বিভাগগুলি

বিজ্ঞানের যুক্তি, যুক্তির বিজ্ঞান

সৌমিত্র ব্যানার্জী

মানুষ দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত ক্রিয়াকলাপই সংঘটিত করে যুক্তিকে ভিত্তি করে। বেশিরভাগ সময়ই তা ঘটে অসচতেনভাবে, কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষ প্রাণীটির বৈশিষ্ট্য হলো, তার জীবনের ছোটবড় সব ক্রিয়াকর্মই যুক্তির দ্বারা পরিচালিত। চাই বা না চাই, বুঝি বা না বুঝি, আমাদের অজান্তেই আমাদের মস্তিষ্ক নানারকম যুক্তি করে চলেছে। আমাদের চিন্তা ও ক্রিয়া তার দ্বারাই সংঘটিত হয়। সে যুক্তি সঠিক হতে পারে, আবার বেঠিকও হতে পারে। তাই সঠিক ক্রিয়ার চাবিকাঠিটি হলো, সঠিক যুক্তি করতে শেখা।

বহুকাল আগেই মানুষের যুক্তিপদ্ধতিকে বিশ্লেষণ করে দার্শনিকরা দেখিয়েছিলেন, সব যুক্তিই দুটি যুক্তিধারার কোনও একটির মধ্যে পড়ে। একটি হলো আরোহী যুক্তিধারা, অপরটি হলো অবরোহী যুক্তিধারা।

আরোহী আর অবরোহী যুক্তি

ধরা যাক, আপনি আকাশে মেঘ করেছে দেখে ব্যাগে ছাতা নিয়ে বেরোলেন। এর পেছনে কী যুক্তি কাজ করেছে? না, আপনি ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন, বৃষ্টি পড়ার আগে আকাশে কালো মেঘ থাকে। একবার দেখেছেন, দুবার দেখেছেন, তিনবার দেখেছেন, তারপর আপনার মন যুক্তি করে নিয়েছে —'আকাশে কালো মেঘ থাকলে বৃষ্টি পড়ে'। কী যুক্তিধারা বেয়ে এই সিদ্ধান্তে এলেন? এটাকেই বলে আরোহী যুক্তি (inductive logic), যেখানে একটা ঘটনাকে বারবার সত্য হতে দেখে আমরা একটা সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছোই। বিশেষ সত্যের বারবার পুনরাবৃত্তি থেকে সাধারণ সত্যে পৌঁছোই।

তারপর কী করেন? একটা বিশেষ দিনে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় আকাশে কালো মেঘ দেখে সিদ্ধান্তে আসেন, ‘আজ বৃষ্টি হতে পারে'। ছাতা নিয়ে বেরোন। কোন যুক্তিধারা বেয়ে এই সিদ্ধান্তে এলেন? এটাকে বলে অবরোহী যুক্তি (deductive logic) যেখানে সাধারণ সত্য থেকে বিশেষ ক্ষেত্রের বিশেষ সত্য সম্বন্ধে সিদ্ধান্তে আসেন।

এই দুই যুক্তিধারা বেয়েই মানুষের জীবনের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ। বিশেষ থেকে সাধারণের সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো, আর সাধারণ ধারণা থেকে বিশেষ সম্বন্ধে সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো — প্রতি মুহুর্তে এই দুই চিন্তাপ্রক্রিয়া ছাড়া মানুষ চলতেই পারে না। কাঁচা ফলে আমরা কামড় দিই না, কারণ একবার দুবার তিনবার এটা করে দেখেছি অভিজ্ঞতাটা সুখকর নয়। সাধারণ ধারণা জন্মেছে, কাঁচা ফল টক হয়। তাই একটি বিশেষ কাঁচা ফল দেখলে অবরোহী যুক্তি করি, এটা নিশ্চয়ই টক হবে।

এর সবটাই যে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ঘটে তা নয়। অনেকক্ষেত্রেই মানবজাতির সম্মিলিত অভিজ্ঞতা বাবা-মা শিশুকে শেখান—বাঘ ভয়ানক জীব, সাপের কাছে যেও না, নোংরা জল খেও না। সেক্ষেত্রে শিশুটিকে নিজস্ব বিশেষ অভিজ্ঞতা সাধারণীকরণ করে শিখতে হয় না। আরোহী যুক্তিলব্ধ সিদ্ধান্ত সরাসরিই তার কাছে পৌঁছোয় ভাষার মাধ্যমে।

জীবজন্তুর আচরণ কি যুক্তি দ্বারা পরিচালিত?

জীবজন্তুর ভাষা নেই। কিন্তু তাকেও খাদ্যসংগ্রহ করতে এবং শিকারী প্রাণী থেকে বাঁচতে পারিপার্শ্বিক জগৎটা সম্পর্কে একটা ধারণা বা perception তৈরি করতে হয়। এটা হয় পরাবর্ত ক্রিয়া বা reflex এর মাধ্যমে। কোনওটি জন্মগত reflex, আবার কোনওটি বারবার কোনো ঘটনার অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখা, যাকে বলে শর্তাধীন পরাবর্ত বা conditioned reflex।

কুমিরের বাচ্চা জন্মেই শিকার ধরতে পারে, কিন্তু বাঘের বাচ্চাকে শিকার করতে শিখতে হয়। মা তাকে বিশেষ পরিস্থিতিতে বারবার ফেলে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে দেয়, conditioned reflex গড়ে তোলে, যার সাহায্যেই ভবিষ্যতে বিশেষ পরিস্থিতিতে বাঘটি চুপিসাড়ে শিকারের পিছন পিছন গিয়ে বিশেষ মুহুর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকার করতে পারে। তাকে কিছু জটিল reflexও তৈরি করতে হয়, যেমন, তার দিক থেকে শিকারের দিকে হাওয়া বইলে শিকার তার অস্তিত্ব টের পাবে। তাই তাকে হাওয়ার গতি অনুযায়ী এমনভাবে শিকারের দিকে অগ্রসর হতে হবে যাতে শিকার প্রাণীটি তার গন্ধ না পায়। এগুলি যত জটিল আচরণই হোক, আরোহী যুক্তি নয়, conditioned reflex।

আরোহী এবং অবরোহী যুক্তি একান্তই মানুষী চিন্তার ফসল, ভাষা ছাড়া যা সম্ভব নয়। তার মাধ্যমে পারিপার্শ্বিক জগৎ সম্বন্ধে শুধু ধারণাই (perception) জন্মায় না, গড়ে ওঠে উপলব্ধি (conception)। এই উপলব্ধির সাহায্যেই মানুষ তার যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনা করে।

