বিভাগগুলি

নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী আব্দুস সালাম

By Molendijk, Bart - Dutch National Archives 

ব্রেকথ্রু ডিজিটাল

আজ পাকিস্তানের একমাত্র নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী আব্দুস সালামের জন্মদিন, যিনি তাঁর নোবেল পুরস্কারটি তাঁর গণিতের শিক্ষক প্রফেসর অনিলেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দেন এবং বলেন, "মাস্টারমশাই, এই নোবেল পদক আপনার, আমার নয়”। ধর্ম দেশের বেড়াজালের উর্দ্ধে উঠে আব্দুল সালাম বিজ্ঞানের জন্য নিবেদিত প্রাণ। আসুন জেনে নিই তাঁর গবেষণা সম্পর্কে।

বর্তমানে বিজ্ঞানের আবিষ্কার অনুযায়ী এই মহাবিশ্বের সমস্ত ধরনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার পেছনে মূলত চারটি মৌলিক বল বা ফোর্স দেখা যায়। সেগুলো হল মহাকর্ষ বল, তড়িৎচুম্বকীয় বল, দুর্বল নিউক্লীয় বল ও সবল নিউক্লীয় বল। বিজ্ঞানীদের অনুমান, এমন একটা তত্ত্ব তাঁরা দিতে পারবেন যেখানে এই চারটি বল সম্পর্কিত সমস্ত ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব এমনভাবে যেখানে এই চার রকমের বলের সমস্ত কিছু আসলে একই রকম কোন এক বল অথবা অন্য কিছু থেকে তৈরি করা যায়। বিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলা হয় একীভূত করা অর্থাৎ বল গুলির একটা ইউনিফাইড থিওরি তৈরি করা। বিজ্ঞানীদের আরও অনুমান এরকম চারটি বলেরই সম্মিলিত অবস্থা তৈরি করতে হলে খুব উচ্চ শক্তি সম্পন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করা প্রয়োজন ।

এক সময় তড়িৎ ও চুম্বক বলকে আলাদা মনে করা হতো কিন্তু প্রথমে বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডের প্রচেষ্টায় ও তারপর বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল সর্বপ্রথম দেখান যে, আপাতদৃষ্টিতে এই বল দুটিকে আলাদা মনে হলেও এগুলি হল অনেকটা একই মুদ্রার (তড়িৎ চুম্বকীয় বল) এপিঠ ওপিঠ। পরবর্তীতে আইনস্টাইন তার Relativity তত্ত্বের মাধ্যমে বিষয়টিকে আরও পরিষ্কার করেন।

ফ্যারাডে ম্যাক্সওয়েল আইনস্টাইন এরপর বিজ্ঞানী আব্দুস সালাম, স্টিফেন উইনবার্গ ও গ্লাসো সফল হলেন আর এক একীকরণ বা ইউনিফিকেশনের কাজে। তাঁরা থিওরিটিক্যালি তড়িৎ চুম্বকীয় বল ও দুর্বল নিউক্লীয় বলকে একীভূত বা ঐক্যবদ্ধ করে ফেললেন। এই থিওরিকে বলা হয় 'ইলেকট্রো উইক ইউনিফিকেশন থিওরি' বা 'সালাম- উইনবার্গ থিওরি'

সালামের থিওরিকে বুঝতে হলে আমাদের বুঝতে হবে সিমেট্রি বা প্রতিসাম্যতা। সিমেট্রি সম্পর্কে মোটামুটি আমরা জানি। যেমন ধরুন, একটি বর্গক্ষেত্রকে 90° ঘোরালে দেখতে একই রকম লাগবে অর্থাৎ এখানে সিমেট্রি বজায় আছে। একটি বৃত্তকে যত ডিগ্রিতেই ঘোরানো হোক না কেন দেখতে একই রকম লাগবে অর্থাৎ অন্য কেউ এসে দেখলে বোঝার উপায় থাকবে না আদৌ বৃত্তটি ঘোরানো হয়েছে কিনা। এক্ষেত্রে বৃত্তটি বর্গক্ষেত্রের চেয়ে বেশি প্রতিসাম্য বা সিমেট্রিক। এরকম অনেক উদাহরণ আছে যেখানে সিমেট্রি আছে। ম্যাথমেটিক্সে গ্রুপ থিওরিতে নামক বিষয়ে সিমেট্রি নিয়ে আলোচনা করা হয়।

খুব সহজভাবে বললে কণা পদার্থবিদ্যায় অথবা পার্টিকেল ফিজিক্সের আবিষ্কৃত নিয়ম অনুযায়ী পরমাণুর মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন বস্তু কণা গুলির মধ্যে যে বলগুলো গুলো কার্যকর হয়, যেমন নিউক্লিয় বল এবং তড়িৎচুম্বকীয় বল সেগুলি আসলে নতুন রকমের কিছু বস্তু কণার বিনিময়ের মাধ্যমে সংঘটিত হয়, যাদেরকে Force Carrier বলা হয়। যেমন দুটি ইলেকট্রনের মধ্যে তড়িৎ চুম্বকীয় বলের মাধ্যমে ইন্টারেকশন ঘটে তখন ফোটন নামক force carrier এর বিনিময়ের মাধ্যমে তা ঘটে।

