বিভাগগুলি

"ভারতীয় জ্ঞানধারা (ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম)" জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পরিপন্থী কেন?



সুব্রত গৌড়ী

এদেশের চিন্তাশীল মহলের কাছে বর্তমান সময়টা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে দুঃসময়।কারণ দেশের যাঁরা কর্ণধার, দেশকে প্রগতির পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য জনসাধারণের কাছে যাঁরা দায়বদ্ধ, তাঁরা দেশকে একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য যে শিক্ষানীতি(জাতীয় শিক্ষানীতি,২০২০) প্রণয়ন করেছেন,বাস্তবে তা দেশকে মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার নীল নক্সা।এর মধ্য দিয়ে তাঁরা জ্ঞানচর্চার সর্বজনস্বীকৃত পদ্ধতিকে নস্যাৎ করে দিয়ে এমনকিছু উদ্ভট দাবি করেছেন যে,মানুষের মধ্যে অন্ধবিশ্বাসের মানসিকতা কে আরও গভীরে নিয়ে যাবে।ভারতীয় জ্ঞানধারা বা ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম হল জাতীয় শিক্ষানীতির অন্তর্ভুক্ত এরকমই একটা প্রচেষ্টা।

মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা প্রাসঙ্গিক বিষয় আলোচনা করে নিতে চাই।আমরা জানি যে,জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল পদ্ধতিগত দিক।একত্রে প্রথমেই যে প্রশ্নগুলো আসে তা হল, বিজ্ঞান বলতে আমরা কী বুঝি?বিজ্ঞানমনস্কতা বলতেই বা কী বুঝি?

বিজ্ঞান বলতে সাধারণভাবে আমাদের সামনে ফুটে ওঠে কয়েকটি বিষয়,যেমন ফিজিক্স,কেমিস্ট্রি,বায়োলজি,ম্যাথেমেটিক্স ইত্যাদি। কিন্তু বিজ্ঞান মানে কিছু সাবজেক্ট মাত্র নয় বা বিজ্ঞানের অর্থ কিছু তথ্য সংগ্রহ নয়। বিজ্ঞান হল চিন্তা করবার একটা পদ্ধতি।যেহেতু আমাদের মস্তিষ্কের চিন্তা করার ক্ষমতা রয়েছে, তাই আমাদের চারপাশের বৈচিত্র্যময় জগৎকে আমাদের মনে নানা ধরনের প্রশ্ন ধাক্কা দেয়। বিজ্ঞান হল – কেন হচ্ছে,কিভাবে হচ্ছে,এইসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার হাতিয়ার। সাধারণভাবে আমরা যখন আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনাকে বা কোনও বিষয়কে বোঝার চেষ্টা করি, তখন তাকে বিচার করার একটা পদ্ধতি সমাজে প্রচলিত আছে। সেটা হল, অভিজ্ঞ কোনও ব্যক্তি বা জ্ঞানী বলে পরিচিত কোনও ব্যক্তি কী বলছেন সেটা শুনে বা জেনে তার ভিত্তিতে বিচার করার পদ্ধতি।এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই আমরা বিষয়টিকে বোঝার চেষ্টা করি।কিন্তু এই পদ্ধতিতে বিচার করার সমস্যা হল,যদি সেই ব্যক্তির বিচারটা ভুল হয়, তাহলে তাকে সংশোধনের কোনও উপায় থাকে না। দ্বিতীয়ত, যদি একাধিক বিচক্ষণ ব্যক্তির দুই ধরনের বা দুটি বিপরীত মত এসে উপস্থিত হয় তখন সত্য নির্ধারণের কোনও সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি খুঁজে পাওয়া যায় না।ফলে এই পদ্ধতিতে সঠিকভাবে বিষয়টিকে বোঝার পরিবর্তে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।তাই সত্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান এই পদ্ধতির উপর নির্ভর করতে পারেনা।এই পদ্ধতিকে বলা হয় সাবজেক্টিভ বা মনগড়া চিন্তা পদ্ধতি।কারণ, এখানে সাবজেক্ট অর্থাৎ যে বিচার করছে তার ব্যক্তিগত ধারণার উপর নির্ভর করে বিচার করা হয়।

এই পদ্ধতিতে সঠিকভাবে জানা সম্ভব হয়না বলেই বিজ্ঞান ভিন্ন পদ্ধতির কথা বলে।বিজ্ঞান যে পদ্ধতির কথা বলে তার মূল কথা হল –

(১ objectivity বা বাস্তবতার উপর নির্ভর করে বিচার করা।অর্থাৎ কোনও মনগড়া ধারণা নয়, বাস্তবে যা আছে তার ভিত্তিতে বিচার করা।