আরোহী যুক্তি করার পদ্ধতি

আরোহী যুক্তি কীভাবে করা হয় তা বুঝতে এই পদ্ধতিতে পৌঁছোনো কয়েকটি সিদ্ধান্ত দিয়ে শুরু করা যাক।

· সব পতঙ্গের ছয়টি পা থাকে।

· গ্রহদের গতিপথ উপবৃত্তাকার।

· আগ্নেয়গিরির অবস্থান পৃথিবীপৃষ্ঠের প্লেটগুলির সীমানার কাছাকাছি থাকে।

· ভিনিগারে ডোবালে তামা সবুজ হয়ে যায়।

এসব সিদ্ধান্তে কীভাবে পৌঁছোনো গেল? কেউ কি পৃথিবীর সব পতঙ্গের পা গুনেছেন? নিশ্চয়ই না। মাছি, ফড়িং, বোলতা, প্রজাপতি ইত্যাদি কয়েকটি প্রজাতির কয়েকটি করে বিশেষ পতঙ্গ ধরে গুনেছেন মাত্র। সবারই দেখা গেছে ছয়টি পা। তাই বিশেষ পর্যবেক্ষণের সাধারণীকরণের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, শুধু সব বোলতার বা সব ফড়িংএর যে ছটি পা থাকে শুধু তাই নয়, সব পতঙ্গেরই ছটি পা থাকে।

কেপলার যখন গ্রহদের গতিপথ নিরুপণ করছেন, তখন মোটে পাঁচটি গ্রহের কথা জানা ছিল—বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি আর শনি। তিনি গণনা করে পেলেন যে তাদের সকলেরই গতিপথ উপবৃত্তাকার, যার একটি ফোকাসে আছে সূর্য। কোনো ব্যতিক্রম না পাওয়ায় বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত নিলেন, গ্রহমাত্রেরই কক্ষপথ উপবৃত্তাকার। এই সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করেই নিউটন তাঁর তত্ত্বের প্রাথমিক প্রমাণ সংগ্রহ করেছিলেন, কারণ তিনি গণিতের সাহায্যে দেখাতে পেরেছিলেন, মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব অনুযায়ী যেকোনও গ্রহের কক্ষপথ উপবৃত্তাকারই হবার কথা।

সেরকমই ভূবিজ্ঞানীরা যখন দেখলেন বেশিরভাগ আগ্নেয়গিরির অবস্থান প্লেট-সীমার কাছাকাছি, তখন সাধারণীকরণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিলেন, এই বৈশিষ্ট্য সব আগ্নেয়গিরিরই। অ্যালকেমির যুগে মানুষ কয়েকবার তামার টুকরো ভিনিগারে ডুবিয়ে দেখেছিল, তা সবুজ হয়ে গেল। তাঁরা আরোহী যুক্তি করলেন, যে কোনো তামার টুকরো ভিনিগারে ডোবালে এটাই হবে। অ্যালকেমি থেকে রসায়নে উত্তরণের কালে এই সিদ্ধান্তটাই বিজ্ঞানীদের তামা ধাতুটার রাসায়নিক চরিত্র বুঝতে সাহায্য করেছিল।

অবরোহী যুক্তি করার পদ্ধতি

এরকম কোনো আরোহী সিদ্ধান্ত যদি হাতে থাকে, তার ভিত্তিতে কোনও বিশেষ পরিস্থিতি সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় অবরোহী পদ্ধতিতে। ধরা যাক আরোহী সিদ্ধান্তটা হচ্ছে "যদি তামা ভিনিগারে ডোবানো হয়, তবে তা সবুজ হয়ে যায়"। এবার অবরোহী যুক্তিতে একটা বিশেষ তামার টুকরো সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত করা যায় যে সেটাকে যদি ভিনিগারে ডোবানো হয় তবে তা সবুজ হয়ে যাবে।

যুক্তিধারাটা একটু ভেঙে বোঝা যাক। আরোহী সিদ্ধান্ত থেকে যা এলো তা হচ্ছে "যদি A হয় তবে B হবে" (এখানে A হলো তামা ভিনিগারে ডোবানো, আর B হলো সবুজ হয়ে যাওয়া)। তারপর বলা হল A সত্য (অর্থাৎ তামা ভিনিগারে ডোবানো হলো)। অবরোহী সিদ্ধান্ত হলো, B সত্য হবে (অর্থাৎ তা সবুজ হয়ে যাবে)। যুক্তির ধাপগুলো হলো:

যদি A হয় তবে B হবে,

A সত্য,

অতএব B সত্য।

এই অবরোহী যুক্তিপদ্ধতিকে বলে modus ponens। আরেকটা উদাহরণ নেওয়া যাক। আরোহী সিদ্ধান্ত হলো, কোনও বস্তু যদি গ্রহ হয় তবে তার গতিপথ উপবৃত্তাকার হবে। বিশেষ পরিস্থিতি হলো, নেপচুন একটি গ্রহ। Modus ponens অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হবে, নেপচুনের কক্ষপথ উপবৃত্তাকার।

এবার ধরা যাক বলা হলো, যদি A হয় তবে B হবে। তারপর দেখা গেল বিশেষ পরিস্থিতিতে B সত্য। তাহলে বলা যায় কি যে A সত্য? না, যায় না, কারণ অন্য কোনও কারণেও B ঘটতে পারে। এটা ভুল যুক্তির একটা উদাহরণ, যেরকম ভুল অনেকেই করে থাকেন। যদি কোনও তামার টুকরোর রঙ সবুজ হয়ে গিয়ে থাকে তবে কিন্তু বলা যায় না সেটাকে ভিনিগারেই ডোবানো হয়েছিল।

কিন্তু যদি বলা হয়, বিশেষ পরিস্থিতিতে B ঘটেনি। তাহলে কিন্তু বলা যায় Aও ঘটেনি, কারণ A ঘটলে B অবশ্যই ঘটতো। এটা সঠিক যুক্তি, যার ধাপগুলো হলো:

যদি A হয় তবে B হবে,

B সত্য নয়,

অতএব A সত্য নয়।

একে বলে modus tollens । যদি তামার টুকরোর রঙ সবুজ না হয়ে থাকে, তবে যুক্তিসঙ্গতভাবেই বলা যায় সেটি ভিনিগারে ডোবেনি।

একটা বিশেষ রকম অবরোহী যুক্তিপদ্ধতিকে বলে syllogism, যা মূলত অ্যারিস্টটলের অবদান। তিনি দেখালেন, যদি সঠিকভাবে যুক্তি করতে হয় তাহলে সাধারণ সিদ্ধান্ত (major premise) এবং বিশেষ পরিস্থিতি (minor premise) দুটোই এমনভাবে প্রকাশ করতে হবে যাতে উদ্দেশ্য (যার সম্বন্ধে বলা হচ্ছে) এবং বিধেয় (যা বলা হচ্ছে) পরিষ্কার থাকে। উদ্দেশ্য আসবে আগে, বিধেয় পরে। যেমন,