আবার অন্যদিকে স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্সের জন্যই প্রোটন গুলো নিউক্লিয়াসে তড়িৎ চুম্বকীয় বলের জন্য নিজেদের মধ্যে প্রবল বিকর্ষণকে উপেক্ষা করেও একত্রে থাকতে পারে। পরমাণুর মধ্যে নিউক্লিয়াসের প্রোটন নিউট্রন নামক কণা গুলো আবার আরও ক্ষুদ্র সাব অ্যাটমিক কণা, যাদের নাম কোয়ার্ক তা দিয়ে গঠিত। এই কোয়ার্ক গুলো আবার তিন ধরণের হতে পারে (বিজ্ঞানীরা এই তিন রকমের কোয়ার্ক কে তিন রকমের রং নীল, সবুজ এবং লাল এর সাথে তুলনা করেন)। এক্ষেত্রে সিমেট্রি বলতে আমরা বুঝব এই তিন ধরনের কোয়ার্ক পরস্পর নিজেদের মধ্যে রুপান্তরিত হলেও এদেরকে ব্যাখ্যা করে যে অংকের সমীকরণ তার কোনও পরিবর্তন হবে না অর্থাৎ সিমেট্রি বজায় থাকবে। গাণিতিকভাবে লেখা যায় SU(3) সিমেট্রি। এখানে n=3 হল তিন ধরনের কোয়ার্ক।

আবার আরেক ধরনের নিউক্লিয় বল উইক নিউক্লিয়ার ফোর্সের জন্য কিছু কিছু নিউক্লিয়াস থেকে ইলেকট্রন ছিটকে বেরিয়ে আসে এই ঘটনাকে beta decay বলে। এই ক্ষেত্রে নিউট্রন রূপান্তরিত হচ্ছে প্রোটন, ইলেকট্রন ও একটি বিশেষ পার্টিকেল যাকে বলা হয় ইলেকট্রন-অ্যান্টি নিউট্রিনো।এক্ষেত্রে ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো পরস্পর রুপান্তরিত হলেও এই ঘটনার প্রকাশকারী ম্যাথামেটিকাল সমীকরণ অপরিবর্তিত থাকে অর্থাৎ সিমেট্রি বজায় থাকে। এটাকে লেখা হয় SU(2) সিমেট্রি আকারে। এখানে n=2 হল দুটি এলিমেন্ট ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো।

খুব উচ্চ শক্তিতে যেখানে তড়িৎ চুম্বকীয় ও স্ট্রং এবং উইক নিউক্লিয় বল একীভূত হবে সেখানকার সিমেট্রি কে SU(3)xSU(2)xU(1) আকারে একটি বড় শক্তিশালী সিমেট্রির মতো লেখা যায়। এর অর্থ হল এই বলের কণা গুলো পরস্পর রূপান্তরিত হলেও সমীকরণটি অপরিবর্তিত থাকবে অর্থাৎ সিমেট্রিক হওয়ার কথা ‌।

ষাটের দশকের শুরুতে শেলডন গ্ল্যাসো ইলেকট্রম্যাগনেটিক ফোর্স ও ইলেকট্র উইক ফোর্সের ইউনিফিকেশন নিয়ে অনেক কাজ করেছিলেন কিন্তু পুরোপুরি সফল হননি। পরে আব্দুস সালাম ও স্টিফেন উইনবার্গ একটি সফল কাঠামো দাঁড় করান। যেখানে তাঁরা প্রস্তাব করেন যে, যেমন ইলেকট্রম্যাগনেটিক ফোর্সের মধ্যে ইন্টারেকশন হয় ফোটন কণা আদান প্রদানের মাধ্যমে তেমনি উইক নিউক্লিয়ার ফোর্সের ক্ষেত্রেও তিনটি ভরযুক্ত কণার ( যাদের নাম W+,W- ও Z0) আদান প্রদানের মাধ্যমে। তাঁদের এই থিওরিতে যেসব ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছিল পরবর্তীতে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সেগুলি সত্যিই প্রমাণিত হয়। তাই 1979 সালে আবদুস সালাম, স্টিফেন উইনবার্গ ও শেলডন গ্ল্যাসোকে ফিজিক্সে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। যদিও তাঁদের প্রস্তাবিত তিনটি কণা আবিষ্কার হয়েছে অনেক পরে 1983 সালে সার্নের গবেষণাগারে।

তাঁদের থিওরি অনুযায়ী নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় উইক নিউক্লিয়ার ফোর্সের তিনটি কণা ও ইলেকট্রম্যাগনেটিক ফোর্সের একটি কণা নিয়ে যখন ইলেকট্র উইক ফোর্স সৃষ্টি হয়ে ইউনিফাইড হচ্ছে তখন এই চারটি কণা পরস্পর রুপান্তরিত বা রদবদল হলেও সমীকরণটি অপরিবর্তিত থাকে অর্থাৎ সিমেট্রি বজায় থাকবে। ইলেকট্র-উইক ফোর্সের ক্ষেত্রে গাণিতিকভাবে লেখা যায় SU(2)xU(1) সিমেট্রি।

আবার তাঁদের থিওরি থেকেই জানা যায় এই সুন্দর সিমেট্রির ভাঙনের কথা যাকে Spontaneous symmetry breaking বলা হয়।

অর্থাৎ প্রচন্ড শক্তিতে যেমন 100GeV শক্তিতে কণা গুলো থাকলে সিমেট্রি না ভেঙে ইউনিফাইড থাকে অর্থাৎ ইলেকট্রম্যাগনেটিক ফোর্স ও উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স মিলে একটাই ফোর্স ইলেকট্র-উইক ফোর্সে পরিণত হয়। কিন্তু কম শক্তি তে symmetry breaking হয়ে আলাদা আলাদা ফোর্স ইলেকট্রম্যাগনেটিক ও উইক নিউক্লিয়ার ফোর্সের সৃষ্টি হয়েছে,যা প্রকৃতিতে দেখা যায়।