বিভাগগুলি

প্রকৃতি বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য




রত্নদীপ সরকার

শৈশবে আমরা অনেকেই হয়তো ‘পিঁপড়ের বুদ্ধি’ বলে একটি গল্প পড়েছি। আঠার মধ্যে আটকে পড়া এক আরশোলা এবং সেই আরশোলাকে সংগ্রহ করার জন্যে পিঁপড়ের দল, কী পরিমাণ বুদ্ধি ও পরিশ্রমের পরিচয় দিয়ে আঠার ওপর ছোট ছোট পাথর ফেলে, পথ তৈরি করে, সেই পথ দিয়েই মৃত আরশোলার দেহটিকে খণ্ড খণ্ড করে নিয়ে গেল। গল্পটির উপস্থাপন ভঙ্গি এমনই প্রাঞ্জল অথচ চিত্তাকর্ষক যে, শৈশবের সরল শিশুমনকে তা এক নিমেষে আকৃষ্ট করে। এই গল্পের লেখক হলেন প্রকৃতি বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য।

উনবিংশ শতাব্দীতে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনীষীর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আমাদের দেশে নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটে। দেশে আধুনিক বিজ্ঞানশিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠার ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে শুরু করে। এরই ফলশ্রুতিতে প্রবল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও পরাধীন দেশে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, পরবর্তীকালে এঁদেরই ছাত্র সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা-এর মতো বিজ্ঞান-তাপসেরা ভারতবর্ষে বিজ্ঞান চর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধতর করে তুললেন। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানচর্চার প্রসারের সাথে সাথে তার ছটা দেশের চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল, কিন্তু জনমানসে বিজ্ঞানের দীপ্তি তখনও অপ্রবেশ্য, জনসাধারণের মনকে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে পুরনো নানান সংস্কার। মানুষের কাছে পৌঁছতে হলে মাতৃভাষা বাংলাতেই বিজ্ঞানের নববার্তা যে তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে এই সত্য উপলব্ধি করেছিলেন নবজাগরণের মনীষীরা। তারা সহজ-সরল ভাষায় সাধারণ মানুষের জন্য লিখলেন বিজ্ঞানীদের জীবন কাহিনী, বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারের কথা। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু সমাজের সর্বস্তরে বিজ্ঞান-শিক্ষা ও বিজ্ঞান-মানসিকতা পোঁছে দেওয়ার জন্যে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠা করলেন 'বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ'। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার এই সংস্থা গড়ে তোলার কাজে সেই সময় নিবিড়ভাবে যাঁর সাহায্য তিনি পেয়েছিলেন তিনি হলেন গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা ও জনবিজ্ঞান চেতনা গড়ে তোলার ভিত্তি স্বরূপ প্রাথমিকভাবে বীজটি যদিও রোপণ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ কিন্তু তাকে ফুলে-ফলে-শাখায় পল্লবিত করে তোলার বলিষ্ঠ ও সচেতন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন গোপালচন্দ্র এবং এই প্রচেষ্টা ছিল তাঁর আজীবনকাল।

বাল্যকাল, বিদ্যালয় শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চা

1895 সালের 1 আগস্ট পূর্বতন পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর মহকুমায় লোনসিং গ্রামে জন্ম হয় গোপালচন্দ্রের। পিতা অম্বিকাচরণ, মা শশীমুখী। অম্বিকাচরণের পাঁচ ছেলে, গোপালচন্দ্রই তাদের মধ্যে অগ্রজ। দরিদ্র নিম্নবিত্তের সংসার। অম্বিকাচরণ যজমানী পৌরহিত্য করে কাটান, কখনও বা করেন জমিদারের কাছারীতে কাজ। বাবা মারা গেলেন যখন গোপালচন্দ্রের বয়স মাত্র পাঁচ বছর। ফলতই দুঃখ-দারিদ্র তাঁর বাল্যসখা। কঠিন দারিদ্রের মধ্যেই প্রবল কষ্ট করে, গোপালচন্দ্র গ্রামের লোনসিং বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। সাংসারিক দুঃখ-দারিদ্র সত্ত্বেও পঠনপাঠনে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন গোপাল। এরপর, কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা পরীক্ষাতেও প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে 1914 সালে তিনি ময়মনসিং এর আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হন। সেই বছর থেকেই পৃথিবীজুড়ে শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। তবে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের যেটা ঘটল, আই এ এর দ্বিতীয় বর্ষের শেষ পরীক্ষা চলাকালীন প্রবল আর্থিক অনটন এবং আকস্মিক এক দুর্ঘটনায় পরীক্ষা আর তাঁর দেওয়া হল না। পাঠ অসম্পূর্নই থেকে গেল। 1915 সালে গোপালচন্দ্র গ্রামের স্কুলেই ভূগোলের শিক্ষক হয়ে ফিরে এলেন।

গ্রামের স্কুলে মাস্টারিতে ঢুকেই গোপালচন্দ্র স্কুলের বাগানেই উদ্যানচর্চায় মনোনিবেশ করলেন। সেখানে ছেলেদের সঙ্গে করে গাছপালা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা, কৃত্রিম উপায়ে পরাগযোগ ঘটিয়ে সংকর উদ্ভিদ তৈরি থেকে শুরু করে কলমের সাহায্যে একই গাছে দু-তিন রকমের ফুল তৈরি ইত্যাদিতে মেতে থাকতেন। ছোটবেলাতে মায়ের কাছ থেকেই বই পড়ার প্রতি অসম্ভব ঝোঁক জন্মায় তাঁর। এই সময় থেকেই ছড়া-কবিতা লেখা শুরু করেন গোপালচন্দ্র।

ক্লাস এইটে পড়ার সময় স্কুলের হেডমাস্টারমশাই বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞানের ম্যাজিক, এক্সপেরিমেন্ট করে ছাত্রদের দেখাতেন, যা ছাত্র গোপালের মনে প্রকৃতিবিজ্ঞান নিয়ে গভীর আগ্রহের সঞ্চার করে। এরপরে সেও নিজে নিজে বিভিন্ন প্রকার ম্যাজিক ও এক্সপেরিমেন্ট অনুশীলন করে এবিষয়ে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করে। স্কুলে মাস্টারি করার পাশাপাশি গাঁয়ের ছেলে-বুড়োর মনে কৌতুক তৈরির জন্য বিভিন্ন সময়ই নানান বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ও ম্যাজিক করে দেখাতেন তিনি। সমাজের সর্বস্তরে বিজ্ঞান শিক্ষা ও বিজ্ঞান মানসিকতা পৌঁছে দিতে, জনবিজ্ঞান প্রসারের কাজটি প্রাথমিকভাবে তখন থেকেই হাতে কলমে শুরু করে দিয়েছিলেন গোপালচন্দ্র, যার ধারাবাহিকতা এবং চরমোৎকর্ষস্বরূপ বাংলা ভাষায় লেখা তাঁর আট শতাধিক বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ বঙ্গদেশে ও বিদেশের জ্ঞানবিজ্ঞান ভাণ্ডারকে পুষ্ট করে এসেছে সুদীর্ঘকাল। বাংলার প্রায় সমস্ত বহুল প্রচারিত পত্র-পত্রিকায় তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধ নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে বহু দশক যাবৎ।