(২) দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞান ভিত্তিক পদ্ধতিতে সত্য নির্ধারণের উপায় হল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যে কোনও ভাবনাকে যাচাই করার পদ্ধতি। যতক্ষণ না কোনও ভাবনা বা ধারণা পরীক্ষা বা এক্সপেরিমেন্ট এর কোষ্ঠী পাথরে সঠিক বলে প্রমাণিত হচ্ছে ততক্ষণ তাকে সত্য বলে গ্রহণ করা যায় না।

(৩) এই কারণে বিজ্ঞান plurality of truth,অর্থাৎ একই বিষয়ে একাধিক সত্যের ধারণায় বিশ্বাস করে না। যেহেতু যে কোনও বস্তু বা ফেনমেনন একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে চলে এবং সত্য বলতে সুনির্দিষ্ট এই নিয়মটিকেই বোঝায়,তাই একটি বিষয়ে একটিই সত্য ধারণা থাকতে পারে।

(৪)বিজ্ঞানের বিচার সবসময়ই নৈর্ব্যক্তিক চরিত্রের হয়।অর্থাৎ কে বলছেন - এটা কোনও বিচার্য বিষয় নয়।যা বলছেন,সেটা যুক্তিসঙ্গত কিনা সেটাই বিচার্য বিষয়।দ্বিতীয়ত,বিজ্ঞানে যা পরীক্ষিত সত্য,তা সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে যে কেউ পরীক্ষা করে দেখুক,তাতে ফলাফলে কোনও হেরফের হয় না।অৰ্থাৎ কে পরীক্ষা করছেন,তার উপর পরীক্ষার ফলাফল নির্ভর করে না।

তাহলে বিজ্ঞানমনস্ক কোনও মানুষের সামনে কোনও প্রশ্ন উত্থাপিত হলে তার ভূমিকা কী হবে? সেই প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর সম্পর্কে তার মাথায় নানা ভাবনা আসতে পারে।সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যতক্ষণ না সেই ভাবনাগুলোর কোনও একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই হচ্ছে,যাচাই করে সত্য প্রমাণিত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই উত্তরটিকে তিনি সঠিক বলে গ্রহন করতে পারেন না।এমনও হতে পারে যে,যে ভাবনাগুলো তাঁর মাথায় প্রাথমিকভাবে এসেছিল,তার কোনোটাই পরীক্ষায় টিকলো না।তখন তিনি অন্য সম্ভাবনার কথা ভাববেন এবং সেই সম্ভাবনাকে পরীক্ষার মধ্যে ফেলবেন।যতক্ষন না তাঁর ভাবনা পরীক্ষায় সঠিক প্রমাণিত হচ্ছে,ততক্ষণ তিনি এভাবেই সত্যের অনুসন্ধান করবেন।বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরি তে ঠিক এই পদ্ধতিই অনুসরণ করেন।

এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি শুধু যে বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য,তা নয়।শিল্প-সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে,দর্শন বা ইতিহাস চৰ্চার ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব।এককথায় জ্ঞানজগতের যে কোনও ক্ষেত্রেই আমরা বিচরণ করি না কেন,বিজ্ঞানভিত্তিক এই পদ্ধতি অনুসরণ করলেই একমাত্র আমরা সত্য পথের সন্ধান পাব।

এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে সূচনাপর্ব থেকেই ছিলনা।বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উদ্ভাবন মানবসমাজের একটা দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল।সভ্যতার সূচনাপর্ব থেকেই জ্ঞানচর্চার সূচনা বলে ধরে নেওয়া যায়।জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত মানুষ সেদিন পঞ্চেন্দ্রিয়র

সাহায্যে যা পর্যবেক্ষণ করত, তার ভিত্তিতেই কোনও বস্তু বা ঘটনাকে বিচার করত।তাঁরা তাঁদের ভাবনাগুলোকে যাচাই করার কথা ভাবতো না।এই ধারণাগুলোকে যাচাই করার প্রশ্নটা সেদিন উত্থাপিতই হয়নি।কারণ তখন যারা চিন্তা করতেন,হাতেকলমে কাজকে তাঁরা ঘৃণার চোখে দেখতেন।তাই আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হত,তার ভিত্তিতেই সেদিনকার জ্ঞানী মানুষরা বিচার করতেন। ফলে বহুক্ষেত্রে যেমন সঠিক ধারণায় পৌঁছনো যেত,বহুক্ষেত্রে ভুল ধারণাও তৈরি হত।তাই ইতিহাসে দেখা গেছে বহু ভ্রান্ত চিন্তা শত-সহস্র বছর ধরে মানুষ সত্য বলে মনে করে এসেছে।বিজ্ঞানচর্চায় এই পদ্ধতির পরিবর্তন হল রেনেসাঁসের সূচনায় ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে। এই পদ্ধতির উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে যিনি পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছিলেন,তিনি হলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি।গ্যালিলিওই প্রথম প্রায় দুহাজার বছর ধরে চলে আসা এরিস্টটলের ভ্রান্ত ধরণাগুলোকে হাতে কলমে পরীক্ষা করে ভুল প্রতিপন্ন করলেন।তিনি বললেন,কোনও বিষয় সম্পর্কে আমরা যাই ভাবিনা কেন,তা সঠিক কিনা সবসময়ই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচাই করতে হয়। এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উদ্ভাবন বিজ্ঞানচর্চায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করল।তাই দেখা যায়, এই পদ্ধতির উদ্ভাবনের আগে কয়েক হাজার বছরে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে বিকাশ হয়েছে, এই পদ্ধতি উদ্ভাবনের পরে কয়েক শতকে তার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বিকাশ হয়েছে।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে দর্শনচিন্তার বিকাশেরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।তাই এই বিষয়ে কয়েকটি কথা বলে নেওয়া জরুরি।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে দর্শনের ভূমিকা