সাধারণ সিদ্ধান্ত: সমস্ত বাঘই স্তন্যপায়ী (উদ্দেশ্য: বাঘ, বিধেয়: স্তন্যপায়ী)

বিশেষ পরিস্থিতি: খৈরি একটি বাঘ (উদ্দেশ্য: খৈরি, বিধেয়: বাঘ)

সিদ্ধান্ত: খৈরি একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী

লক্ষ্য করুন, সিদ্ধান্ত গঠনে বিশেষ পরিস্থিতির উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে সাধারণ সিদ্ধান্তের বিধেয়। সাধারণ সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য আর বিশেষ পরিস্থিতির বিধেয় বাদ পড়ে যাচ্ছে। এই নিয়মটা জানা থাকলে সহজেই যুক্তি করা যায়।

প্রথম বাক্যে যে 'সমস্ত' কথাটা ব্যবহার হয়েছে, সেরকম চার ধরনের বাক্যাংশ সাধারণ সিদ্ধান্ত ও বিশেষ পরিস্থিতিতে থাকতে পারে। বাকিগুলি হল 'একটাও না' (কুমির স্তন্যপায়ী নয়), ‘কোনও কোনওটা' (কোনও কোনও স্তন্যপায়ী মাংসাশী) আর 'কোনও কোনওটা নয়' (কোনও কোনও পাখি পোকা খায় না)। এইরকম বাক্যগুলিকে বীজগণিতের মতো ভাষাতেও প্রকাশ করা যায়:

All a are b

Some a are b

No a is b

Some a are not b.

এইভাবে সাধারণ সিদ্ধান্ত আর বিশেষ পরিস্থিতিকে প্রকাশ করলে যে সব সিদ্ধান্ত টানা সম্ভব তার মধ্যে কোনগুলি যুক্তিসঙ্গত, কোনগুলি নয় তা অ্যারিস্টটল দেখালেন। যেমন, ‘সব বাঘই স্তন্যপায়ী' (all a are b) তা জানা থাকলে সিদ্ধান্ত করা সম্ভব 'কোনও কোনও স্তন্যপায়ী বাঘ' (Some b are a)। কোনগুলি যুক্তিসম্মত জানা থাকলে যে কোনও পরিস্থিতিতে সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত করা যায়। যেসব সিদ্ধান্ত সম্ভব তার মধ্যে কোনগুলি যুক্তিসম্মত তা বর্তমানে মনে রাখার দরকার পড়ে না। Venn diagram থেকে বার করা যায়।

স্থানাভাবে এই যুক্তিধারার আর বিশদ ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না। পাঠক যুক্তিশাস্ত্রের যে কোনও বইতেই পেয়ে যাবেন।

বিজ্ঞানে আরোহী-অবরোহী যুক্তির প্রয়োগ

আরোহী আর অবরোহী যুক্তি একে অন্যের পরিপূরক। দুটির সাহায্যেই মানুষ চিন্তা করে। তা দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট সিদ্ধান্তই হোক, বা বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্বই হোক। অঙ্কে যাকে আমরা theorem বা উপপাদ্য বলি সেগুলো সাধারণ সত্য। যখন বলি ত্রিভূজের তিনটি কোণের সমষ্টি 180 ডিগ্রি, তখন তা কাগজের উপর আঁকা যে কোনও ত্রিভূজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, সাধারণ সত্য। আর্কিমিডিস যখন বললেন কোনও বস্তু যে পরিমাণ জল অপসারণ করে তার ওজন সেই অপসারিত জলের ওজনের পরিমাণেই হ্রাস পায়, তখন তিনি বাথটাবে তাঁর স্নানের বিশেষ অবস্থা সম্বন্ধেই বলছিলেন না। একটা সাধারণ সত্যের সম্বন্ধেই বলছিলেন। আজও প্রত্যেকটি বিশেষ জাহাজ তৈরি করতে তাঁর সাধারণ সূত্রটি প্রয়োগ না করে চলে না। নিউটন যখন তাঁর মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব প্রস্তাবনা করেন তখন তা চাঁদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সূর্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য—এভাবে বলেননি। আরোহী যুক্তি প্রয়োগ করে সমস্ত বস্তুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সাধারণ সূত্র হিসেবেই রেখেছিলেন। পরবর্তী বিজ্ঞানীরা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ করেছেন—কেউ ইউরেনাস গ্রহকে খুঁজে বার করতে, কেউ ঘড়ি তৈরি করতে, কেউ রকেট উৎক্ষেপণ পরিকল্পনা করতে—অবরোহী যুক্তিধারা প্রয়োগ করে।

এমনকি দূর নক্ষত্রে কী প্রক্রিয়া চলে তা বুঝতে বিজ্ঞানীরা এইভাবেই যুক্তি করেন। পৃথিবীতে পাওয়া হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, কার্বন ইত্যাদি মৌলের যে চরিত্র (বিশেষ করে তাদের আলো শোষণ করার ধর্ম) তা জেনে তাঁরা আরোহী যুক্তি করেন, এইসব মৌলের চরিত্র সর্বত্রই একই। ব্রহ্মাণ্ডের যে কোনও প্রান্তে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম বা কার্বন থাকলে তাদের ধর্ম একই হবে। তারপর কোনও তারার আলো বিশ্লেষণ করে যদি অনুরূপ শোষণরেখা পান, তবে তার থেকে সিদ্ধান্ত করেন সেই নক্ষত্রে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, কার্বন আছে। তাদের অনুপাতও বার করেন। এক্ষেত্রে প্রয়োগ হচ্ছে অবরোহী যুক্তির।

সম্ভাবনা-ভিত্তিক আরোহী-অবরোহী যুক্তি

বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আরোহী যুক্তি প্রয়োগে কিছু কিছু সমস্যা ধরা পড়ল। যেমন, আকাশে কালো মেঘ করলে কি নিশ্চিতভবে বলা যায় যে বৃষ্টি হবে? যায় না। বলা যায় যে বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা আছে। অর্থাৎ আরোহী যুক্তির সঠিক প্রয়োগ সম্ভাবনা বা প্রোবাবিলিটির মাধ্যমেই করা সম্ভব। যদি A ঘটনার দুই রকম পরিণতি হতে পারে B আর C, এবং দেখা যায় 100 বার A ঘটলে তার ফলস্বরূপ B ঘটে 80 বার আর C ঘটে 20 বার, তবে A → B ঘটনা পরম্পরার সম্ভাবনা 80/100=0.8 আর A → C ঘটনা পরম্পরার সম্ভাবনা 20/100=0.2 । এর পর একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে A ঘটলে আমরা যুক্তিসম্মতভাবেই অনুমান করতে পারি এর পর B ঘটতে পারে, কারণ তা ঘটারই সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়, কারণ C ঘটারও সম্ভাবনা 0.2 । তার মানে কি অনুমানটা অসঙ্গত? না, তা-ও নয়। সম্ভাবনার ভিত্তিতে এরকম সঙ্গত অনুমান না করতে পারলে জীবনে এক পা এগোনোও সম্ভব নয়।