ছোটবেলা থেকেই যে দারিদ্র তাঁর আবাল্য-সখা, অসময়ে পিতার মৃত্যুর পরে সংসারের অসম্ভব অভাবে সহায় হতে, গোপালচন্দ্র চাইলে পিতার মতই যজমানী-পৌরহিত্যের মাধ্যমে জীবিকার্জন করে, গাঁয়ের আর পাঁচটা ছেলের মতই একঘেয়ে জীবনযাপন করতে পারতেন কিন্তু না, তাঁর প্রকৃতি ছিল ভিন্ন। দারিদ্রের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে, সামাজিক আচার প্রথার বেড়াজালকে কোনো প্রকার তোয়াক্কা না করে, বিজ্ঞানচর্চায় নিজেকে ব্রতী করেছেন তিনি। পূজার্চনা, সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদি তিনি মানতেন না, এই নিয়ে মায়ের সঙ্গে প্রায়ই তাঁর বাদানুবাদ হত। সামাজিক কুসংস্কার প্রসঙ্গে একটি নিজস্ব অভিজ্ঞতা তিনি ‘মনে পড়ে’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন “একবার ভাইয়ের ভয়ানক অসুখ হয়। ডাক্তার ও কবরেজ যখন আশা ছাড়লেন তখন একদিন স্বপ্ন দেখার ভান করে একটা ওষুধ মাকে দিলাম, ওষুধ ধারণ করবার পর রোগী ধীরে ধীরে আরোগ্য লাভ করে। এই ব্যাপারটাকে উপলক্ষ্য করে পদ্য ছন্দে একটি ব্রতকথা লিখে ছাপিয়ে দিলাম। নাম ‘আপদনাশিনীর ব্রতকথা’ বইটি ঘরে ঘরে প্রচলিত হলো। প্রচারের পর মাকে সমস্ত বিষয়টা যে মিথ্যা তা খুলে বলি, এগুলির অসাড়তা বুঝিয়ে দিলাম, অন্য লোকেদেরও বললাম, কিন্তু কেউ আমার এই সত্য কথা মানতে রাজি হননি।” ছোট্ট এই ঘটনাটি থেকেই বোঝা যায় যে প্রথম জীবন থেকেই তাঁর মননে বিজ্ঞানের জমিনটা কতখানি মজবুত ছিল এবং বিভিন্ন প্রচলিত সামাজিক কুসংস্কারের অসারতা প্রমাণে তিনি সেই সময় থেকেই যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এমন অনেক ঘটনা আমরা তাঁর পরবর্তী জীবনেও লক্ষ্য করে থাকব।

এক বর্ষার সন্ধ্যায় স্কুল বোর্ডিংয়ের কয়েকজনের আড্ডার সময় হঠাৎই কচুর ঝোপের মধ্যে আগুনের শিখার মতো কিছু একটা জ্বলজ্বল করতে দেখে সকলেই সেটিকে ভৌতিক কাণ্ড বলে তর্ক জুড়ে দিলেও গোপাল তা মানলেন না। সন্দেহের নিরসন ঘটাতে অপর একজনকে নিয়ে সেই মেঘ-বৃষ্টির মধ্যেই গিয়ে পৌছলেন ‘পাঁচিরমা’র ভিটেয়। লতাগুল্মের ঝোপের মাঝেই দেখলেন অস্পষ্ট আলোর রেখা, ঘন সন্নিবিষ্ট গাছ গুলির নড়ে উঠলেই আলোটি কেঁপে কেঁপে ওঠে, অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করলেন তিনি সেটা। আরোও একটু এগুতেই পরিষ্কারভাবে লক্ষ্য করলেন- “কয়লা পুড়ে যেমন গনগনে আগুন হয়, অনেকটা সেই রকম। আলোর তীব্রতা নেই। স্নিগ্ধ নীলাভ আলোতে আশেপাশের ঘাসগুলি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কর্তিত একটা গাছের গুড়ি থেকে আলো নির্গত হচ্ছিল। সমস্ত গুড়িটাই জ্বলে জ্বলে যেন একটা অগ্নিকুন্ডে পরিণত হয়েছে। গুড়িটির অনেকটাই পচে গেছে। গুড়িটার পাশেই, একটা কচু গাছ জন্মেছিল। তার একটা পাতা এমনভাবে হেলে পড়েছিল যে, একটু বাতাসেই উপরে-নীচে উঠা-নামা করে আন্দোলিত হতো। দূর থেকে আলোটাকে একবার জ্বলতে আবার নিবতে দেখেছিলাম-এখন তার প্রকৃত কারণ বোঝা গেল।” আসলে সেখানে যে কোনো ভৌতিক বিষয় নেই তা অচিরেই বোঝা গেল। সেইখানের সেই গাছপালা ও গাছের গুড়িতে সম্ভবত জৈবদ্যুতি নিঃসরণকারী অণুজীবদের কলোনি গড়ে উঠেছে যা প্রকৃতপক্ষে সেই আলোকপ্রভার উৎস। পরবর্তীকালে এই ‘জৈবদ্যুতি’ বা ‘বায়োলুমিনিসেন্স’ নিয়ে বিশ্বে অগ্রগন্য পর্যবেক্ষণমূলক কাজ করেছেন গোপালচন্দ্র। এর কিছু পরেই একদিন রাতে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে অন্ধকারে গাছের গোরায়, মাটির খুব কাছে থেকে এমনই ধরনের আলো দেখতে পান। একটা লাঠি দিয়ে সেই আলোক নিঃসরণকারী ঝোপঝাড় খুঁচিয়ে সেখান থেকে কিছুটা পরিমাণ মাটি, পচা আমপাতা ও দূর্বাঘাস সংগ্রহ করে দেখলেন- সেগুলি অন্ধকারের মধ্যে শান্তভাবে জ্বলছে, কিন্তু আলর উপস্থিতিতে জ্বলে না। গাছপালার এই আশ্চর্য আলো বিকিরন নিয়েই 1326 বঙ্গাব্দের (ইংরেজি 1919-20 সালের ডিসেম্বর-জানুয়ারি) ‘প্রবাসী’ পত্রিকার পৌষ ও মাঘ পর পর দুটি সংখ্যায় গোপালচন্দ্রের দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। জৈবদ্যুতি (Bio-lumininance) নিয়ে এই সকল পর্যবেক্ষণমূলক কাজ করেছিলেন তখন আমাদের দেশে তো দুরস্থ পাশ্চাত্য দেশেও এই নিয়ে কাজকর্ম তেমন শুরু হয়নি।

সম্ভবত সেই বছরই তিন-চার দিনের জন্যে এক কাজের সূত্রে কলকাতায় গিয়ে ফিরে আসায় আগের দিন কাশীপুরস্থিত ‘বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্স’-এ একটি চাকরীর সুযোগ হওয়ায় সেখানেই যুক্ত হয়ে পড়লেন। পোস্ট টেলিফোন-অপারেটার। সেই কাজের ফাঁকে ফাঁকেই চলত বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান - কীটপতঙ্গ-পোকামাকড়, মাছ, ব্যাঙ ইত্যাদির অভ্যাসবিধি পর্যবেক্ষণ। অফিসে একদিনের আকস্মিক ঘটনায় ও উর্দ্ধতন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কর্তাদের অপমানজনক ব্যবহারের কারণে তিনি চাকরি ছাড়তে চাইলেন। এই ঘটনার দু-তিন দিন বাদে একদিন হঠাৎ বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাশ গোপালচন্দ্রের বাসায় এসে হাজির। পুলিন দাশ জানালেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু গোপালচন্দ্রের সাথে দেখা করতে চান, তিনি জৈবদ্যুতি সম্পর্কে ‘প্রবাসী’তে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধগুলি পড়ে প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। পরের দিনই পুলিনবাবু নিয়ে গেলেন তাঁকে আচার্য বসুর কাছে। গোপালচন্দ্র তো মনে মনে বিস্ময়ে শঙ্কিত। আলোকনিঃসারী গাছপালা নিয়ে কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর আচার্য বসু বললেন, “যদি তুমি আমার এখানে আসতে চাও, তবে অনেক কিছু শিখতে পারবে।” গোপালচন্দ্র সানন্দে আচার্য বসুর প্রস্তাবে সম্মত হলেন। বসু বিজ্ঞানমন্দিরের সাথে স্থাপিত হল তাঁর আমরণ যোগসূত্র। সময়টা 1921 সালের ফেব্রুয়ারি মাস।