দর্শন বলতে আমরা এই দৃষ্টিভঙ্গিকেই বুঝি।আমাদের চারপাশে যে জগৎকে আমরা দেখি,অর্থাৎ প্রকৃতিজগৎ,জীবজগত,সমাজজীবন, এমনকি আমাদের মননজগতে যেসব ঘটনা ঘটে বা সমস্যা দেখা দেয়,সেইসব ঘটনা বা সমস্যাকে দেখার যে দৃষ্টিভঙ্গি, তাকেই আমরা বলি দর্শন।

ইতিহাসের গতিপথে বহু দার্শনিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব হলেও তাদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে, তার ভিত্তিতে এই দার্শনিক মতগুলিকে দুটো ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায় - ভাববাদী দর্শন ও বস্তুবাদী দর্শন।এই বিভাজন করা হয়েছে প্রধানতঃ ভাব ও বস্তুর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে।যে দার্শনিক মতবাদগুলি মনে করে যে,ভাব প্রায়র,অর্থাৎ ভাব আদি অনন্তকাল ধরে অবস্থান করছে।সেই ভাব থেকেই বস্তুজগতের উৎপত্তি,তাদের বলা হয় ভাববাদী দর্শন।আর যে দার্শনিক মতবাদগুলি মনে করে যে,বস্তুই প্রায়র,অর্থাৎ আদি অনন্তকাল থেকে বস্তুরই অস্তিত্ব আছে।এই বস্তু থেকেই ভাবের উৎপত্তি হয়েছে, সেই দার্শনিক মতবাদগুলিকে বলে বস্তুবাদী দর্শন।

এই দুটি দার্শনিক মতবাদ দুধরনের দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়।ভাববাদী দর্শনের চিন্তার আধার হল ভাবের বস্তুনিরপেক্ষ অবস্থানকে ভিত্তি করে।এই যে ধারণা,এর কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই,এটা ভাববাদীদের মনগড়া ধারণাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।তাই ভাববাদী দর্শন মনগড়া ধারণার জন্ম দেয়।অর্থাৎ ভাববাদী দর্শন সাবজেক্টিভ থট প্রসেসেকে অনুসরণ করে।তার বিপরীতে বস্তুবাদী দর্শন বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।তাই এই দর্শন অবজেক্টিভ থট প্রসেসেকে অনুসরণ করে।ফলে বাস্তবে আমরা দেখেছি যে,সমাজে যখন বস্তুবাদী দার্শনিক চিন্তা প্রাধান্য বিস্তার করেছে,তখন বিজ্ঞানচর্চা এগিয়েছে।আবার যখন সমাজে ভাববাদী দার্শনিক চিন্তা প্রাধান্য বিস্তার করেছে,তখন বিজ্ঞানচর্চা স্তিমিত হয়েছে।

বিজ্ঞানের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই চিত্রটি আমরা পরিষ্কার দেখতে পাই।প্রথমে ইউরোপীয় প্রেক্ষাপটে আলোচনা করে দেখা যাক।ইউরোপের বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে আমরা দেখেছি যে,দর্শনচিন্তার বিকাশের সাথে বিজ্ঞানের অগ্রগতির একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে।প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার যে উত্তরাধিকার ইউরোপ পেয়েছিল,তার ধারাবাহিকতা যে রক্ষা করা গেল না,তার পিছনেও রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গিগত এই প্রশ্ন।মধ্যযুগে সহস্রাধিক বছর ধরে গোটা ইউরোপকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল ধর্মীয় অন্ধতা,কুসংস্কার ও কুপমণ্ডূকতা।এই সময় সমাজমননকে চালিত করেছিল ভাববাদী চিন্তা, যার মূল কথা ছিল- প্রশ্ন করোনা, বিশ্বাস করো।অর্থাৎ বাইবেলের বাইরে সত্যের ও অবস্থান নেয়,বাইবেলে যা আছে,তাই সত্য,তাকেই বিশ্বাস করো।রেনেসাঁর সময়কালে এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়।সেই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রাধান্য বিস্তারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।