লক্ষ্য করুন, কোনটি ঘটার সম্ভাবনা বেশি, প্রোবাবিলিটি কতটা, সেই সিদ্ধান্ত কিন্তু নেওয়া হয়েছিল বহু ঘটনায় পাওয়া তথ্যের সাধারণীকরণের মাধ্যমেই। অর্থাৎ আরোহী যুক্তি প্রয়োগ করে। একে বলে সম্ভাবনাভিত্তিক আরোহী যুক্তি (probabilistic inductive logic)।

কখনও কখনও আরোহী যুক্তিলব্ধ তথ্য সংখ্যায় প্রকাশ করতে হয়। যেমন, মানুষের গড় উচ্চতা কতো, বা চড়াইপাখির ডিমের গড় ওজন কতো—এরকম প্রশ্নে বিজ্ঞানীরা কিছু মানুষের বা চড়াই-ডিমের তথ্য সংগ্রহ করেন। পরিসংখ্যানের ভাষায় একে বলে sample। তার থেকে তাঁরা সব মানুষ বা সব চড়াই-ডিম, অর্থাৎ একটা population সম্বন্ধে সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করেন। এর বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি আছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাঁরা যেটা বলেন, তা হলো 95% মানুষের উচ্চতা দুটি সংখ্যা L1 আর L2 এর মধ্যে, অর্থাৎ কোনো একজন মানুষের উচ্চতা L1 আর L2 এর মধ্যে থাকার সম্ভাবনা 95%। এটাও তথ্যের ভিত্তিতে পাওয়া আরোহী সিদ্ধান্ত।

যখন তার ভিত্তিতে বিশেষ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছি, তা করছি অবরোহী যুক্তি বেয়ে, সেটাও প্রোবাবিলিটিকে ব্যবহার করে। কোনো বিশেষ ঘটনার রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে তার কারণ যখন আমরা অনুসন্ধান করি, এই যুক্তিধারা মেনেই করি। অতীতে হয়তো দেখা গেছে y ঘটনাটি যখন ঘটেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার আগে x ঘটেছে; y ঘটনাটির কারণ হিসেবে x কাজ করেছে। এরপর বিশেষ পরিস্থিতিতে y ঘটনাটি ঘটতে দেখলে আমরা যুক্তিসঙ্গতভাবেই অনুমান করি তার কারণ হিসেবে x কাজ করেছে - অবরোহী যুক্তিধারা অনুযায়ী।

কিন্তু এর জন্য অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আরোহী যুক্তির মাধ্যমে সাধারণ সিদ্ধান্তটা থাকা প্রয়োজন। তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিলে তখন আমরা বলি x ঘটে থাকতে পারে, অর্থাৎ x ঘটে থাকারই সম্ভাবনা বেশি। এটাই বিজ্ঞানসম্মত অনুমানের রীতি। এটা ব্যক্তিনির্ভর (subjective) অনুমান না হয়ে ব্যক্তি-নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত হয় তখনই, যখন তা মানবসমাজের অতীত অভিজ্ঞতালব্ধ আরোহী সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নেওয়া হয়। আর এই সিদ্ধান্তটা হয় সম্ভাবনার ভিত্তিতে নেওয়া probabilistic সিদ্ধান্ত।

বিজ্ঞানের কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনাটা 1 হতে পারে। যেমন, কোনও সমতল কাগজে একটা ত্রিভূজ আঁকলে তার তিনটি কোণের সমষ্টি 180 ডিগ্রি হওয়ার সম্ভাবনা 1 । অর্থাৎ তা নিশ্চিৎ (ইংরেজিতে বলে necessary)। গাণিতিক উপপাদ্যের এটাই চরিত্র। আবার লুডো খেলতে বসে ছক্কা পড়বে কি পড়বে না তা কখনওই নিশ্চিৎভাবে বলা যায় না। শুধু বলা যায় ছক্কা পড়ার সম্ভাবনা 1/6 । বাস্তব জীবনের বেশিরভাগ ঘটনার এটাই চরিত্র। সূক্ষ্মকণাদের জগতের সব সিদ্ধান্তই probabilistic সিদ্ধান্ত।

বিজ্ঞানের পদ্ধতিতে আরোহী এবং অবরোহী যুক্তির ভূমিকা

রেনেসাঁসের যুগে, যখন বহুদিন থেকে চলে আসা বিশ্বাসগুলির উপর ভরসা না রেখে বিজ্ঞানকে নতুনভাবে গড়ে তোলার প্রশ্ন এসেছিল, তখন ইংল্যান্ডের দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন একটা দিকনির্দেশ রেখেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, এখন প্রয়োজন প্রকৃতি জগতের বিভিন্ন দিক নিয়ে ব্যাপকভাবে প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ করে তথ্য সংগ্রহ করা, আর আরোহী পদ্ধতিতে সেই তথ্য থেকে সাধারণ সূত্রে পৌঁছোবার চেষ্টা করা। যেমন, বহু স্তন্যপায়ী প্রাণী পর্যবেক্ষণ করে স্তন্যপায়ী জীবগোষ্ঠীর সাধারণ চরিত্র নির্ধারণ করতে হবে; বহু পাখি, মাছ ও সরীসৃপ পর্যবেক্ষণ করে সেই সব জীবগোষ্ঠী সম্পর্কে সাধারণ সিদ্ধান্তে আসতে হবে। বাস্তবে জীববিদ্যার যাত্রা শুরু হয়েছিল এই দিক-নির্দেশ মেনেই। শুধু জীববিদ্যা নয়, কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় পদার্থের সাধারণ ধর্ম, অ্যাসিড, অ্যালকালি, ধাতু, অধাতু ইত্যাদির সাধারণ ধর্ম বার করা এবং পদার্থের শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছিল এই আরোহী যুক্তি প্রয়োগ করেই।