বসু বিজ্ঞানমন্দিরে প্রবেশ ও বিজ্ঞান গবেষণায় আত্মনিয়োগ

ছেলেবেলায় একদা স্কুলের যোগেন মাস্টারের দেখানো ‘গাঢ় খয়েরী রঙের কতগুলি বিচি-সদৃশ বস্তু (যা প্রকৃতপক্ষে কোনো পতঙ্গের ডিমবিশেষ) যা কিছুক্ষণের মধ্যেই পতঙ্গ লার্ভার রূপ পরিগ্রহ করে টেবিলের ওপর লাফাতে আরম্ভ করল’ প্রাণীজগতের এই অবাক করা ঘটনা থেকেই কীট-পতঙ্গ, পোকামাকড় সম্বন্ধে একটা গভীর কৌতূহল জাগতে শুরু করে তাঁর। 1921 সালে আচার্য বসুর আহবানে গোপালচন্দ্র বসু বিজ্ঞানমন্দিরে যোগ দিলেন রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে। বসু বিজ্ঞানমন্দিরে প্রবেশ করে সেখানের কারখানায় গবেষণার জন্যে তৈরি যন্ত্রপাতির কলাকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা, চিত্রাঙ্কাণ, ব্লক তৈরি, উদ্ভিদের ওপর আনুবীক্ষণিক গবেষণাপ্রণালী প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষালাভ করতে লাগলেন। আচার্য্য বসুর ল্যাবের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি চালনার জন্য ‘ক্লাইভ ইঞ্জিনিয়ারিং’-এ ছ-মাসের ট্রেনিং নিলেন। প্রাথমিকভাবে, ছবি আঁকা তিনি জানতেন, তবে ‘পারস্পেক্টিভ ড্রয়িং’ শেখার জন্য ভর্তি হলেন গর্ভমেন্ট আর্ট স্কুলে, সেখানেও কিছুকাল শিক্ষাগ্রহনে অতিবাহিত হল। তারপরও বেশ কিছুকাল যন্ত্রবিজ্ঞান ও টেকনিক্যাল লাইনে শিক্ষাগ্রহন করেন। এ সকল শিক্ষাগ্রহন শেষ করে, বিজ্ঞানমন্দিরে শীঘ্রই যোগ দিলেন তিনি। বিজ্ঞানমন্দিরে নিয়ম করে, গবেষণালব্ধ ফলাফল পত্র পত্রিকায় ও পুস্তকাকারে ছাপা হবে তার জন্যে ছবি আঁকা, ফোটোগ্রাফির কাজ, ছবি আঁকার জন্যে ব্লক তৈরি করা, বৈদ্যুতিক যন্ত্র চালনা ইত্যাদি কাজ করতে হত তাঁকে। রুটিনমাফিক এই কাজের অবসরেই লেগে থাকতেন মাইক্রোস্কোপ নিয়ে, তারই তলে দেশে বেড়াতেন বিভিন্ন প্রোটোজোয়া, অনুজীব, উদ্ভিদ-প্রাণীর দেহাংশ ইত্যাদি। বিস্তীর্ণ সময় ধরে মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে পর্যবেক্ষণের ফলে জীবজগতের প্রতি তাঁর সুগভীর অভিজ্ঞতা জন্মায়। তাঁর এই সময়ের পর্যবেক্ষণের প্রাঞ্জল ও সুগভীর অভিব্যক্তি হিসেবে লক্ষ্য করা যায় 1352 বঙ্গাব্দের, দেশ পত্রিকার আষাঢ় সংখ্যায় প্রকাশিত ‘এক ফোঁটা জলে বিচিত্র জীব’ এই অনবদ্য প্রবন্ধে বর্ণিত সেন্টর, ভার্টিসেলা, রটিফার। প্রভৃতি অণুবীক্ষণীক জীবদের অদ্ভুত দেহ গঠন, সূর্যালোকের উপস্থিতিতে দেহগঠনের পরিবর্তন সহ জীবনরহস্যের বিচিত্র সব কাহিনী।

1928 সালে বসু বিজ্ঞানমন্দিরে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে আসেন জার্মান প্রকৃতি বিজ্ঞানী হ্যানস মলিশ। তিনি সেই সময়ে কিছু কাজ করছিলেন, তিনি এলে গোপালচন্দ্র, তাঁর সহকারী হিসেবে তাঁর সাথে যুক্ত হন। ছ’মাস ধরে তাঁরা দুজনে মিলে বিভিন্নস্থানে অলোক প্রদায়ী এই সকল উদ্ভিদ-প্রাণী-অনুজীব ইত্যাদি বহুস্থান থেকে সংগ্রহ করে তাদের কালচার করে তাদের এই বিশেষ কার্যক্ষমতা নিয়ে বিশদে গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ চালান এবং বহু বিচিত্র তথ্য উদ্ধার করেন।

মোটের ওপরে এই দিয়েই তাঁর বসু বিজ্ঞানমন্দিরে প্রাথমিক গবেষণার কাজ শুরু। পরে কিছু সময় উদ্ভিদের শারীরবৃত্তীয় ধর্মাবলী ও কোষ বিভাজন সংক্রান্ত গবেষণা করলেও আচার্য্য বসুর দিক থেকে তাতে খুব একটা উৎসাহিত না হওয়ায়, সেই কাজে খুব বেশি আর অগ্রসর হননি। বরং ছোটবেলার থেকেই প্রকৃতি জগতের যে বিষয়ে তাঁর অকৃত্রিম টান অনায়াসেই গড়ে উঠেছিল, স্থির করলেন সেই কীটপতঙ্গ, পোকামাকড় নিয়েই তিনি গবেষণায় যাবেন এবং গেলেনও তাই। বিভিন্ন সময়ে গবেষণার প্রয়োজনেই বসু বিজ্ঞানমন্দিরে কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালনা করেছেন। অসংখ্য বিনিদ্র রাত যাপন করতেন পশুপাখির কোনো একটি রহস্যজনক অভ্যাস বা ব্যবহার সচক্ষে দেখবার জন্যে। শুধু বিজ্ঞানমন্দিরের পরিসরেই নয়, গ্রাম বাংলার মাঠে ঘাটে, বন জঙ্গলে, নদী-পুকুরের ধারে ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে ঘুরে সংগ্রহ ও নথিভুক্ত করেছেন প্রাণীজগতের বিভিন্ন রহস্য, কলাকৌশল ও জীবনযাপনের অনবদ্য ভঙ্গি ইত্যাদি। এই প্রকার অভিনব অনুসন্ধানের ব্যতিক্রমী অথচ প্রাঞ্জল বর্ণনা আমরা পাই বাংলার ‘পিপীলিকা অনুকারী মাকড়সা’, ‘চিংড়ির জীবনযাত্রা প্রণালী’, ‘কানকোটারীর জীবনকথা’, ‘শোঁয়াপোকার মৃত্যু অভিযান’, ‘কীট-পতঙ্গের বাজনা’, ‘কীট পতঙ্গের লুকোচুরি’, ‘কীট পতঙ্গের শিল্পনৈপুণ্য’, মাকড়সা সহ ইত্যাদি নিয়ে তাঁর লেখা প্রবন্ধ গুলিতে।