ভারতবর্ষেও আমরা একই জিনিস ঘটতে দেখেছি।আমরা জানি,প্রাচীন ভারত জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।কিন্তু এই চর্চা ধারাবাহিকভাবে একই রকম ছিলনা।কখনও এই চর্চায় গতি সঞ্চারিত হয়েছে,আবার কখনও গতি স্তিমিত হয়েছে।বিজ্ঞানের বিকাশের গতির তারতম্যের সাথে দর্শনের একটা অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক রয়েছে।

যেমন,বৈদিক যুগের শুরুতে মানুষের জানার পরিধি অনেক সীমিত থাকলেও জ্যোতির্বিজ্ঞান,সংখ্যা গণনা,জ্যামিতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পেরেছিল।কারণ সেই সময় মানুষের চিন্তায় বস্তুতান্ত্রিক ভাবনার প্রভাব ছিল।পরবর্তী কয়েক শতকে এই ধারা পুষ্ট হলনা।কারণ সেই সময় আরণ্যক ও উপনিষদে ভাববাদী চিন্তার উন্মেষ ঘটেছে এবং তার যথেষ্ট ব্যাপ্তিও হয়েছে।

বৈদিক যুগের পরে,অর্থাৎ বেদোত্তর যুগে আবার আমরা বিজ্ঞান চর্চায় গতি সঞ্চারিত হতে দেখলাম।চিকিৎসাশাস্ত্র,গণিত,ভাষাবিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে তখনকার বিজ্ঞানীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।কারণ বেদোত্তর যুগের সূচনায় দুটি বেদ বিরোধী নিরীশ্বরবাদী সম্প্রদায় বৌদ্ধ ও জৈনদের উদ্ভব হয়েছে, যাদের সমাজজীবনে যথেষ্ট প্রভাব ছিল,বিশেষ করে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রভাব গোটা ভারতীয় ভূখণ্ডে পড়েছিল।

বিজ্ঞানচর্চায় আরও গতি সঞ্চারিত হয়েছিল বেদোত্তর যুগের শেষ অধ্যায়ে,অর্থাৎ প্রথম থেকে সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত।এই সময় আবিষ্কার হয়েছে গণিতের দুটি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা - শূন্য এবং সংখ্যালিখনের স্থানিক পদ্ধতি।এছাড়া এই সময়েই জন্ম নিয়েছেন আর্য্যভট্ট,বরাহমিহির,ভাস্করাচার্য প্রমুখ দিকপাল বিজ্ঞানীরা।তাঁরা জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত,পদার্থবিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।সূর্য ঘোরেনা, পৃথিবীর আহ্নিক গতির জন্য সূর্যকে ঘুরতে দেখা যায়,এই বক্তব্য আর্যভট্ট বলেছিলেন।

কিন্তু অষ্টম-নবম শতাব্দীর পরে বিজ্ঞান চর্চার এই ধারা মন্থর হতে শুরু করে এবং একাদশ শতকের পরে তা পুরোপুরি শুকিয়ে যায়।কারণ এইসময় শক্তিশালী ভাববাদী দার্শনিক শঙ্করাচার্যের উত্থান ঘটে।শংকরাচার্য তর্ক-বিতর্কের পরিবর্তে কেবলমাত্র শ্রুতি,অর্থাৎ বেদ এবং স্মৃতি, অর্থাৎ মনুস্মৃতির উপর নির্ভর করার কথা বলেছিলেন।বেদ বলতে তিনি বেদান্ত বা উপনিষদের কথা বলেছিলেন,যেখান থেকে তিনি তাঁর মায়াবাদের ধারণা পেয়েছিলেন।মনুস্মৃতি এদেশে জাতপাতের ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিল।ফলে একদিকে তাঁর মায়াবাদ বস্তু জগতের বাস্তব অস্তিত্বকেই নস্যাৎ করে দিয়ে বস্তু জগৎ নিয়ে চর্চার মনকেই মেরে দেয়;অন্যদিকে জাতপাত ভিত্তিক মানসিকতাকে পাকাপোক্ত করে বুদ্ধির চর্চা এবং হাতেকলমে কাজের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান তৈরি করেছিল।

তারপর ভারতে বিজ্ঞানচর্চায় গতি এসেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে।এই শতকের সূচনায় রাজা রামমোহন রায় ধর্মীয় অন্ধতা-কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই করে এদেশে যুক্তিবাদী মনন গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন,ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পার্থিব মানবতাবাদের আদর্শকে ভিত্তি করে যে লড়াই করেছিলেন,তার মধ্য দিয়ে আবার এদেশে বস্তুবাদী দর্শন চর্চার পরিবেশ তৈরি হয়।তাকে ভিত্তি করেই এদেশে আধুনিক বিজ্ঞান চর্চা শুরু হয় এবং অচিরেই তাতে গতি সঞ্চারিত হয়।বিজ্ঞানচর্চার এই ধারাতেই আচার্য্য জগদীশচন্দ্র বসু,প্রফুল্লচন্দ্র রায়,মেঘনাদ সাহা,সি ভি রমন, সত্যেন্দ্রনাথ বসু,প্রশান্তচন্দ্র মহানলবিশ ও আরও অগণিত বিজ্ঞানী।