সমসাময়িক কালেই আর একজন দার্শনিক রেনে দেকার্তে বললেন, বিজ্ঞানকে এগোতে হলে যা নিশ্চিৎভাবে জানা আছে, যা সন্দেহাতীতভাবে সত্য, সেখান থেকে শুরু করে অবরোহী যুক্তিধারা ব্যবহার করে অন্যান্য সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে হবে। আর অবরোহী যুক্তিধারার সর্বোত্তম প্রয়োগ হয় গণিতে, তাই বিজ্ঞানকে গণিতের হাত ধরে এগোতে হবে। পদার্থবিদ্যা অনেকটাই তাঁর দিক-নির্দেশ অনুযায়ী এগিয়েছিল, যার সবচেয়ে সুন্দর প্রকাশ দেখতে পাই নিউটনের গবেষণায়।

ফলে রেনেসাঁস পরবর্তী কালে পদার্থবিদ্যা এগিয়েছিল দেকার্তের দেখানো পথে, অবরোহী যুক্তিধারাকে পাথেয় করে। আর জীববিদ্যা, রসায়ন, ভূবিদ্যা ইত্যাদি এগিয়েছিল বেকনের প্রস্তাবিত রাস্তায়, আরোহী যুক্তিকে ব্যবহার করে। এই পর্যায়ে ধীরে ধীরে পদার্থবিদ্যার কয়েকটি ক্ষেত্র বাদে বিজ্ঞানের সর্বত্র আরোহী পদ্ধতিই প্রধান হয়ে ওঠে। একসময় বিজ্ঞান বলতে এই আরোহী যুক্তি প্রয়োগকেই বোঝাতো, যার ফলে বিজ্ঞানকে বলা হতো inductive sciences। অনেকে ভাবলেন, পর্যবেক্ষণ থেকে আরোহী পদ্ধতিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছোনোই বিজ্ঞানের সামনে একমাত্র নির্ভুল পথ।

আরোহী যুক্তির সমস্যা

আরোহী যুক্তিধারার কয়েকটি সমস্যা অনেকদিন থেকেই বিজ্ঞান-দার্শনিকদের ভাবাচ্ছিল। বিশেষ করে যখন "বিজ্ঞান কীভাবে জানবে কোন সিদ্ধান্তটা সত্য আর কোনটা অসত্য" — এই সমস্যাটা নিয়ে দার্শনিকরা ভাবনাচিন্তা আরম্ভ করেন।

বিজ্ঞান যত এগোলো, একপেশে আরোহী যুক্তিপ্রয়োগের সমস্যাগুলি সামনে আসতে লাগলো। দেখা গেল, আরোহী যুক্তিকে ভিত্তি করে জীবজগৎ ও পদার্থের নানা শ্রেণীবিভাগে এক একটা শ্রেণীর সাধারণ বৈশিষ্ট্য যা জানা গিয়েছিল, অনেক ক্ষেত্রেই তার ব্যতিক্রম পাওয়া যাচ্ছে। মৌল পদার্থগুলিকে ধাতু ও অধাতু—এই দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছিল। এমন কিছু মৌল পাওয়া গেল যাতে ধাতু এবং অধাতু উভয়ের গুণই বর্তমান। সরীসৃপের সাধারণ বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত হয়েছিল যে তারা ডিম পাড়ে। দেখা গেল কিছু সাপ আছে যারা সরাসরি বাচ্চা পাড়ে।

এই দিকটির প্রতি বিজ্ঞানী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন বিশিষ্ট দার্শনিক ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস। Dialectics of Nature বইটিতে তিনি লিখলেন, “আরোহী যুক্তি আমাদের শিখিয়েছে যে, সমস্ত মেরুদণ্ডী প্রাণীর একটি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র থাকে যা মস্তিষ্ক ও সুষুম্নাকাণ্ড এই দুই ভাগে পৃথকীকৃত, এবং সুষুম্নাকাণ্ডটি মেরুদণ্ডের হাড়যুক্ত কশেরুকার (vertebra) মধ্যে অবস্থিত - যা থেকে ভার্টিব্রেট বা মেরুদণ্ডী নামটি এসেছে। তারপর অ্যামফিওক্সাস নামে একটি মেরুদণ্ডী প্রাণী পাওয়া গেল যার স্নায়ুতন্ত্র অপৃথকীকৃত এবং যার কশেরুকা নেই। আরোহী যুক্তি থেকে জানা গিয়েছিল যে মাছ হচ্ছে এমন প্রাণী যারা সারাজীবন শুধু ফুলকার সাহায্যে শ্বাসগ্রহণ করে। তারপর এমন সব প্রাণী পাওয়া গেল তারা যে মাছ তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু তাদের ফুলকা ছাড়াও পরিণত ফুসফুস রয়েছে।" এর মাধ্যমে তিনি আরোহী যুক্তি প্রয়োগে যে সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন তা দেখালেন এবং শুধুমাত্র আরোহী যুক্তিতে তত্ত্বনির্মাণের সমস্যাগুলিকে সামনে এনে অবরোহী যুক্তি প্রয়োগের প্রয়োজনটিও চিহ্নিত করলেন।

যতদূর জানা আছে, তিনিই প্রথম যুক্তি করেছিলেন যে জীবজগতের শ্রেণীবিভাগ লিনিয়াসের মতো আরোহী যুক্তিতে না করে ডারউইনের বিবর্তনবাদের ভিত্তিতে অবরোহী যুক্তিতে করা উচিৎ। অর্থাৎ বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি না করে কোন জীব থেকে বিবর্তিত হয়ে কোন জীব এসেছে—তার ভিত্তিতেই করা উচিৎ। আজ সেইভাবেই জীবজগতের শ্রেণীবিভাগ করা হয়ে থাকে। এইভাবে তিনি বিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞান-দার্শনিকদের মধ্যে একটা অতি-আরোহবাদী ঝোঁকের সমস্যাটা দেখিয়ে বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা ব্যালান্স আনার চেষ্টা করেছিলেন।

কিন্তু পরবর্তীকালে বিশ-শতকে এসে দেখা গেল উল্টো ঝোঁক। একদল বিজ্ঞান-দার্শনিক প্রশ্ন তুললেন, আরোহী যুক্তির মাধ্যমে কখনওই নির্ভরযোগ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব কি? ধরা যাক, বাঘ-ভাল্লুক-হাতি-ঘোড়া প্রভৃতি এক হাজার স্তন্যপায়ী প্রাণী পর্যবেক্ষণ করে আমরা সিদ্ধান্তে এলাম যে স্তন্যপায়ীদের লোম থাকে। এটা কি নির্ভরযোগ্য সিদ্ধান্ত হবে? আরও অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণী পর্যবেক্ষণ করতে করতে একটা পাওয়া যেতেই পারে যার লোম নেই। নিশ্চিৎ সিদ্ধান্তে আসতে সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীকে নিঃশেষে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, আর তা করা হয়ে গেলে আরোহী যুক্তির আর প্রয়োজন থাকে না। তাঁরা বললেন, বিজ্ঞানকে এগোতে হবে নিশ্চিৎভাবে সঠিক বলে জানা জ্ঞানের ভিত্তিতেই, আর যেহেতু আরোহী যুক্তিতে পাওয়া সিদ্ধান্ত কখনওই নির্ভরযোগ্য নয়, তাই বিজ্ঞানকে এগোতে হবে আরোহী পদ্ধতিকে পরিহার করে।