গোপালচন্দ্রের গবেষণার মূল দিক

সারা বিশ্বে বর্তমানে ‘ইথোলজি’ বা ‘আনিম্যাল বিহেভিয়ার’ জীববিজ্ঞান তথা প্রকৃতি বিজ্ঞানের একটি সুপরিচিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত শাখা। লরেঞ্জ, টিনবার্গ ও ফন ফ্রিন এই তিনজন বিজ্ঞানী অ্যানিম্যাল বিহেভিয়ার নিয়ে গবেষণা করে, নোবেল পুরস্কার (1973) পেলেন। এবং বিগত বেশ কিছু দশক ধরে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, ডিসকভারি, অ্যানিমেল প্ল্যানেট ইত্যাদি টেলিভিশন চ্যানেলের সৌজন্যে পৃথিবীর বৈচিত্র্যময় জীবজন্তুর অদ্ভুত সমস্ত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমরা অনেকেই আজ পরিচিত হয়েছি। অসীম নীল সমুদ্রের অন্ধকারময় গভীর তলদেশের রঙ-বেরঙের ছোটো-বড়ো মাছ, জেলি-ফিশ, কেঁচো কিংবা শামুকের মতো কত বিচিত্র দেহী, নিডেরিয়া-অ্যানিলিডা-মোলাস্কা গোছের প্রাণী থেকে শুরু করে সুদুরে হিমাবৃত মেরুদেশের সাদা ভাল্লুক, পেঙ্গুইন কিংবা মেরুবাসী এস্কিমোদের অদ্ভুত জীবনযাত্রা-এসবই আজ আমরা অতি সহজেই দেখতে পাই টেলিভিশনের পর্দায়, কিংবা স্মার্টফোনের স্ক্রিনে। কিন্তু গোপালচন্দ্রের পোকামাকড় নিয়ে গবেষণাকালে এর কদর তো ছিলই না, বরং পোকামাকড় পর্যবেক্ষণটা ছিল পাগলামির নামান্তর। কীটপতঙ্গের খোঁজে ও তাদের অভ্যাসবিধি পর্যবেক্ষণের জন্যে অধিকাংশ সময়ই বনে-জঙ্গলে, পথে-ঘাটে, স্থানে-অস্থানে ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় কাটাতে হয়েছে তাঁকে। তাতে যে কেবল মানুষের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও অপমান ভোগ করতে হয়েছে তাই শুধু নয়, বরং বেশ কয়েকবার শারীরিকভাবে নিগৃহীতও হয়েছেন। কেননা "যে দেশে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্কে ছিল, যে দেশে তপোবন সৃষ্টি হয়েছিল, পঞ্চতন্ত্রের মতো কাহিনী রচিত হয়েছিল সেখানেই সাম্প্রতিককালে লোকেরা প্রকৃতির সঙ্গে সকল সংযোগ হারিয়ে ফেলেছেন এবং আধুনিক বিজ্ঞানের এই অংশটিকে গ্রহণ করেন নি।" তবে, অনেক কষ্ট করে গোপালচন্দ্রকে সেই সময় প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে নিজের মত, গবেষণার পথকে। তখন পরাধীন দেশ, সাম্রাজ্যবাদী শাসন: বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথাগত শিক্ষা ও ডিগ্রি কোনোটিই না থাকায় কাজ এবং গবেষণায় অনেকদূর এগিয়ে থাকলেও সুযোগের ক্ষেত্রেও অসমতার শিকার হতে হয়েছে বারবার, অবজ্ঞা ও অপমান এসেছে। তবে এসব কিছুকে তুচ্ছ করে তিনি কিন্তু নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন তাঁর অভিষ্ট পথেই। সুবিস্তৃত কর্মমুখর জীবনে কাজের ক্ষেত্রে নূন্যতম সময়ের জন্যে হলেও, ভাটা কেউ কোনদিন লক্ষ্য করেনি তাঁর কর্মোৎসাহে পৃথিবীর সকল যুগের মহান বিজ্ঞান সাধকদের এ'যেন এক অনন্য বৈশিষ্ট্য, তাঁদের চরিত্র মাধুর্যে।

গোপালচন্দ্রের লেখাপত্র পড়লেই জানা যায়, জীববিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র ছিল খুবই ব্যাপক। ‘জৈবদ্যুতি’ বা ‘Bio-luminescence’ নিয়ে তাঁর প্রাথমিক কাজ আরম্ভ হয়, প্রথম বৈজ্ঞানিক রচনাও তাঁর একে নিয়েই যা ‘প্রবাসী’ তে প্রকাশিত হয়। তবে, প্রকৃত অর্থে তার প্রথম বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ‘Fish-eating spiders of Bengal’ 1931 সালে। গোপালচন্দ্রের মৌলিক গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল প্রধানত- মাকড়সা, পিঁপড়ে, গুঁয়োপোকা মাছ এবং ব্যাঙাচি। এক সময় ‘American Museum of Natural History’ সারা পৃথিবী জুড়ে মাকড়সার সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করছিল, তখন গোপালচন্দ্রের বাংলা দেশের মেছো বা মৎস শিকারী মাকড়সা নিয়ে লেখা বিস্তৃত প্রবন্ধটি ‘American Museum of Natural History’ এর জার্নাল ‘Natural History’ তে প্রকাশিত হয়। বলা বাহুল্যই, তখন ভারতে এধরনের পর্যবেক্ষণ প্রায় কেউই করতেন না। শিকারী মাকড়সারা কীভাবে দীর্ঘক্ষন জলের মধ্যে ডুব দিয়ে থাকতে পারে, অস্বস্তিতে পড়লে জলের ওপর মৃতের মতো ভান করে চিৎ হয়ে ভাসতে থাকে, সুযোগ বুঝে তাদের সুতীক্ষ্ণ বিষাক্ত দাঁতে বিদ্ধ করে ছোট ছোট মাছ শিকার কিংবা টিকটিকি ধরার জন্যে ফাঁদ পাতার অনবদ্য বর্ণনা পাওয়া যায় ‘বাংলাদেশের মৎস শিকারী মাকড়সা’ প্রবন্ধে। মাকড়সার স্বভাব চরিত্র, প্রজনন ক্রিয়া, সন্তান পালন, মাকড়সাদের মধ্যে লড়াই, চৌর্যবৃত্তি প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অতি সন্তর্পনে, অসীম ধৈর্য্য নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে গেছেন, মাকড়সা নিয়েই লিখেছেন আরও ছ’ সাতখানা প্রবন্ধ।