কিন্তু আজ আমরা এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি যে,আবার আমাদেরকে মধ্যযুগের অন্ধকারময় পরিস্থিতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ আয়োজন চলছে।কারণ,জাতীয় শিক্ষানীতি২০২০'র মধ্যে ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমের নামে যা এনেছে,তার সাথে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের সঠিক পদ্ধতির কোনও সম্পর্ক নেই।শুনতে অবাক লাগলেও এটাই বাস্তব।সেই প্রসঙ্গেই পরবর্তী আলোচনা।

"ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম" বলতে কী বোঝানো হচ্ছে

"ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম" বা "ভারতীয় জ্ঞানধারা" শব্দবন্ধটি আমরা জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০র মধ্যে পেয়েছি।কিন্তু এই শব্দবন্ধটির দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে, তা পরিষ্কার করে বলা নেই।কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের নানা সময়ে করা মন্তব্য থেকে একটা ধারণা করা যায়।সেটা আমরা পরে দেখব।কিন্তু তার আগে একটা প্রশ্ন খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই আসে - নলেজ সিস্টেম বা জ্ঞানধারার কি ভারতীয়করণ সম্ভব?কোনও জ্ঞান মানেই কি তা সর্বজনীন চরিত্রের হয়না?জ্ঞান মানেই তা যে কোনও দেশেই কার্যকরী।কোনও জ্ঞানকেই জাতীয় গন্ডির মধ্যে বেঁধে রাখা যায়না।জ্ঞানের চরিত্র বিশ্বজনীন।জ্ঞানকে জাতীয় গন্ডির বেঁধে ফেলার যে কোনও প্রচেষ্টাই বিজ্ঞানের নৈতিকতার বিরোধী।তাই জাতীয় শিক্ষানীতির প্রণেতারা নলেজ সিস্টেমের ভারতীয়করণ করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে বাস্তবে বিজ্ঞানের নৈতিকতার বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করছেন।

এবার দেখা যাক,ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম শব্দবন্ধটির মাধ্যমে তাঁরা কী বোঝাতে চাইছেন।তাঁদের প্রথম বক্তব্য হল,সারা বিশ্ব জুড়ে আধুনিক বিজ্ঞানের যত অবিস্কার হয়েছে তার বীজ রয়েছে প্রচীন ভারতের নানা পুঁথিতে,বিশেষ করে বৈদিক সাহিত্যে - সে স্টেম সেল বা উড়োজাহাজই হোক,বা টেলিভিশন হোক।দ্বিতীয়ত,জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ তে পরিষ্কার করে কিছু বলা না হলেও আই আই টি,খড়্গপুরে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রক ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম নিয়ে গবেষণার জন্য যে সেন্টার অফ এক্সেলেন্স স্থাপন করেছেন,তারা পরপর দুবছর যে ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেছে তাতে যেসমস্ত দাবি করা হয়েছে, তার থেকে পরিষ্কার যে,তাঁরা ঠিক কী বলতে চাইছেন।

এই ক্যালেন্ডার প্রকাশের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে- "ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম -এর ভিত্তির পুনরুদ্ধার,বেদের গুপ্তবিদ্যার স্বীকৃতি, সিন্ধু সভ্যতার পুনর্মূল্যায়ন এবং আর্যদের ভারতে অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত মিথকে খণ্ডন করা"।

ক্যালেন্ডারে আমরা কী পেলাম?আমরা দেখলাম ক্যালেন্ডারে আগাগোড়া এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়েছে যে,সারা বিশ্ব জুড়ে যতগুলি সভ্যতার জন্ম হয়েছে, তার উৎপত্তিস্থল হল ভারতবর্ষ।

এটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য সর্বপ্রথম এই বিষয়টি তাদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে যে,আর্যরা এদেশেরই আদি বাসিন্দা এবং এখান থেকেই তারা ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল।কিন্তু এটা 'প্রমাণ' করার পথে বড় অন্তরায় হল সিন্ধু সভ্যতা।কারণ আর্যরাই যদি সব প্রাচীন সভ্যতার প্রধান কারিগর হয়,তাহলে সিন্ধু সভ্যতাও আর্য সভ্যতা হওয়ার কথা।কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ইতিহাস চৰ্চার মধ্য দিয়ে এটা বহুদিন আগেই প্রমাণিত হয়ে গেছে যে,সিন্ধু সভ্যতা আর্য সভ্যতা নয়।সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের পরে আর্যরা এদেশে এসেছিল।পুরাতাত্বিক খননকার্যের মধ্য দিয়ে যেসমস্ত তথ্য পাওয়া গেছে,তাতে এই বক্তব্যই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে।

