বিভাগগুলি

রামায়ণ-মহাভারত কি ইতিহাস নাকি কল্পিত কাহিনী?

ব্রেকথ্রু ডিজিটাল

দীর্ঘদিন ধরে কিছু হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী দাবি করে আসছে যে রামায়ণ মহাভারত এবং পুরাণগুলি ঐতিহাসিক সত্য। সম্প্রতি এনসিইআরটি, সমাজবিজ্ঞানের পাঠ্যক্রমে সপ্তম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের রামায়ণ-মহাভারতকে ইতিহাস হিসেবে পড়ানোর সুপারিশ করেছে। তাই এ বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচারের প্রয়োজন আছে এবং এর মধ্যে যে উপাদানগুলি রয়েছে তা কি ইতিহাসের না মহাকাব্যের তা নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

ধরে নেওয়া যাক যে, এই মহাকাব্যে যে ঘটনাগুলি বর্ণনা করা হয়েছে তা প্রাচীনকালে কোনও না কোনও সময়ে ঘটেছে। যদি তা হয় তাহলে ঘটনার বিবরণ সর্বত্র একই থাকার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ভারতের বিভিন্ন অংশে এই গল্পের বিভিন্ন ভাষ্য প্রচলিত আছে। এই মহাকাব্যগুলি যে কোনও এক ব্যক্তির দ্বারা রচিত নয় তার বহু প্রমাণ আছে। আমরা জানি রামায়ণের রচয়িতা বাল্মিকী এবং মহাভারতের রচয়িতা বেদব্যাস- কিন্তু বাস্তবে এগুলি বহুবছর ধরে বহুজনের দ্বারা রচিত হয়েছে।

পুণের ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট মহাভারত ও রামায়ণ সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গবেষণা করেছে যা 1966 সালে প্রকাশিত হয়। গবেষণায় এটা বোঝা যায় যে মহাভারত প্রায় 1000 বছর ধরে (খ্রি.পূ. 800 থেকে 200 খ্রি.) তিনটি ধাপে রচিত হয়েছে এবং রচয়িতারা ক্রমান্বয়ে নতুন নতুন অধ্যায় সংযোজন করার ফলে কাহিনীর আয়তনও বৃদ্ধি পেয়েছে।

গবেষণায় যা পাওয়া গেছে তাতে ধাপগুলি এইরকম ছিল:

  1. জয় (800 খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগে): 2400 পংক্তি

  2. ভারত (800 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে 400 খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে): 24000 পংক্তি

  3. মহাভারত (400 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে 200 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে): 124000 পংক্তি

এদের মধ্যে প্রথমটি 'জয়' হল দুই গোষ্ঠীর মধ্যকার যুদ্ধের এবং যোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনী, একটি সাধারণ ক্ষত্রিয় গল্পগাথা। পরবর্তী ধাপে নতুন নতুন উপাখ্যান সংযুক্ত হয় যাতে সহানুভূতি, ক্ষমা, সত্যবাদিতা, আত্মসংযম ইত্যাদি মূল্যবোধগুলির প্রকাশ ঘটেছে। তৎকালীন সামাজিক জীবনে নৈতিক মূল্যবোধের প্রয়োজনে এই জনপ্রিয় গল্পগাথাগুলির বিশেষ প্রয়োজন ছিল। ইতিপূর্বে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্নভাবে এই উপাখ্যানগুলি লোকগাথা হিসাবে প্রচলিত ছিল। এর কিছু কিছু বৌদ্ধ, জৈন, ব্রাহ্মণ সাহিত্যে পাওয়া যায়। আটশত বছর ধরে এই ধরনের সংযোজনের পরে শেষ পর্যন্ত মহাভারত এক বিশেষ রূপ নেয় যা এখন দেখতে পাই।

দেখা গেছে যে বিভিন্ন শ্লোকে শব্দ প্রয়োগ এবং ব্যাকরণ তাৎপর্যপূর্ণভাবে ভিন্ন, যা থেকে বোঝা যায় যে এর রচনাকাল ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। ভাষা ব্যবহারের ধরনও এক একটি সময়ে আলাদা আলাদা। মনে করা হয় যে, শেষ সংযোজনটি হল গীতা, কারণ এর ভাষা তা সর্বাধুনিক।

যখন একটি গল্প সহস্র বছর ধরে বিভিন্ন রচয়িতার কলমে বিভিন্ন অংশ যোগ হয়ে তৈরি হতে থাকে, তাতে স্বাভাবিকভাবেই কিছু অসঙ্গতি অনিচ্ছাকৃতভাবে ঢুকে পড়ে। মহাভারতে এই ধরনের অনেক দৃষ্টান্ত আছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। যুদ্ধমান দুই গোষ্ঠী – কৌরব ও পাণ্ডবদের কথা ধরা যাক। গল্প অনুযায়ী, রাজা কুরু এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং পরবর্তী সময়কালে শান্তনু ও তার পুত্র বিচিত্রবীর্যকে দেখতে পাই। বিচিত্রবীর্যের দুই পুত্র ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু। তাহলে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু উভয়ের সন্তানেরা কৌরব বলে পরিচিত হওয়ার কথা, কেননা তারা সকলেই কুরু বংশের। অথচ ধৃতরাষ্ট্রের সন্তানেরা কৌরব এবং পাণ্ডুর সন্তানেরা পাণ্ডব নামেই পরিচিত। কেন এমন হল?