মাকড়সাদের পাশাপাশি পিঁপড়েদের সমাজ, তাদের দেহকাঠামো পারস্পারিক যোগাযোগ, ফেরোমনের ক্রিয়া, বাসা তৈরির কৌশল, পিঁপড়ের কলোনিতে শ্রম বিভাজন, খাদ্য সংগ্রহ ও সঞ্চয়, সন্তান লালনপালন, পিঁপড়েদের যুদ্ধ ইত্যাদি নিয়েও দীর্ঘ কাজের স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন। এর মধ্যে ‘পিঁপড়ের বুদ্ধি’ প্রবন্ধটি আমরা সকলেই হয়তো গল্পাকারে ছোট ক্লাসে পড়েছি। সত্যিই! ক্ষুদে ক্ষুদে এই পিঁপড়েরা যে এত কর্মঠ ও বুদ্ধিদীপ্তভাবে বিভিন্ন কর্মসাধন করে থাকে, গোপালচন্দ্রের ‘পিঁপড়ের বুদ্ধি’, ‘শ্রমিক পিঁপড়ের জন্ম রহস্য’, ‘পিঁপড়ের লড়াই’, ‘ক্ষুদে পিঁপড়ের ব্লিৎসক্রিগ’ প্রভৃতি লেখায় তার চমৎকার বর্ণনা পাই। পিঁপড়ের প্রজাতি নির্ণয় এবং যৌন পরিবর্তন সম্বন্ধে তার মৌলিক অনুসন্ধান ও তথ্য সংগ্রহ, তাদের অ্যানিমেল ফিজিওলজি ও বায়োকেমিস্ট্রির গবেষণার পথ বহু দিকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। পিঁপড়ে ও মৌমাছিদের মধ্যে পুরুষ, রানী, শ্রমিক, সৈনিক ইত্যাদির জন্ম বা তাদের যৌন পরিবর্তন এবং এর ফলে উৎপন্ন ‘বহুরূপতা’ বা ‘পলিমরফিজম’ –এগুলি আজও আমাদের গবেষণার বিষয়।

প্রকৃতিতে বহু প্রাণী আছে যারা খাদ্য, বাসস্থান বা আত্মরক্ষার জন্য অন্য কোন ভয়ংকর বা কুৎসিত প্রাণীর রূপ নকল করে, একে বলে ‘মিমিক্রি’ বা ‘অনুকৃতি’। পতঙ্গ পর্বভুক্ত প্রাণীদের মধ্যে এই প্রবণতা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। গোপালচন্দ্র দেখিয়েছেন, প্রকৃতিজগতে এমন ধরনের মাকড়সাও দেখা যায় যাদের চেহারা ঠিক পিঁপড়েদের মতো। পিঁপড়েদের চেহারার সাথে এদের এত মিল যে স্থুল চোখে তা ধরাই পড়ে না। এদের তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘পিঁপড়ে অনুসরণকারী মাকড়সা’। এদের নিয়ে দীর্ঘ গবেষনা করে তিনি 40টি ant mimicking spiders -এর life history আবিষ্কার করেন। তিনি ধারনা করেন, পৃথিবীতে যত রকমের পিঁপড়ে আছে ঠিক তত রকমের পিঁপড়ে অনুসরণকারী মাকড়সাও থাকতে পারে। পিঁপড়ে অনুসরণকারী মাকড়সাদের জীবন ইতিহাস নিয়ে কাজের পাশাপাশি তিনি তাদের বেশকিছু নতুন প্রজাতিও আবিষ্কার করেছিলেন। 1940 সালের মে মাস নাগাদ তৎকালীন কলকাতার লবণ হ্রদ (বর্তমানে sale lake) এলাকার কেষ্টপুর গ্রাম থেকে তিনি এক চামচিকে আক্রমণকারী এক বিশেষ জাতের মাকড়সা প্রজাতিও আবিষ্কার করেন, এর নাম দেন Micaria faltana | আরেক প্রকার লাল পিঁপড়ে অনুসরণকারী মাকড়সার নাম দিয়েছিলেন Propostira ranii । এছাড়াও দু-একটা কীটপতঙ্গের নাম J.C. Bose এবং Bose Institute এর কিছু জায়গার নামানুসারে রেখেছিলেন।

বাংলার বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি ও মথ-র জীবন ইতিহাস, মেটামরফোসিস, প্রজনন কৌশল প্রভৃতির বর্ণময় পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন ‘দুধলতা প্রজাপতির জন্মকথা’, ‘শুঁয়োপোকার মৃত অভিযান’, ‘মথ ও রেশম কীট’, ‘নিশাচর প্রজাপতি’, ‘প্রজাপতির লুকোচুরি’ ইত্যাদি প্রবন্ধে।

কীটপতঙ্গ পোকামাকড়ের ওপর গবেষণার পাশাপাশি সময়াবসারে তিনি উদ্ভিদ নিয়েও কাজ করেছেন। গবেষণার প্রথমদিকে, কলমিলতার কান্ডের প্রস্থচ্ছেদ নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেন তার মধ্যে নতুন ধরনের কতগুলি কোষ। কয়েক ঘন্টা পর পরই তৈরি হয়ে চলেছে -এই পর্যবেক্ষণ তিনি আচার্য বসুর কাছে নিয়ে গেলে তিনি তাতে বিশেষ কোন উৎসাহ প্রকাশ না করায় সেটা নিয়ে তিনি আর বেশি দূর অগ্রসর হননি। তবে পরবর্তীতে পরীক্ষা করে তিনি দেখান, লজ্জাবতী গাছের কাণ্ডে পালভাইনাস দানার স্ফীত অংশের নীচের দিকটা কেটে বাদ দিলে লজ্জাবতীর পাতা নীচের দিকে সংকুচিত হয়ে হেলে পড়ে, আর ওঠে না। কিন্তু স্ফীত আশের ও পরের দিকটা কেটে বাদ দিলে পাতাগুলি স্বাভাবিকভাবেই প্রসারিত হয়ে ওঠে, আর নামে না। এ ধরনের কাজের মধ্যে দিয়ে প্ল্যান্ট ফিজিওলজির গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন চিন্তার খোরাক তিনি জুগিয়েছেন। এই বিষয়ের ওপর ডঃ বসুদেব ব্যানার্জী ও আচার্য দেবেন্দ্রনাথ বসুর সাথে তাঁর একটি গবেষণাপত্রও Transaction-এ প্রকাশিত হয়েছে 1944-46 সালে।