তাই ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমের উদ্গাতারা আওয়াজ তুলছেন যে,এতদিন যে ইতিহাস পড়ানো হয়েছে, তা বিকৃত ইতিহাস।তারা এখন সঠিক ইতিহাস নির্মাণ করছেন।এই 'সঠিক' ইতিহাসের নমুনা কী তা একটু খতিয়ে দেখা যাক।

এই 'সঠিক' ইতিহাস বলতে তারা বলছেন-বৈদিক সভ্যতার সময়কাল সম্পর্কে এতদিন যা বলা হয়েছে(খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-৬০০ সাল),তা ভুল।বৈদিক সভ্যতা আসলে ১০ হাজার বছরের পুরনো।কেন এই সময়কালের পরিবর্তন?কারণ ইতিমধ্যেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে,সিন্ধু সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব ৭ হাজার থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল।তাই সময়কালের এই পরিবর্তন।সিন্ধু সভ্যতা হল আর্য সভ্যতা - এটা 'প্রমান' করার জন্য তারা আরও কতগুলো দাবি করছেন।যেমন,হরপ্পায় এক সিং যুক্ত একটি কাল্পনিক প্রাণীর যে সিল পাওয়া গেছে,সেটিকে তারা পুরাণে বর্ণিত এক শৃঙ্গ ঋষির বলে দাবি করেছেন।দ্বিতীয়ত, তারা দাবি করেছেন যে,সিন্ধু এবং ব্রহ্মপুত্র নদী কৈলাশ পর্বত থেকে বের হয়েছে।তৃতীয়ত,তারা দাবি করেছেন যে,হরপ্পার কিছু সিলে যে স্বস্তিকা চিহ্ন পাওয়া গেছে,সেটা আসলে বৈদিক আইকন।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যাচাই করলে এটা সহজেই প্রমান করা যায় যে, আর্য সভ্যতার সময়কাল সম্পর্কে তারা যা বলছেন, তা তাদের উদ্ভট কল্পনা মাত্র।দ্বিতীয়ত,এটা বুঝতে বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হয়না যে,পুরাণে বর্ণিত এক শৃঙ্গ ঋষির সাথে হরপ্পায় প্রাপ্ত সিলের কোনও যোগসূত্র নেই।তৃতীয়ত,সিন্ধু ও ব্রহ্মপুত্র নদীর উৎস সম্পর্কে যা দাবি করা হয়েছে তাও বাস্তবের সাথে মেলেনা।কারণ সিন্ধু নদী সৃষ্টি হয়েছে কৈলাশ পর্বতের কাছে অবস্থিত বোখার চু হিমবাহ থেকে এবং ব্রহ্মপুত্র নদী সৃষ্টি হয়েছে মানসরোবর লেক অঞ্চল থেকে।চতুর্থত,বাস্তবে প্রায় সকল প্রাচীন সভ্যতায় স্বস্তিকা চিহ্ন পাওয়া গেছে।ফলে স্বস্তিকা চিহ্ন দিয়ে প্রমাণ করা যায়না যে,সিন্ধু সভ্যতা আর্যদের সৃষ্টি।

ইতিহাসের কষ্টিপাথরে বিচার করলে কী প্রমান হয়- সিন্ধু সভ্যতা বৈদিক নাকি প্রাক-বৈদিক?

হরপ্পা ও মহেঞ্জোদরোতে সিন্ধু সভ্যতার যে সমস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে (ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে যা বাস্তব evidence হিসেবে স্বীকৃত),তাতে আমরা কতগুলো বিষয় নির্দিষ্টভাবে পেয়েছি -

প্রথমত,হরপ্পা-মহেঞ্জোদরো সভ্যতায় আমরা পোড়া ইঁটের তৈরি ঘরবাড়ি পেয়েছি।কিন্তু তারপরে এক হাজার বছরেরও বেশি সময়কালে আমরা ভারতীয় উপমহাদেশের কোথাও পোড়া ইঁটের তৈরি ঘরবাড়ির কোনও নিদর্শন পাইনি।এই তথ্য থেকে এটা প্রমাণ হয় যে,আর্যরা ভারতে আসার পরে বহুদিন পর্যন্ত পোড়া ইঁটের ব্যবহারই জানত না।তাই হরপ্পা সভ্যতা আর্য সভ্যতার অংশ হতে পারে না।