কার্ল পপারের বক্তব্য

এরকম আরোহ-বিরোধী যুক্তিধারার উদাহরণ হিসেবে বিখ্যাত অস্ট্রিয়ান দার্শনিক কার্ল পপারের বক্তব্যটা ধরা যাক। বিজ্ঞানসম্মতভাবে কোনও তত্ত্ব-প্রস্তাবনা করতে হলে কী পূর্বশর্ত মেনে তা করতে হবে সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। বিজ্ঞানে যে কোনও প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা নানারকম প্রকল্প বা hypothesis প্রস্তাবনা করেন, এবং তারপর পরীক্ষানিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ভুল প্রকল্পগুলিকে বর্জন করার পথে বিজ্ঞান সঠিক উত্তরের দিকে এগোয়। পপার বললেন, এই প্রকল্প প্রস্তাবনার পূর্বশর্ত হচ্ছে প্রকল্পটি পরীক্ষানিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যাচাই করা সম্ভব হতে হবে। অর্থাৎ, ‘সৌরজগৎ কীভাবে সৃষ্টি হলো' — এই প্রশ্নের উত্তরে hypothesis হিসেবে কেউ যদি প্রস্তাবনা করেন ভগবান সৃষ্টি করেছেন, তাহলে সেই প্রকল্প ঠিক কি না তা পরীক্ষানিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যাচাই করা সম্ভব নয়। তাই বিজ্ঞানীসমাজ তাকে গুরুত্বই দেবেন না।

শুধু তাই নয়, পপার বললেন পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে কখনওই কোনও তত্ত্ব নিঃসন্দেহে সঠিক বলে প্রমাণ করা যায় না। নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব চাঁদ, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি ইত্যাদি গ্রহ-উপগ্রহের গতি সফলভাবেই ব্যাখ্যা করেছিল। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণে যে কোনও বস্তুর গতির ওপর পরীক্ষাতেও নিউটনের তত্ত্ব সফলভাবেই পাস করেছিল। কিন্তু বুধগ্রহের গতির ক্ষেত্রে দেখা গেল নিউটনের তত্ত্ব অনুযায়ী যা হওয়া উচিৎ তার সঙ্গে প্রকৃত গতির সামান্য হলেও একটু ফারাক আছে। বোঝা গেল নিউটনের তত্ত্ব তীব্র মাধ্যাকর্ষণের ক্ষেত্রে কার্যকরী থাকে না। অন্য তত্ত্ব দরকার। আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে দেখালেন সেরকম পরিস্থিতিতে গতির নিয়মকানুন কী হবে।

এই উদাহরণ থেকে পপার বললেন, কোনও একটি তত্ত্ব হাজার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও বলা যায় না তা পুরোপুরি সঠিক। ভবিষ্যতের কোনও পরীক্ষায় তা কোনও বিশেষ ক্ষেত্রে অকার্যকরী বলে প্রমাণ হতে পারে। তাই তত্ত্ব-পরীক্ষার সময় বিজ্ঞানকে এগোতে হবে উল্টো পথ ধরে। পরীক্ষানিরীক্ষা কোনও তত্ত্বকে ঠিক বলে প্রমাণ করতে না পারুক, ভুল বলে প্রমাণ তো করতে পারে! তাই, তত্ত্ব বা প্রকল্প প্রস্তাবনার সময়ই বিজ্ঞানীকে বলতে হবে কোন পরীক্ষায় কী ফল হলে তাঁর তত্ত্ব নিশ্চিৎভাবে ভুল। সেই পরীক্ষা করে যদি বিজ্ঞানীরা সেই ফল না পান তবে তত্ত্বটি পরীক্ষায় পাস করবে। কিন্তু কোনও তত্ত্বকে তখনই বিজ্ঞানীরা গুরুত্ব দেবেন এবং পরীক্ষানিরীক্ষা করতে এগোবেন যদি সেই তত্ত্বটি অন্তত in principle ভুল প্রমাণ করা সম্ভব হয়, এবং কোন পরীক্ষায় কী ফল হলে তা ভুল প্রমাণ হবে তা পরিষ্কারভাবে জানা থাকে।

এই বক্তব্যটিকে বলা হয় পপারের falsifiability criterion । এটি বর্তমানে বিজ্ঞানজগতে স্বীকৃত। কোনও প্রকল্প প্রস্তাবনার সময় তার falsifiability criterion পরিষ্কারভাবে না বললে গবেষণা পত্রিকার সম্পাদক পেপার ছাপতেই রাজি হন না।

এতদূর পর্যন্ত ঠিক আছে। বিজ্ঞানসম্মত কথা। কিন্তু এরপরই একধাপ এগিয়ে পপার বললেন, আরোহী যুক্তিতে পৌছোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে falsifiability criterion অতিসরলীকৃত হয়ে যায়। "স্তন্যপায়ী প্রাণীর লোম থাকে" এই সিদ্ধান্তের falsifiability criterion হিসেবে বলতে হবে কোনওদিন যদি এমন স্তন্যপায়ী প্রাণী পাওয়া যায় যার লোম নেই, তবে এই সিদ্ধান্তটি ভুল। অর্থাৎ তত্ত্বটি পরীক্ষা করতে বিজ্ঞানীদের exhaustive search করতে হবে, যার পরে আরোহী যুক্তির আর কোনও অর্থ থাকে না। এই যুক্তির ভিত্তিতে তিনি বললেন, আধুনিক বিজ্ঞান গড়ে তুলতে হলে আরোহী যুক্তি বাদ দিয়েই এগোতে হবে।

বিজ্ঞানে আরোহী যুক্তির প্রয়োজনীয়তা

কিন্তু 1934 সালে পপারের মূল বই The Logic of Scientific Discovery বেরোনোর পর থেকে আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানজগৎ তাঁর falsifiability সম্পর্কিত বক্তব্যটি গ্রহণ করলেও inductive logic এর বিরুদ্ধে তাঁর বক্তব্য উপেক্ষা করেই বিজ্ঞান এগিয়েছে। কারণ দার্শনিকরা যাই বলুন, বাস্তবে যারা বিজ্ঞান-গবেষণা করেন, বহুক্ষেত্রেই আরোহী যুক্তি বাদ দিয়ে তাঁদের এগোবার কোনও রাস্তা নেই।