গোপালচন্দ্রের কর্মবিভূতি প্রকৃতিবিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারায়, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে, গবেষণা সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী এবং তাঁর লেখা বিজ্ঞান প্রবন্ধ ও গবেষণাপত্র মিলিয়ে সংখ্যাটা প্রায় হাজারের কাছাকাছি। এ’প্রসঙ্গে অপর এক প্রথিতযশা বাঙালি বিজ্ঞানসাধক রতনলাল ব্রহ্মচারীর ‘গোপালচন্দ্রের বৈজ্ঞানিক গবেষণা’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে একটি অংশ উল্লেখ করা যেতে পারে। গোপালচন্দ্রের বিবিধ ক্ষেত্রে পরিব্যপ্ত বিপুলায়তন গবেষণাকর্ম ও আবিষ্কারগুলির পরিমাণ করে, অধ্যাপক ব্রহ্মচারী যথার্থই বলেছেন, “আজ আমি শুধু তাঁর তিনটি আবিষ্কারের কথা বলব, যা আমার মতে পৃথিবীর মধ্যে প্রথম সারির কাজ। প্রথমেই বলছি নালসো পিঁপড়ের ওপর একধরনের গবেষণার কথা। নালসো পিঁপড়ে আম ইত্যাদি গাছে পাতা জুড়ে বাসা তৈরি করে। পিঁপড়ের হাল, চালস্বভাব প্রকৃতি লক্ষ করার জন্য তিনি এক ‘টেকনিক’ উদ্ভাবন করেন। স্বচ্ছ সেলোফেন trallophane) এর সাহায্যে তৈরি করা বাসার। মধ্যে পিঁপড়েদের থাকতে দিয়ে তাদের ওপর অনেক পর্যবেক্ষণ চালানো হলো 2-3 বছর ধরে। একটি বাসায় কতগুলি রাজা, রানী, কর্মী, সৈনিক পিঁপড়ের জন্ম হলো তার সংখ্যাও নির্নয় করা হলো। পিঁপড়ের সমাজে এই চার শ্রেণী আছে। রাজা, রানী বা পুরুষ ও স্ত্রী থাকতেই পারে; কিন্তু তাছাড়া, এই কর্মী বা সৈনিকের উৎপত্তি হয় কেমন করে? তাদের চেহারা ও শারীরবৃত্তের পার্থক্য কি করে সৃষ্টি হতে পারে? জেনেটিক্স বা বংশানুক্রমতা– বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এটি একটি বিরাট প্রশ্ন। কেউ কেউ বলতেন, বোধ হয় বিশেষ ধরনের বা পরিমানের খাদ্যের ওপর নির্ভর করে কোন কোন লার্ভা স্ত্রী বা রানী পিঁপড়ে হয়, কোনটা কর্মী হয়। এইভাবে জেনিটিক থিয়োরী ও ট্রফিক (trophic- খাদ্য নির্ভর) থিয়োরীর দ্বন্দ্ব চলছিল। তৎকালীন বিশ্বের ‘সামাজিক পতঙ্গ’ এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানী Wheeler, এই খাদ্যনির্ভর থিয়োরীর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেননি। গোপালচন্দ্র অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখলেন যে শুধুমাত্র কিছু বিশেষ ধরনের খাদ্য পেলেই নালসো পিঁপড়ের বাসায় নতুন রাজা ও রানী জন্মাতে পারে। পিঁপড়েদের চরে বেড়িয়ে স্বাভাবিক খাদ্য খেতে না দিয়ে, খুব প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য দিলেও বাসাতে শুধুই কর্মী পিঁপড়ের উৎপত্তি হয়। কিন্তু গ্রীষ্মকালে আম এবং আরও কয়েক জাতীয় গাছের পাতা, কোড়ক ইত্যাদি খাদ্য হিসাবে দিলে নতুন রাজা ও রানী পিঁপড়ের জন্ম হয়। প্রাকৃতিক পরিবেশে পিঁপড়েরা এই সমস্ত ধরনের পাতা ও কোড়ক খায়। কাজেই গোপালচন্দ্রের গবেষণায় প্রমাণ হলো যে, ট্রফিক থিয়োরীই সত্য, বিশেষ গুণসম্পন্ন খাদ্য পেলে তবেই বিশেষ শ্রেণীর পিঁপড়ে জন্ম নিতে পারে। আজকের দিনে জেনেটিকস বিজ্ঞান আনবিক পর্যায়ে বহুদুর চলে গেছে, –এই সূত্রে বলা যেতে পারে যে, কোন কোন সামুদ্রিক শামুকের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে লার্ভাগুলিকে বিশেষ ধরনের খাদ্য দিতে পারলে তবেই তাদের রূপান্তর (metamorphosis) সম্ভব হয়।” যাইহোক, ইতিমধ্যে পৃথিবী সুদ্ধ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বেঁধে যাওয়ায় নালসো পিঁপড়ে নিয়ে গোপালচন্দ্রের এই গবেষণা বিশ্বের দরবারে প্রায় অজানাই রয়ে গেল। গবেষণাপত্রগুলি ‘Transacion of Bose Institute’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, কিন্তু বিশ্ব জুড়ে যুদ্ধকালীন অবস্থার জন্য তা জার্মানী, ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় এবং বিশেষ করে জার্মানীতে প্রচারিত হতে পারেনি। পরবর্তীকালে 1937 থেকে 1947 সাল পর্যন্ত জার্মান বিজ্ঞানী (গায়েৎস, এবং 1940 সালে Wesson পিঁপড়েদের ওপর তাদের লার্ভাদের নিয়ে গবেষণা গোপালচন্দ্র অনুক্ত মতকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে।

দ্বিতীয় গবেষণাটি হল, উন্নত প্রাণীদের মতো না হলেও পতঙ্গ জগতেও এক ধরনের tool using বা যন্ত্র ব্যবহারের ক্ষমতা আছে এই রহস্য আবিষ্কার। “পতঙ্গের জগতে বুদ্ধিবৃত্তি কম, সহজাত প্রবৃত্তি বেশি। সেই সহজাত প্রেরণার ফলে তথাকথিত যন্ত্রের ব্যবহার পতঙ্গ জগতেও আছে। তিনি লিখে রেখেছেন কানকোটারির জীবনের এক আশ্চর্য ইতিহাস। কানকোটারি মানে earwig পোকা। এই পোকা ডিমের যত্ন নেয় অনেকেই দেখেছেন। গোপালচন্দ্র লক্ষ্য করলেন, ডিম রক্ষা করবার সময় এরা পায়ে কাদা লাগায়। ওই কাদা শুকিয়ে শক্ত হয়, তখন কোন শত্রু কাছে এলেই, পোকাটি পেছনের পা দিয়ে লাথি মারে, যেন লাথি জোরালো করবার জন্য বুট পরে নিয়েছে। জল দিয়ে তখন ঐ কাদা ধুয়ে দিলে সে আবার কাদা মাখিয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু ডিম পাড়বার পর (বা রক্ষা করবার) সময় ছাড়া আর এই প্রবণতা দেখা যায় না।”

এবার তৃতীয় গবেষণার কথায় আসা যাক, “ব্যাঙাচি থেকে ব্যাঙ হওয়ার ঘটনা সবাই জানেন। ব্যাঙাচির এই পরিবর্তন বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আয়োডিন ঘটিত থাইরক্সিন হরমোনের প্রভাবে এই পরিবর্তন সাধিত হয়। কিন্তু গোপালবাবু লক্ষ্য করলেন যে, পেনিসিলিনের প্রভাবে এই পরিবর্তন বন্ধ হয়ে যায়, ব্যাঙাচিগুলি বড় ব্যাঙাচি থেকে যায়- আর ব্যাঙ হয় না।” এ’প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, এই গবেষণার সময়ই বিখ্যাত বিজ্ঞানী Julian Husky কলকাতায় এসেছিলেন, তাঁকে এই গবেষণার ফলাফল দেখানো হলে তিনি তাতে রীতিমত বিস্মিত হন এবং তৎক্ষণাৎ একটি রিপোর্ট ‘Nature’ পত্রিকায় দেওয়ার কথা বলেন কিন্তু তা যদিও আর দেওয়া হয়ে ওঠেনি। পরে গোপালচন্দ্র তাঁর সহকারীদের নিয়ে এ’সংক্রান্ত আরও কিছু গবেষণা করেন, “দেখেন যে কয়েক রকমের ভিটামিন-বি ১২ সংশ্লেষণকারী ব্যাকটেরিয়া ব্যাঙাচির দেহে বাসা বাঁধে এবং পেনিসিলিনের প্রভাবে তারা ধ্বংস হয়ে যায়। পেনিসিলিনের প্রয়োগে যারা ব্যাঙাচিই রয়ে গেল, ব্যাঙ হলো না-তাদের ক্ষেত্রে ভিটামিন-বিটামিন বি 12 দিয়ে দেখা গেল- এটা 'metamorphosis' আনতে সাহায্যে করে।” এরপরে, সেইসব ব্যাঙাচির ওপর thyroxine হরমোন এবং একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে নানা কৌতুহলোদ্দীপক গবেষণা করেছেন গোপালচন্দ্র ও ডাঃ মেদ্দা। তার নানান বিস্ময়কর ফলাফলও তারা নথিবদ্ধ করেন। এছাড়াও, গোপালচন্দ্রের সহযোগী ডঃ অজিতকুমার মেন্দা, ডঃ প্রমথনাথ নন্দী ও রমা ঘোষ এই ব্যাঙাচির ওপর পেনিসিলিন, স্ট্রেপটোমাইওসিন সহ অন্যান্য অ্যান্টিবায়োটিক ও রাসায়নিকের প্রয়োগ করে এ’বিষয়ে আরও কাজ করেছেন। পাকস্থলীতে বসবাসকারী এই সকল ব্যাকটেরিয়া ব্যাঙাচির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় কাজটি করতে সাহায্য করে। এবিষয়ে গোপালচন্দ্রের অগ্রগণ্য গবেষণা কর্ম এই সংক্রান্ত গবেষণার একটি নতুন দ্বিগন্ত খুলে দিয়েছে। বর্তমানে, বিজ্ঞান গবেষণার অগ্রগতিতে আমরা কিন্তু জানতে পেরেছি, আন্টিবায়োটিক প্রয়োগে এ'ধরনের ঘটনা অন্যান্য প্রাণীসহ মানুষের ক্ষেত্রেও সম্ভব ও পরিলক্ষিত হয়। বলা বাহুল্যই ব্যাঙাচির রূপান্তর (metamorphosis) সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে এ’ধরনের গবেষণার কাজ গোপালচন্দ্রের হাত ধরেই ভারতে প্রথম শুরু হয়।