ভাণ্ডারকর ইন্সটিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে যে বর্তমানে গল্পের ধারা যা আছে সর্বদা তাই ছিল না। প্রথম দুটি ধাপে (জয় এবং ভারতে) যুদ্ধ হয়েছিল কৌরব এবং পাঞ্চালদের মধ্যে এবং পাণ্ডুর সন্তানেরা (পাণ্ডব) পাঞ্চালদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। শেষ ধাপে (মহাভারত) গল্পের ধারার পরিবর্তন হয়: যুদ্ধ হল কৌরব এবং পাণ্ডবদের মধ্যে, আর পাঞ্চালরা পাণ্ডবদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু নতুন গল্পের ধারায় নামগুলি একই রয়ে গিয়েছিল।

একইভাবে, রামায়ণ মহাকাব্য 400 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে 400 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ সময়কাল ধরে লেখা হয়েছে। প্রাথমিক পুরাকথাটি এক নারীর অপহরণ ও উদ্ধারকে কেন্দ্র করে একটি গল্প যা ইন্দোনেশিয়া থেকে আয়ারল্যাণ্ড- এই বৃহৎ ভৌগোলিক ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। প্রথমে এতে ছয়টি কাণ্ড (অংশ) ছিল, পরবর্তী সময়ে এতে আরও একটি কাণ্ড যোগ হয়। বিখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ডঃ সুকুমার সেন দেখিয়েছেন যে বৌদ্ধ ধর্মের জাতক থেকে তিনটি গল্প, জৈন সাহিত্য থেকে একটি গল্প এবং ইরানীয় খোটানীজ ভাষা থেকে একটি গল্পের সমন্বয়ে রামায়ণ মহাকাব্য তৈরি হয়েছে।

বিষয় হল, মহাভারত ও রামায়ণে যে সমস্ত স্থানের উল্লেখ আছে - যেমন হরিয়ানার কুরুক্ষেত্র, উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা বা শ্রীলঙ্কা দেশ – এগুলির কোনও ঐতিহাসিক তাৎপর্য নেই। কুরুক্ষেত্রে অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালিয়ে কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়নি- না একটি বল্লম, না একটি তীর, না কোনও রথের চাকা। অযোধ্যাতেও একইভাবে খননকার্য করে কিছুই পাওয়া যায়নি। কোনও অস্ত্র বা অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ- কোনও কিছুই পাওয়া যায়নি।

কিন্তু মহাশক্তিশালী অস্ত্র যেমন- পাশুপাত অস্ত্র বা শক্তিশেল- এগুলি তাহলে কী? পুষ্পক রথ যা আকাশে উড়তে পারত - তাই বা কী? দৈত্য (দানব বা রাক্ষস) এবং বানর - এরাই বা কী? এগুলির কি কোনও অস্তিত্ব ছিল?

বাস্তব হল, এইরকম কল্পনা সমস্ত মহাকাব্যেই পাওয়া যায়। বিখ্যাত গ্রিক মহাকাব্য ইলিয়াড এবং ওডিসিতেও একই ধরনের কল্পিত চিত্র দেখা যায়। এই রকম কল্পনা গড়ে ওঠারও একটা ভিত্তি থাকে। মানুষ তীর, ধনুক দেখেছে। তারা কল্পনা করল বিশাল শক্তিশালী তীর ধনুকের এবং চমৎকার একটা নামও দিল - - পাশুপাত অস্ত্র, ব্রহ্মাস্ত্র ইত্যাদি। মানুষ ঘোড়ায় টানা রথ দেখেছে। তারা আকাশে পাখিকে উড়তেও দেখেছে। দুটোকে একসঙ্গে মিশিয়ে কল্পনায় এল উড়ন্ত রথ (পুষ্পক রথ)। মানুষ বৃহদাকার মানুষ দেখেছে, বামনাকার মানুষও দেখেছে। ফলে কল্পনায় তৈরি হল বিশাল আকৃতির শরীর (দানব)। আর্য-অনার্যদের মধ্যে সংঘর্ষ ছিল ঐ সময়কার বাস্তব অবস্থা। আর্যরা অনার্যদের কখনোই ভালো চোখে দেখত না। আর্যদের কল্পনায় অনার্যদের দেখানো হল দৈত্য হিসাবে (অসুর এবং রাক্ষস) এবং অনার্যদের মধ্যে যারা আর্যদের সাহায্য করল তারা হল বানর।

উল্লেখ্য যে এই ধরনের কল্পিত চরিত্রগুলি গল্প গাথার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যদি এইগুলি বাদ দেওয়া হয় তাহলে মহাকাব্যগুলি নীরস, একঘেয়ে কাহিনী হয়ে দাঁড়ায়। তাই আমাদের প্রত্যেকের এই কল্পনা উপভোগ করা উচিত এই কথা মনে রেখে যে এগুলি কল্পিত কাহিনী, ঐতিহাসিক ঘটনা নয়।

তথ্যসূত্র - প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞান - বাস্তব বনাম কল্পনা, ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি প্রকাশনা