দ্বিতীয়ত, বৈদিক সাহিত্যের প্রধান পশু হল ঘোড়া।কিন্তু ভারতের কোনও জঙ্গলেই বন্য ঘোড়া পাওয়া যায়না।শতাধিক প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ক্ষেত্র থেকে বহু সিল পাওয়া গেছে।তাতে বলদ,বাঘ,গন্ডার,হাতি,হরিণ,শুয়োর পাওয়া গেছে।এমনকি একটা কাল্পনিক এক শৃঙ্গ জন্তুর সিল পাওয়া গেছে,যার দেহ বলদের মতো এবং মাথা হরিণের মতো।কিন্তু কোথাওই ঘোড়ার চিহ্ন পাওয়া যায়নি।এর অর্থ হল,হরপ্পা সভ্যতায় ঘোড়ার অস্তিত্ব ছিল না।এই তথ্য থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে,ভারতীয় ভূখণ্ডে ঘোড়া এসেছে বাইরে থেকে যেখানে বন্য ঘোড়া পাওয়া যায়।

তৃতীয়ত, হরপ্পা সভ্যতার সিলগুলিতে লিখিত লিপির নিদর্শন পাওয়া গেছে,যদিও সেই লিপির পাঠোদ্ধার এখনও হয়নি।কিন্তু লিপির অস্তিত্ব প্রমান করে যে,হরপ্পা সভ্যতায় লিখিত ভাষা ছিল।কিন্তু আমরা জানি,বৈদিক সভ্যতার শুরুর দিকে বহুদিন পর্যন্ত লিখিত ভাষা ছিলনা।তাই বেদের আর এক নাম শ্রুতি।যদি সিন্ধু সভ্যতা বৈদিক সভ্যতার অংশ হত,তাহলে সিন্ধু সভ্যতার লিখিত ভাষার ধারাবাহিকতায় বৈদিক সভ্যতার শুরু থেকেই লিখিত ভাষার প্রচলন থাকার কথা ছিল।কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি যে,বাস্তবে তার কোনও প্রমান নেই।এমন তো হতে পারেনা যে,একদল মানুষ লিখিত ভাষায় চিন্তার আদানপ্রদানের দক্ষতা অর্জন করার পর বেশ কয়েক শতাব্দী তা ভুলে গেল এবং পরে আবার নতুন করে লিখিত ভাষার প্রচলন করল!তাই এই দৃষ্টান্ত থেকেও নিঃসন্দেহে বলা যায় যে,সিন্ধু সভ্যতা আর্য সভ্যতার অংশ ছিলনা।

চতুর্থত,বৈদিক সাহিত্যের কোথাও শহর জীবনের উল্লেখ নেই।অর্থাৎ বেদ, বেদাঙ্গ, উপনিষদ বা পুরাণ - এগুলোতে কোথাও ইঁটের তৈরি বাড়ি,পরিকল্পিত রাস্তা,ঢাকা দেওয়া পয়:প্রণালী,নিকাশি ব্যবস্থা বা গণ স্নানাগার প্রভৃতি,যা নগর জীবনের অঙ্গ তার কোনও উল্লেখ নেই।অথচ আমরা জানি,সিন্ধু সভ্যতা ছিল নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা।

মূলত এই চারটি তথ্যের ভিত্তিতে ঐতিহাসিকরা এই অভিমতে পৌঁছেছেন যে,সিন্ধু সভ্যতার সাথে বৈদিক সভ্যতার কোনও সাংস্কৃতিক যোগসূত্র নেই।বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হরপ্পা থেকে প্রাপ্ত জিনিসপত্রের সময়কাল নির্ধারণ করার মধ্য দিয়ে জানা গেছে যে,খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ সালের পরে হরপ্পায় কোনও জনবসতি ছিল না।

আর্যরা ভারতীয় ভূখণ্ডে এসেছিল এর কিছুদিন পরে।কারণ তার পর থেকে বৈদিক সভ্যতার নিরবিচ্ছিন্ন বিকাশের নিদর্শন পাওয়া যায়।পাকিস্তানে সবচেয়ে পুরোনো ঘোড়ার যে জীবাশ্ম পাওয়া গেছে,তার সময়কাল আর্যদের আগমনের সময়কালের সাথে মিলে যায়।

তবে আর্যরা যে বাইরে থেকে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিল,তার সবচেয়ে শক্তিশালী তথ্য পাওয়া গেছে জিনবিদ্যার গবেষণা থেকে।

" ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম" জ্ঞানচর্চার পরিপন্থী কেন?