গোপালচন্দ্রের এই প্রকার বহুমুখী গবেষণা যেমন বিভিন্ন নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক সমস্যার সৃষ্টি করেছে তেমনি, বহুদিকে গবেষনার পথকেও উন্মুক্ত করেছে। দেশে-বিদেশের বিভিন্ন গবেষণামূলক পত্র পত্রিকাতে গোপালচন্দ্রের অজস্র প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ‘Transactions’, ‘Bombay Natural History Society’, ‘Scientific Monthly’ (USA), ‘Natural History Magazine’, New York, ‘Science and Culture’, ‘Current Science’, ‘Bombay Natural History Magazine Society’, ‘Wild Life’ (Agra) ‘Modem Review’ ইত্যাদি নামজাদা দেশি-বিদেশি ও বিশ্বের প্রথম সারির সায়েন্টিফিক জার্নালে তাঁর বাইশ খানা কি তারও বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। 1936 সালে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পত্রিকা 'Natural History' তে প্রকাশিত তাঁর লেখা প্রবন্ধ 'Bheing query of Bengal' সম্পর্কে 'New York Times' উচ্ছ্বসিত প্রসংশা করে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী Juhan Huxley তাঁর কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেন। আচার্য। বসু নিজে বলেছিলেন। “গোপাল যা কাজ করেছে তা দিয়ে D. Sc.-র প্রবন্ধ লেখা যায়।”

