষের প্রয়োজনের মেটাবার জন্য হবে।

তখনও আমাদের শিল্প কারখানার দরকার হবে, চেয়ার টেবিল দরকার হবে, বিদ্যুতের দরকার হবে। ফলে প্রকৃতিকে ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু সারাক্ষণই মাথায় থাকবে যে এই উৎপাদনের উদ্দেশ্যটা হল সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন নয়, উদ্দেশ্যটা হলো মানুষের স্বার্থে উৎপাদন। আর মানুষের স্বার্থের সাথে প্রকৃতির স্বার্থটা যেহেতু ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাই এরকম যদি শাসন ব্যবস্থা কোথাও থাকে যেখানে উৎপাদনটা করা হচ্ছে মানুষের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে, সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের জন্য নয়, তাহলে সে দেখবে কীভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত না করে উৎপাদন করা যায়। দেখা হবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে কয়লাটা ব্যবহার করা হচ্ছে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন হচ্ছে তার দ্বারা প্রকৃতির ক্ষতি যদি না করতে হয় তাহলে অতিরিক্ত কী কী করা দরকার। এরকম একটা জায়গায় উৎপাদনের ফলে যে বর্জ্য পদার্থ তৈরি হয় সেটাকে পরিশোধনের ব্যবস্থাটা উৎপাদন পদ্ধতির আবশ্যিক অঙ্গ হবে।

কোথাও একটা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র যদি করতে হয় তাহলে কয়লা পোড়াতে হবে, সেখানে ছাই জমা হবে এবং তার জন্য কিছু দূষণ হবে সেখানে। যদি এই দূষণকে সর্বনিম্ন করার যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের থাকে তাহলে আমরা এই ছাইকে কোনও না কোনও উৎপাদনে ব্যবহার করার চেষ্টা করব যাতে এটি পরিবেশে বর্জ্য পদার্থ হিসেবে পড়ে না থাকে। ইট তৈরি করা যেতে পারে, সিমেন্ট তৈরি করা যেতে পারে, এভাবে নানাভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু যেটাই হোক না কেন ওটা পরিকল্পনার মধ্যে থাকবে। কয়লা পুড়িয়ে যে কার্বন ডাইঅক্সাইড তৈরি হল তাকে শোষণ করতে হলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ঘিরে প্রচুর গাছ লাগাতে হবে। এটাও বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনার মধ্যেই থাকবে। কয়লার মধ্যে যদি সালফার থাকে তবে উৎপন্ন সালফার ডাইঅক্সাইড শুষে নেওয়ার ব্যবস্থাও বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনার অঙ্গ হবে। পাহাড়ি নদী ব্যবহার করে জলবিদ্যুৎও আমাদের তৈরি করতে হবে। কিন্তু ভূপরিবেশ রক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি যদি থাকে, তাহলে বড় বড় জলাধার তৈরি না করে নদীর বহতা ধারাকেই ব্যবহার করে তা করতে হবে, যাকে বলে Micro-hydel plant অথবা run-of-the-river hydro-electric plant। উৎপাদনটা যদি হয় মানবজাতির প্রয়োজনের স্বার্থে তবে কিন্তু সেই উৎপাদনের ফলে প্রকৃতির ক্ষতিটা সর্বনিম্ন করা যায়। এইভাবে প্রকৃতিকে ন্যুনতম বিঘ্নিত করে মানুষের প্রয়োজনে উৎপাদন করাটাই বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি।

পরিবেশ সচেতনতার বিকাশ

এই যে পরিবেশ সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা, সেটা মূলত আরম্ভ হয়েছিল সত্তরের দশক থেকে। তার আগে বাস্তবে আমাদের এই সচেতনতা ছিল না। অনেকেই মনে করতেন যে প্রকৃতিকে জয় করতে হবে, প্রকৃতিকে ব্যবহার করতে হবে মানুষের জীবনযাত্রাকে উন্নত করতে এবং সেটা করতে গিয়ে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে উৎপাদন করা হয়েছে। এইভাবে উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা এক ভোগবাদী অর্থনীতির জন্ম দিয়েছি। যেগুলো আমাদের প্রয়োজন নয়, শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য বা বিজ্ঞাপনে আকর্ষিত হয়ে যেগুলো আমরা কিনি, সেগুলোর জন্য বিপুল হারে প্রকৃতি ধ্বংস হয়। অপ্রয়োজনে বিদ্যুৎ খরচ করতে হয়, প্লাস্টিক তৈরি করতে হয়।