দুটি উদাহরণ দিই।

যেসব জীববিজ্ঞানী জঙ্গলে ঘুরে জীবজন্তু পর্যবেক্ষণ করেন (field biologists), তাঁরা লক্ষ্য করেছিলেন, প্রকৃতিতে একই পরিবেশে বহু প্রাণী বসবাস করে—যেমন আফ্রিকার তৃণভূমিতে জেব্রা, ওয়াইল্ডে-বীস্ট, টমসনস্ গেজেল ইত্যাদি অনেক তৃণভোজী জন্তুর বাস। কিন্তু যখন তাঁরা জন্তুগুলির খাদ্যাভ্যাস, শিকার-শিকারী সম্পর্ক, জীবনধারণের নানা ক্রিয়া পরীক্ষা করলেন, তখন দেখলেন এসব দিক থেকে প্রজাতিগুলির মধ্যে কিছু না কিছু পার্থক্য আছে। একই এলাকায় বহু জীব থাকলেও প্রত্যেকটি প্রজাতি একটিই জীবনধারণের ক্ষেত্র বা নিশ (niche, যথাযোগ্য স্থান) দখল করে থাকে, অর্থাৎ এক একটি নিশ-এ একটিই প্রজাতি থাকতে পারে। আরোহী যুক্তির মাধ্যমে তাঁরা তখন সিদ্ধান্তে এলেন, পৃথিবীর সব প্রজাতিই এক এবং অনন্য নিশ দখল করে থাকে।

এই আরোহী সিদ্ধান্তটি পরবর্তীকালে ভীষণ কাজে এসেছিল। যখন বিজ্ঞানীরা এমন কোনও পরিস্থিতি দেখেন যেখানে একই পরিবেশে একাধিক প্রজাতি সহাবস্থান করছে, তাঁরা তখন বোঝার চেষ্টা করেন এদের নিশ-এর পার্থক্য কোথায়। সর্বক্ষেত্রেই তা তাঁরা পেয়েছেন, অর্থাৎ ওই আরোহী সিদ্ধান্তটা তাঁদের গবেষণায় পথ দেখিয়েছে।

দ্বিতীয় উদাহরণটা জ্যোতির্বিজ্ঞানের। গ্রহতারাদের দূরত্ব আমরা কীভাবে মাপি? চাঁদ ও গ্রহগুলোর দূরত্ব মাপা হয় লম্বন (parallax) পদ্ধতিতে, পৃথিবীর উপর দুটি পৃথক অবস্থান থেকে পিছনের তারাদের সাপেক্ষে জ্যোতিষ্কটির অবস্থানের ছবি তুলে দুটি দৃষ্টিপথের মধ্যে কোণটি পরিমাপ করে। কিন্তু তারাদের দূরত্ব এই পদ্ধতিতে পরিমাপ করতে গেলে কোণটি খুবই ছোট হয়ে যায়। তাই তখন তারাটির ছবি তোলা হয় ছয় মাসের ব্যবধানে। তার মধ্যে পৃথিবী তার কক্ষপথের অর্ধেকটা প্রদক্ষিণ করে ফেলেছে, অর্থাৎ দুটি অবস্থানের মধ্যে তফাৎ পৃথিবী-কক্ষের ব্যাসের সমান। এই পদ্ধতিতে অপেক্ষাকৃত নিকটবর্তী তারাদের দূরত্ব মাপা হয়েছিল। কিন্তু দূরবর্তী তারাদের দূরত্ব এভাবেও মাপা যায় না, লম্বন কোণটি পরিমাপের অযোগ্য অতি ক্ষুদ্র হয়ে যায়। জ্যোতির্বিজ্ঞান বেশ কিছুদিনের জন্য আটকে গিয়েছিল এই জায়গায়।

জটটা খুললো সম্পূর্ণ অন্য দিক থেকে। আকাশে কিছু তারা আছে, যাদের ঔজ্জ্বল্য নিয়মিতভাবে বাড়ে-কমে। এদের বলে সেফিড ভেরিয়েবল তারা। 1908 সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিদ হেনরিয়েটা লেভিট এমন কিছু সেফিড তারা নিয়ে গবেষণা করছিলেন, যারা মোটামুটি কাছাকাছি আছে, অর্থাৎ তাদের দূরত্ব লম্বন পদ্ধতিতে মাপা গেছে। কোনও তারার দূরত্ব আর আপাত-ঔজ্জ্বল্য জানা থাকলে তার পরম-ঔজ্জ্বল্য অর্থাৎ সে কতটা আলো বিকিরণ করছে তা জানা যায়। তিনি লক্ষ্য করলেন যে এইসব তারার ঔজ্জ্বল্য বাড়া-কমার সময়কাল এবং পরম-ঔজ্জ্বল্যের একটা সমানুপাতিক সম্পর্ক আছে।

বিজ্ঞানীরা বললেন, ইউরেকা। দূরত্ব মাপার আরেকটা উপায় পেয়ে গেছি। যে কোনও সেফিড তারার পর্যায়কাল সহজেই মাপা যায়, যতো দূরেই সে থাকুক। আর সমানুপাতিক সম্পর্ক ধরে নিলে তার পরম-ঔজ্জ্বল্যও বার করা যাবে। এবার টেলিস্কোপে দেখে তার আপাত-ঔজ্জ্বল্য মেপে ফেললেই হল—তার থেকে দূরত্ব বেরিয়ে আসবে। সেই সেফিড তারাটি কোনো তারাসমষ্টির বা গ্যালাক্সির অন্তর্ভূক্ত হলে তার দূরত্বও মাপা যাবে।

তখন থেকে এইভাবেই ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় জ্যোতিষ্কের দূরত্ব মাপা হয়ে আসছে। মহাবিশ্ব সম্বন্ধে আমাদের যাবতীয় ধারণা দাঁড়িয়ে আছে এর ভিত্তিতেই।