গোপালচন্দ্রের জীবনের ব্রত ছিল জনবিজ্ঞান প্রসার

বিজ্ঞান বিষয়টি আজও আমাদের কাছে বিশেষ খটমটোই হয়ে রয়েছে তার জন্যে আমাদের দেশের আর্থসামাজিক পরিকাঠামোও পরিকল্পিত রাজনৈতিক মদত যেমন ভীষণভাবে দায়ী তেমনি মধ্যযুগীয় কুসংস্কারমুক্ত বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজগঠনের সচেতন ও সর্বাঙ্গীন প্রয়াসেরও বিশেষ অভাব আজকের দিনে আমাদের মধ্যে। গোপালচন্দ্রের যুগে এই সমস্যা ছিল বিশেষভাবে প্রবল, মধ্যযুগীয় কুসংস্কারে আকীর্ণ সমাজ-মননে ভূত-প্রেত-অপদেবতা নিয়ে ছিল দুর্বার আলোড়ন। সে সময় গ্রামে-গঞ্জে-মফাশলে প্রায়শই এই প্রকার ভৌতিক ও অতিপ্রাকৃত ঘটনা রটনা ইত্যাদি ঘাটার খবর আসত। সাধারণ জনমানসে চিন্তাক্ষেত্রে এই জড়তা সমাজের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিরাট প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নবজাগরনের ফসল স্বরূপ নতুন নতুন স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠল, তার থেকে সায়েন্সের ডিগ্রীধারী প্রচুর ছাত্রও বের হল ফি বছর কিন্তু সংস্কারবসত যথার্থ বিজ্ঞানচিন্তার আদলে মানসিক গঠন গড়ে উঠল না, যেমন আচার্য প্রফল্লচন্দ্র রায় আক্ষেপ করে একদা বলেছিলেন, “আমি ক্লাসে এত করিয়া ছাত্রদের পড়াইলাম, যে চাঁদের ছায়া পৃথিবীর ওপর পড়িষ্যাই চন্দ্রগ্রহণ হয়। তাহারা তা পড়িল, শিখিল, নম্বর পাইল, পাস করিল। কিন্তু মজার ব্যপার হইল যখন আবার সত্যি সত্যি চন্দ্রগ্রহণ হইল তখন চন্দ্রকে গ্রাস করিয়াছে বলিয়া তাহারা ঢোল, করতাল, শঙ্খ লইয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল।” স্বদেশের আন-বিজ্ঞানচর্চা ও সামাজিক মননের এই সংকট সেই সময় যথার্থভাবে উপলব্ধি করেছিলেন আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু, তাই 1948 সালে 25 জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করলেন 'বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ'। জনবিজ্ঞান প্রসার ও সমাজে বিজ্ঞান সচেতনতা গঠনে 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান' পত্রিকা চালু হয় তারই উদ্যোগে। আচার্য বসু বুঝেছিলেন, বিদ্যালয় শিক্ষার মাধ্যমের পাশাপাশি দেশে বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রেও চিন্তার সহজাত ও স্বাভাবিক বিকাশের মাধ্যম হিসাবে মাতৃভাষা চাই। চাই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা। আর এই কাজে তাঁর অন্যতম সহযোগী হলেন গোপালচন্দ্র। সত্যেন্দ্রনাথ সেদিন কিন্তু পেয়েছিলেন এক আত্মনিবেদিত মানুষকে যে তাঁর উদ্ধৃতি 'মাসের ঠিক সময়ে কাগজ বের করতে ইহবে' কে আপ্তবাক্য হিসেবে গ্রহণ করে, সমস্ত শক্তি উজাড় করে ঢেলে দিয়েছেন ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ –এর জন্য। এই পত্রিকার অঘোষিত সম্পাদক ছিলেন গোপালচন্দ্র। 1950 সালে পত্রিকার পূর্ণ সম্পাদক হিসেবে এবং 1974 সাল থেকে পত্রিকার প্রধান সম্পাদকরূপে পরবর্তী তিন বছর এবং 1977 সাল থেকে পত্রিকার প্রধান উপদেষ্টারূপে আমৃত্যু বিজ্ঞান পরিষদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। প্রায় দু' বছর ধরে অসাড় স্ত্রী, নিজের ভগ্নস্বাস্থ্য, ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি সব কিছু উপেক্ষা করে তিনি ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান' এর সম্পাদনা করে গিয়েছিলেন সম্পূর্ন নিরলসভাবে। দীর্ঘ তিন দশক ধরে 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান' এর সম্পাদনা করে, নির্দিষ্ট সময়ে পত্রিকা প্রকাশ করে রেখে গেছেন অসামান্য নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও নিয়মানুবর্তীতার পরিচয়। কাজেই, গোপালচন্দ্রের জীবনের ব্রত- 'জনবিজ্ঞান প্রসার'-এর কাজের আর একটি আঙ্গিক হয়ে উঠল বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা। ভাবলে অবাক হতে হয়, গোপালচন্দ্র তাঁর কর্মজীবনে প্রায় হাজার খানেকের মতো বিজ্ঞান প্রবন্ধ রচনা করেছেন যেগুলো প্রকাশিত হয়েছে- প্রবাসী, বঙ্গশ্রী, উদয়ন, মন্দিরা, পথ, নবারুণ, প্রকৃতি, জ্ঞান ও বিজ্ঞান, দেশ, সন্দেশ, নুতন পত্র, শিশুসাথী, যুগান্তর, আনন্দবাজারের মতো পত্রপত্রিকাতে সুদীর্ঘ ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানসাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর এই অবদান অপরিসীম। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ইউরোপে পতঙ্গজগতের দিকপাল ছিলেন– ফ্যাবার। তিনিই প্রথম শত বাধা বিঘ্নের মধ্যে দিয়ে ফ্রান্সের নানা কীটপতঙ্গের স্বভাব পর্যবেক্ষণ করে কাব্যিক ভাষায় তা পরিবেশন করেন। "নিঃসন্দেহে এও বলা যায় বাংলা ভাষায় গোপালবাবুর প্রবন্ধগুলি ফ্যাবারের রচনাবলীর সঙ্গে তুলনীয়।" কীটপতঙ্গ, পশুপাখি ছাড়াও আবিষ্কারমূলক, উদ্ভিদবিষয়ক ও বিজ্ঞানের সংবাদমূলক 'আধুনিক আবিষ্কার 'বাংলার মাকড়সা', 'করে দেখ', 'আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু' (জীবনী)।, বাংলার কীট-পতঙ্গ', 'মনে পড়ে, পশুপাখি', বিজ্ঞানের আকস্মিক আবিষ্কার', বিজ্ঞান অমনিবাস', 'বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান সংবাদ', 'জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা খবর', 'মানবকল্যাণে পারমানবিক শক্তি', 'জীবন নিয়ে যে বিজ্ঞান', 'বিষয়ঃ উদ্ভিদ', 'প্রভৃতি পর্যবেক্ষণ', 'আমার দেখা পোকামাকড়' ইত্যাদি ছোট বড় 22টি বই তিনি রচনা করেছেন। এর মধ্যে 'বাংলার কীট পতঙ্গ' এবং 'করে দেখ' বই দুটি বিশেষভাবে উল্ল্যেখযোগ্য। 'বাংলার কীট-পতঙ্গ' বইটির জন্য তিনি সাহিত্য ক্ষেত্রে 1974-75 সালের রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। 1905 সালে 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান' পত্রিকায় যে 'কিশোর বিজ্ঞানীর দপ্তর' বিভাগটি চালু হয় তার একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল গোপালচন্দ্রের 'করে দেখ’ শিরোনামে প্রকাশিত বিজ্ঞানের সহজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক মডেল নিয়ে লেখাগুলি। 'করে দেখ' এর এক্সপেরিমেন্টগুলি একটু লক্ষ্য করলে সহজেই বোঝা যায়- বিজ্ঞানক্ষেত্রে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে তাঁর কী অদ্ভুত ও অনায়াস চলন! আজীবন শেখার কী মানসিকতা! সংস্কারমুক্ত ছোটছোট ছেলে মেয়েদের মধ্যে সহজেই বিজ্ঞানের বিভিন্ন রহস্য ও ব্যবহারিক দিকগুলির প্রতি আনুসন্ধানী মন গড়ে তুলতে সুদীর্ঘকাল সচেতন প্রয়াস। নিজের দিনকালের সীমাবদ্ধতার মধ্যে দাঁড়িয়ে, বাংলা ভাষায় ধারাবাহিক বিজ্ঞানচর্চা যখন শুরুও হয়নি, সেদিনের জিজ্ঞাসু অনুসন্ধিৎসুদের অসুবিধা নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বুঝে, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা, জনবিজ্ঞান প্রসার ও সমাজের সর্বস্তরে বিজ্ঞান সচেতনতা গড়ে তোলার কাজে যে 'dedication' এর পরিচয় তিনি রেখেছেন, ইতিহাসে তা বিরল। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বক্তব্যটিই যথোপযুক্ত, “মাতৃভাষায় গোপালচন্দ্রের যে বিজ্ঞানপ্রসারের কাজ তা সব বিতর্কের উর্ধ্বে।"

শেষে অধ্যাপক রতনলাল ব্রহ্মচারীর স্মৃতিচারণার থেকেই বলি, "গোপালচন্দ্র তাঁর 'মনে পড়ে'তে লিখে গেছেন যোগেন মাস্টারের কথা। অখ্যাত এক পল্লীগ্রামের বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক তাঁর কাছে প্রেরণা পেয়েছিলেন গোপালচন্দ্র। আব গোপালচন্দ্রের লেখা প্রবন্ধ পড়ে ছেলেবেলায় কিছুটা প্রেরণা পেয়েছিলাম আমি। আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করি না, কিন্তু অন্য অর্থে ডারউইন, ফ্যাবার, মারে আর যোগেন মাস্টার আজ এই মুহুর্তে আমাদের মধ্যেই বেঁচে আছেন। ক্ষুদ্র স্বার্থ মানুষের সাথেই মরে – মহত্তর মর্মবাণী প্রকাশ পায় জীবনের উত্তরণে, এক সূর্যোদয় থেকে আর এক সূর্যাস্তে, এক সোনার সিংহদুয়ার থেকে আর এক সোনার সিংহ দুয়ারে।" নিভৃতচারী বিজ্ঞান সাধক গোপালচন্দ্রের ক্ষেত্রেও এই একই কথা খাটে। তাঁর জীবনের সাধনা, কর্মনিষ্ঠা, আমৃত্যু সংগ্রাম, এবং প্রদর্শিত পথ থেকে শিক্ষা না নিতে পারলে, সমাজটার এগোনোর পথে বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মী হিসেবে আমাদের আশু কর্তব্যটা এক্ষুনি বুঝে না নিতে পারলে শ্রীহীন হয়ে পড়ব আমরাই।

লেখক পরিচিতি: শ্রী রত্নদীপ সরকার, দ্বিতীয় বর্ষ, প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র:

[1] গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য, 'বাংলার কীট-পতঙ্গ' 1986, দে'জ পাবলিশিং, কলিকাতা - 73; পৃঃ 170-192

[2] গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য, 'বিজ্ঞান অমনিবাস' 1987, দে'জ পাবলিশিং, কলিকাতা - 73; পূঃ 1-19, 241-282

[3] গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য, 'করে দেখ' (তিন খন্ড একত্রে) 2012, দে'জ পাবলিশিং, কলিকাতা - 73; পূঃ 7-17

[4] সমরজিৎ কর, 'অগ্রজ বিজ্ঞানী', 8ম মুদ্রণ, 2012, আনন্দ পাবলিশার্স প্রঃ লিঃ, কলকাতা - 4; পৃঃ 162-170