এর ক্ষতিকর দিকগুলো সত্তরের দশকের আগে অবধি মানুষের নজরে আসেনি। সত্তরের দশকের শুরুতে কিছু বিজ্ঞানী একত্রিত হয়ে একটা গ্রুপ তৈরি করেন, তার নাম ‘ক্লাব অফ রোম’। তাঁরা 1972 সালে একটি বই বের করেন যার নাম ছিল The Limits to Growth। সেখানে তাঁরা দেখান, আমরা যে উন্নয়ন-উন্নয়ন বলে যাচ্ছি, তার একটা সীমা আছে। কারণ যেগুলো দিয়ে আমরা উৎপাদন করছি, যেমন কয়লা, পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি, পৃথিবীতে এগুলোর ভাঁড়ার সীমিত। প্রচুর পরিমাণে থাকলেও একদিন কিন্তু শেষ হবে। ফলে এগুলি ব্যবহার করে আমরা অনন্ত কাল ধরে উৎপাদন করে যাব সেটা কিন্তু সম্ভব হবে না। এ কারণেই তাঁরা বললেন যে এখন থেকে আমাদের এগুলোর ব্যবহার সীমিত করতে হবে, যাতে এগুলিকে আমরা বহুদিন পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারি।

শুধু শক্তি প্রচলিত উৎসগুলো সীমিত তাই নয়, উৎপাদনের কাঁচামালের উৎসও সীমিত। যেমন ধরুন, আমরা যে সমস্ত মিশ্র ধাতু ব্যবহার করি তার মধ্যে কোনও কোনওটির উৎপাদনে ম্যাঙ্গানিজ প্রয়োজন হয়। এই ম্যাঙ্গানিজের পরিমাণ কিন্তু পৃথিবীতে সীমিত। এই মিশ্র ধাতুগুলি ব্যবহারের পরে সেগুলি বর্জ্য পদার্থের মধ্যে চলে যাচ্ছে। তখন এগুলি থেকে কিন্তু আর ম্যাঙ্গানিজকে নিষ্কাশন করে পুনর্ব্যবহার করা যায় না।

ম্যাঙ্গানিজ আমরা আজও পৃথিবী থেকে আহরণ করতে পারছি তার কারণ সেটি এখনও শেষ হয়ে যায়নি, ফলে আমরা মিশ্র ধাতুগুলিও তৈরি করতে পারছি। যত দিন যাবে তত দেখা যাবে এই ম্যাঙ্গানিজের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। কিন্তু এই কমে যাওয়ার মানে কী? ম্যাঙ্গানিজ কিন্তু বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে না। ব্যবহারের পরে আমরা সেটাকে বর্জ্য পদার্থ হিসেবে ফেলে দিচ্ছি। আমাদের চেষ্টা করতে হবে যে এই বর্জ্য পদার্থ থেকে কীভাবে এবং কতটা আমরা পুনর্ব্যবহার করতে পারি। এটা আমরা বাস্তবে করি না কারণ এই পুনর্ব্যবহার করাটা খরচ সাপেক্ষ। সেটা করতে গেলে লাভের থেকে বেশি খরচ হয়ে যাবে। অর্থাৎ যে উৎপাদনে লাভই হচ্ছে আসল উদ্দেশ্য সেই উৎপাদনে এটা কেউ করবে না। আমরা যেগুলো ব্যবহার করছি ব্যবহারের পর সেগুলো থেকে আবার ব্যাপকভাবে জিনিসগুলো পুনরুদ্ধার করাটা এখনো সম্ভব হয়নি এই কারণেই‌। যেখানে যেখানে এটা সম্ভব সেটা এখনো হয়নি তার কারণ এটা এখনও লাভজনক নয়। লাভের জন্যই তো বর্তমানে উৎপাদন হয়। ফলে যদি লাভ না হয় তাহলে উৎপাদন হবে কেন? যখন উৎপাদন ব্যবস্থাটা হবে মানুষের স্বার্থে তখন অবশ্যই সেটা হবে।

ধরা যাক একটা গাড়ির চাকার যে টায়ার সেটা একটা শিল্প-কারখানায় উৎপাদন হল। তারপর গাড়িটা যখন চলবে তখন টায়ারটা ধীরে ধীরে ক্ষয় পেতে থাকবে, অর্থাৎ সেখান থেকে ধীরে ধীরে রাবারের ছোট ছোট দানা ক্ষয় পেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকবে। এগুলিকে কিন্তু কোনওদিন সংগ্রহ করে আবার একটা নতুন টায়ার তৈরি করা সম্ভব নয়। তার মানে যেগুলো আমরা ব্যবহার করি সেগুলো প্রকৃতিতে এমন ভাবে মিশে যায় যে সেগুলিকে আর পুনরায় আহরণ করা সম্ভব নয়। যেহেতু যেগুলো দিয়ে আমরা উৎপাদন করছি তার ভাঁড়ার সীমিত, তাই তাঁরা বললেন যে উন্নয়নের কিন্তু একটা সীমা আছে। ফলে এ বিষয়ে সচেতন হয়ে এখন থেকেই সীমিত ব্যবহার করা উচিত।