এবার লক্ষ্য করুন যুক্তিধারাটা। হেনরিয়েটা লেভিট কয়েকটি বিশেষ সেফিড ভেরিয়েবল তারার তথ্য ব্যবহার করে তাদের পর্যায়কাল আর পরম-ঔজ্জ্বল্যের সম্পর্ক বার করলেন। তারপর বিজ্ঞানীরা আরোহী যুক্তি ব্যবহার করে সিদ্ধান্তে এলেন ওই সম্পর্ক দুনিয়ার সমস্ত সেফিড তারার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যখন এডুইন হাবল্ অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিতে একটি সেফিড ভেরিয়েবল তারা চিহ্নিত করতে পারলেন, তখন তিনি অবরোহী যুক্তিতে ওই সিদ্ধান্তটিকে ওই বিশেষ তারাটির ওপর প্রয়োগ করলেন। তার সাহায্যেই তিনি তারাটির এবং পুরো অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির দূরত্ব মাপতে পারলেন। বোঝাই যাচ্ছে, আরোহী এবং অবরোহী দুটি যুক্তিধারা প্রয়োগ না করে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান এক পাও এগোতে পারতো না।

তাহলে, বাস্তবটা এই—পূর্বে উল্লিখিত দার্শনিকরা যাই বলুন, বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য আরোহী এবং অবরোহী দুটি যুক্তিধারাই প্রয়োজন। কিন্তু এরকম তো হতে পারে না যে দর্শন এক কথা বলছে, আর বিজ্ঞান আরেক কথা। বিজ্ঞান যে পথে চলছে তার দার্শনিক ভিত্তি থাকা প্রয়োজন। আবার দর্শনকেও বিজ্ঞানের কথা শুনে চলতে হয়। নয়তো মনগড়া চিন্তার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা।

সঠিক বিজ্ঞানসম্মত দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি

এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক নজর করা দরকার। কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে অবরোহী যুক্তি প্রয়োগ তখনই সম্ভব, যখন ব্যাপকতর ক্ষেত্রে একটা সাধারণ সিদ্ধান্ত হাতে থাকে। তার ভিত্তিতেই অবরোহী যুক্তি প্রয়োগ করা সম্ভব। সেই অর্থে এই দুই যুক্তিধারার মধ্যে আরোহী যুক্তিই প্রাথমিক বা prior ।

যেহেতু আরোহী যুক্তির সাহায্যে পৌঁছোনো সাধারণ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই বিশেষ পরিস্থিতিতে অবরোহী যুক্তির দ্বারা বিশেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো যায়, আরোহী যুক্তির প্রয়োগ ছাড়া অবরোহী যুক্তির প্রয়োগ সম্ভবই নয়। তাই মানুষের প্রথম চিন্তার স্ফুরণ আরোহী চিন্তার ভিত্তিতেই হয়েছিল। বহু বিশেষ ক্ষেত্রে আগুনের চরিত্র থেকে আগুনের সাধারণ ধর্ম সম্বন্ধে ধারণা না করতে পারলে আগুনের ব্যবহার আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। বহু বিশেষ বীজ মাটিতে পড়ে অঙ্কুরোদ্গম এবং তা থেকে গাছের সৃষ্টি দেখে আরোহী প্রক্রিয়ায় যুক্তি না করলে কৃষি আবিষ্কার সম্ভব নয়। এমনকি ভাষার ব্যবহারের মধ্যে যে বিমূর্তকরণ বা abstraction নিহিত থাকে, তাও আরোহী যুক্তিরই ফসল। 'ফল' শব্দটি তৈরিই হতো না যদি না আম, লিচু, কলা, আপেল প্রভৃতি বহু আলাদা আলাদা ফল থেকে ফলের সাধারণ বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে ধারণা জন্মাতো।

আধুনিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও আরোহী যুক্তির ভূমিকাই প্রাথমিক। আরোহী যুক্তির প্রয়োগ বিনা জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা সম্ভবই নয়, কারণ সেখানে বিজ্ঞানীকে ধরে নিতেই হয় পৃথিবীর বুকে পরীক্ষানিরীক্ষা করে বস্তুর যা ধর্ম আমরা জেনেছি, সুদূর নক্ষত্রে সেই নিয়মকানুনই খাটে। চিকিৎসা করতে ডাক্তারকে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, বসন্ত ইত্যাদি রোগের সাধারণ চরিত্র এবং সাধারণ প্রতিষেধক সম্বন্ধে ধারণা করতেই হয়। তার মানে কি প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ একই হয়? না, তাও নয়। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রের কিছু বিশেষত্ব থাকে। অর্থাৎ সাধারণ সিদ্ধান্ত সমস্ত বিশেষ ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। কিন্তু ম্যলেরিয়ার সাধারণ চরিত্র না জানলে এবং অতীত অভিজ্ঞতায় কোন ওষুধ প্রয়োগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ম্যালেরিয়া সেরেছে তা না জানলে ডাক্তার চিকিৎসাই করতে পারেন না। সেরকমই বিজ্ঞানীও তাঁর নিজের ক্ষেত্রে এক পাও ফেলতে পারেন না অতীতদিনের বিজ্ঞানীদের সম্মিলিত অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত আরোহী সিদ্ধান্তের সাহায্য ছাড়া।

আজকের যুগেও তাই আরোহী এবং অবরোহী এই দুটি যুক্তিধারা নিয়েই চলতে হয়। একে অন্যের পরিপূরক-সম্পূরক (complementary-supplementary) হিসেবে দেখতে হয়। কিন্তু আরোহী সিদ্ধান্ত ছাড়া অবরোহী যুক্তির প্রয়োগ যেহেতু সম্ভবই নয়, তাই আরোহীই আসে আগে। সেটাই প্রাথমিক।

মানুষ সবসময়েই পর্যবেক্ষণ করতে পারে বিশেষ বস্তু বা ঘটনাকে। বারবার পর্যবেক্ষণ করে সাধারণীকরণের মাধ্যমে তার থেকে সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে হয়। আবার সেই সাধারণ সিদ্ধান্তকে বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে বিশেষ ঘটনাকে বুঝতে হয়। প্রত্যেকটি বিশেষ প্রয়োগের মাধ্যমে সাধারণ সিদ্ধান্তটি সম্পর্কে জ্ঞান আরও সমৃদ্ধ হয়। শুধু, আরোহী যুক্তিতে পৌঁছোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপক সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ নিয়েই কাজ করতে হয় বিজ্ঞানীকে। যাচাই করে করে এগোতে হয়, আর কোথাও ব্যতিক্রম চোখে পড়লে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে কোনও দ্বিধা থাকলে চলে না। শেষ পর্যন্ত সত্যে পৌঁছোনোই তো লক্ষ্য।

লেখক পরিচিতি: অধ্যাপক ব্যানার্জী IISER-কলকাতার ডিরেক্টর ও পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির সর্ব-ভারতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক।

“বিজ্ঞানের যুক্তি, যুক্তির বিজ্ঞান” শীর্ষক এই প্রবন্ধটি ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি প্রকাশিত ‘প্রকৃতি’ পত্রিকার পঞ্চদশ বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, নভেম্বর 2021 থেকে নেওয়া।