ইন্ডিয়ান নলেজ সিসটেম বলতে উপরে বর্ণিত বিষয়ের মতো নানা কাল্পনিক বিষয়কে সত্য বলে বিশ্বাস করানোর প্রচেষ্টাই চোখে পড়ে।তার বিস্তারিত বর্ণনার সুযোগ এই প্রতিবেদনে সম্ভব নয়।তবে আরও দুএকটি দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়ের গভীরতা বোঝা যাবে।যেমন,তারা বলছেন যে,ভারতে দুটি মৌলিক সংখ্যা শূন্য ও এক আবিষ্কৃত হয়েছে।শূন্যর আবিষ্কার একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার - এবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।কিন্তু একের আবিষ্কার ভারতেই হয়েছে এরকম তো শুনানি।না,বাস্তবে এরকম কিছু ঘটেনি।তাহলে ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমের শ্রষ্টারা এভাবে বলছেন কেন?কারণ,এদেশে প্রচলিত অনেক দর্শনের মধ্যে অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন হল একটি দর্শন।অদ্বৈতর অর্থ এক।তাই তাদের উদ্ভাবন এক এদেশের আবিষ্কার।প্রশ্ন উঠতে পারে,হঠাৎ এমন ভাবনার উদ্ভাবন কেন?কারণ কম্পিউটারের ক্ষেত্রে এক ও শূন্যের ব্যবহার জরুরি।তাই শূন্য ও এক ভারতের উদ্ভাবন - এটা দেখিয়ে তাঁরা দাবি করছেন যে,প্রাচীন ভারতে কম্পিউটার জানা ছিল।এখানে যে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ এবং উদ্বেগজনক, সেটা হল,যে পদ্ধতিতে তারা এই সব উদ্ভট দাবি করছেন,সেটা সত্য নির্ধারণের জন্য স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির পরিপন্থী।যারা আজকের দিনে এই নীতি প্রণয়ন করতে বদ্ধপরিকর তাঁরা তাঁদের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডার অনুকূল ধরণাগুলোকে শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করছেন। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সেই ধারণাগুলো সঠিক কিনা তা যাচাই করার প্রয়োজন অনুভব করছেন না।বরং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রমানিত সত্যকে তাঁরা অস্বীকার করছেন।ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা শুধু যে ভুল শিখবে তাই নয়,সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিও শিখবেনা।ফলে ভুল সংশোধনের কোনও রাস্তাই তাদের কাছে খোলা থাকবে না।ফলে এই শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে একদল মানুষরূপী রোবট তৈরি হবে।আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার পরিবেশ।মধ্যযুগের অন্ধকার ছিন্ন করে মুক্ত চিন্তার আলো নিয়ে রামমোহন-বিদ্যাসাগর সহ রেনেসাঁর মনীষীরা জ্ঞানচর্চার যে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছিলেন,তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।ফলে দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে যাঁরা এইসব উদ্ভট ধারণাগুলো নিয়ে আসছেন, তাঁরা বাস্তবে দেশকে অন্ধকারেই নিমজ্জিত করে দিতে চান।সেইজন্যই দেখা যাচ্ছে যে,যাঁরা দেশের ঐতিহ্য নিয়ে এত কথা বলছেন,তাঁরা প্রাচীন ভারতে প্রকৃতই জ্ঞানবিজ্ঞানের কী কী অগ্রগতি ঘটেছিল তার চর্চা করছেন না।তাই একথা আমাদের বুঝতে হবে যে, ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমের নামে কেন্দ্রীয় সরকার যা আনতে চাইছে তার সাথে প্রকৃত জ্ঞানচর্চার কোনও সম্পর্ক নেই,ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যেরও কোনও সম্পর্ক নেই।

উপসংহার

কেন এই পদক্ষেপ - এটা আমাদের বুঝতে হবে।আজকের দিনে যারাই এই শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে চাইবে তাদেরকে জ্ঞানচর্চার রাস্তাটাকে বন্ধ করতে হবে।সেইজন্যই সুসংহত চিন্তা গড়ে ওঠার রাস্তাকে বন্ধ করার এই উদ্যোগ-আয়োজন।তাই আমরা দেখছি যে,নতুন নতুন গবেষণায় কেন্দ্রীয় সরকার যেখানে অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দিচ্ছে বা কোথাও কোথাও বন্ধ করে দিচ্ছে,সেখানে "ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম"-এর নামে উদ্ভট ও অনৈতিহাসিক দাবিগুলোকে সত্য 'প্রমান' করার জন্য 'গবেষণায়' তারা অকাতরে অর্থ বরাদ্দ করছেন।উদাহরণস্বরূপ খড়্গপুর আই আই টি'তে ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমের উপর 'গবেষণা'র জন্য সেন্টার অফ এক্সেলেন্স প্রতিষ্ঠা বা আই আই টি,গৌহাটিতে গো-বিদ্যার(cow science) গবেষণার পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

তাই আজ একথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে,এই শিক্ষানীতি শুধু যে ছাত্রছাত্রীদের ভুল শেখাবে তাই নয়,সত্য জানবার সঠিক পদ্ধতিকেও গুলিয়ে দেবে।ফলে আমরা যদি এই সর্বনাশা শিক্ষানীতিকে রুখে দিতে না পারি,তাহলে আগামী প্রজন্ম অদূর ভবিষ্যতে একটা অন্ধকারময় পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে,এ বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।