1972 সালে স্টকহোমে ইউনাইটেড নেশনস এর ডাকে একটা সামিট মিটিং হয়েছিল। সেখানে সমস্ত দেশের নেতারা এসেছিলেন এবং পরিবেশের সমস্যা নিয়ে এই প্রথম একটা বিশ্বব্যাপী আলোচনা হয়। সেখানে বেশিরভাগ দেশনেতাই একমত হন যে এই পরিস্থিতিতে আমাদের কিছু করা দরকার। তাঁরা একটা চুক্তিতে সই করেন যে সব দেশই প্রকৃতি সংরক্ষণে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু তারপরেও দেখা যায় পরিবেশ ধ্বংস বেপরোয়াভাবে চলতে থাকে। অর্থাৎ তাঁরা একমত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু কেউ এটাকে সত্যি করে মানবেন এটা মনে করেননি। তার কারণ, সেই সমস্ত দেশগুলিতে যে উৎপাদন হচ্ছে তার লক্ষ্য সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন। তারা চাইলেও এটাকে তখন বন্ধ করতে পারেন না।

তার দু’দশক পরে রিও ডি জেনেরিওতে যখন আরেকবার এরকম আর্থ সামিট হল তখন কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো সেখানে বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি একটি স্পষ্ট আহ্বান জানান যার শিরোনাম ছিল 'Tomorrow is too late' অর্থাৎ যা করতে হবে আজই করতে হবে, কালকেও খুব দেরি হয়ে যাবে। তিনি দেখালেন যে যেভাবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে, যেভাবে পৃথিবীর জল-বায়ু-মাটিকে আমরা দূষিত করে চলেছি, তাতে একটা সময় এমন আসবে যখন সেটাকে আর ফেরানো সম্ভব হবে না। পৃথিবী অনেক বড় ঠিকই, কিন্তু অসীম নয়। পৃথিবীর সহ্য করার ক্ষমতা অনেক ঠিকই, কিন্তু অসীম নয়। ফলে আমাদের এই ধ্বংসকে বন্ধ করতে হবে আর তা করতে হলে সর্বোচ্চ মুনাফার লক্ষ্যে উৎপাদনকে বন্ধ করে মানুষের সামগ্রিক প্রয়োজনে উৎপাদন করতে হবে।

আমাদের কী করণীয়?

আমাদের বুঝতে হবে এবং অন্যদের বোঝাতে হবে, মানুষের স্বার্থের সাথে প্রকৃতির স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা বেঁচে আছি এই প্রকৃতির কোলেই। তাই আজকে আমাদের পৃথিবীর যা পরিস্থিতি তাতে সাধারণ মানুষ যদি পরিবেশ ধ্বংস নিয়ে প্রতিবাদ না করে, আমাদের এই প্রকৃতিকে মায়ের মতো রক্ষা করার দাবি যদি না তোলে, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমরা এক ভয়ঙ্কর পৃথিবীকে রেখে যাবো।

তাই যেখানেই পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়বে, তার কারণ আমাদের খুঁজতে হবে, আর তা রুখতে হবে। যেখানেই দেখবো কলকারখানার বর্জ্য সরাসরি প্রকৃতিতে মিশছে, আমাদের তা রুখতে হবে। যেখানেই দেখব বন ধ্বংস হচ্ছে, গাছপালা কাটা হচ্ছে, উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে প্রকৃতির ক্ষতিসাধন হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আবার মানুষকে সংগঠিত করে পরিবেশ রক্ষায়, গাছপালা লাগিয়ে বনসৃজনে, জলসম্পদ সংরক্ষণে সক্রিয় উদ্যোগও নিতে হবে।

পৃথিবীকে যদি আমরা পরবর্তী প্রজন্মের বাসযোগ্য অবস্থায় রেখে যেতে চাই তাহলে আমাদের সকলকেই এই দাবি তুলতে হবে যে সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য উৎপাদন নয়, মানুষের স্বার্থে উৎপাদন চাই। এই দিকে যদি আমরা নিয়ে যেতে পারি তাহলেই কিন্তু পরিবেশ আন্দোলন সার্থক হবে। তা না হলে আমরা শুধু আবেগ-তাড়িত হয়ে কিছু দাবি করতে থাকবো, কিন্তু বাস্তব সমস্যার সমাধান হবে না। পরিবেশ ধ্বংস হওয়ার কারণ একটা বিশ্ব-ব্যবস্থা। এই উপলব্ধি ছাড়া পরিবেশ আন্দোলন কখনোই সফল হতে পারে না।

আর মনে রাখতে হবে ভূপরিবেশ রক্ষার জন্যও প্রকৃতি-জগতের নিয়মকানুন গুলোকে জানা প্রয়োজন। তাই বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করেই আমাদের পরিবেশ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে পশ্চাৎমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নয়।

লেখক পরিচিতি - অধ্যাপক ব্যানার্জী IISER-কলকাতা'য় অধ্যাপনায় যুক্ত এবং ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির সর্বভারতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক।

“পরিবেশ-সমস্যা ও আমাদের কর্তব্য” শীর্ষক এই প্রবন্ধটি ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি প্রকাশিত ‘প্রকৃতি’ পত্রিকার পঞ্চদশ বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, জুলাই 2021 থেকে নেওয়া।